রামায়ণ : লঙ্কাকাণ্ড – হনুমানের অন্নভোজন ও বিভীষণাদির স্বদেশ গমন
বিভীষণে কন রাম করিয়া আদর।
আজি হৈতে তুমি মম ভাই সহোদর।।
চারি ভাই ছিলাম হইলাম পঞ্চ জন।
পঞ্চ জন মিলি রাজ্য করিব পালন।।
দান ভিক্ষা দিয়া সবে কর পরিহার।
দানে শূন্য কৈল যত রামের ভাণ্ডার।।
সীতা ঠাকুরাণী গিয়া করিলা রন্ধন।
চারি ভাই এক ঠাঁই করিলা ভোজন।।
হনুমানে অন্ন দেন সীতা ঠাকুরাণী।
বানরের অন্ন দেন যতেক রমণী।।
অন্ন দিয়া যান সীতা আনিতে ব্যঞ্জন।
শুধু অন্ন খায় সব পবন-নন্দন।।
শূন্যপাত্রে ব্যঞ্জন কেমনে দিবে পাতে।
ব্যঞ্জন আনিতে অন্ন খেয়ে বসে থাকে।।
এইরূপে যাতায়াত তিন চারিবার।
দেখিয়া সীতার মনে লাগে চমৎকার।।
সীতা বলে আমি কিছু বুঝিতে না পারি।
বিশ্বের পালনে অন্নপূর্ণা নাম ধরি।।
দৃষ্টি সৃষ্টি পূর্ণ করি নানা উপচারে।
অন্ন দিতে হারিলাম বনের বানরে।।
বুঝিতে না পারি আমি এই কোন্ জন।
স্বর্ণথাল ফেলি কৈলা হস্ত প্রক্ষালন।।
ধ্যানযোগে মা জানকী দেখিলা সত্বর।
বানর-রূপেতে অবতীর্ণ গঙ্গাধর।।
কপিরূপে বসেছেন কৈলাসের পতি।
উদর পূরাতে পারে কাহার শকতি।।
ঊর্দ্ধমুখে অর্ঘ্য বিনে না পূরে উদর।
এতেক ভাবিয়া সীতা চলিলা সত্বর।।
গোপনেতে গিয়া মাতা হনুর পশ্চাতে।
নমঃ শিবায় বলি অন্ন দিলা মাথে।।
হাসিয়া সম্মুখে আসি কহেন বচন।
কত অন্ন হনুমান করিলে ভোজন।।
মস্তক ফুটিয়া অন্ন উপরে উঠিল।
হনুমান বলে মাতা পরিপূর্ণ হল।।
আচমন কৈল গিয়া পবন-কুমার।
সীতার চরণে হনু কৈল পরিহার।।
আমি কি জানিব মাতা তোমার মহিমা।
ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর দিতে নারে সীমা।।
তোমার মহিমা মাতা কি বলিতে জানি।
শ্রীবিষ্ণু-প্রকৃতি তুমি লক্ষ্মী ঠাকুরাণী।।
এতেক শুনিয়া সীতা হরষিত মন।
সবারে বিদায় রাম দিলেন তখন।।
রাক্ষস বানরে রাম দিলেন মেলানি।
গাহিয়ে রামের গুণ চলিল তখনি।।
পাতা লতা খেয়ে কপি পরিত কাছুটি।
শ্রীরামের প্রসাদে কোঁচার পরিপাটি।।
পাসরিব কেমনে রামের সব গুণ।
আর কবে দেখিব ও যুগল চরণ।।
এইরূপে সর্ব্বত্র করিয়া সুবিহিত।
চারি ভাই রাজ্য করে জগতে পূজিত।।
করেন অযুত বর্ষ লোকের পালন।
জ্যেষ্ঠ সত্ত্বে কনিষ্ঠের নাহিক মরণ।।
রামরাজ্যে কেহ কারে নাহি করে হিংসে।
যত যত রাজগণ শ্রীরামে প্রশংসে।।
রামরাজ্যে শোক নাহি জানে কোন জনা।
রামরাজ্য বলি লোকে হইল ঘোষণা।।
পাত্র মিত্র সহ রাম যুক্তি অনুমানি।
পুষ্পক-রথেরে তিনি দিলেন মেলানি।।
কুবেরের রথ তুমি জানে সর্ব্বজন।
কুবেরে জিনিয়া তোমা নিলেক রাবণ।।
তাহাকে মারিয়া তোমায় করিনু উদ্ধার।
কুবেরেরে জানাইও এই পরিহার।।
চলিল সে রথখান শ্রীরাম আদেশে।
চক্ষুর নিমিষে গেল পর্ব্বত কৈলাসে।।
কুবের বলেন রথ কে দিল বিদায়।
রাবণ লইল তোরে জিনিয়া আমায়।।
শুনি বলি রথ তোরে নিল লঙ্কেশ্বর।
করিল কুকর্ম্ম কত তোমার উপর।।
থাকিবেন রাম এগার হাজার বৎসর।
রামের সেবায় কর শুদ্ধ কলেবর।।
শ্রীরাম করিলে পরে বৈকুণ্ঠে গমন।
ফিরিয়া আমার কাছে আসিও তখন।।
রথখান চলিল যে কুবের আদেশে।
আইল রামের কাছে চক্ষুর নিমিষে।।
রথ বলে রঘুনাথ কর অবধান।
কিছুকাল চরণ নিকটে দেহ স্থান।।
রামের আজ্ঞায় রথ রহিল তথায়।
সর্ব্বক্ষণ শ্রীরামের দর্শন সে পায়।।
যে দুঃখ পাইয়াছিল রাম গেলে বনে।
প্রজালোক পাসরিলা সদা দরশনে।।
এইরূপে শ্রীরাম হইয়া আনন্দিত।
রাজত্ব করেন তিন ভ্রাতার সহিত।।
কৃত্তিবাস কবির কবিত্ব সুধাভাণ্ড।
এতদূরে সমাপ্ত হইল লঙ্কাকাণ্ড।।