দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – পাৰ্ব্বত্যপথে
লালপাহাড়ে উঠিয়া রামলালজীর বাটীতে পৌঁছিতে যে প্রশস্ত রাস্তা আছে, তাহার দূরত্ব অনেক বলিয়া তারা বনপথে চলিল। যাইবার সময় বৃদ্ধ বার বার তাহাকে সে পথে যাইতে নিষেধ করিয়াছিলেন। কিন্তু তারা সে নিষেধ সত্ত্বেও সত্বর রামলালজীর বাটীতে পৌঁছিবার জন্য সে বনপথই অবলম্বন করিয়াছিল।
শুক্লপক্ষের জ্যোৎস্নাময়ী রজনী। সনাথনক্ষত্রাবলী গগনে উদিত হইয়া ধরাতলে আলোক বিতরণ করিতেছেন। এমন সময়ে সেই অপূৰ্ব্ব-লাবণ্যবতী, পূর্ণযৌবনা তারা অশ্বারোহণে পার্বত্যপ্রদেশীয় বনজঙ্গল অতিক্রম করিয়া অকুতোভয়ে তীরবেগে অশ্বচালনা করিতেছে। সে কোমলে-কঠিন মিলন দেখিবার যোগ্য। সেই স্থির সৌদামিনী, তিলোত্তমাসমা চম্পকবর্ণা তারার অপূর্ব্ব অশ্বচালনা- কৌশল দেখিলে মনে হয়, রাজপুতনার রমণীগণ বীরপত্নী, বীর-প্রসবিনী কেন না হইবেন?
তারা চলিয়াছে—বিদ্যুদগতিতে অশ্ব ধাবিত হইতেছে। পার্ব্বতগাত্রে অশ্বের পদধ্বনিতে যেন বোধ হইতেছে, কোন বীরপুরুষ সদম্ভে শত্রু দমনোদ্দেশে উন্মত্তের ন্যায় কাহারও পশ্চাদ্ধাবিত হইতেছে।
লালপাহাড়ে উঠিতে গেলে প্রথমতঃ প্রায় এক ক্রোশ পর্ব্বতের উপর বাঁকা-চোরা উঁচু-নীচু পথ অতিক্রম করিয়া যাইতে হয়। তাহার পর লালপাহাড়ের সমতল উপত্যকা ভূমিতে পড়া যায়। তারা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সেই আয়াস-সাধ্য পথ অতিক্রম করিয়া সমতল ক্ষেত্রে উপনীত হইল এবং অশ্বের গতি কিছু কম করিয়া দিয়া অগ্রসর হইতে লাগিল। এই পাৰ্ব্বতীয় সমতল ভূমিতেই দস্যুগণের ভয়ানক অত্যাচার কাহিনী শ্রুত হইত। তারার বিশ্বাস ছিল, ইংরেজের শাসনে চোর- ডাকাইতেরা ভারতবর্ষ পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিয়াছে।
তারা নির্ভয়ে অশ্বচালনা করিতেছে, এমন সময়ে সহসা তাহার অশ্ব বিরুদ্ধভাব ধারণ করিল। আর সে অগ্রসর হইতে চাহিল না। তারা যতই কসাঘাত করিতে লাগিল, ততই যেন অধিকতর উন্মত্ত ভাব প্রদর্শন করিল; ক্ষণে ক্ষণে হ্রেষারব করিতে লাগিল। তারা ভাবিল বোধ হয়, নিকটেই কোন বন্য-জন্তুকে দেখিয়া অশ্ব ভীত হইয়াছে। তখন অনন্যোপায় হইয়া তারা ঘোড়ার পিঠে চাপড়াইয়া, হাত বুলাইয়া তাহাকে শান্ত করিতে চেষ্টা করিল। অনেক চেষ্টার পর ‘কুমার’ শান্ত হইল বটে, কিন্তু সেখান হইতে আর এক পদও অগ্রসর হইল না।
বিস্মিত ও চমকিতনেত্রে তারা দেখিল, ঠিক সম্মুখে ঘোড়ার মাথার কাছে যেন পৰ্ব্বত-গর্ভ ভেদ করিয়া সহসা এক ভীষণ মূৰ্ত্তি উত্থিত হইল। এতক্ষণে ঘোটকের ভয়ের কারণ জানা গেল।
চন্দ্রালোকে সৌন্দর্য্য-বিকশিত তারার লাবণ্যময়ী মূৰ্ত্তি দর্শনে সেই ভীষণ পুরুষ কথা কহিল বলিল, কে গো—কে গো ধনি? এত রাত্রে কোথা যাও?
স্থির, ধীর, শান্ত অথচ নির্ভীকস্বরে তারা উত্তর দিল, “আপনি একটু পাশ কাটিয়ে স’রে দাঁড়ান, আপনাকে দেখে আমার ঘোড়া ক্ষেপে উঠেছে, পথ ছেড়ে দিন;আমি বড় ব্যস্ত হ’য়ে এক জায়গায় যাচ্ছি।”
সেই ভীমাকৃতি পুরুষ ভীষণ হাসি হাসিয়া ভীষণস্বরে, উল্লসিতভাবে কহিল, “আরে বল কি, এত রাত্রে কোথায় যাচ্ছ?”
এই পৰ্য্যন্ত বলিয়া সে উত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই জামার পকেট হইতে একটি বাঁশী বাহির করিল এবং সজোরে বাজাইল। পর মুহূর্ত্তেই আর একটি বাঁশীর শব্দে কে প্রত্যুত্তর দিল। কিয়ৎক্ষণ পরে সেই প্রকার ভীমাকৃতি আরও জন কয়েক লোক সেইখানে উপস্থিত হইল। তাহাদের মধ্যে একজন আসিয়া একেবারে তারার অশ্ববল্গা ধারণ করিল। অশ্ব আরও ক্ষেপিয়া উঠিল।
তারা কাতরকণ্ঠে চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, “সরে দাঁড়াও। তোমাদের চেহারা দেখে আমার ঘোড়া এত ক্ষেপে উঠেছে যে, আর একটু হ’লে আমাকে এই পৰ্ব্বত থেকে ফেলে দেবে।”
পর মুহূর্ত্তেই তারার হৃদয়ে, ভীতির আবির্ভাব হইল। তাহাদের একজনের কণ্ঠস্বর শুনিয়াই তাহার আশা-ভরসা, সাহস সমস্ত কমিয়া আসিল, ভয়ে তাহার রক্ত যেন জল হইয়া গেল। সে বিকট চীৎকার করিয়া বলিল, “চন্দ্ৰ সূৰ্য্য মিথ্যা হবে, তবু আমার কথা মিথ্যা হবে না। আমি নিশ্চয় বলতে পারি, এ সেই তারার গলার আওয়াজ।”
আর একজন অমনই প্রত্যুত্তরে বলিল, “তবে ত তারা নিশ্চয় বুড়োর সেই ঘোড়াটায় চড়ে এসেছে। ভালই হয়েছে—ভালই হয়েছে। আমাদের কপাল ভাল। ঘোড়াটার বেশ দাম হবে। অনেক দিন থেকে ঐ ঘোড়াটার উপর আমার নজর আছে।”
তারা এতক্ষণে বেশ বুঝিতে পারিল, সে কোথায় আসিয়া পড়িয়াছে। একবার ভাবিল, কেন বৃদ্ধ পিতার কথা অবহেলা করিয়া অন্য পথ দিয়া আসিলাম, জানা পথে আসিলে হয় ত এ-বিপদ্ ঘটিত না।
তারা বুঝিল, সে নিষ্ঠুর ভয়ানক দস্যুদলের মধ্যে পড়িয়াছে। রমণী হইলেও তাহার অনিষ্ট করিতে তাহারা বিন্দুমাত্র সঙ্কুচিত হইবে না। বৃদ্ধের নিকটে তারা বলিয়া আসিয়াছিল, “আমি রঘুনাথকে ঘৃণা করি, কিন্তু তাহাকে ভয় করি না।” কিন্তু এখন সেই রঘুনাথের কণ্ঠস্বর শুনিয়া সে বড়ই ভীত হইল, তাহার সর্ব্বাঙ্গ কম্পিত হইতে লাগিল। অন্য সময়ে যদি তারা রঘুনাথকে দেখিত, তাহা হইলে বাস্তবিকই বিন্দুমাত্র ভয় করিত না;কিন্তু এখন এই দস্যুদের সঙ্গে তাহাকে দেখিয়া ভয়ে তাহার প্রাণ উড়িয়া গেল। নিজের জীবনের জন্য তারা বিন্দুমাত্র চিন্তিত বা দুঃখিত হইল না; কিন্তু যে রঘুনাথকে সে কতবার ঘৃণায় দূর করিয়া দিয়াছে, যে রঘুনাথ তাহাকে পাইবার জন্য জীবন-মরণ পণ করিয়াছে, এরূপ নিঃসহায় অবস্থায় তাহার হাতে পড়িলে তাহার পালক-পিতার কি দুৰ্দ্দশা হইবে, তাহাই তখন তাহার মনে ভীষণ আন্দোলন উপস্থিত করিল।
ক্ষণমাত্র এই সকল কথা ভাবিয়াই তারা পলায়নের উপায় চিন্তা করিতে লাগিল। যদিও মৃত্যু হয়, তথাপি বিনা চেষ্টায় আত্মসমর্পণ করিতে তাহার প্রবৃত্তি হইল না। তারা ভাবিল, যদি একবার সে কোন রকমে তাহার অশ্বটীকে উত্তেজিত করিয়া চালাইয়া দিতে পারে, তাহা হইলে আর তাহাকে পায় কে? নির্বিবাদে সে সকল বিপদ্ অতিক্রম করিয়া চলিয়া যাইতে পারিবে; কিন্তু অশ্বচালনাতেও প্রবল অন্তরায়—দুইজন লোক দুই পার্শ্বে তাহার অশ্ববল্লা ধরিয়া দাড়াইয়া আছে। তারা গম্ভীরভাবে বলিল, “সরে দাঁড়াও—আমায় যেতে দাও—আমার বড় দরকার—আমাকে যেতেই হবে—”
দস্যুদলের মধ্যে একজন বিকট হাস্য করিয়া অশ্ববল্লা আরও জোর করিয়া ধরিয়া উত্তর করিল, “এরই মধ্যে কেন গো! ঘোড়া থেকে নামো—তোমার চেহারাখানা একবার দেখি, তার পর যাবে এখন। তোমার কোমল অঙ্গ—এত তেজী ঘোড়ায় চড়া কি তোমার সাজে। তোমাকে আমরা এই ঘোড়ার বদলে একটি বেশ ধীর স্থির শান্ত ঘোড়া দিতে পারি।”
বিপদে পড়িয়া তারা একেবারে হতবুদ্ধি হয় নাই। সে তখনও পলায়নের উপায় অনুসন্ধান করিতেছিল। অশ্ববল্লাধারীকে কথায় ভুলাইয়া দু-এক মুহূৰ্ত্ত সময় অতিবাহিত করিবার অভিপ্রায়ে এবং এইরূপে তাহাকে অন্যমনস্ক করিয়া পলায়নের সুযোগ পাইবার আশায় বলিল, “কৈ তোমাদের ঘোড়া দেখি—আমার এ ঘোড়ার চেয়ে তেজী ঘোড়া না হ’লে আমি বদল করব না।”
একজন অশ্ববল্লাধারী হাসিয়া বলিল, “বাঃ বিবিজান্! তুমি ত দেখছি বেশ বাহাদুর! আমরা ভেবেছিলাম, তুমি আর বড় একটা কথা কইবে না।”
তারা মনে মনে ভাবিল, দস্যুগণকে প্রতারণা করা সহজ নয়। তাহাদের ইতর উপহাসে তাহার মনে বড় কষ্ট হইতেছিল;কিন্তু কি করিবে, কোন উপায় নাই। বিষম সঙ্কটে পড়িয়াও তারা একেবারে হতাশ হয় নাই। সে ভাবিল, “এই সকল স্নেহ-মমতা-বিহীন নির্দয় ও নিষ্ঠুর প্রকৃতি দস্যুগণের হস্তে আত্মসমর্পণ করা অপেক্ষা যে কোন উপায়ে হউক, পরিত্রাণ লাভের চেষ্টা করা উচিত; তাহাতে যদি মৃত্যু হয়, সে-ও ভাল।” তাই অনন্যোপায় হইয়া, সেই মহাদুৰ্বৃত্ত দস্যুগণের কবল হইতে উদ্ধার- লাভেচ্ছায় একবার তারা অসমসাহসীর ন্যায় কার্য্য করিল।
সহসা অশ্বরশ্বি সংযত করিয়া রাজপুত-বালা ‘কুমারের’ পৃষ্ঠে সজোরে কসাঘাত করিল। এই অল্প সময়ের মধ্যে অশ্বটীও কিঞ্চিৎ শান্তভাব ধারণ করিয়াছিল— সে-ও যেন উপস্থিত বিপদ্ বুঝিতে পারিয়াছিল;আরোহিণী কর্তৃক উৎসাহিত হইয়া কুমার একেবারে হঠাৎ লম্ফ প্রদানপূর্ব্বক তড়িদ্বেগে পার্বত্যপথে অগ্রসর হইল। যে দুই ব্যক্তি অশ্ববল্লা ধরিয়াছিল, তাহারা সহসা-সমুখিত সে-ভীষণ বেগ সংবরণ করিতে না পারিয়া সেইখানে লুণ্ঠিত হইয়া পড়িল।
অশ্বটীকে অধিকতর প্রোৎসাহিত করিবার অভিপ্রায়ে তারা দুই-একবার চাবুকের শব্দ করিয়া বলিল, “চল, চল কুমার, তীরবেগে চল।” বিষম বিপদের অবস্থা যেন অনুভব করিয়া কুমার, তীরবেগে ধাবিত হইতে লাগিল। বাল্যকাল হইতে অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া তারা যখনই ভ্ৰমণ করিতে যাইত, বেগে অশ্বচালনার প্রয়োজন হইলে তখনই সে কুমারকে ঐরূপভাবে উদ্দীপন করিত। তাই সেই চিরপরিচিত সম্ভাষণ শুনিয়া কুমার বিদ্যুদ্বৎ দ্রুতবেগে ধাবমান হইল। আশে-পাশে যে যে দস্যু দাঁড়াইয়াছিল, তাহারা স্তম্ভিত হইয়া চাহিয়া রহিল। “চল চল, কুমার!” বলিয়া তারা মুহুৰ্ত্ত মধ্যে বহু পথ অতি দ্রুত অতিক্রম করিল।
নৈশ-নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া পিস্তলের গুড়ুম্ গুডুম্ আওয়াজ হইল। তারার কানের কাছ দিয়া গুলি সাঁই সাঁই করিয়া চলিয়া গেল। তারা বুঝিল, দস্যুরা পিছু লইয়াছে এবং তাহারা কেবল অশ্বটিকে লক্ষ্য করিয়া পিস্তল ছুড়িতেছে। পাছে সেই লক্ষ্যে নিজে আহত হয়, এই ভয়ে তারা ঘোড়ার পিঠের উপরে শুইয়া পড়িয়া, তাহার গলা জড়াইয়া ধরিল এবং কুমারকে অত্যন্ত উত্তেজিত করিতে লাগিল। এইভাবে আর দশ পনের মিনিটকাল কাটাইতে পারিলেই তারা নির্বিঘ্নে দস্যুবৃন্দের কবল হইতে মুক্ত হইয়া সাহসিকতার উপযুক্ত ফললাভ করিতে পারিত; কিন্তু বিধাতা বিরোধী! পরিত্রাণ কোথায়?