তৃতীয় খণ্ড : পিশাচীর প্রেম
প্রথম পরিচ্ছেদ
আর এক ভাব
অনতিবিলম্বে জুমেলিয়া এবং তাহার অনুবর্তী হইয়া দেবেন্দ্রবিজয় সেই অসংস্কৃত অন্ধকারময় নিভৃত অট্টালিকা-সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
জুমেলিয়া কহিল, “এই বাড়ীর ভিতরে তোমাকে আমার সঙ্গে যাইতে হইবে।”
“স্বচ্ছন্দে,” দেবেন্দ্রবিজয় প্রত্যুত্তরে কহিলেন।
“রেবতী এখানে আছে।”
“বেশ, আমাকে তার কাছে লইয়া চল।”
“এখন নয়, সুবিধা মত; আগে তোমার সঙ্গে আমার কতকগুলি কথা আছে, এস।”
উভয়ে সেই বাটিমধ্যে প্রবেশিলেন। দেবেন্দ্রবিজয় যেমন অন্ধকারময় প্রাঙ্গণে পড়িলেন, অমনি বস্ত্রাভ্যন্তরস্থ গুপ্তলণ্ঠন বাহির করিলেন, চতুর্দিক আলোকিত হইল; জুমেলিয়া, একবার চমকিত হইয়া উঠিল—কিছু বলিল না।
তাহার পর উভয়ে উত্তরপার্শ্বস্থিত সোপানীতিক্রম করিয়া দ্বিতলে উঠিলেন; তথাকার একটি প্রকোষ্ঠের মধ্যে প্রবেশ করিলেন। জুমেলিয়া সেই প্রকোষ্ঠের এক কোণে একটি মোমের বাতি জালাইয়া রাখিল; রাখিয়া বলিল, “দেবেন্দ্রবিজয় জান কি, কেন আমি তোমাকে এখানে লইয়া আসিয়াছি?”
“না—জানি না।”
“তুমি জান, আমি প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, তোমাকে হত্যা করিব?”
“জানি।”
“শুধু তোমাকে নয়—তোমার সংসর্গে যারা আছে, তাদেরও?”
“তাহাও জানি।”
“তুমি কি বিশ্বাস কর, আমি প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করিতে পারিব?”
“যদি পার—পূর্ণ করিবে।”
“আমি পারি।”
“ক্ষতি কি?”
“কিন্তু এখন আমার সে ইচ্ছা নাই; আমি তোমার সঙ্গে একটা বন্দোবস্ত করিতে চাই।”
“বটে! কোন বিষয়ে?”
“তুমি সে বিষয়টা কিছু অভিনব, কিছু আশ্চৰ্য্য বোধ করিবে। আমি এখনই আমার প্রতিহিংসা হইতে তোমাকে—তোমার স্ত্রীকে — শচীন্দ্রকে মুক্তি দিতে প্রস্তুত আছি।”
“বটে, এর ভিতরেও তোমার অবশ্যই কোন গুঢ় অভিপ্রায় আছে।” “ছ, যদি তুমি আমার কথা রাখ—আমাকে সাহায্য কর, আমি ইচ্ছা করিতেছি—যত পাপ কাজ-সমস্তই ত্যাগ করিব; এখন হইতে সৎস্বভাব হইব।”
“সে সময় এখন আর আছে কি, জুমেলা?”
“আছে, এখনও অনেক সময় আছে—শুধরাইবার অনেক সময় আছে।”
“বল।”
“দেখ দেবেন, তুমি মনে করিলে আমি যাদের প্রাণনাশ করিতে একান্ত ইচ্ছুক, সামান্ত উপায়ে তাদের তুমি আমার প্রতিহিংসা হইতে উদ্ধার করিতে পার। সে উপায় কি? তুমি আমার স্বভাবের গতি ফিরাও, আমার মতি ফিরাও—যাতে আমি এখন হইতে সচ্চরিত্ৰ হ’তে পারি—সেই পথে নিয়ে যাও। তুমি আমাকে সদা-সর্বদা ‘পিশাচী’ কখন বা ‘দানবী’ বলে থাক; সেই দানবীকে—সেই পিশাচীকে তুমি মনে করিলে দেবী করিতে পার।”
“জুমেল, তোমার এ সকল কথার অর্থ কি?”
“উত্তর দাও, দেবেন! আমার কথার ঠিক ঠিক উত্তর দাও। ঠিক ক’রে বল দেখি, আমি কি বড় সুন্দরী?” [মৃদুহাস্যে কটাক্ষ করিল]
“হাঁ, তুমি সুন্দরী, এ কথা কে অস্বীকার করিবে?”
“কেমন সুন্দরী?”
“যদি তোমার অন্তরের জঘন্ততা তোমার মুখে প্রতিফলিত না হইত, দেখিতাম, তুমি সুন্দরী—তোমার মত সুন্দরী আমি কখনও দেখিয়াছি কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকিত।”
“মনোরমার* চেয়ে সুন্দরী?”
“রেবতীর চেয়ে?”
“হাঁ।”
“তুমি কি সুন্দরীর সৌন্দৰ্য্য ভালবাস না?”
“প্রশংসা করি বটে!”
“যদি আমার অন্তর হতে সমস্ত পাপের কালি মুছে যায়, তা’ হ’লে আমি তোমার মনোমত সুন্দরী হ’ব কি, দেবেন?”
“না, আমি তোমাকে অত্যন্ত ঘৃণা করি।”
“যদি কোন স্থানে তোমার মন বাধা না থাকিত, তা হ’লে তুমি কি আজ আমাকে ভালবাসিতে পারিতে, দেবেন?”
“না।”
এই কথাটাই চূড়ান্ত হইল, জুমেলিয়ার হৃদয় দুর দুর করিতে লাগিল, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের গতিবিধি বন্ধ হইল, মুখমণ্ডল একবার মুহূর্তের জন্য আরক্তিম হইয়া পরক্ষণেই একেবারে কালিমাছন্ন হইয় গেল। কিয়ৎপরে প্রকৃতিস্থ হইয়া পূৰ্ব্বাপেক্ষী মৃদুস্বরে, জুমেলিয়া বলিল, “তা’ হ’লেও তুমি আমাকে ভালবাসিতে পারিতে না, দেবেন—তা’ হ’লেও না?”
“ন!—তা’ হ’লেও না।”
“দেবেন্দ্রবিজয়! আমার বয়স এখন ছত্রিশ বৎসর। এই ছত্রিশ বৎসরের মধ্যে আমাকে অনেকে ভালবেসেছে; কিন্তু সে সকল লোকের মধ্যে আমি এমন কাহাকেও দেখি নাই, যাহাকে আমি তার ভালবাসার প্রতিদানেও কিছু ভালবাসিতে পারি; কিন্তু তুমি—তুমি— তোমাকে দেখে আমার মন একেবারে ধৈর্য্যহীন হ’য়ে পড়েছে। তুমি আমাকে ভালবাস না—ভালবাসা ত বহুদুরের কথা—তুমি আমার শক্ৰ—পরম শত্রু; তথাপি আমার প্রাণ তোমার পায়ে আশ্রয় পাবার জন্য একান্ত ব্যাকুল। আমি পুৰ্ব্বেই জানতে পেরেছিলাম, আমার এ লালসা আশাহীন, তাই আমি তোমাকে হত্যা করিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হ’য়েছিলাম; স্থির করেছিলাম, তোমাকে হত্যা করতে পারলে হয় ত ভবিষ্যতে এক-সময়ে-ন-এক-সময়ে তোমাকে ভুলে যেতে পারব; আজ তোমাকে কেন ডেকেছি জান, দেবেন? তোমার সঙ্গে আমি একট। বন্দোবস্ত করতে চাই।”
“কি, বল?”
“আশা করি, তুমি আমার কথা রাখবে।”
“হাঁ, তোমার কথা রাখতে যদি কোন ক্ষতি স্বীকার করতে না হয়, অবশ্যই রাখব।”
“তুমি তোমার স্ত্রীকে ভালবাস?”
“হাঁ, ভালবাসি।”
“তুমি তার জীবন রক্ষা করতে ইচ্ছ। কর?”
“হাঁ, করি।”
“তার জীবন রক্ষা করতে তুমি কিছু ত্যাগ-স্বীকার করতে পার?”
“হাঁ, পারি।”
“তুমি তোমার ভালবাসা ত্যাগ করতে পার?”
“আমি তোমার কথা বুঝতে পারলেম না।”
“তুমি তোমার স্ত্রীকে পরিত্যাগ করতে পার?”
“তাকে আমি পরিত্যাগ করিব।”
“হাঁ, তাকে—তোমার স্ত্রীকে—তোমার সেই ভালবাসার সামগ্রীকে কেবল এক বৎসরের জন্য; এক বৎসর—বেশি দিন না—চিরকালের জন্য না;–তুমি তাকে মনে মনে যেমন ভাবেই রাখ, কিন্তু কেবল এক বৎসরের জন্য তুমি আমার হও। বৎসর ফুরালে তোমাকে আমি মুক্তি দিব; তখন অবাধে তোমার স্ত্রীর কাছে ফিরে যেতে পারবে। এক বৎসর– কেবল একটি মাত্র বৎসর; শেষে আমিও মরিব—তুমিও নিশ্চিন্ত হ’তে পারবে, আমি নিজের বিষে মরিব; তুমি তখন মুক্তি পাইবে. জুমেলিয়ার হাত হ’তে তুমি আজীবন মুক্ত থাকিবে।”
এই বলিয়া জুমেলিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের দিকে একপদ অগ্রসর হইয়া, জানু পাতিয়া তাহার অতি নিকটে অতি দীনভাবে উপবেশন করিল— তখন সে প্রাণের আবেগে মহা উন্মাদিনী।
দেবেন্দ্রবিজয় তাহার অভিনব অভিপ্রায় শুনিয়া চমকিত হইলেন। তাঁহার সৰ্ব্বাঙ্গ তখন প্রস্তর-প্রতিমুক্তির ন্যায় শীতল, নীরব ও নিশ্চল।
——————-
[* জুমেলিয়ার জটিল রহস্তপূর্ণ অন্যান্য ঘটনাবলী গ্রন্থকারের “মনোরমা” ও “মায়াবী” নামক পুস্তকে লিখিত হইল। প্রকাশক।]
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
আবেগে
জুমেলিয়া বলিতে লাগিল,-“দেবেন, কত সুখ তাতে; মরি! মরি! মরি! আমার হও, আমার হও তুমি—এক বৎসরের জন্য। দেখ দেবেন, আমি প্রাণের মধ্যে–হৃদয়-পটে কেমন মুখের সুন্দর ছবি এঁকেছি। এ কথা মনে করতে আমার আনন্দের সীমা থাকছে না। তোমাকে ভালবাসতে হবে না—তুমি আমাকে ভালবাস কি না, সে কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই না; আমি জানি, আমি এত নিৰ্ব্বোধ নই, তুমি কখনই আমাকে ভালবাসবে না—ভালবাসতেও পারবে না। কিন্তু ছল—ছলনায় আমাকে বুঝায়ো, তুমি আমায় বড় ভালবাস; কেবল একটি বৎসরের জন্য। আমি সাধ ক’রে তোমার প্রতারণায় প্রতারিত হ’তে স্বীকার করছি—এ প্রতারণায়ও সুখ আছে। আমি জানি, আমি যা আশা করেছি, তা আশার অতীত। তুমি আমাকে ছলনায় ভুলায়ে যে, তুমি আমার ভালবাস, আর কিছু না, তাই যথেষ্ট। আমি নিজেকেই বুঝাব যে, তুমি প্রকৃতই আমাকে ভালবাস; তুমি আমার—আমার! রেবতী রক্ষা পাবে, সে তোমার বাড়ীতে নির্বিবঘ্নে পৌছিবে; সেখানে সে তোমার অপেক্ষায় থাকবে, সে কখনই জানতে পারবে না, তার জীবন-রক্ষার্থে তোমায়-আমার কি বন্দোবস্ত হয়েছে— সে তোমার এ বিষয়ের কোন প্রমাণই পাবে না। বৎসর শেষে তুমি স্বচ্ছন্দে তার কাছে ফিরে যেতে পারবে; তখন যা’ তোমার প্রাণ চায়— করিয়ো; ঘাতে তুমি সুখী হও—হইয়ো। কেবল একবার তুমি ক্ষণেকের জন্য স্বর্গের সুষমার আভাসটুকু আমায় দেখাও,—যা” আমি সারাজীবনে কখনও অনুভব করিতে পারি নাই। তোমার স্ত্রী কিছুই জানবে না, কেহই না; কেবল তুমি আর আমি। এক বৎসর পরে তুমি হাসতে হাসতে তার কাছে ফিরে যাবে; আমি মরিব, সত্যসত্যই মরিব; কেবল এ গুপ্তরহস্তা তোমারই জ্ঞাত থাকিবে—লোকের কাছে তোমাকে কলঙ্কের ভাগী হইতে হইবে না।” জুমেলিয়া উঠিল—আরও দুইপদ অগ্রসর হইয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে বাহুবেষ্টিত করিতে চেষ্টা করিল। দেবেন্দ্রবিজয় ঘৃণাভরে তাহাকে সরাইয়া দিলেন।
জুমেলিয়া উন্মাদিনীর ন্যায় বলিতে লাগিল—“শোন দেবেন, আমি বুঝেছি, আমি মরিব; এ কথা তুমি বিশ্বাস করতে পারছ না; আমি বৎসর ফুরালে তোমার সাক্ষাতে বিষপান করব। যখন আমি ম’রে যাব, কি সংজ্ঞাশুন্ত হ’য়ে পড়ব, তখন তুমি শতবার শাণিত ছুরিকা দিয়ে আমার বক্ষঃস্থল বিদ্ধ ক’রো, তা’ হ’লে ত তখন তোমার অবিশ্বাসের আর কোন কারণ থাকবে না। এখন আমরা একদিকে—বহুদূরে চলে যাব; কেবল এই এক বৎসরের জন্য; আমরা কামরূপেই চলে যাব। আমি যে সকল দ্রব্যগুণ জানি, তোমাকে সকলগুলিই শিখাব; শিখালে সহজেই শিখতে পারবে; ত’তে তোমার উপকার বৈ অনুপকার হবে না। তুমি যে দেশ ছেড়ে চলে যাবে, সেজন্য একটা কোন ওজর করলেই চলবে। তোমার স্ত্রীকে সদা-সৰ্ব্বদা তোমার ইচ্ছামত পত্রাদি লিখতে পারবে; কিন্তু তুমি প্রাণান্তেও তোমার স্ত্রীর নাম আমার কাছে এই এক বৎসরের জন্য ক’রো না; যাতে আমার মনে এমন একটা ধারণ হ’তে পারে যে, তুমি আমাকে ভালবাস ন—এমন কিছু আমাকে দেখিয়ে না—জানতে দিয়ে না। আমি ত বলেছি, আমি নিজেকে নিজেই প্রতারিত ক’রে রাখব; তুমি আমার হৃদয়ের রাজ্য হবে – তুমি আমার প্রাণের ঈশ্বর—তুমি আমার সৰ্ব্বস্ব! তার পর এক বৎসর কেটে গেলে আমি নরকের দিকে চ’লে যাব। তোমাকে এক বৎসর পেয়ে, তোমার বৎসরেক প্রেমালাপে আমি যে সুখ লাভ করব, ত’তে আমি হাসিমুখেই নরকের দিকে চলে যাব। এই এক বৎসর আমার জয়জয়কার, দেবেন। দেবেন—প্রাণের দেবেন্! তুমি কি আমার মনের কথা—প্রাণের বেদন বুঝতে পার্ছ না—আমি তোমাকে কতমতে আরাধনা করছি? তুমি মুখে আমার ভালবাস, তাতেও আমি মুখী হ’ব-আমি জোর করে বিশ্বাস ক’রে লইব, তুমি আমায় প্রকৃত ভালবাস। আমার কথার উত্তর দাও; বল-—স্বীকার পাও—প্রতিজ্ঞ কর, আমি তোমাকে যা বললেম, তা’তে তোমার আর অমত নাই; আমি এখনি তোমাকে রেবতীর কাছে নিয়ে যাচ্ছি—সে এখন মড়ার মত প’ড়ে আছে। যে ঔষধে তার জ্ঞান হবে, সে ঔষধ আমি তোমার হাতেই দিব, তুমি সেই ঔষধ তাকে খেতে দিয়ে; সেই মুহুর্তেই তা’র জ্ঞান হবে—শরীরের অবস্থা ফিরে যাবে; যেমন তাকে তুমি আগে দেখেছ, এখনও ঠিক তাকে তেমনি দেখ বে। অস্বীকার কর যদি, নিশ্চয় স্ত্রীর মৃত্যু হবে; ত’ হ’লে তোমার কাছে আমি যেমন সজলনয়নে দাঁড়িয়ে আছি—আর আমার সম্মুখে তুমি যেমন প্রস্তরপ্রতিমূৰ্ত্তির ন্যায়, নিশ্চলভাবে দাঁড়াইয়া আছ, ইহা যেমন নিশ্চয়— তেমনই নিশ্চয় তা’র মৃত্যু জানবে। জগতের কোন বিজ্ঞান তা’র চৈতন্ত সম্পাদন করতে পারবে না—কোন চিকিৎসক তার জীবন দান করতে পারবে না। যে ঔষধের প্রক্রিয়ায় সে এখন অচেতন, আমিই কেবল-তার প্রতীকারের উপায় জানি। এমন লোক দেখি না, আমার সাহায্য বিনা তাকে বাঁচাইতে পারে। যদি তুমি আমার হাত পা লোহশূঙ্খলবদ্ধ কর, এখনই এখানে সুতপ্ত লৌহখণ্ড দিয়ে আমার সৰ্ব্বাঙ্গ ঝলসিত কর, গোছায় গোছায় আমার মাথার চুলগুলি ছিড়িয়া ফেল, সাড়াশি দিয়ে এক-একটি ক’রে সকল দাত মূলোৎপাটিত কর, আমার কর্ণরন্ধে, সৰ্ব্বাঙ্গে গলিত সীসক ঢেলে দাও—ঘত প্রকার যন্ত্রণা আছে—যে সকল চিন্তার অতীত—আমাকে দাও, আমার মনের দৃঢ়তা কখনই তুমি নষ্ট করতে পারবে না; সে যাতে শীঘ্র শীঘ্র মৃত্যুমুখে পড়ে, তা আমি করব; তাতে আমি জানব, আমার প্রতিহিংসা সফল হয়েছে; তাতে তোমার মনে যে যন্ত্রণা হবে, সে যন্ত্রণার কাছে আমার শারীরিক যন্ত্রণা তুচ্ছ বিবেচনা করব। আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করছি, বড় বেশি কিছু নয়—দেবেন, একটি বৎসর মাত্র; এই এক বৎসরের জন্য আমার হও—কেবল আমারই। তার পর তোমার সংসারে সানন্দে তুমি ফিরে যেয়ো—সুখী হ’য়ো। সম্মত হবে কি? তুমি ত বলিয়াছ, রেবতীর প্রাণরক্ষার্থ সকলই করিতে পার; কেবল এক বৎসরের জন্য আমি তোমার কাছে তোমাকেই চাহিতেছি। উত্তর দিবার আগে বেশ ক’রে ভেবে দেখ—দেবেন, বেশ ক’রে বিবেচনা ক’রে দেখ; আমার কথা আমি কিছুতেই লঙ্ঘন হ’তে দিই নাই; আমার অভিপ্লায়ের একবিন্দু পরিবর্তিত হবে
না।”
জুমেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, দেবেন্দ্রবিজয়ের সম্মুখে-সাশ্রনেত্ৰে— মানমুখে—স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া রহিল।
দেবেন্দ্রবিজয়ও সেইরূপ স্থিরভাবে রহিলেন। তাঁহার এখনকার মনের অতিশয় অধীরতা মুখে কিছুমাত্র প্রকাশ পাইল না।
জুমেলিয়া জিজ্ঞাসিল, “কি বল দেবেন, সন্মত আছ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “রেবতী কোথায়?”
জুমেলিয়া। এইখানেই আছে।
দেবেন্দ্র। তার কাছে আমাকে নিয়ে চল।
জু। কি জন্য?
দে। তোমাকে এখন কি উত্তর দিব? আমি তাকে দেখে সে সম্বন্ধে একটা বিবেচনা করতে পারব।
জু। আমি এখনি তার কাছে নিয়ে যেতে পারি।
দে | নিয়ে চল।
জু। তার পর তুমি আমার কথার উত্তর দিবে?
দে। হাঁ।
জু। তবে আমার সঙ্গে এস, দেবেন; তুমি অবশ্যই স্বীকার পাবে : তুমি যেরূপ তাহাকে ভালবাস, তাতে তাকে দেখলে—তার মুখ দেখলে কখনই তুমি আমার প্রস্তাবে অস্বীকার করতে পারবে না—এস।
জুমেলিয়া দেবেন্দ্রবিজয়কে সঙ্গে লইয়া পার্শ্ববৰ্ত্তী কক্ষে গমন করিল। তথায় প্রকোষ্ঠতলে একথানি ছিন্ন গালিচার উপর মৃতপ্রায় রেবতী পড়িয়া।
রেবতীর মুখমণ্ডল অতিস্নান—ঠিক মৃতের মুখের ন্যায়। দেখিয়া দেবেন্দ্রবিজয় হৃদয়ের মধ্যে একটা অননুভূতপূৰ্ব্ব, কম্পপ্রদ শৈত্য অনুভব করিলেন; তখনকার মত তাঁহার অৰ্দ্ধোন্মত্ত অবস্থা আর কখনও ঘটে নাই। তখন তাঁহার, প্রাণের ভিতরে যে কি অসহ যন্ত্রণা হইতেছিল, তাহার বর্ণনা হয় না; কিন্তু বাহিরে তাহার সকলই স্থির—প্রাণে যেন উদ্বেগের কোন কারণই নাই। অতি তীব্রভৃষ্টিতে বারেক জুমেলিয়ার মুখপানে চাহিলেন তার পর নিতান্ত রক্ষস্বরে বলিলেন, “জুমেলিয়া, আমার উত্তর, না।”
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
“মরে – মরিবে”
‘না’ এই শব্দমাত্রটাতে সম্ভব জুমেলিয়া খুব বিচলিত ও চমকিত হইয়া উঠিত; কিন্তু তখনকার ভাব জুমেলিয়া অতিকষ্টে দমন করিয়া ফেলিল; কেবল মৃদু হাসিয়া মৃদুগুঞ্জনে বলিল, “ব্যস্ত হ’রো না, দেবেন; বেশ ক’রে ভেবে দেখ।”
বাক্যশেষে তীক্ষকটাক্ষবিক্ষেপ।
“তেবে দেখেছি, না।”
“তুমি তবে স্বীকৃত হবে না?”
“না।”
“দেবেন, তুমি না বড় বুদ্ধিমান্! তোমার স্ত্রীর এই দশা দেখে তুমি কি এই উত্তর স্থির করলে, দেবেন?”
“হাঁ।”
“কি দেখে তুমি এমন ভরসা করছ?”
“আমার স্ত্রীর কিছুই হয় নাই, মুখমণ্ডল যদিও ম্লান, তা’ ব’লে কালিমাময় বা জ্যোতির্হীন নয়! জুমেলা, যতদূর কদৰ্য্যত ঘটতে পারে— তা তোমাতে ঘটেছে। যতই তুমি পাপলিপ্ত হও না কেন, পবিত্রতা যে কি জিনিষ, অবশ্যই তা তুমি জান। তুমি এখনও বলিতেছ, তুমি আমার ভালবাস?”
“হাঁ, ভালবাসি, দেবেন, এখনও বলছি, তোমার জন্য আমি পাগল হইয়াছি।”
“হ’তে পারে; কিন্তু আমি তোমাকে আন্তরিক ঘৃণা করি।”
“দেবেন, এই কি তোমার উত্তর? কঠিন!”
“আমি অন্যায় কিছু বলি নাই; তুমি আমার কথা ঠিক বুঝিবে কি, জানি না; যদি তুমি প্রকৃত রমণী হইতে, তাহা হইলে নিশ্চয়ই বুঝিতে পারিতে; কিন্তু বিধাতা তোমাকে যদিও রমণী করিয়াছেন, রমণী-হৃদয় দিতে সম্পূর্ণ ভুল করিয়াছেন; আচ্ছ, তুমিই মনে কর, তুমি যেন রেবতী—”
[বাধা দিয়া] “বল – বল—দেবেন, তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক; তোমার মুখে এ কথা শুনে আমার হৃদয়ে আনন্দ ধরছে না।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিতে লাগিলেন, “তুমি যেন রেবতী, তোমার স্বামী তোমাকে অতিশয় ভালবাসেন, তুমি যেন কোন দুর্ঘটনায় ওখানে ঐরূপ মৃতপ্রায় পড়িয়া আছ, এমন সময়ে অন্য একটী স্ত্রীলোক তোমার এইরূপ অবস্থায় তোমার স্বামীর নিকটে এইরূপ একটা জঘন্ত অভিপ্রায় প্রকাশ করছে; অথচ তোমার সম্মুখে এখন বা যা ঘটছে, তুমি যেন তা মনে মনে জানতে পারছ; তুমি কি তখন তোমার জীবন-রক্ষার্থে তোমার স্বামীকে সেই রমণীর হাতে সমর্পণ করতে সন্মত হ’তে পার? পার কি জুমেলা?”
“অ্যাঁ, – না—ন!—না—না! কখনই না! সহস্রবার না!”
“তবে জুমেলা, তুমি কি তোমার প্রশ্নের উত্তর নিজে, নিজেরই মুখে পাচ্ছ না? যার প্রাণের পরিবৰ্ত্তে আমাকে তুমি চাও, সে আমাকে ছাড়িয়। তার প্রাণ চাহে না; আর আমার স্ত্রীকে যদি আমি যথার্থ হাঁ ভালবাসি, তবে তার অনভিপ্রেত কাজে আমার হস্তক্ষেপ কর ঠিক হয় না।”
“তবে কি আমার কথার উত্তর না’? তুমি জান, তা’ হ’লে তুমিই তোমার সেই স্ত্রীরই হন্তারক হবে?”
“তথাপি তুমি আমার মত কিছুতেই ফিরাতে পারবে না, জুমেলা।”
“তবে তুমি আমাকে ঘৃণা কর?”
“হাঁ, ভাল রকমে।”
“তবে ভাল রকমে রেবতী ও মরিবে?”
‘মরে —মরিবে।”
“নিশ্চয় মরিবে।”
“তেমনি নিশ্চয়, সে একা মরিবে না।”
“হোঃ—হোঃ—হোঃ [হাস্য] তুমি আমায় বড় ভয় দেখাচ্ছ!”
“হাঁ।”
জুমেলিয়া আবার হাসিল।
সেই অমঙ্গলজনক—পৈশাচিক তীব্র অট্টহাস্য—নির্জ্জলদগগনবক্ষের গম্ভীরবজধ্বনিবৎ। জুমেলিয়া বলিল, “তোমাকে আমি ভয় করি না–করিতে শিখিও নাই।”
দেবেন্দ্র। যদি না শিখিয়া থাক, আজ শিখিবে।
জুমেলিয়া। কেন?
দে। না শিখিলে আমার কাজ সফল হইবে কি প্রকারে?
জু। তোমার কাজ?
দে। হাঁ।
জু। কি কাজ?
দে। তুমি যে কাজ করিতে আমাকে বলিয়াছ।
জু। আমি তোমায় কি কাজ করিতে বলিয়াছি – বল, তোমার কথা বুঝতে পারছি না।
দে। তুমি তোমার জন্য পূৰ্ব্বে যে যে যন্ত্রণার উল্লেখ করেছ, সেই সকল যন্ত্রণাই তোমাকে আমি ভোগ করাইব। আমি যে মানুষ, এ কথা আমি এখন যতদুর ভুলে যেতে পারি, ভুলিব; তোমার উপযুক্ত— তোমারই মত হ’তে—পিশাচ হ’তে চেষ্টা করিব। আমি এখন একএকটি ক’রে তোমার মস্তকের সকল কেশ—যতক্ষণ না, তোমারই ওই ষড়যন্ত্রপূর্ণ মস্তক কেশলেশহীন হয়—ততক্ষণ মূলোৎপাটিত করব। তার পর আমার এই ছুরি পুড়িয়ে লাল করব, সেখান তোমার কপালে চেপে ধরব—দুই গালে চেপে ধরব—তা দিয়ে তোমার চক্ষু দুটা উৎপাটিত করব।
জুমেলিয়া হাসিতে গেল—পারিল না।
দেবেন্দ্রবিজয় পূৰ্ব্ববৎ বলিতে লাগিলেন, “পাছে তুমি নিজের জীবন নিজে বাহির কর, পাছে যদি তোমার কাছে কোন প্রকার বিষা থাকে, আগে তা কেড়ে নেব, তার পর তোমাকে সেই মুণ্ডিতমস্তক, ঝলসিত মুখ অবস্থা না ঘটে, ততক্ষণ তোমার কোন স্বাভাবিক অবস্থা না ঘটে, ততক্ষণ পথে পথে অনাহারে ঘুরিবে।”
জু। [সচীৎকারে] তুমি! তুমি এই সকল করবে?
দে। হাঁ, আমিই সব করব।
জু। [ সচীৎকারে ] তুমি! তমি এই সকল করবে?
জু। তুমি! দেবেন্দ্রবিজয়!
দে। আঃ, ভুলে যাও কেন, জুমেলা, আমি কেন? দেবেন্দ্রবিজয় মরে গেছে, তার দেহে এক পিশাচের অধিষ্ঠান হয়েছে; সেই পিশাচ, যতক্ষণ না তুমি মর, ততক্ষণ তোমাকে নূতন নূতন যন্ত্রণা দেবে; যখন একটু সুস্থ হবে, আবার নূতন যন্ত্রণা।
জু। [ সরোষে ] নিৰ্ব্বোধ! তুমি কি মনে করেছ, আমি এই সকল যন্ত্রণা সহ করবার জন্য তোমার কাছে ঠিক এমনি ভালমানুষটির মত চুপ্ ক’রে দাঁড়িয়ে থাকব?
দে। কি করবে, মরবে? পারবে না। যদি তুমি আত্মহত্যা করবার জন্য কোন বিষ বাহির করিতে যাও, পিস্তলের গুলিতে তোমার হাত চুর্ণ-বিচূর্ণ ক’রে দিব; যদি পালাবার জন্য এক পা নড়বে, এখনই এই গুলিতে তোমার পা ভেঙ্গে দিব।
জুমেলিয়া তিরস্কারব্যঞ্জক কৰ্কশ হাসি হাসিতে লাগিল।
দেবেন্দ্রবিজয় বজ্রনাদে বলিলেন, “জুমেলা, হাসি নয়—আমি মিথ্য বলি না—শীঘ্র প্রমাণ পাবে।”
“প্রমাণ দেখাও।”
“দেখিবে? তোমার কাণে যে ঐ দুটা দুল আছে, ঐ দুটীর মধ্যেও তুমি কৌশলে বিষ সঞ্চয় ক’রে রেখেছ; তোমার ঐ ফুল দুটির অস্বাভাবিক গড়ন দেখেই তা বুঝতে পারছি—ও দুটি এখনই দূর করাই ভাল।”
বাক্য সমাপ্ত হইতে-না-হইতে দেবেন্দ্রবিজয় উপর্য্যুপরি দুইবার পিস্তলের শব্দ করিলেন, জুমেলিয়ার কর্ণাভরণ দুটা পিস্তলের গুলিতে ভাঙ্গিয়া দুরে গিয়া পড়িল, এবং ঘরটি কিয়ৎকালের নিমিত্ত ধূম্রময় হইয়া উঠিল। ইত্যবসরে দেবেন্দ্রবিজয় পিস্তলটা লুকাইয়া ফেলিলেন।
জুমেলিয়া সভয় চাৎকারে দশ পদ পশ্চাতে হটিয়া গিয়া এক কোণে দাঁড়াইল। যেমন সে হস্তোত্তোলন করিতে যাইবে, দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “সাবধান, হাত তুলিয়ে না; এখনি আমি পিস্তলের গুলিতে তোমার হাত ভাঙিয়া দিব। জুমেলা, এ হাস্যোদীপক প্রহসন নয়, পৈশাচিক ঘটনাপূর্ণ বিয়োগান্ত নাটক।”
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
ধরা পড়িল
দুবার উপর্যুপরি পিস্তলের শব্দ করিয়া দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিতে পারিলেন, তখনই শচীন্দ্র তথায় উপস্থিত হইবে। পাঠক অবগত আছেন, দুইবার পিস্তলের শব্দ তাঁহীদের একটা নির্দিষ্ট সঙ্কেতমাত্র। শচীন্দ্র তখনই অতি নিঃশব্দে আসিয়া জুমেলিয়ার পশ্চাদ্ভাগে দাঁড়াইল। দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে দেখিতে পাইলেন; জুমেলিয়া কিছুই জানিতে পারিল না। এখন আর শচীন্দ্রের সে ভিক্ষুকের বেশ নাই, ইতোমধ্যে তৎপরিবর্তে পুলিশের ইউনিফর্ম ধারণ করিয়াছিল।
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “জুমেলা, তুমি একদিন বলেছিলে না যে, মৃত্যুর পরেও তুমি আমার অনুসরণ করবে? যদি আমি মরিতাম, আমিও তোমার পিছু নিতাম; ভূতের মত অলক্ষ্যে তোমারও পশ্চাতে দাঁড়াতেম; তুমি কিছুই জানতে পারতে না; তার পর তোমার হাত দুটা পিছু-মোড়া করে ধরতেম, তোমার আর নড় বার শক্তি থাকত না—বুঝতে পেরেছ?
জু। না।
দে। এইবার?
তখন শচীন্দ্র জুমেলিয়ার হাত দুখান পিছু-মোড়া করিয়া ধরিল। জুমেলিয়া জোর করিতে লাগিল; চীৎকার করিয়া উঠিল, কিছুতেই শচীন্দ্রের হাত হইতে মুক্তি পাইল না।
জুমেলিয়ার সহিত দেবেন্দ্রবিজয়ের উপযুক্তি কথোপকথনের যে কথাগুলি নিম্নে কৃষ্ণরেখা দ্বারা চিহ্নিত করা হইল, দেবেন্দ্রবিজয় জুমেলিয়াকে না বলিয়া প্রকারান্তরে শচীন্দ্রকেই বলিতেছিলেন। শচীন্দ্র আদেশ পালন করিল।
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “জুমেলিয়া, এইবার তুমি অসহায়— পলায়নের কোন উপায় নাই; এইবার আমি তোমার হাতে হাতকড়ী, পায়ে বেড়ী দিব; তার পর তোমারি মন্ত্রণা মত সেই সব যন্ত্রণা তোমাকেই দেওয়া হবে।”
তখনই জুমেলিয়াকে হাতকড়ী ও বেড়ী পরাইয়া দেওয়া হইল। তাহার পর দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে একখানি চেয়ারে বসাইয়া চেয়ারের সহিত লৌহশৃঙ্খলে তাহাকে বন্ধন করিলেন। তখন জুমেলিয়া শচীন্দ্রকে দেখিতে পাইল—এতক্ষণ দেখিতে পায় নাই; বলিল, “পোড়ারমুখ আমার। কই, আমি ত আগে কিছুই জানতে পারি নাই।”
শচীন্দ্র বলিল, “যাকে তুমি পাহারা দিতে বাগানে রেখেছিলে, তাকে যদি না হাত মুখ বেঁধে গাছতলায় আমি ফেলে রেখে আসতেম— জানতে পারতে, আমি এসেছি। জুমেলিয়া, এখন আমাদের দয়ার উপর তোমার পাপপ্রাণ নির্ভর করছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ—জুমেলা, যাকে ভালবাস, এখন তারই দয়ার উপর তোমার জীবন নির্ভর করছে।”
জুমেলিয়া। তবে দেবেন, তুমি তবে আমার সঙ্গে সন্ধি করতে চাও না?
দেবেন্দ্র | সন্ধি? না—কেন করিব?
জু। তুমি রেবতীকে রক্ষা করিবে না?
দে। যদি পারি—করিব।
জু। তবে কেন তুমি তাতে সাধ করিয়া ব্যাঘাত ঘটাইতেছ?
দে। কি প্রকারে?
জু। আমার সহিত সন্ধির কোন বন্দোবস্ত না করিয়া।
দে। তুমি ত বলেছ, তাকে পরিত্রাণ দেবে না।
জু। তখন আমি তোমার হাতে পড়ি নাই।
দে। এ কথা নিশ্চয়—আমি ভুলে গেছ লেম; যাতে তার জ্ঞান হয়, এখন সে ঔষধ আমার হাতে দেবে কি?
জু। দিতে পারি, যদি তুমি আমাকে ছেড়ে দাও—আমাকে এখান থেকে পালাবার জন্য আটচল্লিশ ঘণ্টা মাত্র সময় দাও—হাঁ, তাহা হইলে আমি দিতে পারি। .
দে। সে আশা বৃথা।
জু। তবে তুমি তোমার স্ত্রীর জীবন রক্ষা করতে অসম্মত?
দে। সে যে রক্ষা পাবে না, এ বিশ্বাস আমার নাই। এবারে তোমার যন্ত্রণা আরম্ভ হবে। [ শচীন্দ্রের প্রতি ] শচী! এখনই এই ছুরি দিয়া জুমেলিয়ার চোখ দুটা উৎপাটন করিয়া ফেল।
জু। [ সচীৎকারে ] বাঁচাও! দয়া কর!
দে। কিসের দয়া?
জু। আমি রেবতীকে বাঁচাতে পারি—বাঁচাব।
দে। বাঁচাও তবে—তাকে।
জু। ছেড়ে দাও আমায়।
দে। সে আশা ক’রো না।
জু। তুমি কি এখন আমার সে প্রস্তাবে সম্মত হবে?
দে। আমি কিছুতেই সম্মত নই।
জু। তবে আমি কখনই তাকে বাঁচাব ন—মরুক সে—চুলোয় যাক সে!
দে। জুমেলা, বাঁচাও তাকে; সে যদি আমাকে তোমার ছেড়ে দিতে বলে, নিশ্চয় তোমাকে আমি মুক্তি দিব; মনে বুঝে দেখ, তোমার ভবিষ্যৎ তার হাতে।
জু। রেবতীর? ভাল, যদি সে স্বীকার করে, তুমি আমাকে ছেড়ে দেবে? আমি এখনই তাকে বাঁচাব। ছেড়ে দাও আমায়; আমি মিথ্যা বলি না।
দে। না।
জু। তবে কি ক’রে তাকে বাঁচাতে পারি?
দে। কি করলে তার জ্ঞান হবে, আমাকে ব’লে দাও—আমিই সে কাজগুলি করব—তুমি না। যদি তাতে তার জ্ঞান না হয়, তোমার সেই নিজের স্থিরীকৃত যন্ত্রণাগুলি তোমাকেই উপভোগ করতে হবে।
জু। সে যদি বাঁচে, তা’ হ’লে তুমি আমাকে ছেড়ে দেবে?
দে। যদি রেবতী স্বীকার পায়।
জু। যে ঘরে তোমাকে আগে নিয়ে যাই, সেই ঘরে টেবিলের ভিতরে একটি ছোট কাঠের বাক্স আছে, নিয়ে এস—যেমন আছে, তেমনই নিয়ে আসবে; সাবধান, যেন খুলিয়ো না।
তখনই দেবেন্দ্রবিজয় সেই বায়ু লইয়া আসিলেন।
জু। ঐ বাক্সের ভিতর থেকে সতের নম্বরের শিশিট বাহির কর, পাঁচ ফোঁটা ঔষধ রেবতীকে খেতে দাও।
দে। কোন ঔষধে তুমি রেবতীকে এখন অজ্ঞান ক’রে রেখেছ—কত নম্বর?
জু। এ কথা জিজ্ঞাসা করছ কেন?
দে। প্রয়োজন আছে।
জু। নম্বর সাত।
দে। বেশ, যদি এই সতের নম্বরের ঔষধে কিছু ফল না হয়, তোমাকে সাত নম্বরের ঔষধ জোর করিয়া খাওয়াইব।
জু। ফল হবে।
দেবেন্দ্রবিজয় ধীরে ধীরে রেবতীর অবসন্ন, তুষারশীতল মস্তক নিজের ক্রোড়ে গ্রহণ করিলেন। তখন তাঁহার মনে যে যন্ত্রণা হইতেছিল, তিনি তেমন যন্ত্রণা ইতিপূৰ্ব্বে কখনও ভোগ করেন নাই। তাঁহার সেই প্রাণের যন্ত্রণার কোন চিহ্ন মুখমণ্ডলে প্রকটিত হইল না। তাহার পর তিনি রেবতীর মুখ-বিবরে বিন্দু বিন্দু করিয়া সেই শিশিমধ্যস্থিত গাঢ় লোহিত বর্ণের তরল ঔষধ ঢালিতে লাগিলেন।
মুহূর্তের পর মুহূৰ্ত্ত কাটিতে লাগিল, গৃহ নিস্তব্ধ—কোন শব্দ নাই।
তাহার পর যখন প্রায় একদণ্ড উত্তীর্ণ হইয়া গেল, সহসা রেবতী চক্ষুরুন্মীলন করিলেন—নিতান্ত বিস্মিতের ন্যায় প্রকোষ্ঠের চতুর্দিকে চাহিতে লাগিলেন।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
একি ইন্দজাল!
চক্ষুরুন্মীলন করিয়া রেবতী যাহা দেখিলেন, তাহাতে তাঁহার বিস্ময়ের সীমা রহিল না।
জুমেলিয়া রেবতীকে ক্লোরোফৰ্ম্ম করিয়া এখানে লইয়া আসে; সে ঘোর কাটিতে-না-কাটিতে সে আবার নিজের অমোঘ ঔষধ প্রয়োগ করে, তাহাতে রেবতী সেই অবধি সম্পূর্ণরূপে সংজ্ঞাহীন। প্রথমে তিনি দেখিলেন, তিনি যে কক্ষে শায়িত আছেন—সে কক্ষ তাহার অপরিচিত—তাহার সম্মুখে দেবেন্দ্রবিজয় দণ্ডায়মান—দেবেন্দ্রবিজয়ের পার্শ্বে ম্লানমুখে শচীন্দ্র এবং কিছুদূরে হাতে হাতকড়া, পায়ে বেড়ী দেওয়া লোহশূঙ্খলে আবদ্ধ জুমেলিয়া একখানি চেয়ারে বিনতমস্তকে বসিয়া।
দেবেন্দ্রবিজয় রেবতীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন আছ?”
রেবতী! ভাল আছি।
দেবেন্দ্র। উঠিতে পরিবে কি?
রে। পারিব। [ দণ্ডায়মান ]
দে। চলিতে পারিবে?
রে। হাঁ, কেবল মাথাটা একটু ভারি বোধ হচ্ছে।
তাহার পর দেবেন্দ্রবিজয় দুই-একটি কথাতে অতি সংক্ষেপে এ পর্য্যন্ত যাহা যাহা ঘটিয়াছে, সকলই রেবতীকে বলিলেন; কেবল জুমেলিয়ার সেই অবৈধ প্রেম-প্রস্তাব সম্বন্ধে কোন কথার উল্লেখ করিলেন না; তজ্জন্য ডাকিনী জুমেলিয়া বারেক সন্তুষ্টনেত্রে দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখপ্রতি দৃষ্টিপাত করিল।
দেবেন্দ্রবিজয় রেবতীকে বলিলেন, “এখন তোমার হাতে জুমেলার ভবিষ্যতের ভালমন্দ নির্ভর করছে; আমি জুমেলার নিকট প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছি, তোমার কথামত আমি কাজ করব; তুমি উহাকে মুক্তি দিতে চাও—দিব, না চাও–না দিব, যা তোমার ইচ্ছা। স্বীকার করি, জুমেলাই তোমাকে মৃত্যুমুখ থেকে ত্রাণ করেছে; কিন্তু সেই জুমেলাই তোমাকে মৃত্যুমুথে তুলে দিয়েছিল; এখন আমি এখান হ’তে বাহিরে যাচ্ছি—এখন এখানে থাকা আমার আবশ্যক করে না; আমার সাক্ষাতে জুমেলা তোমার নিকটে কোন প্রার্থনা জানাতে লজ্জিত হবে; তুমিও কিছুই ভালরূপে মীমাংসা ক’রে উঠতে পারবে না; তবে বাহিরে যাবার আগে তোমাকে একটি কথা ব’লে রাখা প্রয়োজন। সাবধান, তুমি জুমেলিয়াকে স্পর্শ করিয়ো না!—এমন কি নিকটেও যাইয়ো না।”
দেবেন্দ্রবিজয় শচীন্দ্রকে সঙ্গে লইয়া, তথা হইতে বহির্গত হইয়া বাহির হইতে কবাটে শিকল দিলেন। দেবেন্দ্রবিজয় ও শচীন্দ্র বাহিরে অপেক্ষায় রহিলেন।
পনের মিনিট অতিবাহিত হইল, কোন সংবাদ নাই।
আর দশ মিনিট কাটিল – তথাপি কোন সাড়াশব্দ নাই, একটিমাত্র ভিত্তি ব্যবধানে তাহারা দণ্ডায়মান; কোন শব্দ নাই। তখন দেবেন্দ্রবিজয় অস্থির হইতে লাগিলেন। বাহির হইতে উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন, “অরি আমি পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করিব, যা হয়, ঠিক করিয়া লও।” দেবেন্দ্রবিজয় পকেট হইতে ঘড়ী বাহির করিয়া দেখিতে লাগিলেন। সেইরূপ নিঃশব্দে আরও পাঁচ মিনিট কাটিল।
দেবেন্দ্রবিজয় তখন সশব্দে সেই কক্ষদ্বার উদঘাটন করিলেন। যাহা দেখিলেন, তাহাতে তাঁহাকে স্তম্ভিত হইতে হইল, তাঁহার মাথা ঘুরিয়া গেল, মুখ দিয়া কথা বাহির হইতে অনেক বিলম্ব হইল।
যে গৃহমধ্যে তিনি এই কতক্ষণ হস্তপদবদ্ধ জুমেলিয়া এবং রেবতীকে রাখিয়া বাহিরে গিয়াছিলেন, সে কক্ষ শূন্য পড়িয়া আছে।
রেবতী নাই।
জুমেলিয়া নাই।
তাহাদের কোন চিহ্নও নাই।
পাছে ভ্রম হইয়া থাকে, এই সন্দেহে নিদারুণোদ্বেগে দেবেন্দ্রবিজয় উভয় হস্তে উভয় নেত্ৰ মৰ্দ্দন করিতে লাগিলেন। একি স্বপ্ন! জুমেলিয়াকে যে চেয়ারে বন্ধন করা হইয়াছিল, সেই চেয়ারের নিকটে অগ্রসর হইলেন; দেখিলেন, যে শৃঙ্খলে জুমেলিয়া আবদ্ধ ছিল, সেটা চেয়ারের নীচে পড়িয়া রহিয়াছে; হাতকড়ী ও বেড়ী ও সেখানে আছে; তাহা অন্য চাবি দিয়া খুলিয়া ফেলা হইয়াছে í
চেয়ারখানার উপরে এক টুকরা কাগজ পড়িয়া রহিয়াছে, তাহাতে লেখা ছিল;– .
“কেমন মজা; বাহবা কি বাহব্বা-আবার যে-কে সেই! তুমি বোকারাম গোয়েন্দা। আমি আবার স্বাধীন—রেবতী আবার আমার হাতে পার-ক্ষমতা থাকে তাকে উদ্ধার করিয়ো।
সেই
জুমেলা।”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “কিরূপে পলাইল? জুমেলা বাঁধা ছিল। কেবল বাঁধা নয়—তার সম্মুখে রেবতীও ছিল। একি ব্যাপার, শচী? শচী, তুমি যে লোকটাকে বাহিরে বেঁধে রেখে এসেছ, সে ত কোন রকমে এদিকে আসতে পারে নাই?”
শচীন্দ্র সেই সন্ধান লইবার জন্য তখনই যেমন লাফাইয়া গৃহ হইতে বাহির হইতে যাইবেন, অমনি আগুনের একটা সুতীব্র ঝটকা আসিয়া তাহাকে তথায় ফেলিয়া দিল। সেই সঙ্গেই ‘ধ্রূম’ করিয়া একটা পিস্তলের শব্দ হইল। মৃতবৎ শচীন্দ্র দেবেন্দ্রবিজয়ের পদপার্শ্বে পতিত হইল। এখন দেবেন্দ্রবিজয় কি করিবেন? এ মুহূৰ্ত্ত চিন্তার নহে—কার্য্যের। তখনই পিস্তল বাহির করিলেন, যেদিক্ হইতে আগুনের ঝটুক আসিয়াছিল, সেইদিক্ লক্ষ্য করিয়া পিস্তল দাগিলেন। তখনই কোন একটা ভারযুক্ত দ্রব্যের পতন শব্দ এবং মানুষের গেঙানি শুনা গেল—তবে পিস্তলের গুলিটা ব্যর্থ যায় নাই।
তখন দেবেন্দ্রবিজয় দ্বারদেশে নিপতিত শচীন্দ্রকে উল্লঙ্ঘন করিয়া কক্ষের বাহিরে আসিলেন; যেদিক্ হইতে গেঙানি শব্দ আসিতেছিল সেইদিকে দুই-চারিপদ যাইয়াই দেখিতে পাইলেন, একটা লোক মৃতবৎ পড়িয়া রহিয়াছে; বুঝিলেন, তখনও লোকটা মরে নাই।
দেবেন্দ্রবিজয় নীরবে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
শেষ উদ্যম
যখন দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, লোকটা পূৰ্ব্বাপেক্ষ অনেকটা প্রকৃতিস্থ হইয়াছে; জিজ্ঞাসিলেন, “কি হে ভদ্রলোক! আমি এখন তোমাকে যা’ যা’ জিজ্ঞাসা করব, ঠিক ঠিক তার উত্তর দেবে কি? যদি না আমার হাত থেকে সহজে নিস্তার পাবে না—তোমার জিহ্বাটা টেনে ছিড়ে ফেলে দিব।”
সেই লোকটা ভয়ে ভয়ে বলিল, “আপনি আমাকে কি জিজ্ঞাসা করতে চান?”
দেবেন্দ্র। জুমেলা কি প্রকারে মুক্তি পাইল?
লোক। আমি তাকে মুক্তি দিয়েছি।
দে। সেখানে আর একটা যে স্ত্রীলোক ছিল, সে কিছু বলে নাই?
লো। আমি আগেই তাকে তার অলক্ষ্যে ক্লোরফৰ্ম্ম ক’রে গাড়ীতে তুলে দিয়ে আসি।
দে! গাড়ী! কোথাকার গাড়ী?
লো। পুৰ্ব্বদিক্কার পথের ধারে আগে একখানা গাড়ী এনে ঠিক করে রেখেছিলেম।
দে। কার আদেশে?
লো। জুমেলিয়ার।
দে! কি জন্য গাড়ী এনে রেখেছিলে?
লো। জুমেলিয়ার মুখে শুনলেম, তার সঙ্গে আপনি কোথা যাবেন বলেছিলেন।
দে। সে গাড়ীতে আর কে আছে?
লো। গিরিধারী নামে আমারই একজন বন্ধু—আমার সেই বন্ধুকেই আপনার সঙ্গী লোকটা নীচে বেঁধে ফেলে রেখেছিল; আমি গিয়ে তাকে উদ্ধার করি; তার পর আপনাদের এখানকার ব্যাপার চুপিসারে এসে দেখি; সুবিধাক্রমে কাজ শেষ করি—তারা এখন সব চ’লে গেছে।
দে। তুমি গেলে না কেন? তুমি যে বড় থেকে গেলে?
লো। আপনাকে খুন করবার জন্য।
দে। আমাকে খুন করিয়া তোমার লাভ?
লো। জুমেলিয়ার লাভ।
দে। তা’তে তোমার কি?
লো। জুমেলিয়ার লাভে আমার লাভ।
দে। গাড়ীখানা কোথায় গেল?
লো। দমদমার দিকে।
দে। দমদমার কোথায়—কোন ঠিকানায়?
লো। ঠিকানা ঠিক জানি না—তবে বেলগাছি ছাড়িয়ে যেতে হবে।
দে। বেলগাছি ছাড়িয়ে কত দূর যেতে হবে?
লো। শুনেছি, বেশি দূর না—দু-চারখানা বাগানের পরেই একটা গেটওয়ালা বাগান আছে, সেই বাগানের ভিতরে।
দে। ও বুঝেছি! হরেকরামের বাগান বুঝি?
লো। হাঁ—হাঁ—ঠিক ঠাওরেছেন।
দে। যদি তা’ না হয়—যদি মিথ্যা ব’লে থাক—তোমায় আমি—
বাধা দিয়া আহত ব্যক্তি বলিল, “আমি মিথ্যাকথা বলি নাই।”
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসিলেন, “জুমেলিয়ার সঙ্গে তোমার আর তোমার বন্ধুর কতদিন পরিচয় হয়েছে?”
“এক সপ্তাহ হ’বে।”
“সে বাগানে আর কেউ আছে?”
“একজন দরওয়ান—তার নাম পাহাড় সিং।”
“জুমেলা আর তোমার বন্ধু গিরিধারী কতক্ষণ গেছে?”
“আমি যখন আপনার সঙ্গীকে গুলি করি, তার একটু আগে।”
“আমাকে খুন করতে তুমি থেকে যাও, কেমন? আমাকে খুন, করবার কারণ কি? জুমেলিয়ার লাভ কি রকম?”
“জুমেলা যাবার সময় ব’লে গেছে, আপনাকে খুন করলে সে আমাকে বিবাহ করবে।”
“তুমি কি তাকে বিশ্বাস কর?”
“আগে করেছিলাম বটে।”
শচীন্দ্রের ক্রমে জ্ঞান হইতে লাগিল; অল্পক্ষণ পরে উঠিয়া বসিল। দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসিলেন, ‘শচী, চলিতে পারিবে?”
শ। পারিব।
দে। জুমেলা এখন কোথায় যাইবে আমি জেনেছি – আমি এখনই তার সন্ধানে চললেম; তুমি এখন এখানে থাক—যতক্ষণ না আমি ফিরে আসি, ততক্ষণ তুমি এইখানেই থাক; সুবিধামত কোন পাহারাওয়ালাকে রাস্তায় পেলে তোমার সাহায্যার্থ তাকে এখানে পাঠিয়ে দিব।
দেবেন্দ্রবিজয় এই বলিয়া ক্ষিপ্ৰপদে তথা হইতে প্রস্থান করিলেন।
অতি অল্পক্ষণে তিনি ছুটিয়া আসিয়া জগুবাবুর বাজারের পথে পড়িলেন, তথায় দুই-একখানি ভাড়াটিয়া গাড়ী তখনও আরোহীর অপেক্ষায় ছিল। দেবেন্দ্রবিজয় লাফাইয়া একখানি- গাড়ীর কোচ বক্সে গিয়া উঠিলেন; ঘোড়ার লাগাম ও চাবুক স্বহস্তে গ্রহণ করিয়া গাড়ী জোরে হাঁকাইয়া দিলেন। গাড়োয়ান তাহার সেই অদৃষ্টপুৰ্ব্ব কাৰ্য্যকলাপ দেখিয়া অবাক হইয়া রহিল; দেবেন্দ্রবিজয়কে পাগল অনুমানে শঙ্কিত হইল।
দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে বলিল, “গাড়ী দমদমায় যাবে, বিশেষ দরকার। বাধা দিয়ো না; বাধা দাও—গাড়ী থেকে ফেলে দিব; চুপ ক’রে বসে থাক; যদি দশ টাকা ভাড়া পেতে চাও- কোন কথাটি ক’রো না, চুপ্ ক’রে বসে থাক।”
গাড়োয়ান অদৃষ্টের উপর নির্ভর করিয়া চুপ্ করিয়া বসিয়া রহিল। সে দুইদিনে কখন দশ টাকা রোজগার করিতে পারে নাই, এক রাত্রেই দশ টাকা পাইবে শুনিয়া মনে মনে অত্যন্ত আহ্লাদিত হইল।
গাড়ী নক্ষত্ৰবেগে ছুটতে লাগিল।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
উদ্যমের শেষ
দেখিতে দেখিতে গাড়ীখানা শ্যামবাজার অতিক্রম করিয়া অতি অল্প সময়ের মধ্যে দমদমায় আসিয়া পড়িল। এখনও সেইরূপ তীরবেগে গাড়ী ছুটিতেছে।
যখন সেই গাড়ী হরেক্রামের বাগানের নিকটবৰ্ত্তী হইয়াছে, তখন গাড়ীখানার সম্মুখের একখানি চাকা খুলিয়া গেল-গাড়ী দাঁড়াইল। দেবেন্দ্রবিজয় কি এখন চুপ করিয়া থাকিতে পারেন—লাফাইয়া ভূতলে পড়িলেন; নিৰ্ব্বাক্ গাড়োয়ানের হাতে একখানা দশ টাকার নোট ফেলিয়া দিয়া রুদ্ধশ্বাসে ছুটলেন।
দেবেন্দ্রবিজয় মরুদ্বেগে ছুটিতে লাগিলেন—ক্ষণকালের মধ্যে হরেক্রামের উদ্যান-সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। উদ্যানের মধ্যে আসিয়া পশ্চিমাভিমুখে চলিলেন, কিয়দর গমন করিয়া একটা দ্বিতল অট্টালিকা দেখিতে পাইলেন, তন্মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া বামপার্শ্বস্থ সোপানীতিক্রম করিয়া উপরে উঠিলেন। বারান্দার বসিয়া পরম নিশ্চিন্তমনে পাহাড় সিং তাম্রকুটধর্ম পান করিতেছিল—দেবেন্দ্রবিজয় নিঃশব্দে তাহার পশ্চাদ্ভাগে দাঁড়াইলেন। পাহাড় সিং হুঁকার যেমন একট লম্বা টান দিতে আরম্ভ করিয়াছে, দেবেন্দ্রবিজয় উভয় হস্তে তাহার গলদেশ টিপিয়া ধরিলেন। সুখটানে বাধা পড়িল—হু কার কলিকা ফেলিয়া পাহাড় সিং গোঁ গোঁ করিতে লাগিল—ক্রমে অজ্ঞান হইয়া পড়িল, চক্ষু উল্টাইয়া গেল। তখন দেবেন্দ্রবিজয় তাহার গলদেশ ছাড়িয়া দিলেন, তাহারই পরিহিত বস্ত্রে তাহার হস্তপদ বন্ধন করিলেন ও মুখবিবরে খানিকটা কাপড় প্রবেশ করাইয়া মুখ বন্ধ করিয়া দিলেন; তাহার পর দ্রুতপদে নিম্নে অবতরণ করিলেন।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
শেষ
বৈঠকখানা গৃহে দেবেন্দ্রবিজয় প্রবিষ্ট হইলেন, তথার কেহ নাই। একপার্শ্বে একটা অৰ্দ্ধমলিন শয্যা ছিল, তাহার উপরে ক্লান্তভাবে বসিয়া পড়িলেন। অনেকক্ষণ পরে উদ্যানের বাহিরে একটা সচল গাড়ীর ঘর্ঘর ধ্বনি উঠিল। দেবেন্দ্রবিজয় গবাক্ষ দিয়া জ্যোৎস্নালোকে দেখিলেন, একখানি গাড়ী ফটক দিয়া উদ্যান-মধ্যে আসিল; বুঝিতে পারিলেন, তন্মধ্যে জুমেলিয়া ও তাহার পত্নী আছে, উপরে যে ব্যক্তি বসিয়াছিল, সে সেই গিরিধারী সামন্ত।
গাড়ীখান ক্রমে অট্টালিকার দ্বারসমীপ্লাগত হইয়া দাঁড়াইল—লাফাইয়া গিরিধারী সামন্ত অগ্ৰে ভূতলে অবতরণ করিল।
“পাহাড় সিং! পাহাড় সিং!” জুমেলা চীৎকার করিয়া ডাকিল। পাহাড় সিং উত্তর করিল না। কে উত্তর দিবে?
গিরিধারী সামন্ত বলিলেন, “মরুক্ ব্যাটা—হতভাগা পাজী! গেল কোথায়?”
জুমেলিয়া বলিল, “হয় ত ব্যাট সিদ্ধি গাঁজা খেয়ে, বেহুস হয়ে পড়ে আছে—মরুক সে! গিরিধারী, তুমি আমার ভগিনীকে তুলে নিয়ে যাও।”
“ভগিনী! জুমেলিয়ার?” মৃদুগুঞ্জনে ডিটেক্টিভ আপনা-আপনি বলিলেন–তাঁহার আপাদমস্তক বিকম্পিত হইল।
গিরিধারী জিজ্ঞাসিল, “ম’রে গেছে না কি?”
ঈষদ্ধান্তে জুমেলিয়া বলিল, “মরেছে? না—এখনও মরে নি; যাও ইহাকে তুলে নিয়ে যাও।”
গিরি। কোথায় নিয়ে রাখব?
জু। বৈঠকখানা ঘরে।
বৈঠকখানার ভিতরে দেবেন্দ্রবিজয় তাহাদের অপেক্ষায় ছিলেন। গিরিধারী সেই কক্ষেই আসিবে জানিয়া, দ্বারপার্শ্বে লুক্কায়িত রছিলেন। তখনই সংজ্ঞাহীন রেবতীকে লইয়া গিরিধারী তথায় প্রবিষ্ট হইল। তথায় আলো না থাকায় সে দেবেন্দ্রবিজয়কে দেখিতে পাইল না। পশ্চিমপার্শ্বস্থিত অৰ্দ্ধোন্মুক্তবাতায়নপ্রবিষ্ট জ্যোৎস্নালোকে ঘরটি অস্পষ্টভাবে আলোকিত; তৎসাহায্যেই গিরিধারী শয্যাটী দেখিতে পাইল, তদুপরি রেবতীকে রাখিয়া বহির্গমনোদ্যোগ করিল।
এমন সময়ে দেবেন্দ্রবিজয় নিঃশব্দে তাহাকে আক্রমণ করিলেন; যেরূপে তিনি পাহাড় সিংকে বন্দী করিয়াছিলেন, সেইরূপে গিরিধারীকেও বন্দী করিলেন; কোন শব্দ হইল না; অথচ কাৰ্য্যসিদ্ধ হইল। তাহার মৃতকল্পদেহ পালঙ্কের নিম্নে রাখিয়া দিলেন।
তৎপরেই তিনি রেবতীর নিকটস্থ হইলেন, তাঁহার মুখের নিকট মুখ লইয়া সেই অস্পষ্টীলোকে দেখিয়া বুঝিতে পারিলেন, রেবতী এখন ক্লোরফৰ্ম্মের দ্বারাই অচেতন আছে মাত্র। আশঙ্কার কোন কারণ নাই। দেবেন্দ্রবিজয় মৃদুস্বরে বলিলেন, “হতভাগিনি! তোমার দুর্দিন এইবার শেষ হইবে।”
বাহির হইতে জুমেলিয়া ডাকিল, “গিরিধারি! গিরিধারি!”
দেবেন্দ্রবিজয় গিরিধারীর কণ্ঠস্বর অনুকরণ করিয়া বলিল, “আবার কি –কি হয়েছে? চ’লে এস না তুমি।”
জুমেলিয়া বাহির হইতে বলিল, “এখান থেকে ঔষধের বাক্সট আর কাপড়গুলো নিয়ে যাও।”
পূৰ্ব্ববৎ দেবেন্দ্রবিজয়, “রেখে দাও—তোমার কাপড় আর বাক্স, আমি তোমার বোনকে নিয়ে দস্তুরমত একটা আছাড় খেয়েছি।” শুনিতে পাইলেন, জুমেলিয়া তাহার কথা শুনিয়া অত্যন্ত হাসিতেছে; গবাক্ষ দিয়া দেখিলেন, জুমেলিয়া বাটীমধ্যে প্রবেশ করিল; তাহার হস্তে সেই কিরীচ উন্মুক্ত রহিয়াছে, চন্দ্ৰকরে সেটা বিদ্যুদ্ধত ঝক ঝক করিতেছে।
ক্রমে জুমেলিয়া বৈঠকখানা গৃহের নিকটস্থ হইল; দ্বার-সম্মুখে দাঁড়াইয়া নিম্নকণ্ঠে ডাকিল, “গিরিধারী!”
তখন দেবেন্দ্রবিজয় তাহার গুপ্ত লণ্ঠন বাহির করিয়া স্প্রীং টিপিয়া দিলেন; উজ্জল স্বতীব্র আলোকরশ্মিমালা জুমেলিয়ার চক্ষু ধাঁধিয়া তাহার মুখের উপরে পড়িল।
কর্কশকণ্ঠে দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “গিরিধারী এখানে নাই; তোমার অপেক্ষায় আমিই আছি, জুমেলা।”
“দে-বে-দ্র-বি-জ-য়!” জুমেলিয়া সবিস্ময়ে বলিল।
“হাঁ, দেবেন্দ্রবিজয়—তোমার যম—তোমার শক্ৰ—তোমার পরম শক্ৰ ৷ এক পা যদি নড়বে, এখনই তোমাকে গুলি করব—এতদিন তুমি আমাকে নাস্তানাবুদ করে তুলেছিলে; তোমার জন্য কতদিন আমার অনাহারে কেটে গেছে; এমন কি নানাপ্রকার দুর্ঘটনায় আমার মস্তিক্ষও তুমি বিকৃত ক’রে দিয়েছ; আজ তোমার নিস্তার নাই; দেবেন্দ্রের হাতে তোমার কিছুতেই নিস্তার নাই—এক পা অগ্রসর হইলেই গুলি করব।” দেবেন্দ্রবিজয় ক্রোধে উন্মত্তপ্রায় হইয়া উঠিয়াছিলেন; তাঁহার চক্ষু দিয়া তখন যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইতেছিল।
জুমেলিয়া ভয় পাইল না; তাহার অখণ্ড প্রতাপ অক্ষুণ্ণ রাখিয়া স্মিতমুখে বলিতে লাগিল, “মাইরি! গুলি করবে? তুমি! দেবেন্দ্রবিজয়! জুমেলিয়াকে? পার না—তোমার সাধ্য নয়—তোমার হাতে মৃত্যুতেও জুমেলিয়ার কলঙ্ক আছে। দেবেন! তোমার হাতে মরব! হায়! হ’য়ে কেন মরি নাই! মাতৃস্তন্য – কেন আমার বিষ হয় নাই! যাকে ভালবাসি, তার হাতে আমি মরব! কষ্টকর— বড় কষ্টকর—সে মৃত্যু বড় কষ্টকর, দেবেন! দেবেন, এখনও বলছি, তোমাকে আমি ভালবাসি—আগে বাসতাম, এখনও বাসি— – ম’রেও ভুলতে পারব, এমন বোধ হয় না। ভালবাসি বলিয়াই ত আমি আজ না এই বিপদগ্রস্ত; নতুবা এতদিন তোমাকে আমি কোন কালে এ সংসার থেকে বিদায় দিতাম। অনেকবার মনে করেছি— পারি নাই; ঐ মুখ দেখেছি—ভুলে গেছি—সব ভুলে গেছি। আপনাকে ভুলে গেছি, আপনার কর্তব্য ভুলে গেছি, জগৎ-সংসার ভুলে গেছি। শোন দেবেন, যদি তুমি আমার প্রতিদ্বন্দী না হ’তে, তোমার অপেক্ষ সহস্ৰগুণে শ্রেষ্ঠ কোন গোয়েন্দা আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতাচরণ করিত, সে কখনই আমার কেশস্পর্শও করতে পারত না। অবলীলাক্রমে আমি তাহাকে নিহত করতেম। এই তুমি—তোমার রূপে—তোমার গুণে যদি না আমি ভুলতেম—তা’ হ’লে তুমি এতদিন কোথায় থাকতে—কি হ’ত তোমার, কে জানে? এতদিন তুমি আবার কোথায় নূতন জন্মগ্রহণুy করতে। তোমাকে ভালবাসিয়াই ত সৰ্ব্বনাশ করেছি—নিজের মৃত্যু— নিজের অমঙ্গল নিজে ডেকেছি। কি করব? মন আমার বশীভূত নয়। আমি মনের দাস। যখন তুমি তোমার গুরু অরিন্দম গোয়েন্দার সাহচৰ্য্য কর, আমার গুরুই বল, স্বামীই বল—ফুলসাহেবকে গ্রেপ্তার কর, তখন হ’তে তোমাকে আমি কি চোখে দেখেছি, তা জানি না। দেবেন, এটা যেন চিরকাল স্মরণ থাকে—যে জুমেলা তোমার পরম শক্ৰ, সেই জুমেলাই তোমার প্রেমাকাজিহ্মণী; যে জুমেলার তুমি পরম শক্ৰ, সেই জুমেলার তুমি প্রাণের রাজা। তোমার হাতে মৰ্বতে, মৃত্যুযন্ত্রণা বড় ভয়ানক হবে; নিজে মরি—দেখ—তোমার সামনে মরি—হাসতে হাসতে মরতে পারব। তুমিও জুমেলার মৃত্যু হাসিমুখে দেখতে থাক, জুমেলাও তোমাকে দেখতে দেখতে হাসিমুখে মরুক।” এই বলিয়া জুমেলিয়া সেই কিরীচ নিজের বক্ষে আমূল বিদ্ধ করিল। ভলকে ভলকে অজস্ৰ শোণিত নিঃসৃত হইতে লাগিল। বুকের ভিতরে অত্যন্ত যন্ত্রণা হইতে লাগিল, করতলে বুকের সেই ক্ষতস্থান চাপিয়া বাত্যাবিচ্ছিন্ন বল্লরীর ন্যায় জুমেলিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে গৃহতলে পড়িয়া গেল। মুখ ও দৃষ্টি সৰ্ব্বাগ্রে মৃত্যুচ্ছায়ান্ধকারমান হইয়া আসিল। তখনও সেরূপ প্রবলবেগে তাহার সৰ্ব্বাঙ্গ পরিহিত বসন ও গৃহতল প্লাবিত করিয়া শোণিতপাত হইতে লাগিল। ছিন্নবিচ্ছিন্ন বাতবিকম্পিত, রক্তচন্দনাক্ত রক্তপদ্মবং জুমেলিয়া। সেইখানে পড়িয়া লুটাইতে লাগিল—তখনই তাহার মৃত্যু হইল।
দেবেন্দ্রবিজয়ের পরম শত্রু এইখানে এইরূপে পরাভূত ও নিহত হইল।
সে সময়ে কেহ যদি বিশেষ লক্ষ্য করিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে একবার চাহিয়া দেখিত, অবশ্যই সে দেখিতে প্লাইত, দেবেন্দ্রবিজয়ের চক্ষু, তখন নিরশ্রু বা শুষ্ক ছিল না। সেই সময়ে তাহার সেই বিস্ময়বিস্ফারিত চক্ষু দুটিতে দুইবিন্দু জল ছলছল করিতেছিল।