Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মেয়েলি আড্ডার হালচাল || Bani Basu » Page 14

মেয়েলি আড্ডার হালচাল || Bani Basu

‘বউদি বিধুভূষণবাবু এয়েছিলেন কিন্তু’— দরজা খুলে দিয়েই শেফালিবাবু অভ্যর্থনা করলেন।

‘বাড়িতে ঢুকতে দেবে তো? না কী?’

‘না বললে, তুমিই বলবে বলোনি কেন সময়মতো।’

‘মা, আমার হাত ভেঙে গেছে?’ শান্ত স্লিং-এ ঝোলানো হাত নিয়ে আনন্দে প্রায় লাফাতে লাফাতে বলল।

‘সে কী? কী করে?’

‘বাস্কেট বল খেলতে গিয়ে, সেন্ট টমাসের সঙ্গে টুর্নামেন্ট ছিল …’

‘কে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল? এক্স রে হয়েছে? কোন ডাক্তার?’

‘স্কুল থেকে মা। বাড়িতে ফোন করে তোমায় পায়নি তো! বাবাকে আপিসে ফোন করেছিল, বাবাও সিটে ছিল না। ওরাই নিয়ে গেল, এক্স রে করতে যা লেগেছে না, উরিব্বাস।’

‘তা এখন এত লাফাচ্ছ কেন? এখন কি লাগছে না? লাফাবার মতো কী হয়েছে? চুপ করে বসো গে।’— শেফালির দিকে ফিরে বললাম—‘এ কথাটা চেপে গিয়েছিলে কেন?’

‘বাপ্‌রে, দরজার গোড়ায় কখনও খারাপ খবর দিতে হয়? বউদি তুমি না মানতে পারো, আমি বাপু স-ব মানি। বিধুবাবু তো আমাদের লক্ষ্মী গো! ভাল খবরটা তাই আগেই দিলুম।’

সিঁড়ির মোড় থেকে গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এল— ‘আড্ডা শেষ হল?’

‘শেষ আর হল কই? এ একটা সিরিয়্যাল ব্যাপার। ক্রমশ ক্রমশ ক্রমশ …’

‘তাই তো দেখছি। একটা বিপদের সময়ে বাড়িতে লোকে ডেকে পায় না। ছেলের এক্সরে, ছেলের হাড় সেট, ছেলের ডাক্তারপাতি করবে অন্য লোক, হ্যাঁ?’

‘গৃহবধূ না হয় সুযোগ পেয়ে এক আধ দিন আড্ডা মারে। কিন্তু ইউনিভার্সিটির কর্মী কেন সিটে থাকে না? ইউনিভার্সিটির আপিসটা কি মামার বাড়ি? গৃহবধূ না হয় দিন দশেক গৃহ চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে বেড়াতে যায়, গৃহকর্তাই বা কেন একমাত্র সন্তানকে ফেলে বান্ধবী নিয়ে সিনেমা, রেস্তোরাঁ করে বেড়ায়?’

শেষের কথাগুলোর টাইমিং আমার হল অদ্ভুত। নীচে শেফালি সবে অদর্শন হয়েছে, তার পেছন পেছন শান্ত। শেষের জন ধরেই নিয়েছে হাত যখন ভেঙেছে তখন ক’দিন সাতখুন মাপ, অর্থাৎ লেখাপড়া, স্কুল-যাওয়া এবং সেই সঙ্গে সরীসৃপের পাঁচটি পা-ও তদ্দ্বারা দৃষ্ট হয়েছে, অর্থাৎ যা খুশি আবদার করা যাবে। এখন সম্ভবত কোনও আবদারের পশ্চাদধাবন করতেই শেফালির পেছন পেছন হাওয়া হয়েছে। ঠিক তখন আমার গলাও সুন্দর উঠছিল নামছিল, প্রফেশন্যাল শ্রুতিনটরা আমার কাছ থেকে শিখে যেতে পারেন। ধরুন ঊর্মিমালা, ব্রততী …। আর সব চেয়ে যেটা আশ্চর্যের সেটা হল গোটা ব্যাপারটাই সম্পূর্ণ অচেষ্টাসম্ভব, বেরিয়ে এল বিনা আয়াসে, কোনও চিন্তা ছাড়া। সহজাত প্রতিভাবলে, যে প্রতিভার সম্পর্কে আমি নিজেই অবহিত ছিলাম না।

সিঁড়ির মোড়ে একটি হকচকানো মনুষ্যমূর্তিকে পেছনে ফেলে আমি আমার নিজের নিজস্ব ঘরটি আশ্রয় করি। এবং ভাবতে থাকি শান্তর কেসটা কী? হেয়ার লাইন ফ্র্যাকচার? না ডিসলোকেশন, না আর একটু সিরিয়াস? এক্স রে প্লেটটা দেখলেই নিশ্চয় জানা যাবে, জিজ্ঞেস করলেও, কিন্তু ঠিক এই সময়টায় সেটা সম্ভব হচ্ছে না, কেন না এখন আমার ভূমিকা হচ্ছে ক্ষুব্ধা, অপমানিতা, খণ্ডিতার।

সবই ঠিক। অভিনয় করছি। কিন্তু এই অভিনয়টা আমি করলাম কেন? হঠাৎ? স্বতঃস্ফূর্তভাবে? তবে কি ভাঙব? এটাকেও ভেঙে ফেলব? মালবিকাদির ‘তুই’ ডাকের মধ্যে যেমন একটা সম্পর্ক গোপন করার, চোখে ধুলো দেবার চালাকি লক্ষ করেছিলুম, আমার হঠাৎ আক্রমণটাও কি তেমন কিছু একটা ঢাকতে? একটা অপরাধবোধসম্ভূত? কীসের অপরাধবোধ? বাড়িতে না থাকা? যেটা নিরুপম বলতে চেয়েছিল? আমার মনে হয় অবজেকটিভ কোরিলেটিভটা আমারও মিলছে না। বাড়ি ফেলে আড্ডা মারার অভিযোগে এতটা তেরিয়া হয়ে যাবার কথা আমার নয়। কোথায় এর শেকড় সুমিতা? পরের কথাগুলোয় কি সূত্রটা পাব? শিল্পীর কথা তুলে খোঁচা দিলাম কেন? কুকুর আমিই লেলিয়ে দিয়েছি! ইসস শিল্পীকে আমি কুকুরের সঙ্গে তুলনা করছি? কত ভালবাসি শিল্পীকে। তাকে জিরাফিণী অর্থাৎ একটি তরুণী জিরাফ বলা যায়, কিন্তু কুকুর? এ কী? কুকুর কৃষ্ণের জীব তাকে আমি এত খারাপ ভাবছি? কুকুর তো দেখতেও সুন্দর! সব কুকুরই তো নেড়িকুত্তা নয়। অ্যালসেশিয়ান আছে, ডালমেশিয়ান আছে, গোল্ডেন রিট্রীভার তো অপূর্ব! স্প্যানিয়েল, স্পিৎজ ঝুলঝুলে, তুলতুলে মিষ্টি নয়? এক যদি ডবারম্যান বলো তো কেমন বেখাপ্পা দেখতে। আর থ্যাবড়া-নেকো লম্বা-কেনো বুলডগ? সে-ও তো বেশ মজার! বুলডগ বলতেই আমার আবার শান্তর মুখটা মনে পড়ল। কেন জানি না। বুলডগের সঙ্গে বেচারা শান্তর কোনও মিল নেই। শুধু বুল-এর সঙ্গে যদি থাকেও, গাঁট্টা-গোঁট্টা তো! কিন্তু বুলডগের সঙ্গে? নৈব নৈব চ। কী আশ্চর্য! বুলডগকেও আমি কোনও ভদ্র সুন্দর মানুষ ছানার সঙ্গে অতুলিতব্য মনে করছি। শান্তকে বেচারি বলছি। মিনিট দশেক পরে দেখলুম নিজেকে বোঝবার চেষ্টায় আমি একটি সম্পূর্ণ হতভম্ব বিভ্রান্ত জীবে পরিণত হয়েছি। ঘরটা যেন আমার অবিরল প্রচেষ্টায় কেমন গরম হয়ে উঠেছে। এখান থেকে আমার পালানো দরকার।

তাড়াতাড়ি মুখ-টুখ ধুয়ে, জামা-কাপড় বদলে আমি নীচে শান্তর খোঁজে যাই। শান্ত যেখানে তার বাবাও সেখানে। সত্যিই শান্ত এবং শিষ্ট হয়ে সে বাবার সঙ্গে গল্প করছে বসে বসে।

‘কীভাবে পড়লে, তারপর কী কী হল আমাকে বল এবার’— আমি বেশ গুছিয়ে বসলাম।

‘সেন্ট টমাসের একটা দারুণ লম্বা শিখ ছেলে আমাকে ক্লীন লেঙ্গি মেরেছিল মা। পড়েছি বলটা ন্যাটা রতনকে পাস করে দিয়ে একেবারে কনুই মুড়ে।’

‘মুড়মুড়িয়ে ভেঙে গেছে? না কী?’

‘এক্স রে রিপোর্ট তো কাল পাওয়া যাবে, আপাতত ডাক্তারবাবু এই রকমভাবে রাখতে বলেছেন। একটু এদিক-ওদিক হলেই ভীষণ লাগছে মা।’— মুখটা বিকৃত করল শান্ত।

‘খেলাধুলো করতে হলে অমন একটু-আধটু হয়, কিন্তু এবার থেকে সাবধান হবে। পরীক্ষা এগিয়ে আসছে না?’

শান্তর মুখটা ফ্যাকাশে হতে শুরু করেছে। এতক্ষণ বেশ চলছিল, পরীক্ষাটা আবার কোথা থেকে এসে পড়ল? এবার পড়ার বিষয়গুলোও না পরপর এসে পড়ে, সেই জন্যে ও বাবা-মার সঙ্গে গুলতানির লোভ ছেড়ে হঠাৎ … ‘আসছি’ বলে বেরিয়ে গেল।

খুব গম্ভীর মুখে কী একটা বই পড়ছে নিরুপম। সাধারণত ও এ সময়টা প্রচুর পত্র-পত্রিকা নিয়ে বসে। একই খবর পাঁচটা কাগজে পড়বে। আজ হাতে বই নিয়ে শান্তর সঙ্গে গল্প করছিল। শান্ত চলে যেতে বইটা তুলে নিয়েছে। অর্থাৎ আমার সঙ্গে কথা বলবে না। না বলুক। আমার তো কিছু হয়নি। সুতরাং আমি বসে আছি।

এত রাগই বা কীসের? অন্যায়ভাবে আমাকে আক্রমণ করেছিল তার সমুচিত জবাব আমি দিয়েছি। দিয়েছি ছেলে এবং কাজের মেয়ের কান বাঁচিয়ে। তাতে আবার এত রাগ কীসের? সত্যি কথা বলেছি— তাই? সিটে থাকো না কেন? সিটে না থাকাটাই যেন পলিটিকস-বাজদের নিয়ম। আর যে করে করুক, আমার নিজের বর আর সব্বাইয়ের মতো অন্যায্য কাজ করলে আমি বলতে পাব না? বেশ করেছি বলেছি। বারো মাস তিরিশ দিন আমি বাড়িতেই থাকি। বাড়িতে বসে বসেই দু পয়সা রোজগার করি। এই যদি আমাকে আপিস বেরোতে হত? তা হলে? তা হলে তো ফট করে আড্ডার খোঁটাটা দিতে পারতে না নিরুপম চন্দর। আমি ঘর সামলাব, ছেলের স্কুল থেকে হঠাৎ তলব এলে, ছেলে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে আজকের এই অসম্ভবের যুগে কোথায় হাসপাতাল রে, নার্সিংহোম রে, ডাক্তার রে— সকলই সামলাব, গপ্পো আর রম্যরচনা লিখে লিখে সংসারের সাশ্রয় করব। আর তুমি সিটে থাকবে না। তুমি গরম গরম বক্তৃতা হাঁকড়াবে। আর বউয়ের স্লিম বন্ধুর সঙ্গে …। জেনে রেখো নিরুপম চন্দর গড়াই, গপ্পো লেখা খুব সোজা কাজ নয়। তার জন্য, ঘোরাঘুরি লাগে, তুমি ভাবো ঘোরাঘুরি মানে শুধু বিধুভূষণবাবুর দোকানে পর্যন্ত যাওয়া-আসা। তাই নয়? কিন্তু না, আরও অনেক ঘোরাঘুরি করতে হয়। ফর্ডাইস লেন, কীভাবে সার্পেন টাইন লেনে পড়েছে এবং কীভাবে সার্পেনটাইন ডিকসন লেন থেকে সার্কুলার রোডে পড়া যায়, জায়গাটা কেমন জানার জন্যে আমায় ওই চত্বরে পাক খেতে হয়েছিল। রিকশা নিয়ে এক দিন পুরো রামবাগান ঘুরে এসেছি, তা জানো? এখন ওখানে রামকৃষ্ণ মিশন বেতের কাজ শেখাচ্ছে তা কি জানতে? জানো কি এসপ্লানেডের কাছে যেমন ধর্মতলা আছে, শালকেতেও তেমন এক ধর্মতলা আছে, কিন্তু তার পাশে কোনও এসপ্লানেড নেই, খোলা ড্রেনে জৈব সারের চাষ আছে। তুমি মনে করো শুধু ক’জন মধ্যবিত্ত গিন্নিই আমার বন্ধু, তাদের সঙ্গে পি এন পি সি করাই আমার অবসরকালীন প্রমোদ। কিন্তু জানো কি আড্ডা মারতে গিয়ে আমি তাদের নড়াচড়া, কথা বলার ঢং, তাদের মতামত এ সবই আমার গল্পের স্বার্থে নোট করে আনি। যে গল্পের দক্ষিণায় তোমাদের দু’-দিনের বাজার তো অন্ততপক্ষে হয়ই। তা ছাড়াও, জানো কিনা জানি না আমি কিছু সোশ্যাল ওয়ার্কস করি। পাড়া বেপাড়ার যত রিকশাওয়ালা সবার সঙ্গে আমার ভাব, গরমের দিনে আমি তাদের শশা খাওয়াই ডাব খাওয়াই, এক পয়সাও ভাড়া কম নেয় না তারা তার জন্যে, শীতের দিনে তোমাদের পুরনো সোয়েটার, প্যান্ট, শার্ট আমি রিকশাওয়লাদের দিই। যদিও তাদের সেগুলো কখনওই পরতে দেখিনি, শোনা যায় সেগুলো তারা বিক্রি করে তাড়ি খেয়ে নিয়েছে। আর তুমি কী করো? — সিটে থাকো না। আর শিল্পীর সঙ্গে বেড়াতে যাও। যে শিল্পী তোমার সঙ্গে স্রেফ খেলে।

আবার শিল্পী? হায় রাম। আমার সব চিন্তা, সব খেদ, সব বক্রোক্তি যে শিল্পী-কেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে? এ কী? কে যেন বলে উঠল শালবনের কালকোটালে কোনও ভালমানুষের বিবি যায়?

ভাল করে নিরুপমের দিকে তাকিয়ে দেখি, ও বই হাতে একই রকম কাঠ হয়ে আছে। মনে অপরাধবোধ, সিটে না-থাকার জন্যে ততটা নয়, যতটা জিরাফিনী এক নারীর সঙ্গে আহেলিতে যাবার জন্য। পরিষ্কার বুঝতে পারি। যেন খোলা বইয়ের মতো বিদ্যাসাগরমশাইয়ের বর্ণ পরিচয় প্রথম ভাগের মতো আমি পড়তে পারছি আমার বরকে। এবং এ-ও বুঝতে পারছি শালবন সংক্রান্ত প্রশ্ন আমিই করেছি আমাকে। নিজের সঙ্গে এক নিবিড় কথোপকথনের সুযোগে দমকা উঠে এসেছে প্রশ্নটা।

শিল্পী তো জিরাফ রমণী। গঙ্গপ্রসাদ কী? কাজলরেখা অবশ্য বলে ভুণ্ডিল মুনি। কিন্তু আমার নিজস্ব একটা ভার্শনও তো থাকা উচিত! গঙ্গাপ্রসাদ কি এক রকমের শান্ত বাইসন? যে বাইসনের বাঁকানো শিঙের জায়গায় কড়কড়ে কালো বেশ কুড়মুড়ে চুল। যে বাইসনের চোখে আগুন নেই বরং কেমন একটা উদাস উদাস বাউল-বাউল ভাবের মধ্যে হঠাৎ হাসির ঝিকমিক আছে! যে বাইসনের লেজের বদলে কাঁচি ধুতির কোঁচা, খুরের বদলে কাবলি, থলথলে গলকম্বলের বদলে ঢোলা খাদির পাঞ্জাবি? যাঁর ভুঁড়ি আমি মাফ করে দিয়েছি তিনি আমার হৃদয়ের গোলকধাঁধার সংবাদ জানতে পেরেছেন বলে, ‘আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা’ বেশ অর্থবহভাবে আমায় শুনিয়েছেন বলে?

ভেঙেছে বাঁ হাত, তা-ও আমি সেদিন শান্তকে খাইয়ে দিলুম। ‘ন্‌ না, ন্ না— আমি পারব’—বলতে বলতে কোমর মোচড়াচ্ছিল। কিন্তু আমি জোর করতে বেশ লক্ষ্মী ছেলের মতোই খেল, একটাই অভিযোগ— ‘তোমার গরসগুলো কট্টুকু মা? আরেকটু বড় করো!’

রাত্রে ছেলেকে নিয়ে শুলামও। হাতের তলায় দুটো কুশন ঠিকঠাক করে রেখে, পিঠের দিকে একটা কুশন দিয়ে যাতে একটু বাঁ কাতে থাকে, আমি চুপচাপ শুয়ে পড়লাম। আজ আর পড়াশোনা কিছু হবে না। ছেলেটার চোখে আলো লাগবে। গরম, ঘোরাঘুরি এবং আড্ডার ক্লান্তি, সব মিলিয়ে কখন ফটাস করে ঘুমিয়ে পড়েছি।

দেখি হাফশার্ট আর ধুতি পরা উত্তমকুমার একটা কাটা দরজার, মানে সুইং, ডোরের ওপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে কথা বলছেন। উঠোনে কল, কলের তলায় টিনের বালতি। অদূরে ঘরে ওঠবার দাওয়া, সেখানে দড়ি টাঙানো। কোনও সিনেমা দেখছি না, এটা একেবারে বাস্তব। দাওয়ার ওপরের ঘর থেকে সুচিত্রা সেনের বেরিয়ে আসার কথা কিম্বা সাবিত্রী চাটুজ্জের। কিন্তু বেরিয়ে এলাম আমি। আমি আমাকে দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু আমার আমিত্ববোধ ওই দরজা দিয়ে বেরিয়ে, সুইং ডোরে হাত রাখা উত্তমকুমারের সঙ্গে কথা বলতে লাগল। খুব সাধারণ প্রতিদিনের কথা, কী তা আমার মনে থাকল না।

স্বপ্নটা ভাঙবার পর আমি অবাক হয়ে রইলাম। কোনওদিন আমি কোনও নট-নটীকে স্বপ্ন দেখিনি। এঁদের স্বপ্ন দেখা খারাপ বা এঁরা স্বপ্নে দেখার যোগ্য নন তা কিন্তু আমি বলতে চাইছি না। কিন্তু কোনওদিনই তো দেখিনি। যখন উত্তকুমার জীবিত ছিলেন! তাঁর প্রথম দিকের ছবি ‘হারানো সুর’, ‘শাপমোচন’ দেখেছি প্রথম ঘুম-ভাঙা চোখে প্রথম রোম্যান্স! কই তখনও তো স্বপ্ন দেখিনি! এখন একটা কথা বলে নেওয়া দরকার। উত্তমকুমারকে আমরা পছন্দ করতাম ঠিকই। কিন্তু একটু হাসাহাসিও করতাম। উত্তম-ভক্তরা কিছু মনে করবেন না। এ রকম হয়। উত্তমকুমারের মাথার শিঙাড়া বা হুঁ বলে মুখ তুলে তাকানো নিয়ে আমরা এক সময়ে খুব মজা করেছি। সেই শিঙাড়া ভাঙে কিনা দেখবার জন্যেই আমরা ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ দল বেঁধে দেখতে যাই এবং শেষকালে বৃদ্ধ রাইচরণের মসৃণ বিউটি-মাসাজ করা হাত দেখে হাসতে হাসতে বাড়ি-ফিরি। আসলে উত্তমকুমার ছিলেন এক জন বেশ প্রিয়দর্শন মজার মানুষ আমাদের কাছে যাঁকে আমরা কোনওদিন সিরিয়াসলি নিইনি। কোনও সিনেমার অভিনেতাকেই কি নিয়েছি, যেভাবে শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, শাঁওলি মিত্রকে নিয়েছি, কুমার রায়, অমর গাঙ্গুলি, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখদের নিয়েছি? সিনেমা বোধহয় সত্যিই-সত্যিই রপোলি পদা, রুপো দিয়ে একটা মেকি পৃথিবী বানানো, তাই ভাল লাগে, কিন্তু ওই যে বললাম— সিরিয়াসলি নেওয়া যায় না।

যাই হোক, মোদ্দা কথা বলতে, উত্তমকুমারকে নিয়ে আমার কোনও অবসেশন ছিল না। এ সব অবশ্য নির্জ্ঞান স্তরেও থাকতে পারি। তো থাকলে আমি একটু আশ্চর্য হব, এই। এর চেয়ে বেশি কিছু না। সকাল বেলায় নিরুপমের মুখোমুখি হতে অবশ্য একটু লজ্জা করতে লাগল। ওকে শিল্পীকে নিয়ে সিনেমা দেখার খোঁটা দিয়েছি এদিকে নিজে স্বপ্নে মহানায়ক দেখছি।

চা-পানের সময়েই আগ বাড়িয়ে ভাব করে ফেললুম।

কীরকম আলগা-আলগা হয়ে বসেছিল। জানালুম— ‘শান্ত রাতে খুব ভাল ঘুমিয়েছে। একটুও কাতরায়নি। মনে হয় তেমন কিছু হয়নি।’

‘এক্স রে রিপোর্টটা কখন পাওয়া যাবে?’ জিজ্ঞেস করি।

‘দশটায়।’

‘নিয়েই কি ডাক্তারের কাছে যেতে হবে?’

‘ন্যাচর‍্যালি।’

‘তা হলে তো আজ তোমার অফিস পাংচার।’

ভুরু দুটো একটু কুঁচকোল। ‘অফিস পাংচার’ শব্দগুচ্ছ শুনে না এক্স রে-রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবার কথায়, বোঝা গেল না।

‘আমার মনে হয় শান্তকে নিয়ে আমরা দুজনেই বেরোই, বুঝলে?’ আমি পরামর্শ দিতে থাকি— ‘রিপোর্টটা নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাব। যা করবার ডাক্তার করুন। তার পরে আমি ওকে নিয়ে বাড়ি চলে আসব, তুমি অফিস চলে যাবে?’ ভুরু দুটো সোজা হল। অফিস আছে এই তালে পুরো দায়টা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করছিল। সেটা ভণ্ডুল হল বলে ভুরুতে ভাঁজ। এখন অর্ধেক বেঁচেছে দেখে জ্ঞানীব্যক্তি বিপদের সময়ে অর্ধেক ত্যাগ করেন এই আপ্তবাক্য মেনে ভুরুর ভাঁজ সোজা করেছে।

এই ভাবেই আমি বেশ কিছুদিন ঘরে আটকে যাই। শান্তর ব্যাপারটা কমপাউন্ড ফ্যাকচার। কবজি থেকে কনুই অবধি প্লাস্টার হয়। তার পরেও স্লিং-এ ঝোলানো। আশা করে নাম শান্ত রাখলেও সে তো আদৌ শান্ত নয়। আমি অহর্নিশি তাকে চোখে চোখে রাখি এবং সেই সুযোগে আমার উপন্যাসও তরতর করে এগিয়ে যায়। প্লট তো ওরা আমাকে দিয়েই রেখেছে। স্টোরি বিল্ডিং-এ একসারসাইজের মতন। এত্তো বড় বড় ফাঁকঅলা। পুট পুট করে কয়েকটা পয়েন্ট-ওয়ালা একখানা প্লট। নাই-ই বা খোঁজ পেলুম সুমিতার। আপাতত সুমিতা, মালবিকাদি এদের কেউ না হলেও চলবে। মাথার মধ্যে থেকে সুমিতা নেমে আসে, মালবিকাদি নেমে আসে। আর আর চরিত্ররাও নেমে আসে। মানে আমি তাদের নামিয়ে দিই। একদিক থেকে আমি তো ঈশ্বরী—সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের অধিকার আমার হাতে। ইচ্ছে করলেই থই থই শূন্যতার অন্ধকার জলে রূপের আলো ফুটে উঠবে, জেগে উঠবে রক্তাভ সৃষ্টির পদ্ম সহস্র দল মেলে। ইচ্ছে করলেই দিকে দিকে ঘুম ভেঙে উঠে বসবে আদম-ইভরা। তাদের সন্ততিরা দখল নেবে এই পৃথিবীর মাঠে মাঠে ফসল ফলাবে, মেষ চরাবে, পত্তন করবে নতুন নতুন সভ্যতার, হানাহানি করবে, ইচ্ছে করলেই ধ্বংসের কালভৈরবকে নামিয়ে দেব— তা তা থই থই তা তা থই থই তাতা থইথই। এই প্রচণ্ডা ইচ্ছাশক্তি উদ্ভাবনী শক্তির কাছে একটা সুমিতা একটা শুভম, একটা মালবিকা কিংবা বিকাশকান্তি তো তুশ্চু ব্যাপার। আমি আমার অদৃশ্য যাদুচক্রটাকে আঙুলের মাথায় বাঁইবাঁই করে ঘুরিয়ে ছেড়ে দিই। ছুঁড়ে দিই। যা চাকা, খুঁজে নিয়ে আয় পুত্তলীগুলোকে। আমার নিজস্ব এক্স রে আমি তাক করি, যা রে যা বস্তুপৃথিবীর জড় পুঁটলিটাকে ফুটো করে ঢুকে যা দেখা সেই কল্পলোক।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress