রথযাত্রা
[শ্রীকৃষ্ণ-বলরাম ও সুভদ্রার মিলনের গুহ্য রহস্য]
—————————————————————
একদিন দ্বারকায় শ্রী রুক্মিনী দেবী শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন, – “হে স্বামিন
হে প্রিয়তম,আমরা আপনার সেবিকা প্রেয়সী আপনার সেবা করে ধন্য হই।কিন্ত রাতে ঘুমের ঘোরে আপনার প্রণাপ বাক্য ও ক্রন্দন শুনে আমরা আশ্চর্য হয়ে যাই।
তার মর্ম বুঝতে পারি না।তাই আপনাকে জিজ্ঞাসা করি – কে সেই নন্দরাজ, নন্দরানী যাদের ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আপনি
খেঁজেন? আবার সে-ই বা কে যাকে আপনি রাধারানী রাধারানী বলে ডাকেন?
আরও নাম শুনি ললিতা,বিশাখা,সুবল,
সুদাম,শ্রীদাম, এরা কারা?
এতদিন জানতাম,আমরাই আপনার সেবিকা-প্রেয়সী। কিন্তু তারাই ধন্য যাদের আপনি ভালবাসেন, রাতদিন যাদের কথা চিন্তা করেন।আজ আপনাকে সমস্ত ব্যাপার খুলে বলতে হবে, প্রভু।
এই প্রশ্ন শুনে, শ্রীকৃষ্ণ বললেন,
দেখ আমি এখন সুধন্বা সভায় যাচ্ছি, ফিরে এসে সমস্ত কথা বলবো।
কিন্তু রুক্মিনী দেবী ছাড়েন না, তখনই তার
শুনবার ইচ্ছা। তখন শ্রীকৃষ্ণ বললেন, তাহলে রোহিনী মাতাকে জিজ্ঞাসা করো, তিনি সব কথা বলবেন।
রুক্মিনী,সত্যভামা,জাম্ববতী প্রমুখ আট মহিষী রোহিনী মায়ের কাছে গেল। তারা বলল,ম্নেহময়ী মা আমাদের বলুন, স্বামী কৃষ্ণ ঘুমের ঘোরে কাদের খোঁজেন,কাদের জন্য আকুলি বিকুলি কাঁদেন? আমরা কিছুই বুঝতে পারি না।
আপনি এই গোপন রহস্য আমাদের বলুন।
রোহিনী মা বললেন, তোমাদের সব কথাই বলবো, কিন্তু তার আগে একটা গোপন ঘরে চলো, আর দরজায় পাহারা রাখ, না হলে এই লীলার কথা বলতে আরম্ভ করলে মন্ত্রমুগ্ধ সাপের মতো কৃষ্ণ বলরাম এসে হাজির হবে। তখন আর বলা যাবে না।
রানীরা মিষ্টি কথায় সুভদ্রাকে বললেন,
সু্ভদ্রে তুমি এই দরজায় দ্বারী হয়ে পাহারা
দাও, দেখবে তোমার দাদারা যেন ঘরে ঢুকতে না পারেন। তোমাকে খুব সুন্দর মতির মালা আর পট্টবস্ত্র দেবো। সুভদ্রা রাজী হয়ে দরজা আগলে দাঁড়িয়ে রইল।
রোহিনী দেবী ব্রজের সৌন্দর্যের কথা বর্ণনা করে ব্রজবাসীর মহিমা কীর্তন আরম্ভ করলেন।সেই মহা মাধুর্যময় ব্রজপুরের সমুদ্রসম সম্পদের নিকট দ্বারকার বৈকুন্ঠ সম্পদ একবিন্দু মাত্র।
সেখানে কোটি কোটি মাধুর্যবতী কৃষ্ণপ্রিয়াগণ পরম পুরুষোত্তম কৃষ্ণের কান্তা রূপে বর্তমান। সেই মাধুর্যমন্ডিত বৃন্দাবনের লীলা স্মরণ করেই কৃষ্ণ বিলাপ করেন। ব্রজের মাধুর্য আর গোপীনাথ শ্যামের মাধুর্যের তুলনা কোথায়ও নাই।
ব্রজভূমির আর ব্রজবাসীর মাধুর্যের কথা আশ্চর্য হয়ে রানীরা পরম বিস্ময়ে শুনছেন। ইতিমধ্যে কৃষ্ণ বলরাম দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। সুভদ্রা দুই হাত দিয়ে তাদের দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছে।কিন্ত ব্রজলীলা শ্রবণ করে তারা প্রেমে আকুলি বিকলি করছে। মহাভাব তাদের শরীরে প্রকাশিত হচ্ছে। ফলে দুই হাত আর পা’দুটি ক্রমশ শিথিল হয়ে আসছে। চোখদুটি বিস্ফারিত হয়ে উঠছে।সুভদ্রার অবস্থাও সে’রকম।
এমন সময় নারদ এসে দরজায় তাদের এই ভাবাবেশে প্রেমময় মূর্তি দেখে এবং উভয়ের মধ্যে সুভদ্রা দেবীকে দেখলো।
তখন মহানন্দে নারদ স্তব শুরু করলেন।
নারদের স্তব শুনে কৃষ্ণ বলরাম পুনরায়
সহজ সুন্দর মূর্তি ধারণ করলেন। তখন নারদ প্রার্থনা করে বলল, হে প্রভু এমন অপূর্ব প্রেমময় মূর্তি আর কখনও তো দেখিনি। নীল শৈলে লবন জলধি তীরে নীলাচল ক্ষেত্রে এই অপূর্ব মূর্তি প্রকাশিত হোক। কৃষ্ণ বলরাম তথাস্তু বলে তার প্রার্থনা মঞ্জুর করলো।
কৃষ্ণের মহা প্রেমময় মূর্তি নীলাচল ক্ষেত্রে
ভক্তিমান উৎকল রাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন, মহারানী
গুপ্তিচা দেবী, শবররাজ বিশ্বাবসু , ইন্দ্রদ্যুম্নের প্রধানমন্ত্রী বিত্যাবতীকে নিমিত্ত করে লবন সমুদ্রতীরে দারুব্রহ্ম রূপে প্রকাশিত হয়ে আছেন আজও, বিশ্বাস ভক্তদের।
[ উৎকল ভাষায় লেখা ‘ মহাভাব প্রকাশ’ গ্রন্থ থেকে আহৃত।]