Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মুক্তি || Kazi Nazrul Islam

মুক্তি || Kazi Nazrul Islam

রানিগঞ্জের অর্জুনপটির বাঁকে
যেখান দিয়ে নিতুই সাঁঝে ঝাঁকে ঝাঁকে
রাজার বাঁধে জল নিতে যায় শহুরে বউ কলস কাঁখে –
সেই সে বাঁকের শেষে
তিন দিক হতে তিনটে রাস্তা এসে
ত্রিবেণির ত্রিধারার মতো গেছে একেই মিশে।
তেমাথার সেই ‘দেখাশুনা’ স্থলে
বিরাট একটা নিম্ব গাছের তলে,
জটওয়ালা সে সন্ন্যাসীদের জটলা বাঁধত সেথা,
গাঁজার ধুঁয়ায় পথের লোকের আঁতে হত ব্যাথা।
বাবাজিদের ‘ধুনি’ দেওয়ার তাপে –
না সে তপের প্রতাপে –
গাছে মোটেই ছিল নাকো পাতা,
উলঙ্গ এক প্রেত সে যেন কঙ্কালসার তুলেছিল মাথা।
ভুলে যাওয়ার সে কোন নিশিভোর,
‘আজান’ যখন শহুরেদের ভাঙলে ঘুমের ঘোর,
অবাক হয়ে দেখলে সবাই চেয়ে,
শুকনো নিমের গাছটা গেছে ফলে-ফুলে ছেয়ে!
বাবাজিরাও তল্পি বেঁধে রাতেই
সটকেছেন সব; বোধ হয় পড়েছিলেন বেজায় কাতেই।

অত ভোরেও হোথা
হট্টগোলের লাগল একটা বিষম জনতা।
কিন্তু দেখে লাগল সবার তাক,
একোন মহাব্যাধিগ্রস্ত অবধূত নির্বাক?
সে কী ভীষণ মূর্তি!
ঈষৎ তার এক চাহনিতে থেমে গেল গোলমাল সব স্ফূর্তি।
জট-পাকানো বিপুল জটা,
মেদিনী-চুম্বিত শ্মশ্রু, গুম্ফগুলো কটা,
সে এক যেন জটিলতার সৃষ্টি –
অনায়াসে সইতে পারে ঝড় ঝঞ্ঝা বৃষ্টি।

পা দুটো তার বেজায় খাটো – বিঘত খানিক মোটে,
দন্ত-প্রাচীর লঙ্ঘি অধর ছুঁতেই পায় না ঠোঁটে,
চক্ষু ডাগর, নাকটা বেজায় খাঁদা,
মস্ত দুটো লোহার শিকল দিয়ে
হাত দুটো তার সব সময়ই বাঁধা,
ভাষাটা তার এতই বাধো-বাধো,
কইলে কথা বোঝাই যায় না আদৌ।
ও পথ বেয়ে যেতে
দুষ্টু ছেলে যা-তা দেয় খেতে,
ফকিরও সে এমনই সোজা নেবেই তা মুখ পেতে
বিষ হোক চাই অমৃত হোক।
দেখে অবাক লোক!
শহরে সে কতই কানাঘুষি, –
কেউ বলে, ‘চাঁদ তল্পি বাঁধো, তুমি শুধুই ভুসি।‘
কেউ বলে, ‘ভাই, কাজ কী বকাবকির?
হতেও পারে জবরদস্ত ফকির!’
এই রকম নানান কথা বলে যার যা খুশি!
মৌন ফকির হাসে মুচকি হাসি।



দেখতে দেখতে এমনি করে
নিম গাছটার দুবার পাতা গেল ঝরে।
ফকির তেমনি থাকে, –
হঠাৎ সেদিন সেই পথেরই বাঁকে
নিশি – ভোরেই
বোঝাই গোরুর গাড়ি হেঁকে যাচ্ছিল খুব জোরেই
খোট্টা গাড়োয়ান
ভৈরবীতে গেয়ে গজল-গান।
‘হোহো’ করে হঠাৎ ফকির উঠল বিষম হেসে।
গাড়ি-সুদ্ধ দামড়া বলদ চমকে উঠে এসে
পড়ল হঠাৎ ফকিরেরই ঘাড়ে,
চাকা দুটো চলে গেল একেবারে বুকের হাড়ে,
মড়মড়িয়ে উঠল পাঁজর যত! –
গাড়োয়ান তো বুদ্ধিহত
খ্যাপার মতো ছুটোছুটি করছে থতমত!
পুলিশ ছিল কাছেই
গাড়োয়ানেরে ধরে বাঁধলে ওই নিম্ব গাছেই।
লাগল হুড়োহুড়ি –
তেমন ভোরেও লোক জমল সারাটা পথ জুড়ি।
রক্তাক্ত সে চূর্ণ বক্ষে বদ্ধ দুটি হাত
থুয়ে ফকির পড়ছে শুধু কোরানের আয়াত,
হয়নি মুখে আদৌ ব্যাথার কোমল কিরণ-পাত,
স্নিগ্ধ দীপ্তি সে কোন জ্যোতির আলোয়
ফেললে ছেয়ে বাইরের সব কুৎসিত আর কালোয়,
সে কোন দেশের আনন্দ-গীত বাজল তারই কানে,
সেই-ই জানে, –
শিশুর মতো উঠল হেসে চেয়ে শূন্য পানে।
ধ্যানমগ্ন ফকির হঠাৎ চমকে উঠে চায়,
কুণ্ঠিত সে গাড়িওয়ালা গাছে বাঁধা, হায়!
প্রহার-ক্ষতে রক্ত বয়ে যায়!
আকুল কণ্ঠে উঠল ফকির কেঁদে, –
ও গো, আমার মুক্তিদাতায় কে রেখেছে বেঁধে?
এ কোন জনার ফন্দি, –
বাঁধন যে মোর খুলে দিলে তায় করেছে বন্দি?
ভোরের সারা আকাশ-আলো ব্যেপে
উঠল কেঁপে কেঁপে
দরবেশের সে ব্যাকুল বাণী অমৃত-নিষ্যন্দী!
চিরবদ্ধ হাতের শিকল অমনি গেল খুলে,
ঝুলি হতে দশটি টাকা তুলে
লাল-পাগড়ির হাতে গুঁজে বললে, ‘শুনো ভাই,
কোনো দোষ এর নাই,
নির্দোষ এ অবোধ গাড়োয়ান,
এ মলে যে মরবে সাথে তিনটি ছোট্ট জান!’
নিমের ডালে হাজার পাখি উঠল গেয়ে গান!
পায়ে ধরে কেঁদে পুলিশ কয়,
‘এও কখনও হয়?
ও গো সাধু, অর্থ-লালসায়
আমি শুধু হব কি আজ বঞ্চিত দয়ায়?
তা হবে না কভু,
পরশমণির বিনিময়ে পাথর নেব প্রভু?’
বুক বেয়ে তার ঝরে অশ্রুনীর –
দু-হাত ধরে তুলে তায় ফকির
বলে, ‘বাবা, মোছ এ অশ্রুলোর,
মুক্তি হবে তোর।
ওই যে মুদ্রাগুলি
গাড়োয়ানে দে তুলি!’ –
নিম্ব গাছের সকল পাতা
ঝরঝরিয়ে পড়ল ঝরে – আর হল না কথা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress