Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রাজবাড়ির রহস্য || Sunil Gangopadhyay

রাজবাড়ির রহস্য || Sunil Gangopadhyay

টুক করে একটা শব্দ হতেই শৈবাল দত্তর ঘুম ভেঙে গেল। এত সহজে তাঁর ঘুম ভাঙে না। শব্দটা ঠিক যেন কোনও ঘরের ছিটকিনি খোলার শব্দের মতন। তিনি বেডসাইড টেবলের ঘড়িটা দেখলেন। অন্ধকারে ঘড়ির কাঁটাগুলো জ্বলজ্বল করছে, এখন রাত দুটো বেজে কুড়ি মিনিট।

গতকাল রাতেও প্রায় এই সময়েই একটা গণ্ডগোলে তাঁর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সিঁড়ির কাছে একটা জোর শব্দ হয়েছিল হুড়মুড় করে। শৈবাল ছুটে গিয়ে দেখেছিলেন, দোতলা থেকে একতলায় নামার সিঁড়ির মাঝখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে দেবলীনা।

কেওনঝড়ে একটা পুরনো রাজবাড়িতে মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন শৈবাল দত্ত। দেবলীনার সঙ্গে তার বান্ধবী শর্মিলাও এসেছে। মস্ত বড় প্রাসাদ, অনেক ঘরই ফাঁকা পড়ে আছে। পাশাপাশি দুখানা ঘর নিয়েছেন ওঁরা। শর্মিলাকে না ডেকে অত রাতে একা-একা বাইরে বেরিয়েছিল কেন দেবলীনা? বাথরুমটা একেবারে পাশেই। তবু টানা লম্বা বারান্দা অনেকখানি হেঁটে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে গিয়েছিল কেন সে?

দেবলীনার মুখে খানিকটা জলের ছিটে দিতেই তার জ্ঞান ফিরে এসেছিল। কিন্তু সে বাবার কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। শৈবাল দত্ত বারবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুই নীচে নামছিলি কেন, কোথায় যাচ্ছিলি? দেবলীনা মাথা ঝাঁকিয়ে চোখ বুজে বলেছিল, জানি না। জানি না।

শর্মিলার ঘুম খুব গাঢ়। সে এসব কিছু টেরই পায়নি। শৈবাল মেয়েকে ধরে-ধরে নিয়ে আবার শুইয়ে দিয়েছিলেন বিছানায়। কিন্তু তাঁর মনে একটা খটকা লেগেছিল, ব্যাপারটা খুব সাধারণ নয়।

আজ সকালে দেবলীনা আবার খুব হাসিখুশি। এ বাড়ির একজন বুড়ো দরোয়ানকে নিয়ে ওরা দুই বান্ধবী জঙ্গলে বেড়াতে গেল। দুপুরবেলা ফিরে এসে দেবলীনা মহা উৎসাহে বাবাকে গল্প শোনাল যে, ওরা জলার পাশে হাতির পায়ের ছাপ দেখেছে! দেবলীনার মুখ দেখলে মনে হয়, যেন কাল রাত্তিরের ঘটনা তার মনেই নেই।

আজ রাতেও ছিটকিনি খোলার শব্দ শুনেই শৈবালের কীরকম যেন সন্দেহ হল। তাড়াতাড়ি খাট থেকে নেমে তিনি প্রায় নিঃশব্দে নিজের ঘরের দরজা খুলে তাকালেন বাইরে। ঢাকা বারান্দাটায় কোনও আলো জ্বলছে না, তবে বেশ জ্যোৎস্না এসে পড়েছে। সাদা একটা ফ্রক পরে হেঁটে যাচ্ছে দেবলীনা। সে খুব জোরেও যাচ্ছে না, আস্তেও না, সে যেন পা মেপে মেপে হাঁটছে। মুখখানা একেবারে সামনের দিকে সোজা।

বুকখানা এর ধক করে উঠল শৈবালের। এ কি তাঁর মেয়ে দেবলীনা, না অন্য কেউ? এরকম চুপিচুপি সে কোথায় যাচ্ছে? সে কি ঘুমের মধ্যে হাঁটছে? স্লিপ-ওয়াকার?

চটি না পরেই বেরিয়ে এলেন শৈবাল, পা টিপেটিপে অনুসরণ করতে লাগলেন মেয়েকে। স্লিপ-ওয়াকারদের হঠাৎ ডেকে চমকে দিতে নেই। দেখাই যাক না ও কোথায় যায়। শৈবাল একবার ভাবলেন, ফিরে গিয়ে তাঁর রিভলভারটা নিয়ে আসবেন কি না! শর্মিলা একা রইল। সে আবার হঠাৎ জেগে উঠে ভয় পেয়ে যাবে না তো? কিন্তু দেবলীনা ততক্ষণে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করেছে। দেরি করলে যদি ও হারিয়ে যায়?

আজ দেবলীনা বেশ এক-পা এক-পা করে নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে। একতলায় একটা গোল উঠোন, তারপর লোহার গেট। একতলায় কয়েকজন কর্মচারী থাকে, তারা সবাই এখন ঘুমন্ত। গেটে দরোয়ানের পাহারা দেবার কথা, কিন্তু সেখানে কেউ নেই, তবে গেটে একটা প্রকাণ্ড তালা ঝুলছে।

দেবলীনা সেই গেটের সামনে গিয়ে তালাটায় একবার হাত বুলোল। তারপর বসে পড়ল হাঁটু গেড়ে। আগেকার দিনের এই সব বড় গেটের মধ্যে আবার একটা ছোট গেট থাকে, সেটাতে শুধু ছিটকিনি দেওয়া তালা নেই। সেই ছোট গেটটা খুলে দেবলীনা বাইরে বেরিয়ে গেল।

একতলার বারান্দা থেকে দৌড়ে এলেন শৈবাল। ছোট গেটটা দিয়ে মাথা বার করে দেখলেন, দেবলীনা এখন ছুটছে। শৈবালও বাইরে এসে ছুটতে লাগলেন।

এখানে এককালে একটা বাগান ছিল, এখন কেউ যত্ন করে না বলে ঝোপঝাড় হয়ে গেছে। বাগানের কাঠের গেটটা ভেঙে পড়ে গেছে অনেকদিন, কোনও বেড়াও নেই। মাঝখান দিয়ে একটা লাল সুরকির রাস্তা। একটুখানি পরেই সেই রাস্তাটা নেমে গেছে নীচের দিকে। এখানকার মাটি ঢেউ-খেলানো। দেবলীনাকে আর দেখা যাচ্ছে না। সে যেন মিলিয়ে গেছে জ্যোৎস্নায়।

বাগানের বাইরে লাল সুরকির রাস্তাটা বেঁকে গেছে ডান দিকে। এক পাশে একটা জঙ্গলের মতন। দেবলীনা কি রাস্তাটা ধরেই গেছে, না জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, তা বুঝতে পারলেন না শৈবাল। কাল রাতে খুব কাছেই শেয়ালের ডাক শোনা গিয়েছিল। রাত্তিরের দিকে আরও কোনও জন্তু-জানোয়ার আসতে পারে। শৈবাল ভয় পেয়ে গেলেন। দেবলীনা কি জঙ্গলে ঢুকে পড়ল? ও গাছপালা খুব ভালবাসে।

শৈবালও জঙ্গলের মধ্যেই দেখতে এলেন আগে। এখানে জ্যোৎস্নার আলো পড়েনি ভাল করে। ঝি ঝি ডাকছে, টিপটিপ করছে কয়েকটা জোনাকি। সঙ্গে টর্চ নেই, কোনও অস্ত্র নেই, দেবলীনাকে এতদূর আসতে দেওয়া উচিত হয়নি। কিন্তু গেট দিয়ে বেরিয়েই যে দেবলীনা ছুটতে আরম্ভ করবে, তা ভাবতে পারেননি শৈবাল। তার ধারণা ছিল, স্লিপ-ওয়াকাররা আস্তে-আস্তে হাঁটে, তারা দৌড়য় না।

শুকনো পাতার ওপর কার যেন পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, সেইদিক লক্ষ্য করে খানিকটা এগিয়েও শৈবাল কাউকে দেখতে পেলেন না। এবারে তিনি দেবলীনার নাম ধরে ডাকতে যেতেই কার যেন কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলেন।

কয়েক মুহূর্ত তিনি থমকে দাঁড়িয়ে শব্দটা ভাল করে শুনলেন। প্রথমে কান্নার মতন মনে হলেও পরে গানের মতন শোনাল। গানের কোনও কথা নেই, শুধু একটা টানা সুর।

শৈবাল পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেলেন। জঙ্গলের মধ্যে খানিকটা ফাঁকা জায়গা, সেখানে একটা উঁচু ঢিবি। তার ওপরে হাঁটু গেড়ে বসেছে দেবলীনা। আঙুল দিয়ে কী যেন লিখছে মাটিতে, সে-ই গান গাইছে।

শৈবাল অপলকভাবে চেয়ে রইলেন সেদিকে। দৃশ্যটা খুবই সুন্দর, তবু গা-ছমছম করে। মাঝরাতে বিছানা ছেড়ে উঠে এসে এই জঙ্গলের মধ্যে একা-একা গান গাইছে কেন দেবলীনা? এ কী মাথা-খারাপের লক্ষণ?

হঠাৎ যেন একটা ঝড় উঠল। শোঁ শোঁ আওয়াজ, গাছগুলো দুলতে লাগল, পাতা ঝরতে লাগল ঝাঁকঝাঁক। ঝড়ের শব্দটাও অন্যরকম, ঠিক যেন মানুষের গলায় প্রচণ্ড হাসির আওয়াজ।

দেবলীনার কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। সে একইরকমভাবে বসে আছে।

শৈবাল চিৎকার করে ডাকলেন, খুকি, খুকি?

দেবলীনা কোনও সাড়া দিল না, পেছন ফিরে তাকাল না পর্যন্ত, হয়তো ঝড়ের আওয়াজের জন্য সে তার বাবার ডাক শুনতে পায়নি।

শৈবাল খুকি খুকি বলে ডাকতে ডাকতে দৌড়ে উঠতে লাগলেন ঢিবির ওপর। এখানে মাটির বদলে বালি বেশি, তাঁর পা পিছলে যেতে লাগল, তবু তিনি উপরে উঠে এসে দেবলীনার হাত ধরে বললেন, অ্যাই খুকি, এখানে কী করছিস?

দেবলীনা খুব চমকে গিয়ে বলল, কে? আপনি কে?

শৈবাল বললেন, খুকি, আমি তোর বাবা! ঝড় আসছে, শিগগির বাড়ি চল।

উঠে দাঁড়িয়ে এক ঝটকায় নিজের হাতটা ছড়িয়ে নিয়ে দেবলীনা একটা দৌড় লাগাল, দৌড়তে-দৌড়তে চিৎকার করতে লাগল, না, না, না, না…

শৈবাল তাকে ধরার চেষ্টা করেও ধরতে পারলেন না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10
Pages ( 1 of 10 ): 1 23 ... 10পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress