Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

রাই জাগো–রাই জাগো

তারপর?

তারপর একটি অবিচ্ছিন্ন মিলনের গাঢ় আনন্দ। এই আনন্দের মধ্য দিয়া দিবারাত্রিগুলি স্বচ্ছন্দে শ্বাসপ্রশ্বাসের মত বহিয়া যায়। মিলনের আবেশে চোখের নিমিখ নামিয়া আসে, সে নিমিখ খুলিতে খুলিতে রাত্রি আসে। আবার রাত্রি কাটিয়া প্রভাত হয়। পাখির কলরব জাগিয়া ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যাহার ঘুম ভাঙে, সে অপরের কানের কাছে মৃদুস্বরে গায়—

রাই জাগো–রাই জাগো
ওই শুক-শারি বোলে।

ঘুম ভাঙে। প্রভাত হইতে আবার আরম্ভ হয়-হাসি, গান, আনন্দ, অভিমান, অনুনয়, অভিনয়, অশ্রু। আবার মিলন হয়। আবার হাসি, আবার আনন্দ। মোট কথা, দুইটি তরুণ নরনারীর জীবনের যা লীলা-তাই। পুরাতন ধারা জীবনে ঘুরিয়া-ফিরিয়া অল্প একটু বেশ পরিবর্তন করিয়া দেখা দেয়। নর-নারী দুইটি কিন্তু ছদ্মবেশ ধরিতে পারে না। তাহারা পায় তাহার মধ্যে নূতনের সন্ধান।

কিন্তু তবু কমল মাঝে মাঝে চমকিয়া ওঠে। মনে হয়, পরী যেন ঈর্ষাতুর দৃষ্টিতে চাহিয়া কোন অন্ধকারে দাঁড়াইয়া আছে।

সেদিন দোল। বসন্ত-পূর্ণিমা শেষ—ফালুনে আসিয়া পড়িয়াছিল। দক্ষিণা বাতাসের গতি ঈষৎ প্রবল। ঘরে দোলনা খাটানো হইয়াছে। দেবতার পায়ে আবীর-কুমকুম নিবেদন করিয়া দিয়া থালাখানি হাতে রঞ্জন দাওয়ায় আসিয়া উঠিল। কমল বসিয়া মালা গাঁথিতেছিল। কৌতুক ভরে রঞ্জন একটা কুমকুম ছুড়িয়া কমলকে মারিল। রাঙা মুখে কমলও উঠিয়া একটা কুমকুম তুলিয়া লইল।

কিন্তু সে কুমকুম তাহার হাতেই থাকিয়া গেল। চমকিয়া উঠিয়া বিবৰ্ণ মুখে সে বলিয়া উঠিল, কে কাঁদিছে গো?

সবিস্ময়ে রঞ্জন প্রশ্ন করিল, কই, কোথা?

ওই ঘরে!

ওই ঘরটায় পরী মরিয়াছিল। সত্যই একটা অস্ফুট কান্নার মত শব্দ যেন দীর্ঘায়িত বিলাপের ছন্দে বাজিতেছিল।

সাহস করিয়া রঞ্জন ঘরে ঢুকিল। বাতাসের তাড়নায় একটা খোলা জানোলা ধীরে ধীরে দুলিতেছিল-তাহারই মরিচা-ধরা কাজার শব্দ সেটা।

রঞ্জন হাসিয়া উঠিল–এত ভয় তোমার!

কমল হাসিতে চেষ্টা করিল।

এমনই করিয়া দিন কাটে। দিনে দিনে মাস-মাসে মাসে বৎসর চলিয়া যায়। বৎসরের পর বৎসর যাইতেছিল। পাঁচ বৎসর পর বোধহয়। কমল হঠাৎ একদা অনুভব করিল, দিনগুলি যেন বড় দীর্ঘ হইয়া পড়িয়াছে। দিনগুলির ধারারও কেমন যেন পরিবর্তন হইয়াছে, তেমন স্বচ্ছন্দ গতিতে আর যায় না-কেমন যেন মন্দগতি। মধ্যে মধ্যে কাটিতে চায় না দিন। রঞ্জন আখড়ার জমি-জমা লইয়া বড় বেশি জড়াইয়া পড়িয়াছে। কাজের আর অন্ত নাই।

দোলের দিন রঙ-খেলায় সে আর তেমন করিয়া মাতে না। ঝুলনের দিন বকুলশাখায় ঝুলনা আর ঝুলানো হয় না। রঞ্জন গাছে উঠিতে পারে না, বলে, এ বয়সে হাত-পা ভাঙলে বুড়ো হাড় জোড়া লাগবে না। রাসের দিন দেবতার রাস সারিয়া রঞ্জন ঘুমাইয়া পঢ়ে। ঘুম আসে না কমলের। মধ্যে মধ্যে সেই পুরনো ভয় হঠাৎ তাহাকে চাপিয়া ধরে। মনে হয়, ও-ঘরের মধ্যে পরী যেন পদচারণা করিয়া ফিরিতেছে।

কমল ক্রমে হাঁপাইয়া উঠিল।

সেদিন রঞ্জন খাইতে বসিলে সে বলিল, দেখ, চল, কিছুদিন তীৰ্থ ঘুরে আসি।

রঞ্জন বিক্ষিত হইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিল। কমল বলিল, আমার ভাল লাগছে না বাপু, চল, একবার ব্ৰজধাম ঘুরে আসি।

শ্লেষের হাসি হাসিয়া রঞ্জন বলিল, কত খরচ জান? বোষ্টম-ভিখারির ঝুলিতে তা নাই।

কমল স্নান হইয়া গেল, বলিল, তোমার তো টাকা না থাকার নয়!

রঞ্জন পরিষ্কার বলিল, আমার একটি পয়সাও নাই।

কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া কমল আবার বলিল, বেশ তো, কাজ কি টাকাকড়িতে! চল, ভিক্ষের বুলি কাঁধে করে বেরিয়ে পড়ি।

রূঢ়কণ্ঠে রঞ্জন বলিল, আমার বাবা এলেও তা পারবে না।

কমল আঘাত পাইল, অভিমোনও হইল। কিন্তু কেন কে জানে সে অভিমান প্রকাশ করিতে তাহার সাহসী হইল না।

ইহার পর কমল যেন সজাগ হইয়া উঠিল। মহান্তের সেবাযত্নের পারিপাট্যে গভীরভাবে সে আত্মনিয়োগ করিল। রঞ্জনও একটু প্ৰসন্ন হইয়া উঠিল। কিন্তু তবু কমলের মনে অতৃপ্তি ঘুরিয়া মরে। তাহার মনে হয়, সেদিন আর নাই। সে ব্যাকুল অন্তরে সেই হারানো দিন ফিরিয়া পাইবার উপায় খুঁজতে লাগিল।

দোলের দিন আবার সে রঙের খেলা খেলিতে চায়, রাসের রাত্রে সারা রাত্রি জাগিয়া সে গান করিতে চায়, জীবনে সে লীলা চায়।

শ্রাবণ মাস, সম্মুখেই ঝুলন-পূর্ণিমা। শুক্লপক্ষের মেঘাচ্ছন্ন বর্ষণমুখর একটি রাত্রি। রঞ্জন বাড়িতে ছিল না, কমল দাওয়ার উপর বসিয়া আকাশের দিকে চাহিয়াছিল। ওপাশে শুইয়াছিল বাউরি-বুড়ি। মহান্ত না থাকিলে ওই বুড়ি বাড়িতে শোয়।

মেঘাবরিত চাদের জ্যোৎস্নার স্বচ্ছ প্রভার মধ্যে অবিরাম ধারা-পাতের ঝরঝর ধারা কুহেলীির মত দেখা যাইতেছিল। রাত্রিটি কমলের বড় মধুর লাগিল। আকাশ নিচে নামিয়া শ্যামা ধরণীকে আলিঙ্গন করিতে চায়, কিন্তু বাতাস নিয়তির মত পথ রোধ করিয়া হা-হা করিয়া হাসে, তাই আকাশ যেন কাঁদিয়া সারা।

কমল মনে মনে আগামী দিনের জন্য এমনই একটি রাত্রি বার বার কামনা করিল। একটি সুন্দর সঙ্কল্প করিয়া সে পুলকিত হইয়া উঠিয়াছে। দেব-মন্দিরে ঝুলনা ঝুলানো হইয়াছে, যুগল বিগ্ৰহ ঝুলনে চাপিয়াছেন। কমল সঙ্কল্প করিল, ঝুলনে সেকালের মতন শয়ন—মন্দিরে তাহারাও ঝুলনা বাঁধিয়া ঝুলনে দোল খাইবে।

কমল কল্পনা করিতে করিতে বিভোর হইয়া উঠিল।

সবুজ রঙের ছাপানো সেই কাপড়খানি সে পরিবে। চুল এলানো থাকাই ভাল। নাকে রসকলি, কপালে চন্দন। মহান্তের গলায় দিবে গন্ধরাজের মালা। নিজের জন্য বেলফুলের মালাই তাহার পছন্দ হইল।

কিন্তু এমন জ্যোৎস্নাস্বচ্ছ বর্ষণমুখর। রাত্রিটি কি কাল হইবে? কমলের আক্ষেপ হইতেছিল। আজ যদি সে থাকিত! শুধু আক্ষেপ নয়, সে তাহার লঙ্কার জন্য একটি সলজ্জ বেদনাময় অভাব অনুভব করিতেছিল। কেহ কোথাও নাই, যেন নিজের কাছে নিজের লজ্জা বোধ হইতেছিল। তাহার।

কখন বাউরি-বুড়ির ঘুম ভাঙিয়া গিয়াছিল, সে পাশ ফিরিয়া শুইতে শুইতে বলিল, ঘরদোরে আলো কই গো? সন্ধেপিদম জ্বাল নাই নাকি?

কমল চমকিয়া উঠিল। তাই তো, মহাপ্রভুর ঘরে-যুগল বিগ্রহের ঘরেও যে আলো দেওয়া হয় নাই, কীর্তন গাওয়া হয় নাই! তাড়াতাড়ি কাপড় ছাড়িয়া সে প্ৰদীপ জ্বলিতে বসিল।

প্রদীপ দেওয়া শেষ করিয়া সে নিয়মমত খঞ্জনী লইয়া কীর্তন গাহিতে বসিল। গান ধরিল—

এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর—

অকস্মাৎ সে স্তব্ধ হইয়া গেল। সে করিয়াছে কি? যুগল বিগ্রহ যখন পূর্ণ মিলনানন্দে ঝুলনে চাপিয়াছেন, তখন সে এ কি গান গাহিল? মনে মনে বার বার মার্জনা চাহিয়া সে ঝুলনের গান ধরিল।

পরদিন প্ৰভাতেও মেঘ কাটিল না। কমল সজল মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখিয়া পুলকিত হইয়া উঠিল। কল্পনা করিল, আজিকার রাত্রিটি গতরাক্রির চেয়েও সুন্দর হইবে। আজ চাঁদ এক কলা বাড়িবে যে। ঝুলনের বন্দোবস্তে ব্যস্ত হইয়া উঠিল। মাথালি মাথায় দিয়া সে বড় পিঁড়েখানি ঘরে আনিয়া তুলিল। ধুইয়া মুছিয়া তাহাতে আলপনা আঁকিতে বসিল। আলপনায় পাশাপাশি দুইটি পদ্ম সে আঁকিল। তারপর সে দোকানো বাহির হইয়া গেল। যখন ফিরিল, তখন মহন্ত আসিয়াছে। মহান্তকে দেখিয়া কমল কাপড়ের আঁচলে কি যেন লুকাইল। বেশ দেখাইয়াই লুকাইল। কিন্তু রঞ্জন সেদিকে লক্ষ্যই করিল না, সে আপন মনেই বলিতেছিল, জ্বালাতন রে বাপু, সারা দিনরাত টিপটিপ ঝিপঝিাপ! হবে তো তাই ভাল করে হয়ে ছেড়ে দে রে বাপু!

রঞ্জন বলি, হোক না বাপু, তোমারই বা কি, আমারই বা কি? কাল কেমন রাতটি হয়েছিল। বল দেখ?

রঞ্জন বলিল, হুঁ, তা হয়েছিল। কিন্তু জলে-কাদায় যে পায়ে হাজা ধরে গেল। তোমার কি বল, তোমার জলই ভাল, তুমি যে কমল।

কমল খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। এইটুকু আদরেই সে গলিয়া গেল। আঁচলের ভিতর হইতে সে এবার লুকানো জিনিসটি বাহির করিল। বেশ মোটা এক আঁটি দড়ি বাহির করিয়া রঞ্জনের সম্মুখে রাখিয়া দিয়া বলিল, দেখ তো!

রঞ্জন একনজর দৃষ্টি বুলাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি, হবে কি?

কমল তরুণীর মত ঝঙ্কার দিয়া উঠিল, বাঃ রে, আমি বললাম, দেখ তো জিনিসটা কেমন; আর উনি জিজ্ঞেস করছেন, হবে কি? আগে আমার কথার উত্তর দাও!

–একবার নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখিয়া রঞ্জন বলিল, দড়ি শক্ত বটে। এখন হবে কি শুনি?

সকৌতুকে কমল বলিল, বল দেখি, কি হবে! দেখি তুমি কেমন!

রঞ্জন যেন ঈষৎ বিরক্ত হইয়া উঠিল, বলিল, আরে, তাই তো পাঁচবার জিজ্ঞাসা করছি।

কমল বলিল, আচ্ছ। আচ্ছা, বলছি। কিন্তু আগে আর একটা কথার জবাব দাও দেখি, দুজন মানুষের ভার সইবে এতে?

কেন, গলায় দিয়ে ঝুলতে হবে নাকি? তা সইবে।

কমলের মুখ এক মুহূর্তে বিবৰ্ণ হইয়া গেল। এ কথাটাকে সে কিছুতেই রহস্য বলিয়া মনে মনে সান্ত্বনা খুঁজিয়া লইতে পারিল না। তবুও সে চেষ্টা করিয়া ঈষৎ হাসিয়া বলিল, আজ ঝুলন হবে আমাদের। শোবার ঘরে ঝুলনা টাঙাব।

কমলের মুখের দিকে অল্পক্ষণ একদৃষ্টি চাহিয়া থাকিয়া রঞ্জন ঈষৎ হাসিয়া বলিল, বলি বয়স বাড়ছে, না কমছে?

রুদ্ধশ্বাসে কমল বলিল, কেন?

রঞ্জনের হাসির ধারায় কমল ভয় পাইয়া গিয়াছিল। রঞ্জন এবার অতি দৃঢ়ভাবে বলিয়া উঠিল, নইলে এখনও তোমার ঝুলনের সাধ হয়! আয়নাতে কি মুখ দেখা যায় না, না নিজের রূপ খুব ভালই লাগে?

কমলের বুকে যেন ব্যথা ধরিয়া উঠিল। দড়ির গোছাটা হাত হইতে আপনি খসিয়া পড়িয়া গিয়াছিল। সে দ্রুতপদে সেখান হইতে পলাইয়া আসিল। তাহার বুকের মধ্যে তখন কান্নার সাগর উথলিয়া উঠিয়াছে। সে গিয়া ঢুকিল পরী যে ঘরটায় মরিয়াছিল। সেই ঘরে। মেঝের উপর লুটাইয়া পড়িয়া কমল ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে লাগিল।

অকস্মাৎ তাহার পরীর কথা মনে পড়িয়া গেল। মৃত্যুর দিন সে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিয়াছিল, রূপ একদিন আমারও ছিল। সেদিন তাহার মনে হইয়াছিল, এ পরীর বেদনার বিলাপ। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে মনে হইল, পরী তাহাকে অভিশােপই দিয়া গিয়াছে।

শুনছ?

ঘরের দুয়ারে দাঁড়াইয়া রঞ্জন তাহাকে ডাকিল। অশ্রুর লজ্জায় কমল মুখ ফিরাইতে পারিল না, সে নীরবেই পড়িয়া রহিল।

রঞ্জন বলিল, আমাকে আজ এখুনি আবার যেতে হবে। দিনতিনেক হবে, বুঝলে?

তারপর সব নীরব। রঞ্জন উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে নাই, তখনই চলিয়া গিয়াছে। কমল উদাস নেত্ৰে খোলা জানালার দিকে চাহিয়া পড়িয়া ছিল। মনের মধ্যে সে শুধু ভাবিতেছিল, সেই লঙ্কা! কেন এত অবহেলা তাহার? হঠাৎ সে উঠিয়া বসিল, রঞ্জনের কথাগুলা তাহার মনে পড়িয়া গেল, ‘আয়নায় কি মুখ দেখ না?’ সে ব্যস্ত হইয়া কুলুঙ্গি হইতে আয়নাখানা পাড়িয়া আপনার মুখের সামনে ধরিল। প্রতিবিম্বের দিকে একদৃষ্টি চাহিয়া রহিল।

বাস্তব আজ তাহার চোখে পড়িল। কালের সঙ্গে সঙ্গে তিলে তিলে তাহার যে পরিবর্তন ঘটিয়াছে, তাহা চোখে পড়ে নাই এতদিন, আজ পড়িল-সত্যই তো, কোথায় সেই প্রাণমাতানো রূপ তাহার? সেই চাপার কলির মত রঙ এখনও আছে, কিন্তু সে চিকুণতা তো আর নাই। চাঁদের ফালির মত সেই কপালখনি আকারে চাঁদের ফালির মতই আছে, কিন্তু তাঁহাতে যেন গ্ৰহণ লাগিয়াছে, সে মসৃণ স্বচ্ছতা আর তাহাতে নাই। গালে সে টোলটি এখনও পড়ে, কিন্তু তাহার আশেপাশে সূক্ষ্ম হইলেও সারি দিয়া রেখা পড়িতে শুরু করিয়াছে-এক দুই তিন। নাকের ডগায় কালো মেচেতার রেশ দেখা দিয়াছে। সেই সে, সেই সব, কিন্তু সে নবীন লাবণ্য তাহার আর নাই। এই দীর্ঘ দিনে পৃথিবীর ধূলামাটি তাহাকে স্নান করিয়াছে। তাড়াতাড়ি সে আয়নাটা বন্ধ করিয়া দিল। আবার তাহার কাঁদিতে ইচ্ছা করিল। রঞ্জনের অবহেলার জন্য নয়, তাহার রূপের জন্য কাঁদিতে ইচ্ছা হইল। কয় ফোঁটা চোখের জল ঝরিয়া পড়িয়া মাটির বুকে মিশিয়া গেল।

থাকিতে থাকিতে বিদ্যুৎচমকের মত মনে পড়িয়া গেল আর একজনের কথা। বৃদ্ধ রসিকদাস-বগ-বাবাজীর মুখ বহুদিন পরে তাহার চোখের সম্মুখে যেন ভাসিয়া উঠিল। সেই কৌতুকোজ্জ্বল হাসি-হাসি মুখ। কমলের মনে হইল মহান্ত ব্যঙ্গভরে হাসিতেছে। কিন্তু পরীক্ষণেই সমস্ত অন্তর তাহার প্রতিবাদ করিয়া উঠিল-না না না। সে তাহাকে বলিত, কৃষ্ণপূজার কমল। সে-ই তাহার নাম দিয়াছে।–রাইকমল। কমল শুকায়, কিন্তু রাইকমল, সে তো কখনও শুকায় না! আবার সে শিহরিয়া উঠিল, মনে পড়িল পরীকে। পরী ব্যঙ্গভরে হাসিতেছে যেন—সেই জীৰ্ণ শীর্ণ বীভৎস মরণাতুর মুখ।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress