রামায়ণ : লঙ্কাকাণ্ড – শুক সারণ কর্ত্তৃক শ্রীরামের সৈন্যাদি দর্শন ও বিভীষণাদি কর্ত্তৃক নিগ্রহ
বান্ধা গেল সাগর, কটক হৈল পার।
দিনে দিনে রাবণের টুটে অহঙ্কার।।
ফাঁফর হইল রাজা গণি মনে মনে।
দুই চর শুক আর সারণেরে তণে।।
শুন শুক সারণ তোমরা বুদ্ধিমান।
চর্চ্চা গিয়া রামের কটক সপ্রমাণ।।
পাথরেতে বান্ধা গেল সাগর গভীর।
ত্রিভুবনে হেন কর্ম্ম করে কোন্ বীর।।
ভালমতে জান বিভীষণের যে মতি।
একে একে জান সব যোদ্ধা সেনাপতি।।
বল বুদ্ধি জান সব রামের মন্ত্রণা।
প্রথমে জানিহ সব প্রধান যে জনা।।
রামের সহিত থাকে কোন্ মহাবীর।
লঙ্কায় আসিয়া কেবা রণে হবে স্থির।।
রাজার আদেশ চর বন্দিলেক মাথে।
রাজ-প্রদক্ষিণ করি যায় মনোরথে।।
কপিরূপে সান্ধাইল বানর ভিতর।
লেখা জোখা নাহি যত দেখিল বানর।।
কত পার হৈল কত হৈতে আছে পার।
লিখিবার শক্তি কার দেখিতে অপার।।
কটক চর্চ্চিয়া ভ্রমে চর দুই জন।
দূরে থাকি দেখে তাহা মিত্র বিভীষণ।।
রাক্ষসের মায়া সে রাক্ষস ভাল জানে।
বিভীষণ দুই চরে চিনে সেই ক্ষণে।।
ঘরের সেবক বলি না করিল আস্থা।
বানর হাতাইয়া কৈল পঞ্চম অবস্থা।।
আপনার প্রত্যয়িত্ব জানাবার তরে।
রথ হৈতে নামিয়া সে দুই চরে ধরে।।
বিভীষণে ঠেলি চর যায় পলাইয়া।
দূরে থাকি সুগ্রীব তা দেখিল চাহিয়া।।
শালগাছ উপাড়িয়া আনে আচম্বিতে।
মহাকোপে ধায় বীর রাক্ষসের ভিতে।।
এড়িলেক শালগাছ মেঘের সমান।
রাক্ষসের বাণে গাছ হৈল খান খান।।
আর গাছ আনে তার দেশ ক্রোশ গোড়া।
গাছের বাড়িতে রথ করিলেক গুঁড়া।।
পড়িল সারথি ঘোড়া নাহিক দোসর।
গদা হাতে দুই জন যুঝে ঘোরতর।।
বাণের উপরে করে বাণ বরিষণ।
গদার বাড়িতে কেহ ত্যজিল জীবন।।
গদার বাড়িতে সবে করে চূরমার।
সুগ্রীব বলেন গর্ব্ব করিস্ গদার।।
মার দেখি গদা, বুক পতে দিনু তোরে।
তোর ঘা সহিয়া তোরে দেই যমঘরে।।
দুই হাত তুলিয়া পাতিয়া দিনু বুক।
মার দেখি গদা সবে দেখুক কৌতুক।।
পাতিয়া দিলেন বুক সুগ্রীব ভূপতি।
গদা মারে শুক আর সারণ দুর্ম্মতি।।
বজ্র সম বুক তার বজ্রেতে নির্ম্মাণ।
তাহাতে লাগিয়া গদা হৈল খান খান।।
গদা মারি দুই জন হইল ফাঁফর।
দুই চর বান্ধি নিল রামের গোচর।।
বসিয়া আছেন রাম গুণের সাগর।
ডান দিকে মিত্র তাঁর সুগ্রীব বানর।।
বামদিকে উপবিষ্ট অনুজ লক্ষ্মণ।
যোড়হাতে বসিয়াছে যত মন্ত্রিগণ।।
হেনকালে দুই চর ধাইয়া আগুসরে।
প্রণাম করিল দোঁহে রাজ-ব্যবহারে।।
ভয়েতে ছাড়িল তারা জীবনের আশ।
কহিতে লাগিল কিছু গদগদ ভাষ।।
কটক চর্চ্চিত মোরে পাঠায় রাবণে।
কে জানে এমন দায় ঘটিবে এখানে।।
লুকাইয়া আসিয়া হইলাম বিদিত।
বুঝিয়া করহ প্রভু যে হয় উচিত।।
শুনিয়া চরের কথা শ্রীরামের হাস।
উভয়েরে দয়াময় করেন আশ্বাস।।
বিভীষণ ধরিলেক কাটিবার মনে।
বারণ করেন রাম তারে সেইক্ষণে।।
ক্ষান্ত হও, চর হত্যা নহে রাজধর্ম্ম।
সেবক মারিলে সিদ্ধ হবে কোন্ কর্ম্ম।।
গোপনে আইলে চর ভ্রম সব স্থানে।
দুই চারি কথা এই বলিহ রাবণে।।
হরিয়া আনিল সীতা মম অগোচরে।
সেই হেতু সেতুবন্ধ হইল সাগরে।।
শূন্য-ঘরে সীতা হরে আনিল আমার।
ভয়ে পলাইয়া এল সাগরের পার।।
সেই ত সাগর আমি হইলাম পার।
জিজ্ঞাস রাবণ রাজা কি বলিবে আর।।
শুনিয়াছ খর দূষণের যে প্রকার।
প্রভাতে হইবে সেই প্রকার তোমার।।
যে সে প্রকারে আজি পোহাউক রাতি।
এক জনা না রাখিব বংশে দিতে বাতি।।