Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রাধানগর || Bani Basu

রাধানগর || Bani Basu

একটা প্রকাণ্ড মাঠ। কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে জানি না। ছমছম করছে জোছনা মাঠময়। পাতলা সরের মতো এই জোছনা যেন মাঠটাকে মুড়ে রেখেছে। সরও নয়। মসলিন কাপড়। একটা রেশমি-রেশমি ভাব। দুরে দুরে গাছের জট। পাকুড়…শিরীষ…তমাল…ওটা কী? শিমুল না ছাতিম? পাহাড়ের মতো উঁচু তেঁতুল দেখা যাচ্ছে একটা। পাখা ঝাপটাতে ঝাপটাতে কী একটা রাত-পাখি উড়ে গেল। এই মাঠটা আমাকে পার হতে হবে। একটা ঠিকানা…একটা ঠিকানায় পৌঁছতে হবে আমায়। এ মাঠ আগাগোড়া এই একই রকম। কতটা এলাম বোঝবারও কোনও উপায় নেই।

কোথাও গঙ্‌ গঙ্‌ করে গম্ভীর সুরে একটা ঘণ্টা বাজছে না? অনেক দূর থেকে আসছে আওয়াজটা। আমাদের ঠাকুরবাড়ির ঘণ্টাটার মতোই আওয়াজ! উঁচুতে, মন্দিরের আড়ার সঙ্গে বাঁধা ঘণ্টাটা। দড়িতে টান মেরে মেরে বাজাতে হয়।

দূরে, মাটির তলা থেকে যেন ঠেলা খেয়ে উঠে আসছে কী একটা। অন্ধকার রং। দুর্গ। দুর্গ একটা। আশ্চর্য! এই তো সেই দুর্গ যেখানে আমার পৌঁছবার কথা। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি দুৰ্গটার বুরুজে বুরুজে কামান। সবগুলো আমার দিকে তাক করা। জানি এই কামানগুলোর পেছনে, কালো পোশাক পরা কালোকাপড়ে মুখ ঢাকা গোলন্দাজরা আছে। যাঃ দুম দাম করে গোলা ছুটে আসছে যে! যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল? আমার সঙ্গে ওদের? আমি কি মধ্যযুগীয় নাইট? একা আমার সঙ্গে কেন এত লোকে যুদ্ধ করে? গোলাগুলো এসে পড়ছে আমার আশেপাশে। পায়ের কাছ এসে পড়ল একটা। আশ্চর্য! এ তো গোলা নয়। কালো কাপড়ে-ঢাকা মুণ্ডু একটা। গোলন্দাজ-সৈনিকের মুণ্ডু। আমি জানতাম না এই ভাবে কামান ছুঁড়তে হয়। গুঁড়ি মেরে কামানের নলের মধ্যে ঢুকে পড়ে নিজের মুণ্ডুটাকেই গোলার মতন এমনি ছুঁড়ে দিতে হয়? এ ভাবেই যুদ্ধ হয়? তাই তো… এ ভাবেই তো হওয়ার কথা!

হঠাৎ মনে পড়ে বাঃ আমি তো উড়তে জানি! পায়ের পাতায় একটু চাপ দিয়ে শূন্যে উঠে যাই। আরামে উড়ছি। নীচে জোছনার মাঠ, মাঠে মুণ্ডু গড়াগড়ি খাচ্ছে। এসে গেছি…এসে গেলাম… ‘অজামিল! অজামিল!’ কে যেন ডাকছে আমায়। সাড়া দেবার প্রাণপণ চেষ্টায় হাঁকপাঁক করতে করতে জেগে উঠি। ঘোর কাটেনি এখনও। এখনও শরীরে ওড়ার বেগ, চোখে ভাসছে অন্ধকার রঙের দুর্গ। কিন্তু, কেন সাড়া দিতে গেলাম? কাকে? আমি তো অজামিল নই! আমার নাম যে মন্দার! লোকে আমায় ডাকে না। ডাকার দরকার হয় না। তবু যদি কখনও আমাকে শনাক্ত করতে হয়, কেউ মন্দারও বলে না। বলে ছোট সোনা। অর্থাৎ ‘সোনা’ নামটাও আমার ভাগের। ‘সোনা’ বলে আমার পূর্ববর্তী একজন আছে। সে-ই প্রকৃত সোনা। কোনও অসতর্ক মুহূর্তে কেউ হয়তো আমাকেও ‘সোনা’ বলে ডেকে ফেলেছিল। সেই থেকে আমিও একজন ‘সোনা’ হয়ে গেছি। তবে ছোট সোনা, নকল সোনা, আসল নয়।

ভোর হচ্ছে এখন আমার তক্তপোশের বিছানার চারদিক ঘিরে। প্রভাতী গানের সুর ভেসে আসছে দূর থেকে। কোল-হার্মোনিয়াম নিয়ে ছোট চক্কোত্তি বেরিয়ে পড়েছেন। সঙ্গে ওঁর স্যাঙাৎ ভবতারণ, তার গলায় মাদুলির মতো ঝুলছে শ্ৰীখোল। পেছনে ভবতারণের ছেলে, হাতে খঞ্জনি। অর্থাৎ রাধানগরের ভোর

‘রাই জাগো রাই জাগো শুকসারি বলে

কত নিদ্রা যাও কালা মাণিকের কোলে’

এদিক থেকে নাকের সাজা পুব দিকে চলে গেলে ঠাকুরবাড়ি পড়বে। প্রভাতী শুরু হতে না হতেই খুলে যাবে ঠাকুরবাড়ির দরজা। কোল্যাপসিব্‌ল-এর ভেতর দিয়ে দেখা যাবে ঠাকুরমশাই রাধামাধবের নিদ্রা ভাঙাচ্ছেন। পাতলা মসলিন কাপড়ের টুকরো দিয়ে ঘষে ঘষে চকচকে করবেন উনি ঠাকুরের অঙ্গ। তারপর মাধবকে পরাবেন চাঁপা রঙের সিল্কের ধুতি, রাধারানির অঙ্গে উঠবে নীল বেনারসী বস্ত্র। তারপর দোলায় এসে বসবেন ঠাকুর। এই রকম সব ভাষাই ব্যবহার করতে হয় ঠাকুরের বেলায়— অঙ্গবস্ত্র, মার্জনা, নিদ্রা, শয়ান, জাগরণ। অনেক দিন আমি মন্দিরের ধাপে বসে বসে এইসব দেখি। খুব আলগা চোখে দেখি। যেন অন্য কিছু করবার নেই বলে দেখছি। অন্য কেউ কোথাও নেই বলে…।

আজ অনেকক্ষণ বিছানাতেই বুঁদ হয়ে থাকি। এই দুৰ্গটা আমি আগেও যেন দেখেছি, আগেও যেন পৌঁছতে পারিনি, আগেও যেন কে ‘অজামিল অজামিল’ বলে ডেকে আমার সব কিছু গুলিয়ে দিয়েছিল, আগেও আমি ঘুম ভেঙে বুঝতে পারি আমি ঠকে গেছি, ভুল নামে সাড়া দিতে গিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গেছি। আগে যখন ঘটেছে তখন পরেও নিশ্চয় ঘটবে! তখন, সেই অনাগত ভবিষ্যতে কি এ ভুল শুধরে নিতে পারব?

একদিন না একদিন ওই মুণ্ডুগুলোর কালো কাপড়ের ঘোমটা আমি এক ঝটকায় সরিয়ে দেবই। মুণ্ডুগুলোর পরিচয় আমায় জানতে হবে। ওরা কারা? কেন ওরা এমন মরিয়ার মতো নিজেদের মুণ্ডু আমার দিকে তাক করে? কীসের শত্রুতা আমার সঙ্গে ওদের? একদিন না একদিন ওই দুর্গে আমি ঢুকবই।

শিশিরদা আমার মাস্টারমশাই। উনি আমাকে একটা ডায়েরি উপহার দেন। ডায়েরির ভেতর ভারতের রেলপথ, সড়কপথের মানচিত্র, সারা বছরের ছুটির দিনের হিসেব, প্রধান প্রধান শহরের ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক বিবরণ, জরুরি টেলিফোন নম্বর, প্রধান প্রধান ট্রেনের খবর, আয়করের চার্ট, রাশিফল, আরও কত রকম খুঁটিনাটি তথ্য। পাতাগুলো রুলটানা, ভাল কাগজ, লিখতে বসলে কলম যেন আপনা আপনি চলতে থাকে। এই ডায়েরিতে পৃথিবীর অনেক সুন্দর জায়গার চমৎকার সব ফটোগ্রাফ আছে। প্যারিসের আইফেল টাওয়ার, কোপেনহেগেনে সাগরের নীল জলে অ্যান্ডারসেনের জলপরীর মূর্তি, নায়াগ্রা জলপ্রপাতের ওপর ইন্দ্রধনু, দক্ষিণ মেরুর বরফের ওপর পেঙ্গুইন-পাড়া, ইলোরার কৈলাস মন্দির, চিনের প্রাচীর, লাসার পোতালা প্রাসাদ…। এই ছবিগুলো আমার খুব প্রিয়, এগুলো আমাকে খুব নিষ্পৃহ হতেও সাহায্য করে। যেন আমি আর রাধানগরের রায়বাড়ির পশ্চিম প্রান্তের চারচালা ঘরটায় নেই। ঘুরে বেড়াচ্ছি জেটগতিতে কানাডা থেকে উত্তরমেরু, উত্তরমেরু থেকে তিব্বত, তিব্বত থেকে মালয়েশিয়া। জানি সবটাই একটা মোহ, একটা কল্পমায়া, কিন্তু তারও একটা মূল্য আছে আমার কাছে। এই ছবিগুলো দেখতে দেখতেই নিজের অকিঞ্চিৎকরত্ব আমি ভুলে যাই। ভুলে যাই আমি একটা কেউ-না। ডায়েরির মসৃণ পাতা আমায় হাতছানি দিতে থাকে। আমি লিখি। লেখা তো নয়, আসলে এটা নিজেকে গুছিয়ে তোলা। লোকে যেমন ছুটির দিনে আলমারি গোছায়, তাক গোছায়। গোছাতে গেলেই পরিষ্কার জানা যায় কী আছে আর কী নেই, কোন জিনিসটা হারিয়ে গেছে, কোনটা দরকার…।

আমি প্রাণীটি খুব চাপা প্রকৃতিরও বটে। চট করে কারও কাছে মন খুলি না। কাউকে ডেকে বসিয়ে জোর করে নিজের কথা শোনাবার ইচ্ছে আমার নেই। নিজের জীবনকে বুঝে নিতে চাই বলেই না আমার ডায়েরি লেখা! সত্যি কথা বলতে কী, বড্ড বেশি কুয়াশায় থেকেছি, বড্ড বেশি আবছায়ায়। আবছা কোনও কিছু আমি যেন আর মেনে নিতে পারি না। স্পষ্ট পরিচয়ের আলোয় দাঁড় করিয়ে দিতে চাঁই সব কিছু।

এই আবছায়ার ব্যাপারটা খুলে না বললে আপনারা বুঝতে পারবেন না।

শৈশবে আমাদের প্রথম জ্ঞান হয় একটা কি দুটো মানুষকে ঘিরে। নয়? যেমন এই আমার মা। এ আমাকে খাওয়ায়, নাচায়, ঘুম পাড়ায়। ওই আমার বাবা এল, এই সময়ে আমার বাবা আসে। কতকগুলো কার্যকারণ সম্পর্কও আমরা আবিষ্কার করি, কাঁদি, তা হলেই ঠাকুমা ছুটে আসবেন। ছটফট করি, বিরক্ত করি এদের, তা হলেই এরা আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবে। কোনও কাকা, মামা-দাদা বা খুব আপন কোনও কাজের লোক নিয়ে যাবে খুশি হয়ে।

আমার অভিজ্ঞতা কিন্তু এ রকম নয়।

ধরুন আমি কাঁদছি। কেন কাঁদছি আমি জানি না। বুঝতে পারছি না। কাঁদতে কাঁদতে কখন আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। আবার কখনও কখনও কাঁদতে কাঁদতে আমি চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরের বাইরে চলে এসেছি। কাঁদছি একটা জৈবিক তাগিদে। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে আমার। বুঝতে পারিনি সেটা।

একজন মহিলা বললেন— কেঁদে পাড়া মাথায় করল যে। কী হয়েছে সোনা! ও সাবির মা একটু দেখো না। এর বোধহয় খিদে পেয়েছে। দেখি তো! একটা আঙুল মহিলা আমার মুখের দিকে বাড়িয়ে ধরলেন। আমি সাগ্রহে সেটা মুখে পুরতে যাই।

—দেখছ তো। ঠিক ধরেছি! ও সাবির মা।

গেলাসে করে দুধ খাওয়ানো হয় আমাকে অতঃপর।

একটা কাঁসার বাটি কেউ বসিয়ে দিয়ে গেছে আমার সামনে। আর একজন মহিলা। বাটিতে মুড়ি। যত না খাচ্ছি, তার চেয়ে বেশি ছড়াচ্ছি চারদিকে। কয়েকটা শালিক এসে ফুটুর ফুটুর করে খেয়ে যাচ্ছে সেগুলো। আমি মজা পাচ্ছি। আরও মুড়ি ছড়িয়ে দিচ্ছি।

গোঁফওয়ালা একজন লোক আমায় এক রকম টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। পুকুরঘাটে দাঁড় করিয়ে মাথায় দু ঘটি জল ঢেলে দিল। হাঁসফাঁস করে কেঁদে উঠলাম আমি। কাঁধের গামছাটা দিয়ে খপ খপ করে গা মুছিয়ে দিল লোকটা। এবার উল্টো মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল– যা এবার পালা।

আমি এগিয়ে যাচ্ছি, একেবারে নাঙ্গা। একজন ভারী গলার রাশভারী লোক আমার পথ আটকে দাঁড়িয়েছেন।

—আরে! আরে! তুরতুর করে এ দিগম্বর চলল কোথায়? কে এটা? রঘু! রঘো! বাসু! কে আছিস?

—কী সেজোবাবু!

—আরে বছরকার দিনে কার খোকা এমন ন্যাংটা ঘুরে বেড়াচ্ছে?

—এ হল ছোট সোনা, রাজেন দাদার…

—অ। তা জামা-কাপড় পরিয়ে দে না!

আমাকে টানতে টানতে পশ্চিমের ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়।

—কে আছ গো! কেউ আছ না কি?

—কী বলছ? কে?

—এই তো নন্দদিদি, দাও দিকি এই খোকাকে জামা-প্যান পরিয়ে। চান হয়ে গেছে এর।

আধ ডজন লোকের হাতে ঘুরে-ফিরে আমার স্নান, ভোজন, বেশকরণ, শয়ন হতে থাকে। সকলেই করে দায়ে পড়ে। এই আধ ডজনও আবার পাল্টে পাল্টে যেতে থাকে। তো কী করে আমি চিনব এদের, কী করে বুঝব এদের কার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক?

তবে সবচেয়ে আগে এদের ভেতর থেকে স্পষ্ট হয়ে বেরিয়ে আসে নন্দ পিসি। কোরা-কোরা থান-পরা। গলায় তুলসীর কণ্ঠী। খালি গা। তলার পাটির দুটো দাঁত নেই। কপালে একটা চন্দনের টিপ। চুলগুলো টঙের দিকে তুলে একটা গুটকি খোঁপা বাঁধা। নন্দপিসি আমার ঘরে শোয়। মোটের ওপর আমার জামাকাপড়, খাওয়াদাওয়া, অসুখবিসুখের খোঁজ রাখে। মোটের ওপর। কেন না, তারও তো কাজ কম নয়!

আর একজন বেরিয়ে আসে— রঘুদা। বেশ শক্তসমর্থ জোয়ান। বুকটা চ্যাটালো। হাঁটুর কাছ অবধি গুটিয়ে তুলে ধুতি পরা। পায়ের পাতাগুলো যেন শাবলের মতো। তেমনই খসকা কালো, তেমনি শিরা ওঠা আঁকাবাঁকা আঙুলঅলা! এদের আমি সারা দিনে একাধিক বার দেখি। রঘুদাকেও আমি চিনে ফেলি। মাঝেসাঝে রঘুদা আমাকে হিজলবাগানে বেড়াতে নিয়ে যায়।

আরেক মহিলা আসেন। স্বর্গ থেকেই নেমে আসেন বোধহয়। কারণ এঁর সান্নিধ্যে সুন্দর গন্ধ। এঁর হাত-পা-চুল চোখমুখ সব ভরা ভরা। সুন্দর রঙিন কাপড় পরে থাকেন। সোনার হাতে সোনার কাঁকন…। এঁকে মা বলি। কিন্তু এই মাকে তো পাই না সর্বক্ষণ। সারা বছর। ক’দিন দেখি আমাদের পশ্চিমের ঘর আলো করে ঘোরাফেরা করেন, খুব আদর করেন আমায়। কাছে নিয়ে শোন। গল্প বলেন, তারপর একদিন দেখি ঘরদোর ভাল করে গুছিয়ে নন্দপিসিকে ডেকে বলেন ‘মন্দারের সব গুছিয়ে দিয়ে গেলাম। একটু দেখো ওকে।’ অনুনয় মিশে থাকে গলায়। আমাকে চুমু খেয়ে ইনি দাওয়া থেকে উঠোনে নামেন, মাথায় ঘোমটা তুলে দেন, ব্যাগ কাঁধে জুতো পায়ে দেখতে দেখতে আবার দৃষ্টির বাইরে চলে যান। ভেতর থেকে কান্না ওঠে আমার, কাতর একটা ডাক উঠে আসতে চায়, সে-সব গিলে নিই আমি। নন্দপিসি বলে মহিলা একবার মায়ের চলে-যাওয়ার পথের দিকে তাকায়, একবার আমার দিকে তাকায়,—‘ধাত বটে একখানা বাবা, পাষাণও হার মেনে যাবে।’ কাকে লক্ষ্য করে বলে পিসি? আমাকে? না আমার মাকে!

মা এলে একজন মানুষকে একটু বেশি বেশি দেখতে পাই। একে বলে ‘বাবা’। লাঠিয়ালদের মতো পাকানো চেহারা এর। পেশির ঢেউ গোটা দেহে। চকচক করছে একেবারে। যেন তবক দেওয়া শরীর। বাবরি চুল। পাকিয়ে তোলা গোঁফ। টানা টানা চোখ। চোখের পাতা এত ঘন যে মনে হয় কাজল পরে আছে। মা থাকলে আমরা এই দাওয়াতে খাই। বাবাকে দেখতে পাই ঘন ঘন। মা চলে যাবার পর তাই এই বাবার কাছেই ঘেঁষতে যাই। বাবার বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু যত রাতই হোক বাবা আমাকে তুলে আমার নিজের ঘরে, নিজের বিছানায় তুলে দিয়ে যায়।

মা চলে যাবার পরে আবার সব গুলিয়ে যায়। সম্পর্ক, সময়, সব। কখন চান করি, সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরি, কখন কোথায় যাই তার কোনওই ঠিক থাকে না। ইচ্ছে হল চান করলাম। মনে পড়ল না, করলাম না। খিদে পেলে আগে ঘরে খুঁজি। যদি মুড়ি, নারকোল নাড়ু, কি মুড়ির চাক ছোলার চাক কিছু পাওয়া গেল, তা-ই চিবিয়ে নিলাম। কিছু না পেলে যেখানে রান্না হতে দেখেছি, বসে পড়ি। তিন চারটে ঘরে রান্না হয় রায়বাড়ির, যেখানে হোক বসে পড়লেই হল।

—কী? খিদে পেয়েছে?

—হ্যাঁ।

থালায় করে ভাত এসে যায়। হাতায় করে ডাল ঢেলে দেওয়া হয়। তরকারি, ভাজা, অম্বল, দই, যেটা ভাল লাগল খেলাম, যেটা না লাগল পড়ে রইল পাতে।

এর চেয়েও যখন ছোট ছিলাম, আমার খাওয়ার সময় ছিল মাঝ রাত্তির। সারাদিন হয়তো খাওয়া হয়নি। কেউ মনে করে দেয়নি। একটা বয়স পর্যন্ত শিশুদের তো দিতেই হয়! আমাকে কারও দিতে মনে থাকত না। ঘুমিয়ে পড়েছি এক সময়ে। মাঝরাত্তিরে খিদের চোটে ঘুম ভেঙে গেছে। তখন পিঁড়ির ওপর পিঁড়ি সাজিয়ে শিকেয় রাখা খাবার পাড়বার চেষ্টা করেছি। কিন্তু হাত পৌঁছচ্ছে না।

—ও কী? সোনা! কী খুটুর খুটুর করছ? খিদে পেয়েছে বুঝি?

নন্দপিসি শিকে থেকে ঠাকুরের রাতের ভোগের মালপো, সুজির পায়েস বার করে দিত।

যেমন উল্টোপাল্টা খাওয়া, তেমন যেখানে সেখানে ঘুম। খেলতে খেলতে যেখানে ঘুম পেল, সেখানেই ঘুমিয়ে পড়তাম। খেলা মানে তো বেড়ালের পেছনে ছোটা, কাঠবেড়ালির সঙ্গে গাছে ওঠা। এই সব খেলায় তো লোকালয়ের চৌহদ্দিতে আটকে থাকা যায় না! সুতরাং কখনও মাঠে-ঘাটে, কখনও গোয়াল ঘরে, কখনও পুকুরের ঘাটে, আমাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখা যেত। কারও চোখে পড়লে তুলে দিয়ে যেত, অনেক সময় শুধু ঠেলে তুলে দিত।—যা বাড়ি গিয়ে ঘুমোগে যা। তবে এসব ঘটনা ঘটত দিনের বেলার পরিসরে। একবার হল কী, ঘুম ভেঙে দেখি ভীষণ হাওয়া দিচ্ছে, হাওয়া তো নয়, নদীর স্রোত যেন। এক আকাশ জলজ্বলে তারা হাওয়ার স্রোতে ভেসে চলেছে। তারপর দেখি, আরে আমিও তো ভেসে যাচ্ছি? আমার শরীরের তলায় মাটি, চারিদিকের গাছপালা সবই তো ভেসে যাচ্ছে? ভয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, কোথায় যাচ্ছি আমি? চারদিকে কেমন ছায়া-ছায়া মূর্তি সব। এরা যেন সব পাহারা দিয়ে আমাকে নিয়ে চলেছে। যাতে আমি কিছুতেই পালাতে না পারি। মনে হল, অনেক দিন থেকে আমাকে নিয়ে একটা চক্রান্ত চলছিল। এই আকাশ, এই তারা, এইসব ছায়ামূর্তি মিলে ভয়ঙ্কর কিছু একটা করার তালে ছিল, হঠাৎ ঘুমটা না ভাঙলে সেই ভয়ঙ্করটা নির্বিঘ্নে হয়ে যেত।

এই সময় দূরে কোথাও শেয়াল ডেকে উঠল। প্রথমে একটা। তারপর অনেকগুলো। বিশ্রী একটা ‘হ্যা হ্যা হ্যা’ ডাকে চারদিক যেন ভেঙে চৌচির হয়ে যেতে লাগল। আমি প্রাণপণ চেষ্টায় চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। রাতের নিস্তব্ধতায় সেই আওয়াজ হয়তো অনেকদূর ছড়িয়ে গিয়েছিল। মানবশিশুর কান্না বলে বোঝা গিয়েছিল কি না জানি না অবশ্য। কেননা কেউ সাড়াশব্দ করেনি। গাঁয়ের লোকের নানারকম কুসংস্কার তো থাকেই, হয়তো লোকে শুনে থাকলেও ভূতের ছল, কি পেতনির কান্না ভেবে নিয়েছিল। কিন্তু গোরুদের তো কুসংস্কার নেই। কয়েকটা গোরু কাছাকাছি কোথাও হাম্বা হাম্বা করে রীতিমতো শোরগোল শুরু করে। তখন লণ্ঠন নিয়ে দু’জন মানুষ বেরিয়ে আসে।

—কে রে? গোরুগুলো এত ডাকছে কেন? কে যেন কাঁদল? হরি হরি, রাধাকেষ্ট, রাধাকেষ্ট।

আমি তখন ভয়ে নেতিয়ে পড়েছি। এরা নিচু হয়ে আমাকে দেখছে, আমি বুঝতে পারছি কিন্তু গলা দিয়ে আর আওয়াজ বেরোচ্ছে না।

—এ যে একটা ছোট ছেলে দেখছি। কাদের ছেলে? একেবারে হিম হয়ে গেছে যে। তোল তোল!

ভজহরি আর শ্রীরাম, দুই ভাই আমাকে বাসা থেকে পড়ে যাওয়া পাখির ছানার মতো তুলে নিয়ে যান। ওঁদের বাড়ির মেয়েরা অনেকক্ষণ ধরে গরম সেঁক দিয়ে দিয়ে, অল্প করে গরম দুধ খাইয়ে খাইয়ে আমায় চাঙ্গা করেন। পরদিন বেলা ৯টা অবধি আমি ঘুমোই। ওঁরাই পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা করে নিশ্চিত হন যে আমি ঠাকুরবাড়ির ছেলে। ভাগ্যক্রমে রঘুদাকেই ওরা ডেকে নিয়ে যান আমায় শনাক্ত করতে।

আমি তখন ভজহরি ঘোষের স্ত্রীর কোলের কাছে বসে কাঁঠালের রস দিয়ে মেখে চিড়ের ফলার খাচ্ছি। রঘুদাকে ঢুকতে দেখেই ফলার টলার ফেলে উঠে দাঁড়াই।

—ওঘু, ওঘু…।

রঘুদা বলে ওঠে—আরে এ তো ছোট সোনা, রাজেনকত্তার ছেলে। কী করে এল এখানে?

—মাঠের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিল। বটগাছতলায়, চারদিকে ঝুরি নেমেছে তো৷! আরাম পেয়েছিল বোধহয়!

এই ঝুরিগুলোকেই আমার ছায়ামূর্তি মনে হয়েছিল।

বলরাম ঘোষের স্ত্রী বললেন—সাপেখোপে কাটেনি এই ঢের। বাড়িতে নিশ্চয় এতক্ষণে কান্নাকাটি পড়ে গেছে?

রঘুদা বললে—তুমিও যেমন বউঠাকরুন, ও ঠাকুরবাড়ির কেউ এখনও টেরই পায়নি যে ছেলেটা বাড়িতে নেই!

—আশ্চয্যি। মা নেই, না কি?

—আছে আবার নেই-ও। ও সব বড় ঘরের কারবার, তুমি আমি বুঝব না গো! তখন আমার কত বয়স হবে? বছর চারের বেশি না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16
Pages ( 1 of 16 ): 1 23 ... 16পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress