দশম পরিচ্ছেদ : সুন্দরীর অনুরোধ
সেই কৃতাবগুণ্ঠনা বলিতে লাগিল, “আমার স্বামী আজ দুই বৎসর হইতে পীড়িত। অনেক চিকিৎসক দেখিয়াছে; কিন্তু এ পর্যন্ত কি রোগ অথবা রোগের কারণ কি, কেহ কিছু ঠিক করিতে পারে নাই; সুতরাং তাহাদিগের ঔষধেও কোন ফল হইল না। দুই-একজন কবিরাজ এক-প্রকার বায়ুরোগ মনে করিয়া চিকিৎসা করিয়াছিল তাহাতেও কিছু উপকার হয় নাই; বরং আমার স্বামীর ব্যারাম বাড়িয়া উঠিতে লাগিল;আগে দিনে একবার মূৰ্চ্ছা যাইতেন, এখন প্রতিদিন দুই-তিন বার মূৰ্চ্ছা হইতে লাগিল;আগে একঘণ্টা মূৰ্চ্ছিত থাকিতেন, মূৰ্চ্ছাশেষে বেশ জ্ঞান হইত; এখন একবার মূর্ছিত হইলে দুই ঘণ্টায় সংজ্ঞালাভ করিতে পারেন না। মূৰ্চ্ছা ভাঙিলেও তাহার পর আধঘণ্টা সে ঘোর লাগিয়া থাকে, উন্মত্তের মত প্রলাপ বকিতে থাকেন। কলিকাতার অনেক দক্ষিণে বেহালা নামে যে একটি গ্রাম আছে, সেখানে মূৰ্চ্ছারোগের একটি দৈব ঔষধ পাওয়া যায়। কাল শনিবার প্রাতে সেই ঔষধ গ্রহণ করিতে হয়, তাই আজ রাত্রেই আমার স্বামীকে লইয়া, নৌকায় করিয়া সেখানে যাইতেছিলাম। এই প্রান্তরটি পার হইয়াই আমার স্বামী বাড়ী ফিরিয়া যাইবার জন্য অধীর হইয়া পড়িলেন;আজ যাওয়া হইবে না বলিয়া, অনেক আপত্তি করিতে লাগিলেন;মাঝিকে নৌকা ফিরাইতে বলিলেন। আমি মাঝিকে মানা করিয়া দিলাম। নৌকা ধার দিয়া যাইতেছিল, আমার স্বামী লাফাইয়া তটে উঠিলেন;উঠিয়া চীৎকার করিয়া বাড়ীর দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিতে লাগিলেন। আমিও তখন সেই সঙ্গে নামিয়া পড়িলাম। সেখানে বড় বন-জঙ্গল, তাহার ভিতরে তিনি কোথায় অদৃশ্য হইয়া গেলেন আর দেখিতে পাইলাম না। সম্ভব, তিনি বাড়ীতে ফিরিয়া গিয়াছেন। হয়ত সেখানে গিয়া তিনি আবার অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছেন; অজ্ঞান হইবার কিছু পূর্ব্বে তাঁহার মনের এইরূপ একটা চাঞ্চল্য ঘটিয়া থাকে।”
যুবক অনন্যমনে সেই অপরিচিতা সুন্দরীর কথাগুলি আকর্ণন করিলেন। তাহার কাতরোক্তিপূর্ণ কথায় এবং উৎকণ্ঠিতভাবে ইত্যাদিতে যুবক বিশ্বাসী ও দুঃখিত না হইয়া থাকিতে পারিলেন না। বলিলেন, “চলুন, আমি আপনাকে রাখিয়া আসিব। আমিও কিছু কিছু ডাক্তারী জানি, যদি বলেন, আপনার স্বামীর রোগারোগ্যের জন্য একবার চেষ্টা করিয়াও দেখিতে পারি।”
রমণী বিস্মিতা হইয়া বলিল, “আপনি ডাক্তার। ভালই হইয়াছে; কিন্তু—কিন্তু—”
যুবক রমণীকে ‘অর্দ্ধসমাপ্ত বাক্যে নীরব হইতে দেখিয়া বলিলেন, “বলুন, কি বলিতেছেন?”
রমণী বলিল, “বহুদিন হইতে ডাক্তার কবিরাজের চিকিৎসা করাইয়া কোন উপকার দূরে থাকুক্, বরং অপকার হওয়ায় আমার স্বামী আজকাল ডাক্তার কবিরাজের নামে যেন জ্বলিয়া আছেন; এমন কি তাঁহারই দুই-একজন বন্ধু নামজাদা ডাক্তার। এখন তিনি তাঁহাদের সঙ্গে বাক্যালাপও করেন না—ডাক্তার কবিরাজের উপরে আজ-কাল যেরূপ ঘৃণা প্রকাশ করিয়া থাকেন, তাহাতে পাছে তিনি আপনাকে কোন প্রকার আপমানের কথা বলিয়া বসেন, তাহাই ভাবিতেছি।”
যুবক কহিলেন, “সেজন্য আপনার কোন চিন্তা নাই।”
রমণী। এক কাজ করিবেন, আপনি যে ডাক্তার, এ পরিচয় তাঁহাকে দিবেন না।
যুবক। সে যাহা ভাল হয়, আমি করিব।
র। না মহাশয়, আপনি তাঁহাকে জানেন না। তিনি বড় উগ্রপ্রকৃতির লোক, আপনি আমার কথা রাখিবেন।
যু। তাহাই হইবে।
এইরূপ কথোপকথনের পর যুবক সেই অপরিচিতা সুন্দরীকে আপনার নৌকায় উঠাইয়া লইলেন। মাঝি তাঁহাকে নিষেধ করিল। প্রেতিনীরা এইরূপভাবে সুন্দরী রমণীর মূর্ত্তিতে পথিককে বিপথে চালিত করে, সে ভয় দেখাইল! এবং অনেক স্ত্রীলোক দস্যুর নিকটে অর্থ সাহায্য পাইয়া এইরূপ নিশাচরীর ন্যায় সারারাত শিকার সন্ধান করিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়, অনেকরকম কৌশলে ভুলাইয়া লইয়া গিয়া দস্যুপতির করতলগত করিয়া দেয়। প্রেতিনী বা অপদেবতার ভয় যুবকের হৃদয়ে মুহূর্ত্তের জন্য স্থান পাইল না। তিনি মাঝির এই কুসংস্কারপূর্ণ যুক্তি যুক্তি-যুক্ত বোধ করিতে পারিলেন না, তিনি শিক্ষিত, সাহসী, বলিষ্ঠ, বুদ্ধিমান্, যৌবনোঞ্চ। তিনি সেই অপরিচিতা সুন্দরীকে নৌকায় উঠাইয়া লইয়া নৌকা ফিরাইতে বলিলেন। মাঝি অনিচ্ছায় নৌকা ফিরাইয়া লইয়া চলিল। তাহার মনে বড় ভয় হইতে লাগিল না জানি কি একটা ভয়ানক কাণ্ডই ঘটিবে;হয়ত নৌকা বানচাল হইয়া যাইবে, নৌকা ডুবিবে, নৌকার সঙ্গে তাহাকে যে প্রেতিনী ডুবাইয়া মারিবে না, এমনও কি হইতে পারে? দম আটকাইয়া প্রাণটা যাইবে? তখন তাহার গৃহিণীর কথা মনে পড়িল, সন্তান-সন্ততির কথা মনে পড়িল। এইরূপ নানা কথা ভাবিতে ভাবিতে তাহার প্রাণটা আকুল হইয়া উঠিল, এবং শরাহত পক্ষীটির ন্যায় রুদ্ধ পঞ্জর-পিঞ্জরের ভিতর ছট্ফট্ করিতে লাগিল।
তাহার পর যখন স্রোতোমুখে নৌকা দ্রুত চালিত হইয়া, অনতিবিলম্বে প্রান্তর পার হইয়া সেই আমবাগানের ধারে গিয়া উপস্থিত হইয়া কিনারায় লাগিল, যুবক সেই রমণীকে লইয়া তটে অবতরণ করিলেন। তখন সুদক্ষ মাঝি একটা আস্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিল। একটা ফাঁড়া কাটিয়া গেল ভাবিয়া ঈশ্বরকে মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ দিতে লাগিল।
যুবক যাইবার সময়ে বলিয়া গেলেন, যতক্ষণ না তিনি ফিরিয়া আসেন, নৌকা যেন সেইখানে বাঁধিয়া রাখা হয়।
যুবকের যে এই প্রত্যাগমন ঘটিবে না, মাঝি সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ।