Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

ঠিক দুপুরে খাওয়ার পর প্রিয়নাথের সামান্য দিবানিদ্রার অভ্যাস। শুলেই ঘুম আসে না। দোতলার ঘরটা ওর খুবই নিরিবিলি। কাকলি এ সময় নিজের ঘরে বসে ছবি—টবি আঁকে। অথবা খুব মৃদু শব্দ বাজে রেডিয়োর। হরলিক্সের আসর বোধহয় শুনছে। ঘড়ির কাঁটার মতো একটা শব্দ এবং কিছু প্রশ্ন, প্রশ্নগুলি কাকলি শুনে নিজেই একটা জবাব খাড়া করে রাখে। আজকালকার ছেলেমেয়েদের জন্য কত রকমের প্রোগ্রাম করে থাকে রেডিয়ো। এবং এ—বাড়িতে প্রয়োজন কাকলিরই সবচেয়ে বেশি। তিনি অবশ্য সাড়ে সাতটার খবর নিবিষ্ট মনে শোনেন। যেন আজকালকার মধ্যেই কোনো বিপজ্জনক খবর আবার রেডিয়োতে ভেসে আসবে। কোথাও কিছু একটা হচ্ছে। যেন সব ভেঙে চুরমার করে দেবার জন্য কারা গোপনে প্রস্তুত হচ্ছে। তার বুক কাঁপে। পাশে ধর্মজীবন বাবাজীর আশ্রম আছে। সন্ধ্যায় সেখানে গীতাপাঠ, রামায়ণ পাঠ এবং ধর্মাধর্মের ওপর নানারকম আলোচনার সুবন্দোবস্ত আছে। বুড়ো মানুষদের জন্যে খুবই জরুরি এটা, তিনি অন্যমনস্ক থাকার জন্য কিছুটা সময় সেখানে অতিবাহিত করেন। কত রকমের বয়সের ছাপ মারা মুখ। যৌবনে ওরা কতটা তেজি ঘোড়া ছিল মাঝে মাঝে ভাববার চেষ্টা করেন। কত রকমের যে সংকট শরীর বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দেখা দেয়। একটা বয়সের পরে আবার তা নিভে আসে। এবং তখন সেই যে বলে না প্রকৃতির কূটবুদ্ধি অথবা নির্জনে তার খেলা—মানুষ টেরও পায় না, অহরহ রক্তে মাংসে মজ্জায় এবং স্নায়ুতে কী তুমুল তুফান তুলে পালের দড়িদড়া ছিন্ন—ভিন্ন করে দিচ্ছে। এবং ওই সময়টাতে জীবনের সঠিক অর্থ কী, জীবন কী, জীবন মানে তো মাটির হাঁড়ি কলশি নয়, ভেঙে গেলেই অকেজো হয়ে যাবে—এবং দেখেছেন যত ভেঙে যায়, তত তার তেজ বাড়ে এবং তখন এক অন্যমনস্ক বৃদ্ধের ছবি এবং মৃত্যু ভয়। অদৃশ্য অস্পষ্ট অন্ধকারের ভয়। দিন যত যাচ্ছে ভয়টা তাকে ক্রমশ শিথিল করে দিচ্ছে। পুত্রের নিহত হওয়ার ঘটনা খুব একটা আর ভাবায় না! স্ত্রী গত হয়েছে দেড় দু—যুগ আগে। মাঝে মাঝে স্বপ্নে এক বালিকার ছবি দেখতে পান। সে বেণী দুলিয়ে হেঁটে যায় তাঁর পাশে।

বাবা আপনার জল।

প্রিয়নাথ বসে থেকেই জলটা খেলেন।

তোমার এখনও খাওয়া হয়নি!

এই হয়ে যাবে। আপনি শুয়ে পড়ুন না।

ভানু চলে গেল।

যায়নি। ও ঘরে আছে। পত্রিকা পড়ছে।

ওকে বল, যেন চলে না যায়। ওর সঙ্গে খেলা শেষ হয়নি। একটু গড়াগড়ি দিয়েই লড়ব।

মন্দাকিনী সামান্য হাসল। বলল, বলব।

প্রিয়নাথ জানে এ বাড়িতে এই যুবক কত প্রয়োজনীয়। খুব কম বয়স থেকেই এটা তার চরিত্রের দোষ বা গুণ যাই—ই বলা যাক—দুঃখ—টুঃখ একদম দু’চোখের বিষ। শোকতাপকে আমল দেওয়াই মানুষের অনুচিত।

এ—জন্য ভেতরের প্রাচীন মানুষটার সঙ্গে সংঘর্ষ বেধে যায় মাঝে মাঝে। তখন প্রিয়নাথ কিছুটা নির্মোহ হয়ে পড়েন। এই নির্মোহ স্বভাবের জন্যেই সে অনায়াসে নীরজার সঙ্গে কিছুটা পাপে লিপ্ত হতে পেরেছিল। এই নির্মোহ স্বভাবের দরুনই বিধবা পুত্রবধূর সামনে একজন যুবকের উপস্থিতি আদৌ কষ্ট দেয় না। প্রাচীন মানুষটা ভেতর থেকে বের হয়ে আসতে চাইলেই থাবা মেরে বসিয়ে দেন। বলেন, তুমি বুড়ো জান না, কিছু বোঝো না, বাইরের কেলেঙ্কারির চেয়ে এটা অনেক ভালো। ও—বাড়ির সঙ্গে দীর্ঘদিনের সখ্যতা। ভানু আগেও এ—ভাবেই চলে আসত, থাকত, দাবা খেলত, সেই রেওয়াজটাই আছে। একজনের মৃত্যুতে কিছুই ব্যতিক্রম হয়নি।

এবং শুয়ে পড়ে চোখ বুজলেন প্রিয়নাথ। সামাজিক সম্মান—বোধটাই ওকে বেশি তাড়া করে। মন্দাকিনীর যা বয়েস ধরে রাখা যেত না। ভানু থাকতে বয়েসটা বাড়িয়ে দিতে পারলে ফ্রন্টে কিছুটা সুবিধা মিলতে পারে। যদ্দিন চলে চলুক। প্রিয়নাথের হাই উঠছিল। যা রেখে যাচ্ছেন তাতে দুটো

প্রাণীর হেসে খেলে চলে যাবে। কাকলির দুষ্টু দুষ্টু গলা এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েটা কী ঘুমিয়ে পড়ল! এবং প্রিয়নাথ ভুলে গেছেন একটা শো দেখার কথা আছে কাকলির। কাকলি এবং তার ক্লাশের বান্ধবীরা মিলে কোথায় যেন একটা বাচ্চাদের ফিল্ম দেখতে যাচ্ছে। স্কুল থেকে নিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং কিছুটা নিশ্চিন্তে দিবানিদ্রায় মগ্ন হওয়া যায়। তিনি পাশ ফিরে শুলেন। হাতটা মাথার কাছে। পা দুটো ভাঁজ করে শুয়েছেন।

মন্দাকিনী দুটো শব্দ একই সঙ্গে পেল।

কাকলি বলল, যাচ্ছি মা। ভানু কাকা যাচ্ছি। তুমি কিন্তু চলে যাবে না। কথা আছে।

ভানু বুঝতে পারে না মেয়েটা এমন সব কথাবার্তা শিখল কার কাছে! কথা আছে বললেই যে কিছু আড়াল আবডাল, কিছু সংশয়, কিছু লজ্জা মিশে থাকে মেয়েটা বোঝে না।

শ্বশুরমশায়ের নাক ডাকছে, মন্দাকিনী ঘরের দরজা অতিক্রম করার সময় টের পেল।

তখনই দ্রুত এক জলতরঙ্গ বাজনা সারা শরীরে খেলে যায় মন্দাকিনীর, শরীর কাঁপে থর থর করে। কানে কেমন ঝোড়ো হাওয়ার শব্দ। এমন নির্জন বাড়ি যে মনে হয় মন্দাকিনী বেশিদূর এগোতে পারবে না। সামান্য আওয়াজই ভয়ংকর শোনাবে। সে ওই ভানু নামক যুবকের ঘরে তখন পা টিপে টিপে হেঁটে যেতে চায়। অথচ কোথায় কী ভাবে যে কিছু প্রবল বাধা থাকে, ভানুর ইচ্ছে কী, কেন এ—বাড়িতে পড়ে থাকতে ভালোবাসে সব টের পেয়েও মন্দাকিনী জল খায় ঢক ঢক করে। শুনিয়ে শুনিয়ে জল খাচ্ছে। খাবার পর, কিছু সময় পার করে সে অনেকটা খায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বেশ আয়াস ও তৃপ্তির সঙ্গে খায়। যেন জানান দিচ্ছে, হয়ে গেল।

জানালার পর্দা ফেলা। মন্দাকিনী করিডোর ধরে হেঁটে গেল। ভানু মরার মতো চোখ বুজে পড়ে আছে। কে বলবে বাইরের পৃথিবীতে ট্রাম বাস গাড়ি ঘোড়া এবং স্টেশনে বানভাসি জলে মানুষ উঠে আসে? অথবা কোথাও বড় রাজনৈতিক ঝড়, ভিয়েৎনামে অনেক রক্তপাত, লিবিয়া নামক একটা দেশ আছে কে বলবে! এবং বারান্দায় ছায়া ছায়া কিছু নড়ছে। ওদের কোনো কথা হয়নি, ওরা দুজনই একটা বিষয়ে এতদিন পরও ফয়সালা করতে পারেনি, কতটা এগোনো দরকার! একজন পুরুষের সান্নিধ্য উষ্ণতা দেয়, কিন্তু নিকটবর্তী হয়ে প্রপাতের জলে ডুবে যাওয়া এখনও হয়ে ওঠেনি। অথবা তেমন একটা সুযোগ হয়ে উঠছে না। আজ যেন সবাই মিলে একটা সুযোগ করে দিয়েছে দুজনকে। কাকলি চলে গেল। প্রিয়নাথকাকার নাক ডাকছে। এবং বাড়ির রান্নার মেয়েটির কামাই। করিডরে আর পায়ের শব্দও শোনা যাচ্ছে না।

ভানু জোরে হাই তুলল। সে জানান দিল, ঘুম আসছে না।

মন্দাকিনী দেয়ালে ভর করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।

ও—ঘরে প্রিয়নাথের নাক ডাকছে বাঘের মতো। যেন প্রলয়ঙ্কর ঝড়ে পড়ে সব জন্তু জানোয়ার ছুটোছুটি লাগিয়েছে।

ভানু ঘাড় তুলে দেখল পর্দা ফেলা দরজার। নিচে ঠিক রেলিঙের কাছে প্রিয়নাথের বেড়ালটা থাবা চাটছে।

মন্দাকিনীর পা কাঁপছিল। দাঁড়াতে পারবে না মনে হচ্ছে। এ—ভাবে শরীর অসাড় হয়ে যায় কোনোদিন টের পায়নি। এমন একটা দুপুর বিকেলের মাঝামাঝি সময়ে শরীরে এটা যে কী হচ্ছে!

মন্দাকিনী ভাবল ঘরে ঢুকে ঠেলা দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দেবে। কী মানুষ রে বাবা! কিছু বোঝে না। গাছের চারপাশে বেড়া না থাকলে গোরু ছাগল তো খাবেই। মন্দাকিনী নানাভাবে নিজেকে দমন করতে চাইছে।

তখন নিচে বাতাবি লেবু গাছটায় দুটো চড়ুই কিচির মিচির করছে। এবং একটা আর একটাকে তেড়ে যাচ্ছে। প্রকৃতির কূটখেলা পাখি দুটোর ভেতরে জেগে উঠছে। মন্দাকিনী আর সত্যি পারছে না।

সে না পেরে ভাবল, নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়বে। সে উপুড় হয়ে মৃত স্বামীর জন্য কিছুক্ষণ কাঁদবে ভাবল। আশ্চর্য কোনো দুঃখেই সে ব্যথাতুর হতে পারছে না। এমন কেন হয়। সে যেন বলল, ঈশ্বর আমি এটা চাইনে! আমি ভালো থাকতে চাই। কিন্তু শরীরে যেন রক্তপাত হচ্ছে। তারপরই মনে হল এটা পাপ। পাপ পাপ! সে দুবার পাপ কথাটা উচ্চারণ করল। তারপরই মনে হল, সুখ সুখ। সে দুবার সুখ কথাটা উচ্চারণ করল।

তারপরই আবার ভেতর থেকে কে কথা কয়ে উঠল, সুখই পুণ্য। তাকে অবহেলা করতে নেই। সে ফের উচ্চারণ করল, এটাই আমার পাপ, এটাই আমার পুণ্য।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *