রসিকদাস
পরদিন প্রভাতে উঠিয়া কমল দেখিল, মহান্ত দাওয়ার উপর বসিয়া আছে।
কখন যে সে শয্যাত্যাগ করিয়াছে, কমল তাহা জানিতে পারে নাই; কিন্তু মহান্তের মূর্তি দেখিয়া সে শিহরিয়া উঠিল। রক্ত-মাংসের মানুষটা যেন পাষাণ হইয়া গিয়াছে। নিশ্চল মূকনিষ্পলক শূন্য দৃষ্টি তাহার। চোখের কোলে কোলে দুইটি গভীর কালো রেখা দেখা দিয়াছে। শুষ্ক নদীর ভাঙন— ধরা তটরেখার মত বিগত-বন্যার বার্তা যেন তাহাতে পরিস্ফুট।
সবই কমল বুঝিল। আপনাকেই একান্তভাবে অপরাধী করিয়া কমলা লজ্জায় দুঃখে এতটুকু। হইয়া গেল। কতবার সান্ত্বনার কথা কহিতে গিয়াও সে পারিল না। সমস্ত প্রভাতটা সে আড়ালে আড়ালে ফিরিল।
রসিকদাসই আগে কথা কহিল। সে ডাকিল, কমল!
ডাকটা কমলের কানে যেন ঠেকিল–যেন খাটো-খাটো, কণ্ঠস্বরও যেন হিম-কঠিন। কমল তাহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল নতমুখে।
রসিক তাহার মুখপানে চাহিয়া কাতরভাবে বলিল, কমল, আমি মানুষ।
কমল উত্তর দিল, কেউই পাথর নয়। তবে তুমি আজ পাথর হয়েছ দেখছি।
মহান্তের কণ্ঠস্বরে বাদল যেন ঝরিয়া পড়িল। সে বলিল, অহল্যার মত পাষাণই বুঝি হলাম কমল।
কতকালের গৃহিণীর মত কমল আপনার আঁচল দিয়া মহান্তের সজল চোখ মুছাইয়া দিল। তারপর বলিল, মালা তো ফুলেরই মালা মহান্ত, তাতেও তোমার যদি গলায় ফাঁসি লাগে তবে তুমি ছিঁড়ে ফেলো।
মহান্ত ধীর ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না। সে পারব না। আবার সে ঘাড় নাড়িল–না।
হাসিয়া কমল বলিল, আমার জন্যে ভাবছ? আমার জন্যে তুমি ভেবো না। গোবিন্দ তোমার একার নয়। তার হাতে ছেড়ে দিতেও কি তুমি পারবে না?
রসিক বলিল, না কমল, সে আর আমি পারব না-দেবতার, পায়ে নয়, মানুষের হাতেও নয়। আমার ভিতর বাহির তুমিময় হয়ে গিয়েছে। তুমি ছাড়া আমি বাঁচব না। জান কমল, কাল রাত্রে পালাবার চেষ্টা করেছিলাম, পারি নাই। পা উঠেছে, কিন্তু চোখ ফেরাতে পারি নাই।
কমল ম্লানমুখে কহিল, কিন্তু আমি যে দুঃখে লজ্জায় মরে যাচ্ছি মহান্ত। তোমার এতদিনের ভজন-পূজন সব আমার জন্যে পণ্ড হল।
উন্মত্তের মত কমলের হাত দুইটি আপনার বুকে চাপিয়া ধরিয়া মহান্ত বলিল, যাক-যাকযাক। সংসারে আমি কিছু চাই না। শুধু তুমি যেন আমায় ছেড়ো না কমল।
প্রবল আকর্ষণে সে কমলকে বুকের মধ্যে টানিয়া লইল।
কমল বলিল, ছাড়। ওঠ, উঠে স্নান কর। গোরাচাদের পুজো করে এস।
মহান্ত অকস্মাৎ হু-হু করিয়া কাঁদিয়া উঠিল।
আজন্ম—কুমার বৈরাগীর বুকের ক্ষুধা এতদিন ঘুমন্ত জনের ক্ষুধার মত অবিচলিত ছিল। আজ আহাৰ্য সম্মুখে ধরিয়া তাহাকে জাগাইয়া তোলার সে-ক্ষুধা অজগরের গ্রাস বিস্তার করিয়া মাথা তুলিল। সে-অজগর বাউলের আজন্ম সাধনায় অর্জিত বৈরাগ্যকে অসহায় বনকুরঙ্গের মত জড়াইয়া ধরিয়াছে। তাহাকে পিষিয়া মারিয়া সে তাহাকে নিঃশেষে গ্ৰাস করিবে।
রসিকদাস শিহরিয়া উঠিল। সে যেন কেমন হইয়া গেল। তাহার রসের উৎস শুষ্ক হইয়া গিয়াছে। শুক-শারির দ্বন্দ্রের গান আর জমে না। গোষ্ঠ বিহারের সুদাম—সুবলের সখী-সংবাদ আর সে গায় না। হাসে না, কাঁদেও না, সে এক অদ্ভূত অবস্থা।
মধ্যে মধ্যে একা, অথবা নিশীথ-রাত্রে আকাশের দিকে চাহিয়া হাত জোড় করিয়া ডাকে, হে গোবিন্দী! হে গোবিন্দ!
ধীরে ধীরে দুইটি নরনারীর জীবন কেমন একটা স্পন্দনহীন গুমটি অসহনীয় হইয়া উঠিল। কমলেরও যেন শ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসিতেছিল। একদিন সে বলিয়া ফেলিল, এ তো আর ভাল লাগে না মহান্ত।
মহন্ত চমকিয়া উঠিল। বিবৰ্ণ মুখে স্পন্দনহীন দৃষ্টিতে সে কমলের মুখের দিকে চাহিয়া ६श्ठा।
কমল বলিল, ঘর যে বিষ হয়ে উঠল! চল, কোথাও যাই।
গৃহত্যাগের নামে রসিক যেন একটু জীবন্ত হইয়া উঠিল। সেও বলিয়া উঠিল, তাই আিচল, তাই চল কমল! কোথায় যাবে বল দেখি?
বৃন্দাবন।
রসিকদাস শিহরিয়া উঠিল। বলিল, না না না। অন্য কোথাও চল, ব্রজের চাদকে এ মুখ আমি দেখাতে পারব না।
কিছুক্ষণ নীরবতার পর আবার সে কহিল, জন কমল, সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত গোরাচাদের মন্দিরে যাই নাই।
কমলের মরিতে ইচ্ছা করিল। আপনার পানে চাহিতেও যেন তাহার ঘৃণা বোধ হইতেছিল। সে মহান্তকেই প্রশ্ন করিল, আমার মাঝে কি এতই পাপ আছে মহান্ত?
রসিক সে-কথার কোনো উত্তর দিতে পারিল না। একান্ত অপরাধীর মত নতমস্তকে মাটির–দিকে চাহিয়া রহিল। কমল চোখ মুছিতে মুছিতে আবার বলিল, বেশ, কোথাও গিয়ে কাজ নাই। চল, পথে পথেই ঘুরব আমরা।
আঃ, রসিক যেন বাঁচিয়া গেল। পথে-পথে-পথে-পথে! সঙ্গে সঙ্গে সে উঠিয়া দীড়াইল। বলিল, তাই চল রাইকমল, তাই চল। আজই চল। তাহার মনে হইল, পথের ধুলার মধ্যেই কোথায় আছে যেন মুক্তি। ঘর নয় কুঞ্জ নয় বিশ্রাম নয় অভিসার নয়, শুধু চলা-চল, আজই চল।
কমল হাসিয়া বলিল, ‘ওঠা’ বলতেই কাঁধে বুলি! ঘর-দোরের একটা ব্যবস্থা করতে হবে তো?
বাধা দিয়া রসিক বালিল, থাক থাক, পড়ে থাক ঘর-দোর! ঘর যখন আর বাঁধব না, তখন ঘর বিক্রি করে, ঘর সঙ্গে নিয়ে কি হবে? সখি, বৈরাগী বাউল-হতে হয়। হারায়ে দুকূল।
কমল আর আপত্তি করিল না। সে বলিল, যা খুশি তোমার তাই কর মহান্ত।
পরাজিত বন্দি বৈরাগী মুক্তির আশায় কাঁধে ঝোলা লইয়া মাথায় বাঁধিল নামাবলী। দাড়িতে আজ আবার বিনুনি পাকাইতে পাকাইতে অভিসারের গান ধরিল।
দীর্ঘদিন পর ঘর ছাড়িয়া পথের উপর দাঁড়াইয়া অকস্মাৎ রসিক হইয়া উঠিল যেন পিঞ্জরামুক্ত পাখি—প্ৰগাঢ় নীলিমার মধ্যে সঞ্চরমাণ, মুখর। রসিক পায়ে পরিয়াছে নূপুর; হাতের একতারাটিতে উঠিয়াছিল অবিরাম ঝঙ্কার, সে নিজে গাহিয়া চলিয়াছিল। গানের পর গান। দ্ধিপ্রহরের সময় একখানা বর্ধিষ্ণু গ্রামের বাজারের মুখে পথের পাশে পুকুরের বাঁধা ঘাট দেখিয়া পথবিহারী নরনারী দুইটি ঘর পাতিল।
রসিক গাছতলা পরিষ্কার করিয়া উনান পাতিল, কাঠকুটা ভাঙিয়া সংগ্ৰহ করিল। তারপর ডাকিল, এস গো ঘরের লক্ষ্মী।
কমল স্নানান্তে আসিয়া একটু হাসিল। রান্নার ব্যবস্থায় বসিয়া দেখিয়া শুনিয়া বলিল, ঝুলির ভঁড়ারে যে নুন নাই গো ঘরের কর্তা!
মহান্ত নুন আনিতে গেল। নুনের ঠোঙা হাতে ফিরিয়া দেখিল, কমলকে ঘিরিয়া দর্শকদের ভিড় লাগিয়া গিয়াছে।
পরম কৌতুকে রসিকদাস দর্শকদের পিছনে দীড়াইল। দৃষ্টি পড়িল তাহার কমলের পানে। হাঁ, দেখিবার মত রূপ বটে। ভিজা এলোচুলের প্রান্তদেশ একটি গিট দিয়া ভাঁজ করিয়া মাথার উপর তোলা! আগুনের আঁচে সুন্দর মুখখানি সিন্দূরের মত রাঙা হইয়া উঠিয়াছে। নাকে রসিকলি, কপালে তিলক জ্বলজ্বল করিতেছে। দর্শকদের সে দোষ দিতে পারিল না। দর্শকদের দল কিন্তু দেখিয়াই নিরস্ত ছিল না। প্রশ্নের পর প্রশ্ন বর্ষণ হইতেছিল।
প্রশ্নের কিন্তু জবাব ছিল না। কমল নীরবে মর্যাদাভরে গরবিনীর মত বসিয়া ছিল। কোনো দিকেই তার ভ্ৰক্ষেপ নাই।
একজন বার বার প্রশ্ন করিতেছিল, কি নাম গো বোষ্টুমী? কোথা বাড়ি?
পিছন হইতে রসিক উত্তর দিল, নাম রাইকমল। বাস রসকুঞ্জে।
কথার শব্দে পিছন ফিরিয়া সকলে একবার রসিকের দিকে চাহিল। কে একজন প্রশ্ন করিল, ও আবার কে হে?
রসিক কমলের পাশে আসিয়া সেই লতার লাঠিটা মাটিতে ঠুকিয়া বলিল, আজ্ঞে, আমার নাম খেঁটে-হাতে আয়ান ঘোষ গো প্ৰভু। বোষ্টুমীর বোষ্টম গো আমি।
দর্শকের দল খসিতে শুরু করিল।
কৌতুকে মহান্ত হাসিয়াই সারা হইল। নির্জীব বৈরাগী আজ মুক্ত বায়ুর স্পর্শে যেন বাঁচিয়া উঠিয়াছে।
আপনার মনে গুনগুন করিতে করিতে সে ডাকিয়া উঠিল রাইকমল!
কমল ম্লান হাসি হাসিয়া বলিল, তবু ভাল। কতদিন পরে আজ রাইকমল বলে ডাকলে!
ঘর-ছাড়ার কোন আনন্দে বৈরাগী আজি মাতোয়ারা, কে জানে! রুসিকের শুষ্ক রসসাগর যেন উথলিয়া উঠিয়াছে। স্মিতহাস্যে কৌতুকোচ্ছল চোখে সে বলিয়া উঠিল, তাই ভাল, তাই ভাল রাইকমল, আজ মোনই তুমি কর। গেরস্থের দোরে দোরে আজ আমি মানের পালা গাইব।
কমল হাসিল। হাসিয়া বলিল, গান তুমি গাইতে পাের মহান্ত, কিন্তু মান তো ভাঙাতে পারবে না। নারীর সঙ্গ বাউল-বৈরাগীর পাপ, লজ্জা—সে তো তুমি ভুলতে পারবে না।
খুব জোরের সহিত বাউল বলিয়া উঠিল, খুব পারব গো রাইমানিনী, খুব পারব। পাপলজ্জা ঘরের বস্তু, ঘরেই ফেলে এসেছি। তাই তো আজ আবার তুমি আমার রাইকমল-কৃষ্ণ পূজার কমল-মালা।
পথে পথে চলে বৈষ্ণব-বৈষ্ণবী। গৃহস্থের দুয়ারে হাত পাতিয়া দাঁড়ায়। পথের পর পথ, গ্রামের পর গ্রাম পিছনে পড়িয়া থাকে। গঙ্গা অনেক পিছনে পড়িয়াছে। অজয়ের তীরে তীরে পথ।
চলিতে চলিতে মাস—দুই পরে একদিন কমল পথের উপর চমকিয়া দাঁড়াইয়া গেল। কহিল, এ কোথায় এলাম মহান্ত?
রসিক চারিদিক দেখিয়া শুধু বলিল, রাইকমল!
মায়ার টানে, না, পথের ফেরে কে জানে, পথের মানুষ দুইটি এ কোথায় আসিয়া দাঁড়াইয়াছে?
ওই দূরে অজয়ের তীর। ঘন শরবন চলিয়া গিয়াছে কূলে কুলে। এই তো বনওয়ারীলালের রাসমঞ্চ।
বনওয়ারীলাল এখানকার প্রাচীন জমিদারের গোবিন্দ-বিগ্রহ। এই অঞ্চলে অজয়ের কুলে কুলে বনওয়ারীলালের লীলাক্ষেত্ৰ তৈয়ারি করিয়া গিয়াছেন বনওয়ারীদেবের সেবাইত-রাসমঞ্চ, দোলমঞ্চ, ঝুলনকুঞ্জ। এখান হইতে ওই অনতিদূরে তাঁহাদের গ্রাম। ওই তো!
উভয়েই একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।
কমল বলিল, ফেরো মহান্ত।
রসিক ঘাড় নাড়িয়া উত্তর দিল, না রাইকমল। মা যখন টেনেছেন, গোবিন্দ যখন এনেছেন, তখন মায়ের কোলে ক্রিরাত্রি বাস না করে ফিরব না।
তাহারা আসিয়া দাঁড়াইল রসিকুঞ্জের দুয়ারে। দুয়ার বলিলে ভুল হইবে, রসকুঞ্জের ধ্বসিয়া— পড়া ভিটার প্রান্তে।
মনের কোণে মমতা কোথায় লুকাইয়া ছিল, নয়ন-পথে অকস্মাৎ আত্মপ্রকাশ করিল। চোখে জল আসিল।
কমলদের আখড়ার অবস্থাও তাই। তবে অটুট আছে শুধু জোড়া-লতার কুঞ্জটি, আর চারিপাশে ঘন বেষ্টনীটি। কুঞ্জতলের রাঙা মাটিতে নিকানো সেকালের সেই সুপরিচ্ছন্ন অঙ্গনটির উপর জাগিয়াছে সবুজ ঘাসের আস্তরণ। পাথবাসী মানুষ দুইটি সেই ছায়াতলে বসিয়া পড়িল। অনির্বচনীয় নিবিড় একটি মমতার মোহ তাহাদের মন ও চৈতন্যকে যেন আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। নির্বাক হইয়া বসিয়া উভয়ে চিরপরিচিত পারিপার্শ্বিকের সহিত আজ আবার যেন নূতন করিয়া পরিচয় করিয়া লইতেছে।
কতক্ষণ পর কমল বলিয়া উঠিল, বড় মায়া হচ্ছে মহান্ত। ফেলে যাবার কথা মনে করতেও কষ্ট হচ্ছে, মন যে থাকতে চাইছে।
রসিক তখন গান ধরিয়া দিয়াছে–
বহুদিন পরে বঁধুয়া আইল
দেখা না হইত। পরান গেল।
কমল তাহার সঙ্গে যোগ দিল। চোখ তাহার সজল হইয়া উঠিল। গানের শেষে মহান্ত বলিল, আর যাব না। রাইকমল। বাতাসে মাটিতে আমাকেও যেন জড়িয়ে ধরেছে।
কমল নীরবে আমগাছটির দিকে চাহিয়া ছিল।
রসিক আবার বলিল, আমার কিন্তু রসকুঞ্জে থাকতে দিতে হবে।
তিক্ত হাসিয়া কমল বলিল, তাই হবে গো, তাই হবে, তোমার কুঞ্জেই তুমি থাকবে। ভয় নাই, ধ্যান তোমার ভাঙবে না।
মহান্ত বলিল, না গো না, আসব আমি। শাঙনের বাদল রাতে ঝুলনায় তোমার দোল দিতে আসব। রাসের রাতে ফুলের গয়না নিয়ে তোমার দরবারে আসব আমি। ফাল্গুনের পূর্ণিমায় আসব। ফাগ-কুমকুম নিয়ে!
তীব্র ব্যঙ্গভরে হাসিয়া কমল বলিয়া উঠিল, একটি লীলা যে বাকি থাকল। ঠাকুর-গিরি-গোবর্ধনধারণ।
রসিক অপ্রতিভ হইল না। কহিল, ভুল করলে যে রাইকমল। আমি তো সে হয়ে আসব না। তোমার দরবারে রাইমানিনী। আমি হব তোমার বৃন্দে, তোমার ললিতা, তোমার মালাকর, তোমার কুঞ্জদ্বারের দ্বারী। কটা দিনের কথা ভুলে যাও-হারিয়ে ফেল, মুছে দাও জলের আলপনার মত।
কমল তাহার মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, মালা কি সত্যিই ফাঁসি হয়ে গেলায় লেগেছে মহান্ত যে ছিঁড়তেই হবে?
দূর, দূর, বাজে বকে সময় মাটি। বলি ওগো বেষ্টমী, পেটের কথা ভাব। চল, দোরে দোরে দুটো মেগে আসি।
মহন্ত একতারায় ঝঙ্কার দিয়া উঠিল।
ম্লান হাসি হাসিয়া কমল বলিল, চল। কিন্তু শাক দিয়ে কি মাছ ঢাকা যায় মহান্ত?
পথ চলিতে চলিতে কমল সহসা বলিয়া উঠিল, মহান্ত, আর একদিন এই কথাটাই তোমায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, আজ আবার জিজ্ঞেস করি।–আমার মাঝে কি এতই পাপ আছে?
মহান্ত পথ চলিতেছিল, সঙ্গে সঙ্গে হাতে বাজিতেছিল একতারা, পায়ে তালে তালে বাজিতেছিল নূপুর।
একতারা নীরব হইয়া গেল, পায়ের নূপুর বাজিয়া উঠিল বেতালা। মহান্ত কোনো উত্তর খুঁজিয়া পাইল না।
হঠাৎ কমল দাঁড়াইল।
রসিকদাস বলিল, দাঁড়ালে যে?
কমল আপনার অঙ্গের পানে চাহিল। চিকন উজ্জ্বল ত্বক রৌদ্রের ছটায় ঝলমল করিতেছে নিখাদ সোনার মত। বুকের নিশ্বাসে তো কই কালি নাই—কোনো গন্ধ নাই? তবে? মন তাহার বলিয়া উঠিল, কোথায় পাপ? কিসের পাপ? সে আর মহান্তকে প্রশ্ন করিল না।
মহান্ত বলিল, কাদুর বাড়ি আগে যাই চল।
কমল বলিল, না। তা হলে সে আর ছাড়বে না। সমস্ত গাঁ ফিরে শেষে তার বাড়ি যাব।
প্রথম গৃহস্থের দুয়ারে আসিয়া কমলই কহিল, বাজাও মহান্ত, একতারায় সুর দাও।
দুয়ারে দুয়ারে বৈষ্ণব-বৈষ্ণবী গান গাহিয়া ভিক্ষা মাগিয়া ফেরে। গ্রামের জন তাহাদের কুশলবার্তা জিজ্ঞাসা করে। মহান্ত গানেই উত্তর দেয়–
বল বল তোমার কুশল শুনি,
তোমার কুশলে কুশল মানি।
মেয়েরা কিন্তু ছাড়ে না। তাহারা তাহাদের কুশল শুনিয়া। তবে ছাড়ে। কমলকে দেখিয়া ক্ষিতমুখে তাহারা বলিয়া ওঠে, এ যে লক্ষ্মী-ঠাকুরুনটি হয়েছিস কমলি-অ্যাঁ!
নিজেরা দেখিয়া তৃপ্ত হয় না, তাহাদের গৃহের মধ্যে কেহ থাকিলে তাহাকেও তাহারা ডাকে, দেখে যাও গো মাসি। আমাদের সেই কমলি এসেছে, দেখে যাও।
মাসি আসিয়া কমলকে দেখিয়া বলে, নবদ্বীপের জলের গুণ আছে।
কমলের মুখ লজ্জিত ক্ষিতহাস্যে ভরিয়া ওঠে। উত্তর দেয় রসিকদাস। সে বলিয়া ওঠে, সে যে গোরাচাঁদের দেশ, রূপের সায়র গো। কৌতুকচপল পল্লীর মেয়েরা পরিহাস করিতে ছাড়ে না। তাহারা বলিয়া ওঠে, তা বটে। তোমারও চেহারার জলুস হয়েছে দেখছি।
কথার শেষে তাহারা মুখে কাপড় দিয়ে হাসে।
রসিকদাস কিন্তু অপ্রস্তুত হয় না। স্মিতমুখে সে জবাব দেয়, কাল যে কলি গো, নইলে শুকনো গাছেও ফুল ফুটত।
মুখের চাপা কাপড় ভেদ করিয়া এবার তরুণী-কণ্ঠের অবাধ্য হাসি উচ্ছলিত হইয়া ওঠে।
রসিকের কাছে পরাজয় মানিয়া এবার আবার তাহারা কমলকে লইয়া পড়ে। জিজ্ঞাসা করে, কমলি, এখনও সোঁদা আছিস নাকি? তোর বোষ্টম কই লো?
রসিকদাসকে এবার লজ্জায় নীরব হইতে হয়। কমলই জবাব দেয় ক্ষিতমুখে, এই যে আমার মহান্ত।
মেয়েদের বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। কিন্তু বিস্ময়ের ঘোর কাটিতেই তাহারা কলস্বরে হাসিয়া ওঠে। কেহ কেহ বলিয়া ওঠে, কাল কলি হলে কি হবে মহন্ত, নামের গুণ যায় নাই। শুকনো গাছেও ফুল ফুটেছে।
মহান্ত অকারণে ব্যস্ত হইয়া ওঠে। বলে, ভিক্ষে দাও গো। পাঁচ-দোর ঘুরতে হবে আমাদের।
রঞ্জনদের বাড়ির কাছাকাছি আসিয়া মহান্ত বলিল, রাইকমল, আজ আর থাক। দুটো পেট এতেই চলে যাবে।
কমল বলিল, বাঃ, তাই কি হয়? আমার লঙ্কার বাড়ি না গেলে বলবে কি?
এতটুকু দ্বিধার লেশ সে কণ্ঠস্বরে ছিল না। মহান্ত সবিস্ময়ে তাহার মুখের দিকে চাহিল। আনন্দোজ্জ্বল মুখ, সন্মুখপথে নিবদ্ধ দৃষ্টি কমলের। দুয়ারের পর দুয়ারে ভিক্ষা সারিয়া রঞ্জনদের দুয়ারে আসিয়া কমল বলিয়া উঠিল, মহান্ত, একি?
রঞ্জনদের বাড়িঘর সমস্ত একটা ধ্বংসস্তুপের মত পড়িয়া আছে।
মহান্ত ডাকিল, রাইকমল?
কমল মুখ ফিরাইল, হাসিয়া বলিল, বল।
মহান্ত বলিল, ফিরি চল।
কমল হাসিয়া বলিল, চল।
পথে দাঁড়াইয়া ছিল একটি মেয়ে। সঙ্গে চার-পাঁচটি ছেলেমেয়ে। সে অকস্মাৎ ঝঙ্কার দিয়া উঠিল, মাথা খাব তোমার, নাকে ঝামা ঘষে দোব। এত দেমাক তোর কিসের লা? আমাকে হেনস্তা-কেন, কেন শুনি?
কমল বলিল, কাদু!
কাদু আবার ঝঙ্কার দিয়া উঠিল, কাদু কিসের লা? বল ননদিনী!
তারপর সহসা স্নেহকোমল স্বরে অনুযোগ করিয়া বলিল, এই দুপুর-রোদে কৰ্ম্মভোগ দেখা দেখি। বলি, আমি কি আজ খেতে দিতে পারতাম না? আয় আয়, জল খাবি আয়। এস গো মহান্ত। না, তুমি বুঝি আবার দাদা হয়েছ। বলিয়া সে খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।