জয়দেবধামের মন্দির প্রাঙ্গণে
জয়দেবধামের মন্দির প্রাঙ্গণে রঞ্জনকে বরণ করিয়া সেখান হইতেই কমল তাহার অনুগামিনী হইল। ঘরের কথা মনে হইল না। কাদুর কথা মনে হইলেও কাদু যেন অনেক ছোট হইয়া গেল। মনে মনে ভাবিল, ইহার পর ননদিনীকে একটা সংবাদ পঠাঁইয়া দিলেই হইবে, কিংবা তাহারা দুই জনে গিয়া একেবারে তাহার দুয়ারে দাঁড়াইয়া ভিক্ষা চাহিবে। পোড়ারমুখী ননদিনী ছুটিয়া আসিয়া অবাক হইয়া যাইবে।
কল্পনার জাল বুনিতে বুনিতে রঞ্জনের সঙ্গে তাহার আখড়ায় যখন গিয়া পৌঁছিল, বেলা তখন যায়, গোধূলির আলো ঝিকমিক করিতেছে।
মনের মধ্যে উল্লাসের তৃপ্তির আর পরিসীমা ছিল না তাহার। কিন্তু সে উল্লাস বাহিরে প্রকাশ করিবার যেন উপায় ছিল না। রঞ্জনকে সম্ভাষণ করিবার যোগ্য সম্বোধন সে খুঁজিয়া পাইতেছিল না। তাহার লঙ্কা-কিন্তু ছিঃ, মহান্ত বলিতেও যে লজ্জা হয়, মনও ওঠে না। মনে মনে বিচার করিয়া লঙ্কার’ চেয়ে ‘মহান্ত’ সম্বোধন কিছুতে সে প্রিয়তর বা মধুরতর মনে করিতে পারিল না।
রঞ্জন উল্লসিত হইয়াছিল। কপোতীকে বেড়িয়া কপোত যেমন অনর্গল গুঞ্জন করিয়া ফেরে, তেমনই ভাবে সে কখনও কমলের আগে, কখনও পিছনে পথ চলিতে চলিতে অনর্গল কথা কহিয়া চলিয়াছিল।
গ্রামে ঢুকিবার মুখে রঞ্জন বলিল, আজ সন্ধেতে কিন্তু আমার ঠাকুরকে গান শোনাতে হবে কমল।
কমল ঘাড় নাড়িয়া সায় দিল। মনে মনে স্থিরও করিয়া রাখিল, কোন গান সে গাহিবে। গানের কলিগুলি মনের মধ্যে তাহার এখনই গুঞ্জন করিয়া উঠিল–
আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়নু
পেখনু পিয়ামুখচন্দা।
আখড়ার নিকটে আসিয়া আগড় খুলিয়া রঞ্জন বলিল, এস, এই আমার আখড়া।
প্রাঙ্গণে দাঁড়াইয়া কমল চারিদিকে চাহিয়া চাহিয়া দেখিল। আখড়াটি সুন্দর। শুধু সুন্দর নয়, ভিক্ষুকের ভবনের মধ্যেও সচ্ছল সমৃদ্ধির পরিচয় চারিদিকেই সুপরিস্ফুট। একদিকে জাফরিবোনা বাঁশের বেড়ার মধ্যে গাদ্দাফুলের গাছ। গাছগুলির সর্বাঙ্গ ভরিয়া ভারে ভারে ফুল ফুটিয়া আছে। মাঝে মাঝে কয়টা রাধাপদ্মের গাছে বড় বড় হলদে ফুলের সমারোহ। কয়টা সন্ধ্যামণি গাছে তখন সদ্য সদ্য রাঙাবরন ফুল ফুটিতেছিল। ওপাশে পাঁচ-ছয়টা আমগাছ মুকুলে যেন ভাঙিয়া পড়িয়াছে। মোঝ আঙিনায় একটা সজিনা গাছের পুষ্পিত শীর্ষগুলি মাটির দিকে নুইয়া পড়িয়া বাতাসে অল্প অল্প দুলিতেছে।
সম্মুখেই দাওয়া-উঁচু বাঁধানো-মেঝে মেটে ঘর একখানি। তাহার ঠিক পাশেই ঘরখানির সহিত সমকোণ করিয়া আর একখানি ছোট্ট ঘর। তাহারও বাঁধানো মেঝে। আকারে প্রকারে মনে হয়, এইটিই বিগ্রহ-মন্দির। দুয়ারের চৌকাঠে, সিঁড়িতে আপনার দাগ অস্পষ্ট হইলেও দেখা যাইতেছিল।
কমলের অনুমানে ভুল হয় নাই। রঞ্জন গিয়া ঘরের দুয়ার খুলিয়া দিয়া কহিল, এস, প্ৰণাম করি।
কমল দেখিল, মন্দিরের মধ্যে গৌরাঙ্গ-বিগ্রহ। রঞ্জন ও কমল পাশাপাশি বসিয়া ভক্তিভরে প্ৰণাম করিল।
মহান্ত!
পিছনে অস্বাভাবিক দুর্বল কণ্ঠস্বরে কে যেন বুক ফাটাইয়া চিৎকার করিয়া উঠিল। কমল চমকিয়া উঠিল। প্ৰণাম তাহার সম্পূর্ণ হইল না, সে পিছন ফিরিয়া দেখিল, ও-ঘরের দাওয়ার উপরে অদ্ভুত এক নারীমূর্তি প্ৰাণপণে দুই হাতে মাটি আঁকড়াইয়া ধরিয়া কাঁপিতেছে! কমল শিহরিয়া উঠিল। মানুষের এমন ভয়ঙ্কর কুৎসিত পরিণতি সে আর দেখে নাই। কঙ্কালাবশেষ জীৰ্ণ দেহ হইতে বুকের কাপড় শিথিল হইয়া খসিয়া পড়িয়া গিয়াছে। কমল দেখিল, সে-বুকে অবশিষ্টের মধ্যে শিথিল চর্মের আবরণের মধ্যে শুধু কঙ্কালের স্তুপ। সেই স্তুপ ভাঙিয়া বাহিরে আসিবার জন্য প্রাণ হৃৎপিণ্ডের দ্বারো যেন উন্মত্তভাবে মাথা কুটিতেছে।
রঞ্জন কর্কশকণ্ঠে কহিল, এ কি! আবার তুই বাইরে এসেছিস পরী? পরী!
অজ্ঞাতসারে কমল অস্ফুট স্বরে বলিয়া উঠিল, পরী!
এই পরী! সেই পরীর এই দশা! সেই হৃষ্টপুষ্ট শ্যামবর্ণ মেয়ে এমন হইয়া গিয়াছে! সেই পরিপুষ্ট সুডৌল মুখ এমন শীর্ণ দীর্ঘ দেখাইতেছে! মুখে ও চামড়ার নিচে প্রত্যেকটি হাড় দেখা যায়। গালের কোনো অস্তিত্বই নাই যেন, আছে শুধু দুইটা গহ্বর। পরীর চুলের শোভা ছিল কত! কিন্তু এখন সেখানে সাদা মসৃণ চামড়া বীভৎসভাবে চকচক করিতেছে। যে কয়গাছ চুল আছে, তাহার বর্ণ পিঙ্গল, রুগণ কর্কশতায় বীভৎস। চর্মসার কঙ্কালের মধ্যে অস্বাভাবিক উজ্জ্বল শুধু দুইটি চোখ, চোখ দুইটা যেন দপদপা করিয়া জ্বলিতেছে। শীর্ণ দেহের মধ্যে কোথাও স্থান না পাইয়া মানবহৃদয় যেন ওইখানে বাসা গাড়িয়াছে। ক্ৰোধ, হিংসা, অভিমান, লোভ, মমতা, স্নেহ সব আত্মপ্রকাশ করে ওই দৃষ্টির মধ্য দিয়া।
রঞ্জনের কর্কশ তিরস্কারে পরী কর্ণপাত করিল না। সে আর্তকণ্ঠে চিৎকার করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ও কে মহান্ত?
দৃষ্টি দিয়া পরী যেন কমলের রূপসম্ভীরভরা সর্ব অবয়ব গ্রাস করিতেছিল।
রঞ্জন বলিল, চিনতে পারলে না? ও যে কমল। তুমি যে আমায় বলেছিলে পরী—
পরী পাগলের মত দুই হাতে আপনার বুক চাপড়াইয়া বলিয়া উঠিল, না না না, বলি নাই; বলি নাই আমি। সে আমি মিথ্যে বলেছি। তোমার মন রাখতে, মন বুঝতে বলেছি আমি।
হা-হা করিয়া সে কাঁদিয়া উঠিল।
কমল থরথর করিয়া কাঁপিতেছিল। রঞ্জন তাহার হাত ধরিয়া ডাকিল, কমল, কমল!
দেবতার ঘরের খুঁটিটা ধরিয়া কমল বলিল, পরী বেঁচে থাকতে তুমি এ কি করলে? আমায় তো তুমি বল নাই! ছি!
রঞ্জন বলিল, পরী মরেছে, সে কথা তো আমি বলি নাই কমল।
সে কথা সত্য কি না যাচাই করিয়া দেখিবার সময় সে নয়। কমল বলিল, ধর ধর, তুমি পরীকে গিয়ে ধর। পড়ে যাবে, পড়ে যাবে হয়ত।
রঞ্জন পরীকে ধরিয়া ডাকিল, পরী, পরী!
তাহার পায়ের উপর আছড়ে খাইয়া পরী বলিল, কি করলে গো, এ তুমি কি করলে? দুটো দিন সবুর করতে পারলে না? আমি তো বাঁচিব না। দুদিনও হয়ত বাঁচব না। দুদিনের জন্যে আমার বুকে এ তুমি কি শেল হানলে গো?
আবার সে হা-হা করিয়া কাঁদিয়া উঠিল।
রক্তমাংসের মানুষ লইয়া এ কি কুশ্রী কড়াকড়ি! কমলের করুণা হইল। ওই মেয়েটির বুকে যে আজ কি বেদনা, কত তাহার পরিমাণ, সে তো নিজে নারী, সে তাহা বোঝে। শুধু তাই নয়, আজ যে তাহাকে কঠোরভাবে জানাইয়া দেওয়া হইল, তোমায় মরিতে হইবে—একান্ত নিঃস্ব রিক্ত হইয়া কাঙালিনীর মরণ মরিতে হইবে।
কমলের চক্ষে জল দেখা দিল। সে আসিয়া পরীর পায়ের কাছে বসিয়া বলিল, পরী, আমার ওপর রাগ করলি ভাই?.
বেরো—বেরো-দূর হ-দূর হ। চিৎকার করিয়া পরী তাহার কঙ্কালসার দেহে যতখানি শক্তি ছিল প্রয়োগ করিয়া কমলকে লাথি মারিয়া বসিল। অতর্কিত কমল নিচে উল্টাইয়া পড়িয়া গেল। রঞ্জন কিছু করিবার পূর্বেই কমল নিজেই উঠিয়া বসিল।
ও কি, তোমার ভুরু থেকে রক্ত পড়ছে যে! রঞ্জন পরীকে ছাড়িয়া দিয়া কমলের পরিচর্যার
পরীর চোখ বাঘিনীর চোখের মত হিংস্র দীপ্তিতে দপদপ করিয়া জ্বলিতেছিল।
সে দৃষ্টি কমল দেখিয়াছিল। ভ্রতে বুলানো রক্তমাখা হাতখানি দেখিতে দেখিতে সে বলিল, না না, লাগে নাই আমার। যাও, তুমি পরীকে ধর-ও রোগা মানুষ। আমি নিজেই ধুয়ে ফেলছি।
কমল এপাশ-ওপাশ অনুসন্ধান করিয়া দেখিল, একটি চারা আমগাছের তলায় জল ফেলিবার জন্য একটুখানি স্থান বীধানো রহিয়াছে। বালতির জল লইয়া সে ভ্রর রক্ত ধুইতে বসিল। ধুইতে ধুইতে শুনিল, পরী বলিতেছে, না না, এমন করে তুমি চেও না। রাগ করো না। দুটো দিন, দুটো দিন ওকে পর করে রাখ। আদর কোরো না, কথা কয়ে না। দুটো দিন গো, দুদিন বৈ আর আমি বঁচব না। সত্যি বলছি।
–সন্ধ্যায় দেবতার সম্মুখে নিত্য কীর্তন হয়। রঞ্জন কমলকে বলিল, এস, আমার প্রভুকে গান শোনাবে এস!
কমল বলিল, না।
রঞ্জন আশ্চর্য হইয়া গেল। বলিল, সে কি! এ এখানকার নিয়ম। আর এরই মধ্যে লোকজন এসেছে সব, তাদের বলেছি আমি।
কমল দৃঢ়স্বরে বলিল, না। পরীর অবস্থাটা ভাব দেখি। আমার গান শুনলে সে হোত পাগল হয়ে উঠবে।
রঞ্জন একটা দীৰ্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, হুঁ।
কমল আবার বলিল, যাও, তুমি নাম-গান আরম্ভ করে গে, সন্ধে বয়ে যাচ্ছে। আমি বরং যাই, দেখেশুনে পরীর জন্যে একটু সাবুকি বার্লি চড়িয়ে দিই।
রঞ্জন অকস্মাৎ উত্তেজিত হইয়া উঠিল। সে কমলের হাত ধরিয়া বলিল, কমল, আগে দেবসেবা পরে মানুষ। এস বলছি।
ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া কমল বলিল, আমারও এতদিন তাই ছিল। কিন্তু আজ আমি ধৰ্ম পালটেছি। ছাড় আমাকে তুমি।
রঞ্জন হাত ছাড়িয়া দিল। কমল ধীরপদক্ষেপে ওদিকে চলিয়া যাইতেছিল, রঞ্জন অকস্মাৎ বলিয়া উঠিল, মরবেও না, আমারও অশান্তি ঘুচিবে না।
কমল ঘুরিয়া দাঁড়াইল। ভর্ৎসনাপূর্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল, দেবতার পায়ে প্রাণ ঢেলেও দেবতার সাড়া পাই নি। দেবতা পাথরের বলে মানুষকে ধরেছি জড়িয়ে। মানুষের ওপর ঘেন্না ধরিয়ে দিও না। আর। ছি!
রঞ্জন এতটুকু হইয়া গেল। ঘরের ভিতরে দুর্বল ক্ষীণ, কণ্ঠস্বরে পরী গুমরিয়া গুমরিয়া কাঁদিতেছিল।
রঞ্জন নিজেই খোল লইয়া দেবতার দুয়ারে বসিল।
কীর্তন ভাঙিয়া গেলে ফিরিয়া আসিয়া ডাকিল, কমল!
কমল তখন পরীর কাছে বসিয়া ছিল। পরীর সবে একটু তন্দ্ৰা আসিয়াছে। কিন্তু তখনও তাহার তন্দ্ৰাতুর বক্ষের ক্ৰন্দনকম্পিত দীর্ঘশ্বাস মধ্যে মধ্যে বাহির হইয়া আসিতেছিল।
কমল সন্তৰ্পণে বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল।
রঞ্জন বলিল, নাও।
সে একডালা ফুল আগাইয়া দিল। কমল হাত বাড়াইয়া লইল। কিন্তু জিজ্ঞাসু নেত্ৰে তাহার দিকে চাহিয়া রহিল।
রঞ্জন হাসিয়া বলিল, ফুলশয্যা—
না।
রঞ্জন আশ্চর্য হইয়া প্রশ্ন করিল, কেন?
কমল ম্লান হাসি হাসিয়া বলিল, ভুল করে করেই জীবন চলেছে আমার। যত বড় মানুষ আমি, ভুলের পর ভুল জমা করলে সেও বোধহয় তত বড়ই হবে। আবারও বোধহয় ভুল করলাম আমি।
রঞ্জন কমলের কথার অর্থ বুঝিতে পারিল না। সে বিক্ষিত নেত্রে তাহার দিকে চাহিয়া রহিল। কমল বলিল, যে মানুষের প্রয়োজন নাই, তার কি কোনো দাম নাই তোমার কাছে? একবার পরীর কথা ভাব দেখি।
রঞ্জন বলিয়া উঠিল, তুমি কি পাথর?
আমি? কমল হাসিল। তারপর আবার বলিল, পাথর হলে পাথরেই মন উঠত লঙ্কা, এ কথা আর একবার বলেছি। মানুষ বলেই মানুষের জন্যে পাগল হয়েছি, মানুষের জন্যে মমতা না করে যে পারি না।
আচ্ছা, থাক। রঞ্জন ঈষৎ উষ্মাভরেই সেখান হইতে চলিয়া যাইতেছিল।
পরী আবার চিৎকার করিয়া উঠিল, না না, সরে যা তুই বলছি।
সভয়ে কমল বাহিরে আসিয়া রঞ্জনকে বলিল, যাও ডাকছে তোমায়। একান্ত অনিচ্ছার সহিত রঞ্জন পরীর শয্যাপার্শ্বে গিয়া দাঁড়াইল। পরী বলিল, আজ তোমার ফুলের বাসর হবে, নয়? তোলা বিছানার মধ্যে তোশক বালিশ–
বাধা দিয়া রঞ্জন বলিল, থাক থাক, ওসব তোমাকে ভাবতে হবে না পরী।
না। বিছানা নামিয়ে নাও গে। কিন্তু আমি শখ করে যা যা করিয়েছি, সেগুলো নিও না। সে আমার, সে আমি সইতে পারব না। প্ৰাণ থাকতে সে দেখতে আমি পারব না।
উত্তরে রঞ্জন অতি কটু একটা জবাব দিতে গেল। কিন্তু পিছনে লঘুপদশব্দে কমলের অস্তিত্ব অনুভব করিয়া সে তাহা পারিল না। শুধু পরীর মাথায় হাত বুলাইতে চেষ্টা করিল। পরী হাতখানা ঠেলিয়া দিয়া বলিল, থাক।
রঞ্জনও যেন বাঁচিল, সে চলিয়া গেল।
খাওয়াদাওয়ার পরে রঞ্জন তামাক খাইতেছিল। কমল আসিয়া কহিল, তোমার বিছানা পরীর ঘরে।
রঞ্জন চমকিয়া উঠিল। কমল বলিল, ‘না’ বলতে পাবে না। আমার কথা তোমাকে শুনতে হবে।
রঞ্জন আর আত্মসংবরণ করিতে পারিল না-বার বার অস্বীকার করিয়া বলিল, না না। রোগীর গায়ের গন্ধে আমার ঘুম হবে না।
শান্তভাবে কমল প্রত্যুত্তরে বলিল, তা হলে আমারও যদি কোনো দিন ওই পরীর মত দশা হয়, তবে তো তুমি এমনই করেই আমাকে জঞ্জালের মত ঘেন্না করবে, আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিতে চাইবে!
রঞ্জন চুপ করিয়া রহিল। কিছুক্ষণ পরে সে হাসিমুখেই কমলের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, তোমার জয় হোক কমল।
কমল হেঁট হইয়া রঞ্জনের পায়ের ধূলা লইল। রঞ্জন মুহূর্তে অবনত কমলকে বুকে টানিয়া তুলিয়া লইল, চুম্বনে চুম্বনে অধর ভরিয়া দিল, সবল পেষণে যেন পিষ্ট করিয়া দিতে চাহিল। কমলের চোখ দুটিও আবেশে মুদিয়া আসিতেছিল। এ আনন্দ তাহার অনাস্বাদিতপূর্ব।রসিকদাসও তাহাকে এমনই আদরে বুকে লইয়াছে, কিন্তু সে যেন তাহাতে পাথর হইয়া যাইত। ঠিক এই সময়ে ভিতরে পরীর সাড়া পাওয়া গেল, সে বোধহয় আবার কাঁদিতেছে। মুহূর্তে আত্মস্থ হইয়া সে বলিল, ছোড়।
না।
কমল বলিল, ছাড়। যে মরতে বসেছে তাকে আর ঠকিও না।
রঞ্জনের বাহুবেষ্টনী শিথিল হইয়া আসিয়াছিল, কমল আপনাকে মুক্ত করিয়া লইয়া বলিল, যাও, শোও গে যাও। বলিয়া সে আর উত্তরের অপেক্ষা করিল না, এপাশের ঘরে ঢুকিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিল।
পরদিন প্ৰভাতে পরীর ঘরখানি পরিষ্কার করিবার জন্য সে সেই ঘরে ঢুকিল। ঝাঁট দিতে দিতে পরীর দিকে চাহিতেই সে দেখিল, পরী তাঁহারই দিকে চাহিয়া আছে। কমলের ভয় হইল, পরী হয়ত আবার উত্তেজিত হইয়া উঠিবে।
কমলি! পরী তাহাকে ডাকিল।
পরী আবার ডাকিল, শোন, আমার কাছে আয় ভাই কমলি! ভয় নাই। কমল কাছে আসিয়া বসিল। পরীর জীর্ণদেহে সস্নেহে হাত বুলাইয়া বলিল, ভয় কি ভাই! পরী সে কথার কোনো উত্তর দিল না। সে একটা দীৰ্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, রূপ একদিন আমারও ছিল।
কমল চমকাইয়া উঠিল। করুণ হাসি হাসিয়া পরী বলিল, তোকে আশীৰ্বাদ করব বলেই ডাকলাম ভাই। আজ ছ। মাস বিছানা পেতেছি, ছ। মাস এক পড়ে পড়ে কাঁদছি। বড় সাধ ছিল ভাই, সে সাধ তুই মেটালি। আশীৰ্বাদ করি—
আর সে কথা বলিতে পারিল না, অকস্মাৎ অস্থির চঞ্চল হইয়া উঠিল। কমল ব্যস্ত হইয়া ডাকিল, পরী পরী!
বালিশে মুখ গুঁজিয়া পরী শিশুর মত কাঁদিয়া উঠিল, বলিল, না না, তুই যা, তুই যা। আমার সামনে থেকে তুই যা।
ওই দিন সন্ধ্যাতেই পরী দেহ রাখিল। যেন ওই আকাঙক্ষাটুকুই তাহার জীবনকে জীৰ্ণ পিঞ্জরের মধ্যে বাঁধিয়া রাখিয়াছিল। বহুদিনের রোগী প্রায় সজ্ঞানেই দেহত্যাগ করে। পরীরাও তাহাই হইয়াছিল। বৈকালের দিকে শ্বাস উপস্থিত হইতেই রঞ্জন বলিল, পরী, চল, তোমাকে প্রভুর সামনে নিয়ে যাই, প্রভুকে একবার দেখ।
পরী হাত নাড়িয়া বলিল, না।
জীবনের জ্বালা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মানুষের বোধহয় যায় না। কষ্ট্রের পরিসীমা ছিল না। তবুও পরী হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, দেবতার সেবা অনেক করেছি, কিন্তু দেবতা আমায় কি দিলে? দেবতা নয়; মহান্ত, তুমিও না! তোমার মুখ আমার দেখতে ইচ্ছে করছে না। সরে যাও তুমি। আমি একা থাকব।
তারপর একটি সকরুণ হাসি হাসিয়া বলিল, আমি তো আজ একাই।
আপন জীবনের সমস্ত তিক্ত রসাটুকু হতভাগী নিঃশেষে পান করিয়া তবে গেল।