মেয়েলি আড্ডার হালচাল : 02
এই বার পাঠক, আমি মাঝে মাঝেই আমার আমি সত্তা বিসর্জন দিয়ে রঞ্জনা সত্তাতে অন্যদের হাতে নিজেকে ছেড়ে দেব। বন্ধুদের কাছে একটা প্লট চেয়েছিলুম তো ওরা দিল না। মানে দিল, কিন্তু ওরা জানে না ওরা দিয়েছে। হে ঈশ্বর, ওদের ক্ষমা করো, অকিঞ্চিৎকর মনুষ্যসকল, উহারা জানে না উহারা কী করিয়াছে। কিন্তু ঔপন্যাসিকের বেসিক্স তো আমার আছে। আমি সবজান্তা, সর্বত্রগামী, সর্বত্র উপস্থিত। অমি সমস্ত আমির গহনে ডুব দিতে পারি, আমি মালবিকাতেও আছি, সুমিতাতেও আছি, ধর্মে এবং জিরাফে এক সঙ্গে অবস্থান করার মতো। কর্ণের ছিল সহজাত কবচকুণ্ডল, আমার আছে সহজাত টেলিস্কোপিক লেন্স চোখে, কানে সহজাত হিয়ারিং এইড। বধিরদের জন্যে তৈরি নয় শ্রুতিমানদের স্পেশ্যাল। আমার পায়ে অদৃশ্য রণপা, হাতে গুলতি থেকে বুমেরাং থেকে অতি আধুনিক এ কে ফর্টি সেভেন। পাশুপতাস্ত্র, ব্রহ্মাস্ত্রের জন্য সাধনা শুরু করেছি। মনে রয়েছে প্রখর ইন্টুইশন। এমত অবস্থায় আমার অনুকম্পা এত বেশি থাকে যে কখন আমি কাজলরেখা মিত্তির, হাস্যমুখী মৌরি-চিবোনো, পকেটমার হয়ে যাচ্ছি, কখন ধুরন্ধর, প্রখর বুদ্ধিসম্পন্না বয়ছাঁট মালবিকা সান্যাল হয়ে যাব, কখন হরিণীসদৃশ, ছটফটে, ফন্দিবাজ শিল্পী বরাট, কখন আবার সাইকলজির লোক সুমিতা সরকার হয়ে যাব তার কোনওই ঠিক-ঠিকানা নেই। ভোলেভালা গঙ্গাপ্রসাদ, অতিব্যস্ত বিকাশকান্তি যাঁর নাকি ভুঁড়ো শেয়ালের মতো চেহারা বা পার্ট-টাইম লাইফ-পার্টনার বলে খ্যাত শুভম সরকার বা উদার আমুদে স্বভাবে চন্দন বরাট—এদের যে কেউ হয়ে যাওয়াও আমার কেউ আটকাতে পারবে না। খালি নিরুপমটা আমি পুরোপুরি হতে পারব কি না জানা নেই। প্রদীপের তলাতেই অন্ধকার বেশি কি না।
আমার দক্ষিণের জানলার থেকে দেখা যায় একটা বিঘে খানেকের প্লট। চারপাশে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পড়ে আছে কোনও ভাগ্যমন্ত পকেট-ভারী এন আর আই-এর জন্যে, কিংবা কোনও ঘোড়েল, ওয়েল কানেকটেড প্রোমোটার-ডেভেলপারের জন্যে।
এই পড়ে থাকাটা আমাদের লাভ। প্রচুর দখিনা বাতাস পাই। একটি পুং তালগাছ তার ঝাড়ালো যৌন-কেশ নিয়ে, একটি বিরাট এবং দু-তিনটে মাঝারি রাধাচূড়া, সাদা গুলঞ্চ একটা, শিমূল দুটো। এখন তাদের রজঃস্বলা অবস্থা শেষ হয়ে গেছে। ফল ফাটিয়ে প্রচুর রেশমি তুলোও তারা পাঠিয়েছে এ বাড়ি ও বাড়ি, এখন নিশ্চিন্ত সবুজ। আরও আছে বাঁকা নারকেল। ঝাঁপালো বেল, কিন্তু বেল পাকলে কাকের কী! আমাদের বাজার থেকেই বেল আনতে হয়, নিমও আছে তার সম্পর্কেও এই একই কথা প্রযোজ্য। আর আছে সপ্তপর্ণী ; যার ওপর আমার বাল্যবয়স থেকে নিদারুণ পক্ষপাত। ঝোপ ঝাড় আছে তলায়, তলায়, কিন্তু এই ছাতিম, গুলঞ্চর ডালপালার ফাঁক দিয়ে, শিমূলের গা ঘেঁষে একটি ছায়াময় পথ দেখা যায়—হলুদ-ব্রাউন, সামান্য একটু পথ, ভাঙা ভাঙা গেটে গিয়ে শেষ হয়েছে। কিন্তু যেন শেষ হয়নি, চলে গেছে পাঁশকুড়া, মেমারি, শক্তিগড়, বর্ধমান পেরিয়ে গুসকরা, পিচকুড়ির ঢাল, ভেদিয়া পেরিয়ে রিকশা চড়ে সেই মহাবটের গা ঘেঁষে যেথা সেই চৈত্রের শালবন। শালের মঞ্জরীর গন্ধ রোদের গন্ধের সঙ্গে মিশে আপাদমস্তক শা-ন্ত অথচ মত্ত করে দিচ্ছে। গোরুর গাড়ির না-তেল দেওয়া চাকার ক্যাঁচ-কোঁচ ক্যাঁচ-কোঁচ, মাটির বেহালার ছড়ের টানের মতো শুনতে পাই।
অধ্যাপক গঙ্গাপ্রসাদ মিত্র এখন শান্তিনিকেতনে। প্রায়ই যান। কখনও অতিথি অধ্যাপক হয়ে, কখনও গবেষণার কাজে, নিজের তো বটেই, প্রোফেসর জেনকিন্স বলে এক অস্ট্রেলীয় ছাত্রের জন্যও তাঁকে যেতে হয়। একটি লিটল ম্যাগের শারদীয় সংখ্যার জন্য জেনকিন্স একটি প্রবন্ধ লিখছেন। রবীন্দ্রপরবর্তী যুগের সব কবিই রবীন্দ্রনাথের মতো লেখা দিয়ে শুরু করেছেন—এই তাঁর প্রতিপাদ্য, জীবনানন্দর ‘ঝরা পালক’, সুধীন্দ্রনাথের ‘তন্বী, বুদ্ধদেবের ‘বন্দীর বন্দনা’ প্রধানত তাঁর শিকার। প্রবন্ধের নামটা প্রোফেসর জেনকিনস আগেই ঠিক করে ফেলেছেন, প্রোফেসর গঙ্গাপ্রসাদ বন্ধু (মিত্র)কে জিজ্ঞেস করেই। নাম—‘উত্তররৈবিকে রবিরুদয়।’
গঙ্গাপ্রসাদ বলেন ‘নামটা একটু খটোমটো হয়ে গেল না?’
‘খাটোমাটো বলেই তো আগ্রহ যেমন “চলচ্চিত্ত চঞ্চরী’, যেমন “সন্মার্গ সপর্যা”।’ প্রোফেসর বলতে চান খটোমটো বলেই নামটা লোকের আগ্রহ ঔৎসুক্য জাগাবে।
‘কিন্তু রবিরুদয়টা যেন কেম’ন, গঙ্গাপ্রসাদ খুঁত খুঁত করতে থাকেন। ‘রবেঃ+উদয় = রবেরুদয় একটা হয় আর একটা হতে পারে রবি+উদয় = রব্যুদয়। কিন্তু…’
অধ্যাপক জেনকিন্স তাড়াতাড়ি তাঁকে থামান, —‘আপনার গোড়া গলদ হচ্ছে অধ্যাপক বন্ধু—এটি বাঙালা সন্ধি। রবির+উদয় = রবিরুদয়। অক্সিমোরোন অর্থে বিরোধাভাস অলোঙ্কার হল। গোড়াতেই পাটকের চমক হচ্ছে।’
ফাদার জেনকিন্স আজকাল বাংলা উচ্চারণ অনেক সড়গড় করে নিয়েছেন। তার ওপরে সংস্কৃতও শিখছেন। কিন্তু অত কঠিন ‘চলচিত্তচঞ্চরী’ বা ‘সন্মার্গ সপর্যা’ উচ্চারণ করতে তাঁর অসুবিধে হচ্ছে না অথচ সামান্য পাঠককে কেন তিনি সব সময়েই মেরে পাট করে দেওয়ার মতো ‘পাটক’ বানিয়ে দেন, প্রায়ই হচ্ছেকে ‘হোছে বলেন তা গঙ্গাপ্রসাদ বুঝতে পারেন না। বাংলাকেই বা তিনি কেন ‘বাঙালা’ বলবেন? বেশি কথা কি তাঁর আলোচিতব্য তিনটি বই? ‘ঝরা পালক’ কী তিনি বলেন? বলেন ‘জরা পালক’, ‘তন্বী’ও তিনি বলেন না, বলবেন ‘তনভি’, বেশি চাপাচাপি করলে ‘তিন্নি তিন্নি’ বলে হাততালি দেবেন। এমন নয় যে তিনি অধ্যাপক বন্ধুকে খ্যাপাতে চাইছেন, এ বয়সে কি আর খুনসুটি মানায়? আসল কথা সঠিক উচ্চারণটা তিনি ঠিকমতো ধরতে পেরেছেন মনে করেই আনন্দে হাততালি দ্যান। ভারী সরলমতি ছেলেমানুষ ফাদারটি। তারপরেই ব্যন্ডির বাডনা বলে তিনি ব্যাণ্ড বাদ্য বাজিয়ে দেবেন।
খুবই মনঃক্ষুন্ন হন গঙ্গাপ্রসাদ। দোষটা তাঁরই। তিনিই যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক উপায়ে ফাদারকে শেখাননি। ফনেটিকস চর্চা তিনি তেমন করে করবার সময় পাননি। আজীবন তিনি জীবনান্দে মজে আছেন। ফলে তাঁর খানিকটা ইয়েটস চর্চা, পো-চর্চা আছে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়-চর্চাও তিনি করে থাকেন। কিন্তু ফাদার জেনকিনস তাঁর ছাত্র হওয়ার আগে ফনেটিকস-চর্চার উপযোগিতা তিনি বুঝতে পারেননি।
যাই হোক, ‘উত্তর-রৈবিকে রবিরুদয়’—শিরোনামটা শুনেই দুর্গাপুরের একটি লিটল ম্যাগাজিন ফাদার জেনকিন্সকে স্বাগত জানিয়েছে। যদি প্রবন্ধটা খুব বড় হয়ে যায় তো তার জন্যে কয়েক ফর্মা বাড়াতেও ওরা রাজি আছে, অবশ্য সবিনয়ে জানিয়েছে ফাদার জেনকিন্স্ যদি সামান্য ব্যয়ভার বহন করেন, তা হলে …পূর্বাঞ্চলের সমস্ত সংস্কৃতিমান পাঠকই ‘উস্রী শারদীয়র জন্যে হা-পিত্যেশ করে বসে থাকেন তো! ফাদার লেখা শুরু করার আগেই পঞ্চাশ ডলার পাঠিয়ে দিয়েছেন। তো এখন ফাদারকে সহায়তা করা কি গঙ্গাপ্রসাদের পবিত্র কর্তব্য নয়?
শিরোনাম নিয়ে গঙ্গাপ্রসাদের খুঁতখুঁতুনি যে কিছুতেই যাচ্ছে না এ ব্যাপারে ফাদারের জ্ঞান টনটনে। তিনি ভাল করে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেন—‘বাঙালা সাহিত্যে আমি কিছু অবদান করতে চাই। অধ্যাপক বন্ধু। নুতুন কিছু। পুরনোর চর্বণচর্বিতে কী লাভ হচ্ছে? বাঙালা ইউসেজের একটি বই অধ্যাপক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বার করেছেন, তাতে তিনি ওনেক স্বাধীনতা দিচ্ছেন, যেমন ফাউলারের নুতুন এডিশন। কিন্তু আমি আরও স্বাধীনতা করতে চাই।’
গঙ্গাপ্রসাদ সংক্ষেপে শুধু বলেন, ‘নীরেন্দ্রনাথ কবি, তিনি অধ্যাপক নন।’
‘কিন্তু তিনি তো ভাষণ দিচ্ছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সব ভিড় কচ্ছে। যেমন আর্নল্ড’
‘কিন্তু আপনাদের আর্নল্ড পোয়েট্রির চেয়ারে ছিলেন অক্সফোর্ডে। অডেন, স্পেন্ডার এঁদের কথা ধরুন, সবাই তো ভাষণ দিয়েছেন বাবা জেনকিন্স। কিন্তু তাঁদের পরিচয় কি অধ্যাপকের।’
বাবা জেনকিন্স্ শুনে ফাদার ঘাবড়ে যান। গঙ্গাপ্রসাদ খুবই সদাশয় মানুষ, কিন্তু কোনও কারণে বিরক্ত হলেই তিনি বাবা জেনকিন্সটা বলে থাকেন। এখন, গঙ্গাপ্রসাদের বিরক্তির কারণ ওই ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ এবং ‘ভির’, বিশ্ববিদ্যালয়টা পরিষ্কার উচ্চারণ করে ‘ভিড়ে’ এসে ফাদার জেনকিন্স ভিরমি খান কী করে?
যাই হোক, এই কাজে এখন মগ্ন, গঙ্গাপ্রসাদ এবং তাঁর ছাত্র। খুবই মগ্ন, ছাত্র মগ্ন পড়াতে এবং লেখাতে। মাস্টার মগ্ন এড়াতে এবং পালাতে। এ ছাড়াও গাছের তলায় ছাত্রদের স্পেশ্যাল ক্লাস নিতে গঙ্গাপ্রসাদের অনেকটা সময় যায় এ মত সময়ে পত্নী কাজলরেখা মিত্তিরের একটি চিঠি আসে—
‘প্রিয়তমেষু,
আশা করি তুমি তোমার বাবা-সহ ভাল আছো। তোমাকে দুটি মা-ও পাঠাচ্ছি কত দিন আর মাতৃহীন হয়ে কাটাবে বেচারি খোকাবাবু? একটি মা তোমার সাক্ষাৎ কন্যা সে তোমাদের ওপর নজর রাখবে। আর দ্বিতীয়টি আমার সাক্ষাৎ বন্ধু বা বান্ধবী বা বন্ধুনী রঞ্জনা ‘পরদারেষু লোষ্ট্রবৎ।’ সে কয়েকদিন শান্তিনিকেতনে যাপন করতে চায়, বিশেষ শান্তির আশায়। দেখো কারও কোনও অশান্তির কারণ না হয়।
ইতি
একান্ত তোমারই
কাজল
চিঠিটি পেয়ে গঙ্গাপ্রসাদ হতবাক হয়ে যান। ‘প্রিয়তমেষু?’ এই সম্বোধন কাজলরেখা মিত্তির তাঁকে এ জন্মে কখনও করেনি। প্রথম বিবাহের পর তিনি কাশী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেমিনারে যোগ দিতে যান এবং পত্নীকে প্রিয়তমাসু সম্বোধনে চিঠি দ্যান। সে লজ্জার কথা গঙ্গাপ্রসাদ ইহজীবনে ভুলবেন না। চিঠির উত্তরে যে চিঠি আসে সেটি কম্পিত হাতে খুলে তিনি দেখেন সম্বোধন লেখা রয়েছে—গঙ্গাপ্রসাদেষু জাঠামশাইসু। ভেতরে যা লেখা আছে তা আর কহতব্য নয়। বাংলার মাস্টারমশাইকে তাঁর নব পরিণীতা পত্নী জ্ঞান দিয়েছে—বিংশ শতকের গোড়ার দিকেই স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর গিন্নিবান্নি স্ত্রীকে ‘ভাই ছুটি’ বলে সম্বোধন করেছেন। গঙ্গাপ্রসাদ তাঁর বিরহ কাতরতার কথা জানিয়েছিলেন, কাজল লিখেছিল বিরহ খুব স্বাস্থ্যকর। তিনি আদর সোহাগ সাধারণভাবে এবং বিশেষভাবে চুম্বন দিয়েছিলেন। কাজল তার উত্তরে লেখে—বাবা গো এত দূর থেকেও আমার হাঁসফাঁস লাগছে, ঝাঁটা গোফ ফুটছে।
সেই বেরসিকা স্ত্রী আজ তাকে একুশ শতকের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ‘প্রিয়তমেষু’ সম্বোধন করছে? কন্যা অর্থাৎ তীর্ণা। তিনু আসছে, খুব ভাল কথা। তিনু এলে তাঁর খাওয়া দাওয়ার সুবিধে হয়। তিনু নিজে পাঁচরকম খেতে ভালবাসে কাজেই ফরমায়েশ করে ভালমন্দ তৈরি করায়। তিনু তাঁদের অর্থাৎ তাঁকে ও ফাদার জেনকিন্সকে দেখাশোনা করবে, এ খুব ভাল প্রস্তাব, বাবা জেনকিন্স তাঁকে পাগল করে দিতে শুধু বাকি রাখছেন, সে ক্ষেত্রে তিনু একটা রিলিফ। কিন্তু ‘নজর রাখা’ ইউসেজটা কি কাজলের ঠিক হল? ভাষার এ রকম ব্যবহার ফাদার জেনকিন্সকে মানায়, কিন্তু কাজল? তারপর রঞ্জনা কাজলের বয়সী একটি ধাড়ি মেয়ে সে তাঁর মা হতে যাবে কেন? তাঁর মা হতে হলে রঞ্জনাকে আরও ধাড়ি হতে হবে, নয়তো আরও অনেক কচি, এগুলো কি কাজলের বাড়াবাড়ি নয়? ‘পরদারেষু লোষ্ট্রবৎ’ এই বচনই বা সে অসঙ্গতভাবে উদ্ধৃত করল কেন? কাজলের কি মাথা খারাপ হয়েছে? তার ওপরে ‘একান্ত তোমারই?’… গঙ্গাপ্রসাদ ভেবে-চিন্তে কিছুই স্থির করতে পারেন না। কাজলের মাথা যে চট করে খারাপ হবার নয় এ তিনি হাড়ে হাড়ে জানেন। তবে?
এ দিকে তীর্ণা আর রঞ্জনা এসে পৌঁছয়। এই গরমে কেউই আর স্টেশনে যাননি। গাছ-গাছালির ছায়ায় ছায়ায় থাকতে পছন্দ করেছেন। তা ছাড়া ফাদার জেনকিনসের ঘরটি এয়ার কন্ডিশনড। এয়ার-কন্ডিশনারটি ফাদার টোপ হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। হয়তো গঙ্গাপ্রসাদ নিজের ঘরে নিজের কাজে মগ্ন। ফাদার জেনকিন্সও ‘জরা পালক’ নিয়ে পড়েছেন। কিছুটা লেখার পরই তাঁর মনে হয় এটুকু অধ্যাপক বন্ধুকে দেখিয়ে নেওয়া ভাল। সহজে যে গঙ্গাপ্রসাদ ঘাড় পাতবেন না, তা এত দিনে ফাদার জেনে গেছেন। তিনি এয়ার কন্ডিশনারটি ‘ফুল’ চালিয়ে দিয়ে গঙ্গাপ্রসাদের ঘরে উঁকি মারেন—‘ওহ। অধ্যাপক আপনি যে কী করে এই গর্মে মনঃসন্নিবেশ করছেন?’
মুখ না তুলেই গঙ্গাপ্রসাদ বলেন—‘আমরা গরম দেশের মানুষ গরমে আমাদের মনোযোগ নষ্ট হওয়া উচিত নয়।’
‘সন্ন্যাস করবার কী জরুরি অধ্যাপক বন্ধু, আমার ঘরে এখন আমলকির ওই ঢালে ঢালে, টেবিলে যথেষ্ট জাগা। আসুন না।’ অর্থাৎ ফাদার বলতে চাইছেন সন্ন্যাস অর্থাৎ কষ্ট করার কী দরকার? তাঁর ঘরে এখন শীতের আবহাওয়া। তিনি শান্তিনিকেতনে রয়েছেন সুতরাং “শীতের পাতায় লাগল নাচন আমলকির ওই ডালে ডালে” উদ্ধৃত করবার লোভ তিনি সামলাতে পারেননি। প্রথম অংশটা মনে না থাকাতেও তিনি মোটেই ঘাবড়াননি।
এখন এই আহ্বানে যদি এক বার গঙ্গাপ্রসাদ লুব্ধ হয়ে ফাদারের ঘরে যান তো হয়ে গেল। ওই চমৎকার ঠাণ্ডা থেকে তিনি আর বেরিয়ে আসতে পারবেন না। এবং এক ফাঁকে ফাদার তাঁর কাজটি সেরে নেবেন।
এই পরিস্থিতিতেই রঞ্জুমাসিকে নিয়ে তীর্ণা পৌঁছয়।
‘আমাদের জন্যে কী রান্না করিয়েছ?’ এসেই তীর্ণ মিলিটারি স্টাইলে জিজ্ঞেস করে। ‘তার আমি কী জানি?’ গঙ্গাপ্রসাদ ঠাণ্ডা ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বলেন।
‘মানে?’
রান্না-বান্নার ব্যাপার-স্যাপারের আমি কী জানি বল! শম্ভুকে বলে দিয়েছি তোরা আসছিস বাস।’
ফাদার জেনকিন্স এই সময়ে হাস্যমুখে বলেন—‘জোল-ভাত। আমরা গর্মে জোল খাই। রোহির জোল।’
‘আমি তো একা নই রঞ্জু মাসিও আসছে আর তুমি ঝোল ভাতের অর্ডার দিলে? তীর্ণা ঝাঁঝিয়ে ওঠে।
রঞ্জু মাসি তাড়াতাড়ি বলে ‘ওমা, ঝোল ভাত তো ভাল জিনিস। এই গরমে আর কিছু খাওয়া যায়? সত্যজিতের, “অশনি সংকেত”-এর শেষ দিকে “মাছের ঝোল ভাত” বলতে বলতে একটা মেয়ে মরে গিয়েছিল, মনে নেই? তার শেষ ইচ্ছে “মাছের ঝোল ভাত।”
‘তাই বলে আমাদেরও কি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ঝোল ভাত খেয়ে যেতে হবে রঞ্জু মাসি? মা গরমের দিনে রোজ বলবে আজকে পাতলা করে একটা ঝোল রেঁধে ফেলি কী বলিস? শীতের দিনে বলবে—আনাজ পাতি শস্তা, কত রকম। জম্পেশ করে একটা ঝোল রাঁধছি। উই আর ফেডআপ উইথ ঝোল।’
গঙ্গাপ্রসাদ এই সময়ে বলেন ‘তা কেন? এখন তোর রঞ্জুমাসি এসেছেন উনি ঠিকই একটা কিছু ব্যবস্থা করবেন।’
রঞ্জুমাসির মুখ যে ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে তা তিনি লক্ষ করেন না। ও দিক থেকে ফাদার হাততালি দিয়ে ওঠেন, ‘জগাখিচুড়ি, কাফতা, কোবাব, পালাও, কাঁটালের ডালডা, মোচের চপ…’
রঞ্জনার মুখ এ বার লালচে হতে শুরু করেছে সবাই লক্ষ করে। গঙ্গাপ্রসাদ কাঁচুমাচু মুখে ক্ষমা চান—‘বুঝলেন রঞ্জুমাসি, অতিরিক্ত উৎসাহ হলে ফাদারের বাংলা একটু গুলিয়ে যায়। উনি আপনার রান্নার প্রতি কোনও কটাক্ষ করেননি। উনি কাউকে পালাতে বলছেন না। গোঁফের চপও ফরমায়েশ করছেন না। আর খিচুড়ি আর জগা-খিচুড়ির তফাত আমি ওঁকে আজও বোঝাতে পারিনি।’
ফাদারও জোড় হাত করেন। কিন্তু তাঁরা কেউই রঞ্জুমাসির লালচে হওয়ার আসল কারণটা ধরতে পারেননি। মোচের চপ যে মোচার চপ এটা রঞ্জুমাসি ঠিকই বুঝেছিলেন। কিন্তু এই বিদেশি ফাদারটি তাকে দিয়ে এই সব রাঁধাবে নাকি? তার ওপর আদিখ্যেতা করে গঙ্গাপ্রসাদ যদি পোঁ ধরেন। বাড়িতে শেফালিই আছে, এখানে কে তাকে উদ্ধার করবে? তীর্ণার রকম-সকমও তো ভাল ঠেকছে না।
শম্ভু এতক্ষণ রঞ্জুমাসি ও তীর্ণার ব্যাগ সুটকেস ইত্যাদি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এ বার বলল—‘না, না, বিউলির ডাল আর বড়ি পোস্ত হয়েছে। কাঁচা আম দিয়ে মৌরলা চচ্চড়ি আর লালশাক ভাজা। দই পেতেছি রাত্তিরে বেশি করে।’
ফাদার বললেন, ‘কাদ্যতালিকা ভাল। আর দুই বাদ তো খেতেই যাচ্ছে না।’ ‘দুই’ মানে দুটি পদ তিনি বোঝাননি। তিনি বুঝিয়েছেন ‘দই।’