মেয়েলি আড্ডার হালচাল : 04
সরকারের প্রথম হবি যদি হয় ঘুম, তত দ্বিতীয় হবি আড্ডা। প্রচণ্ড আড্ডাবাজ ছিল সে এককালে। সেইখান থেকে তুলে এনে যখন তাকে জাহাজে জুতে দেওয়া হয়, তখন সে জাহাজটাকেই যথাসম্ভব আড্ডাখানা করে ফেলবার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। সাধ মেটাতে অতএব বাড়ি ফিরেই তাকে আড্ডার খোঁজে বেরোতে হয়। এবারও অন্যান্যবারের মতোই শুভম ঘুম থেকে উঠল পাঁচটা বাজিয়ে। বিকেল পাঁচটা। সারাদিনের রাগী চেহারা এখনও সম্পূর্ণ যায়নি। তবু ভুরভুরে হাওয়া দিতে আরম্ভ করেছে। আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলে, সাইড-টেবিলে রাখা ফ্লাস্ক থেকে শুভম চা খেল। আরও দু বার হাত পা ছাড়াল। পাশের ঘরে তার দুই মেয়ে দেবাঞ্জলি আর আম্রপালী নাচ প্র্যাক্টিস করছে। তা তা থেই তেই এই সব অর্থহীন বুকনি উচ্চকণ্ঠে তাদের নাচের মাস্টারমশাইয়ের মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে। সুমিতা একটু দেরিতে বেরিয়েছে আজ, ফিরবেও দেরিতে। চান করে পায়জামা পাঞ্জাবি ও ঘাড়ে-পাউডারে সুসজ্জিত হয়ে শুভম মেয়েদের ঘরে উঁকি দিল, দেবাঞ্জলি তখন হাতের এমন একটা মুদ্রা করছিল যাতে মনে হল সে বাবাকে একটু সুললিতভাবে টা টা করছে। শুভম বাড়ানো গলা গুটিয়ে নিল। মা ঘরে ঘরে ধূপ দিচ্ছে। বলল ‘বেরোচ্ছিস?’ মানে শুভম যে বেরোবেই, তার বেরোনোই যে ভাল এটা সবাই জানিয়ে দিচ্ছে। বাবার ব্যবহার আরও ভাল। তিনি সত্তর বছর বয়সে লুঙ্গি আর ফতুয়া পরে, আরাম চেয়ারে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছেন। মধুবালা দিলীপকুমার। ‘প্যার কিয়া তো ডরনা ক্যা?’
শুভম বেরিয়ে পড়ে। রোজই এ সময়টা সে কফি হাউজে যায়। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা যে হবেই, এমন কথা নেই। তবে হলেও হতে পারে। রাধেশ্যাম কি আসবে? তবে শুভম-এর আসল যেটা লোভ সেটা হচ্ছে কফি-হাউজের আবহাওয়া। এক কাপ কফি নিয়ে সে এক কোণে বসে থাকে। তার মনে থাকে না বিয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ বয়স হয়ে গেল, সে এখন মাস গেলে পঁচিশ হাজার টাকার মতো মাইনে পায়, তা ছাড়াও বহু পার্কস। মনে থাকে না বন্ধুরা সব চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে, অনড় আছে শুধু শয়তান রাধেশ্যামটা। সে যেন সেই আধা-বেকার সদ্য যুবক যে তর্ক করতে ভালবাসত, নাটক দেখা যার জীবনের অবশ্য কর্তব্যের মধ্যে পড়ত, সব রকমের গানের আসরে যাকে দেখা যেত। আজও সে দোতলায় উঠে ডান দিকের কোণের দিকে এগোচ্ছিল, দেখল এক মহিলা তার জায়গাটা নিয়ে বসে আছেন। ভারী বিরক্ত হল সে। খুবই অযৌক্তিক এ বিরক্তি। জায়গাটা তো তার কেনা নয়। তবু সতৃষ্ণ নয়নে জায়গাটার দিকে আরেকবার তাকাল সে। ভদ্রমহিলা তার দিকে চেয়ে খুব সপ্রতিভভাবে বললেন—‘বসবেন?’
‘না’ বলাটা ভাল দেখায় কি? শুভম ধন্যবাদ জানিয়ে বসল। ভদ্রমহিলা কফির কাপে চুমুক দিলেন। কাঁচা পাকা বয়ছাঁট চুল মহিলার। চোখ দুটো ছোট কিন্তু ঝকঝকে, লম্বাটে মুখ, নাকটা চোখা। বেশ ধারালো অথচ নারকুলে কুলের মতো মসৃণ। টেবিলের ওপর একটা মোটা ফাইল, কাঁধেও ব্যাগ।
‘আমি মালবিকা সান্যাল। আপনি?’
‘শুভম সরকার। আপনি কি ইউনিভার্সিটিতে আছেন?’
একটু হাসলেন ভদ্রমহিলা—‘মাস্টারি না করেও তা হলে মাস্টারির ছাপ পড়ে গেছে চেহারায়?’
‘না, না, তা নয়’ শুভম খুব অপ্রস্তুত হয়। বছরের আটটা মাস তাকে অকূল বারিধিতে কোমল নারীসঙ্গবিবর্জিত কাটাতে হয়। নারীদের সম্পর্কে সে খুব স্পর্শকাতর। মানে, নারীদের স্পর্শকাতরতা সম্পর্কে সে খুব স্পর্শকাতর। খুবই। বাড়িতে এই স্পর্শকাতরতা সে বিশেষ প্রয়োগ করতে পারে না। তার বাড়ির নারীরা তার আট মাস বাইরে থাকাটায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে মনে হয়। তা ছাড়া তারা যেন কেমন! মা নির্লিপ্ত, স্ত্রী নিজের কাজকর্ম নিয়ে সবসময়ে উৎসাহে টগবগ করছে। দীর্ঘ বিরহের জন্য একটু রোম্যান্টিক বিষাদ, একটু আলাদা আকুলতা যদি তার থাকত! ছিল, মেয়েরা হবার আগে ছিল। কিন্তু মেয়েরা যত বড় হচ্ছে সুমিতা তত প্র্যাক্টিক্যাল হয়ে যাচ্ছে।
শুভম একটু সাহসী হয়ে বলল— ‘কিছু মনে করবেন না, আপনাকে দেখে মনে হয় আপনি জাক দেরিদার ফলোয়ার। ক্ষুরধার বুদ্ধি না হলে তো ঠিক…
বিদেশি স্টাইলে গ্যালান্ট্রি না করেও যে ভদ্রমহিলাকে সূক্ষ্মভাবে কমপ্লিমেন্ট দেওয়া গেল কোনও রক্ষণশীল ভদ্রতাবিধি লঙ্ঘন না করে এবং সাহিত্যিক বিশ্বে লেটেস্ট দেরিদার নামটা যে সে শুনিয়ে দিতে পেরেছে এই আঁতেল মহিলাটিকে তাতে শুভমের একটা দারুণ আত্মতোষ হয়।
মহিলা হেসে বললেন ‘দেরিদা কি তাড়াতাড়িদা কারওই ফলোয়ার আমি নই। একটু আধটু সোশ্যাল ওয়ার্ক করে থাকি। কখনও কাজ হয়, কখনও হয় না। আপনার কফি এসে গেছে, পান করুন।’
শুভম হাসি-হাসি মুখে কফিতে এক চুমুক দিল, বলল— ‘আজ কাজ হল?’
‘কাজ হবে বলেই আশা করছি অপেক্ষা করছি, আশা করতে তো পয়সা লাগে না, তা ছাড়া আমার বন্ধুরাও আমাকে সাহস দেয়, প্রেরণা দেয়।’
‘আপনার বন্ধুরাও সোশ্যাল ওয়ার্ক করেন?’
‘আনসোশ্যাল বা অ্যান্টিসোশ্যাল কিছু করে না—এটুকু বলতে পারি।’ শুভম হেসে ফেলল। মহিলা ভারী মজার তো? চোখেমুখে সব সময়ে একটা মজা-পাওয়া হাসি খেলা করছে। তবে চালাকও কম নয়। কায়দা করে তার প্রশ্নগুলোকে এড়িয়ে যাচ্ছেন।
‘কফিটা এখানে ঠিক আগের মতোই আছে বলুন?’
‘তা আছে। সবই চেঞ্জ করছে, কিন্তু কিছু কিছু যদি অপরিবর্তিত অবিচলিত থেকে না যায়, তা হলে তো পৃথিবীর রিদম্টাই নষ্ট হয়ে যাবে!’
‘যেমন?’ —শুভম তর্কের গন্ধ পেয়ে খাড়া হয়ে ওঠে।
‘যেমন ধরুন জল, মানে জলধি। ডাঙায় তো সবই চেঞ্জ করে যাচ্ছে কিন্তু সমুদ্রে? সেই একই নীল, একই সবুজ, একই ঢেউ, গভীরতা, চোরা স্রোত, সেই একই তিমি হাঙর, উড়ুক্কু মাছ। আপনি যখন ডাঙা থেকে জলে যান তখন জীবনের সেই অপরিবর্তনীয় ছন্দ কি আপনি অনুভব করেন না?’
‘আমি ডাঙা থেকে জলে যাই—আপনি কী করে বুঝলেন? কী করে বুঝলেন আমি জাহাজের লোক?’
‘আপনি জাহাজের লোক বুঝি? আমি সাধারণভাবে ডাঙা থেকে জলে যাওয়ার কথা বলছিলাম। নানা কারণে প্রাপ্তবয়স্কদের তো এখন জলে নামতেই হয়! তো কিছু মনে করবেন না, আপনি কি খালাসি না সারেং?’
শুভম এত জোর হেসে উঠল যে আশেপাশে অনেকেই ফিরে তাকাল। তবে সেটা বেশিক্ষণের জন্য নয়, তারা নিজেরাও এত হাসছে, চেঁচাচ্ছে যে তাদের দিকেই কে ফিরে তাকায় তার ঠিক নেই।
‘খালাসি বা সারেং ছাড়া জাহাজে আর কেউ কাজ করে না বুঝি? শুভম এখনও হাসছে।
‘কিছু মনে করবেন না আমার গল্পের বই পড়া বিদ্যে তো! খালি সারেং আর খালাসিদের উল্লেখই পাই সব জায়গায়। আর অবশ্য ক্যাপ্টেন থাকেন। তো জাহাজের ক্যাপ্টেনদের তো ভীষণ রাফ হাবভাব, রেলাও খুব, তাই…’
ভদ্রমহিলার ছেলেমানুষিতে শুভম-এর ভারী একটা স্নেহ একটা বাৎসল্য জন্মায়। তার ওপর ‘রেলা’…
‘তা আমাকে কি খালাসি মনে হয়। ক্যাপ্টেন না হয় না-ই মনে হল।’
ভদ্রমহিলা জিভ কাটলেন— ‘ছি, ছি, আপনাকে ব্যথা দিয়েছি। তাই তো। আপনি কখনওই খালাসি হতে পারেন না। সত্যি আপনি কী বলুন তো? জাহাজ সম্পর্কে আমার কোনও ধারণাই নেই।’
‘আমি যা-ই হই না কেন, আপনার লজ্জা বা দুঃখ পাবার কোনও কারণই নেই।’
‘কিন্তু আমি যে সোশ্যাল ওয়ার্কার তা আপনাকে বলেছি। বলিনি? সুতরাং ন্যায়ত আপনার কাজ-কর্মের কথাও আমাকে বলা আপনার উচিত।’
‘সে কথা ঠিক,’ শুভম বলে, ‘আমি জাহাজের এঞ্জিনিয়ার আর কি।’
‘ও হো, ম্যারিন এঞ্জিনিয়ার আপনি, তাই তো, এই সহজ কথাটা আমার মাথায় আসেনি। আপনি তো তা হলে খুব ভাল পাত্র? জাহাজে ওরা খুব ভাল মাইনে-পত্তর দেয় শুনেছি।’
‘ভাল মাইনে-পত্তর হলেই ভাল পাত্র হয় বুঝি?’
‘প্রধান ফ্যাক্টর তো ওটাই। তা ছাড়াই আপনাকে সুস্থ সবল এবং স্বাভাবিকও তো মনে হচ্ছে? আর কী চাই?’
‘আপনার হাতে অনেক পাত্রী বুঝি? আপনি কি কফি-হাউজে পাত্র খুঁজতে এসেছিলেন? এই কি আপনার সোশ্যাল ওয়ার্ক?’
এতোগুলো প্রশ্ন একসঙ্গে করে ফেলেই শুভম বুঝতে পেরেছিল একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। না জানি ভদ্রমহিলার কী প্রতিক্রিয়া হয়।
কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে ভদ্রমহিলা হাসিমুখে বললেন— ‘আপনি যদি আমাকে মালবিকাদি বলে ডাকেন, তা হলে আমি আপনাকে শুভম বলে ডাকতে পারি তো? না আবার শুভবাবু-টাবু বলতে হবে?’
‘না না শুভবাবু-টাবু আমাকে কেউ বলে না। হয় বলে শুভম, নইলে বলে সরকার।’
তবে এই নিন, পান নিন শুভম’— মালবিকাদি পানের ডিবে বার করে, সযত্নে সরু করে সাজা পানের দুটো খিলি এগিয়ে দিলেন।
‘আপনি কি পানাসক্ত?’ শুভম জিজ্ঞেস করে— ‘কিন্তু বোঝা যায় না তো?’
‘পানাসক্ত আমি ঠিকই। কিন্তু পানে খয়ের দিই না কখনও। তা ছাড়াও দাঁত সম্পর্কে সতর্ক আমি।’
‘বা, আমরাও যদি এমনি হতে পারতাম’— শুভম আক্ষেপ করে।
‘লবঙ্গ ছোট এলাচ একসঙ্গে চিবিয়ে নেবেন, আর এই পানের পাতা যদি একটু চুন লাগিয়ে চিবিয়ে নেন, তা হলে তো আরও ভাল। গন্ধ পাওয়া যাবে না।’
‘মানে বলছেন পান স্কোয়্যার?’
‘যা বলেন। তা আপনার বাড়ি কি খুব কনজারভেটিভ? জাহাজের লোকেদের তো শুনি…’
‘আর বলবেন না। আপনি একজন বাইরের লোক হয়ে বোঝেন, আর আমার মা বাবা এঁরা বোঝেন না। একদম। বাবা বলেই দিয়েছেন—কোনও ছুতোতেই মাতাল দাঁতাল হওয়া চলবে না। মায়ের কথা যদি বলেন, এমন আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ি মা আমি দেখিনি। ভদ্রলোকের বাড়ির ছেলে যে মদ ছুঁতে পারে তা তিনি বিশ্বাসই করতে পারেন না। অথচ ম্যারিন..বুঝলেনই তো।’
‘হুঁ, আপনার খুব প্রবলেম।’ মালবিকাদি ঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত করে বললেন— ‘এবার আমায় উঠতে হচ্ছে। চলি, আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভাল লাগল ভাই সরকার।’
‘উঠছেন?’ রাজ্যের হতাশা ঝরে পড়ে শুভম-এর গলা থেকে।
‘এই যে পাত্রীর কথা বলছিলেন? আপনারাও কি আমার মায়ের মতোই কনজারভেটিভ? ম্যারিন শুনেই পিছিয়ে গেলেন।’
মালবিকাদি হাসিমুখে বললেন— ‘পাত্রীর কথা আপনিই বলছিলেন ভাই, আমি তো বলিনি।’
‘সে কী? এই যে বললেন সুস্থ, সবল আর কী চাই! ভাল পাত্র—’
‘তাই বলুন। আমি বলেছি পাত্রের কথা। কিন্তু কোনও পাত্রীর কথা আমি তো কখনোই বলিনি!’
হাসি-হাসি মুখে শুভমের দিকে চেয়ে আছেন মালবিকাদি।
‘আচ্ছা তা যেন হল, আমিই না হয় পাত্র শুনে অবধারিতভাবে পাত্রীর কথা বলে ফেলেছি। কিন্তু আপনার এ রকম নামধামহীন হয়ে চলে যাওয়াটা আমার একটা লস বলে মনে হচ্ছে।’
‘নাম তো আগেই বলেছি, মালবিকা সান্যাল। ধাম বলতে আমাদের সেন্টার হল শ্যামপুকুর স্ট্রিট, চুয়াল্লিশের বি—ওইখান থেকেই আমি অপারেট করে থাকি। যদি কিছু সমাজসেবা করতে চান…’ মৃদু হাসি দিয়ে অসমাপ্ত বাক্যে ইতি টেনে, কাঁধে ব্যাগ, হাতে ফাইল মালবিকাদি চলে গেলেন।
শুভম বিদায় জানাতে উঠে দাঁড়িয়েছিল, মালবিকাদি চেয়ার ছেড়ে একটু এগোতেই সে মালবিকাদির পরিত্যক্ত চেয়ারে বসে পড়ে। দেওয়ালের দিকে মুখ করে বসে থাকতে নিশ্চয়ই কারও ভাল লাগে না। এবং দেখে মালবিকাদি সুনীল আঁচল বাঁহাতের কনুইয়ের ওপর দিয়ে ন্যস্ত করে কেমন সোজা সতর্ক ভঙ্গিতে একটার পর একটা ধূমায়মান জটলা পার হয়ে চলে যাচ্ছেন। দরজা পর্যন্ত গিয়ে মালবিকাদি পেছন ফিরে এক বার হাতটা নাড়লেন, মুখে হাসি।
ইস্ মালবিকাদির চেয়ারের সিটটা এখনও গরম হয়ে আছে। ঠিক ওঁর দরদী মরমী মনটুকুর মতোই নরম গরম। এত অল্প সময়ের মধ্যে এতো সুন্দর আলাপ কারও সঙ্গে হতে পারে, বিশেষ, কোনও মহিলার সঙ্গে শুভমের যেন ধারণাতেও ছিল না। কী চমৎকার ভদ্রমহিলা। মালবিকাদি আহা মালবিকাদি…। মালবিকা, মাধবিকা, মাধুরিকা, মানসিকা…শুভম আরো এক কাপ কফির অর্ডার দেয়। আলাপ সালাপ একা হলেই জমে ভাল, তুমিও একাকী আমিও একাকী। এই যদি এখন তার বন্ধু রাধেশ্যাম পেছনে থেকে এসে তার বিরাট ধ্যাবড়া পাঞ্জা দিয়ে তার কাঁধে থাবড়া কষাত ‘কিরে স্ শালা, খোঁয়াড়ের ভেড়া খোঁয়াড়ে ফিরেছিস তা হলে?’
কী হত? ঘড়ঘড়ে গলায় বকবক করে যেত রাধেশ্যাম। মালবিকাদি উঠে যেতেন, ওরা লক্ষও করত না। খানিকটা সময় অনর্থক ভ্যাড়ভ্যাড়ানি। সে কত টাকা উপায় করে, মাসে হাজার টাকা করে রাধেশ্যামকে দিক না, আফটার অল সে-ই তো নিজের সীটটা ছেড়ে দিয়ে শুভমকে ম্যারিনে চানস দিয়েছিল! তা না-ই দিক, ও রকম স্যাক্রিফাইস রাধেশ্যাম অনেক করেছে, টুইশ্যনি করেই রাধেশ্যাম পর্ণশ্রীতে ফ্ল্যাট কিনেছে, বেলেঘাটায় ফ্ল্যাট কিনেছে। সে কারও কড়ি ধারে না। মারোয়াড়ি বাড়িতে বাঁধা টুইশ্যনি রাধেশ্যামের। সরকারি চাকরি। হপ্তায় এক দিন হাফ ডুব আরও দু দিন ফুল ডুব দিয়ে রাধেশ্যাম চালিয়ে যাচ্ছে। পুরো সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ জুড়ে রাধেশ্যামের বাজার। এক এক বাড়িতে নটা দশটা করে বাচ্চা পড়ায়। ন দশ হাজার করে ফিজ পায়। এই সব গপ্পো মারতে মারতে সময়টা কেটে যেত ঠিকই, কিন্তু মুখে একটা বাজে স্বাদ নিয়ে বাড়ি ফিরতে হত। মেজাজটা থাকত চড়ে। সুমিতার সঙ্গে রাত রোম্যান্সটা জমত না। একেই তো মেজাজি মেয়ে।
‘খেয়ে এসেছ? দাড়ি কামাওনি? চুল এত চিপচিপে কেন? শ্যাম্পু করতে পারো না? আবার রাধেশ্যামের সঙ্গে আড্ডা মেরেছ? সারা গা দিয়ে রাধেশ্যাম-রাধেশ্যাম গন্ধ ছাড়ছে।’
অদ্ভুত ঘ্রাণশক্তি সুমিতার।
‘রাধেশ্যাম-রাধেশ্যাম গন্ধ যে করছো? গন্ধটা চিনলে কী করে?’
‘এই, খবর্দার বাজে কথা বলবে না। রাধেশ্যামের গন্ধ ঘাম, লাড্ডু, ভুজিয়া, মালাই, নস্যি, বাংলু আর খারাপ পাড়ার গন্ধ—সবাই চিনবে। আমি সাইকলজির লোক। আমার কাছে চালাকি নয়।’
‘সাইকলজির লোক’ ব্যাপারটাকে সুমিতা তার একটা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, সব রকমের মোকাবিলায়। এবং ওই বাক্যাংশটি সুপার হিট। ‘সাইকলজির লোক’ মানেই যেন তার চোখের সামনে মানবচরিত্র খোলা পড়ে আছে। সে যা বলবে সব্বাইকে তা মেনে নিতে হবে। এ ব্যাপারে যদি শুভম পয়লা রাত্তিরেই বেড়াল মারতে পারত, কোনও ঝামেলা হত না। কিন্তু তা সে পারেনি। তার মতো একদা-ফেলুটস আড্ডাবাজ ছোকরার যে সাইকলজির অধ্যাপিকা গুচ্ছের মাইনে পাওয়া স্বাধীনচেতা অথচ লিচুর মতো নরম রসালো বউ জুটবে তা সে ভাবতেও পারেনি। অধ্যাপিকা শুনে প্রথমেই সে প্রস্তাবটা বাতিল করে দিয়েছিল। তার মা-বাবা তখন হন্যে। এই রে ছেলে জাহাজে চড়ে ভেসে গেল বয়ে গেল বুঝি, চরিত্রহীন হবার সব রকম উপাদান না কি এ চাকরিতে আছে। তাঁরা বললেন— ‘অধ্যাপিকার যোগ্য তুই নোস আমরা জানি। তবু, বেড়ালের ভাগ্যেও তো শিকে ছেঁড়ে! মেয়েটিকে এক বার দেখে, আলাপ করেই আয় না।’
শুভম তখন প্রথম সফর সেরে এসেছে। খুব কাঠখোট্টা। সুমিতার দিদির দেওর তার বন্ধু। সেখানেই সুমিতার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা। বন্ধু নিলয় তাকে ড্রয়িং রুমে বসাল ‘চা খাবি না কফি?’
‘কফি,’
‘দাঁড়া বলে আসি।’
নিলয়ও বলে এল, একটি সালোয়ার কামিজ পরা কিশোরীও কফি নিয়ে ঢুকল।
শুভম তখন ভীষণ যাকে বলে এস্মার্ট। সে কফির কাপ তুলে নিয়ে খুব স্টাইলের মাথায় বলল— ‘তোমার সঙ্গে পরে আলাপ করব। আগে তোমার দিদিকে ডেকে দাও।’
নিলয়দের বাড়ির সবাইকে সে চেনে ; এ মেয়েটি নতুন, অর্থাৎ তার অধ্যাপিকা দিদির সঙ্গে মজা দেখতে হাজির হয়েছে—এমনটাই তার ধারণা।
মেয়েটি মিটিমিটি হেসে বলল— ‘আমিই আমার দিদি।’ এবং নিলয় অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল।
শুভম বোকার মতো বলল— ‘আমি ভেবেছিলুম আপনি হায়ার সেকেন্ডারি-টারি পড়েন।’
‘অসাবধান মুহূর্তে সাবকনশাস তো ঠেলে উঠবেই। আসল কথা আপনি অ্যাভারেজ বাঙালি কুমারের মতো শ্যালিকায় বেশি ইন্টারেস্টেড।’ নিলয়ের হাসি আরও বেড়ে গেল।
‘কিন্তু আমিই আমার দিদি আমার বোন সবই, দুঃখিত।’
দুঃখিত বললেও দুঃখের কোনও ছায়া-ছবি দেখা যায়নি সুমিতার মুখে।
মাথায় ঝাঁকড়া এক ঝুড়ি চুল, লিচু-লিচু মুখ, কাজল-পরা-শয়তান-শয়তান চোখ, হাসি-উপছে পড়া ঠোঁটের এই পাঁচফুটি সালোয়ার কামিজ নাকি এক্সপেরিমেন্টাল সাইকলজিতে এম এসসি, একটা মহিলা কলেজের অধ্যাপনায় ঢুকেছে।
তারপর নিলয়ে সুমিতায় শুভমে যে জমজমাট আড্ডাটা হল, সেটা রাত্তির নটা পর্যন্ত যখন গড়ালো তখন শুভম সুমিতাকে সুমিতা বলছে। সুমিতা শুভমকে শুভম বলছে, মার্লান ব্র্যান্ডো, ইউল ব্রিনার, অড্রে হেপবার্ন সম্পর্কে মতামতের আদানপ্রদান হয়ে গেছে। শুভম এবং নিলয়ের পাহাড় ভাল লাগে, সুমিতার সমুদ্র। সুমিতা শীত ঋতুর ভক্ত, কেনো বেড়ানো যায়, নানা রং পরা যায় শুভমের বর্ষা ভাল লাগে বাড়ি ফিরতে দেরি হলে কেউ রাগারাগি করে না বলে, সুমিতা শ্যাম্পেন এবং পোর্ট চাখতে চায়, জিন উইথ লাইম ছাড়া আজও কিছু খায়নি, ড্রাই মার্টিনি কাকে বলে জানতে আগ্রহী, সুবোধ ঘোয আর পরশুরামের দারুণ ভক্ত, শুভম নারায়ণ গাঙ্গুলির টেনিদার। সুমিতার এক্সপার্ট ওপিনিয়ান—শুভমের মেন্টাল এজ বালকের। এবং এই রকম বালক-বালক লোককে ট্যাকল করতে তার দারুণ লাগবে বুঝে শুভম পুলকিত।
শুভম এখনও বউয়ের বাৎসল্য এবং মনস্তত্ত্ব-জ্ঞানের ছায়ায় ছায়ায় রয়েছে। সমুদ্রযাত্রার সময়ে সুমিতা তাকে বাছা বাছা গল্পের বই, বাছা বাছা ফটো গুছিয়ে দেয়। যত কান্না পায় তত বেশি হাসে, যত মন মরা হয় তত লাফায় ঝাঁপায় এবং মুখ ঝামটে ঝামটে বলতে থাকে ‘তোমার আর কী! কত দেশ দেখবে, জাহাজও তো একটা রাজপুরী বিশেষ। ভাল ভাল খাবে, তরল চলবে খুব…আমারই মুশকিল।’
আসলে কিন্তু উল্টো। শুভম দেখে শুধু জল, জল আর জল, ডাঙা যখন আসে তখন নিজেকে পরিত্যক্ত, পরিচয়হীন, অবান্তর লাগে, দিনের পর দিন স্টোরেজের খাবার খেয়ে খেয়ে ক্রমশ খাবার ইচ্ছে চলে যায়, ভাল ভাল তরল সে খেতে পায় ঠিকই কিন্তু অনীশ, সুমন, প্রদীপ, নিলয় ইত্যাদি বন্ধুদের সঙ্গে খাওয়ার মজা আলাদা। আর এদিকে সুমিতা? শ্বশুর-শাশুড়ি মা বাবা দিদি জামাইবাবুর স্নেহচ্ছায়ায় দিব্যি থাকে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে মেরে এখন রকে বসলেই হয়। সাজছে গুজছে, কলেজে পড়াবার নাম করে গিয়ে কলীগ ছাত্রী সব্বার সঙ্গে আড্ডা মেরে আসছে, থিসিস-ফিসিস লিখছে আর বর নেই বলে সবাইকার সহানুভূতি কুড়োচ্ছে। তার ওপর এই কন্যা দুটি হবার পর থেকে তো সুমিতার পাত্তাই পাওয়া যায় না। বালিকা দুটিকে প্যারাগন করে তুলতে সুমিতা বদ্ধপরিকর। তার মনস্তত্ত্বজ্ঞানের পুরো বেনিফিটও সে মেয়েদের দিতে চায়।
আহা, মালবিকাদির মতো স্নেহশীলা দরদিনী কেউ যদি তাদের পরিবারে থাকত! মাঝে মাঝে মনে পড়ে মালবিকা সান্যালের মুখ…উড়ক উড়ক তারা পউষের জোৎস্নায় নীরবে উড়ুক।
আরও খানিকটা ঘুরে ঘেরে রাত্তির নটা করে শুভম বাড়ি ফেরে।
সুমিতা চান সেরে পাউডারে সাদা হয়ে একটা হাফ পাঞ্জাবি আর পাজামা পরে হাতে ঠাণ্ডার গেলাস নিয়ে বসে। বড় মেয়ে দেবাঞ্জলি এখনই সুমিতার থেকে লম্বা হয়ে গেছে, ধরণধারণও ভাবুক, গম্ভীর-গাম্ভীর, সে সুমিতাকে একটি ছোটখাটো লেকচার দিচ্ছে মনে হয়, এবং সুমিতা মুখ উঁচু করে শুনছে। আম্রপালী ঘরের আরেক দিকে মেঝেতে গুচ্ছের রং তুলি ছড়িয়ে আঁকায় মগ্ন। ঘরে ভাল করে পা দিয়ে শুভম বুঝল দেবাঞ্জলি কোনও পার্ট মুখস্থ বলছে, লেকচার দিচ্ছে না। অর্থাৎ অভিনয়-টয় আছে আর কি কোথাও। তবে লেকচার দিলেও আশ্চর্যের কিছু নেই। কার মেয়ে দেখতে হবে তো।
শুভমকে দেখেই তিনজনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আঁকা ফেলে আম্রপালী উঠে এসে বাবার হাত ধরে টানতে থাকে। দেবাঞ্জলির মুখস্থ বলা শেষ হয়ে গেলে সুমিতা বলে— ‘জল থেকে ডাঙায় তুললেই তুমি খাবি খেতে থাকো, না? —নটা বেজে গেল, কোথায় গিয়েছিলে? মা খাবার নিয়ে বসে আছে।’
‘ওহ্ তোমাদের সবাইকার খাওয়া-দাওয়া শেষ?’
‘মেয়েদের হয়ে গেছে, আমি তোমার জন্যে পেটে কিল মেরে বসে আছি।’ নাহলেই তো আবার রাগ হবে। উঃ কী দারুণ খিদে। সুমিতা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল।
দেবাঞ্জলি একটা ফুলকাটা হাউজকোট এগিয়ে দেয় মায়ের দিকে। সেটাতে হাত গলিয়ে সুমিতা নাক কুঁচকে বলে ‘পান খেয়েছ মনে হচ্ছে? খাওয়া-দাওয়া সেরে এলে নাকি?’
‘কোনও কোনও পান খাওয়া দাওয়ার আগেই খাওয়া যায়।’
‘সে পান নয়, আমি পোস্ট-ডিনার সলিড পানের গন্ধ পাচ্ছি।’
‘একটা পান আমি খেতে পারি না?’
‘না, তা পারবে না কেন, অবশ্যই পারবে।’ —সুমিতা খুব সন্দেহের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
নাক বটে একখানা। শুভম মনে মনে বলে। রাধেশ্যাম-রাধেশ্যাম গন্ধ, এবার কি মালবিকাদি-মালবিকাদি গন্ধ বলবে?
তাকে অবাক করে দিয়ে সুমিতা বলে— ‘পানটা কোনও দোকানের নয় এটুকুই “সাইকলজি’র লোক’ হিসেবে তোমাকে বলতে পারি।” এবং তাকেও অবাক করে দিয়ে শুভম বলে—‘ঠিকই বলেছ। মালবিকাদি দিয়েছে।’ বলেই শুভম হাত মুখ ধুতে চলে যায়।