মৃত্তিকা মায়া
পাহাড়ে র কোলে, ছবির মত সুন্দর উজানতলি গাঁ। সবুজ অরন্যের চাদরে ঢাকা, সহজ সরল মানুষ গুলোর আনন্দ বেদন মাখা জীবন যাপনের আলপনা সেখানে ॥ বরষার কাজলকালো মেঘেরা যখন পাহাড়ে র গলা জড়িয়ে ধরে থাকে, তখন । অরন্যের সবুজ যেন ঈরষায় নীল হয়ে ওঠে।পাহাড় যে তার একার !ভাবে কোথা থেকে এল এই মেঘবালিকারা…সজল..কাজল রূপে?পাহাড় কে নি য়ে তাদের এত মাতামাতি কেন ? এই বিদ্যুতের চমকে চারিদিকে আলোর রোশনাই…তো এই যেন মাদলের গুরু গুরু রব ।বাদল বাউলের এক তারার সুরে প্রকৃতি যেন মাতোয়ারা॥এই প্রকৃতি মায়ার আর এক ভাগিদার হল…সূরজ…মূর্তি গড়া র ওস্তাদ!ওর দু হাতের আঙ্গুলে যেন জাদু আছে!
হাতের জাদুতে মাটির মূর্তি গড়ে অবহেলে।
ওর বেশির ভাগ মূর্তিই ”মাটি” র চেহারা কে ঘিরেই!”মাটি”বা”মৃত্তিকা” এ গাঁয়ের ই মেয়ে। ”মৃত্তিকা” তো সত্যিই মাটির মত পেলব…নরম..মিষ্টি।এই ”মৃত্তিকামায়া” ই সূরজ কে এই গাঁয়ে বেঁধে রেখেছে।
নিজের ঘরের দুয়ারে বসে আকাশপাতাল চিন্তা করছিল…হটাৎ দেখে দূরে রাঙ্গাপথের বাঁকে কে যেন আসছে…..সামনে আসতে ষ্পষ্ট হয়…মৃত্তিকা…মাটি॥এসেই ঝোড়ো হাওয়ার মত সব ভাসিয়ে নিয়ে চললো….”চল , মনফকিরার মাঠে যাব ,ওখান থেকে বনতালসির দিঘির পাড়ে । ওখানে পলাশ..শিমূলের রঙ খেলা শুরু হয়েছে…যাবি না ? চৈত্রবনে র দামাল হাওয়ায় মত সূরজ কে নিয়ে উড়ে চলে মাটি॥মনফকিরার মাঠের পাশে বিরাট দিঘি….কাকচক্ষুর মত স্বচ্ছ জল ॥বন তালসির দিঘি বলে সবাই।এর পাড়ে পলাশবন …রক্তরাঙাফুলের আগুনে যেন দাবানল জ্বলছে॥ ওখানে একদল ছেলেমেয়ে হুল্লোড় করছে….ওরা শহর থেকে এসেছে পলাশফোটার উৎসবে।ওদের দেখেই এসে আলাপ জমায়।মাটি চুপ থাকে…সূরজকথা বলে…..সূরজ মূর্তি গড়ে শুনে ওঁরা দেখতে চায়ওর শিল্পকর্ম! সবাই হৈ হৈ করে আসে সূরজের ঘরে…..উঠোনের পাশে ওর কাজের চালায় চাঁদের হাট বসে॥ ওর গড়া মূর্তি গুলো নি য়ে ওরা কাড়াকড়ি করতে থাকে।মাটি একপাশে চুপ করে থাকে…ভাবে…এবার সূরজ নিশ্চয় ই শহরে যাবে….এত স্তুতি…যশ…সুযোগ কী ও হাত ছাড়া করবে?সূরজের শিল্প কে এতদিন ও দু হাতের পেলব বাঁধনে র আলতো ছোঁয়ায় রক্ষা করেছে….এবার তা আঁচল ছাড়া হল ॥সবার অলক্ষ্যে একপা একপা করে মাটি চলে আসে ওখান থেকে বুকের উথালপাথাল কষ্টটা জল হয়ে উপচে ওঠে চোখের কোল বেয়ে॥
এরপর সেই চিরন্তন ঘটনার ই পুনরাবৃত্তি।নাগরিকতার চাকচিক্যের জাদুগরী মোহে …উজান তলির সূরজ, মহানগরীর জটিল শিল্পজগতের আবর্তে হাবুডুবু খেতে থাকে॥ প্রথম প্রথম ভীষণ ভালো লাগে….যশ..অর্থ…প্রতিপত্তি।বিভিন্ন মহিলার
সংস্পর্শে ওর সরল মন টা হারিয়ে যায় !বিলাসও ভোগের গড্ডালিকায় গা ভাসায় ও॥”মৃত্তিকামায়ার” স্নেহের পরশ হারিয়ে ফেলে ভোগের আবিল ছোঁয়ায়॥
কালচক্র ঘুরে চলে নিজের খেয়ালে॥ কেটে যায় দন্ড পলের হিসেবে পাঁচ বছর॥
প্রথম প্রথম সূরজ মাটির সাথে যোগাযোগ রাখলেও এক সময় তা বন্ধ হয়ে যায় ॥মাটি প্রতীক্ষায় থাকে….ও যে ”মৃত্তিকামায়া”…সূরজের শিল্পেজড়ি য়ে আছে॥
নিজের মনে ই থাকে মাটি….মাটিছেনে পুতুল গড়ে ….কল্পনার স্বর্গে বাস করে।ফাগুন এলেই উজান তলিগাঁ…মনফকিরারমাঠ…বন তালসির দিঘির পাড়ে পলাশ ফোটার উৎসবে ও খুজে ফেরে তার ভালবাসা কে….॥
এবার ও এসেছে পলাশ ফোটার উৎসব !মনফকিরার মাঠ পেরিয়ে কে যেন আসছে….একা….আস্তে আস্তে অবয়ব টা স্পষ্ট হয়…একমাথা ঝাঁকড়া চুল….মুখে ক দিনে র না কাটা দাড়ি ….বড়ো ক্লান্তদুটো চোখ.. .সূরজ…নাগরিক যান্ত্রিকতায় হাঁফ ধরা মন যেন আশ্রয় খূঁজছে. . ॥
উজান তলিগাঁয়ের মুখে…”মাটি”র ঘরের দুয়ারে দাড়া য় সে….দুহাতে মাটি ছান ছে…”মাটি”….পিছন থেকে ডাক দেয় সূরজ….”মাটি”….
চমকে ফিরে তাকায় …..বিস্ময়ে.. ভাল লাগায়…আবেগে থর থর করে কাঁপতে থাকে মাটির হৃদয…..দু চোখের কোল উপচে পড়ে ….
সূরজ দুহাতে জড়ি য়ে বলে._মৃত্তিকামায়াকে ভুলতে পারি কি কখন ও ? পথ ভুলে ছিলাম….আবার খুজে পেয়েছি…!
বাতাসে বসন্ত রাগ বাজতে থাকে…….॥