শুনেছি আমারে ভালো ই লাগে না ,
নাই-বা লাগিল তোর ,
কঠিন বাঁধনে চরণ বেড়িয়া
চিরকাল তোরে রব আঁকড়িয়া
লৌহশৃঙ্খলের ডোর ।
তুই তো আমার বন্দী অভাগিনী
বাঁধিয়াছি কারাগারে ,
প্রাণের শৃঙ্খল দিয়েছি প্রাণেতে
দেখি কে খুলিতে পারে ।
জগৎ-মাঝারে যেথায় বেড়াবি ,
যেথায় বসিবি , যেথায় দাঁড়াবি ,
কি বসন্ত শীতে দিবসে নিশীথে
সাথে সাথে তোর থাকিবে বাজিতে
এ পাষাণ প্রাণ অনন্ত শৃঙ্খল
চরণ জড়ায়ে ধরে ।
এক বার তোরে দেখেছি যখন
কেমনে এড়াবি মোরে ।
চাও নাই চাও , ডাক নাই ডাক ,
কাছেতে আমার থাক নাই থাক ,
যাব সাথে সাথে , রব পায় পায় ,
রব গায় গায় মিশি —
এ বিষাদ ঘোর , এ আঁধার মুখ ,
হতাশ নিশ্বাস , এই ভাঙা বুক ,
ভাঙা বাদ্য-সম বাজিবে কেবল
সাথে সাথে দিবানিশি ।
অনন্ত কালের সঙ্গী আমি তোর
আমি যে রে তোর ছায়া —
কিবা সে রোদনে কিবা সে হাসিতে ,
দেখিতে পাইবি কখনো পাশেতে ,
কখনো সমুখে কখনো পশ্চাতে ,
আমার আঁধার কায়া ।
গভীর নিশীথে একাকী যখন
বসিয়া মলিন প্রাণে ,
চমকি উঠিয়া দেখিবি তরাসে
আমিও রয়েছি বসে তোর পাশে
চেয়ে তোর মুখপানে ।
যে দিকেই তুই ফিরাবি বয়ান
সেই দিকে আমি ফিরাব নয়ান ,
যে দিকে চাহিবি আকাশে আমার
আঁধার মুরতি আঁকা ।
সকলি পড়িবে আমার আড়ালে ,
জগৎ পড়িবে ঢাকা ।
দুঃস্বপ্নের মতো , দুর্ভাবনা-সম ,
তোমারে রহিব ঘিরে —
দিবস-রজনী এ মুখ দেখিব
তোমার নয়ননীরে ।
বিশীর্ণ-কঙ্কাল চিরভিক্ষা-সম
দাঁড়ায়ে সম্মুখে তোর
‘ দাও দাও ‘ বলে কেবলি ডাকিব
ফেলিব নয়নলোর ।
কেবলি সাধিব , কেবলি কাঁদিব ,
কেবলি ফেলিব শ্বাস —
কানের কাছেতে প্রাণের কাছেতে
করিব রে হা-হুতাশ ।
মোর এক নাম কেবলি বসিয়া
জপিব কানেতে তব ,
কাঁটার মতন দিবস রজনী
পায়েতে বিঁধিয়ে রব ।
পূর্বজনমের অভিশাপ-সম
রব আমি কাছে কাছে ,
ভাবী জনমের অদৃষ্টের মতো
বেড়াইব পাছে পাছে ।
ঢালিয়া আমার প্রাণের আঁধার
বেড়িয়া রাখিব তোর চারি ধার
নিশীথ রচনা করি ।
কাছেতে দাঁড়ায়ে প্রেতের মতন
শুধু দুটি প্রাণী করিব যাপন
অনন্ত সে বিভাবরী ।
যেন রে অকূল সাগর-মাঝারে
ডুবেছে জগৎ-তরী —
তারি মাঝে শুধু মোরা দুটি প্রাণী
রয়েছি জড়ায়ে তোর বাহুখানি ,
যুঝিস ছাড়াতে , ছাড়িব না তবু
সে মহাসমুদ্র- ‘ পরি ।
পলে পলে তোর দেহ হয় ক্ষীণ ,
পলে পলে তোর বাহু বলহীন ,
দুজনে অনন্তে ডুবি নিশিদিন —
তবু আছি তোরে ধরি ।
রোগের মতন বাঁধিব তোমারে
নিদারুণ আলিঙ্গনে —
মোর যাতনায় হইবি অধীর ,
আমারি অনলে দহিবে শরীর ,
অবিরাম শুধু আমি ছাড়া আর
কিছু না রহিবে মনে ।
গভীর নিশীথে জাগিয়া উঠিয়া
সহসা দেখিবি কাছে ,
আড়ষ্ট কঠিন মৃত দেহ মোর
তোর পাশে শুয়ে আছে ।
ঘুমাবি যখন স্বপন দেখিবি ,
কেবল দেখিবি মোরে ,
এই অনিমেষ তৃষাতুর আঁখি
চাহিয়া দেখিছে তোরে ।
নিশীথে বসিয়া থেকে থেকে তুই
শুনিবি আঁধারঘোরে ,
কোথা হতে এক কাতর উন্মাদ
ডাকে তোর নাম ধরে ।
সুবিজন পথে চলিতে চলিতে
সহসা সভয় গণি ,
সাঁঝের আঁধারে শুনিতে পাইবি
আমার হাসির ধ্বনি ।
হেরো অন্ধকার মরুময়ী নিশা —
আমার পরান হারায়েছে দিশা ,
অনন্ত এ ক্ষুধা অনন্ত এ তৃষা
করিতেছে হাহাকার ।
আজিকে যখন পেয়েছি রে তোরে
এ চিরযামিনী ছাড়িব কী করে ।
এ ঘোর পিপাসা যুগ-যুগান্তরে
মিটিবে কি কভু আর ।
বুকের ভিতরে ছুরির মতন ,
মনের মাঝারে বিষের মতন ,
রোগের মতন , শোকের মতন
রব আমি অনিবার ।
জীবনের পিছে মরণ দাঁড়ায়ে ,
আশার পশ্চাতে ভয় —
ডাকিনীর মতো রজনী ভ্রমিছে
চিরদিন ধরে দিবসের পিছে
সমস্ত ধরণীময় ।
যেথায় আলোক সেইখানে ছায়া
এই তো নিয়ম ভবে ,
ও রূপের কাছে চিরদিন তাই
এ ক্ষুধা জাগিয়া রবে!