দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : দানব ও দানবী
ভিতরে নিদ্রার ভাণে পড়িয়া ফুলসাহেব সকলই দেখিতেছিল—শুনিতেছিল। প্রহরীকে পড়িতে দেখিয়া ফুলসাহেব কপট নিদ্রা ত্যাগ করিয়া উঠিল। বলিল, “কাজ হাসিল?”
জুমেলিয়া প্রহরীর হাত হইতে সেই হাতকড়ির চাবিটি লইয়া, দ্বার উন্মুক্ত করিয়া, ফুলসাহেবকে বাহিরে অনিয়া, তাহাকে বন্ধনমুক্ত করিয়া বলিল, “এই এতক্ষণে হাসিল হইল।”
ফুলসাহেব জুমেলিয়ার কণ্ঠালিঙ্গন করিয়া, সোহাগভরে বলিল, “এত গুণ না থাকিলে, আমি তোমার এত অনুগত হইব কেন?”
জুমেলিয়া হাসিতে হাসিতে বলিল, “লঙ্কেশ্বরের প্রাণটা আগেই আমি প্রায় সবটা হস্তগত করিয়াছিলাম—আর অমন একটা নির্ব্বোধ মেডুয়াকে যদি ভুলাইতে না পারিব—তবে আর হইল কি? তাহার পর যখন দুই হাতে তাহাকে জড়াইয়া একটা চুম্বন দিলাম—তখন তার প্রাণের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, সেটুকু পর্য্যন্ত দখল করিলাম। যখন সব প্রাণটা হস্তগত হইল, তখন তাহাকে উকুনটির মত নখে টিপিয়া অনায়াসে মারিব, তার আর আশ্চর্য্য কি? সেই বিষ-কাঁটাটি পিঠে ফুটাইয়া দিলাম।”
ফুলসাহেব বলিল, “টের পায় নাই?”
জুমেলিয়া বলিল, “টের পাইলেই বা ক্ষতি কি? যদি টের পাইয়া চীৎকার করিয়া উঠে, এইজন্য চুম্বনের ছলে মুখ দিয়া তার মুখটা জোরে চাপিয়া বন্ধ করিয়া রাখিয়াছিলাম—তা’ দুই হাতে জড়াইয়া ধরিতেই আনন্দে তা’র জ্ঞান লোপ পাইয়াছিল—একটা কাঁটা ফুটিলে কি—বোধ হয়, তখন তাহার পিঠে সহস্র শেল ফুটিলেও অনুভবেই আসিত না।”
ফুলসাহেব বলিল, “চল, এখনও অনেক কাজ বাকি।”
ফুলসাহেব জুমেলিয়ার হাত ধরিয়া অগ্রসর হইয়া চলিল;কিছুদূর গিয়া ফুলসাহেব সহসা ফিরিয়া দাঁড়াইল;বলিল, “জুমেলিয়া দাঁড়াও, তাড়াতাড়িতে একটা কাজ ভুল করিলাম, এখনই আসিতেছি।” বলিয়া জুমেলিয়াকে তথায় রাখিয়া ফুলসাহেব আবার সেই হাজতঘরের সম্মুখে আসিল;মৃত প্রহরীর বন্দুকের সঙ্গীন ও কোমর হইতে কিরীচখানি খুলিয়া লইল। তাহার পর ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া কিরীচের মুখ দিয়া ভিতরের দেওয়ালে বড় বড় অক্ষরে লিখিল,—
“অরিন্দম! সাবধান, এক সপ্তাহের মধ্যে তোমাকে খুন করিব, তবে আমার নাম—
তোমার চিরশত্রু ফুলসাহবে।”
তখনই ফিরিয়া আসিয়া ফুলসাহেব, জুমেলিয়াকে সেই কিরীচখানি দিল; নিজের হাতে সেই তীক্ষ্ণমুখ সঙ্গীনটী রাখিল। তাহারা উভয়ে সেই দুর্ভেদ্য অন্ধকারের ভিতর দিয়া পূর্ব্বদিকের প্রাচীর লক্ষ্য করিয়া চলিল।
ঘনান্ধতমোময়ী রাক্ষসী নিশা, নরপ্রেত ফুলসাহেবের ও রাক্ষসী জুমেলিয়ার সহায়তায় আরও ভয়ঙ্করী মূর্ত্তি ধারণ করিল।