অর্জুন চাপা গলায় দুর্গাদাসকে বলল
অর্জুন চাপা গলায় দুর্গাদাসকে বলল, চুপ।
পাতলা অন্ধকারে কাজলের মুখ দেখা যাচ্ছিল না। ছেলেটা দুঃসাহসী। পাশপোর্ট ছাড়া যেভাবে এখানে এসে আত্মীয়ের পরিচয় দিয়ে বাস করছে, তা অর্জুন নিজেও পারত না। হঠাৎ বিলের ওপাশে একটা আওয়াজ হতেই কাজল সোজা হয়ে দাঁড়াল। তার মুখ, আওয়াজটা যেদিকে হল সেদিকে। অর্জুনও আওয়াজটা পেয়েছিল। দুর্গাদাসের নজরও সেদিকে। ওরা কাজলকে ধীরে-ধীরে বাড়ির ওপাশে ঝোপটার দিকে যেতে দেখল। এবং চোখের পলকেই ঘটে গেল ব্যাপারটা।
তিন-চারটে ছায়ামূর্তি ঝোপঝাড় থেকে লাফিয়ে পড়ল কাজলের ওপর। সে শব্দ করার আগেই ওরা ওকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে মিলিয়ে গেল ঝোপের মধ্যে। ততক্ষণে দুর্গাদাস নৌকোর ওপর উঠে দাঁড়িয়ে সড়কি তুলেছে ছুড়বে বলে। অর্জুন তাড়াতাড়ি তাকে বাধা দিল, না, চুপ। দুগাদাস যেন অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাল। সামলে বলল, ছার!
ততক্ষণে জলে বৈঠা পড়ার শব্দ হচ্ছে। ওরা দেখতে পেল দুটো সরু নৌকো পাঁই-পাঁই করে বিলের জল চিরে ছুটে যাচ্ছে। এবার দুগাদাসের গলা স্পষ্ট হল, এরা বেদিয়া। লোকটারে ধইর্যা নিয়া গেল। কন যদি পিছন ধরতে পারি।
কিছু দরকার নেই। তুমি এমন একটা জায়গায় নামিয়ে দাও যেখান থেকে থানা কাছে হবে। অর্জুন বলল। অগত্যা আদেশ পালন করছিল দুগাদাস।
ইউসুফভাই এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন। এবার বললেন, ওদের কি বেদে বলে মনে হল?
আমি স্পষ্ট বুঝতে পারিনি। তবে দুর্গাদাসের দেখতে ভুল হবে না।
আপনি কি অনুমান করেছিলেন বেদেরা আজ আসবে?
না। এটা আমার মাথায় ছিল না। আমার মনে হয়েছিল কাজল আজই গুপ্তধন খুঁড়তে নামবে। তা ছাড়া বেদেরা যে ওর লুকিয়ে থাকার জায়গাটা জানতে পেরেছে, তাই আমার জানা ছিল না। আচ্ছা, প্রতিশোধ নেওয়ার ব্যাপারে এরা কীরকম ভয়ঙ্কর হয়?
এরা মাঝে-মাঝেই আইনকানুন মানে না বলে পুলিশের খুব অসুবিধে হয়।
তীরে নেমে দুগাদাসের দেখানো পথে ওরা দ্রুত থানায় চলে এল। থানায় একজন সেপাই বসে ঢুলছিল। তাকে পাঠানো হল অফিসারকে বিছানা থেকে তুলে আনতে। তিনি এলেন খুব বিরক্ত হয়ে। অর্জুনদের দেখে একটু অবাকও!
অর্জুন বলল, মাফ করবেন, ডিস্টার্ব করতে বাধ্য হচ্ছি। ওই বেদের দল এইমাত্র ঘোষবাবুদের অতিথিকে তুলে নিয়ে গেছে নৌকোয়।
সে কী! কী করে তুলল?
ভদ্রলোক পায়চারি করছিলেন মন্দিরের কাছে। ওরা বাধা পায়নি।
আপনারা দেখলেন কী করে?
আমরা বিলে বেড়াচ্ছিলাম খাওয়াদাওয়ার পরে। নৌকো চড়তে মন্দ লাগছিল না।
আপনি শিওর, ওরা বেদে?
আমাদের মাঝি তাই বলল। কিন্তু এই লোকটাই যে ওদের মুক্তো চুরি করেছে–।
হাত তুলে অর্জুনকে থামালেন অফিসার, আমারই ভুল হয়েছে। বিকেলে আপনারা চলে যাওয়ার পরে বেদেরা এসেছিল, জানতে, আসামিকে পাওয়া গেছে কি না। তাদের ভরসা দিতে পারিনি। তখন ওরা বলেছিল কালীগঞ্জে তিনজন নতুন মানুষ এসেছে। সেই খবর আমি জানি কি না। তাদের আপনাদের কথা বললাম। আর জানালাম ঘোষবাবুর বাড়িতে যিনি এসেছেন তার দাড়ি নেই। ওরা নিশ্চয়ই খোঁজ-খবর নিয়েছে। ঘোষবাবু জানেন ব্যাপারটা?
বোধ হয় না। আপনি কি ছেলেটাকে উদ্ধার করতে পারেন না?
নিশ্চয়ই করতে হবে। কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিলে শাস্তি পাবেই। এই বেদেরা খুব ডেঞ্জারাস। এর মধ্যে যদি ওকে কেটে বিলে ফেলে না দেয়, তা হলে…। অফিসার ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন লোক ডাকতে। একটু বাদে ভ্যান রেডি হয়ে গেল। ওদের সামনে দিয়ে সেটা রওনা হতে আর কিছু করার ছিল না। ইউসুফভাই বললেন, দারোগা নিশ্চয়ই বেদেদের ডেরায় যাচ্ছেন।
বাড়ি ফিরে শুয়ে পড়েছিল ওরা। অর্জুনের ঘুম আসছিল না। ওপাশের খাটে ইউসুফভাই নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছন। অর্জুনের মনে হল, সন্ধেবেলায় কাজলের পরিচয় অফিসারকে জানিয়ে দিলে ওকে বেদেদের হাতে মারা যেতে হত না। কয়েক বছর জেল খাটিয়ে বাংলাদেশ সরকার হয়তো ওকে ভারতবর্ষে ফেরত পাঠিয়ে দিতেন। মাঝরাতের পর দরজায় শব্দ হল। কেউ টোকা দিচ্ছে।
অর্জুন উঠে দরজা খুলতেই দুর্গাদাসকে দেখতে পেল। দুগদাসের শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। সে চমকে উঠল, কী হয়েছে?
লোকে বলে মানুষের উপকার করতে নাই। বড় কতা বলতেন কথা মিথ্যা। কিন্তু আজ বুঝছি লোকের কথাই সত্যি। দুর্গাদাস বলল।
তাকে ঘরে ঢুকিয়ে যতটা পারে ক্ষত মুছিয়ে দিল অর্জুন। তারপর জিজ্ঞেস করল, এই গ্রামে ডাক্তার আছেন?
হ।
ইউসুফভাইয়ের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। দৃশ্যটি দেখে তিনি উদ্যোগ নিলেন ডাক্তার ডেকে আনার। ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইজিচেয়ারে দুর্গাদাসকে শুইয়ে দিল অর্জুন। বলল, বিশ্রাম নাও। ততক্ষণে বাড়ির অনেকেই জেগে উঠেছে। ইদ্রিস মিঞাও হাজির। অতএব সবার সামনেই ঘটনাটা বলতে হল। অর্জুনদের তীরে নামিয়ে দিয়ে দুর্গাদাসের মনে হয়েছিল, চোখের সামনে ওরা অন্যায় করে পার পেয়ে যাবে এমনটা সহ্য করা যায় না। সে নিজে ডাকাতি করা ছেড়ে দিয়েছে অনেকদিন, কিন্তু অন্যায় সহ্য করবে কেন? সঙ্গে সঙ্গে সে নৌকো নিয়ে ওদের পেছনে ধাওয়া করেছিল। যেহেতু বেশ কিছুটা সময় চলে গেছে, তাই প্রথমে ওদের খুঁজে পায়নি সে। গাজিপুরের কাছে এসে শেষপর্যন্ত ওদের দেখা পায়। বেদেরা অত্যাচার করছিল লোকটার ওপর। তাকে দেখতে পেয়ে বলে সরে যেতে। বলে ওই লোকটা চোর, তাদের মুক্তো চুরি করেছে। মুক্তো বের করলে হাত কেটে ছেড়ে দেবে, না করলে মুণ্ডু কাটবে। দুর্গাদাস প্রতিবাদ করে বলে, চুরি করেছে যখন, তখন থানায় নিয়ে যাও। বিচার যা করার, তা পুলিশ করবে। তখন বেদেরা তাকে শাসাতে থাকে। সেই শাসানি শুনে তার মাথায় রক্ত উঠে যায়। নৌকো কাছে ভিড়িয়ে সড়কি নিয়ে লাফিয়ে পড়ে সে। বেদেদের সঙ্গে মারপিট হয়। শরীরে কাটা-হেঁড়া হলেও দমে যায় না সে। তারপর লোকটাকে মুক্ত করে বলে ওর সঙ্গে হাত মেলাতে। বেদেদের সে তখন জলে ফেলে দিয়েছিল। চারটে রুগণ বেদে তার সঙ্গে পারবে কেন? ঠিক তখনই ওই লোকটা তার কাঁধে বৈঠা দিয়ে আঘাত করে। নৌকোর ওপর পড়ে যায় দুর্গাদাস। সেই সময় লোকটা আর-একটা নৌকো পাড়ে ভিড়িয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। বেদেরা নৌকোয় উঠে দুগাদাসের অবস্থা দেখে বলে, সাপকে দুধ খাওয়ালেও যে ছোবল মারে, তা আর কবে বুঝবেন ভাই। দুর্গাদাস ওদের কাছে প্রতিজ্ঞা করে, যেভাবেই হোক লোকটাকে ধরে শাস্তি দেবে। ততক্ষণে বেদেরা ওকে চিনতে পেরেছিল। তার ডাকাতি-জীবনের কাহিনী একজন জানত। ওরাই দয়া করে তাকে এখানে পৌঁছে দিয়ে গেছে।
ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে অবাক! যে-পরিমাণ আহত হয়েছে দুর্গাদাস, তাতে এই বয়সে এতদূরে আসতে পারাটাই বিস্ময়কর। তখনই তাকে গাজিপুরের হাসপাতালে ভর্তির জন্য নিয়ে যাওয়া হল। ভোর হল। ঘুমের কোনও অবকাশই ছিল না। আলো ফুটতেই অর্জুন ইউসুফভাইকে নিয়ে হাঁটতে বের হল। ইউসুফভাই বললেন, মনে হয় কাজল এবার এই তল্লাট ছেড়ে পালিয়ে যাবে।
অসম্ভব। লোভ এমন জিনিস, একবার কামড়ালে আর ছাড়তে চায় না।
গাজিপুর এখান থেকে কতদূরে জানেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
আসবার সময় মনুভাই দেখিয়েছিলেন। হেঁটেই আসা যায়।
তা হলে ও গাজিপুরে আস্তানা গাড়বে আর রাত্রে ঘোষবাড়িতে হানা দেবে।
পুলিশকে ব্যাপারটা জানিয়ে দিতে হয়! ইউসুফভাই বললেন, ডেঞ্জারাস লোক, যার জন্য বাঁচলি, তাকেই তুই মারলি?
কথা বলতে বলতে ওরা ঘোষবাড়ির সামনে পৌঁছে গিয়েছিল। সেখানে তখন পুলিশ অফিসারের ভ্যান দাঁড়িয়ে। ওরা এগোতেই অফিসার আর বিমানবিহারীকে দেখা গেল কথা বলতে বলতে বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে
আসতে।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, খবর আছে কিছু?
কী করে থাকবে? গোয়েন্দা স্পটে থাকলে পুলিশ বোকা হয়ে যায়।
আপনি কিন্তু আমাকে অনর্থক ঠুকেছেন। আমি গোয়েন্দা নই।
তা ছাড়া বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি ছাড়া আপনি গোয়েন্দাগিরি করতেও পারেন না।
নিশ্চয়ই। তবে সত্যসন্ধান করে আপনাকে জানাতে পারি।
গুড। আপনার আসামি পালিয়ে গেছে। বেদেগুলো মিথ্যে বলবে না।
আমার সন্দেহ, গাজিপুরেই আছে।
থাকলে ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যে ধরা পড়বে। বাপধনের বিরুদ্ধে এখন দুটো চার্জ। মুক্তো চুরি এবং দূর্গাদাসকে আঘাত করা, যা থেকে মৃত্যু হতে পারত।
আরও আছে। অর্জুন হাসল।
তাই নাকি? কীরকম?
লোকটার আসল নাম কাজল মুখার্জি। তার সঙ্গে ঘোষ-পরিবারের কোনও সম্পর্ক নেই। বিমানবিহারী বাবুর ভালমানুষির সুযোগ নিয়ে এ বাড়িতে জাঁকিয়ে বসেছিল ভুয়ো পরিচয় দিয়ে।
বিমানবিহারী চমকে উঠলেন, সে কী! ও বিজনকাকা আর ওর ছেলে গগনবিহারীর নাম করল! ওদের কথা বলল।
স্বাভাবিক। যাতায়াত আছে। ওখানে সে আর একটা ক্রাইম করেছে, যা অবশ্য আপনাদের কাজে লাগবে না। যে অপরাধ শুনলে আপনি অবাক হবেন তা হল, কাজলবাবুর সঙ্গে এদেশে আসার কোনও বৈধ কাগজপত্র নেই।
তার মানে ও উইদাউট পাশপোর্ট এসেছে? অফিসার চেঁচিয়ে উঠলেন।
ঠিক তাই।
তা হলে মশাই একথাটা আমাকে কাল থানায় গিয়ে বলেননি কেন?
আমার নিশ্চিত হওয়া দরকার ছিল যে, ওই লোকটাই কাজল। কাজলের দাড়ি ছিল। আর আপনি বলেছেন এর দাড়ি নেই। তা হলে কী করে বলি?
হুম। আমি গাজিপুরে যাচ্ছি। অফিসার ভ্যানে চেপে চলে গেলেন।
এবার বিমানবিহারী বললেন, আচ্ছা, এই ধাপ্পাবাজ লোকটি আমার বাসায় উঠতে গেল কেন বলুন তো? আমার আত্মীয়দের খবরই বা নিয়ে এল কেন?
এর কারণ একটা চিঠি।
কী চিঠি? কার লেখা?
নুটুবিহারী বলে কেউ আপনাদের বংশে ছিলেন?
হ্যাঁ। তিনি আমার বাবার পিতামহের বড় ভাই। ওঁর ছেলে ইন্ডিয়ায় চলে গেলেও তিনি আজীবন আমাদের সঙ্গে ছিলেন। বিমানবিহারী বললেন।
আপনাদের ধারণা ছিল একান্নবর্তী পরিবারের শরিক হওয়া সত্ত্বেও নুটুবিহারী তাঁর ছেলেকে সাহায্য করতে প্রচুর টাকা ইন্ডিয়ায় পাঠিয়েছেন।
হ্যাঁ। আমার ঠাকুর্দা বলতেন তিনি সোনাদানাও ছেলেকে দিয়ে দিয়েছেন।
আর তাই আপনি বিজনবিহারীর কাছে অর্থসাহায্যের জন্য গিয়েছিলেন?
আপনি জানলেন কী করে?
কথাটা কি মিথ্যে?
না। সত্যি। পাকিস্তান আমলে আমি গিয়েছিলাম।
বিজনবিহারী বলেন তিনি এবং তাঁর পিতা সমস্ত টাকা শোধ করে দিয়েছেন। অর্জুন বলল, আর সোনাদানা কিছুই নেননি।
তা হলে সেগুলো গেল কোথায়?
হাঁ। সেটাই রহস্য! আর সেই কারণে কাজল মুখার্জির মতো একজন লোভী মানুষ বিনা পাশপোর্টে এখানে উপস্থিত হয়েছে। সে জানতে পেরেছে। ওই সোনাদানা এই বাড়ির কোথাও লুকোনো আছে। সেই কারণেই তাকে ছদ্মপরিচয়ে আপনার এখানে উঠতে হয়েছিল। অর্জুন শান্ত গলায় বুঝিয়ে বলল।
এ বাড়িতেই সোনাদানা লুকোনো আছে? বিড়বিড় করলেন বিমানবিহারী।
কাজল সেই খবরই পেয়েছে।
আচ্ছা অর্জুনবাবু, আপনি কি সত্যি গোয়েন্দা?
গোয়েন্দা নই, সত্যসন্ধানী।
ও। কিন্তু আপনাকে এইসব খবর কে দিল?
আমার মক্কেলের নাম আপনাকে বলতে বাধ্য নই।
আপনি বাংলাদেশে এসেছেন কেন? বেড়াতে, না সত্যসন্ধান করতে?
দুটোই। বাংলাদেশের হৃদয় দেখার খুব সাধ ছিল। পদ্ম, গঙ্গা, মেঘনা, যমুনা, শীতলক্ষ্যা অথবা আড়িয়াল খাঁ না দেখলে নিজেকে বাঙালি বলা যাবে না। সত্যসন্ধানের কাজটা যখন পাওয়া গেল তখন রথও দেখব কলাও বেচব।
আপনি জানেন সেইসব সোনাদানা কোথায় লুকোনো আছে?
অর্জুন হাসল, জানি। কিন্তু আরও অনেক কিছু না জানা পর্যন্ত বলব না।
কাজল মুখার্জি এখনও ধরা পড়েনি। গত দুদিনে গাজিপুরের মানুষ হঠাৎ-হঠাৎই একজন অচেনা মানুষকে দেখেছে, কিন্তু কিছু বলার আগেই সে উধাও হয়ে গিয়েছে। পুলিশের কল্যাণে তারা সবাই জানে একজন অপরাধী সেখানে লুকিয়ে আছে। গ্রামের মানুষ সজাগ থাকা সত্ত্বেও কাজল গ্রেফতার এড়িয়ে যাচ্ছে।
গাজিপুরের হাসপাতালে বৃদ্ধ দুর্গাদাস শুয়ে আছে সমস্ত শরীর ব্যান্ডেজে মুড়ে। অর্জুন এবং ইউসুফভাই তাকে দেখে এসেছে। দিনদশেক থাকতে হবে তাকে হাসপাতালে।
বিমানবিহারী গত দু রাত বাড়ি পাহারা দিয়ে কারও দেখা পাননি। অবস্থা এখন এমন, কাজলের পক্ষে যে-পথে এ-দেশে এসেছিল সেই পথে ভারতে ফিরে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
ইউসুফভাই ব্যবসায়ী মানুষ। তাঁর অনেক কাজ। অর্জুন ওঁকে ঢাকায় ফিরে যেতে অনুরোধ করেছিল, কিন্তু তিনি যেতে রাজি নন। মাঝে-মাঝেই পোস্ট অফিসে গিয়ে বাড়িতে ও অফিসে ফোন করছিলেন। কালীগঞ্জের রহস্য তাঁকে আটকে রেখেছিল। অর্জন এই দুটো দিন মাছ ধরে কাটাল। ইদ্রিস মিঞার হাতছিপ দিয়ে সে অনেক ছোট-মাছ ধরল।
তৃতীয় দিনে শুটিং পার্টি এল কালীগঞ্জে। নায়ক-নায়িকাকে দেখতে যেন মেলা বসে গেল। বিমানবিহারীর বাড়িতে তাদের রাখা হল, বাকিরা বিলের পাশে তাঁবু ফেলল। ইউসুফভাই শুটিং দেখতে গিয়েছিলেন, সন্ধের মুখে ফিরে এলেন আকাশবিহারীকে সঙ্গে নিয়ে। আকাশবিহারীর পেছনে সেই প্রযোজক।
আকাশবিহারী বললেন, কী মশাই, আমি আপনাকে আমন্ত্রণ জানালাম ঘোষবাড়িতে থাকার ব্যাপারে, আর আপনি মনুর বাড়িতে এসে উঠেছেন?
অর্জুন ইউসুফভাইকে জিজ্ঞেস করল, আপনি ওঁকে সব কথা বলেননি?
বলেছি, কিন্তু ওর কানে ঢুকছে না। ইউসুফভাই বললেন।
চলুন আপনি আমাদের ওখানে। জমিয়ে আড্ডা মারা যাবে। আকাশবিহারী বললেন।
অনেক ধন্যবাদ। এখানে আমি খুব ভাল আছি। আড্ডা মারার দরকার হলে যাওয়া যাবে, বেশিদূর নয় তো। কাজ ভাল হচ্ছে?
তা হচ্ছে। ও হ্যাঁ, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ একজন প্রতারককে বাড়ি থেকে তাড়াতে পেরেছেন বলে। আরে, আমাদের বাড়িতে গুপ্তধন লুকোনো আছে, অথচ সেটা আমিই জানতাম না। শোনামাত্র আমি মাসুদকে বললাম, আর তোমার ভয় নেই, ছবি শেষ হবেই।
মাসুদ কে?
ওই যে। বিখ্যাত প্রযোজক।
সেই বিশাল কালো মানুষটি মাথা নোয়ালেন সামান্য।
কিছুক্ষণ এলোমেলো কথা বলার পর কাজের কথায় এলেন আকাশবিহারী, এবার বলুন, গুপ্তধন কোথায় লুকোনো আছে? আপনি ইন্ডিয়া থেকে খবর নিয়েই এসেছেন। আমি যদি কালীগঞ্জের কথা নাও বলতাম তবু আপনাকে ওই কারণে এখানে আসতে হত!
শুনেছি সেটা আপনাদের বাড়ির মধ্যেই আছে।
সত্যি বলছেন না। মাটির তলায় থাকলে দুবিঘে জমি চষতে হবে। কতটা নীচে আছে তাও জানি না। কিন্তু আপনি জানেন। আকাশবিহারী এবার সিরিয়াস।
অর্জুন হাসল, আপনাদের বাড়ির মাটির নীচে যদি সোনাদানা পাওয়া যায় তা হলে এখন তার মালিক হবে কে?
কে আবার? আমি। আপনাদের ওই বিমানবিহারীর ক্ষমতা আছে আমার বিরুদ্ধে কথা বলার? ফোঁস করে উঠল আকাশবিহারী।
তা হলে আপনার উচিত এখনই কাজলকে খুঁজে বের করা।
কাজলকে?
হ্যাঁ। ওর কাছেই গুপ্তধনের নকশা আছে।
আপনি যে সত্যি বলছেন তার প্রমাণ কী?
সত্যি বলতে পারছি বলেই আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
কিন্তু আপনিও তো একজন প্রতারক হতে পারেন। ওই কাজলের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে এখানে আসতে পারেন। কী প্রমাণ আছে আপনার স্বপক্ষে?
এ-প্রশ্নের জবাব আপনাকে দেব না আকাশবিহারীবাবু। নিজেকে দিয়ে আপনি আমাকে বিচারের চেষ্টা করবেন না। দমদম এয়ারপোর্টে কিসের ভয়ে ওই মানুষদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে সাহস হয়নি, টেলিফোনের অভিনয় করতে হয়েছিল সেটা আমি জানি! অর্জুন কথাটা বলামাত্র আকাশবিহারী চমকে উঠলেন। পরমুহূর্তেই তাঁর চোখ জ্বলে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে তিনি বললেন, তার মানে আপনি আমাকে অনুসরণ করছিলেন?
না। মজার ব্যাপার হল কাঁচা ক্রিমিনালরা সহজেই নিজেকে ধরিয়ে দেয়।
আপনি সাপের গর্তে হাত ঢুকিয়ে খোঁচা মারছেন। এর ফল আপনাকে ভোগ করতে হবে। আকাশবিহারী আর দাঁড়ালেন না। দলবল নিয়ে চলে গেলেন। ইউসুফভাই বললেন, আপনি কাজটা ভাল করলেন না।
অর্জুন হাসল, মাঝে-মাঝে এরকম খারাপ কাজ করতে হয় ইউসুফভাই।
সেই রাতটাও ভালভাবে কাটল। শেষরাতে কেউ বা কারা বিল পেরিয়ে ঘোষবাড়িতে উঠেছিল নৌকো নিয়ে। আকাশবিহারী শুটিং পার্টি নিয়ে আসার পরে বিমানবিহারী আর বাড়ির বাইরে আসেননি। আকাশবিহারীর লোজন আগন্তুককে তাড়া করতে একটা নৌকোকে বিলে ছুটে যেতে দেখা যায়। ইউসুফভাইয়ের শুটিং দেখতে মজা লাগছে। তিনি সেখানে গেলেন। অর্জুন সাত-সকালে থানায় এল। অর্জুন বলল, অফিসার, আমার দৃঢ় বিশ্বাস কাজল গাজিপুরেই আছে। গত রাত্রে সে-ই এসেছিল।
ইম্পসিবল। আমি যেভাবে খুঁজেছি তাতে তার থাকার কোনও চান্স নেই।
বেশ। যে-লোকটা নৌকো নিয়ে এসেছিল তাকে গাজিপুরের দিকেই যেতে দেখা গেছে।
হুম। চলুন, যাবেন গাজিপুরে?
এরকম প্রস্তাব পাবে আশা করেনি অর্জুন। অফিসার তাকে এড়িয়েই চলছিলেন।
গাজিপুরে পৌঁছে অর্জুনের অনুরোধে বিলের দিকটায় গেলেন অফিসার। সেখানে গিয়ে জানা গেল ভোরবেলায় একটা নৌকোকে তীরে দেখা গেছে ভাসতে, যেটার ওখানে থাকার কথা নয়। নৌকোর মালিক বলল, কেউ রাত্রে নির্ঘাত ওটা চুরি করেছিল।
কাজল যদি সেই চোর হয়, তা হলে সে এই জায়গা দিয়েই গাজিপুরে ঢুকেছে। বিলের পাশে সবকটি ঝোপঝাড়, গাছ গ্রামের মানুষদের আবার খুঁজে দেখতে বলা হল। অর্জুন চারপাশে নজর রেখে গ্রামের দিকে এগোল। সামনেই একটা কবরখানা। বেশ পুরনো হলেও নিয়মিত পরিষ্কার করা হয়। আগাছা নেই বললেই চলে। এখানে কাজলের পক্ষে লুকিয়ে থাকা সম্ভব নয়। অর্জুনের দৃঢ় বিশ্বাস, সে লুকিয়ে আছে কোনও মানুষের কাছেই। তিনদিন না খেয়ে কেউ থাকতে পারে না। বনে-জঙ্গলে থাকতে হলে কাজলকে অভুক্ত থাকতে হবে।
অফিসার ওর পাশে এসে দাঁড়ালে অর্জুন বলল, আপনার পরামর্শ চাই।
বলুন।
আকাশবিহারী ঘোষকে আপনার কীরকম মনে হয়?
একটু বেপরোয়া। রাগী।
এই সময় দুটো দিশি কুকুর কবরখানার মুখটায় দাঁড়িয়ে চিৎকার শুরু করল। অফিসার একটা ঢিল ছুড়লেন তাদের তাড়াবার জন্য। কুকুরদুটো একটু সরে গিয়েও ফিরে এল।
কাজলের ধারণা, ঘোষবাড়ির মাটির তলায় গুপ্তধন আছে। আকাশবিহারী সেইটে কজা করতে চান। অথচ তিনি জানেন না কোথায় সেটা লুকোনো আছে। আপনি একটু খোঁজ নিন, এর মধ্যে আইনসঙ্গত কোনও ব্যাপার আছে কি না।
তার মানে?
বাংলাদেশ সরকারের কোনও আইন আছে কি না!
নিশ্চয়ই। যার কোনও দাবিদার নেই তা সরকারি কোষাগারে জমা পড়বে।
দাবিদার আছেন, কিন্তু তাঁরা জানেন না সম্পত্তির পরিমাণ কী অথবা কে রেখেছিল।
বাঃ, তা হলে দাবি টিকবে কেন?
কাজলের কাছে গুপ্তধনের বিশদ বিবরণ আছে। আকাশবিহারী যদি তাকে ধরতে পারেন, তা হলে ওঁর পক্ষে আগাম দাবি জানানো সুবিধে হবে।
বুঝতে পেরেছি। আমি আজই বড়কর্তাদের ব্যাপারটা জানাচ্ছি। কিন্তু আপনি যখন এত কথা জানেন, তখন গুপ্তধনের হদিসটা আপনারও জানা স্বাভাবিক।
আমি জানি। কিন্তু অফিসার, যিনি ওই সম্পত্তি মাটির তলায় পুঁতে গিয়েছিলেন, তিনি চাননি আকাশবিহারীরা ওগুলোর অধিকারী হোক।
এর কোনও প্রমাণ আছে?
হ্যাঁ। উনি একটি চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিটা কাজলের কাছে আছে।
কুকুরদুটো চিৎকার করছিল। ওরা এখন ভেতরে ঢুকে পড়েছে। একটা পুরনো কবরের সামনে গিয়ে ওরা গলা তুলছিল। অফিসার ঢিল মারতেই ওরা পালিয়ে গেল। অর্জুন কবরটার দিকে তাকাল। বেশ পুরনো কবর। পাশে মাটি উঠেছে। আর একটা মোটা পাটকাঠি ওর ভেতর থেকে বেরিয়ে আছে। অফিসার ফিরে যাচ্ছিলেন। অর্জন ওঁকে অনুসরণ করতে করতে আর-একবার কবরের দিকে তাকাতেই মনে হল পাটকাঠিটা স্থান পরিবর্তন করেছে। যেদিকে ছিল তার উলটোদিকে ঢলেছে এখন, অথচ বাতাস বইছে না।
অর্জুন দাঁড়িয়ে পড়তেই অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, কী হল?
এসব কবরের নীচে কফিন আছে?
থাকার কথাই। তবে বেশি পুরনো হয়ে গেলে শরীরের সঙ্গে সেগুলোও পচে যায়।
সেখানে মানুষ চেষ্টা করলে লুকিয়ে থাকতে পারে?
খুব কষ্ট হবে। নিশ্বাসের অসুবিধে হবেই।
যদি নাকের সামনে কোনও নলজাতীয় কাঠি লাগানো থাকে?
অফিসার হেসে ফেললেন, এমন অভিনব বুদ্ধি কার মাথায় আসবে?
আমার মাথায় যখন এল, তখন কাজলের মাথাতেও আসতে পারে।
তা হলে সবকটা কবর খুঁড়ে দেখতে হয়। ব্যাপারটার সঙ্গে এলাকার মানুষের সেন্টিমেন্ট ও ধর্মবিশ্বাস জড়িয়ে আছে। প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবতে পারবেন না।
সবকটা কবর খুঁড়ব কেন? আমরা বেরিয়ে গেলে কুকুরদুটোকে কবরখানায় ঢুকতে দিন। যে-কবরটার সামনে দাঁড়িয়ে ওরা চেঁচাবে, সেটাই পরীক্ষা করুন।
কোনও ক্লু পেয়েছেন নাকি?
আপনি আমার কথামতো পরীক্ষা করে দেখুন না! এটা তৃতীয় ব্যক্তি জানবে না।
ওরা বাইরে বেরিয়ে এলে কুকুরদুটোকে দেখা গেল না। তারা তাদের ধান্দায় চলে গেছে। অফিসার খুব নিরাশ হলেন, এখন কুকুর পাই কোথায়?
দূর থেকে কবরটাকে দেখার চেষ্টা করল অর্জুন। কাঠিটা আবার জায়গা বদলেছে। সে হাত বাড়িয়ে কবরটা দেখিয়ে দিল অফিসারকে। অফিসার সেদিকে এগিয়ে গেলেন। প্রথমে জায়গাটাকে ঘুরে দেখলেন ভদ্রলোক। তারপর হাত বাড়িয়ে কাঠিটাকে হ্যাঁচকা টানে ওপরে তুলে নিলেন। চোখের সামনে সেটা ধরে মাথা নাড়লেন।
তাঁর ইঙ্গিতে সবাই কবরটার কাছে পৌঁছে গেল। দেখা গেল, কবরের নীচের দিকে একটা গর্ত আছে, যার ভেতর দিয়ে নীচে ঢোকা অসম্ভব নয়। অফিসারের হম্বিতম্বিতে কা হল। ধীরে-ধীরে কাজলের মুণ্ডু এবং দেহ বাইরে বেরিয়ে আসতেই তাকে বেঁধে ফেলা হল। এখন তার চেহারা খুবই খারাপ দেখাচ্ছে। তিনদিনে পেটে তেমন কিছু পড়েনি বোঝা যাচ্ছিল।
অর্জুন বলল, কাজলবাবু, আমাকে মনে পড়ছে?
ফ্যালফ্যাল করে তাকাল ছেলেটা। কথা বলল না।
আমি অর্জুন। আপনি যখন পাশপোর্টের চেষ্টায় জলপাইগুড়ির থানায় গিয়েছিলেন, আমি তখন সেখানে বসে ছিলাম। জলপাইগুড়ির বদনাম করে ফেললেন আপনি!
ও! তোর জন্যই আমার এই অবস্থা? হিসহিস করে উঠল ছেলেটা।
আসামি ধরা পড়েছে শুনে পিলপিল করে লোকজন ছুটে আসছিল। অফিসার আর দাঁড়ালেন না। কাজলকে ভ্যানে তুলে সোজা থানায় ফিরে এলেন।
থানায় জিজ্ঞাসাবাদের সময় কাজল প্রথমে কিছুই বলছিল না। অল্পস্বল্প অত্যাচারের পর সে মুখ খুলল, আমি কোনও অন্যায় করিনি।
পাশপোর্ট ছাড়া বাংলাদেশে ঢোকোনি?
না। পাশপোর্ট চুরি গিয়েছে।
বেদেদের মুক্তো চুরি করোনি?
না।
নিজেকে ঘোষবাবুদের আত্মীয় বলে মিথ্যে পরিচয় দাওনি?
না। আমি সত্যিই আত্মীয় হতে যাচ্ছি। জলপাইগুড়ির গগনবিহারী ঘোষের মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ের কথা পাকা।
দুর্গাদাসকে তুমি মারোনি?
না। সে নিজেই পড়ে গিয়েছিল।
তা হলে কবরের মধ্যে লুকিয়ে ছিলে কেন?
বেদেদের ভয়ে। ভেবেছিলাম সব ঠাণ্ডা হয়ে গেলে থানায় গিয়ে নিজেই সাহায্য চাইব।
অফিসার বললেন, এ যে ঘোর মিথ্যেবাদী!
অর্জুন বলল, এই ঘটনার পরে টুকু বেঁচে যাবে, ওটুকুই লাভ।
টুকুকে তুই চিনিস? লাল চোখে তাকাল কাজল।
চিনব না কেন? ওর সরলতার সুযোগ নিয়ে আপনি চিঠিটা চুরি করে গুপ্তধনের লোভে এতবড় ঝুঁকি নিয়েছিলেন। অর্জুন বলল।
অফিসার বললেন, চিঠিটা দেখি?
কেন?
আমার দরকার, তাই। প্রশ্ন করা হচ্ছে। দাও চিঠিটা।
আমার কাছে নেই।
তৎক্ষণাৎ ওকে সার্চ করা হল। দেখা গেল চিঠিটা কাজলের সঙ্গে নেই। এই সময় থানার বাইরে হইচই শোনা গেল। আকাশবিহারী দলবল নিয়ে থানায় ঢুকলেন, আপনি কি ওঁকে অ্যারেস্ট করেছেন?
হ্যাঁ।
অভিযোগ?
অনেক।
উনি আমাদের অতিথি। আমি ওর জন্য জামিন হিসেবে এসেছি।
কোর্টে গিয়ে বলবেন।
অফিসার! আমার সঙ্গে ঝামেলা করবেন না। আমি সই করে ওকে নিয়ে যাচ্ছি। যখনই বলবেন কোর্টে পৌঁছে দিয়ে যাব কিন্তু ঘোষবাড়ির বদনাম হতে দেব না।
আপনি তো মশাই একে আগে চিনতেন না?
ঘোষবাড়ির রক্ত আমার শরীরে বইছে যে। টেলিফোনের কাছে এগিয়ে গেলেন তিনি, একটা ফোন করছি।
ফোনে যার সঙ্গে কথা বললেন ভদ্রলোক, তিনি কোনও বড়কর্তা হবেন। নিজে কথা শেষ করে অফিসারকে দিলেন রিসিভার। অফিসার আপত্তি জানাচ্ছিলেন। অফিসার রিসিভার নামিয়ে রেখে বললেন, কাজ হল না আকাশবাবু। বস আমাকে আইনমাফিক চলতে নির্দেশ দিয়েছেন। তবে আপনি ইচ্ছে করলে ওর সঙ্গে আলাদা কথা বলতে পারেন।
বেশ। তাই হোক।
পাশের ঘরে ওদের পাঠানো হলে অর্জুন অফিসারকে বলল, আপনার গাড়িটাকে কিছুক্ষণের জন্য পেতে পারি?
কেন?
খুব জরুরি ব্যাপার। এসে বলব।
ভদ্রলোকের অনুমতি এবং একজন সেপাই সঙ্গে নিয়ে পুলিশের গাড়িতে অর্জুন ছুটল গাজিপুরে। কবরখানায় পৌঁছে ও দৌড়ে গেল সেই কবরের কাছে, যেখান থেকে কাজলকে ধরা হয়েছিল। অনেক কষ্টে নীচে নামল সে। জায়গাটা প্রায় অন্ধকার। হাতড়ে-হাতড়ে কিছুই পাওয়া গেল না প্রথমে। তারপর উঠে এসে সে সেপাইকে একটা টর্চের ব্যবস্থা করতে বলল। মাটির নীচে শ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল তার। টর্চ পুলিশের গাড়িতেই ছিল। সেটা নিয়ে আসার পর অর্জুন আবার নীচে নামল। এবং তখনই সে কঙ্কালটাকে দেখতে পেল। একপাশে কাত করে রাখা হয়েছে। ভেতরে কাজলের কোনও জিনিসপত্র নেই। কঙ্কালটাকে টর্চের আলোয় পরীক্ষা করতে করতে হঠাৎ নজরে এল। করোটির গর্তে সেলোফেনে মোড়া কিছু ঢোকানো আছে। জিনিসটা বের করতেই সে খামটাকে পেয়ে গেল। পবনবিহারীকে লেখা নুটুবিহারীর চিঠি। যে-চিঠি রি করে টুকু দিয়েছিল কাজলকে।
ওপরে উঠে আসামাত্রই অর্জুন চিৎকারটা শুনতে পেল, হ্যান্ড্স আপ।
সে দেখল আকাশবিহারী এবং মাসুদ কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশবিহারীর হাতে রিভলভার। আকাশবিহারী বললেন, চিঠিটা দে।
গুলি করুন! কিন্তু চিঠিটা পাবেন না।
ইয়ার্কি হচ্ছে? ওই চিঠি আমার দরকার। আর দরকার মেটাতে আমি কখনও আপস করি না। তিন গুনব, তার মধ্যে না পেলে …।
অর্জুন খামটাকে মুঠোর মধ্যে করে সেপাইটার দিকে তাকাল। সে তালপাতার মতো থরথর করে কাঁপছে। খামটাকে মাটিতে ফেলে দিল অর্জন।
মাসুদ, ওটাকে তোল। আমাদের আর স্মাগলিং-এর ব্যবসা করতে হবে না। মাসুদ এগিয়ে আসছিল। হঠাৎ আর্তনাদ করে মাথা দুহাতে চেপে ধরে বসে পড়লেন আকাশবিহারী। অর্জুন দেখল রিভলভার তাঁর হাত থেকে মাটিতে পড়ে গেল। সে দ্রুত ছুটে গিয়ে রিভলভার তুলে নিতেই ইদ্রিস মিঞাকে দেখা গেল এগিয়ে আসতে। বৃদ্ধের হাতে লম্বা গুলতি।
অর্জুন অবাক হয়ে বলল, আপনি?
কেন ছার? একা দুর্গাদাসই পারে, আমি পারি না? আপনি আমাদের মেহমান, সেই মেহমানের ওপর এব্যাটা বন্দুক ওঠায়?
আপনি এখানে এলেন কী করে?
দুর্গাদাসরে দেখতে আইছিলাম। নাতি কইছিল গুলতি আনতে। এইটা কাজে লাগল। ইদ্রিস গলা তুলল, এই মিঞা, পালাইবেন না, এই বুড়ার হাতে এখনও তাগদ আছে।
আকাশবিহারী, মাসুদ এবং কাজলকে সদরে চালান করে দিয়ে অফিসার বললেন, বড়কর্তা আপনাকে ধন্যবাদ দিতে বলেছেন।
দুর। আমি কী করলাম! সবই তো আপনি করলেন।
আপনি কাল থাকবেন না?
না। আজই চলে যাচ্ছি।
কিন্তু কাল বড়কর্তার সামনে মাটি খোঁড়া হবে।
সেইজন্যই থাকব না। চিঠিটা নিয়ে যাচ্ছি। ক্লায়েন্টের চিঠি চুরি গিয়েছিল, সেটা তাঁকে ফেরত দেব। আপনি এর জেরক্স রেখে দিন। গুপ্তধন পাওয়া গেলে তা ওই চিঠি অনুযায়ী এখানকার ঘোষ-পরিবারের প্রাপ্য নয়। জলপাইগুড়ির ঘোষ-পরিবার যেহেতু এ দেশের নাগরিক নন, তাই তাঁরাও দাবি করতে পারেন না। কালীগঞ্জকে ভালবাসতেন বলে নুটুবিহারী এখানেই থেকে গিয়েছিলেন। অতএব ওঁর সম্পত্তি বাংলাদেশ সরকারের পাওয়া উচিত, যাতে তা দেশের মানুষের উপকারে লাগে।
দৃশ্যটা দেখবেন না?
না।
কেন?
যদি কিছুই না থাকে? যদি নুটুবিহারী মিথ্যে কথা লেখেন? যদি এই চিঠিটাই জাল হয়? অথবা ইতিমধ্যে কেউ গুপ্তধন তুলে নিয়ে গিয়ে থাকে? কী দরকার মশাই আর সমস্যা বাড়িয়ে। অর্জুন হাসল।
এই সময় একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল থানার সামনে। ইউসুফভাই বললেন, মনুভাই এসেছেন। আমাদের এবার ফিরতে হবে।
অফিসার বললেন, একটু চা খেয়ে যান। ততক্ষণে আমি চিঠিটার জেরক্স করানোর জন্য গাজিপুরে লোক পাঠাই।
অর্জুন সম্মতি জানাল।