Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » যোগসূত্র || Mallik Kumar Saha

যোগসূত্র || Mallik Kumar Saha

যোগসূত্র

শহরের নিকটবর্তী এক পাড়ার মাঝখানে এক টুকরো জমি কিনে রেখেছেন নরহরি মশাই। ঘর সংসার করার ইচ্ছাটুকু যৎসামান্যই ছিল। কালক্রমে দুই পুত্রের বাবা হলেন বটে, কিন্তু সংসারের মোহ তাকে বেশীদিন ঘরে আটকে রাখতে পারল না। ঘর সংসারে অনীহা থাকলেও বিবেককে একেবারে নিষ্ক্রিয় করে ফেলেননি। মাত্র এক বৎসরের মধ্যেই কঠোর পরিশ্রম করে সেই জায়গায় একখানা কুঁড়ে ঘর তৈরী করে বড় ছেলে যাদবকে বিয়ে করিয়ে সংসারের দায়দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে নিভৃতে গৃহত্যাগী হওয়ায় উভয়ের মনে ভীষণ শূন্যতা দেখা দিল। মনক্ষুন্ন হয়ে বসে থাকলেও গরীবের পেটের জ্বালা কজনেই বা বুঝবে?

এমনিভাবেই কয়েক বৎসর কেটে গেল। পিতার কোন খোঁজ মেলেনি। ছোট ভাই মাধব এক ব্যবসা শুরু করে নিয়মিতভাবে অর্থ সঞ্চয় করতে লাগলেন। কাল বিলম্ব না করে এক সুপাত্রীর সঙ্গে মাধবকে বিয়ে করানো হল। দুই ভাইয়ের মধ্যে আন্তরিক সদ্ভাব বজায় থাকায় সংসার জীবন এক রকম ভালই কাটছিল।

পিতা নিরুদ্দেশ হয়েছেন বলে ছেলেরা শীঘ্রই তার কথা মন থেকে মুছে ফেলবেন এমনটি নয়। বিভিন্ন মঠ, মন্দির ও আশ্রম গুলোতে খোঁজ নিয়েছেন যানব মশাই। হঠাৎ একদিন লোক মুখে খবর পেলেন যে তাদের বাবা বিহার প্রদেশের এক গোপাল মন্দিরে ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকেন। এই সুসংবাদ শুনা মাত্রই যাদবের সমস্ত দেহ-মনে নূতন শক্তির সঞ্চার ঘটল। কাল বিলম্ব না করে একদিন পিতাকে দেখার নিমিত্ত রওনা হলেন। যান বাহনের নানান ঝঞ্ঝাট তুচ্ছজ্ঞান করে বিহার প্রদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে গোপাল মন্দিরের সন্ধান করতে লাগলেন। সুমার্জিত ধূতি পাঞ্জাবী পরিহিত বাঙালী ভদ্রলোককে দেখে গ্রামের লোক তৎপরতা সহকারে যাদব বাবুর সম্মুখে এসে উপস্থিত। তাদের মধ্য থেকে একজন মাঝারি বয়সের লোক জিজ্ঞেস করলেন : “কাহা জানা হ্যায়,বাবু ?”

যাদববাবু করজোড়ে সকলকে নমস্কার জানিয়ে উত্তর করলেন: ” ইস্ গাঁও কা
গোপাল মন্দির জানা হ্যায়।”

গ্রামের এই ছোট্ট মন্দিরের খোঁজে এই প্রথম এক বাঙালী বাবুকে দেখে সকলে একরকম সন্দেহের চোখে দেখলেন।

আপকো দেখকে লাগতা হ্যায় কি আপ পরদেশী বাবু। তো আপ ইস্ মন্দির দেখনে আয়ে হো বাবু ?

— জী হা। আওর উস্ মন্দিরকে পূজারীসে ভি মিলনা হ্যায়।

এই গ্রামে মন্দিরটি যেমন প্রসিদ্ধ ঠিক তেমনি মন্দিরের পূজারীর যশ চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। এই গ্রামের সকলেই উনাকে ‘মৌনিবাবা’ নামকরণ করেছেন। অতঃপর গ্রামবাসীদের নির্দেশনায় যাদববাবু কিছুক্ষণ সংকীর্ণ পথ হেটে এক বিরাট অশ্বথ অশ্বথ বৃক্ষের নীচে অবস্থিত মন্দিরের মূখ্য দারের সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন। ভিতরে দেখতে পেলেন অপূর্ব কলাকৃতিতে সজ্জিত রাধামাধবের যুগলমূর্তি। সেই মূর্তিদ্বয়ের সম্মুখে গৈরিক বসনে আসীন নরহরি মশাইয়ের পৃষ্ঠদেশ দেখামাত্রই পিতার স্নেহে পালিত যাদববাবুর সমস্ত শরীরে শীহরণ জাগল। পিতার মুখমণ্ডল দর্শনের অপেক্ষায় তিনি স্থির নয়নে তার পানে তাকিয়ে রইলেন। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর পূজা সমাপনান্তে পুরোহিত মশাই ভক্তদের দিকে ঘুরে দাঁড়ানো মাত্রই অতি সুপরিচিত নয়নযুগলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। কয়েকযুগ পর পিতাকে নূতনভাবে আবিষ্কার করতে পেরে যাদববাবুর নয়নযুগল জলে আপ্লুত হল। মুখের ভাষা হারিয়ে ফেললেন। দিক্‌বিদিক্ না দেখে দ্রুত পিতার চরণদ্বয়ে মস্তক রেখে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন। অশ্রুর বারিধারায় চরণযুগল ভেসে গেলে নরহরি মশাই পুত্রকে বক্ষে টেনে নিলেন। পিতার বক্ষের শীতল স্নেহে মন জুড়িয়ে গেলে যাদববাবু পিতাকে জিজ্ঞেস করলেন : “একটি বারের মত নিজের সন্তানদের খোঁজটুকু নেবার প্রয়োজন মনে করলেন না বাবা?”

পুত্রের এরূপ অভিযোগে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে উত্তর করলেন : “এই বিশ্বচরাচরের প্রতিটি প্রাণী ঈশ্বরের সৃষ্টি। বিধাতা নিজেই যখন সমস্ত জীবের দায়িত্ব নিজের হাতে নিয়েছেন তখন কি আর তোমাদের জন্য আলাদা করে ভাবনার কিছু থাকতে পারে? আমি সেই করুণাময় ঠাকুরের প্রতি আস্থাবান এবং জগতের মঙ্গল কামনায় ন্যস্ত !”

— বাড়ীর কথা মনে পড়ে?

যতদূর দুচোখ যায় সমস্তই আমার আবাস। এই ধরিত্রীই আমার শয্যা। সমস্ত চরাচর আমার পরিবার। সব কিছুর উপর যিনি বিরাজমান, সেই আত্মশক্তির অনুভবই চলার পথকে মসৃণ করে এগিয়ে নিয়ে যায়।

—বাবা, আমি আপনাকে বাড়ীতে নিয়ে যেতে এসেছি। একবার সবাইকে দেখে আসবেন। তারা সবাই আপনার আশায় পথ চেয়ে বসে আছে।

আমাকে এই দেবস্থানে ভক্তদের মাঝে থেকেই নশ্বর দেহ ত্যাগ করে পঞ্চতত্ত্বে বিলিন হতে হবে। ঈশ্বরের পথে অনেক আগেই নিজেকে সমর্পন করেছি। তুমি বাড়ী ফিরে যাও। আশীর্বাদ রইল।

পিতার দৃঢ় আধ্যাত্মবাদে মনের কিঞ্চিত পরিমানেরও পরিবর্তন না দেখে তিনি সজল নয়নে পিতার বক্ষে মাথা রেখে দুবাহু প্রসারণ করে তাকে জড়িয়ে রাখলেন। ইতোপূর্বে পিতার অনেক কঠোর বাক্য শুনা সত্যেও হৃদয় বিগলিত হয়নি। কিন্তু আজ তার সহজ সরল বাক্যগুলিও যাদববাবুর হৃদয় বিদীর্ণ করে দিল। পিতাপুত্রের এই যুগলবন্দী অবস্থা মন্দিরে উপস্থিত অন্যান্য ভক্তদের কাছে দৈব-মিলন বলে মনে হল। অনেক বেদনা বুকে জড়িয়ে যাদববাবু পিতার চরণ স্পর্শ করে মন্দির প্রাঙ্গণ ত্যাগ করে চলে গেলেন।

আজ যাদববাবু একেবারে প্রৌঢ়। বয়সের এই পরন্ত বেলায় আঙুলে কলম তুলে কিছু লেখার সাহস তার আর নেই। নশ্বর দেহে পিতার সঙ্গে মিলনের সাধ আর পূর্ণ হল না। দীর্ঘ পাঁচ বৎসর প্রায় পিতা স্বর্গবাসী হয়েছেন। অতি কষ্টে যোগাযোগ স্থাপনের পর শেষ বাসনাটুকু পূর্ণ করার লক্ষে তিনি সেই মন্দিরের পরবর্তী পুরোহিতের কাছে কয়েক হাজার টাকা মানি অর্ডার যোগে পাঠিয়ে দিলেন। অন্যের সাহায্যে পত্র লিখে পাঠালেন যেন সেই অর্থে পিতার মৃত্যু বার্ষিকীতে অর্থাৎ আগামী মৌনী অমাবস্যার দিনে গ্রামবাসীদের ভোজন করানো হয়। সশরীরে উপস্থিত থেকে পিতার ভক্তদের ভোজন করাতে না পারায় তিনি সাতিশয় দুঃখিত। এই সামান্য কর্তব্যটুকু পালনের মধ্য দিয়ে পিতার স্বর্গীয় আত্মার শান্তি কামনা করেন।

ইহজগতের সমস্ত বন্ধন ছিন্ন হলেও পরজগতের সঙ্গে যে যোগসূত্র স্থাপন করা হয় তা ব্যক্তি চেতনাকে আলোড়িত করে। নির্বিকার মনের মানব সাধনা পরস্পর সম্পর্ককে চিরদিন অটুট রাখে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *