মেয়েলি আড্ডার হালচাল : 05
যাদু ঘোষের স্ট্রিটে কদিন ধরে মহাবিপদ যাচ্ছে। ধাঙড় স্ট্রাইক। অন্যান্য পাড়াতেও নিশ্চয়ই এই একই বিপদ। কিন্তু যাদু ঘোষের স্ট্রিটের কথা আলাদা। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নিরুপম গড়াই কি অন্য পাঁচজন কাউন্সিলরের মতো? তিনি আলাদা। চার দিন স্ট্রাইক সহ্য করবার পর নিরুপম পাড়ার ছেলেদের তলব করেছেন।
যাদু ঘোষের স্ট্রিটটি একটি সার্পেন্টাইন লেন বিশেষ। সরু হতে পারে কিন্তু পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে নানা বিস্তৃততর স্ট্রিট পার হয়ে সার্কুলার রোডের সঙ্গে সেন্ট্রাল এ্যাভিনিউকে জুড়েছে। কলেজ স্ট্রিট পার হবার পর তার নাম বদলে গেছে ঠিকই। কিন্তু আদতে এরা যে একই স্ট্রিট এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো পর্যন্ত এক বার হাঁটলেই যে-কেউ বুঝতে পারবে। নিরুপম গড়াই কাউন্সিলরের ওয়ার্ডের মধ্যমণি এই রাস্তা। এখানে কেউ পানের পিক বা থুতু ফেলে না, দেওয়ালে পোস্টার সাঁটে না, রাস্তায় দাঁড়িয়ে জলবিয়োগ করে না। পাড়ার লোকেরা সবাই জানে এবং সবাই মানে এ সব। বেপাড়ার কোনও পথিক যদি অভ্যাসবশত রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে যান, ওপর থেকে বালতি বালতি জল পড়ে। পাড়ার সবাইকে ঢালাও অনুমতি দেওয়া আছে। ত্যাণ্ডাই ম্যাণ্ডাই করবার উপায় নেইঃ জল পড়ার ঝপাং শব্দ হওয়া মাত্র হয় মহিলাবাহিনী নয় বালকবাহিনী বেরিয়ে আসে। এই বাহিনীর পুরোভাগে সাধারণত থাকে চৌধুরীবাড়ির কাজের লোক অনিলামাসি। মাসির উবুঝুঁটি খোঁপা, হাতে ঝাঁটা হোক বালতি হোক ঝুলঝাড়া হোক কোনও না কোনও অস্ত্র, বঁটিও অনেক সময়ে থাকে। মাসি কাউকে খাতির করে না। যত ভদ্রবেশী, যত ফর্সাই হোক না কেন দুষ্কৃতকারীকে মাসি রেহাই দেয় না।
‘কী ছোটলোক গা তুমি, ভদ্দরলোকের বাড়ির গায়ে ছচ্ছড় করে মুতে দিলে? কেন নিজের বাড়িতে কলঘর নি? কলঘরও নি! লজ্জাও নি!’
এক বার এক স্থানীয় স্কুলের প্রৌঢ় মাস্টারমশাই, দুপুরবেলা শুনশান দেখে দাঁড়িয়ে গেছিলেন। হঠাৎ তাঁর সামনের জানলাটা খুলে যায় এবং একটি বাল-মুখ বেরিয়ে পড়ে।
‘মাস্টারমশাই!’ —আনন্দিত বিস্ময়ে সে বলে ওঠে, এবং তার বন্দিত মাস্টারমশাইকে দেখবার জন্য মাকে ডাকতে থাকে।
‘মা, ওমা দেখে যাও আমাদের ভূগোলের স্যার।’
ভূগোলের স্যার সেবার ভড়কে চমকে অজ্ঞান হয়ে যান। সেই ছাত্রের বাড়িতেই তাঁর প্রাথমিক চিকিৎসাদি হয়। কিন্তু জ্ঞান আসবার পরেও তিনি অজ্ঞান থাকার ভান করে চোখ বুজে মড়ার মতন পড়েছিলেন, যার ফলে তাঁকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখান থেকেই তিনি নাক-কান মুলে পালিয়ে যান।
যাদু ঘোষের স্ট্রিটের দু ধারে গাছপালা, বড় জালের খাঁচায় মুনিয়া পাখি, একটি মাছের অ্যাকোয়ারিয়াম পর্যন্ত শোভা পাচ্ছে। পাড়ার বয়স্করা অনেক সময়েই মোল্ডেড চেয়ার নিয়ে রাস্তায় বসেই গল্পসল্প করে থাকেন। এই পাড়ায় চারদিন ধরে ময়লা জমাটা যে কলকাতার মতো সর্বংসহা নগরীতেও একটা ভীষণ ব্যাপার বলে গণ্য হবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। ভোর ছটাতেই লাউডস্পীকারে নিরুপম গড়াইয়ের গলা ভেসে ওঠে— ‘বন্ধুগণ, ভাই সব, ছোট ভাইয়েরা, আমাদের ছেলেমেয়েদের, মা বোনেদের, বাবা-কাকা-জ্যাঠাদের স্বাস্থ্য বিপন্ন। যে কোনও সময়ে মহামারী দেখা দিতে পারে। ভগিনী নিবেদিতা এক জন বিদেশিনী মেমসায়েব হয়ে যদি ভয়াবহ প্লেগের মড়কে বাগবাজারের রাস্তাঘাট পরিষ্কার করে থাকতে পারেন, আমরা যাদু ঘোষের স্ট্রিটের অধিবাসীরাই বা পারব না কেন। আমরাও কি নিবেদিত নই? সেলফ-হেল্প ইজ দা বেস্ট হেল্প, দরকার পড়লে আমরা ধাঙড় হয়ে ভাগাড় পরিষ্কার করব, আবার দরকার হলে ভাংরা নেচে আসর জমাব। আমরা সব কাজের কাজি। ভাই সব ক্লাবঘরে গ্লাভস, বেলচা, হুইলব্যারো সব রেডি। তোমরা সব কাজে নেমে পড়ো। নাকে মুখে যে যার রুমাল বেঁধে নাও।’
এর পরে নিরুপম গড়াই অর্জুনা রণতুঙ্গার মতো হাত নেড়ে নেড়ে ডাইনে বাঁয়ে বাহিনীকে নির্দেশ দেয়। তার পরিচালনায় বল্লেবাজ এবং গেনবাজরা স্কোর করতে থাকে এবং আউট করতে থাকে, এক বেলচা, দু’বেলচা, তিন বেলচা। গাড়ি-ভরতি করে ময়লা তুলে নিয়ে ওয়ার্ডের বাইরে এক বিস্তৃত আবর্জনা স্তূপে ফেলে আসা হয়, শেষ হলে ঘর্মাক্ত কলেবরে সবাই নিরুপমদার পাশে দাঁড়িয়ে যায় সার সার, নিরুপম আবার মাইক্রোফোনে ঘোষণা করেন— ‘পল্লীর সমস্ত বাড়িতে অনুরোধ আবর্জনা এখন আর বাইরে ফেলবেন না, ঘরেই জমান, এবং সন্ধের পর ওয়ার্ডের বাইরে ফেলে আসুন।’
বেলা তখন দেড়টা, ঘোষণাটি শেষ হয়ে এসেছে, এমন সময়ে নিরুপম এবং সমবেত ছেলেদের মাথার খই এবং পুষ্পবৃষ্টি হল। নিরুপমের বাড়ির সামনেই মাইক্রোফোনটি ফিট করা আছে, তাঁরই বাড়ি থেকে পুষ্প এবং লাজবৃষ্টি হয়েছে নিশ্চয়ই। অন্যান্য বাড়ির বাতায়নলগ্নারা নীচের বীরদের দেখতে এবং বাহবা দিতে এমনই মত্ত যে নিরুপমের বাতায়নের দিকে কেউ চাইবার অবসর পাননি। তবে প্রেরণা পেয়ে তাঁরাও শাঁখ বাজালেন, অনেকে উলু দিলেন। সে এক রই রই ব্যাপার। শত শঙ্খ বাজছে, দুইশত মুখে হুলুধ্বনি। পাশের গলি থেকে অনেকেই ছুটে এল, ‘এখানে কি কোনও গণ-গায়ে-হলুদ হচ্ছে?’ এই তাদের জিজ্ঞাসা। স্বাভাবিক। একটি বাড়ির বিবাহোৎসবে তো এই রকম হুলুস্থূল ব্যাপার হওয়া সম্ভব নয়।
এই সময়ে মাইক্রোফোনে নিরুপম-কণ্ঠের গর্জন শোনা গেল ‘কী হচ্ছেটা কী? রঞ্জু-উ শেফালি-ই-শান্ত-ও।’
নিরুপমের খেয়াল নেই সামনে চালু মাইক্রোফোন। ছেলে শান্ত পাশেই প্রকৃত শান্ত এবং গলদঘর্ম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কারণ কিছুক্ষণ আগেকার টুর্নামেন্টে সে ছিল একজন অতি দক্ষ ফিল্ডার। সে আরও ভুলে গেছে যে রঞ্জনা তার লেখক-স্ত্রী (লেখিকা বললে রঞ্জনা ক্ষুব্ধ হয়) আপাতত যাদু ঘোষের স্ট্রিটে নেই। কী এক রহস্যময় লেখার তাগিদে সে এই বৈশাখী গরমে শান্তিনিকেতনে গেছে।
এতক্ষণের কাজকর্মের গম্ভীর আবহাওয়া মুহূর্তে ভেঙে যায়। চারপাশ থেকে হাসির রোল ওঠে। এবং নানা জানলা থেকে খই অভাবে চিঁড়ে মুড়ি বৃষ্টি হয়। ছেলেরা হই-হই করে ওঠে, মারমুখী ইয়ং জনতা এক। “আমরা এত কষ্ট করে রাস্তা পরিষ্কার করলুম, এখন আবার আবর্জনা ফেলে রাস্তা নোংরা করা হচ্ছে?’ পাড়ার বড়রা মধ্যস্থতা করেন— ‘আহা হা, আনন্দ করছে মেয়েরা, একটা শুভ অনুষ্ঠানে পরিণত হল তোমাদের প্রশংসনীয় কাজটা।’
মেয়েরা বললেন— ‘চিড়ে মুড়ি খই ফুল আবর্জনা এ কথা আমরা জন্মেও শুনিনি।’
নিরুপম নারীদের উদ্দেশে ঘোষণা করলেন— ‘প্রত্যেক বাড়ি থেকে এক জন অন্তত মহিলা নেমে এসে সকলে মিলে এই চিঁড়ে মুড়ি খই ফুল ঝেঁটিয়ে বিদায় করুন। আর যদি জিনিসগুলি খুব শুভ বলে মনে হয় তো নিজেদের উদ্যোগে গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে আসুন।’
বুড়োরা হাঁ হাঁ করে উঠলেন— ‘গঙ্গার দূষণ আর কত বাড়াবে নিরুপম?’ উত্তরে নিরুপম বলেন— ‘তা হলে ওগুলো ফলার করে খেয়ে ফেলুন।’
নিরুপম আর দাঁড়ান না। ছোকরা বয়স তো আর নেই, যে পাড়ার মহিলাদের সঙ্গে ফক্কুড়ি মারা মানাবে? চেহারাটা চিরদিনই পাতলার ওপর, ঠোঁটের ওপর একটি কার্তিক-গোঁফও আছে, চুলটাও বাবরি। এই জন্যেই কি কেউ কোন দিন তাঁকে সিরিয়াসলি নিল না? না নিল তো কাউন্সিলর হলেন কী করে?
কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বাড়ির উঠোনে ঢুকেই নিরুপম গর্জন করলেন— ‘শেফালি!’
‘শেফালি রাস্তায় খই কুড়োতে গেছে, যা বলবার আমাকে বলুন!’
বিনীত-ললিত একটি নারী দাঁড়িয়ে আছে নিরুপমের সামনে। মহিলা? না মেয়ে? মেয়েই। শাড়ির আঁচল আঙুলে পাকায় তো মেয়েরাই। লজ্জাবনত মেয়েরা। কবে? হায়রে কবে কেটে গেছে লজ্জাশীলার কাল।
‘আপনি…আপনি কে?’
শান্ত বলে উঠল— ‘ও তো শিল্পী মাসি। মায়ের বন্ধু। কখন এলে মাসি! তুলতুল আসেনি?’
‘রঞ্জু তো নেই।’ নিরুপম কী রকম বোকার মতো বলে ফেলে।
‘সেটা আমি জানতাম না। আমি চলেই যেতাম, কিন্তু…’ নিরুপম ভীষণ লজ্জিত হয়ে বলে—‘না, না, চলে যাবেন কেন? চলে যাবার কী আছে? আমি তা বলিনি।’
‘চলে নিশ্চয়ই যেতাম, রঞ্জুদি না থাকলে এখানে আর আমার…’ কিছুটা কথা অসমাপ্ত রেখে শিল্পীমাসি বলে— ‘আসলে এমন একটা জিনিস দেখলাম যে যেতে পারলাম না। এ রকম কখনও দেখিনি তো! আপনাদের মানে আপনার ওই আবর্জনা হটানোর ড্রাইভটা…এ রকম ব্যক্তিত্ব এরকম লীডারশিপ, এ রকম অর্গ্যানাইজেশন এখনও আছে…তবু আমাদের এই দুর্দশা কেন? বেশিদিন থাকবে না—বেশিদিন থাকবে না…’
শ্রদ্ধামুগ্ধ চোখ তুলে যেন দিন আগত ওই চোখ দিয়ে গাইতে গাইতে শিল্পী ঘাড় নাড়তে লাগল।
এত শ্রদ্ধা, এত আশার সামনে নিরুপম ঠিক লজ্জা পেতেও পারছে না, ‘কী যে বলেন!’ জাতীয় কথাই তার সর্বাগ্রে মনে এসেছিল। কিন্তু সেটা গিলে নিয়ে সে বেশ সন্তোষের সঙ্গে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল—‘কাউকে তো শুরু করতেই হয়। কেউই যদি কিছু না করে তা হলে…’
‘এগজ্যাক্টলি’—এখন শিল্পী অনেকটা টান-টান—‘কিন্তু কে শুরু করবে? এই যে দেশ-ভরতি নাগরিকের দায়িত্ব-জ্ঞানের অভাবের বেড়াল তার গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? কেউই তো এগিয়ে আসে না নিরুপমদা! হংকংএ এই সব অপরাধের জন্য পাবলিক ফ্লপিং হয়, জানেন? আমি নিজে দেখেছি।’
নিরুপম শ্র্যাগ করে বলল— ‘তবেই বুঝুন।’
‘আচ্ছা, আমি এখন যাই?’
‘সে কী? এই দেড়টা দুটোর সময়ে আপনি না খেয়ে চলে যাবেন? বাইরে রোদ্দুরও খুব।’
শেফালি নিরুপমের পেছন থেকে বলল— ‘তার ওপর শিল্পীদিদি তো আজ রান্নাও করেছে। চলে যাবে মানে?’
‘আপনি…রান্না করেছেন?’ —নিরুপম হতবাক।
‘আমি তো রোজই রান্না করি!’ —শিল্পী সপ্রতিভ স্মিতহাস্যে বলে।
‘তা অবশ্য করতেই পারেন?’ নিরুপম হাসে, ‘যদিও সবাই মানে সব মেয়ে করে না, যেমন আপনার বন্ধু রঞ্জুদি, সে শেফালি নামে ওই মেয়েটির ওপর বরাত দিয়ে রেখেছে, যে নাকি অনেক সময়েই অখাদ্য রাঁধে, তা সে যাই হোক আপনি এখানে এসে রান্না করেছেন?’
শেফালি মুখিয়েছিল, বলে উঠল— ‘আমি অখাদ্য রাঁধি বলেই তো বউদির বন্ধুরা যেদিন আড্ডা থাকে সেদিন রান্না করে নিয়ে আসে। সবাই অবশ্য নয়। কাজলদিদি গোবরঘণ্ট আর জল-ভাত ছাড়া রাঁধতে পারে না, সুমিতাদিদিও হেভি ফাঁকিবাজ, তবে শিল্পীদিদি আর মালুদিদি হেরভি রাঁধে। কিন্তু মনে রেখো দাদা, আমি যদি অখাদ্য রাঁধি তো শিল্পী দিদি রাঁধে—কুখাদ্য। শুয়োর গরু এই সব।’
‘তুই চুপ করবি?’ নিরুপম এক হাঁকার ছাড়ে—তারপর শিল্পীর দিকে তাকিয়ে বলে ‘কী ব্যাপার বলুন তো?’
শিল্পী বলল— ‘একটু পাখার তলায় গিয়ে বসলে হত না?’
‘নিশ্চয়ই, ছি ছি’ —নিরুপম বসবার ঘরের দিকে এগোয়।
সেই ঘর, যেখানে দিন দশেক আগে জমাট আড্ডা বসেছিল। যেখানে মালবিকাদি আবৃত্তি করেছিল ‘দেশে দেশে মোর বউ আছে আমি সেই বউ মরি খুঁজিয়া।’ যেখানে সুমিতা শেফালিকে আনকাট ডায়মন্ড বলে শনাক্ত করে, এবং শেফালি তার ফেভারীট গান শনাক্ত করে ‘ধক ধক ধক ধক’। হঠাৎ শিল্পীর ভীষণ হাসি পেয়ে গেল, সে দমকা হেসে উঠল। কিছুতেই সামলাতে পারল না। নিরুপম অবাক, একটু অফেন্ডড-ও।
এত হাসির কী হল? হঠাৎ?
শিল্পী তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে বলল— ‘ওই কুখাদ্য। শেফালি বলে মেয়েটি আপনাদের খুবই রসিক।’
‘শেফালি আমাদের মেয়ে নয়, মিসেস শিল্পী…?’
‘বরাট।’
‘আচ্ছা বরাট, ওকে বড়জোর “কাজের মেয়ে” বলা যেতে পারে, এই করে করেই এদের মাথায় তুলেছেন আপনারা, কেন ‘মহানগর’-এ অনিল চ্যাটার্জির মা “ঝি অ ঝি” বলে ডাকেননি, তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল? কল আ স্পেড আ স্পেড।’
শিল্পী অবাক হয়ে বলে—‘এই যে শুনেছিলুম আপনি কমিউনিস্ট?’
নিরুপম চট করে নিভে যায় বলে— ‘ঘরসংসারের ডে টু ডে প্রবলেমে ব্যাপারটা সব সময়ে মনে থাকে না, বুঝলেন না মিসেস …’
‘কী আশ্চর্য, আমাকে শিল্পী বলুন, আমি রঞ্জুদির বন্ধু, কিন্তু অনেক ছোট। আপনি তো দেখছি মধ্যযুগের মানুষ, কাজের মেয়েকে ঝি বলেন, স্ত্রীর বন্ধুকে মিসেস বলেন, শুনেছিলাম বটে উত্তরের লোকেরা একটু ব্যাকডেটেড। এখন দেখছি সেটা সত্যি।’
শ্রদ্ধা বিনয় নম্রতা বীরপূজার মুখোশগুলো শিল্পীর আস্তে আস্তে খসে যেতে থাকে।
‘দেখুন উত্তরের লোকেরা ব্যাকডেটেড। ঠিকই হিসটরিক্যালি, দে গো ব্যাক টু দা সেভেনটিনথ সেঞ্চুরি। তার আগেও কলকাতা ছিল। সুতানুটি অর্থাৎ উত্তর কলকাতাই আসল কলকাতা, খানদানি কলকাতা, অভিজাত, প্রতিভাবান সম্পদশালী। নবকৃষ্ণ দেব, রাধাকান্ত দেব, মন্মথ মিত্তির, মতি শীল এখানকারই ধনী। বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, সুধীন্দ্রনাথ, এখানকারই প্রতিভা, তারাশংকর, নীরেন্দ্রনাথ, বিকাশ ভট্টাচার্য, সমরেশ মজুমদার উত্তর কলকাতার গর্ব। বেশি কথা কি প্রেসিডেন্সি, স্কটিশ চার্চ, বেথুন কলেজ, হিন্দু স্কুল, হেয়ার স্কুল, শৈলেন্দ্র সরকার স্কুল সুবিখ্যাত সব রঙ্গমঞ্চ, সিনেমা হল এখানেই এখানেই এখানেই।
‘সাউথে এত ধনী যে হাতে গুনে শেষ করা যায় না নিরুপমদা। নেতাজি, সুভাষচন্দ্র আমাদের, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ আমাদের, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, আধুনিক সাহিত্যের যত তাবড় তাবড় প্রতিভা সব ওদিকে। সুনীল গাঙ্গুলি আমাদের বাজারে বাজার করেন, শরৎকুমার, তারাপদ, সমরেন্দ্র, প্রণবেন্দু, বুদ্ধদেব গুহ, নবনীতা দেবসেন— এঁরা সব ওই সাউথের রাস্তা দিয়েই চলাচল করেন।… সুকুমারী ভট্টাচার্য, গৌরী ধর্মপাল, কল্যাণী দত্ত, গোবিন্দ গোপালের মতো পণ্ডিতরা …’
‘শুনুন শুনুন শিল্পিতা ধনী হলেই হয় না, ধন পাবলিক কজ-এ ইউজ করতে হয়।’
শিল্পী চেঁচিয়ে ওঠে— ‘বেড়ালের বিয়ে দিয়ে, হাউই জ্বালিয়ে, পায়রা উড়িয়ে?’
‘তা কেন হবে? কালো রঙের টাকা উড়িয়েই তো ভাল…’
‘ঝগড়া হয়ে যাবে নিরুপমদা, ভাল হচ্ছে না— স্যামবাজারের সসিবাবু তো আপনাদেরই কালচার?’
‘আর “আমি বসছি উইথ হাঁটু মুড়ে ভাই” কাদের কালচার?’
‘জীবনানন্দকে কী দিয়েছে সাউথ? রাসবিহারী তাকে অপঘাত মৃত্যু দিয়েছে। জীবনানন্দ সাউথের নয়। আর অন্যরা সব অভিবাসী!’
‘অভিবাসী?’
‘সুনীল গাঙ্গুলি আমাদের এই টাউন স্কুলের ছেলে, শঙ্খ ঘোষ সল্টলেকের মুখে থাকেন, সুকুমার সেন আমাদেরই …।
তা ছাড়া এঁরা বেশির ভাগই পূর্ববঙ্গের, আবার ফরিদপুর অঞ্চলের, নর্থ বেঙ্গলেরও আছেন। আর নেতাজিকে ধরে টানাটানি করবেন না শিল্পিতা— ভবানীপুরকে আমি সাউথ ধরি না। বহুবাজার টু ভবানীপুর, দি এনটায়ার স্ট্রেচ ইজ মধ্য কলকাতা।’
‘নেতাজিকেও দেবেন না?’ বলে শিল্পী রাগে লাল হয়ে উঠে দাঁড়ায়।
‘কাম ডাউন, শিল্পিতা কাম ডাউন প্লিজ।’
‘আমি শিল্পিতা-ফিল্পিতা নই। আমি শিল্পী। এখন চললাম।’
এতক্ষণে নিরুপমের চৈতন্য হয়। তার স্ত্রীর বন্ধু এই মেয়েটিকে সে সাংঘাতিক চটিয়েছে। মেয়েটি অতিথি। আতিথ্যের অবমাননা তো উত্তর কলকাতার আভিজাত্যের ভাল পরিচয় দেবে না। সে নিরুপায় হয়ে ডাকে—শেফালি, শান্ত, শেফালি, শান্ত’, এবং শিল্পীর গমনপথ আটকে বলে—‘রাগ করে না খেয়ে চলে গেলে গেরস্তের অকল্যাণ হয় শিল্পী।’
শিল্পী ফুঁসতে ফুঁসতে বলে—‘না। আমি খাব না।’
ততক্ষণে শেফালি এবং শান্তও এসে পড়েছে। তারাও যথাসাধ্য শান্ত করবার চেষ্টা করছে শিল্পীমাসিকে। কিন্তু সফল হচ্ছে না। শিল্পীমাসির এখন চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এসেছে।
অনুতপ্ত নিরুপম কাঁচুমাচু মুখে বলে— ‘আমি ক্ষমা চাইছি। ঠিক আছে নেতাজি আপনার। আর কাকে দিলে খাবেন বলুন? দিব্যেন্দু পালিত? ভাগলপুরের লোক কিন্তু দিয়ে দিচ্ছি, দিয়ে দিচ্ছি।
‘ও সব জানি না যদি সিনেমা দেখান একটা আজকেই, এক্ষুনি, তবে খাব।’
‘তো বেশ তো! এই কথা! নিশ্চয়ই দেখাব। কিন্তু এমন বিনা নোটিসে ফট করে টিকিট পাওয়া যাবে তো?’
‘আমি তো আর “হিন্দুস্তানি” কি “দিলওয়ালে দুলহনিয়া” দেখতে চাইছি না, ‘দর্পণা’য় অপর্ণার যুগান্ত এসেছে— দেখান। শুনেছি রূপা-অঞ্জন ফাটিয়ে দিয়েছে।
শেফালি বলল— ‘টিকিট পাওয়া যাবে দাদা, আমি একছুটে যাব আর আসব।’
‘ড্রেস সার্কল কাটবি। টাকা নে।’
নিরুপম টাকা দিয়ে দেয়। শেফালি টেবিলে খাবার দাবার অনেকক্ষণ সাজিয়ে ফেলেছে। আঙুল দেখিয়ে দেখিয়ে বলে—‘এই শশার রায়তা, এই চিংড়ি মাছের পোলাও, এই পনীরের মাখন-কাবাব। শিল্পী দিদি করেছে। আর এই বিউলির ডাল, এই সুক্তুনি, পোস্ত দিয়ে লাউশাক, আর বাটা মাছের সর্ষে ঝাল, ভাজা— আমি, ঝি, করেছি।’ —বলে শেফালি মটমট করে বেরিয়ে যায়।
সব দিক থেকে পরিশ্রান্ত, পরাজিত নিরুপম গড়াই অতএব মাথায় জল ঢালে আর জল ঢালে। জল ঢালে আর জল ঢালে। চমৎকার একটি প্রায় অপরাহ্ন-ভোজের পর নিজে আদ্দির পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে বর সেজে সুসজ্জিতা শিল্পীর সঙ্গে ইভনিং শো-এ সিনেমা দেখতে বেরোবার আগে পর্যন্ত নিরুপমের মাথায় আসেইনি সে জীবনে এই প্রথম স্ত্রী ছাড়া অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে সিনেমা যাচ্ছে। একা একা। মানে দোকা দোকা।