চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ : অনুসরণে
যখন যদুনাথ গোস্বামীর বাড়ী হইতে অরিন্দম সেই অপরিচিত লোকের অনুসরণে অনেকদূর আসিয়া পড়িলেন; তখন তিনি উপযাচক হইয়া তাহার সহিত এইরূপ প্রথম আলাপ করিলেন, “মহাশয়কে যেরূপ দেখিতেছি, যদিও আপনার সঙ্গে আলাপ পরিচয় নাই; কিন্তু যেরূপ দেখিতেছি, সামনে বললে খোসামুদি করা হয়—অতি—অতি—”
অপরিচিত লোকটি এইরূপ আলাপে যত সন্তুষ্ট না হউক, বড় বিস্মিত হইয়া বলিল, “কে হে বাপু, তুমি?”
অরিন্দম আরও একটু স্বরটা গড়াইয়া বলিলেন, “এই, এই কথাটা হচ্ছে যে, মহাশয়ের সামনে বলে খোসামোদ করা হয়—আপনি অতি—অতি—”
অপরিচিত একটু বিরক্ত হইয়া বলিল, “কেবল ‘অতি অতিই কর্ছ যে–কি বল না—অতি ভদ্রলোক, না অতি সদাশয় লোক?”
অরিন্দম বলিলেন, “আরে রাম রাম! তাও কি কখনও হ’তে পারে একজন অতি ধড়ীবাজ লোক। সামনে বলে খোসামোদ করা হয়, তাই বলি বলি করেও বলতে পারছিলেম না।” বলিতে বলিতে অরিন্দম আরও একটু তাহার নিকটস্থ হইলেন। নিকটস্থ হইয়া তাহাকে—বিশেষতঃ তাহার মুখখানি একবার ভাল করিয়া দেখিয়া লইলেন।
সেই অপরিচিত লোকটি ললাট কুঞ্চিত করিয়া একটু হাসিল। অরিন্দম দেখিলেন, তাহার মুখখানি গড়িতে বিধাতার কি জানি, এমনই এক সৃষ্টি বৈচিত্র্য দেখাইবার চেষ্টা ছিল যে, সে মুখখানিতে হাজার হাসি একসঙ্গে দেখা দিলেও বুঝাইত না, লোকটি হাসিতেছে, না কি এক অসহ্য অরুন্তুদ যন্ত্রণায় মুখবিকৃতি করিতেছে। লোকটি হাসিয়া—কি বিকৃত মুখে বলা যায় না—বলিল, “তুমি কি পাগল না কি?”
অরিন্দম বলিল, “এমন কথা পূর্ব্বে আর কাহাকেও বলিতে শুনি নাই, এই প্রথম তোমার মুখে শুনিলাম। সে কথা যাক্, এখন বল দেখি, কি মনে ক’রে আজ, আবার সন্ধ্যার পর বাহির হয়েছ? কাল রাতে ত একটাকে শেষ করেছ, আজ আবার কার বুকে ছুরি বসাবে, দাদা।”
অপরিচিত বলিলেন, “তোমার কথা বুঝতে পারছি না।”
অরিন্দম বলিলেন, “মনে মনে খুব বুঝতে পারছ;এই যে এত বড় একটা খুন হ’য়ে গেল, তা’র কি কোন খবরই রাখ না?”
সেই লোকটি বলিল, “না, কিছু না, আমি এখানে থাকি না। তুমি একজন গোয়েন্দা না কি?” রি। তা’না হ’লে তোমার পিছু লইব কেন? আমি বেশ বলতে পারি, তুমিই সেই মেয়েটিকে খুন করেছ।
অপরিচিত। আমি কিছুই জানি না।
অরি। তুমিই না কাল রাতে একবার বলাই মণ্ডলের দোকানে আবির্ভূত হয়েছিলে?
অপ। না, আমি বলাই মণ্ডল নামে কাকেও জানি না।
অ। জান বই কি, হয় ত এখন ভুলে গেছ। বলাই মণ্ডল মিথ্যাকথা বলার লোক নয়, তা’র মুখেই আমি তোমার কথা শুনেছি।
অপ। সে কি তোমার কাছে আমার নাম বলেছিল?
অ। নাম না বললেও তোমার মুখখানি দেখে বেশ বুঝতে পারছি, তুমিই স্বয়ং সেই মহাপুরুষ।
অপ। মিথ্যাকথা, তবে আমি এ খুনের কিছু কিছু জানি বটে। তুমি এখন সেই বালিকার মৃতদেহের সন্ধান করছ না কি? তা’ হ’লে আমি তোমার কিছু উপকার করতে পারি।
অ। তা’ হ’লে আমি বাধিত হ’ব।
অপ। মৃতদেহ বাহির করতে পারলে তুমি বেশী রকমের একটা পুরস্কার পেতে পার, এমন একটা সম্ভাবনা আছে কি?
অ। আছে বই কি, তা’ না হ’লে আর সেই সকাল অবধি এখনও পর্য্যন্ত ঘুরে ঘুরে বেড়াব কেন, বল?
অপ। আমি যদি সেই মৃতদেহ বার ক’রে দিই, তা’ হ’লে কিছু বখরা দিতে পার?
অ। তোমার দ্বারা যদি এত বড় একটি মহৎ কাজ হয়, তা’ হ’লে তা’ আর দিব না? তখনই।
অপ। আমি কাল রাত দুটার পর ঐ দীঘির ধার দিয়ে যখন আসি, ঐ পশ্চিম দিক্কার একটা জঙ্গলের ভিতরে একটা বালিকার মৃতদেহ দেখেছি। আমার সঙ্গে গেলে দেখাতে পারি।
অ। এখনও এ কথা গোপন করে রেখেছিলে কেন?
অপ। সাধ ক’রে কে পুলিসের হাঙ্গামে পড়ে বল। এখন আমার সঙ্গে যাবে কি?
অরিন্দম একবার কি ভাবিলেন। বলিলেন, “চল যাইব।”