Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রাজবাড়ির রহস্য || Sunil Gangopadhyay » Page 6

রাজবাড়ির রহস্য || Sunil Gangopadhyay

ঢং ঢং ঢং ঢং করে ছুটির ঘন্টা বেজে গেল। সন্তুর তখনও তিন-চার লাইন লেখা বাকি। সন্তু মুখ তুলে একবার দেখে নিল, প্রোফেসর সেন সব ছাত্রদের কাছ থেকে খাতা নিয়ে নিচ্ছেন। সন্তু বসেছে একেবারে পেছনে, তার কাছে পৌঁছতে এক-দু মিনিট সময় লাগবে। সে ঝড়ের বেগে লিখতে লাগল।

প্রোফেসর সেন যখন তার কাছে এসে বললেন, টাইম ইজ ওভার সন্তু বলল, এই যে হয়ে গেছে, স্যার! শেষ বাক্যটা লিখে সে তলায় একটা জোরে দাগ কাটল! বুক থেকে একটা স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এল। যাক, শেষ করা গেছে!

জোজো দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে। তার শেষ হয়ে গেছে মিনিট-পাঁচেক আগেই। সে সন্তুকে জিজ্ঞেস করল, কেমন হল রে?

সন্তু বলল,মোটামুটি! তোর?

জোজো বলল, সব কোশ্চেনগুলো তো আমার জলের মতন জানা। একশোর মধ্যে একশো নম্বর পাওয়া উচিত। অরিন্দম বেচারির ভাল হয়নি, ও মন খারাপ করে বাড়ি চলে গেছে।

সন্তু বলল, অরিন্দমটা বরাবরই নাভাস টাইপের। এইসব পরীক্ষা নিয়ে এত ঘাবড়াবার কী আছে?

তুই গুড নিউজ শুনেছিস, সন্তু? আমাদের বাকি পরীক্ষাগুলো বারো দিন পিছিয়ে গেছে।

পরীক্ষা পিছিয়ে গেছে? তার মানে?

দ্যাখ না, বাইরে নোটিস দিয়েছে। কাল শুক্রবার, কাল আমাদের কিছু নেই। শনিবার অন্য কী একটা ছুটি। সোমবার থেকে এখানে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার সিট পড়েছে। ওদেরটা সেই গত মাসে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল না? সেটা এখন হবে, আমাদেরটা পিছিয়ে গেল?

জোজোর কথায় চট করে বিশ্বাস করা যায় না। সন্তু নিজের চোখে নোটিস বোর্ড দেখতে গেল। জোজো এটা বানিয়ে বলেনি, নোটিস বোর্ডের সামনে অনেক ছাত্র ভিড় করে আছে, অনেকেই বেশ খুশি হয়েছে।

সন্তুর বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে গেল। পরীক্ষা মাঝ পথে বন্ধ হয়ে গেলে তার মোটেই ভাল লাগে না। শেষ হলেই চুকে যায়। তা ছাড়া, এই পরীক্ষার কারণে তার এবার কাকাবাবুর সঙ্গে যাওয়া হল না! কোনও মানে হয়!

জোজো বলল, আমার ভালই হল, বাবা পরশুদিন দামাস্কাস যাচ্ছেন। আমার সঙ্গে যাওয়ার কথা ছিল, পরীক্ষার জন্য যাওয়া হচ্ছিল না। এবারে ঘুরে আসব।

তুই এই কদিনের জন্য দামাস্কাস যাবি?

হ্যাঁ। প্লেনে যাব, প্লেনে ফিরব, মাঝখানে থাকব তিনদিন। দামাস্কাসের শেখ বাবাকে হাত দেখাতে চেয়েছেন। বাবার দেওয়া আংটি পরে এই শেখ জগলুল পাশা তার ভাইয়ের হাতে গুলি খেয়েও বেঁচে গিয়েছিল। বাবাকে খুব ভক্তি করে। ফেরার পথে লণ্ডনেও থেকে আসতে হবে দুদিন।

দামাস্কাস থেকে ফেরার পথে বুঝি লন্ডন পড়ে?

একটু ঘুরে আসতে হবে অবশ্য। কিন্তু উপায় নেই। ইংল্যান্ডের প্রিন্স চার্লস আমার বাবার কাছে জানতে চেয়েছেন, উনি কবে সিংহাসনে বসবেন।

ওর মায়ের তো রিটায়ার করার কোনও লক্ষণ নেই! তুই জানিস, উইম্বলডনে খেলতে যাবার আগে প্যাট ক্যাশ আমার বাবার কাছ থেকে একটা মাদুলি নিয়ে গেছেন? সেইজন্যই তো জিতলেন। ওঁর মা অস্ট্রেলিয়া থেকে আমাদের বাড়িতে এক গাদা কনডেন্সড মিল্ক-এর টিন পাঠিয়েছেন।

শুধু কনডেন্সড মিল্ক?

অস্ট্রেলিয়াতে তো আর কিছু পাওয়া যায় না। আর একজোড়া ক্যাঙারু পাঠাতে চেয়েছিলেন, তা নিয়ে আমরা কী করব!

চল জোজো, আজ আমরা একটা সিনেমা দেখি। ই. টি. দেখবি?

ই. টি.? ও তো পুরনো ছবি। আমার তিনবার দেখা। এখানে নয়, ফরেনে। প্রথমবার যখন কনকর্ড প্লেনে চেপে ফ্রান্স থেকে আমেরিকা যাই, ওরা বাবাকে আর আমাকে নেমন্তন্ন করেছিল, তখন প্লেনেই ই. টি. দেখাল। তারপর আর একবার মস্কো ওলিম্পিকের বছরে..

সন্তু বুঝল, আজ জোজোর কল্পনাশক্তি ওভারটাইম খাটতে শুরু করেছে। মাঝপথে তাকে বাধা দিয়ে সন্তু বল, তা তো বুঝলুম, কিন্তু তুই আজ আমার সঙ্গে যাবি কি না, সেটা বল!

জোজো অবহেলার সঙ্গে বলল, যেতে পারি। আর একবার দেখলে ক্ষতি নেই। কোন্ হলে হচ্ছে। গ্লোবে? ঠিক আছে, তোকে টিকিটও কাটতে হবে না। ওই হলের ম্যানেজার আমার ছোটকাকার আপন বন্ধু?

ওসব চলবে না, জোজো। তোর ছোটকাকার আপন বন্ধু বা পরের বন্ধু যা-ই হোন, কারও কাছে অকারণ ফেভার চাওয়া আমি পছন্দ করি না। আমার কাছে পয়সা আছে, টিকিট কাটব।

বড় রাস্তায় এসে ওরা ট্রামে চাপল। খানিকটা ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছে। রাস্তায় লোকের ভোলা ছাতা হাত থেকে উড়ে গিয়ে ঘুরপাক খেতে লাগল মাটিতে। একটা বেলুনওয়ালার হাত ফসকে চলে গেল এক গোছ বেলুন। কোনও একটা দোকানের সাইনবোর্ড খসে পড়ল ঝনঝন শব্দে।

সন্তুদের সামনের সিটে একজন লোক আর-একজনকে বলল, গত সপ্তাহে ওড়িশায় গিয়ে কী ঝড়ের মুখে পড়েছিলুম রে বাবা! যাজপুর থেকে কেওনঝড় যাচ্ছিলুম বাসে, রাস্তায় এমন ঝড় উঠল, বড় বড় গাছ ভেঙে পড়ল..

সন্তু চমকে উঠল। সেই মুহূর্তে সে কাকাবাবুদের কথা ভাবছিল, আর ঠিক তখনই আর-একটা লোকের মুখে কেওনঝড়ের নাম শোনা গেল।

কাকাবাবুরা এখন কেওনঝড়ে কী করছেন কে জানে! কাকাবাবু এবার সঙ্গে অনেক বই নিয়ে গেছেন। বলেছেন যে, গাছতলায় শুয়ে-শুয়ে বই পড়বেন। দেবলীনাটা দিব্যি সঙ্গে চলে গেল, সন্তুর যাওয়া হল না! কেওনঝড়ে রোজ ঝড়বৃষ্টি হলে অবশ্য আর ওঁদের গাছতলায় শুয়ে বই পড়া হবে না!

এসপ্লানেড পৌঁছবার আগেই বৃষ্টি নেমে গেল বড়-বড় ফোঁটায়। ট্রাম থেকে নেমে জোজো আর সন্তু দৌড় মারল সিনেমা হলের দিকে। কাউন্টারের সামনে যখন পৌঁছল, তখন দুটো মাত্র টিকিটই বাকি আছে।

সিনেমাটা দেখতে দেখতে সন্তুর আরও মন খারাপ হয়ে গেল। এই সব সুন্দর দৃশ্য দেখলেই ওইসব জায়গায় চলে যেতে ইচ্ছে করে। অন্য কোনও গ্রহের এরকম একটি প্রাণীর সঙ্গে যদি বন্ধুত্ব হয়, যদি তার সঙ্গে একবার মহাশুন্যে চলে যাওয়া যায়…মানুষ আর কতদিন বাদে অন্য-অন্য গ্রহে সহজে যাতায়াত করতে পারবে?

শো ভাঙবার পর সে জোজোকে বলল, কাকাবাবুরা কেওনঝড়ে গেছেন, জানিস? এবারে আমার আর যাওয়া হল না!

জোজো সঙ্গে সঙ্গে বলল, কেন যাওয়া হল না? পরীক্ষার জন্য? পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গেছে, চল, তুই আর আমি ঘুরে আসি!

তুই যে বললি তুই পরশু দামাস্কাস যাবি?

তা হলে সেখানে যাব না। কেনঝড় খুব চমৎকার জায়গা। রাজস্থানে তো! ওর পাশেই জয়সলমিরে আমার বড়-জামাইবাবু থাকেন। কোনও অসুবিধে নেই। বড়-জামাইবাবু গাড়ি দিয়ে দেবেন?

শোন্ জোজো, জয়সলমিরে তোর বড়-জামাইবাবু থাকতে পারেন, কিন্তু কেওনঝড় ওড়িশায়। কলকাতা থেকে খুব বেশি দূরে নয়।

ঠিক আছে, সেইখানেই যাব।

তুই দামাস্কাস, লন্ডন ছেড়ে কেনঝড়ে যেতে চাস?

ওসব জায়গায় যে-কোনও দিন যাওয়া যায়। বাবা কত নেমন্তন্ন পাচ্ছেন। প্লেনে উড়ে গেলেই হল। কেওনঝড়ে একলা একলা গেলে বিপদে পড়ে যেতে পারিস, তোকে তো একটা প্রোটেকশান দেওয়া দরকার।

সন্তু হেসে ফেলল। কোনও ব্যাপারেই জোজো দমে যাবার পাত্র নয়। সে বলল, কেওনঝড়ে কোনও বিপদের সম্ভাবনা নেই রে। ছোট নিরিবিলি জায়গা, কাকাবাবু বিশ্রাম নিতে গেছেন। দেখি, মাকে বলে দেখি, মা যেতে দিতে রাজি হন কি না!

জোজোর বাস আগে এসে যেতে উঠে পড়ল সে। সন্তু দাঁড়িয়ে রইল লিন্ডসে স্ট্রিটের মোড়ের স্টপে। সন্ধেবেলা খুব এক-চোট বৃষ্টি হয়ে গেছে, রাস্তা এখন প্রায় ফাঁকা। এখনও বৃষ্টি পড়ছে গুড়িগুড়ি। বাস আসছে অনেকক্ষণ বাদে বাদে।

একটা সবুজ রঙের মারুতি গাড়ি থেমে গেল তার সামনে। গাড়িতে মোট তিনজন লোক। তাদের একজন মুখ বাড়িয়ে বলল, আরে, তুমি সন্তু না? এই বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছ, কোথায় যাবে? এসো এসো, উঠে এসো, তোমায় পৌঁছে দেব!

সন্তু লোকটিকে চেনে না, জীবনে কখনও দেখেইনি। বেশ শক্তসমর্থ চেহারা, হলুদ রঙের হাফশার্ট পরা, কলারটা ওলটানো। বছর চল্লিশেক বয়স হবে।

সন্তু বলল, না, ঠিক আছে। আমি বাসেই যাব!

লোকটি বলল, তুমি রাজা রায়চৌধুরীর ভাইপো তো? কালকেই সন্ধেবেলা ওঁর সঙ্গে দেখা হল নিউ আলিপুরে, সেখানে তোমার সম্পর্কেও কথা হচ্ছিল। এসো, উঠে এসো, বৃষ্টিতে ভিজবে কেন শুধু-শুধু?

সন্তু দুদিকে মাথা নাড়ল।

লোকটি এবার বিদ্রুপের সুরে বলল, তুমি গাড়িতে উঠতে ভয় পাচ্ছ নাকি? আমি তো শুনেছিলাম তুমি খুব সাহসী ছেলে! তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে চাইছি।

একটা দোতলা বাস এসে গেছে। সেদিকে একবার দেখে নিয়ে সন্তু হাসিমুখে বলল, আমি বৃষ্টির দিনে বাসে চাপতেই ভালবাসি!

গাড়িটার পেছন দিক দিয়ে দৌড়ে গিয়ে সে উঠে পড়ল বাসে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল দোতলায়।

ওই গাড়ির লোকটার চেহারা দেখলেই সুবিধের মনে হয় না। কাকাবাবু কাল সকালের ট্রেনে চলে গেছেন কেওনঝড়, আর সন্ধেবেলা ওর সঙ্গে দেখা হল নিউআলিপুরে? লোকটার মতলব ভাল ছিল না। কাকাবাবুর শত্রুর সংখ্যা সত্যিই খুব বেড়ে গেছে দেখা যাচ্ছে।

কাকাবাবুরও খানিকটা দোষ আছে। অসম্ভব সব পাজি, শয়তান লোকগুলোকে তিনি নিজে খানিকটা শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দেন, পুলিশে ধরিয়ে দেন না। সেই লোকগুলো কয়েকদিন পরেই সুস্থ হয়ে ফিরে আসে, তারপর তারা প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করবে না? বারুইপুরের অংশু চৌধুরীর মাথায় লাল পিঁপড়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল শুধু। লোকটাকে জেলে পাঠানো উচিত ছিল। অংশু চৌধুরী নিশ্চয়ই সাঙ্ঘাতিক খেপে আছে।

এরা কি অংশু চৌধুরীর লোক, না অন্য কারও? ঠিক বোঝা গেল না। কাকাবাবু যে কলকাতায় নেই, তা এরা জানে না।

বাস থেকে নামবার আগে সন্তু সাবধানে এদিক-ওদিক দেখে নিল। একটা পার্কের পাশ দিয়ে তাদের বাড়ির রাস্তায় যেতে হয়। রাত মোটে নটা, এর মধ্যেই পাড়াটা ফাঁকা হয়ে গেছে। পার্কটা একেবারে নির্জন। রাস্তার আলোগুলো নেভানো।

অন্যদিন সন্তু পার্কের ভেতর দিয়ে শর্টকাট করে। আজ আর সে ভেতরে। ঢুকল না। বৃষ্টিতে পার্কের মাটি কাদা কাদা হয়ে আছে। সে হাঁটতে লাগল রেলিং ধরে ধরে।

হঠাৎ অন্ধকার ফুড়ে দুটো লোক এসে দাঁড়াল তার দুপাশে। একজন তার কাঁধে হাত দিয়ে গম্ভীর কড়া গলায় বলল, চ্যাঁচামেচি করে কোনও লাভ নেই, চুপচাপ গাড়িতে উঠে পড়ো।

একটু দূরেই একটা গাড়ির পেছনের লাল আলো দেখা যাচ্ছে।

সন্তু বেশ বিরক্ত হল। পাড়ার মধ্যেও গুণ্ডামি? এরা ভেবেছেটা কী, সন্তু কি এখনও নিতান্ত ছেলেমানুষ নাকি? খুব কাছেই বিমানদার বাড়ি, দোতলার ঘরে আলো জ্বলছে। পাইলট বিমানদা বাড়িতে আছেন।

সন্তু স্প্রিংয়ের মতো লাফ দিয়ে পার্কের রেলিংটা ধরে সামারসল্ট খেয়ে চলে গেল পার্কের মধ্যে। তাকে ধরবার জন্য একটা লোক হাত বাড়াতেই সন্তু তার বগলের তলা চেপে ধরে হ্যাঁচকা টান মারল, লোকটাও উলটে চলে এসে পড়ল মাটিতে।

সন্তু চিৎকার করে বলল, বিমানদা, বিমানদা, একবার চট করে আসুন তো! শিগগির!

অন্য লোকটা পার্কের মধ্যে চলে আসার চেষ্টা করছিল, তখনই থেমে থাকা গাড়িটা স্টার্ট দিল। দ্বিতীয় লোকটা একটু দ্বিধা করে, পার্কের মধ্যে আর না ঢুকে দৌড়ে গেল গাড়ির দিকে। সন্তু প্রথম লোকটার মুখ কাদার মধ্যে চেপে ধরে তার ঘাড়ের ওপর মারতে লাগল রদ্দা। লোকটা উঠতে পারল না।

কাছাকাছি কয়েকটা বাড়ির বারান্দায় লোক এসে গেছে। বিমানদা জানলা দিয়ে বলল, কে? কী হয়েছে?

গাড়িটাতে উঠে পড়ল অন্য লোকটা, সেটা হুশ করে বেরিয়ে গেল। সন্তু গাড়িটার নম্বর দেখার চেষ্টা করল, কিন্তু নজর করতে পারল না।

মাটিতে পড়ে থাকা লোকটা একটা প্রচণ্ড ঝটকানি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল এবার। সঙ্গে-সঙ্গে সে কোমর থেকে একটা ছুরি বার করল। প্রায় আধ হাত লম্বা একটা ভোজালি। সন্তু এবার আর লোকটির সঙ্গে লড়তে গেল না, সে উঠে দৌড় মারল।

কাদায় পিছল হয়ে গেছে মাঠ, পা হড়কাতে হড়কাতে কোনও রকমে সামলে নিয়ে এঁকেবেঁকে ছুটতে লাগল সন্তু। ভোজালি হাতে লোকটা তাকে তাড়া করে আসছে। সন্তু কোনও রকমে বিমানদার বাড়ির কাছে পৌঁছতে চায়। সে চিৎকার করছে, বিমানদা! বিমানদা!

সন্তু আবার পার্কের রেলিং ডিঙিয়ে এসে পড়ল রাস্তায়। ভোজালি হাতে লোকটাও এসে রেলিংটা ধরতেই দেখতে পেল একসঙ্গে পাঁচ-ছজন লোককে। ভোজালি দেখে কয়েকজন একটু পিছিয়ে গেল। কাছেই একটা নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে, রাস্তার ওপর ইট জড়ো করা। বিমানদা একটা আস্ত ইট তুলে নিয়ে হুকুমের সুরে বলল, ছুরি ফেলে দাও! না হলে মাথা ভেঙে দেব!

সন্তুও একটা ইট কুড়িয়ে নিয়েছে।

লোকটা কটমট করে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। ইটের সঙ্গে সে লড়তে পারবে না বুঝতে পেরে উলটো দিকে ফিরে দৌড় লাগাল। সবাই চেঁচিয়ে উঠল, ধর ধর, ধর ধর! কিন্তু একটা সশস্ত্র লোককে ধরার জন্য কেউ অবশ্য পেছন পেছন ছুটে গেল না। লোকটা একবার আছাড় খেয়ে পড়ল, আবার উঠে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।

বিমানদা জিজ্ঞেস করল, লোকটা কে রে? তোকে মারতে এসেছিল কেন?

সন্তু বলল, আমি জীবনে ওকে দেখিনি। আর-একজন ছিল, আমার পাশে এসে বলল, একটা গাড়িতে উঠতে। ভেবেছিল, আমি ভয় পেয়ে অমনি সুড়সুড় করে উঠে পড়ব।

বিমানদা বলল, কাকাবাবু কলকাতায় নেই, এখন তুই বুঝি সদারি করে বেড়াচ্ছিস?

সন্তু বলল, লোকটাকে আর-একটু হলে ঘায়েল করে দিতুম। ইস, পালিয়ে গেল! ওকে ধরে রাখলে ওদের মতলবটা বোঝা যেত!

বিমানদা বলল, দেখে তো মনে হল ভাড়াটে গুণ্ডা! কেউ পাঠিয়েছিল তোকে ধরে নিয়ে যেতে।

সন্তু বলল, পুলিশে ধরিয়ে দিলে তারা ঠিক ওর কাছ থেকে কথা বার করে নিতে পারত!

বিমানদা বলল, সাবধানে ঘোরাফেরা করিস সন্তু। এখন কাকাবাবু নেই…চল, তোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসব?

সন্তু হেসে বলল, আমাকে এ-পাড়া থেকে ধরে নিয়ে যাবে এমন সাধ্য। কারও নেই। এরা তো একেবারে নভিস গুণ্ডা! সঙ্গে রিভলভার পর্যন্ত আনেনি।

বাড়ির সদর দরজার কাছে পৌঁছে সন্তু ভাবল, লোক দুটোকে বাধা না দিয়ে। ওই গাড়িটায় উঠে পড়লে বোধহয় মন্দ হত না। দেখা যেত, ওরা কী করে। অন্তত ওদের পরিচয়টা তো জানা যেত!

ওরা নিশ্চয়ই হাল ছেড়ে দেবে না, আবার ফিরে আসবে!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress