রোদনভরা বসন্ত
” মুগ্ধ হয়ে গানের আবেগে
উঠল মনে প্রেম যে জেগে
মধুর অমৃত বাণী শুনে
প্রেমের নেশা জমলো নয়নে
মরমে উঠল সে ধ্বনি বেজে
বসন্ত কেন যে হৃদয় ভেঙেছে?
গোলাপদিনে কি হলো দশা
ব্যাকুল মন হারাল ভাষা
জাগল কেন যে মনে তৃষা?
হারাল হৃদয় স্বপন নেশা।”
একমাস ধরে মিঠু আর আমি খেয়াল করছি ছেলেটি ওষুধের দোকানের সামনে রোজ বসে থাকে।টুলে বসে রোমান্টিক সব গান গায়।দূরে গাছের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় আমাদের দেখলেই যেন তার উৎসাহ বেড়ে ওঠে। অনুপমের বাড়িয়ে দাও তোমার হাত গানটা তার মনে পড়ে যায়,বে-সুরে গাইতে থাকে। আর কি যেন ভেবে হাসে।আমি দেখি মুচকি মুচকি মিঠুও হাসে। লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে তার মুখ। থুতনি তুলে ধরে তাকে আমি দেখি আর বলি
কি হল রে তোর?
অমনি মিঠু হাতটা আমার সরিয়ে দিয়ে,ধ্যাত কি যে বলিস? বলেই মুখটা নত করে। জিজ্ঞেস করি,প্রেমের কলি ধরল নাকি মনে।কথাটা তার কানে বাজে। কিন্তু প্রেমের কুঁড়ি তার মনে ফুটেছে, দেখলেই বোঝা যায়।
কি যে হল সেদিন। মিঠু আর আমি যাচ্ছিলাম শপিংমলে।মিঠু ছিল আমার সামনে দাঁড়িয়ে। বাস এসে থামতেই মিঠু মাথা নত করে বাসে উঠে পড়ে আর বাসের ভেতর থেকে কেউ একজন নীচে নেমে আসার চেষ্টা করে।হঠাৎ মিঠুর বুকে তার হাতটি লেগে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মিঠু ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বলে ওঠে অসভ্য ইতর।ঘরে মা বোন নেই? বলে সে চড় মারার জন্য হাত তুলতে যায়। এমন সময় কেউ একজন পেছন থেকে হাতটা চেপে ধরে বলে সত্যিটা জানলে আপনি হাত তুলতে পারতেন না।আর কোন কথা না বলে পাশ কাটিয়ে দুজনে নেমে গেলে আমি মিঠুকে নিয়ে বাসে উঠে বসলাম।অনেকেই নানান মন্তব্য করতে থাকে। দুজনেই তা হজম করে নিলাম।শপিং সেরে ফিরলাম বাড়ি। ফেরার পথে ওষুধের দোকানে আবার ওই লোক দুজনকে দেখে মিঠু চমকে ওঠে। আমাকে বলে চল সরি বলে আসি। আমি বললাম থাক ঘটনাটা তো তখনই শেষ হয়ে গেছে। বলে দুজনে যে যার বাড়ি চলে গেলাম।
আমাদের পাড়ার মোরে ওষুধের দোকানটা নতুন খুলেছে।কাজেই তেমনভাবে চেনা পরিচয় হয়নি।পরেরদিন মিঠুর সাথে আমার দেখা হতেই দেখি মিঠু ওষুধের দোকানের দিকে তাকিয়ে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে।আর বলছে ওই দেখ ছেলেটা টুলে বসে আছে।আমি ঝাঁঝি মেরে বলি তো। তাতে তোর কি। বসতেই পারে।তোকে তো আর জড়িয়ে ধরতে আসছে না।মিঠু বললে তা আসছে না ঠিক। আমাকে মিঠু বললে, আচ্ছা বলতো তুই কোনদিন বিদ্যুতের শখ খেয়েছিস?আমি বললাম কেন বলতো?বললে না থাক ও তুই বুঝবি না।তবে সত্যিটা জানতে হবে।সেদিনে যেভাবে বিদ্যুৎতরঙ্গ শরীরে খেলেছিল সেটাই আমার মনকে দুর্বল করেছে। বারবার মনে হয়েছে হাত তোলাটা ঠিক হয়নি।একবার অন্তত সরি বলে আসি। আমি বুঝতে পারছি যে মিঠুর দরদী মনে বসন্ত এসেছে। কিন্তু সত্যিটা না জেনে মনকে প্রশ্রয় দেওয়া কি ঠিক হবে?আমায় যাতে মিঠু ভুল না বোঝে তাই ওকেই জিজ্ঞেস করি কি উপায় সে ভেবেছে। সে বললে ভেবেছি ভ্যালেন্টাইন ডেতেই জেনে নেবে সত্যিটা।
আমি বলি কিভাবে জানবি? কেন প্রথম দিন তো গোলাপ দিন। তাই গোলাপ দিয়ে বলব, শুভেচ্ছা নাও। তোমার দিনগুলো গোলাপের মতো রঙিন হোক। গোলাপের মতো তোমার জীবন সৌরভে ভরে উঠুক। তবে কি পরের দিন যাবি প্রতিশ্রুতি আদায় করতে?আমি মিঠুকে জিজ্ঞেস করলাম। মিঠু বলল, হ্যাঁ তা তো যাবই।পরেরদিন যাব ক্যাডবেরি নিয়ে মিষ্টতা গাঢ় করতে। বাব্বা তুই পারিস-ও…. তারপর টেডি নিয়ে খেলব দুজনে। মিঠুর কথা শুনে আমি হেসে ফেলি…. বলি,– খেলতে খেলতে জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়ে বলবি আমি ভালবাসি তোমাকে। মিঠু বললে তা তো বলবই। আমি অবাক হই ওর কথা শুনে,বলিহারি তুই। অচেনা নাম গোত্র হীন মানুষটাকে জড়িয়ে ধরবি? মিঠু বলল কেন? একমাস ধরেই তো দেখছি তাকে আমরা। আমি বললাম বেশ। ছেলেটা যদি তোর প্রস্তাব গ্রহণ না করে?
তবে জানতে চাইব আমাদের দেখে রোমান্টিক গানে হৃদয় জুড়ে ঢেউ তোলার দরকার কি? আচ্ছা তুই এমন ভাবছিস কেন।ও কি আপন মনে গানগাইতে পারে না? মিঠু যেন ওর গানে মুগ্ধ হয়ে পাগল হয়ে গেছে।সেদিনের গালিগালাজ সব ভুলে গেছে। যাক গোলাপ দিন আসতে দুই দিন বাকি।ওই দু’দিন তাকে দোকানের টুলে বসতে দেখি নি আর। মিঠুর মন যেন উতলা হয়ে উঠেছে।গোলাপ দিনে সে সত্যিই তরতাজা গোলাপ কিনে আমাকে সঙ্গে নিয়ে ওষুধের দোকানে গেল। দোকানে যেতেই দোকানদার জানতে চাইল আমরা কি চাই। মিঠু বললে ওষুধ নেব না,এখানে বসে যে ছেলেটি গান গাইতো তাকে সরি জানাতেই আজ এসেছি। লোকটি বললে মানে? কিসের সরি?মিঠু বললে ওই যে বাসে সেদিন….রাগে ওইদিন সরি বলতে পারি নি। একবার দয়াকরে তাকে ডেকে দিন।লোকটি হেসে বলে সে তো দুদিন আগেই বাড়ি চলে গেছে। সে তো কলকাতায় ডাক্তার দেখাতে এসেছিল।তার দৃষ্টি হঠাৎই ক্ষীণ হয়ে যায়। চোখে সবসময় জল পড়ে। সব সে কেমন ঝাপসা দেখতে থাকে। তাই ডাক্তারের পরামর্শ নিতেই এখানে সে এসেছিল।ডাক্তার বলেই দিয়েছেন সে আর কোনদিন দৃষ্টি ফিরে পাবে না। শুনে মিঠু মনমরা হয়ে গেল।স্বপ্নমাখা চোখদুটো ভারি হয়ে ভিজে উঠল।আমায় বলল চল।আমারও মনটা উদাস হয়ে গেল।আমি চেয়েছিলাম মিঠুর হাতে ধরা গোলাপটির দিকে।এমন সুন্দর দিনে সেও ভিজে গেল।উঠল না সে আর কারো বুকে।