মানুষের ঘরবাড়ি (Manusher Ghorbari) – প্রথম খণ্ড – 18
আজকাল জানলায় বসে থাকলে কত কিছু টের পাই। আমার এই ছোট্ট জানলা এখন ভারি প্রিয়। মানুষের বুঝি এমনই হয়। যেখানে নিত্যদিন তার বসবাস, শোওয়া থাকা, এক রকমের অভ্যাসের দাস বলা চলে, আমার মধ্যে সেই দাসত্ব দানা বাঁধছে। সকালবেলা বই খুলে বসি। মাঝে মাঝে চোখ তুলে দেখি—সামনের গাছপালা, রেল-লাইন এবং খড়ের ঘরবাড়ি— সবুজ পাতার গন্ধ পাই। বর্ষার জলভরা মেঘের মতো আমার মনটা কেমন এ-সময় সবুজ ঘ্রাণে ভরে থাকে। বুঝি, শরৎকাল এসে যাচ্ছে। আকাশে কখনও গভীর মেঘমালা, কখনও ঝলমলে রোদ। নিরন্তর পাখিদের ওড়া। নিজের মধ্যে টের পাই এক তরুণ যুবক সে তার আত্মপ্রকাশের জন্য পাগল হয়ে উঠেছে। আমার যেন কিছু আর ভাল লাগে না। কী যে চাই নিজেও বুঝি না। ছোড়দিকে চিঠি লিখতে ইচ্ছে হয়। ছোড়দিকে ছেড়ে এসেছি যেন কতকাল আগে। সেই দুরত্ত বালিকা এখন না জানি কত বড় হয়েছে। এতদিনে মেয়েরা কত বড় হয়ে যেতে পারে আমি যেন অভিজ্ঞতায় আজকাল টের পাই। এ-বাড়ির লক্ষ্মীকে দিয়ে বুঝতে শিখে গেছি, ছোড়দিও আমার মতো জলভরা এক খন্ড মেঘ। যে কোন মুহূর্তে ধারাপাত শুরু হতে পারে। নিজের সঙ্গে ছোড়দির সঙ্গে আমার তখন কথা হয়। কেউ দেখলে টেরই পাবে না ছোড়দি আমার জানলায় দাঁড়িয়ে আছে। কিংবা কোন মাঠে অথবা দামোদরের বালির চরে। আমরা দু’জনে দৌড়াই। চোখ বইয়ের পাতায়, অথচ ভেতরের কি এক গভীর গোপন রহস্য ছোড়দিকে ছুঁতে চায়। সে কেবল বন-বাদাড় পার হয়ে ছোটে। আমার এই অন্যমনস্কতা কেবল লক্ষ্মী টের পায়। সে জলখাবার দিতে এলেই, আমি ঠিক ঠিক পড়ছি কি না বুঝতে পারে। আশ্চর্য এই মেয়েটা! বড় বেশি সচেতন সব কিছু সম্পর্কে। লক্ষ্মীর ভয়ে কেমন জুজু বনে থাকি।
—তুমি ঠাকুর কি ভাবছ?
—কৈ কিছু না তো!
—ঘ্যানর ঘ্যানর করছ। পড়ছ না।
—লক্ষ্মী তুমি পড়ার কিছু বোঝ?
—সব বুঝি। আমি মুখ্য মানুষ বলে মনে কর কিছু বুঝি না!
—তুমি বুঝবে না কেন। তোমার সঙ্গে কথায় আমি পারি?
লক্ষ্মীর সঙ্গে আমার এমন ধরনের কথাই হয়। আজকাল আর আগের মতো এই দেবীস্থানে লক্ষ্মীর মতো আমিও আশ্রিত, মনে থাকে না।
মনে হয় ইহকাল বুঝি আমার এখানেই কেটে যাবে। এ আমার কোনো পান্থনিবাস বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। জানলায় ছোড়দি, পাশের দরজা দিয়ে লক্ষ্মীর যে-কোনো মুহূর্তে প্রবেশ—নিরুপায় হয়ে বলি, ছোড়দি তুমি যাও। আমার পড়ার বিঘ্ন ঘটছে।
বিঘ্ন কথাটাতে কেমন অবাক হয়ে গেলাম। আসলে, ছোড়দির বাড়ির আভিজাত্য বোধহয় আমাকে একটু বেশি সংস্কৃতিবান হতে শেখাচ্ছে। এই জন্য বিঘ্ন কথাটা উচ্চারণ।
ছোড়দি বলল, সাইকেলের পেছনে যাবি না?
—তুমি কবে নিয়ে যাবে বল?
—যেদিন মানুষ হবি।
কেমন যেন বুকের ভেতর একটা দুরুদুরু ভয়। যদি মানুষ না হই। মানুষ হওয়াটা কী! পড়াশুনা করে বড় হওয়া। পুলিশ সাহেব কিংবা ডাক্তার হওয়া। কিংবা এম এ পাস, ফার্স্ট ক্লাস এই সব। বড় চাকরি। কিংবা কোনো আস্তাবল থেকে একটা ঘোড়া বের করে মাঠের উপর দিয়ে ছোটা! কোনো পর্বত সানুতে ছোড়দির হাত ধরে দাঁড়িয়ে বলা, কী এবারে মানুষ হয়েছি! দেখ না। হাত মাথার উপর তুলে বলা, কী দ্যাখ মানুষ সত্যি হয়েছি কি না! ছোড়দির খিলখিল হাসি—তুই বিলু না, তোর না, কিচ্ছু হবে না। আয় জলে সাঁতার কাটি।
পড়ার বইয়ের পাতা খোলা—আমার চোখ বইয়ের পাতায়, বিড়বিড় করে পড়ার অভ্যাস হয়ে গেলে ঠোঁট বোধহয় আপনিই নড়ে। ছোড়দি আর আমি দুজনেই জলে সাঁতার কাটছি—সাঁতার কেটে একটা নদীর পাড়ে উঠে গেছি যেন। সামনে দীর্ঘকায় এক অরণ্য, তার ভেতর মহা অজগর পাক খাচ্ছে। ফোঁসফোঁস করছে। আমাদের টেনে নিতে চায়। ভয়ে ছোড়দিকে জড়িয়ে ধরলে ছোড়দিও আমাকে জড়িয়ে ধরে। এই ভয়টা কীসের? অজগরটা দেখলাম কেন। পড়তে পড়তে এত অন্যমনস্ক হয়ে গেলে আমি মানুষ হব কী করে। ছোড়দিকে বলি, আচ্ছা তুমি আজ যাও। কাল ডাকলে এস। আমি এখন পড়ব।
ছোড়দি বলল, তুই যে বলেছিলি বাড়ি গিয়ে চিঠি দিবি, দিলি না তো?
জান ছোড়দি, রোজই ভাবি একটা চিঠি লিখব। কিন্তু কেন যে পারি না। তোমাকে চিঠিতে কী লিখব ঠিক বুঝতে পারি না।
কেন, লিখবি ছোড়দি তুমি কেমন আছ? তোমাকে খুব মনে পড়ে।
নিজের এই ভাবনাটুকুতেই আমার মধ্যে কেমন বিদ্যুৎ খেলে যায়। এক বালিকা বড় হয়, ছোটে এর মধ্যে আমার যে কী নাড়ির টান। অথচ ছোড়দিকে কিছুতেই চিঠি লেখা হল না। ছোড়দি যদি চিঠি দিত। আর সঙ্গে সঙ্গে মনের মধ্যে কী যে সংকোচ খেলা করে বেড়ায়। ছোড়দি আমার নামে চিঠি লিখলে বাবা মা কী না ভাববে। আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠছে এমনও ভাবতে পারে। আমার যা বয়স তাতে কোনো বালিকার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলে গুরুজনরা কিছু ভাবতে পারে। সবচেয়ে ভয় পিলুকে। বাবা মা পিলু মায়া আর ছোট ভাইটা বাদে আমার সঙ্গে আর কারো কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে সে বিশ্বাসই করতে পারবে না। আর বিশ্বাস করলে ভাববে আমি সংসারের একজন মস্ত বড় বিশ্বাসঘাতক। আমার সঙ্গে পিলু তবে আর কথাই বলবে না। আগে পিওন এলে ভয় করত— ছোড়দি যা একখানা মেয়ে। লিখেই না ফেলে। কীরে চিঠি দিস না কেন। আমার বুঝি ইচ্ছে হয় না তোর চিঠি পাই। ছোড়দির চিঠি পাবার আগ্রহ যতই প্রবল হোক, মাথার উপর গুরুজনদের অস্বস্তির খাঁড়া ঝুলে থাকে বলে, মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকতাম, ভগবান ছোড়দি যেন আমাকে কখনও চিঠি না দেয়। ছোড়দির জন্য টান বাড়ছে কী কমছে বুঝতে পারছি না, লক্ষ্মী ইতিমধ্যে মনের মধ্যে কতকটা জায়গা দখল করে নিয়েছে।
সেদিন লক্ষ্মী আমাদের বাড়ি গিয়ে সব জেনে ফেলেছে। বাবা বলেছে, বিলুটার মতি গতি কখন কী যে হয়!
পিলু বলেছিল, লক্ষ্মীদি জান দাদা বাড়ি থেকে একবার চলে গিয়েছিল।
লক্ষ্মীর স্বভাব, সবার সামনে কথা বললে, আমাকে মাস্টার ডাকে। দেবস্থানে আমি থাকি, সেবাইতের ছেলে আর ভাগ্নেকে পড়াই। দেবস্থানে সেবাইত বদরিদা আর বৌদি ছাড়া সবাই আমাকে মাস্টার ডাকলে, লক্ষ্মী না ডেকে থাকে কী করে? কিন্তু একা পেলেই অন্যরকম। ও ঠাকুর শুনছ, আজ ভাত হবে না। ডাক্তার বলে গেছে, কাল ভাত খাবে। এই নাও বার্লি আর কাগজিলেবু। ঐ খেয়ে পেট ভরে রাখ।
দেবস্থানে আমার উপর এই করে লক্ষ্মীর অধিকার জন্মে গেছে জোর খাটাবার। আগে লক্ষ্মীর চোপার ভয়ে কিছু বলতে পারতাম না, আমার সমবয়সী একটা ঝি মেয়ের চোপা থাকতেই পারে- কিন্তু সঙ্গে টান থাকলে যা হয়। লক্ষ্মীর শাসন দিনকে দিন বাড়ছিল, সেই লক্ষ্মী বাড়ি থেকে সব শুনে এসে আমার সম্পর্কে নতুন একটা ধারণা নিয়ে কেমন কথাবার্তা কম বলছে। লক্ষ্মীর স্বভাবই এমন। সে কখন যে কীভাবে চটে থাকবে বোঝার উপায় নেই। ছোড়দির খবরটা মোটামুটি বাড়িতে গোপনই ছিল। বাবা জানত— কারণ ছোড়দির চিঠি পেয়েই বাবা আমার প্রবাসের ঠিকানাটা জেনে ফেলেন। তিনি নিজে না গেলে আমার বাড়ি ফেরা সহজ হত না। কারণ বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম মানুষ হব বলে। আর যাই করা যাক, বাবার মনমতো গ্যারেজে মেরামতির কাজ শিখলে এতদিনে বাস-ড্রাইভার না হোক কনডাক্টরের কাজটা হয়ে যেত। অভাবী বাবার সন্তান এর চেয়ে বড় কাজ করবে, কে কখন ভাবে! বাবাই বলেছিলেন রহমানদাকে, ছেলেটার পড়ার বাই আছে। বাড়িতেও চায়, কলেজে পড়ুক। কিন্তু…….বলেই থেমে গিয়েছিলেন বাবা।
ছোড়দি তখন দরজায় দাঁড়িয়ে। হাতে শেকল বাঁধা সেই বিশাল কুকুরটা। সাদা ফ্রক গায়। বাবা এয়েছে শুনে, সে স্কুলে যায়নি। বাবাকে দেখে ভারি তাজ্জব। বাবা সুপুরুষ মানুষ। খার কাচা ধুতি পরনে। গায়ে নামাবলী এবং পা খালি। সাদা ধবধবে পৈতা। রহমানদা বাবার পরিচয় পেয়েই ছোড়দিকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কারণ আর যাইহোক রহমানদা তো একজন বামুন মানুষকে আদর আপ্যায়ন করতে পারেন না। ডাক্তারবাবুর মেয়েটির বড় দরকার পড়েছিল তার। আর ডাক্তারবাবুর মেয়েটি ঠিকানা লিখে চিঠি না দিলে এই নিষ্ঠাবান মানুষটির এমন শহরে আসারও প্রয়োজন পড়ত না। বাবার প্রশ্ন ছিল, বালিকাটি কে?
আমি বলেছিলাম, ছোড়দি।
ছোড়দি বলেছিল, আপনি আসুন।
বাবা এক সময় জমিদার বাড়িতে কাজ করতেন বলে জাঁকজমকের কিছু খবর রাখতেন। সুন্দর ছবির মতো বাংলো বাড়িটায় উঠে বাবা আদৌ ঘাবড়ে যান নি। ছোড়দির মার সঙ্গে পরিচয়। একই গোত্রের জেনে তিনি সেখানে আহারও করেছিলেন। ফলে বাবা ছোড়দির খবরটা রাখতেন। কিন্তু বাড়ি এসে কেন জানি বাবা ছোড়দির সম্পর্কে কোনো উচ্চবাচ্য করেন নি। না করাই ভাল। কিন্তু লক্ষ্মী সেদিন গেলে বাবাই বলেছিলেন, ওর ছোড়দির চিঠি না পেলে কে জানত বিলুটা কোথায় আছে।
আর সেই থেকে ছোড়দিকে নিয়ে লক্ষ্মীর খোঁচা মারা কথা।
—হ্যাঁ ঠাকুর, তোমার ছোড়দিটা কে?
—ছোড়দি আবার কে? ছোড়দি।
—ছোড়দি আবার বালিকা হয় নাকি? বয়সে তোমার বড় না?
—আমি বলেছিলাম, না। বড় না। ছোটই হবে।
—তবে ছোড়দি ডাকত কেন?
—রহমানদা ডাকতে বলে।
—রহমানদা কে?
—উনিই আমায় আশ্রয় দিয়েছিলেন।
—ছোড়দি রহমানদার কে হয়?
—ছোড়দির বাবার ড্রাইভার।
—এ ত দেখছি বিশাল কথা গ।
অবাক হলে লক্ষ্মী এভাবেই কথা বলে।
—বিশালই।
—তোমার ছোড়দি কী করে?
—স্কুলে পড়ে।
—দেখতে কেমন?
—খুব সুন্দর।
লক্ষ্মী কেমন মনমরা হয়ে যেত কথাটা শুনে। জানে তার ভাগ্য অন্যরকম। তার বড় আশা শোভা পায় না। ছোট জাতের মেয়ে। দু’দুবার বিয়ে দু-বারই স্বামী হারা। শরীরে ভাল করে বয়স ধরতে না ধরতেই দু-দু’জন মরদ খেলে কে আর সাহস পায়। দেবস্থানে সেই থেকে আশ্রয়। ছোড়দির কথায় ওকে কখনও কেমন ম্রিয়মাণ দেখায়। কখনও ভারি উৎফুল্ল। বলে তোমার কলেজ ছুটি হলে চল না যাই, দেখে আসি ছোড়দিকে।
—সে অনেক দূর লক্ষ্মী।
—কতদূর আর হবে? রেলে চড়ে যাব।
—শুধু রেলে চড়ে যাওয়া যায় না।
আমার এই ঘরটায় দুটো তক্তপোশ মাঝখানে টেবিল— দেয়ালে বড় আয়না। জানালায় আলো বেশি বলে পড়ার সময় টেবিলে বসি না। চেয়ারে আজকাল অধিকাংশ সময় নটু কিংবা পটু বসে। কারণ আমার কাছ থেকে যেমন ওদের এতে দূরত্ব বাড়ে তেমনি মার খাওয়ার সুযোগটাও ওদের কম থাকে। লক্ষ্মীর স্বভাব চেয়ারে পিঠ ভর করে দাঁড়ানোর।
নটু পটু না থাকলেই লক্ষ্মী এ কথা সে কথায় ছোড়দির কথা টেনে আনবে। ছোড়দি দেখতে কেমন এমন প্রশ্নে বার বার নিজের মুখ আয়নায় দেখবে। রাস্তার দিকে মুখ করে পড়তে বসি বলে, লক্ষ্মী বোঝে, আমি কিছু দেখি না। সে তখন পৃথিবীর তাবৎ সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে পাল্লা দিতে চায়। শ্যামলা রঙ। এবং বয়স ধরছে বলে লাবণ্য উপচে পড়ছে। ওর পরনে থাকে কালো পাড়ের এবং সাদা জমিনের শাড়ি।
এই যে বই খুলে বসে আছি, পড়ায় মন দিতে পারছি না, এজন্য কেন জানি লক্ষ্মীর উপর রাগ জন্মাতে থাকল। ছোড়দির প্রসঙ্গ আজকাল এতবার উঠছে যে, আমি নিজেই কেমন অস্থির বোধ করছি। লক্ষ্মী কথা খুঁচিয়ে বের করার কৌশলটাও বড় বেশি আয়ত্তে রেখেছে। না হলে, আমি বলতে যাব কেন, মানুষ হব বলে পলাতকের জীবন বেছে নিয়েছিলাম। অভাবী বাবার পুত্রের দুঃসাহস না থাকলে বড় হওয়া যায় না। কোনও দুঃসাহসে ভর করেই যে গ্যারেজের বড় মিস্ত্রী গোবিন্দদার কৌটা থেকে কুড়ি টাকা চুরি করেছিলাম তাও লক্ষ্মী জেনে নিয়েছে। এও জেনেছে টাকা, মান, যশ হলে সব সুদসহ ফেরত। এতে করে লক্ষ্মী আমার উপর খবরদারি করার আরও যেন বেশি মৌকা পেয়ে গেছিল।
যেমন বলত, আসলে ছোড়দির বড় টান ছিল তোমার জন্য।
—টান মানে লক্ষ্মী?
–ও গো এও বোঝ না। কলেজে পড়ছ কেন? পড়া ছেড়ে দাও না। টান বোঝ না!
-–না বুঝি না। যাও তুমি এখান থেকে।
—না যাব না। ও টান বোঝে না। দাড়ি গোঁফ উঠে গেছে টান বোঝে না।
লক্ষ্মীর সঙ্গে আমি কখনও কথায় পারি না। বলি, ওতো সব সময় ত্রাসের মধ্যে রাখত। পুলিশে দেবে ভয়ও দেখিয়েছিল।
ওটি মুখের কথা গ। তুমি যাতে সেখান থেকে না পালাও সে জন্য ভয় দেখিয়ে রেখেছিল। নালে পয়সা ক’টা ছোড়দির গেলাপজাম পাড়তে গিয়ে হারালে সেই নিয়ে এত কাণ্ড করত না।
এটা ঠিক ছোড়দির সেই শেষ খারাপ আচরণ আমাকে এখন নতুন করে আবার তাড়া করছে। পয়সা ক’টা হারিয়েছি ছোড়দি আমাকে বাগানে দৌড় ঝাঁপ করিয়েছে বলে। গোলাপজাম পাড়তে গাছের ডগায় না উঠলে, কিংবা কখন যে কোথায় রহমানদার দেওয়া হোটেলের পয়সা ক’টা পকেট থেকে পড়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। ছোড়দির মা সব জেনে পয়সা ক’টা আমা ক দিলে খুবই খুশি হয়েছিলাম। ও মা, শেষে কিনা ছোড়দি হাতের উপর হামলে পড়ে পয়সা ক’টা ছিনিয়ে নিল। বলল বিলু, তোমার বাবাকে চিঠি লিখে দেব, তিনি যেন তোমাকে নিয়ে যান।
এখন বুঝতে পারি ছোড়দির কাছে আমার মর্যাদার প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। ছাড়দির মা’র দেওয়া পয়সা ক’টা নিলে আমি খুবই ছোট হয়ে যাব। শুধু আমি না, ছোড়দি নিজে বুঝি। লক্ষ্মী যেন বিষয়টা এতদিন পর ধরিয়ে দিল—আসলে আমি কেমন একখানা মানুষ। এই সব করেই, লক্ষ্মী ছোড়দির ভূত আমার মাথায় আবার চাপিয়ে দিয়েছে; সত্যি তো যে মেয়েটা আমার মর্যাদা নিয়ে এত ভাবত, বলত, বিলু তুমি কলেজে পড়বে, তুমি বড় হবে—কিসের আশায় এ-সব কথা। অথচ সেই ছোড়দি একটা চিঠি দিয়ে জানল না, আমি কী করছি। বোধ হয় ভুলে গেছে, ভাবলেই মনের কষ্টটা বাড়ে।
ক’দিন থেকে ছোড়দিকে একটা চিঠি লিখব ভাবছি। গোপনে লিখতে হবে। ঠিকানা থাকবে এই দেবস্থানের। কিন্তু কোনো খামে চিঠি এলে বদরিদা ভাববেন, কে দিল চিঠি, আমাকে চিঠি লেখার তো কেউ নেই। রেললাইন পার হয়ে বাঁশবনের ভিতরে ঢুকে কিছুটা কারবালার মধ্যে দিয়ে গেলেই আমার বাবার বাড়িঘর। সেখানেই শুধু আমার প্রিয়জনরা থাকে। আর কোনো প্রিয়জন থাকতে পারে বদরিদার মাথায়ই আসবে না। সংগত কারণে তিনি হয়তো প্রশ্ন করবেন, বিলু কার চিঠিরে?
এমন প্রশ্নের উত্তরে সে তো বলতে পারবে না, ছোড়দির চিঠি, যদি বলে ছোড়দিটা কে? হয়ে গেল! গলা কাঠ। আমতা আমতা করে সব যেমন লক্ষ্মীকে বলে ফেলেছি, বদরিদাকেও না আবার বলে ফেলি। তাহলে সব গেল। আশ্রিতজনের এমন বেয়াদপি তিনি সহ্য নাও করতে পারেন। লক্ষ্মীর আর যাই হোক, কোনো কারণে আমি অপদস্থ হই সে তা চায় না। ছোড়দির খবরাখবর ফলে লক্ষ্মী নিজের মধ্যেই গোপন করে রেখেছে।
জানালা পার হলে রাস্তা। নিমগাছের ডালপালা হাওয়ায় দুলছে। শরৎকাল আমার প্রিয় ঋতু বলে মনটা কেমন ভিজে স্যাঁৎস্যাতে থাকে। অল্পতেই সব কিছুতে বড় বেশি মগ্ন হয়ে পড়ি। বইয়ের পাতা উল্টানো আছে। পড়ছি না। গাছের ডালপালাগুলি দেখছি। দুটো ইষ্টিকুটুম পাখি বসে আছে গা লাগিয়ে— বড় নিবিড়ভাবে। ছোড়দিকে নিয়ে এ-ভাবে কোথাও কোনো নদী তীরে আমার আজকাল বসে থাকতে ইচ্ছা হয়। কাশবনে ফুল ফুটতে দেখলে ছোড়দির কথা মনে হয়। রেললাইন ধরে হাঁটার সময় ছোড়দির কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে হয়। যখনই একা থাকি, কিংবা কলেজে যাই মাথার মধ্যে ছোড়দি ভর করে থাকে। পড়তে বসলে জানালায় যেন ছোড়দি এসে দাঁড়িয়ে থাকে। পায়ে কেডস জুতো, বব করা চুল সাদা ফ্রক গায়ে ছোড়দি। যেন নিচে আছে ছোড়দির সাইকেলটা। বের হলেই বলবে, ক্যারিয়ারে বোস। তারপর আশ্চর্য ভঙ্গীতে আমাকে পিছনে নিয়ে উধাও হয়ে যাবে। আমি আজকাল স্বপ্নেও ছোড়দিকে দেখতে পাই। স্বপ্নে ছোড়দি দেখা দিলে কী যে হয় তখন!
ছোড়দির কথা ইদানীং ভুলেই গেছিলাম। লক্ষ্মী আমাদের বাড়ি গিয়ে ছোড়দির খবর না পেলে, এবং রোজ রোজ না খোঁচালে ছোড়দির জন্য এ-ভাবে আকুল হতাম না। লক্ষ্মীই ছোড়দির একটা নতুন পরিচয় প্রকাশ করে আমাকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। এও জানি জীবনেও আর ছোড়দিকে আমার চিঠি লেখা হবে না। বড় হলে স্বাধীন হলে ছোড়দিকে একটা চিঠি দিতে পারি। কিন্তু তা যেন কত দুর ভবিষ্যতের কথা। ততদিনে ছোড়দি আমার কথা ভুলে যাবে। আমার মতো কাঙাল মানুষকে তার মনে রাখার দায় পড়েছে। আসলে ওটা তার করুণা ছাড়া কিছুই ছিল না। সারাদিন না খেয়ে ছিলাম খবর পেয়ে ছোড়দির চোখ চকচক করে উঠেছিল, তা আমি দেখেছি। বেশি খাই বলে রহমানদার অতিথিকে বরাদ্দ পয়সায় খেতে দেয়নি খবরটা পেয়ে ছোড়দি কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেছিল—তাও মনে পড়ে। তবু যেন ছোড়দির পৃথিবীতে আমি সব সময় একজন আগন্তুক। ছোড়দিকে নিয়ে এমন আকুলতা আমার শোভা পায় না। পড়াশোনার ক্ষতি করছি ভেবে আবার পড়ার চেষ্টা করলে দেখলাম মন বসছে না। লক্ষ্মীর উপর কেন জানি আমার ক্ষোভ জন্মাতে থাকল। সব অনিষ্টের মুলে লক্ষ্মী। এখানে আসার পর থেকেই সে আমাকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন মজা আবিষ্কার করতে ভালবাসে। এও তার একটা। আমাকে খুঁচিয়ে দিয়ে মজা দেখছে।
কিছুই ভাল লাগছিল না। বই-টই ফেলে উঠে পড়লাম। জামাটা গায়ে দিয়ে বের হতে যাব, দেখি লক্ষ্মী সামনে হাজির। ওকি এতক্ষণ দরজার ওপাশ থেকে আমার আচরণ লক্ষ্য করে মজা পাচ্ছিল। কারণ এতদিনে ওকে আমার চিনতে বাকি নেই। সে আমার মনের মধ্যে কি গোপন কথা লুকিয়ে থাকে সব ঠিক টের পায়। ওর সঙ্গে আমার কোন কথা বলার ইচ্ছে নেই। দরজা পার হয়ে রাস্তায় নামতে যাব তখন যেন না পেরে লক্ষ্মীর বলা, কলেজ যাবে না ঠাকুর?
–না, যাব না।
—দাঁড়াও বদরিদাকে বলছি।
—কী বলবে?
—বলব, মাস্টার বেড়াতে বের হয়ে গেল।
বদরিদাকে আমি সমীহ করি লক্ষ্মী জানে। যা কিছু ভয় এখন আমার এই মানুষটাকে। লক্ষ্মী তাঁরই কাছে নালিশ দিতে যাচ্ছে। পরীক্ষা পুজোর ছুটি শেষ হলে। এ সময় কলেজ কামাই করলে খুব ক্ষতি। বদরিদা এ-সব বলতে পারেন। এ-বাড়িতে বদরিদার ছেলে এবং ভাগ্নের যেমন আমি গার্জিয়ান, তেমনি বদরিদা আমার গার্জিয়ান। মানুকাকা একদিন এসে বলে গেছে, বিলুটা চাপা স্বভাবের। লক্ষ্য রেখ বদরী।
লক্ষ্মী কী দেখল আমার মুখে সেই জানে। বলল, যা খুশি করগে! আমার কী। তোমার ভালর জন্যই বলা।
—হ্যাঁ ভালর জন্য বলা। তোমাকে আমি চিনি না।
লক্ষ্মী মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বলল, ওমা, এ কি কথা গ। আমি তোমার কী করলাম।
—কিছু কর নি। যাও। দরজা থেকে সরে দাঁড়াও।
লক্ষ্মী সরে দাঁড়াল না। লক্ষ্মীর গোয়ার্তুমি আমি জানি। কিছু বলাও যায় না। আমার সঙ্গে সেদিন বাড়ি যাবে বলে গোঁ ধরল, গিয়ে তবে ছাড়ল। বৌদিকে বলতে গিয়ে উল্টো ঝামেলা—তুই কীবে বিলু। পোড়াকপালী একটা মেয়ে, যার তিনকুলে কেউ নেই—সে তোর মা বাবাকে দেখতে যাবে— তুই নিয়ে যাবি না বলছিস! তুই এত স্বার্থপর বিলু।
বার বার লক্ষ্মীর কাছে হেরে গিয়ে আমার এখন আর কোনো নালিশ জানাতেও ভালো লাগে না। লক্ষ্মীর বিষয়ে আমি পটু নটু এক দলে। নানাভাবে ওর বিরুদ্ধে আমরা সত্যাগ্রহ করে থাকি। কখনও কথা না বলে, কখনও ওর সেবা যত্ন পরিহার করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারা যায় না। বার বার সেই এক হেরে যাওয়া। তার যা করার সে করে। আমরা নিজেরা করে রাখলে সে এক ফাঁকে এসে লণ্ডভণ্ড করে দেবেই। অভিজ্ঞতা থেকে যখন প্রমাণ হয়ে গেছে তখন জোরজার করে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে যে বের হয়ে যাব তারও উপায় নেই। বললাম, আমার কিছু ভাল লাগছে না লক্ষ্মী। সরে দাঁড়াও।
—কেন ভাল লাগছে না জানি।
—তুমি তো বাবাঠাকুর জানবে না কেন?
বাবাঠাকুরের কথা তোলায় লক্ষ্মী জীভ কাটল। কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করল। এ-দেবস্থানে যে মানুষটি কিংবদন্তীর শামিল তাকে নিয়ে ঠাট্টা। যার ঘর মার মন্দিরে। মন্দিরে যিনি থাকেন খান, শোন, যাঁর আশীর্বাদে সবার বেঁচে থাকা তেনার মতো মানুষকে টেনে আনা! লক্ষ্মীর শুধু না, এ- বাড়ির সবার, এমন কী শহরের সব অভিজাত পরিবারগুলো যাঁর শ্রীচরণ অবলম্বন করে বেঁচে আছে, ভূত ভবিষ্যৎ যিনি দেখতে পান চোখ বুজলে তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা। লক্ষ্মী কেমন ত্রাসের মধ্যে পড়ে গেছে মতো বলল, যাও। যা খুশি কর ঠাকুর। তবু বাবাঠাকুরকে টেনে এন না। আমার মাথার দিব্যি রইল।
যেন লক্ষ্মী এই যে আমি বাবাঠাকুরকে নিয়ে বিদ্রুপ করছি এতে আমার অমঙ্গল হতে পারে। সবার জন্য সে করে না। আমার জন্য সে করে। আমার জন্যে তার ভাবনা—এতে আমার না আবার কিছু হয়। ফের বাবাঠাকুরকে নিয়ে কিছু বলব ভয়েই যেন সে দরজা থেকে সরে গেল।
আমার ঘরটা একেবারে বাইরের দিকে বলে কেউ টেরও পাবে না কখন আমি বের হয়ে গেছি।. কোথায় যে যাব তাও জানি না। লক্ষ্মী শুধু দাঁড়িয়ে বলল, আর তোমার ছোড়দিকে নিয়ে খোঁচাব না! ছোড়দির জন্য তোমার এমন মাথা খারাপ হবে যদি আগে জানতাম।
লক্ষ্মী বলে কী! এই বয়সে মেয়েরা মানুষের সব কিছু টের পায় কী করে। আমার সমবয়সী মেয়েটা বুঝল কী করে, সত্যি শরৎকাল এসে যাওয়ায় আমার মধ্যে সেই বিবাগী মানুষটা ছোড়দির কথা ভাবতে ভাবতে উত্তাল হয়ে উঠেছে। তবু গোপন করার জন্য বললাম, তুমি তো দেখছি সব জেনে বসে আছ।
লক্ষ্মী শুধু বলল, তোমাকে আমার চিনতে বাকি নেই মাস্টার।
লক্ষ্মীর এই কথাটা অভিমানের। একা দুজনে কথা বললে, লক্ষ্মী ঠাকুর বলে আমাকে। অভিমান বশে সে আমাকে মাস্টার বলছে। বললাম, যখন চিনেই ফেলেছ তখন আর দরজায় দাঁড়িয়ে কেন। যাও ভিতরে যাও।
লক্ষ্মী আর একটা কথা বলল না। রাস্তায় নেমে মন্দিরের সদর দরজার দিকে চলে গেল। কলেজ যাব না কেন নিজেই বুঝতে পারলাম না। হয়তো রেললাইন ধরে কিছুটা এগিয়ে কাপড়ের কলের সামনে যে আমবাগানটা আছে ওটার পাশে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকতাম। অন্যমনস্কভাবে ঘাসপাতা ছিঁড়তাম। কিংবা ঘাসের উপর শুয়ে পাখি প্রজাপতি দেখতে দেখতে একসময় কলেজে যাওয়া দরকার খুব ভাবতাম। চলে আসতাম ঠিক সময়ে। কেন যে বলে ফেলেছি, কলেজ যাব না। জেদ আমারও কম নয়,যখন বলে ফেলেছি যাব না, তখন কে বাধ্য করে দেখি। কেমন নিজের সঙ্গে নিজের লুকোচুরি খেলা আরম্ভ হয়ে গেল। ছোড়দির কথা ভাবলে এত উদাস হয়ে যাই কেন বুঝতে পারি না।— শরীরের শিরা উপশিরায় বোধহয় এক ঝড় উঠে যায়। মন বিবাগী হয়ে ওঠে। কিছুটা হেঁটে বেড়ানো। শরতের আকাশ কী গভীর নীল। ঘুঘু পাখির ডাক কোন সুদূর থেকে যেন কেবল শুনে যাচ্ছি। মাঠে মাঠে ধান, সবুজের সমারোহ। আমার এই জীবনে সেই সমারোহ উথলে উঠছে বুঝতে পারি। এবং একসময় চুপচাপ গাছের ছায়ায় বসে থাকলে টের পাই, কেউ এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে। তাকিয়ে দেখি সেই চোপাবাজ এবং চঞ্চল মেয়েটা। বলছে, চল ঠাকুর বাড়ি যাবে। তোমার ছোড়দির আমি খোঁজ পেয়ে গেছি। সে তোমাকে দেখবে বলে বসে আছে পড়ার ঘরে।
এমন কথায় বিচলিত হওয়া স্বাভাবিক। আমার সঙ্গে লক্ষ্মী আর যাই করুক কখনও কোন তঞ্চকতা করে না। বললাম, তার মানে?
–মানে সোজা গো। এ বয়সে এমনটা হয়! ভাল লাগা মানুষের জন্য মনে কষ্ট দেখা দেয়।
লক্ষ্মীর এত পাকা পাকা কথা আমার ভাল লাগে না। বলি, তুমি সব সার বুঝে বসে আছ।
এখন চল তো। শহর থেকে রায়বাহাদুর চাটুজ্যে বাবুরা এয়েছেন। বছরে বাবাঠাকুরকে একবার সবাই দর্শন করে যান। তোমার ছোড়দির মতো দেখতে কেউ গিয়ে দেখ এয়েছে।
—ছোড়দির মতো বলছ কেন? ওকে তো তুমি দেখনি…….।
—না দেখলে বুঝি চেনা যায় না! ওঠো না! এ বয়সে সব ছোড়দিরাই সমান। কৌতূহল বাড়ছে। আমার পড়ার ঘরে কেউ বসে আছে তবে। সে কে? আমার সম্পর্কে তারই বা এত কৌতূহল কেন? বললাম, আমার জন্য বসে থাকবে কেন? দেখ অন্য কাউকে খুঁজছে।
—খুঁজলেই হল। আমি বুঝি জানি না। আমি বুঝি কিছু বুঝি না। তোমার ছোড়দির চেয়ে দেখতে খারাপ না! কত বড় মানুষ তেনারা! দুর্গাপূজার সময় কত পাঁঠা বলি হয়। কত লোক খায়। মিমিদি আমার খুব চেনা। নটু পটুর নতুন মাস্টারের কথাতেই লাফিয়ে তোমার ঘরে হাজির।
এ সময়ে আমি ভারি সংকোচে পড়ে যাই। কোনো মেয়ে পড়ার ঘরে আমাকে দেখবে বলে বসে আছে ভাবতেই কেমন ভেতরে রাগ জন্মে যায়। আমাকে দেখার কী আছে। আমি বাঘ না ভাল্লুক। আসলে মানুষ মনে করলে এত সহজে লাফিয়ে কেউ ঘরে ঢুকে যেতে পারে না। এ-ভাবে দেখবে বলে বসে থাকলে কেমন তরলমতি মনে হয় মেয়েদের। আর যাই ভাল লাগুক কোনো তরলমতি বালিকার দর্শনীয় বস্তু আমি হতে চাই না। বললাম, তুমি যাও আমি যাচ্ছি না।
আর ঠিক এ-সময় বাবাঠাকুরের ডাক শুনতে পেলাম। তিনি আমাকে খুঁজছেন। এমন মানুষের ডাক আমি অবহেলা করি সাধ্য কী। ভয় লেগে গেল। বাবাঠাকুর পর্যন্ত আমার ডাক খোঁজ করছেন। সহসা সবাই আমাকে খুঁজতে আরম্ভ করছে কেন? লক্ষ্মীর কোন কূট চাল নয়তো। তিনকুলে মেয়েটার কেউ নেই বলে বাবাঠাকুর লক্ষ্মীকে স্নেহ করেন। আমার কলেজ না যাওয়া, গম্ভীর হয়ে যাওয়া এসব কী লক্ষ্মীকে খুব ভাবিয়ে তুলেছে। সে বাবাঠাকুরকে পর্যন্ত লাগিয়ে এসেছে, দেখগে মাস্টারের কী হয়েছে। সকালে কিছু খায়নি, কলেজে যায়নি, রেলের ধারে চুপচাপ বসে আছে। এ-বয়সটা যে খুব খারাপ লক্ষ্মী নিজের জীবন দিয়ে হয়তো বুঝতে পারে। অগত্যা উঠে দাঁড়ালাম। সাড়া দিলাম, যাই।
তীর্থস্থান বলে শনি মঙ্গলবারে যাত্রীদের ভিড় বেশি। শহর থেকে রিকশায় আসে কেউ, কেউ দূরদেশ থেকে হেঁটে আসে আবার কেউ আসে পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে। ধর্মশালায় দু’চারদিন অনেকে থেকে যায়। নিমগাছটার নিচে বাবাঠাকুর দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে বললেন, বেটা বাঙ্গাল কোথায় গেছিলি!
বিষয়টা বোধহয় লক্ষ্মীরও বোধগম্য হয়নি। বাবাঠাকুর সহসা মাস্টারকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন কেন! তিনি তো খ্যাপা মানুষ। নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলেন। মন্দিরে তাঁর একমাত্র কথা বলার লোক পাথরের ঠাকুর। আর যা কথাবার্তা সে বড় কদাচিৎ। কখনও কোন কারণে রেগে গেলে সবাইকে বাড়ির বার করে দেন। বদরিদা, বৌদি, নটু, পটু, দিদি, ধনুদা ও কার্তিক সবাই তেনার ভয়ে তটস্থ থাকে তখন। গাছতলায় রাত্রিবাস করিয়ে ছাড়ে কখনও। সেই মানুষ মাস্টারকে খুঁজে বেড়ালে আশঙ্কা বৈকি।
বাবাঠাকুরের কৃপা আমার উপরে আছে এমন লক্ষ্মীর ধারণা। আমারও কেন জানি এমন মনে হয়। বাবাঠাকুর আমাকে স্নেহ করেন। মন্দিরে গেলে হাত পাততে বলেন। কখনও সন্দেশ, কখনও শুধু ফুল বেলপাতা—আর মাঝে মাঝে আমার মুখের দিকে কেন যে অপলক চেয়ে থাকেন। লক্ষ্মী দূর থেকে সেটা কখনও লক্ষ্য করে থাকতে পারে। কাছে গেলে লক্ষ্মীই বলল, বাবাঠাকুর, মাস্টারের মন ভাল না।
ধুস ছুঁড়ী। এই মাস্টার এদিকে আয়।
বাবাঠাকুরের পরনে সেই গেরুয়া নেংটি। যেন তিনি কবেই শতবর্ষ পার করে দিয়েছেন। গলায় কাচার মতো উপবীত ঝুলছে। এত যে বয়স হয়েছে, তবু কি সাবলীল হাঁটা চলায়। পড়ার ঘরের পাশে দেখলাম, দু’তিনখানা গাড়ি। বিদেশী আতরের গন্ধ নিমগাছটা পার হতে টের পেলাম। পড়ার ঘরে কেউ যদি সত্যি বসে থাকে। যাবার সময় চোখ তুলে তাকালাম, কিন্তু তক্তপোশের খানিকটা অংশ বাদে আর কিছু চোখে পড়ল না।
বাবাঠাকুর আমাকে বললেন, খুলে দেখ কী আছে?
চাতালে আশ্চর্য সব সুন্দর রমণীরা লাল পেড়ে গরদ পরে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকজন প্রবীণ সুপুরুষ হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে। হাতের আংটি থেকে উজ্জ্বল আলো ঠিকরে পড়ছে। মুহূর্তে যেন চাতালটা কোন এক অন্য গ্রহ হয়ে গেছে। এমন সুন্দর পুরুষ রমণী আমি জীবনেও দেখিনি। কিছুটা হতবুদ্ধি যুবকের মতো দাঁড়িয়েছিলাম। কী যে খুলতে বলছেন বুঝতে পারছি না। বাবাঠাকুর মন্দিরের দরজার দিকে হাত তুলে দেখালেন।
বুঝলাম তিনি মন্দিরের দরজা খুলতে বলছেন। ঠিক দরজা নয়, বরং গ্রিল বলা চলে। চাতাল থেকে দেবী দর্শনে যাতে অসুবিধা না হয় সে-জন্য এ-ভাবে একটা গ্রিল এখানে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। গ্রিলের হুকটা তুলে দরজা খুললে, বাবাঠাকুর বললেন, বোস, আসনে বসে মাকে অন্নদান কর : আজ তোর পালা। ঠাকুরের অনেক খ্যাপামি আমি দেখেছি। কিছু শোনা। হাগা মোতা কাপড়ে দেবীকে বলেন, খা খা। এতে যে মানুষটার একটা বড় বিশ্বাসের জায়গা আছে সহজে ধরতে পারি। না হলে এমন জাগ্রত দেবীর অন্ন ভোগে না কোন মন্ত্রোচ্চারণ, না কোন ফুল, বেলপাতা, শুধু এক কথা খা খা। খা মাগি। সাধারণ মানুষ যে নন তিনি তাঁর কথাবার্তা এবং জাগ্রত দেবীর প্রতি তাঁর আচরণ দেখলেই বোঝা যায় সেটা। কিন্তু তাই বলে আমাকে এর মধ্যে টেনে আনা কেন। পূজা আমি জানি না যে তা নয়। উপনয়নও হয়েছে খুব শৈশবে। বাবা বাড়ি না থাকলে যজনযাজন কখনও কখনও করতেও হয়েছে। কিন্তু এমন জাগ্রত দেবীকে নিয়ে বাবাঠাকুর যা খুশি করতে পারেন, আমি পারি না। কিছুটা ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে সবাইকে দেখতে গিয়ে মনে হল বদরিদা চাতালের থামের আড়াল থেকে আমাকে ইশারায় কিছু বলছেন।
লক্ষ্মী দৌড়ে পাশে দাঁড়িয়ে বলল, যা বলছে, কর মাস্টার।
বুঝতে পারছি, যে কোন কারণেই বাবাঠাকুর খেপে গেছেন। অগত্যা মন্দিরে ঢুকে আসনে বসতে হল। যে সব ভোগ পড়েছে, তাতে ফুল বেলপাতা দিতে হল। সেই অভিজাত পরিবারের পুরুষ নারীদের বাবাঠাকুর নির্দেশ দিলেন, চরণামৃত নিতে। তারা এসে হাঁটু গেড়ে বসল। একে একে সবাই মায়ের আশীর্বাদ ফুল বেলপাতা নেবার শেষ দিকটায় চমকে গেলাম। সেই মেয়েটা। আমার ছোড়দি না। তবে একে দেখলে আমার ছোড়দির কথা মনে হয়। যেন এতদিন পর শাড়ি পরলে এমনই দেখাত। কলেজে যায় আমাদের ইয়ারে পড়ে। বড় মেধাবী ছাত্রী। ছিমছাম লম্বা এবং সাদা জমিনের সিল্ক আর নীল রঙের ব্লাউজ গায়। কোনো দিকে তাকায় না। অভিজাত পরিবারের হলে বোধহয় মেয়েদের কোন দিকে তাকাবার নিয়ম নেই।
কলেজ টাওয়ারের নিচে কতদিন গোপনে মেয়েটাকে দেখেছি। জেলখানার পাঁচিলের পাশে এসে ওর গাড়িটা থামত। গাড়ি থেকে নেমে তারপর কোন দিকে না তাকিয়ে হাঁটা দিত। হাসনুহানা ফুলের গাছটা পার হয়ে সে সিঁড়ি ভাঙত ধীর পায়ে। বুঝতে পারতাম, সব ছেলেদের চোখ তখন ওর দিকে। যে কোনোদিকে তাকায় না সে জানে, সবাই তাকে দেখছে। সুতরাং তার পক্ষে অহংকারী হওয়া মানায়। ওদের পরিবার এই দেবস্থানে আসে, বাবাঠাকুরের প্রসন্নতা লাভে ওদের পরিবার যে ভিক্ষুকের শামিল আগে জানলে আমি লক্ষ্মীর মিমিদির সঙ্গে কলেজেই আলাপ করতাম। কলেজের প্রথম বছরটা কী যে মহার্ঘ ওকে না দেখলে যেন আমরা টের পেতাম না। ওর নামকরণ এত বেশি সংখ্যায় হয়েছে যে আসল নামটা আমাদের কাছে হারিয়ে গিয়েছিল। মিমি হাঁটু মুড়ে হাত পেতে বসে আছে। আমাকে চিনতে না পারারই কথা।
আমিও তাকাচ্ছি না। ছোড়দির জন্য যে আবেগ বোধ করছিলাম মিমির শরীর এবং সুন্দর ভঙ্গী দেখে তার অনেকটা উপশম হয়েছে। আসলে রক্তে নেশা ধরেছে—ভাল জাত হলেই হল। এখন তো শুধু বড় হওয়ার পালা। বড় হতে গেলে চারপাশের গাছপালার মতো চাই কোনো লাবণ্যময়ীর সাহচর্য। ওর শরীরে কোনো সুগন্ধী আঁতরের গন্ধ। সিল্কের ভাঁজ থেকে মনে হচ্ছিল এক্ষুনি সব প্রজাপতিরা উড়ে এসে আমার শরীর ঢেকে দেবে। ফুল বেলপাতা দেবার সময় কী বুঝে তাকাতে গিয়ে দেখলাম মিমি ফিকফিক করে হাসছে। কিছুটা যেন উপহাসের মতো।
বাবাঠাকুরের তখনই বিকট চিৎকার, ও-ভাবে না, ও-ভাবে না। লম্বা হয়ে যা মেয়েছেলে। কচি আছিস, লম্বা হয়ে যা। মাথায় দে। হ্যাঁ হ্যাঁ, পা ধরে বল, ঠাকুর তুমিই আমার সব। বল বল। কিন্তু মিমি কিছুটা গোঁ ধরে আছে যেন! সেই অভিজাত পরিবারের নারী পুরুষ তখন বলছে, মিমি বাবাঠাকুর বললে করতে হয়।
আমি জানি, বাবাঠাকুর আজ আমাকে আসনে বসানোতে মিমির মধ্যে কোনো কৌতূহল দেখা দিয়েছে, আমি একই কলেজে ওর সঙ্গে পড়ি তাও হয়তো লক্ষ্মীর কাছে জেনেছে। কারণ সেতো কাউকে চেনে না, সবাই তাকে চেনে! তা একটা কলেজ ছোকরা এমন জাগ্রত দেবীর হয়ে ফুল বেলপাতা দিচ্ছে, ভাবতে গিয়ে ফিক করে হেসে দিতেই পারে! অপরাধের কিছু না। বাবাঠাকুর বোধহয় লক্ষ্য করে কিছুটা অপমান বোধ করেছেন। তাঁর ইচ্ছেয় খড়কুটোও বাবাঠাকুর, তিনি এই ধারণার বশবর্তী হয়ে আমাকে তাঁর প্রতিভূ ভেবেছেন। আমার হাত থেকে মায়ের আশীর্বাদ গ্রহণের সময় হাল্কা পরিহাসের অর্থই হচ্ছে তাঁকে লঘু করা। যেন এই অপরাধে সংসার রসাতলে যাবে। এখন একমাত্র উপায়, এই প্রতিভূর দু-পায়ে জড়িয়ে ভিক্ষে চাওয়া, ঠাকুর তুমিই আমার সব।
বিদ্যুতের মতো আমার মাথার মধ্যে সব কারণগুলো শিরা উপশিরায় প্রবাহিত হতে থাকলে আমি ভারি বিব্রত বোধ করতে থাকলাম। এবং এ হেন দুরবস্থায় কী যে করি। অভিজাত পুরুষ রমণীরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে। মিমিকে বড় কাতর কণ্ঠে বলছে, ধর মা, বাবাঠাকুরের নির্দেশ অমান্য করতে নেই।
মেয়েটির মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। বদরিদা বৌদি ধনুদা এবং অন্য সব তীর্থযাত্রীরা যেন ভাবছেন, বাবাঠাকুর এ-ভাবে আর কারো উপর করুণা বর্ষণ করেন না। মেয়েটা খেপী। কিছুই বুঝছে না! চোখ স্থির করে বসে আছে। হাসতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত এমন একটা ফ্যাসাদে পড়বে আগে যদি তার এতটুকু সে টের পেত।
মেয়েটির যত না ফ্যাসাদ তার চেয়ে বেশি আমার। ছুটে পালাতে পারলে বাঁচি। বড় বেশি বিব্রত বোধ করছি। বাবাঠাকুরের কাছে এর অর্থ কী দাঁড়ায় আমি ঠিক জানি না, আসলে তিনি হয়তো বিশ্বসংসারের সব কিছুর নিয়ামকের একটা হেতু আমার মধ্যে কিংবা তাঁর মধ্যে খুঁজে পেতে পারেন। জন্ম মৃত্যু আধি ব্যাধি, শোক জরা সব কিছু সেই নিয়ামকের ইচ্ছা অনিচ্ছা, তিনিই মানুষের ঠাকুর কিংবা জাগ্রত দেবী অথবা এক মহিমময় করুণাময় ঈশ্বর! সেই অপার্থিব রোষ থেকে যেন মেয়েটির তরল হাসিজনিত পাপ, বা অবহেলার মুক্তির কথা ভাবছেন বাবাঠাকুর—মিমি তখন সত্যি সত্যি আমার দু-পা জড়িয়ে ধরেছে। আমি ভাবছিলাম—ছিঃ ছিঃ এ কি পাগলের পাল্লায় পড়া গেছে! এমন অপ্রস্তুত হতে হবে জানলে বাবাঠাকুরের ডাকে সাড়াই দিতাম না। তার আগে ছুটে যেদিকে দুচোখ যায় পালাতাম।
তারপর এক সময় সব কেমন নিঝুম হয়ে গেল। আজ বলিদান হয়নি। শনি মঙ্গলবারে এই মন্দিরের চাতালে ছাগশিশুর আর্তনাদ কানে আসবেই। আজ সে সবের কিছু হয় নি। আমার মনে হতে থাকল, বলিদান হয়েছে, তবে সে কোন ছাগশিশুর নয়, এক মানবীর। আমিই সেই নিধনের হোতা। মনটা কুণ্ঠায় কেমন সংকোচিত হয়ে থাকল। দেবীর থান থেকে উঠে কোনদিকে যাব ভাবছিলাম! দেখলাম বাবাঠাকুর পরম নিশ্চিন্তে তাঁর ঘরে দরজা বন্ধ করে একটা কম্বলে শুয়ে আছেন। মাথার কাছে ম্যাকবেথ বইখানা। যা তিনি অনায়াসে অনর্গল আবৃত্তি করতে পারেন। তাঁর কণ্ঠে সেই ইংরেজি শব্দমালা আমি কতদিন গোপনে কান পেতে শুনেছি। উপনিষদের কোন শ্লোক তার ব্যাখ্যা তিনি নিজে একা একা করেন এবং শোনেন। শ্রীশ্রীচণ্ডীর দেবী মাহাত্ম্য বর্ণনার সময় তাঁর দুচোখ বয়ে জল পড়ে। কোমল এক প্রাণ মনে হয় অথবা সেই উচ্চারণ—ফ্রেলটি দাই নেম ইজ ওম্যান যখন বলতে বলতে কেঁপে ওঠেন, তাঁর দিকে তখন ভয়ে তাকানো যায় না। গেরুয়া নেংটি পরা শীর্ণ হাত-পা-ওয়ালা মানুষটার লাল জবাফুলের মতো চোখ দেখলে ভয়ে অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়।
পা টিপে টিপে সিঁড়ি ধরে চাতালে নেমে এলাম। বৌদি চাতালের একটা থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে হাতের ইশারায় আমাকে ডাকছেন। কাছে গেলে বললেন, বাবাঠাকুরের কাছ থেকে রেহাই পেলি!
মাথা ঝাঁকালাম। আমাকে খুব বিমর্ষ দেখে বৌদি বললেন, ভিতরে যা। স্নান টান সেরে খেয়ে নে। তোর দাদা তোকে আবার কেন জানি খুঁজছে। ভিতরে ঢুকতেই দেখলাম, বারান্দার এক পাশে নটু পটু লুডু খেলছে। বাবাঠাকুরের পাল্লায় পড়ে আমি জব্দ হওয়ায় ওরা যেন কিছুটা মনে মনে খুশি। বদরিদার ঘরে ঢুকে দেখলাম সেই অভিজাত পরিবারের সবাই বেশ হাসি গল্পে মশগুল। বাবাঠাকুর প্রসন্ন না হলে তাঁর কৃপালাভ আজ ঘটত না। কতকাল থেকে যেন তারা বাবাঠাকুরের এমন বিচিত্র লীলা দেখার জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করছিল। যাদের প্রতি প্রসন্ন হন, তিনি তাদেরকেই নির্যাতন করেন এমন ধারণা চালু থাকলে আমি আর কী করতে পারি। ওরা আমাকে দেখে বলল, তুমি মিমির সঙ্গে পড়?
—পড়ি ঠিক না, এক কলেজে পড়ি। আমার কমার্স, ওর সাইন্স।
—বাবাঠাকুর দেখছি তোমার ওপর খুব প্রসন্ন
—হবে।
এই সব কথা বলার ফাঁকে মিমিকে আমি খুঁজছিলাম। মেয়েটা কোথায়। এরা এত শিক্ষিত পরিবার অথচ গুরু মহিমা এদের এত কাতর করে রাখে কী করে! মিমিকে না নিয়ে এলেই যেন ভাল করত।
চোখে লম্বা কাজল টানা এবং যাকে নবীনাই বলা যায় আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের বাড়ি এস। বৌটির কপালে বড় সিঁদুরের ফোঁটা। চুল কোঁকড়ানো। এবং ভ্রু জোড়া যেন পাখির ডানার মতো। চোখে আশ্চর্য ধার। মিমির কেউ হয়। যেন এই পরিবারটি বংশের আভিজাত্য রক্ষার নিমিত্ত কোনো এক দূরাতীত গ্রহ থেকে অপ্সরীদের সংগ্রহ করে এনেছে।
বদরিদা বললেন, এই আমাদের বিলু। মাস্টারমশাইর ভাইপো
মানুকাকাকে ওরা চেনে। প্রৌঢ় মতো মানুষটি বললেন, বাবাঠাকুরের খুবই স্নেহভাজন দেখছি। শহরে গেলে আমাদের বাড়িতে এস।
আসলে কী বাবাঠাকুর প্রসন্ন বলে তাঁর আশীর্বাদের ছোঁয়াচ আমার সঙ্গে এই পরিবারে প্রবেশ করবে। যেন বাবাঠাকুরের প্রতিনিধি একজন আমি। আমার সেবাযত্ন করলেই বাবাঠাকুর তৃপ্তি লাভ করবেন এমন ধারণা তাদের হতে পারে। কিছু বললাম না। কারণ যাকে খুঁজছি তাকে দেখতেই পাচ্ছি না। সে কোথায়। আমার এই বয়েসটা বুঝতে শিখিয়েছে, এতে একজন তরুণীর কত বড় অপমান এবং জ্বালা। তার কাছে দাঁড়িয়ে যদি বলি, আমার কিছু করার ছিল না মিমি। আমি নিমিত্ত মাত্র। আমি অভাবী বাবার সন্তান। মানুকাকা এই আশ্রয় ঠিক করে দিয়েছেন। আমার বড় হবার সখ। যেমন তোমাকে দেখলে আমার মনে হয়, আমি ঠিক ঠিক বড় হতে না পারলে তোমার কাছে পৌঁছাতে পারব না। বাবাঠাকুরকে কেউ অমান্য করতে পারে না। তোমাদের মতো পরিবারও না। তোমার যে কী দরকার ছিল ঠোঁট টিপে ফিকফিক করে হাসার।
বারান্দায় বের হলেই দেখলাম কার্তিক মামার বৌ রান্নাবাড়ির দিকে যাচ্ছে। কার্তিক মামা মামীর পেছনে যাচ্ছিল, বলিদানের সময় তার অন্য মেজাজ। এ কাজটি এ তীর্থস্থানে পাকাপাকিভাবে সে হাতে নিয়েছে। আজ তার কাজটা ছিল না এবং আমাকে নিয়ে আজ বাবাঠাকুর লীলা করেছেন জেনে, মামীর সঙ্গে অনুসরণ করা অনুচিত ভাবল। ঘুরে দেখল আমাকে। চোখ ট্যারা বলে বোঝা যায় না কোন দিকে তাকিয়ে আছে। আন্দাজে ধরে নিতে হয় আমাকেই বলছে, কী মামা আজ বাবা খুব নাকি খেপে গেছিল!
আমি বললাম, আর বলবেন না, কী ঝামেলা বলুন তো!
—আরে ঝামেলার কী হল। মার থানে কী কখন লীলা কেউ বলতে পারে! আমার দাদুর কথা জান?
দাদুটা কে বুঝতে পারলাম না। চোখমুখ দেখে ধরতে পেরে বলল, আরে বদরিদার বাবা। সিদ্ধাই মানুষ-কাপালিক। শব সাধনা করতেন। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। তান্ত্রিক মানুষ। তাকে দেখলে তো তুমি ভিরমি খেতে। বদরিদার মাথার কাছে যে মানুষটির ছবি আছে তিনিই এই শর্মার দাদু। তা দেখলে ভয় পাবার মতো। হাতে চিমটা, ত্রিশূল এবং কমণ্ডলু। কম্বল গায়ে বাঘের ছালে মানুষটা ঢাকা।
কার্তিক বলল, দাদুর দেহত্যাগের পর এল নরেন খ্যাপা। বাবাঠাকুরের অলৌকিক এবং বিভূতির কিছু খবর আমি আগেই পেয়ে গেছি—এখন কার্তিক মামা আবার নতুন কিছু খবর দেয় কিনা জানার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। অথবা সে কী বলতে চায় জানারও আগ্রহ।
তোমার কপাল খুলে গেল—থানে বসার মানুষ তুমি। বাবাঠাকুর তাঁর কাজটা তোমাকে দিয়ে যেতে চান। তুমি কিন্তু মামা, তন্ত্রমন্ত্র সব ভাল করে জেনে নেবে। বাবাঠাকুরের কাছে অনেক গূঢ় সিদ্ধাই আছে। অবহেলা কর না।
কথাটাতে আমি আরও ঘাবড়ে গেলাম। এখানে আশ্রয় নিয়ে আছি, কলেজে পড়ি, নটু পটুকে পড়াই। আমার ছোড়দিরা চারপাশে বড় হচ্ছে, কত আমার স্বপ্ন সামনে—আর কিনা বাবাঠাকুর গত হলে আমাকে বসিয়ে দিতে চায়।
বাবাঠাকুর মনে মনে এসব ভাবছে তবে! আমি বললাম, তুমি যে কি না, এ-সব আমি করবই না।
—এই চুপ। এ-ভাবে বলো না। বাবাঠাকুর শুনতে পেলে আবার খেপে যাবে। শেষে বিলের জলে নামিয়ে দেবে সবাইকে!
এ-সব খবর আমার জানা, আমি এখানে আসার মাসখানেক আগে বাবাঠাকুর সহসা ক্ষিপ্ত। ঠিক সহসা বলা যায় না। রাতে শিবাভোগের সময়, দুটো সাদা শেয়াল ঝিলের ধারে রোজ ডাকলেই ভোগ খেতে আসে। হাতে কলাপাতা, কাচা মাংস আর দুধ। এই দিয়ে শিবাভোগ। ঝড় তুফান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা বন্যা যাই এই ইহসংসারকে গ্রাস করুক না কেন, নিশীথে শিবাভোগ তিনি সেই প্রাচীন অশ্বত্থের নিচে ঝিলের পাড়ে দিতে যাবেনই। আর ঝড় জল প্রাকৃতিক দুর্যোগ যাই থাকুক না, সেই শিবাভোগে যে দুটি প্রাণী রোজ আসে আমন্ত্রণ রক্ষা করতে তারা আসবেই। না এলেই ব্যাস — কোথাও কিছু ত্রুটি ঘটে গেছে। বাবাঠাকুর তখন সেবাইত বদরিদার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। সেবাইতের মনে কোন পাপ ঢুকেছে হয়তো ভাবেন। সে-কারণে সে-রাতে প্রাণী দুটো ভোগ খেতে না আসায় রাতের দ্বিপ্রহরে সবাইকে বলেছিলেন, এখনই গৃহত্যাগ! বাবাঠাকুরের উপর কোনো অলৌকিক প্রবাহ তবে ছুঁড়ে দিচ্ছে কেউ। তারই নির্দেশে তিনি সবাইকে এই শীতের রাতে গৃহত্যাগ করতে বলছেন। মন্দির এবং পাশের সংলগ্ন কোঠাবাড়ি থেকে সবাইকে বের করে নিয়ে ঝিলের ঘাটে গিয়েছিলেন। সারারাত গলা পর্যন্ত জলে ডুবিয়ে রেখেছিলেন সব কজনকে, শিবাভোগে ত্রুটি ঘটায় সংসারের উপর যে রোষ নেমে আসার কথা ছিল, এই করে তা থেকে বাবাঠাকুর নিষ্কৃতির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন বদরিদা এবং তাঁর পরিবার পরিজনদের।
কার্তিক মামা দেখছি আগের চেয়ে একটু বেশি সমীহ করতে শুরু করেছেন আমাকে। মার থানে আমিই ভাবি পুরোহিত। কুলীন বামুন, তার উপর আমার নিষ্ঠাবান পিতার খবর এ-বাড়িতে আগেই পৌঁছে গেছে। যাজনে এত পটু যার বাবা তার পক্ষে কালীবাড়ির পুরোহিত হওয়া খুব স্বাভাবিক এবং গর্বের বস্তু। লক্ষ্মীকেও দেখছি আগের মতো তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে না। বৌদির সেবাযত্ন আমার প্রতি এমনিতেই একটু বেশিমাত্রায় ছিল—এই ঘটনার পর কথাবার্তায় যেন তার শ্রদ্ধার ভাব এসে গেছে। এ-সব কারণে আমি আরও সংকোচের মধ্যে পড়ে গেলাম। আমাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে ঠিক আবার পলাতক হব—কে আমাকে একটা মন্দিরে পুরোহিত বানায় দেখব। সাধ্য কি— কিন্তু যেটা এর চেয়ে দুঃখের, তা হচ্ছে মিমির অবমাননা। মিমির নরম হাত, কী সরু আর লম্বা চাঁপাফুলের মতো, হাতে হীরের আংটি, যেন পদ্মকলিতে কোন রুপোলি ভ্রমর এসে উড়ে বসেছে। মেয়েটাকে খুঁজছি মনে মনে।
গাড়ি দুটো আমার পড়ার ঘরের পাশে ঠিক আছে। ওরা ভোগের প্রসাদ খেয়ে তবে যাবে। বদরিদার ঘরে সবাই বসে আছে। বদরিদা ওদের একটু বেশিই খাতির যত্ন করছেন। চা আসছে, মন্দির থেকে সন্দেশ আসছে এবং বাবাঠাকুর এত প্রসন্ন হওয়ায় কপালে যার যা দুশ্চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছিল সব মুছে গেছে। ওরা কথায় কথায় হা হা করে হাসতেও পারছে।
শুধু এ তীর্থস্থানে বোধ হয় একজন তার অবমাননায় হাসতে পারছে না। সমবয়সী একটা ছোঁড়ার পা ধরে, তুমিই আমার সব ঠাকুর বলার পর সে উধাও। এই মেয়ে পড়ার ঘরে গিয়ে বসেছিল, আমাকে নিয়ে কিঞ্চিৎ মজা উপভোগ করবে বলে বোধ হয়। নাহলে আর কী কারণ থাকতে পারে- আগে বুঝতে পারি নি, দেখার পর বুঝেছি, যে মেয়ের গুমর এত, কলেজে কারো দিকে চোখ তুলে তাকায় না সেই মেয়ের তার কলেজের এক আশ্রিত ছাত্রকে দেখার জন্য এত কৌতূহল। মনে মনে ভাবলাম, বেশ হয়েছে, এখন বোঝ— তারপরই আর এক দুর্বলতা এসে গ্রাস করতে থাকল। বাবাঠাকুর সিদ্ধ পুরুষ। অন্তর্যামী। তিনি বোধ হয় আগেই টের পেয়ে গেছিলেন, তার বিলুকে নিয়ে মজা করার জন্য রায়বাহাদুরের নাতনি পড়ার ঘরে ঢুকে বসে আছে। রায়বাহাদুরের নাতনি বলেই তুমি সবাইকে অবজ্ঞা করতে পার না।
মিমি কোথায় আছে কাউকে বলতেও পারছি না। তোমার ছোকরা এমন রূপসীকে খুঁজে বেড়ানো কেন? মনে মনে খোঁজা। নটুকে একবার দেখলাম দৌড়ে মন্দিরের চত্বরের দিকে গেল। তাকে বললে হয়, এই নটু জানিস, মিমি কোথায়। মাস্টারমশাই আমাকে ডাকছেন? আমার বয়স আর ওদের বয়সের তফাত পাঁচ সাত বছরের। কিন্তু এঁড়ে বাছুরের মতো গুঁতাতে এখনই এরা শিখে গেছে। অকালপক্ব। আমার খোঁজাখুঁজির মধ্যে যদি কোন দুর্বলতা আছে টের পায়। ধুস্ মরুকগে। দরকার নেই। পড়ার ঘরে গিয়ে লম্বা হয়ে পড়ে থাকাই ভাল। না হয় স্নান-টান সেরে ফেলি। এক সঙ্গে পাত পড়বে লম্বা বারান্দায়। রায়বাহাদুর আর তার পরিবারবর্গের সঙ্গে এক সঙ্গে ভোজন। বৌদিও দু-বার তাড়া দিয়েছেন, এই বিলু স্নান করে নে। কলেজে গেলি না, তোর দাদার সঙ্গে খেতে বসবি।
আর আশ্চর্য মন্দির থেকে বের হয়ে লক্ষ্মীকেও দেখছি না। লক্ষ্মী আর মিমি কী তবে বাগানের দিকে গেছে। যাওয়া ঠিক হবে না—তবু টানে। দু’জন দু’রকমের। দুই মেরুর। একটা জায়গায় বোধ হয় ওরা এখন সমব্যথী। একজন অনাথ, অন্যজন আর এক অনাথের কৃপালাভে পা জড়িয়ে ধরেছে। তবে তুমিও অনাথ! এ-সব হিজিবিজি চিন্তা মাথায় খেলা করলে দেখতে পেলাম ওরা দু’জনেই খিড়কি দরজা দিয়ে হা হা করে হাসতে হাসতে ছুটে আসছে। সব ভেস্তে গেল। পায়ে ধরে বলাটাও যেন এক মজা। আমাকে দেখে গুম মেরে গেল। বাবাঠাকুরের চর সামনে।
হঠাৎ আমার মাথায় রাগ চড়ে গেল। রাগ চড়ে গেলেও নিজের সম্পর্কে সচেতন বলে, রাগ সামলেই কথা বলতে হল। ডাকলাম, এই লক্ষ্মী শোন।
লক্ষ্মী থামলে মিমি দাঁড়াবে। আসলে যতই মাথা গরম হয়ে থাক, মিমিকে আমি সম্বোধন করতে পারি না। কারণ কলেজে যে মেয়ে উর্বশীর মতো ঘুরে বেড়ায় তাকে একজন বাউণ্ডুলে বাবার সন্তান নাম ধরে ডাকতে পারে না।
মিমি আর লক্ষ্মী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। দু’জনের চোখেই কৌতূহল—আমি কী বলব শোনার জন্য।
লক্ষ্মীকে বললাম, দেখ লক্ষ্মী তোমাদের মিমিকে বলে দিও আমি বাঘও নই, ভাল্লুকও নই। লক্ষ্মী স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে বলল, ওমা এ কি কথা মাস্টার। তোমাকে বাঘ ভাল্লুক আমরা ভাবব কেন?
আসলে আমি বলতে চেয়েছিলাম, আমার কোন দোষ নেই মিমি। বাবাঠাকুর বললে কী করি তাই পা দুটো বাড়িয়ে না দিয়ে পারি নি।
মিমি এবার বেশ কিছুক্ষণ আঁচলে শরীর ঢেকে দাঁড়াল। বলল, আপনি আমাদের কলেজে পড়েন?
–পড়ি।
—কোন ইয়ার?
—সেকেণ্ড ইয়ার।
–মিছে কথা, কখনও তো দেখিনি।
—আপনি তো কাউকে দেখেন না।
—সবাইকে দেখি। সবাই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে না দেখে উপায় আছে।
তাহলে মিমি সব দেখে। শুধু আমাকে দেখেনি। সাহসই হয়নি কখনও মিমির কাছে যাবার। দূর থেকে দেখলে, মিমি তাকে লক্ষ্য করবে কী করে, কিন্তু আসল কথাটা যে বলা হল না।– মিমি বুঝলে। ঢোক গিললাম।
লক্ষ্মী কেমন মাষ্টারী গলায় বলল, বলেই ফেল না। ঢোক গিলছ কেন?
মিমির চোখ দুটো আরও বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে। সেই দুষ্টু হাসি ঠোটে। আমাকে দেখলে এ- ভাবে হাসে কেন? আমি যে গোবিন্দদার কাছ থেকে টাকা নিয়ে পলাতক হয়েছিলাম, সে কথা কি লক্ষ্মী বলে দিয়েছে। ছোড়দি যে আমাকে সাইকেলের পেছনে চড়িয়ে দামোদরের বালিয়াড়িতে নিয়ে যেত তার কথাওকি….? যে ছেলে একটা মেয়ের সাইকেলের ক্যারিয়ারে উঠে হাওয়া খেতে যায়, সে আবার পুরুষ মানুষ কী করে! এই অবজ্ঞা থেকেই হাসি। অমাদের দারিদ্র্যের কথাও জানতে পারে। মিমিকে কিছু বলার অর্থই হচ্ছে, আমার অধিকার সম্পর্কে আমি ঠিক সচেতন নই। কিছুটা ক্ষমা চাওয়ার মতো ব্যাপার। পায়ে ধরে তুমি আমার সব ঠাকুর বলার সময় মুহূর্তে যে বিষণ্ণতা জেগে উঠেছিল চোখে, মন্দির থেকে বের হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তা শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলেছে দেখছি। একজন খ্যাপা মানুষ দাদুর গুরুদেব, তার ইচ্ছে অনিচ্ছেতে দাদু ভয় পেলেও মিমি পায় না। দাদু ছোট না হয়ে যায় ভয়েই মিমি আমার চরণ দুখানি ধরে সবার সমানে নাটক করেছিল।
আমার আর কথা বলার সাহস থাকল না। ভারি বিব্রত বোধ করতে থাকলাম। কেন যে কথা বলতে গেলাম। মেয়েদের সম্পর্কে আমার একটা ভয় কিংবা সংকোচ এমনিতেই এত প্রবল যে যা কিছু ইচ্ছে গোপনে। প্রকাশ করার ক্ষমতা কম। মিমি তখন যেন না বলে পারল না, কী চলে যাচ্ছেন।
—স্নান করতে যাব।
— কিছু বললেন না যে।
—না মানে।
আপনি ধন মান যশ হলে সবাইকে নাকি আবার সব ফিরিয়ে দেবেন।
লক্ষ্মী সাহসা কেমন ঠেলা দিয়ে বলল, এই মিমিদি….
লক্ষ্মী এই প্রথম আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল। সমবয়সী বলে আমার সব কথা মিমিকে বলে দেওয়া ঠিক হয়নি। আমি গুম মেরে গেলাম। চলে যাচ্ছিলাম, মিমি ডাকল, শুনুন। যেন আদেশ। আমাকে ফিরে দাঁড়াতেই হবে।
মেয়েরা ডাকলে আমি চলে যেতে পারি না। খিড়কি দরজার দিটায় তখন কেউ নেই। আমরা তিনজন। লক্ষ্মী যেন আমাকে দেখছে না। মন্দিরের গায়ের কারুকার্য দেখছে এমন চোখে তাকিয়ে আছে। এতক্ষণ এরা তবে বাগানে বসে বসে আমাকে নিয়েই কথা বলেছে। লক্ষ্মী কাজটা ভাল করেনি। পিলুর কথাও বলে দিতে পারে—আমরা দেশ ছাড়া এবং উদ্বাস্তু এসবও বলে দিতে পারে। লক্ষ্মী তো আমাদের বাড়ি গিয়ে সবই দেখে এসেছে। কত গরীব আমরা মিমি টের পেয়ে গেছে।
আমরা খুব গরীব। এ-কথা টের পেলে আমি বড় ছোট হয়ে যাই। বাবার বিচিত্র খেয়ালের কথাও বলে দিতে পারে। অভিজাত পরিবার বিষয়টা কি আমার জানা হয়ে গেছে। ছোড়দির বাড়িতে তা টের পেয়েছি। দেশে বাবার জমিদার দীনেশবাবুর বাড়ি গেলে তা টের পেয়েছি। যেন ওরা মানুষ না। অন্য গ্রহের দেবদেবী। আমাদের কুঁড়েঘরে নিজেদের থাকবারই জায়গা হয় না, তার মধ্যে আবার শংকরাকে ডাকা। বাড়িতে এক পাল বেড়াল, হাঁস কবুতর একটা হনু পর্যন্ত পিলুর কৃপায় আশ্রয় লাভ করেছে। লক্ষ্মী সব বলে দিলে আমরা যে একটা মজার দেশের মানুষ মিমি ভাবতেই পারে। এখন যত রাগ গিয়ে আমার কেন জানি লক্ষ্মীর উপর পড়ল। কিছু বলারও উপায় নেই। নালিশ দিলে বদরিদা বলবেন, বিলু। লক্ষ্মীর সঙ্গে তোদের বনে না কেন বুঝি না। ও তোদের জন্য এত করে আর তোরা ওর পেছনে লাগলে খাপ্পা হবে না। তোদের অর্থে, আমি নটু পটু।
এ দেশের মানুষেরা উদ্বাস্তুদের যে কত করুণার চোখে দেখে! আমি যখন উদ্বাস্তু আর মিমি যখন তা টেরই পেয়ে গেছে তখন আর ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। বরং আমার বাবাঠাকুর সাজার বিষয়টা নিয়ে মিমি এখন কী বলে সেটা শোনাই ভাল।
মিমি সেদিকটায় একেবারেই গেল না। শুধু বলল, মাস্টার তোমার বাড়ি আমাকে নিয়ে যাবে?
আপনি থেকে তুমি! লক্ষ্মী বাগানে বসে ঠিক সারাক্ষণ মাস্টার মাস্টার করেছিল, সব ধরে ফেলেছে।
—আমার বাড়ি কেন?
—বেড়াতে যাব।
—না না আপনি আমাদের বাড়ি বেড়াতে যাবেন কেন?
—বেড়াতে গেলে দোষের কিছু আছে?
—না, দোষের হবে কেন।
লক্ষ্মী টানতে থাকল মিমির হাত ধরে। চল মিমিদি। বলেছিলাম না, মাস্টার স্বার্থপর। ছোট ভাইটাকে পর্যন্ত এখানে দুরদার করে। আমি তো জোরজার করে গেছিলাম। তোমাকে যেতে হলে জোরজার করে যেতে হবে।
—তাই যাব ভাবছি। মিমি শুধু এইটুকু বলেই চলে যাচ্ছিল। আমি তাড়াতাড়ি পিছু পিছু এগিয়ে গেলাম।—আমাদের বাড়ি আপনি যাবেন কেন? বন জঙ্গলের মধ্যে বাড়ি। ঢোকাও যায় না।
—তোমরা ঢোক কী করে!
—অভ্যাস হয়ে গেছে। আপনাকে আমি নিয়ে যাব না। মনে মনে বললাম, মজা পেয়েছ না? বাড়ি গিয়ে দেখবে, মা হয়ত বাবার সঙ্গে ঝগড়া করছে। পিলু হয়তো খালি গায়ে এক বোঝা ঘাস নিয়ে ঢুকছে বাড়িতে। বাবা তখন হয়ত হাঁটুর কাপড় তুলে নিশ্চিন্তে হুকা খাচ্ছেন। মায়া হয়তো হনুটাকে কাঁধে নিয়ে দুলে দুলে পড়ছে। ঘরের মধ্যে একটা তক্তপোশ নেই। বাঁশের মাচান। বারান্দায় একটা চেয়ার নেই, মাদুর পাতা। রান্নাঘর বলতে শণ দিয়ে ছাওয়া ঝাঁপের বেড়া। হয়তো বাবা গামছা পরে স্নানে যাবার আগে পোষা কুকুরটার এঁটুলি বাছছেন। মানুষের চেয়ে জীবজন্তুর প্রতি সেবাযত্ন লক্ষ্য করলেই ধরতে পারবে অবস্থা বিপাকে আমরা কোথায় এসে পৌঁছেছি। ও সব দেখে তুমি মজা পাও সে হতে দেব কেন। শুধু মজা, কলেজের আর মেয়েরা, শুনে আমার দিকে ঠিক যাবার সময় চোখ তুলে তাকাবে। তাকালেই বুঝতে পারব ওরাও জেনে গেছে। তুমি শ্রীময়ী কলেজে এত অহংকারী এখানে এসে এত মুখরা হয়ে উঠলে কী করে? বাবা বলেন, স্ত্রীজাতি যা দেবী সর্বভূতেষু — তোমরা কখন যে কী যদি ঈশ্বর বুঝতে পারতেন।
মিমি আমাকে চুপচাপ থাকতে দেখে বলল, শোনো মাস্টার তুমি নিয়ে না যাও, আমি লক্ষ্মীকে নিয়ে যাব!
—লক্ষ্মী আমার সঙ্গে একবার গেছে। আর একবার গেলে এমন বনজঙ্গলে ঢুকে যাবে, যে সে আবার নবমী বুড়ি না হয়ে যায়।
—নবমী বুড়ি মানে?
—লক্ষ্মী জানে।
নবমী বুড়ির কথায় মিমি বোধহয় কিছুটা ঘাবড়ে গেল।
লক্ষ্মীর দিকে তাকিয়ে বলল, নবমী বুড়িটা কেরে?
—আরে মাস্টারের বাড়ি যাবার পথে জলে পড়ে।
—তুমি বল লক্ষ্মী কী গভীর বনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়।
—না মিমিদি, সুন্দর রাস্তা। একবার গেলে তোমার কতদিন যে রাস্তাটার কথা মনে থাকবে। বড় বড় গাছের ছায়া, কত রকমের পাখি, দু’পাশের ঝোপ জঙ্গলে কত অচেনা ফুল।
ভীষণ রেগে গিয়ে বললাম, কবি হয়ে গেলে দেখছি।
–কবি মানে? লক্ষ্মী মিমির দিকে তাকিয়ে বলল, কবি কিগো মিমিদি!
—তুমি নিজেই কবি মাস্টার। ভীতু মানুষেরা কবি হয় জান। নারীর স্বভাবসুলভ সেই এক মুখ ঝামটা মিমির।
—আমি ভীতু মানুষ!
—তা ছাড়া কী।
যাই হোক আর যাওয়ার কথা উঠছে না বলে নিশ্চিন্ত। এবারে কেটে পড়লে হয়। বৌদি এসে এমন নিরিবিলি জায়গায় দুটো মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি দেখলে খারাপ ভাবতে পারেন। পা বাড়াতেই আবার ডাক, বাবাঠাকুর আমরা কিন্তু যাব।
মিমির কাছে বাবাঠাকুর হয়ে গেলাম! আমাকে পায়ে ধরার সময় ঠাকুর বলেছিল। ঠাকুর না বাবাঠাকুর! আমি কিঞ্চিৎ বিভ্রমে পড়ে গেলাম। তাকালাম না। চলে যাওয়াই শ্রেয়। এখন দরকার আমার লক্ষ্মীকে একা পাওয়ার। রাত দশটা এগারটা নাগাদ পাওয়া যাবে। সে তখন আমার নটু পটুর বিছানা করতে আসে পড়ার ঘরে। নটু পটুকে সঙ্গে নিয়ে লাগতে হবে। তুমি শেষ পর্যন্ত আমার পেছনে এতটা লেগছে। রায়বাহাদুরের নাতনিকে লেলিয়ে দিয়েছ। কলেজের দেখা আর এখানে দেখা একেবারে আলাদা রকমের। কত সম্মান দিতাম, কত মহিমময়ী ভাবতাম, দেবী মনে হত, শাড়ির খসখস শব্দ শুনলে বুকের ভেতরটা কেমন করত। এখন দেখছি, তুমি আর লক্ষ্মী একরকমের। আমার পেছনে লেগে মজা খুঁজে বেড়াও। আমি তোমাদের কাছে বাবাঠাকুর!
—দেখুন আমাকে বাবাঠাকুর ডাকবেন না। আমি বিলু। কর্মাস নিয়ে পড়ি। কম্পার্টমেন্টালে পাস। বাবার কথায় দশটা বিষয়ের মধ্যে নটাতে পাস। জীবনে কে কবে সব বিষয়ে পাস করে। অবশ্য এ-সবই মনে মনে। যা বললাম, তা অন্যরকম।—বাবাঠাকুর হতে যাব কেন। বাবাঠাকুর নরেন খ্যাপা। তার ভক্ত আপনার পিতামহ।
—হাঁ মাস্টার, তুমি বাবাঠাকুর তবে! লক্ষ্মী গলা উঁচিয়ে কথাটা বলল।
—না, আমি বাবাঠাকুর না।
মিমি বলল, বাবাঠাকুর দ্য সেকেণ্ড।
ইস কেন যে সাড়া দিয়েছিলাম বাবাঠাকুরের ডাকে। তাঁর কাছে শরীর পবিত্র অপবিত্র বলে কিছু নেই। মানুষের মন পবিত্র থাকলে সে সব সময় পবিত্র হাগামোতা কাপড়ে পূজা আটকায় না। স্নান না করেও মায়ের মন্দিরে ঢোকা যায়। পূজা দেওয়া যায়। আমি শুধু তাঁর আজ্ঞা শিরোধার্য করেছি। আমি বাবাঠাকুর দ্য সেকেণ্ড হতে যাব কেন। আসলে মিমি তাঁর অপমানের জ্বালা এভাবে মেটাতে চায়। মিমির এই ব্যবহারে নারী জাতির উপর ভারি বিদ্বেষ জন্মাল। ছোড়দির জন্য যে ভাবালুতায় ভুগছিলাম তাও কেটে গেল। অবশ্য আমার মা’র অভাবে অনটনে যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তি রূপেন সংস্থিতার চেহারাটা জীবনে বার বার দেখা। দেখা সত্ত্বেও, একা থাকলেই কোনো ফুলের উপত্যকায় এক তরুণী কেবল দৌড়ায় এমন একটা ছবি মাথার মধ্যে কে যে গুঁজে দিয়ে যায়। আর এটা থাকে বলেই পড়ার প্রতি আগ্রহ জন্মাচ্ছে। এটা আছে বলেই বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখি। না হলে যেন সব ফাঁকা মাঠ, জীবন মৃত বৃক্ষের মতো। আবার সেই ধন মান যশের কথা মনে উঁকি দিল। ও-সব হলে কেউ আর মজা করতে পারবে না। তখন গাড়ি থেকে নেমে এ-শর্মার গলায় মালা দেবার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। এবং এ-ভাবে কোনো এক উঁচু মঞ্চ থেকে আমি জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেই, কখনও নিমগ্ন থাকি বই লেখায়, কখনও কবি হয়ে যাই। অথবা শিল্পী, ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি-আয়ে না বালম—যা কিছু আমার নাগালের বাইরে সেই সব স্বপ্নে মনটা বিভোর হয়ে থাকে।
এদের সঙ্গে কথায় পারব না। মেয়েদের সঙ্গে আমি ঠিক গুছিয়ে কথাও বলতে পারি না। আমার দৃঢ়তা কম। আমার মধ্যে নারীজাতির জন্য দুর্বলতাই বেশি। সব সুন্দরী কিশোরীকেই মনে হয় এদের ছুঁতে পারলেও পবিত্র হওয়া যায়। ছোড়দি নীল রঙের গাড়িতে যখন স্কুলে যেত, আমি রোয়াকে বসে দেখতাম। এই দেখার মধ্যে এক সৌন্দর্য আবিষ্কারের নেশা ছিল, তার পায়ে সাদা কেডস, সাদা মোজা, বব করা চুল রেশমের মতো, যেন আমার সামনে আস্ত তাজা ফুল হয়ে ফুটে থাকত। এ- সৌন্দর্যবোধ কোথায় রাখি। সৌন্দর্যবোধই আমাকে বড় বিপাকে ফেলে দেয়। কলেজে এই মিমিকেও সেই এক সৌন্দর্যবোধ থেকে আবিষ্কার। এখন দেখছি কত নিষ্ঠুর হতে পারে মিমি। সে আমাকে জব্দ করার জন্য বাড়ি পর্যন্ত যেতে চায়। বংশ যার এত দীন হীন তার আবার বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখা কেন? বাবাঠাকুর দ্য সেকেণ্ড বলায় এত রাগ যে বলি, বাড়ি গেলে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেবে পিলু। ওকে তো জানেন না। সে তার দাদার সঙ্গে কেউ মস্করা করছে জানলে আর রক্ষা রাখবে না। দাদাই হচ্ছে পৃথিবীতে দেখা তার বড় মানুষ। দাদা আর বিদ্যাসাগর তার কাছে সমান। দাদা তার কলেজে পড়ে সোজা কথা না!
সহসা খিড়কির বাগানের দিকটায় পটু হাজির। স্যার আপনি এখানে। মামা খুঁজছে।
তাড়াতাড়ি পালাতে হয়। মিমি আর লক্ষ্মীর সঙ্গে নিভৃতে কথা বলা অশালীন ব্যাপার। বয়স তো হচ্ছে। আঠার বয়সটা কম না। বদরিদার বিবাহ ষোল বছরে। বৌদির বয়স নয়। বৌদির বার বছর বয়সে নটুর দাদা জন্মেই মরে গেল। নটু তার অনেক পরের। অনেক মানত তার জন্য। বদরিদা বোঝেন সব। আমার বয়সটা ভাল না। বৌদি অন্যরকমের। তাঁর কাছে বিলু সংসারে পাপ তাপ আছে বলে জানে না। নাহলে একা লক্ষ্মীকে আমার সঙ্গে বাড়ি যেতে দেন! কিংবা রুচির প্রশ্নও থাকতে পারে। শত হলেও মাস্টারদার ভাইপো।
যাই হউক কারো দিকে না তাকিয়ে ধর্মশালা রান্নাবাড়ি পার হয়ে ছুটে যাচ্ছিলাম, তখনই মিমি বলছে, গেলে কী হবে। ছাড়া পাবে না। তোমার সঙ্গে কথা আছে। ছোড়দি নাকি চিঠি লিখবে তোমাকে?
মাথাটা ঝাঁঝাঁ করতে থাকল। লক্ষ্মী আমাকে সত্যি ডুবিয়েছে। লক্ষ্মীকেই একমাত্র সেই পলাতক জীবনের কথা বলেছিলাম। ঠিক বলিনি, লক্ষ্মী খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে একা পেলেই বেশ সমব্যথীর মতো কথা তুলেছে ছোড়দির। যেন ছোড়দি তার একাই নয়, লক্ষ্মীরও। এখন বুঝতে পারছি আমি কত হাবা। যদি বদরিদার কানে যায়। ইস্ সত্যি কেন যে বলতে গেলাম বিশ্বাস করে। তুমি বিলু গরীবের ছেলে। তোমার এই ঘোড়ারোগ কেন।
আরে বিলু চান করবি না? সবার হয়ে গেছে।
রায়বাহাদুর পত্নীর এতক্ষণে চৈতন্য উদয়—মিমিটা কোথায়?
সঙ্গে তার পুত্র, কন্যা, পুত্রবধূ — ছোট ছোট কাচ্চা-বাচ্চা, মিমি তোমাদের ছোট নেই। বাগানে বসে মাস্টারের মুণ্ডুপাত করছে দেখগে। বাবাঠাকুর দ্য সেকেণ্ড ভাবতে শুরু করেছে আমাকে।
রায়বাহাদুর উঠে দাঁড়ালেন, হ্যাঁ আপনি চান করে নিন।
এ-আবার কেমন কথা! আমাকে আপনি আজ্ঞে করছে। রায়বাহাদুরও কী আমাকে বাবাঠাকুর দ্য সেকেণ্ড ভেবে ফেলেছে। যার হবার কথা নেতা, না হয় কবি, শিল্পী কিংবা সংগীত বিশারদ, তাকে নাঙ্গা সন্ন্যাসী বানিয়ে দেবার এই ষড়যন্ত্র কেন। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকাতেই যেন পরমগুরুর করুণা ভেবে বলা, আপনার উপর বাবাঠাকুরের অশেষ কৃপা। তিনি তাঁর যদি এক বিন্দু আমাদের দিতেন।
আমার জিভে শালা কথাটা এসে গেছিল—শালা আমি কি তোমাদের গুরু ভাই!
আপনি আজ্ঞে করায় মনটা তিক্ততায় ভরে গেল। বদরিদার উপর এদের প্রভাব, সীমাহীন খাতিরযত্ন দেখেই এটা টের পেয়েছি। যদি বদরিদাও বুঝে ফেলেন, কুলীন বামুনের ছেলে, তায় আবার দেখতে ব্রহ্মচারীর মতো, সহজেই মন্দিরের বলির পাঁঠা করে ফেলা যায়। আমার বাবা যা একখানা মানুষ, তাতে করে বদরিদার প্রস্তাব সহজেই লুফে নিতে পারে। যদি বলে, বাবাঠাকুরের বয়েস হয়ে গেল, যে কোনদিন দেহরক্ষা করতে পারেন, বিলুকে দিন মন্দিরে ঢুকিয়ে দিই। ইহজন্ম এবং পরজন্মের কাজ একই সঙ্গে সারা হয়ে যাবে। কত বড় কথা এমন জাগ্রত দেবীর থানের পুরোহিত হওয়া। সাত পুরুষের পুণ্যফল না থাকলে এমন সৌভাগ্য মানুষের জন্মায় না।
আসলে রায়বাহাদুর বোধহয় ভেবে ফেলেছেন, আমার আহার না হলে ওদের পাতে বসা অনুচিত। বাবাঠাকুর এদিকটায় খেতে আসেন না। তিনি আহার কখন করেন কেউ আমরা জানিও না। কাঁচা ফলমূল দই সন্দেশ এই তাঁর আহার। মন্দিরে বসেই তিনি নিজের খুশিমত খান, খেতে ইচ্ছে না হলে শুয়ে থাকেন। শুতে ইচ্ছে না হলে মন্দিরে প্রদক্ষিণ করেন, কিংবা তাঁর ঘরে পুঁথি ডাঁই করা আছে তা পাঠ করেন। সকালবেলায় হোতার সাঁকো পর্যন্ত যান। কারণ তখন প্রাতঃকৃত্যের দরকার হয়। দু’পাশের গরীব মানুষ-জন, ফড়ে, সাধু থেকে চোর বাটপাড়, পাটের মহাজন সবাই বাবাঠাকুরকে দেখার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। দেখলে পুণ্য। দিন ভাল যায়। একজন মানুষ দর্শনে শুভাশুভ যে এমন তীব্র তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে এ অঞ্চলে না এলে তা বিশ্বাস করা যায় না।
খেতে বসে বোঝা গেল, আমার প্রতি সবার নজর। ধর্মশালার বারান্দায় আজ পাত পড়েছে। রায়বাহাদুরের পরিবার সহ আমরা সবাই। নটু পটু কার্তিক মামা, ধনুদা এবং আমি। আমার দু’পাশে দু’জন, বদরিদা ডান পাশে, বাঁ পাশে রায়বাহাদুর। সবার খালি গা, সাদা উপবীত। ঠিক সামনে বসে আছে মিমি। লক্ষ্মীর এখন কাজ জল, পাতে লেবু এবং নুন দেওয়া। সে খেতে বসবে বৌদির সঙ্গে। মিমি আমার সামনে বসে। নির্বিঘ্নে যে খাব তারও উপায় নেই।
রায়বাহাদুর গদ্গদ হয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনার পিতৃদেব কী করেন?
আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল। শুধু বললাম, কিছু করেন না। বদরিদা জানেন আমি নিরীহ গোবেচারা মানুষ। সেই মানুষ কোন কারণে অতিষ্ঠ না হয়ে উঠলে এমন জবাব দেয় না। বদরিদা গণ্ডুষ করার সময় আমার দিকে তাকালেন।
আমিও তখন পঞ্চদেবতাকে নিবেদন করে গণ্ডুষ করতে যাচ্ছি। দু’জনের চোখাচোখি হয়ে গেল। গণ্ডুষ সেরে বদরিদা বেশ ক্ষুণ্ণ গলায় বললেন, তোর হয়েছেটা কি? সকাল থেকে নাকি মেজাজ খারাপ করে আছিস। নটু পটুকে পড়াতে বসালি না। কলেজে গেলি না। রেললাইনে গিয়ে বসে থাকলি। স্থূলকায় রায়বাহাদুর সরু আতপ চালের ভাত ঘি এবং সুকতোর ডাল দিয়ে মাখছিলেন, গন্ধরাজ লেবুর সুঘ্রাণ উঠছে—তিনি তাঁর খাওয়ার চেয়ে আমার সম্পর্কে বেশি কৌতূহল অনুভব করছেন বোধ হয় — কারণ ভোগের দিকে তাঁর মন নেই—বদরিদার কথার দিকে তাঁর মন। বদরিদা ঠিক বাবাঠাকুরের মহিমা বুঝে উঠতে পারছেন না—তাঁকে বিষয়টা অধিগত করানো দরকার ভেবেই যেন বলা, বাবাঠাকুরের ইচ্ছে! তুমি বদরি কেন যে বুঝছ না!
অর্থাৎ আমার আজকের মেজাজ মর্জি সবই বাবাঠাকুরের মহিমার ফলে হয়েছে। বাবাঠাকুরকে আমিও শ্রদ্ধা ভক্তি করি। বিষয় আশয় থেকে মুক্ত তিনি। তাঁর জ্ঞান অসীম। এ-সব এখানে থাকতে থাকতে টের পেয়েছি। কিন্তু তাঁকে পার্থিব জগতের বাইরের কোন শক্তি ভাবিনি।
বদরিদা বললেন, তা ঠিক।
—বাবাঠাকুরের অসুখের সময় বৃন্দাবন চক্রবর্তীকে নিয়ে আসা হল মন্দিরে ফুল জল দেবার জন্য। ঢোকাতে পারলে! বাবাঠাকুর বলির খাঁড়া নিয়ে লোকটার পেছনে ছুটেছিলেন। তিনি সব বোঝেন। ধরতে পার বাবাঠাকুর তাঁর নিজের উত্তরাধিকারী ঠিকই করে ফেলেছেন! তোমার মাস্টারের মুখখানি দেখেছ। নিষ্পাপ, পবিত্র, নবীন সন্ন্যাসীর মতো দেখতে। নবীন সন্ন্যাসী কথাটি শুনে মিমি আমার দিকে একবার চোখ তুলে তাকাল।
আমি গালে হাত দিলাম। সোনালী রেশমের মতো গালে দাড়ি। এরই জন্য তবে যত হুজ্জুতি। আচ্ছা দেখা যাবে। কোনরকমে খেয়ে উঠে ঘরে এসে বসতে না বসতেই দেখি মিমি হাজির। ও আমাকে ছেড়ে দেবে না বলছে। না-ছাড়ার কাজটা বোধহয় এখন থেকেই শুরু করতে চায়।
খুব ভাল মানুষ হয়ে গেলাম। বিনীত কথাবার্তা-আপনারা কখন যাচ্ছেন।
—সে দিয়ে তোমার কী দরকার!
যখন জানার দরকার নেই বালিশটা টেনে শুয়ে পড়া যাক। চোখ বোজার চেষ্টা করি। ঘুমই এখন এর হাত থেকে পরিত্রাণ করতে পারে। পাশ ফিরলাম।
—ছোড়দি নাকি তোমাকে পুলিশে দেবে বলেছিল?
—ভয় দেখিয়েছে। চোখ বুজেই বললাম। কারণ লক্ষ্মী যা ডোবাবার ডুবিয়েছে। এখন ভেসে উঠে লাভ নেই।
—কেন ভয় দেখাল?
—হুঁ। কিছু বলছেন। হাই তুললাম।
–কেন ভয় দেখাল!
—চুরি করেছিলাম। -কী চুরি করেছিলে?
—টাকা। আমি আস্ত একটা চোর। হাই উঠতে থাকল। হাই তুলে যদি রেহাই পাই।
—কার টাকা?
—গোবিন্দদার। গ্যারেজে কাজ করতুম। মেট্রিকে কম্পার্টমেন্টালে পাস করে এর চেয়ে বেশি কিছু করা যায় না।
—এখানে উদয় হলে কী করে?
–সেও ভাগ্য।
—তোমাকে গ্যারেজেই মানায়।
—ঠিকই বলেছেন! হাই তুলেও দেখছি নিস্তার নেই।
—আমাদের গ্যারেজে কাজ করবে?
—না। আমি যে কথা দিয়েছি।
–কাকে কথা দিয়েছ?
—ছোড়দিকে!
–কী কথা!
—মানুষ হব। বাবাঠাকুর হব না! চোর জোচ্চোরকে বাবাঠাকুর মানায় না। তারপরেই উঠে সোজা মিমির কাছে হাতজোড় করে বললাম, দোহাই বলবেন না যেন, আমি চুরি করেছিলাম গোবিন্দদার কৌটো থেকে। টাকা চুরি করে পালিয়েছিলাম। আপনার পিতামহ জানলে দুঃখ পাবে।
–বয়ে গেছে দুঃখ পেতে।
—শুনলেন না, বলল, দেখতে নবীন সন্ন্যাসী!
—ঐটুকু তো তোমার সম্বল। শ্রীচরণ দুখানি বাড়িয়ে দিতে লজ্জা করল না। এক কলেজে পড়ি, এক ইয়ারের ছাত্র।
—মিমি কলেজে আপনাকে দূর থেকে দেখতাম। কী গম্ভীর। আমাদের সাহসই হত না আপনার কাছ দিয়ে যাবার। আপনি এখন আমার পেছনে লেগেছেন। একটা কাজ করবেন, বড় উপকার হয়।
—কী কাজ —?
—পিতামহকে নিবৃত্ত করুন। যা আজ্ঞে, আপনি করছে?
—ভাবছ তোমাকে করছে?
—না তা না। বাবাঠাকুরের ডামি আমি তিনি বুঝে ফেলেছেন। তবু যাই হোক অমন বুড়ো মানুষ আজ্ঞে আপনি করলে অস্বস্তি হয়।
—দাদুকে সব বলে দিলেই আজ্ঞে আপনি বন্ধ হয়ে যাবে।
–কী বলবেন?
—তুমি একটা চোর।
—বলবেন ত!
—তার মানে।
যদি দয়া করে বলেন, জানাজানি হয়।
তুমি আমাকে আপনি আজ্ঞে করছ কেন? বলব না!
গেল সব, প্রথম ভেবেছিলাম দোহাই বলবেন না বললে, ঠিক বলে দেবে। পরে ভাবলাম কথা যদি রাখে, তাহলে আমি যে চোর ছ্যাঁচোড় জার্নাজানি হবে না। এটা এখন সত্যি দেখছি জানাজানি হওয়া দরকার। বৃন্দাবন চক্রবর্তীকে ঢুকতে দেন নি বাবাঠাকুর, এক পঞ্চতীর্থ এসেছিল দেবীর পুরোহিত হবে বলে, বাবাঠাকুর তার গেরুয়া বসন এক হ্যাঁচকায় নাঙ্গা করে দিয়েছিলেন—আরও এভাবে দু- একজন এসে বাবাঠাকুরের কোপানলে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তাঁর মহিমা বোঝা দায়। এখন ভেবে ফেলেছে সবাই, আমিই সেই মানুষ বাবাঠাকুর যার সন্ধানে ছিলেন। একমাত্র চোর জোচ্চোর প্রতিপন্ন হলে যদি এই বিষম দায় থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। বললাম, দোহাই বলুন। সবাইকে বলুন, চোর ছ্যাঁচোড় দিয়ে কখনও থানে পূজা হয়। সব প্রণামীর পয়সা মেরে দেবে না!
মিমি কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেল। বলল, জানাজানি হলে ভাল হবে? এখান থেকে সটকে যেতে হবে না? বদরিদা একটা চোরকে জেনেশুনে রাখবে?
—মিমি আমার কাছে দুই সমান।
—তার মানে।
—তার মানে আপনি বুঝবেন না। আমার চোখ সত্যি বড় কাতর দেখাল। কাতর চোখ দেখলে বোধহয় মেয়েদের মধ্যে মাতৃভাব জাগে। মিমির মধ্যেও মাতৃভাব জাগছে। এই সুযোগ। বললাম, আপনি আদুরে নাতনি। রায়বাহাদুরকে দিয়ে বলান, আমাকে দিয়ে ওসব কাজ হয় না। হবে না।
—তুমি দেখছি খুব ভয় পেয়ে গেছ?
—আপনি তো আমার বাবা কাকাকে জানেন না।
—মাস্টারমশাই তোমার কাকা না?
—হ্যাঁ, আমার মানুকাকা। তিনি কম্পার্টমেন্টাল পাস করেছিলাম বলে গ্যারেজে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। হাতের কাজ শিখলে নাকি অনেক পয়সা। তাঁর বন্ধু গাড়ি বাড়ি পর্যন্ত করেছেন।
—তোমার বাবা মত দিলেন।
—বারে দেবেন না। গাড়ি চালাব। একটা আস্ত গাড়ি আমার হাতে। কত লোকের প্রাণ আমার হাতে। অফিস কাচারিতে ঠিকমতো হাজিরা আমার হাতে। বাবা তো একেবারে গদ্গদ। গ্যারেজে কাজ শিখলে একদিন গাড়ি চালাতেও শিখে যাব। আমার বাবার বড় স্বপ্ন ছিল আমি গাড়ি চালাই।
মাতৃভাবটা আরও দেখছি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মিমির!
—তোমার বাবা এটা ঠিক কাজ করেন নি। তুমি গাড়ির ড্রাইভার হবে, ছিঃ ভাবা যায় না।
–আচ্ছা বলুন তো ভাবা যায়। কেবল আমার ছোট ভাই পিলু বলত, দাদা কলেজে পড়বে। বোনটাও। মারও ইচ্ছে।
—তাই তো হওয়া উচিত।
—সে আর হচ্ছে! আপনার দাদু, বাবাঠাকুর, বদরিদা মিলে মানুকাকার কাছে যদি যায়—আমি মরেছি।
—ওরা যাবে কেন?
—বাবাঠাকুর বানাবার জন্য।
—ওরা বললেই তোমার বাবা মত দেবেন কেন।
—হায় ভগবান তুমি তো আমার বাবাকে চেন না। বাবা দেশ ছেড়ে এসে কতকাল যে জাতমান উদ্ধারের জন্য নামাবলি গায়ে ঘোরাফেরা করেছেন। তুমি তো জানো না, মানুকাকার ইচ্ছেই বাবার ইচ্ছে। মানুকাকার উপর আর কারো কথা নেই। হাতের কাছে এত বড় সুযোগ বাবা কী সহজে ছাড়বেন! এত বড় মন্দিরের বাবাঠাকুরের তিনি বাবা হবেন—মন্দিরের প্রণামী থেকে সব কিছুর বখরা তাঁর হবে—তিনি কী ছাড়তে পারবেন!
সহসা আমি কেন যে মিমিকে তুমি বলে ফেললাম। এটা ধৃষ্টতা হতে পারে। ভয়ে ভয়ে চোখ তুলে তাকালাম। চোখে-মুখে মাতৃভাব আছে না মিলিয়ে গেছে লক্ষ্য করা দরকার। যদি দেখি বদল হয় নি সঙ্গে সঙ্গে সংশোধন। এই যে আপনি মানে আপনার পিতামহ মানে সবাই আমার কাছে স্বপ্নের দেশের মানুষ—লক্ষ্মী বলল, আপনাদের সামনের বাগানে নাকি একটা কাকাতুয়া বসে থাকে— একদিন নিয়ে যাবেন, দেখে আসব। এত সব মনের মধ্যে যখন ক্রিয়া করছে, তখনই লক্ষ্য করলাম, মাতৃভাব বদলে গিয়ে চোখ ঘুরপাক খেতে খেতে কেমন সামান্য প্রেমিক-প্রেমিক মুখ। আমার দিকে আর সোজাসুজি তাকিয়ে কথা বলতে পারছে না। এতে প্রবল উৎসাহ সঞ্চার হল আমার মধ্যে। বললাম, মিমি তুমিই পার আমাকে এ-বিপদ থেকে রক্ষা করতে।
মিমি আঁচল সামলাচ্ছে। শরীর ঢাকছে। যাক আমি যে পুরুষমানুষ এ-বোধটা এতক্ষণে ভেসে উঠেছে মনের মধ্যে। এ-বোধটা একজন তরুণ এবং তরুণীর মধ্যে থাকা ভাল। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল বলের মতো পায়ে গড়াচ্ছিলাম, এখন মনে হচ্ছে বল না হাতের বটুয়া। একেবারে পায়ে নিয়ে গিয়ে গোলের কাছে ফেলার আগেই হাতে তুলে বটুয়া করে ফেলেছে। মিমি বলল, তোমাদের সঙ্গে নিরঞ্জন পড়ে না?
—হ্যাঁ পড়ে।
—ও আমাদের পাড়ায় থাকে।
মিমি কি তাহলে এ-বিষয়ে গুরুত্ব দিতে চায় না। মিমিকে বললাম, বোস না। দাঁড়িয়ে থাকলে কেন?
আসল কথায় আসছে না। তবু বেশী চাপ দেওয়া ঠিক না। যখন একবার বশ মেনেছে এবং আমি কর্মাস নিলাম কেন, কম্পার্টমেন্টালে পাস করলে হয় কমার্স না হয় আর্টস—তা বলতে পারে আর্টস নিতে পারতে— কিন্তু বোঝাই কী করে তিন চার মাস লেট করে ফেললে আমার জন্য কে জায়গা রাখবে? মিমি সায়েন্স নিয়ে পড়ে। জেলা থেকে জলপানি পাওয়া মেয়ে। ও-মেয়েকে কে না দেখতে ভালবাসে। আর সাদা জমিন আর নীল পাড়ের শাড়ি পরে মিমি যে কত নীল হয়ে যায় গাছপালা পর্যন্ত তার সাক্ষী দিতে পারে। আমি তো সামান্য কম্পার্টমেন্টাল পাস — আমার কথা না হয় বাদই দিলাম।
আমি বললাম, কর্মাস আমার ভাল লাগে।
—তোমাকে আর্টস নিয়ে পড়লে মানাত!
এ-কথা কেন! সায়েন্স নয় কেন? আর্টস মানে ত বাংলা ইংরেজি সংস্কৃত, শেষ বিষয়টি বাবাঠাকুরকে মেরামত করতে বিশেষ সাহায্য করতে পারে। মিমি কি সত্যি চায় আমি মন্দিরে বাবাঠাকুর হই। বর্তমান বাবাঠাকুরের যা শারীরিক অবস্থা যে কোনোদিন টেসে যেতে পারেন। কেবল বড় রকমের কোনো কোপের বশবর্তী হয়ে চলেছেন বলে যেন বেঁচে আছেন। বাবাঠাকুর মরে গিয়েও যদি রেহাই না দেন। তাঁর পছন্দমতো উত্তরাধিকারী আবিষ্কার করতে পারলে বদরিদা কিংবা মন্দিরের পৃষ্ঠপোষকদের বড় রকমের স্বস্তি।
বললাম, আর্টস ভাল লাগে না।
—তোমাকে কবি কবি লাগে দেখতে।
—তোমার দাদু যে বললেন, নবীন সন্ন্যাসী।
—সন্ন্যাসী না ছাই।
—কেন বললেন না! তুমি শুনলে না!
—শুনেছি। আমার পছন্দ না!
—কাল ভেবেছি ভৃগুর কাছে যাব। বলব, দাদা এবারের মতো বাঁচাও।
—ভৃগু আবার কে।
—দাড়ি কামায়। গাল সাফ করে দেব। গোঁফ ফেলব না। চুল খাটো করে কাটব। নবীন সন্ন্যাসী আর কবি দুই ছুটে যেতে তখন পথ পাবে না।
মিমি হিহি করে হাসল। বড় সুন্দর দাঁত। দাঁত কেন—কী নয়। যেদিকে চোখ সেদিকেই নয়নাভিরাম- আহা আমি কালিদাস নই—আমি মাইকেল নই—এ-বর্ণনা কী করে দিই। ওর হাতের আঙুল যেন পদ্মকলি, পদ্মকলি না চাঁপাফুল, না কী সোনালী যবের শিষের মতো। ওর পা শকুন্তলার পতিগৃহের যাত্রার আগে যেমন সুচারু ছিল দেখতে তার চেয়ে প্রবল কিছু। আমার সেই ছোড়দি বড় হয়ে এখানে হাজির। সারাজীবন ভোগাবে। বললাম, মিমি আমাকে বাঁচাও। তুমি এত সুন্দর, তুমিই পার বাঁচাতে।
বাঁচানোর সঙ্গে সুন্দরের কী সম্পর্ক আমি নিজেও বুঝলাম না। তবু বলে ফেললাম।
মিমি বলল, দেখি আমি কী করতে পারি।
—কিছু করতে হবে না। শুধু পিতামহর কানে কথাটা তুলে দাও।
—কী কথা?
—বারে ভুলে গেলে। এত করে বলছি। আমি কবি নই, নবীন সন্যাসীও নই! একটা আস্ত চোর। যদি এটা বাবাঠাকুর কিংবা তোমার পিতামহ জানতে পারেন তবেই বেঁচে যাব।
—তুমি নিজেই গিয়ে বল না।
—আমি বললে বিশ্বাস করবে ভাবছ। ভাববে, বাবাঠাকুর হবার ভয়ে বানিয়ে মিছে কথা বলছি।
—সে দেখব। তুমি কিন্তু কলেজ মেগাজিনে কবিতা লিখবে এবার।
মিমির ভাল নাম দীপান্বিতা। এ-নামে আবার কেউ ডাকে না। আমরা মিমির নাম যে যার নিজের মতো ঠিক করে নি। মিমি আমার কাছে ছোড়দি। ছোড়দিকে নিয়েই আমার প্রথম মনঃকষ্ট, অর্থাৎ যাকে সাদা বাংলায় বলে ভালবাসা — এক বছর পর টের পেয়েছি—এরই নাম ভালবাসা—এটি টের পাবার পর মিমি আমার কাছে ছোড়দি হয়েই আছে। যেমন নিরঞ্জনের কাছে মিমি বিশালাক্ষী। কেউ ডাকে হৈমন্তি যার যেমন—সেই মেয়ে কলেজ ম্যাগাজিনের সহ সম্পাদক— কে কবিতা লিখবে, কে গল্প লিখবে, কে প্রবন্ধ লিখবে তারই ঠিক করে দেবার কথা।
বললাম, মিমি দোহাই তোমার। আমি জীবনেও কবিতা লিখিনি। কবিতা রবিঠাকুর লিখেছেন জানি। নবীন সেন, রঙ্গলাল, আর কী যেন নাম, আমার মনেও থাকে না—জীবনানন্দ না যেন কী। দ্যাখ আমার উপর তুমি এ-গুরু দায়িত্ব অর্পণ কর না। দোহাই, তোমরা সবাই দেখছি আমাকে পাগল করবে না হয় আবার দেশ-ছাড়া করবে।
মিমি এবারে বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, হবে। দাদুর কানে কথাটা তুলব। চোর ছ্যাঁচোড় দিয়ে হয় না তাও বলব। তবে শর্ত একটাই, তোমাকে কলেজ ম্যাগাজিনে কবিতা লিখতে হবে।
আপাতত মিমির শর্তে রাজি হওয়া উচিত। পারি না পারি চেষ্টা করব। যা হয় লিখে না হয় টুকে দিয়ে দেব। তবু যা ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে তাতে করে মিমি ছাড়া আমার অন্য কোন বাঁচার পথ খোলা নেই। মিমি যাবার সময় ডানার মতো চোখ তুলে তাকাল—ডানার মত চোখ তুলে। বেশ কাব্য আছে দেখছি, তাড়াতাড়ি মিমিকে ফের ডাকলাম, মিমি শোন পেয়ে গেছি—যদি এ-ভাবে শুরু করি কবিতাটা, ডানার মত চোখ তুলে
—অন্যের, অন্যের কবিতা। মিমি চেঁচিয়ে উঠল। কে বলবে এখন মিমি কলেজের সেই মেয়ে। দৃঢ়তার ছবি, কারো দিকে না তাকানোর স্বভাব, শুধু ওর দাদা ফোর্থইয়ারে পড়ে, সে এবং তার বন্ধুবান্ধব ছাড়া যে কথা বলে না, আমরা যারা মিমিকে চোর ছ্যাঁচোড়ের মতো পালিয়ে দেখি সেই মিমির মধ্যে একি প্রগল্ভতার প্রকাশ। মিমি বলল, তুমি আস্ত একটি নকল নবীশ। ঠিক টুকতেও সেখনি—লাইনটা হবে, পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে—
আমি বললাম, অঃ। কার কবিতা?
—জীবনানন্দ দাশের। নামটাও জানো না। কী গাঁইয়ারে।
আমি বলতে চাইলাম, আমাদের মতো তোমাদের তো আর ঘরবাড়ি ছেড়ে আসতে হয়নি। কবিতা- ফবিতা কোথায় উড়ে যেত। অন্নহীন মানুষের আবার কবিতা কি!
মিমি শেষপর্যন্ত সতর্ক করে দিয়ে গেল, ঐ কথা থাকলো।
আর তখনি লক্ষ্মী হাজির। বলল, বাবাঠাকুর মন্দিরে বসেছেন। তা আমি কি করব?
ডাক পড়েছে, লক্ষ্মী বলল।
মিমি আমার মুখ দেখে বুঝল, আমি কিছুটা বিবর্ণ হয়ে গেছি। বলল, যাও, ভয় কী আমি তো আছি।
শার্ট গলিয়ে মন্দিরে গেলাম। মন্দিরের দরজায় তিনি ঊর্ধ্বনেত্র হয়ে বসে আছেন। মন্দিরে যেতে পাথরের মেঝেতে রায়বাহাদুর তাঁর পত্নী এবং পরিবারবর্গ বসে। মিমি আমার আগে এসে গুটি গুটি বসে পড়েছে। মিমির শরীরে কী রকম এক আশ্চর্য সুঘ্রাণ – গোলাপ না চামেলি না জুঁইফুলের সুবাস ঠিক বুঝতে পারি না। ওর শরীর বড় ঋজু। চুলের খোঁপায় সোনার প্রজাপতি ক্লিপ। পরনে মুর্শিদাবাদ সিল্ক। ডাঁটো সাপের মতো লকলক করছে সব সময়। সে আমার আগেই দু-লাফে হাজির। তার পক্ষে দুলাফে হাজির হওয়া সম্ভব। কারণ তার মজা উপভোগ করবার পালা। আমার যাওয়ার অর্থই হচ্ছে বিষয়টার ভিত গড়তে প্রথম দিকের খোঁড়াখুঁড়ি। বদরিদা বৌদি জানালার পাশটায় বসেছেন। আমাকে দেখেই বদরিদা বললেন, বাবাঠাকুর বিলু এসেছে।
চোখ নেমে এল তাঁর। মুখে মধুর হাসি জেগে গেল। যেন তপস্যা ভাঙার পর গিরিরাজ দর্শন।
রায়বাহাদুর উঠে জায়গা করে দিলেন ভিতরে যাবার জন্য।
আমি বললাম, এখানেই বেশ। বলে মিমির পাশেই বসে পড়লাম। তাঁর এই বেলায় কী লীলাখেলা হবে আমার জানা নেই। মন্দিরে হরেকরকম আচার অনুষ্ঠান হয়, বড় বড় ওস্তাদ গাইয়েরা এসে গানবাজনা করে যান বাবাঠাকুরকে মধ্যমণি করে। কখনও চণ্ডীপাঠ, তার ব্যাখ্যা করেন। আমার নটু পটুর পড়াশোনা থাকে বলে ওদিকটা আমরা মাড়াই না। তিনি কখনও শোনার জন্য ডাকেন। আমি বাইরের লোক, বাইরের মতোই ছিলাম। আজ সহসা তাঁর আসরে আমার আমন্ত্রণ খাঁড়া ঝুলে আছে বলেই। খাঁড়া কী ভাবে নামে দেখার জন্য বসে থাকলাম।
কারো কারো স্মৃতি প্রখর থাকে, অনেক কিছু মনে রাখতে পারে—কিন্তু বাবাঠাকুর এক জন্মে যা পড়েছেন, তাঁর অন্য জন্মে তা কী করে কণ্ঠস্থ থাকে আমি বুঝতে পারি না। তিনি আমাকে দেখেই শুরু করলেন, মন্দং মন্দং নুদতি পবনশ্চানুকূলো যথা ত্বাং/বামশ্চায়ং নদতি মধুরং চাতকস্তে সগন্ধ। তিনি এভাবে গম্ভীর, যেন এক আদিগন্ত মাঠ পার হয়ে কোনো মহাপ্রাণ সৃষ্টি রহস্যের মধ্যে ডুবে যাচ্ছেন। মুগ্ধ হবার বিষয় থাকে এতে। মিমিরও সেই উদাত্ত কণ্ঠ শুনতে শুনতে কেমন পলক পড়ছে না—আমার দিকে তাঁর চোখ, তিনি একবার থেমে বললেন, এদিকে আয়। ভুল হলে বলবি। বলেন কী! আমি কী জানি। তাঁর এই বিশ্বাস আসে কোত্থেকে। তিনি তাঁর সংলগ্ন হয়ে বসার নির্দেশ দিলেন। আমি উঠবার আগেই রায়বাহাদুর এবং বদরিদা উঠে দাঁড়ালেন। মন্দিরে ঢুকে বসার জন্য পথ করে দিলেন। বুক আমার কাঁপছে। লক্ষ্মী দেখলাম খুব খুশি। সে ত এই চায়। এই মন্দিরে আমি পড়ে থাকি, আর আমাকে জ্বালাবার সুযোগ এতে তার চিরদিনের মতো হয়ে যাবে। তিনি আমাকে সামনে বসিয়ে একটা বই ঠেলে দিলেন। বাংলা হরফে সংস্কৃত শব্দমালা। পড়তে অসুবিধা হবে না। যেন অভিষেকের পয়লা কিস্তি। কিন্তু এতো কোন চণ্ডী কিংবা পুরাণ নয়। মেঘদূত। মেঘদূত থেকে তিনি শ্লোক উচ্চারণ করে তাঁর বাংলা বলে যাচ্ছেন—বুঝলে গর্বিত চাতক তোমার বাঁদিকে সুমধুর কূজনে মত্ত। আকাশে পাখা মেলে বলাকার দল মালার মতো সেজে থাকবে এবং তোমার নয়ন মনোহর সেবা করবে কেননা তোমার সঙ্গে তাদের ক্ষণ পরিচয়, তুমি আড়াল রচনা না করলে ওরা মিথুনে মিলিত হবার সুযোগ পেত না।
বাধাহীন গতিতে এগিয়ে গেলে আমার পতিব্রতা পত্নীকে অর্থাৎ তোমার ভ্রাতৃজায়াকে দেখতে পাবে। সে মিলনের আশায় এখন প্রতীক্ষায় আছে। সে জীবিত আছে কেন না, বৃত্ত যেমন ফুলকে ধরে রাখে, আশাও তেমন জীবনকে বাঁচিয়ে রাখে। এই আশার বন্ধন বিরহকালে নারীর ভঙ্গুর হৃদয়কে ধরে রাখে। মেঘদূত বিষয়টি কী আমার জানা নেই। কবি কালিদাসের লেখা, মেঘদূত, অভিজ্ঞান শকুন্তলমের কথা বাবার কাছে শোনা এই পর্যন্ত। পুরাণ নয়, উপনিষদ নয়, চণ্ডীপাঠ নয়, একেবারে একজন মহাকবিকে নিয়ে পড়েছেন। কবিতার মতো করে তার উচ্চারণ এবং যক্ষের ক্রন্দন দুই মিলে আমাকে ধীরে ধীরে কিসের জন্য যে বিরহকাতর করে তুলছে। সেটা কী, সেটার নামই কী বড় হওয়া। মাঝে মাঝে মিথুন কিংবা এই সংক্রান্ত কথাবার্তায় এসে আমি দেখলাম, মিমির গম্ভীর মুখ লজ্জায় রক্তাভ হয়ে উঠছে। পেছনে দেবীমুর্তি— তিনি দণ্ডায়মান, গলায় মুণ্ডমালা এবং খাঁড়া উত্তোলন করে ধাবমান। মহাকাল তাঁর পায়ের নিচে। বাবাঠাকুর কুহক জানেন কি? না হলে মহাকাল এবং দেবীমূর্তির এই প্রকট বেশ আমার মধ্যে মুহূর্তে জীবন কত অনিত্য এমন ভাবাবেগে বিচলিত করে কী করে।
বাবাঠাকুর বললেন, আমি ভুল করেছি। তুমি অন্যমনস্ক বিলু। শুধরে দাও। আমার মনোযোগ ঠিক আছে কী না সেই দেখার জন্য হয়তো এমন বলা! অথবা তুমি বিলু ছোড়দির জন্য ভীষণ আবেগ বোধ করেছিলে, এই মহাতীর্থে কিংবা পবিত্র স্থানে এলে তার সার্থকতা কোথায়! তুমি তো সেই মহাকাল, তোমার বুকে তিনি দাপাদাপি করছেন।
কী হবে বিলু?
আমি ধরিয়ে দিলাম, স্থিত্বা তস্মিন বনচরবধূভুক্তকুঞ্জে মুহূর্তং।
হ্যাঁ, ঐ আম্রকূটের কুঞ্জবনে বনচর বধুরা বাস করেন। মেঘ তুমি অল্পক্ষণ সেখানে অবস্থান করে কিঞ্চিৎ বর্ষন কর। বর্ষণের পর তোমার ভার লঘু হবে, তখন তুমি ত্বরিতে অগ্রসর হও—তখন দেখবে বিন্ধ্যপর্বত মূলে বিশীর্ণা রেবা নদী প্রবাহিত। মেঘ তুমি সেখানে বর্ষণ করবেই। বর্ষণের পর হাল্কা হবে। তখন সুবাসিত রেবা নদীর জলধারা পান করে নেবে। তুমি সারবান হলে বায়ু তোমাকে খুশিমতো উড়িয়ে নিতে পারবে না।
এই মহাকাব্য পাঠ আমার মধ্যে আশ্চর্য ভাবাবেগ সৃষ্টি করতে থাকে। নিজেই কখন যেন যক্ষ হয়ে যাই। অতি মধুর সেই স্মৃতিমালা আমাকে আনমনা করে তোলে। নারী সান্নিধ্য উত্তাপ সঞ্চার করে শরীরে। নারীর সহগমনই যেন একজন মানুষের বড় হওয়ার বিষয়। আমার সামনে মিমি, এবং লক্ষ্মী। বাড়ির সবাই এবং তীর্থস্থানে আগত আরও যাত্রীসমূহ। আমার মধ্যে এক নিদারুণ গদ্য খেলা করতে থাকে। সৃষ্টির উল্লাস আমার মধ্যে সঞ্চারিত হয়। এই উল্লাসই মানুষকে কোথাও কোনো বড় জায়গায় নিয়ে যায়। এই যে আমার যাত্রা, ঘরবাড়ি ছেড়ে কখনও পলাতক, কখনও খালি মাঠে মহাশূন্যের দিকে তাকিয়ে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে চিন্তা, এবং রোগ জরা ব্যাধি মৃত্যুর কথা ভাবা সেটাই কি সেই মহাকালের এক পলকের উল্লাস অথবা ক্রন্দন!
তিনি সেই সংস্কৃতশ্লোক উচ্চারণ করে চলেছেন এবং সঙ্গে তার ব্যাখ্যা—ওগো মেঘ পথে যেতে যেতে তোমার বর্ষণে কদম্বফুল ফুটে উঠবে, সবুজ এবং পাংশুবর্ণ মিলনে তাদের শোভা হবে অপূর্ব। অর্ধেক উদ্ধত কেশর কোথাও কোথাও নদী তীরে ভুঁইচাপা তোমার বর্ষণে মাটি থেকে মাথা বের করে উঁকি দেবে। কোথাও বনভূমি ছিল নিদাঘ তাপে দগ্ধ—তোমার বর্ষণে তা হবে স্নিগ্ধ মাটি থেকে উদগত হবে এক মধুর গন্ধ। সেই গন্ধ আঘ্রাণ করতে করতে চকিতে হরিণগুলি তোমার বর্ষণসিক্ত পথে ছুটে যাবে—তারাই বলে দেবে সবাইকে, কোন পথে তুমি গিয়েছ।
তিনি ঋজু হয়ে বসে আছেন, চোখ বন্ধ। যেন তিনি নিজেই এখন সেই মেঘমালা। মানুষের সৃষ্ট কাব্যময় এই ধরণীর সৌন্দর্যের কথা শেষবারের মতো সবাইকে আর একবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর খেয়ালি চরিত্র এবং খ্যাপামি যেন সবই এই বসুন্ধরার ক্ষণিক চঞ্চলতা। ঝড় অথবা বৃষ্টিপাতের মতো আগমন এবং ক্ষণিক স্থিতির পর তার প্রস্থান। তখন সামনে পড়ে থাকে শুধু আবহমানকালের এক মনুষ্যত্বের বিকাশ যা অতি পবিত্র এবং সুন্দর এবং সুচারু গঠনভঙ্গী।
তিনি বলে যাচ্ছিলেন, বিদিশা নগরীর উপকণ্ঠেই এক সুন্দর পাহাড়—নাম তার নীচে। সেই পাহাড়ে বিশ্রাম নেবার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে পার। তোমার অপেক্ষাতে আছে সব কদম্বফুল। তোমার আসার জন্য তারা উদ্গ্রীব। তারা তোমাকে দেখলে সংস্পর্শে বড়ই পুলকিত হবে। সেখানে নির্জন গিরিগুহায় যৌবনবিলাসী প্রেমিকের দল বিলাসী রমণীদের সঙ্গে মিলিত হয় তাদের সুবাসিত অঙ্গের পরিমলে গিরিগুহাগুলি সুগন্ধে পূর্ণ হয়ে উঠবে।
কেন জানি মনে হল, গিরিগুহাকন্দরে আমিই সেই যৌবনবিলাসী। মিমির মতো ছোড়দিরা সেই বিলাসে অবগাহন করার জন্য তৈরি হচ্ছে। আমার শরীর সহসা বড় রোমাঞ্চিত হল।
আমার দিকে মিমি অপলক তাকিয়ে আছে। জলভারে আনত মেঘমালার মতো তার মুখে সংকোচ এবং লজ্জা। নারীকে এ সময় বড় সুন্দর দেখায়। যৌবন বিলাসীর কথাতে এই নারীর মধ্যে জেগে গেছে উষ্ণ প্রস্রবণতার ধারা নেমে আসছে মিমির শিরা উপশিরায়। তার চোখের মধ্যে দেখতে পেলাম ক্ষুরধার দৃষ্টি। যেন সে পারলে এই মুহূর্তে সেই গিরিকন্দরে প্রবিষ্ট হতে চায়। আমার মনের যে সামান্য ভীতি ছিল নারী সম্পর্কে, মিমির মধ্যে সেই রহস্য এবং বসুন্ধরার গর্ভবতী হবার আকাঙ্ক্ষা দেখে মুহূর্তে তা কেমন দূর হয়ে গেল। মিমিকে কেন জানি মনে হল নিজের কাছের এবং কতকালের চেনা। সৃষ্টির সেই আদিকালে যে জন্মপ্রবাহ এই গ্রহে অনুপ্রবেশ করেছিল মিমি যেন এখন তাই ধারণ করে বসে আছে।
তিনি বলছিলেন—উজ্জয়িনীয় রমণীরা ধূপ জ্বেলে কেশ সংস্কার করে। সেই সুগন্ধি ধূপের ধোঁয়া জানালার পথে বাইরে এসে তোমার শরীরে বল সঞ্চার করবে। সেখানে ঘরে ঘরে পোষা ময়ূরগুলি তোমাকে দেখে আনন্দে নাচবে। প্রাসাদগুলিতে দেখতে পাবে বিরহকাতরা নারীর আলতার চিহ্ন। সেই সব প্রাসাদের মাথায় ক্ষণিক দাঁড়িয়ে শ্রমের ক্লান্তি অপনোদন করবে।
উজ্জয়িনীর গন্ধবতী নদীর তীরে চণ্ডিকাপতি মহেশ্বরের মন্দির। সেই মহাকালের মন্দিরে তুমি যাবে। মহেশ্বরের কণ্ঠ নীল, তিনি নীলকণ্ঠ, তুমিও নীল, মেঘমালা, তাই অনুচর প্রমথগণ তোমার দিকে সাগ্রহে তাকাবে। পাশেই আছে এক মায়াজাল ঘেরা উদ্যান। নদীর বায়ু তার উপর দিয়ে বয়ে যায়, উদ্যানের গাছপালা থরথর করে কাঁপে —কোনো নারীর মিথুন মিলনের মধ্যে। তুমি হয়তো জাননা সেই বায়ু গন্ধবতীর পদ্মগন্ধে আর জলকেলিরত তরুণীদের দেহগন্ধে সুবাসিত।
দেখলাম মিমি নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।
এই বর্ণনার সঙ্গে মিমি নিজের সেই উষ্ণ প্রস্রবণে ডুবে যাচ্ছে। একবার জোরে ডাকতে ইচ্ছে হল, মিমি, তুমি কী অস্থির! তোমার শরীর কী অশান্ত হয়ে উঠছে— মেঘদুতের বর্ণনা শুনে।
তিনি তখনও বলে যাচ্ছেন, সেই চণ্ডিকাপতির মন্দিরে দেবদাসীরা নৃত্য করে। তালে তালে নূপুর ধ্বনিত হয়, মেঘমালার ঝংকার ওঠে, তারা ধীরে ধীরে চামর ব্যজন করে—চামর বিচিত্র রত্নে ভূষিত। ক্রমে তাদের হাত শ্রমে অধীর হয়। শরীরে প্রিয়তমের মৃদু নখখতযুক্ত স্তনবৃত্তে বিন্দু বিন্দু বর্ষণ পেলে তৃপ্ত হয়ে তোমার দিকে কৃতজ্ঞ কটাক্ষ নিক্ষেপ করবে।
আর তখনই সহসা দেখলাম, মিমি মুখে আঁচল ঢাকা দিয়ে দৌড়ে পালাল। ও আর এতটুকু স্থির হয়ে বসতে পারেনি।
পরে মিমিকে আবিষ্কার করলাম আমার পড়ার ঘরে। যেন ব্যথাতুর রমণী—চুপচাপ বসে আমার বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে।
ঘরে ঢুকলে মিমি আমার দিকে তাকাল না। আরও বইয়ের মধ্যে নিবিষ্ট হয়ে গেল। লক্ষ্মী এসে বলল, মিমিদি ডাকছে।
মিমি আমার দিকে না তাকিয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে শাড়ি সামলে নিচে নেমে এল। মিমির শরীর যে কত মহার্ঘ ওর এই সতর্কতায় ধরা পড়লে আমি আজ বড় বিচলিত বোধ করলাম। আমার মাথার মধ্যে হাতুড়ি ঠুকতে থাকল কেউ। কান মুখ ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকল। জ্বর আসার মতো এক নতুন অসুখ আমাকে আক্রমণ করল। ঠিক জ্বর নয়, তবু জ্বরের মতো—চোখ বড় জ্বালা করছে। মিমি যাবার সময়ও আমার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারল না।
বাবাঠাকুর যে আমার জন্য মন্দিরের দরজা খুলে দিয়েছেন—বদরিদার কথাবার্তায় তা টের পেলাম। বৌদির কথাবার্তাতেও। কলেজ থেকে একদিন ফিরে এলে বদরিদা বললেন, মাস্টারদা এসেছিলেন।
আমি কিছু বললাম না।
বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে এলে বৌদি আমার জন্য আলাদা করে রাখা ভোগের প্রসাদ রেখে দেন। বড় সুস্বাদু। এবং কামিনীভোগের আতপে এত সুঘ্রাণ যে খাবারের লোভ ত্যাগ করাই কঠিন। ঠিক বুঝতে পারছি না, একজন ভাবী মন্দির পুরোহিতের জন্য তাঁদের এটা ষড়যন্ত্র কি না।
সেদিন এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। কলেজ টাওয়ারের পাশটায় আমরা বসি। আমি, প্ৰশান্ত, নীরঞ্জন সেদিনও বসব বলে এগুচ্ছি, দেখছি ভাগীরথীর পাড় ধরে মিমি হাঁটছে। কলেজ পাঁচিল পার হলেই ভাগীরথীর বাঁধ। মিমি এবং তার বান্ধবীরা। এদিকটায় একবার তাকাবে জানি। তারপর এগিয়েও আসতে পারে। মিমির সঙ্গে আমার যে একটা গোপন পরিচয় গড়ে উঠেছে কেউ টের পায় না। যেন আগের মতোই আমরা বড় দুরের এবং চুরি করে দেখতে ভালবাসি তাকে।
মিমি একদিন কলেজের কমনরুমে আমাকে যেতে বলল। ওর কখন ক্লাস তা আমি জানি। মেয়েদের কমনরুম আলাদা। হাতে গোনা ক’জন মেয়ের জন্য আলাদা কমনরুম—এটা আমাদের মনে সহিষ্ণুতার অভাব ঘটালেও মুখে কারো বলার সাহস নেই।
মেয়েরা ডেকে না পাঠালে তাদের কমনরুমে আমাদের যাওয়া বারণ। ওরা অবশ্য ইচ্ছে করলেই আমাদের কমনরুমে আসতে পারে। কেউ না ডাকলেও পারে কিন্তু এতদিন ক্লাস করছি, কোনদিন একটা মেয়েকেও আমাদের কমনরুমে ঢুকতে দেখিনি। আমরা যেন মানুষ না, কিংবা মেয়েদের শ্লীলতাহানির জন্য যেন সুযোগ খুঁজে বেড়াচ্ছি—তা না হলে এটা কেন হয়, আমাদের কাছ থেকে তাদের সব সময় দুরে সরিয়ে রাখা কেন? ক্লাসে যখন ওরা আসে, অধ্যাপক সঙ্গে থাকেন, যখন অধ্যাপক বের হয়ে যান, তাঁর সঙ্গে মিমিরাও বের হয়ে যায়। আমরা সব সময় ওদের শত্রুপক্ষ। অথচ কলেজ ইউনিয়নে মিমি দাঁড়ালে, কেউ এসে আমাদের তার হয়ে না বলা ত্তেও ভোট দিয়েছিলাম। মিমিকে ভোট দিয়ে আমরা নিজেরাই কৃতার্থ হয়েছিলাম। কলেজ সোসালে অন্ততঃ মিমি আমাদের একটা ধন্যবাদ দিতে পারত, তাও দেয়নি। শুধু কলেজ ইউনিয়ন সেক্রেটারি সুহাসদার কাছে মিমি যখন তখন যেতে পারে—রোগা পটকা, বেঁটে এবং বক্তৃতাবাজ মানুষ। ভারি চশমা চোখে। শহরে একটা রাজনৈতিক দলের পান্ডা। সুহাসদাকে সবাই এক ডাকে চেনে। মান্য-গণ্য করে। সুহাসদা মিমির এবং তার দাদার অভিভাবকের মতো। সুহাসদার কাছে একলা গেলে মিমি কিংবা অন্য কোনো মেয়েরই গায়ে যেন কোনো আঁচ লাগে না। এজন্য মানুষটার উপর আমাদের ছেলে ছোকরাদের গোপন একটা রাগ ছিল।
মিমিকে আমারও খুব দরকার। কী হল শেষপর্যন্ত। হপ্তা পার হয়ে গেছে—মিমির সঙ্গে আর সুযোগই হয়নি কথা বলার। মাঝে জন্মাষ্টমী এবং আগস্টের ছুটিতে দু’দিন কলেজ বন্ধ। সোমবার মিমি কলেজে আসেনি। শুক্রবারও না। শনিবারে ওর দু’টো ক্লাস। আমার ক্লাস সেরে ওর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ করে উঠতে পারছি না। ওর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ঘটেছে, জানলে, প্রশান্ত, নিরঞ্জন, নিখিল সবাই খেপে যাবে। কিংবা পেছনে এমন লাগবে যে শেষ পর্যন্ত না আবার মিমিকে নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়।
কলেজ করিডোরে দেখা হয়েছে, কেউ কথা বলিনি। কারণ চারপাশে সবার চোখ মিমিকে লক্ষ্য করছে। বললেই আমি চিহ্নিত হয়ে যাব। কোন সেকসানে পড়ে দেখ। খোঁজাখুঁজিও শুরু হয়ে যেতে পারে। সুতরাং কলেজে আমাদের চাওয়াচায়ি সার। আজ ডেকে পাঠাল। খবরটা নিতে পারব।
মিমি টেবিল টেনিস খেলছিল। ভারি দুরন্ত হাত। কপালে ঘাম। এদিকটায় আমাদের আসা হয় না বলে জানি না, তারা কি করে এখানে। পাশেই অধ্যাপকদের বসার ঘর। তার পাশে অধ্যক্ষ মশাই বসেন। মিমিদের কমনরুমে ঢোকা ঠিক হচ্ছে কি না এটাও মনে একবার উদয় হয়েছিল। যা থাকে কপালে, এবং কিছুটা গোপনেই ঢুকে গেছি। আমাকে দেখেই মিমির হাত শিথিল হয়ে গেছে। কিছুটা নিস্তেজ। সাপুড়ে হয়ে গেলাম নাকি। ভাল কথা নয়। এমন বিষধর সাপ ফণা গুটিয়ে নিয়ে আমাকে দেখছে! মিমি আঁচলে মুখের ঘাম মুছল। তারপর র্যাকেটটা হাতে নিয়েই যতটা দ্রুত সম্ভব কাছে এসে বলল, কাল সকালে আসবে।
—কোথায়!
—আমাদের বাড়ি।
—মারবে নাতো কেউ।
—মারবে কেন?
—তোমাদের বাড়িতে কাকাতুয়া আছে। দারোয়ান আছে।
—আমার নাম বললেই ছেড়ে দেবে।
–দাদুকে বলেছিলে?
—অত কথা বলবার সময় নয় এখন। কাল এস, বলব। বলেই মিমি আবার খেলতে আরম্ভ করে দিল। যেন তার সঙ্গে আমার কোনো পরিচয়ই নেই। মিমিকে যে বলব, শেষপর্যন্ত বাড়ি, এখানে বলতে পারলে না। ফিরে যাচ্ছি, তখনই আবার ডাক, সঙ্গে ওটা নিয়ে যাবে।
—ওটা মানে। আমি ফিরে দাঁড়ালাম।
—কলেজ ম্যাগাজিন —বুঝতে পারছ।
—ও কবিতা!
মিমি আবার খেলায় ব্যস্ত। আমার কথা তার কানে গেল না। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাও যায় না, আমি আর মুহূর্ত দেরি করি। কিন্তু বলা যে দরকার, মিমি আমার কবিতা হবে না। কত চেষ্টা করেছি। কবিতার কথা ভাবলে রাতে ঘুম হয় না। আর নটু পটুর যা স্বভাব, কিছু গোপনে লিখতে বসলেই ঝুঁকে দেখা—স্যার কী লিখছেন?
কাল সকালে মানে রবিবার সকাল। রবিবার সকালে বাড়ি যাই। মা বাবা ভাই বোনেদের প্রতি টানটা এখনও যে আছে টের পাই। ছোড়দিরা শত চেষ্টা করেও টানটা আলগা করতে পারছে না। ওদের বাড়িটা চিনতে কষ্ট হবে না। ডাকসাইটে জমিদার বাড়ি। শহরের কে না চেনে।
রাতে কবিতা নিয়ে বসা গেল। নটু পটুর ছুটি সকাল সকাল দেওয়া গেল। রাত বারোটার পর আমার আর বদরিদার খাবার সময়। শিবা ভোগ না হলে আমরা খেতে পারি না। আগে নটু পটুও দলে ছিল। রাত বারটা অবধি জেগে থাকা বড় কষ্ট। এখন আর নটু পটু জাগে না। আগেই খেযে নেয়। বাবাঠাকুরের নির্দেশে সব হয়। আমার বেলায় নির্দেশটা তিনি এখনও আলগা করছেন না। আর দু’জন জেগে থাকে। একজন বৌদি, অন্যজন লক্ষ্মী। লক্ষ্মী অবশ্য ঠিক জেগে থাকে না। যখন তখন যেখানে সেখানে ঘুমিয়ে নিতে পারে। মশার কামড় তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে না। আর আশ্চর্য শিক্ষা। একবার ডাকলেই উঠে পড়বে। বৌদির ফাই ফরমাস খাটার জন্য রাত বারোটার পরও তার দরকার হয়।
সুতরাং দেখা গেল লক্ষ্মী মশারি টাঙিয়ে দিচ্ছে। নটু পটু না ঘুমালে বসতে পারছি না। আমার যে কত দায় এখন কবিতা লেখার তা যে কেউ অনুমান করতে পারবে। চোখে মুখে নিদ্রাহীনতার ছাপ। কবিতা লিখতে পারলে মন্দিরের কাজ থেকে মুক্তি। মিমি বলেছে, কবিতা লিখে দিলেই সে বাকি দায়িত্বটুকু হাতে নিয়ে নেবে। লক্ষ্মীর বড় দুঃস্বভাব। একবার এ ঘরে ঢোকার অজুহাত পেলে আর সহজে যেতে চায় না। আমি চাইছিলাম, ঘরটা নিঝুম হোক। পাতা পড়ার শব্দ পাই। পাখির ডাক শুনি। এসব শুনতে শুনতে নাকি কবিতার লাইন হুস করে একটা রেলগাড়ির মতো মাথার মধ্যে ঢুকে যায়। তা আস্ত একখানি রেলগাড়ি এতটুকু মগজে ঢুকে গেলে তার দোষ কি। ঘিলু ভারি হয়ে যাওয়ার অর্থই নড়বড়ে হয়ে যাওয়া। ঘিলু নড়বড়ে না হলে কবিতা নাকি লেখা যায় না। কবিতা লেখা সম্পর্কে বন্ধু-বান্ধবদের কাছে পরামর্শ নিতে গিয়ে এসব খবর পেয়েছি। এখন লক্ষ্মীর প্রস্থান আমার কবিতা লেখার পক্ষে জরুরী দরকার।
লক্ষ্মী নটুকে ঠ্যাং ধরে তক্তপোশের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা ঘুমিয়ে পড়লে আর উঠতে চায় না। শত ঠেলাঠেলিতেও কথা কয় না। ঘুমে এমন কাতর হতে বড় দেখা যায় না। এ বিষয়ে লক্ষ্মীর অভিজ্ঞতা চরম বলে সে আর ওদের ডাকাডাকি করে না। তক্তপোশের একটা দিকে তোষক পেতে নেয়। তারপর আমায় দরকার হয় লক্ষ্মীর। যে দিকটায় তোষক পাতা হয়ে যায়, সেদিকটাতে আমরা দু’জনে দু’জনকে চ্যাংদোলা করে এনে ফেলে রাখি। কাজটা দ্রুত করার পক্ষে এটাই মোক্ষম উপায়।
লক্ষ্মীকে বলতেও পারছি না, তুমি এখন যাও। যদি বলে ফেলি, তবে আর নড়বেই না। যা বলব তার বিপরীত কাজ করতে সে আজকাল পছন্দ করে। এ বাড়িতে সেও যে ইচ্ছে করলে জোর খাটাতে জানে, তা দু-একবার কেন, অনেকবারই প্রমাণ হয়ে গেছে। আমি নিবিষ্ট রয়েছি পড়াশোনায়, ট্রায়াল ব্যালেন্স কিছুতেই মেলাতে পারছি না, বইয়ের পাতা ঘাঁটাঘাঁটি করছি—যেন দেখে বোঝে, মাস্টারের সঙ্গে কথা বললেও পড়ার ব্যাঘাত ঘটতে পারে এমন একটা ভাব নিয়ে যখন ডুবে আছি— তখনই লক্ষ্মী বলল, রাতে ঘুমাও না কেন? মাথায় কী ঢুকেছে! তুমি নাকি কবিতা লেখ!
—কে বলেছে!
—কে বলবে আবার, সব জানি।
—জানলে ত বয়ে গেল।
—ও-স্বভাব ভাল না মাস্টার। তুমি পড়তে এয়েছ। তোমার মাথায় এ-সব বাতিক কেন? লক্ষ্মী আমার এত ভাল মন্দ বোঝে যে কিছু বলতেও পারি না। আমি যে বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে পাই সে লক্ষ্মীর দয়ায়। কি কাচতে হবে না হবে, সে ঠিক জানে। গেঞ্জি রোজ জলকাচা করে দেবে। শুকিয়ে জায়গারটা জায়গায় ভাঁজ করে রাখবে। একটা জিনিস এদিক ওদিক হবার জো নেই। সেই লক্ষ্মী যখন জেনে ফেলেছে আমি কবিতা লেখার চেষ্টা করছি তখন বদরিদার কানেও কথাটা উঠবে। একজন মানুষের চারপাশ থেকে এত বিপদ দেখা দিলে সে স্থির থাকে কী করে? বললাম, দয়া করে যাও। আমি পড়ছি।
—পড়ছ না ছাই।
—তবে আমি কি করছি?
—কী করছ তুমিই জান!
—কী মুশকিল, দেখছ না ট্রায়াল ব্যালেন্স করছি। লক্ষ্মী এসবের কিছুই বোঝে না। কেবল আমাব চোখ দেখলে সব টের পায়। এত যে অনুভূতিশীল তার কাছে আমার না ধরা পড়ে উপায় কী। এবারে না পেরে বললাম, লক্ষ্মী সবই যখন টের পাও মন্দিরে গিয়ে বস না কেন? তুমিও দেখবে শেষ পর্যন্ত মা সদানন্দময়ী টয়ি হয়ে যাবে।
—কী বললে?
—এই মা করুণাময়ী, তোমার ভড় উঠবে। মানুষের চোখ দেখে তার ভবিষ্যৎ বলে দেবে।
—দেখ ঠাকুর দেবতা নিয়ে তামাশা কর না। এতে মানুষের জিভ খসে পড়ে জান। তখনই দেখলাম, লক্ষ্মী কপালে হাত রেখে কার উদ্দেশে প্রণাম করছে। মা করুণাময়ীকে নিয়ে ঠাট্টা। এতে সে অমঙ্গল আশঙ্কায় কেমন কাতর হয়ে গেল। লক্ষ্মীর ধারণা, তার জীবনে মঙ্গল অমঙ্গল বলে আর কিছু নেই। আমার কোনো অমঙ্গল হবে ভেবেই যেন সে তার ঠাকুরের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিল। আর কথা বলল না, আবার কোন ঠাকুর দেবতাকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করব সেই ভয়ে লক্ষ্মী চলে গেল। লক্ষ্মীকে ঘর থেকে তাড়াতে হলে এমন সব অস্ত্রের সন্ধান থাকা ভাল। বেশি বাড়াবাড়ি করলে ঠাকুর দেবতা নিয়ে ঠাট্টা তামাশা জুড়ে দিলেই হল। লক্ষ্মী চলে গেল ঠিক, কিন্তু আমার মন বসল না। পদ্য লিখতে হলে গভীরে ডুব দিতে হয়। সে কতটা গভীর জানা নেই। পাখির কোনো ডাকও কানে আসছে না। নিঝুম। কেবল জানালার দিকে তাকালে দূরের একটা গভীর নীল সিগনালের আলো চোখে পড়ে—একটা লাইন লেখা যাক—
দূর তুমি সিগনালের আলো
বেশ কথা, আর আছে কাব্য।
আমার লেখা কিছুই হয় না,
না কবিতা না ছন্দ।
মন্দ লাগছে না। সন্দ করার কারণ নেই। এই আমার প্রথম কবিতা। আচ্ছা আবার শুরু করা যাক-
পাখির শব্দ শোনার জন্য
রাত জেগে থাকি বসে। অন্ধকার
অবিরাম। কখনও নীল জ্যোৎস্না
উদার আকাশে—দূরে সিগনালের বাতি,
ছোড়দির কথা আছে চিঠি লেখার।
জানালায় কেউ আজকাল রোজ
নীলখাম রেখে যায়। দূরাতীত
গ্রহ থেকে কারা আসে, ডাকে।
কীট পতঙ্গ ওড়ে বনে জঙ্গলে।
সাদা প্রজাপতি মুক্তোর ডিম পাড়ে
কোনো এক পদ্মকলি আঙুলে।
এটা আসলে কোনো কবিতা কিনা জানি না। কাল মিমির কাছে যাবার অন্তত পাসপোর্ট হয়ে গেল, এটা দিয়ে বলব, মিমি আমি আমার কথা রেখেছি, এবার তুমি তুলে দাও কানে, বিলুটা চোর ছ্যাঁচোড়। ও কি মুক্তির স্বাদ। এই লিখে দিলে যদি মুক্তি পাওয়া যায়। আমার চোখে মুক্তির আনন্দে জল এসে গেল। চোর ছ্যাঁচোড় জানলে আমাকে আর কেউ মন্দিরের পুরোহিত করতে ভরসা পাবে না।
সকালবেলাতেই রওনা দিলাম। বৌদি বললেন, বাড়ি যাচ্ছিস?
—বাড়ি আর কোথায়? যাব শহরে।
শহরে কাকার বাড়ি যেতে পারি ভেবে বদরিদা বললেন, মাস্টারমশাইকে আসতে বলবি, কথা আছে।
কী কথা! যাই কথা থাক ওটি আর হচ্ছে না। তারই গোড়া কাটতে যাচ্ছি মিমির কাছে। বললাম, বলব।
বারান্দা থেকে নামার সময় লক্ষ্মী বলল, যেখানেই যাও জলখাবার খেয়ে যেও।
এই এক প্রতিবন্ধক সৃষ্টি হয়েছে সব কাজে। খাওয়াটা সব সময় বড় কথা না। যেখানে যাচ্ছি সেখানেও আদরযত্ন কম পাব না। সংসারে আমার জন্য তুমি একাই ভাব, এমন মনে কর না। বললাম, এখন খাব না। দেরি হয়ে যাবে।
—কোথায় তোমার রাজসূয় যজ্ঞ আছে যে দেরি হবে।
লক্ষ্মীর ট্যারা কথা আমার একদম ভাল লাগে না। যাচ্ছি একটা শুভ কাজে তোর কী দরকার আগ বাড়িয়ে কথা বলার!
—তুমি লক্ষ্মী যা বোঝ না সে নিয়ে কথা বল না।
—আমার বয়েই গেছে কথা বলতে।
চোখ ঘুরিয়ে ঠোঁট উল্টে এমনভাবে বলল, যে একটা কথা বলার আর স্পৃহা থাকল না। ঘরে এসে জামা প্যান্ট পরছি। আর আয়নায় মুখ দেখছি। আজকাল এটা হয়েছে, চুল ঠিক আছে কিনা, কিংবা আমার মুখ দেখতে কেমন আয়নায় বার বার দেখা। নিজেকে বার বার দেখেও আশ মেটে না কেন? আর পাশে তখন আর একটা মুখ ভেসে ওঠে। সে কখনও ছোড়দি, কখনও মিমি কিংবা কখনও লক্ষ্মী। লক্ষ্মীর মুখ ভেসে উঠলেই কেমন নিজেকে মনে হয় ছোট করে ভাবছি। বারবার আয়না থেকে লক্ষ্মীকে সরিয়ে দিয়ে সেখানে মিমি কিংবা ছোড়দিকে লটকে দিই।
মুখ দেখছিলাম, এবারে বের হব। ভাল করে চুল পাট করলাম। চিরুনি একটা ছোট আকারের পকেটে ভরে নিলাম। ফাঁকে ফাঁকে আয়নায় মুখ দেখা। এক নাগাড়ে দেখতে পারি না—কে এসে আবার দেখে ফেলবে। সব চেয়ে ভয় লক্ষ্মীকে। আর লক্ষ্মীই তখন হাজির। জাম বাটিতে মুড়ি, কলা, সন্দেশ—কাঁচাগোল্লা। দেখেই বিগড়ে গেলাম।
—নিয়ে যাও। খাব না। সময় নেই।
—বৌদি বলেছে খেয়ে যেতে। পিত্তি পড়বে। বৌদি না, তুমি!
—আমার দায় পড়েছে।
এখন আমার মনে সংশয়, যদি সত্যি বৌদি পাঠিয়ে থাকেন, প্রায় জননীর মতো এই বৌদিটি আমার সম্পর্কে সব সময় সজাগ। মিমিদের বাড়ি খুব কাছে নয়। হোতার সাঁকো পার হয়ে তেলকলের পাশ দিয়ে গেলেও ঘন্টাখানেক লাগবে। সকালে মুখে কিছু না দিয়ে বের হলে পিত্তি পড়তেই পারে।
বললাম, রাখ।
—লক্ষ্মী ঠেলা মেরে বাটি গ্লাস রেখে দিল।
—তুমি যাও।
—কেন আমি থাকলে লজ্জা করবে খেতে?
—করবে।
—এত দিন তো করেনি!
লক্ষ্মী বলতেই পারে। তিনজনের তিন বাটি মুড়ি দিয়ে লক্ষ্মী বসবে তক্তপোশে। পা দোলাবে। রাজ্যের গল্প জুড়ে দেবে। এবং পাড়ায় কার হাঁস শিয়ালে নিয়ে গেল, কে পড়ে ঠ্যাঙ ভেঙেছে, কার ছেলে আমবাগানে ধরা পড়েছে, এবং বিলে যারা জাল ফেলে বসে আছে, তাদের নৌকায় কী আছে, তীর্থযাত্রীরা কোত্থেকে কে এসেছে—এমনি কত খবর। যেন লক্ষ্মী এই সব খবর আমাকে না দিতে পারলে শাস্তি পায় না।
তাড়াতাড়ি আছে। জল ঢেলে মুড়ি ভিজিয়ে কলা সন্দেশ কাঁচাগোল্লা এক সঙ্গে মেখে গোটা পাঁচেক থাবায় সব শেষ করে দেবার সময় লক্ষ্মী বলল, এত তাড়াতাড়ি খাচ্ছ কেন? গলায় আটকালে কী হবে?
—তোমার তো কোন দায় নেই।
লক্ষ্মী এ সময় বড় করুণ চোখে আমার দিকে তাকাল। এ চোখ আমি চিনি। কে বলবে লক্ষ্মী মুখরা—মায়া দয়া নেই। লক্ষ্মীর মধ্যে যেন এক দূরের বাউল কোন এক করুণ স্বর তুলে মাঠে নেমে যায়। এমন চোখ দেখলে আমারও কেমন রাগটা নিমেষে উবে যায়। লক্ষ্মী যেন কিছু বলবে বলে তাকিয়ে আছে।
আমি জল খাবার সময় লক্ষ্মীর মুখ, চোখ বাঁকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। লক্ষ্মী মাথা নিচু করে বসে আছে।
–কী হল তোমার?
লক্ষ্মী মুখ তুলল না।
–ঠিক আছে আর বলব না। তাড়াতাড়ি খাইনি। আস্তেই খেয়েছি।
লক্ষ্মী এবারে বলল, তুমি কার কাছে যাচ্ছ মাস্টার?
—মিমির কাছে।
—কেন যাচ্ছ?
লক্ষ্মী তো কখনও এভাবে আমাকে কোন প্রশ্ন করে না। কেমন বেসুরো ঠেকল। বললাম, কাজ আছে?
—কী কাজ?
ইচ্ছে করলে বলতে পারি, তোমার জানার কী দরকার এত। কিন্তু লক্ষ্মী আমার কাছে গোপনে তার ভান্ডার তুলে দিয়েছে—এই সব কথা বললে, সেটা বেশি মনে হবে। আমি কলেজ থেকে দেরি করে ফিরলে, ওর শুকনো মুখ। কখনও দেখেছি মন্দিরের দরজায় বসে আছে পথ চেয়ে। ঘরে ঢুকলেই বলবে, এত দেরি কেন মাস্টার?
ক্লাস থাকে, কখনও বন্ধুদের সঙ্গে লালদিঘির ধারে আড্ডা, কখনও সাইকেল চড়া শিখি মাঠে নানা কারণে দেরি হয়ে যায়। লক্ষ্মী কেমন তখন ব্যথাতুর রমণীর মতো গালে হাত দিয়ে মন্দিরের দরজায় বসে থাকে। এ-সব টের পাই বলেই তার প্রশ্নের সব জবাব দিতে এসময় বাধ্য থাকি। কিন্তু মিমির জন্য কবিতা লিখেছি ভাবলে লক্ষ্মী কষ্ট পেতে পারে। মিমির সঙ্গে তার যতই সখ্যতা থাকুক, কোথায় যেন টের পেয়েছে, মিমি তাঁর ভ্রমরের কৌটোয় হাত দিয়েছে।
বললাম, এই একটু কাজ। মানে কলেজে বলল কি না কাল যেতে।
—যাও না মাস্টার। আমি কি বারণ করছি। তাড়াতাড়ি ফিরো কিন্তু
বাইরে বের হয়ে রাস্তায় হাঁটছিলাম। লক্ষ্মী এবং আমি পাশাপাশি কত দিন ধরে এখানে আছি। দু’জনই আশ্রিত। দু’জনই পান্থনিবাসের যাত্রী। আমার প্রতি লক্ষ্মীর গোপন একটা টান আছে, সেটা মাসখানেক না যেতেই একবার বুঝেছিলাম—আজ তাকে অন্যভাবে বুঝতে শিখেছি। মুখে যাই বলুক, যে কোন মিমি তার শত্রু পক্ষ। সে ভেতরে ভেতরে সব সয়ে যাবে। মুখ ফুটে কোনো কথা বলবে না।
আমি যে কী করি! আমার যে বড় হওয়ার কথা। লক্ষ্মীর মধ্যে আটকে থাকলে আমি বড় হব কী করে। আর যদি বাবা, মানুকাকা, রায়বাহাদুর এবং বদরিদা মিলে সত্যি মন্দিরের পুরোহিত বানিয়ে দেন তবে আমার বড় হওয়াটা যে এখানেই শেষ। মিমির কাছে যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু মিমির কাছে আমার ভ্রমরের কৌটা গচ্ছিত আছে আপাতত, কারণ মিমিই পারে আমাকে এই বন্দী দশা থেকে মুক্তি দিতে।
কখন যে হাঁটতে হাঁটতে হোতার সাঁকো পার হয়ে এসেছি। বয়স মানুষকে এ-সময় বোধহয় বেশি ভাবাবেগে তাড়িত করে। সব কিছু পরিপূর্ণ মনে হয়। পাখির ডাক শুনতে ভালবাসি। গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। দূরে কোন সবুজ বনভূমি দেখলেই কেমন এক রহস্য টের পাই। মিমির সৌন্দর্য, আভিজাত্য এবং শরীরে আশ্চর্য মায়াবী সুবাসেও টের পাই সেই রহস্য খেলা করে বেড়াচ্ছে। আমার কাছে কিছুই চিরন্তন হয়ে থাকে না। কিংবা মনে হয় না, এখানেই শেষ। এই আবাসই আমার সব। নিত্য নতুন ছবির টানে একটা বিবাগী মন তৈরী হয়ে গেছে আমার ভেতর। আমি হাঁটি। কতকাল আমাকে এভাবে হাঁটতে হবে জানি না। তেলকল পার হতেই পুলিশ ফাঁড়ি, বাঁ পাশ দিয়ে গলিগুঁজি রাস্তা। নর্দমা, দুর্গন্ধ এবং শহরের পুরানো জরাজীর্ণ বাড়ি ঘর পার হলেই বাজার।
বাজার পার হয়ে দুটো রাস্তা গেছে দুদিকে। কোন দিক দিয়ে এগোলে মিমিদের প্রাসাদতুল্য ভবন ঠিক জানা নেই। জিজ্ঞাসাবাদ করে রাস্তাটা জেনে নেওয়া গেল। এ-দিকটায় আমি পিলুর সঙ্গে দু’চারবার এসেছি। গোটা শহরটা ভাগীরথীর পাড়ে পাড়ে— লম্বা। একটাই বড় সড়ক এ-মাথা থেকে ও-মাথা। নদীর ধারের রাস্তাটা এখনও ফাঁকা। ওখানটায় নদীর চরে বাবলা বন। বন পার হলে জেলখানার পাঁচিল। পাঁচিলের পাশ থেকে জঙ্গলটা দেখা যায়। কিছু সাদা ফুল ফুটে থাকে সব সময়। জায়গাটায় এলেই ফুলগুলি চোখে পড়ে। ভয় পাই। আমার মনে হয় সেই মৃত শহীদেরা হয়তো এখানটাতেই ফুল হয়ে ফুটে আছে। মনের মধ্যে কত সব চিন্তা যে কাজ করে। মিমির বাড়ি যেতে যেতে শহরটার সব কথাবার্তা যেন কানে আসে। নন্দকুমারের ফাঁসির কথা মনে হয়। সেই বাড়িটাও একদিন দেখা দরকার। তাঁর উত্তর-পুরুষের সঙ্গে মিমিদের জানাশোনা। বলেছিল, একদিন আলাপ করিয়ে দেবে। ইতিহাসের পাতায় যাঁরা আছেন, তাঁরা যেন এই শহরটায় ঢুকলে গা ঠেসাঠেসি করে হাঁটতে থাকেন। কেমন রোমাঞ্চ বোধ করি।
এগুলিই বোধ হয় আমার বড় হওয়ার লক্ষণ। আমি সব টের পাচ্ছি ধীরে ধীরে। এগুলোই গৌরব গাঁথা মানুষের। গৌরব গাঁথাই মানুষকে বড় হতে শেখায়। একটা সিনেমা হল সামনে। একজন রাজপুরুষ। ছবিটা কার আমি জানি। কোন নায়কের আমি জানি। দাঁড়িয়ে যাই। যে নায়ক, তাকে হিংসে হয়। তার টাকা মান যশ হয়েছে, সেও আমার মতো বড়ো হবে বলে বের হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত এই ছবিটায় এসে আটকে গেছে। যেমন আমার মন্দিরে আটকে যাবার কথা হচ্ছে।
আরে ব্বাস-এ-কী বাড়ি রে বাবা। সামনে ফুলের বাগান, কত রকমের ফুল। কেয়ারি করা ফুলের গাছ। দাঁড়ে কাকাতুয়া বসে। যেন ছবির মতো সব কিছু। নুড়ি পাথর বিছানো পথ। গেটে দারোয়ান। এসব দেখলেই সংকুচিত হয়ে পড়ার স্বভাব। বললাম, মিমি আছে?
—মিমি কোন আছে? গোঁফয়ালা লোকটা উঠে দাঁড়াল।
—মিমি, মানে কলেজে পড়ে। মিমিকে চেন না।
—ও ছোড়দি।
আরে একী বলছে। সেই এক ছোড়দি এখানে-ও তবে।
গেট খুলে দিলে বাঁদিকে গ্যারেজ। ওপরে দোতলায় লম্বা বারান্দা। চিক ফেলা। বাগানে মালী কিসের চারাগাছ পুঁতছে। একজন বামুনঠাকুর বের হয়ে এল। এক সৌদামিনী জল ছেটাচ্ছে। বোধহয় গঙ্গাজল। ভিতরে দাসদাসী এবং কলরব শোনা যাচ্ছে। একটা লোক খাঁচায় একদল মুনিয়া পাখিকে শিস দিয়ে কি যেন বলছে। আরে এই তো সেই লোকটা। বললাম, মিমি আসতে বলেছিল। আরে আপনি ঠাকুরমশাই!
এই রে, বলে কি। আমি ঠাকুরমশাই হতে যাব কোন দুঃখে। লোকটা গম্ভীর গলায় ডাকল, হরিচরণ। কোন অন্ধকার থেকে কে যেন জবাব দিল, যাই হুজুর।
হরিচরণ কাছে এলে বলল, বাবাকে খবর দে।
—শুনুন, বাবাকে না, মিমিকে। মিমি আমাকে আসতে বলেছিল।
—ঐ ঠিক আছে। বল কালীবাড়ি থেকে ঠাকুরমশাই এসেছেন।
এ কী ঝামেলা। এলাম মিমিকে কবিতা দেব বলে, এখন দেখছি আমি এখানকার ঠাকুরমশাই! একজন বামুনঠাকুর তো এইমাত্র গঙ্গাজল ছিটিয়ে বের হয়ে গেল। আমাকে আবার কেন!
তারপরই সেই দশাসই পুরুষ রায়বাহাদুরের আবির্ভাব। বোধহয় জপ-তপে বসেছিলেন। গলায় লম্বা সাদা ধবধবে উপবীত। রেশমের ধুতি পরনে। খালি গা। বুকভর্তি সাদা লোম। – আসুন আসুন। বাবাঠাকুর পাঠিয়েছেন?
—না-ত।
কেমন দমে গেল সেই দশাসই মানুষটা। বাবাঠাকুর বোধহয় সব সময় কৃপা করবে, এমন আশায় এঁরা বসে থাকেন। বাবাঠাকুরের প্রিয়জন আমি। আমার পদার্পণও কম সৌভাগ্য না তাঁদের পক্ষে। তবু বাবাঠাকুর কোন শুভবার্তা যদি পাঠান এ-পরিবারের সম্পর্কে সেই আশা। মানুষের অর্থ, মান, যশ হলে কী শেষ পর্যন্ত এই হয়। একজন বাবাঠাকুরের দরকার হয়ে পড়ে। এত প্রভাব প্রতিপত্তিও শেষপর্যন্ত বিন্দুমাত্র বড় হওয়ার কথা বলে না। বাবাঠাকুরের কৃপালাভই কী শেষ পর্যন্ত মানুষের স্বপ্নের সেই বড় হওয়া। তবে আমি কার পেছনে ছুটছি। এ তো দেখছি শেষ পর্যন্ত সবটাই আলেয়া। আর তখনই সেই আলেয়ার আবির্ভাব। -আরে বিলু। যা হোক তবে কথা রাখলে। তুমি আসবে ভাবিই নি।
—তার মানে।
—তুমি যা একখানা মানুষ। ভুলেই গেছ ভাবলাম। আমার ওটা এনেছ তো?
রায়বাহাদুর আমার সঙ্গে মিমির এমন কথাবার্তায় যেন কিছুটা খাবি খেতে শুরু করলেন। বিলু কি রে!
—হ্যাঁ ওর নাম বিলু। জিজ্ঞেস কর না।
—নাম বিলু কখনও হতে পারে। কেমন চোখ দেখছিস। মা’র আশীর্বাদ পুষ্ট মন্দিরের নবীন সন্ন্যাসী।
আমি বললাম, দেখুন আপনি আমাকে আবার আজ্ঞে আপনি করছেন। আমার কেমন মাথাটা ঘুরছে।
মিমি বলল, তোমার না দাদু মাথায় ভীমরতি ধরেছে। বিলুকে তোমরা কী ভাব। তুমি যাও তো। বিলুর সঙ্গে আমার কথা আছে।
আদরের নাতনিরা মাথায় চড়বে বেশি কী! বোঝাই যাচ্ছে নাতনির বড় বেশি অনুগত তিনি। তিনি হাই তুললেন। তুড়ি দিলেন মুখের সামনে। পৈতায় হাত ঘষে ধার দিলেন। তারপর যাবার সময় বললেন, ঠিক আছে, তোরা কথা বল। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, চলে যাবেন না। কথা আছে।
মহা মুশকিল, নাতনিরও কথা থাকে, দাদুরও থাকে। একজন মানুষের পক্ষে, এমন দুই বিপরীত মেরুর কথা থাকলে, তার কপালে যে দুর্ভোগ লেখা থাকে সেটা আমার মতো অপোগণ্ডও বুঝতে পারে। তিনি চলে গেলে, কিছুটা হাঁফ ছেড়ে সোফায় বসলাম। এবং এতক্ষণে মিমিদের বৈঠকখানা বলতে কী বোঝায় দেখার সুযোগ পেলাম। একখানা হলঘর। দাগ টেনে দিলে দু’পক্ষের হাডুডু খেলার জায়গা হয়ে যায়। হলঘরের এক পাশটায় পর্দা ফেলা। ওটা কি? ওখানে পর্দা কেন প্রশ্ন করার ইচ্ছে হল। পর্দাটা কালো রঙের। সোনালি বর্ডার। মারবেল পাথরের টেবিল মাঝখানটায়। দুই দেয়ালে কাচের দুটো বড় জার। ছাদে রঙিন কাচের ঝাড়লণ্ঠন। নিচে কার্পেট সবুজ। মাঝখানে নৃত্যপরায়ণা রমণীর ছবি। এ-সব আমি বাবার জমিদার দীনেশবাবুর বাড়িতে দেখেছি। ওরাও বাবার জমিদার দীনেশবাবুর গোত্রের। বললাম, মিমি কিছু হল?
–কী হবে!
—বারে সেই কথাটা।
–কবিতা এনেছ?
—দেখ মিমি আমি কবিতা কাকে বলে ঠিক বুঝি না। ছন্দ যতি মিল আমার জীবনে কোথাও ছিল না। কিছু ভাল ভাল কথা মনের ভেতর যদি ভেসে ওঠে আর তা যদি কবিতা হয়—তবে এটাও কবিতা।
–ভেসে ওঠে মানে?
—আরে বোঝ না কেন। কিছু তো ভাল লাগে না। কী যেন চাই—পাই না। এই কথায় মিমি আমার পাশে বসে পড়ল। আমাকে ঝুঁকে দেখল। বলল, বিলু কবিতা সেদিন শুনলে না?
—কবে শোনলাম?
—বাবাঠাকুর পড়ছিলেন।
—মেঘদূতের কথা বলছ?
মিমিকে কেমন কাতর দেখাচ্ছে। মিমি হাত বাড়িয়ে দিল, দাও।
পকেট থেকে সন্তর্পণে বের করতে যাচ্ছি তখনই রায়বাহাদুর হাজির, হুঁম। আপনার সেবায় যদি লাগে, পেছনে রাইকমলই হবে, কারণ এ-রকম চেহারার মানুষ দেখলে আমার কেন জানি রাইকমল নামটাই মনে হয়। সাদা পাথরে মিষ্টি সাজানো, সাদা পাথরের গেলাসে জল। তিনি হাত জোড় করে আছেন। রাইকমল সন্তর্পণে খাবার নামিয়ে রাখল। বললাম, আমি খেয়ে এয়েছি দাদু।
—দাদু না, দাদু না। বাবাঠাকুর বিরাগ হবেন।
অগত্যা বললাম, খাব না। খেয়ে বের হয়েছি। কপাল কাকে বলে। এক সময় না খেতে পেলে শসা চুরি করে এনেছে পিলু। দুজনে ভাগ করে খেয়েছি। এখন চারপাশে কত প্রাচুর্য! এতেও কেমন মাথাটা ঘুরে যায়। বললাম, খাব না। খেয়ে বের হয়েছি।
মিমি আমায় খোঁচা মারল তখন।
কী ব্যাপার বোঝলাম না। তাকালে মনে হল মিমি এই নিয়ে কথা বাড়াতে বারণ করছে। সে আমার হয়ে বলল, তুমি যাও না দাদু। ঠিক খাবে। আমি খাইয়ে ছাড়ব।
রায়বাহাদুর উঠে গেলেন সিঁড়ি ধরে।
—দাও দেখি।
—দেব? কিন্তু আমার কথাটা।
—হবে।
—আচ্ছা তোমার দাদু আমার সঙ্গে এমন কেন করেন বল তো?
বাড়ির গুরুদেবের তুমি চেলা। একটু করবে। আমাদের বাড়িতে ওঁর ফটো আছে। সন্ধ্যায় কীর্তন হয় জান। সবাইকে বসতে হয়। স্তোত্র পাঠ করতে হয়। তাঁর সন্দর্শনে বছরে এক দু’বার যাবার নিয়ম। কারণ দাদু এত বেশি যেতেন, যে বাবাঠাকুর কড়ার করে দিয়েছিলেন শুধু একদিন, যেদিন গান বাজনার আসর বসবে, সেদিন, অষ্টমীতে হয়। দেখবে বড় বড় ওস্তাদ আসবে মন্দিরে। সারা রাত গান। মাইক বাজবে।
পূজার পরে আমার আসা। আর এক পুজা এবারে এসে গেল। গতবারের অষ্টমী দেখা হয়নি। এবারে দেখা হবে, সেদিনই কী তবে আমার অভিষেকের পালা। বুকটা গুড়গুড় করতে থাকে। ডাকলাম, মিমি!
—বল।
—আমার কথাটা।
—বলেছি। কিন্তু মাস্টারমশাইর ইচ্ছে……
—এই রে হয়ে গেল!
মাস্টারমশাই অর্থাৎ আমার মানুকাকার ইচ্ছে, তাঁর ইচ্ছে মানেই আমার বাবার ইচ্ছে, আমার মার ইচ্ছে, আমার আর নিজের ইচ্ছের বুঝি তবে দাম থাকল না।
—তাহলে তুমি আমাকে দিয়ে কবিতা লেখালে কেন?
—কবিতাটা দেখি আগে।
—এই দেখ না। আমি মিছে কথা বলছি ভাবছ।
—তা বলতেই পার। না বলে না কয়ে টাকা যে নিতে পারে, সে সব পারে।
কবিতাটা সাক্ষী প্রমাণের মতো তুলে ধরলাম— মিছে কথা বলি নি।
কবিতা পড়ে মিমি অবাক চোখে তাকাল। বলল, অসামান্য।
—অসামান্য মানে!
—অসামান্য মানে অসামান্য।
—এবারে বলবে ত!
—দেখি।
মিমি দোহাই আর দেখি না। কাজে নেমে পড়। আমার চোখ কাতর। কাতর চোখ দেখলে মিমির মধ্যে বোধহয় মেঘদূত উড়তে থাকে। সে ওঠার সময় বলল, বলব, বলব। তুমি প্রাণের ঠাকুর না বলে পারি।
বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। আমি সত্যি কি প্রাণের ঠাকুর। লক্ষ্মীও মাঝে মাঝে ঠাকুর বলে। ঠাকুর বলার মধ্যে যে এত বড় ম্যাজিক থাকে আগে যদি বুঝতে পারতাম! বললাম, মিমি তাহলে যাই।
মিমি আমার হস্তাক্ষর দেখছিল। কেমন মুহ্যমান অবস্থা। সেই যক্ষের বার্তাবহ, যেন কার স্তনবৃত্তের ক্ষত বিন্দু বিন্দু বারি বর্ষণে শান্তি লাভ। এরই মধ্যে কী সেই ইচ্ছেটা মিমির মধ্যে জাগছে।
উঠে পড়লে মিমি কাছে এল। বলল, তুমি এত সুন্দর বিলু। বলেই কথা নেই বার্তা নেই আমাকে চকাস করে চুমু খেল।
বললাম, ছিঃ ছিঃ এটা কী করলে!
—কী করেছি। কী সুন্দর কবিতা।
—কেউ দেখে ফেললে।
—দেখুক না। আমি অষ্টমীর দিনে যাব। জ্যোৎস্না রাত। দুজনে রেল-লাইন ধরে হেঁটে যাব। আর গান হবে, আয়ে না বালম।
আমারও কেমন একটা ইচ্ছে ইচ্ছে ভাব। না বলতে পারি না। চুরি করে খাবার সখ সব সময়- লোকলজ্জা মিমির নেই। বড়লোকের মেয়েদের বুঝি লোকলজ্জা থাকতে নেই। তাছাড়া আমি এ- বাড়ির এখন অন্দরের মানুষ। মিমি আমাকে নিয়ে উপরে গেল, সব দেখাল। মিমিদের দেয়ালে দেয়ালে হরিণের ছাল, বাঘের ছাল, মুণ্ডু, শিকারী রায়বাহাদুরের এক কালের শিকারের সাক্ষী এ সব। সেই শিকারী আমার মতো একটা ছিঁচকে চোরকে গুরুদেবের ডামি ভেবে মিমিকে নির্ভাবনায় ছেড়ে দিয়েছে। চোর ছ্যাঁচোড়ের লজ্জা থাকতে পারে না। মিমিও নিশ্চিন্তে তাই আমাকে জড়িয়ে চুমু খেল। পুষ্ট স্তনে মিমি টের পাবে সেই এক ক্ষত। মেঘদূত যদি বারিবর্ষণ করে তবে তার নিরাময় হবার সম্ভাবনা তা আমার যৌবন তার সেই বারিবর্ষণ। আমি যত বড় হব তত মিমিরা আকুল হবে। বড় হওয়ার মানে বুঝি এই বারিবর্ষণ। তবে আমার বড় হওয়াটা এই একটা হেতুতে মিমির কাছে আটকে পড়েছে।
মিমির চুমু খাওয়ার আকস্মিকতায় আমি কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। মিমি সহজেই লাফিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে পারল, উপরে উঠে যেতে পারল। আমি পারলাম না। এত বিচলিত যে মিমি কী বলছে ঠিক কানে আসছে না। এইমাত্র সংগোপনে মিমি যা করল তাতে আমার চোখ জ্বালা করছে। আমি কেমন একটা ভ্যাবলুকান্ত বনে গেলাম। সে যা যা বলল সবই আমি করব এমনও স্বীকার করে ফেললাম। আমার সত্তা সহজে গ্রাস করে ফেলা মিমির পক্ষে সম্ভব। কারণ আমি একজন উঠতি তরুণ। তা- ছাড়া ছিন্নমূল পিতার সন্তান। পরের বাড়িতে আশ্রিত।
মিমি বলল, কী মনে থাকবে?
—থাকবে।
—অষ্টমীর দিন।
—হ্যাঁ অষ্টমীর দিন। আমার কথাটা।
—অষ্টমীর দিনটা যাক।
আমার এ-সময় আর কিছু মনে থাকল না। অষ্টমীর দিন, মিমির সঙ্গে জ্যোৎস্না রাতে ঘুরতে হবে পুজোমণ্ডপে না, রেলের ধারে! চারপাশে মানুষজন গিজগিজ করবে। ঢাক বাজবে, ঢোল বাজবে। আর মাইকে মন্দিরে গানের আসর চলবে। শহরের বনেদী লোকেরা আসবে পরিজনসহ গান শুনতে। মিমিরাও আসবে। ওর কথামত কাজ না করলে সে বিগড়ে যেতে পারে। রাজি না হওয়া ছাড়া আমার উপায় কি।
ফিরতে বেশ বেলা হল। এসময় বাড়িতে লক্ষ্মীর দেখা পেলাম না। রান্নাবাড়িতে কাজকর্মে ব্যস্ত থাকতে পারে। নটু বলল, স্যার আপনার বাবা এয়েছিলেন?
—বাবা এয়েছিলেন। কেন?
—সে তো জানি না।
নটু ফের বলল, বাবার সঙ্গে কি সব কথা হল।
—শুনিস নি?
–না।
বিষয়টা পাকাপোক্ত হয়ে যাচ্ছে। আমার রেহাই নেই। কবে যে অষ্টমী আসবে?
মন মেজাজ ভাল নেই। খেতে বসে ভাল মতো খেতে পারলাম না। বিকেলে বৌদিকে বললাম, বাড়ি যাব। আজ ফিরছি না।
বাড়িতে বাবাকে পাওয়া গেল না। না পাবারই কথা। সংসারে তাঁর মতো ব্যস্ত লোকের পক্ষে বাড়িতে আটকে থাকা পোষায় না। মা বলল, কার নতুন গাছে বাতাবি লেবু হয়েছে, তাই খাওয়াবে বলে নিয়ে গেছে। গাছটার কলম বোধহয় বাবাই করে দিয়েছিলেন। গাছের প্রথম ফল, সেই সঙ্গে ফলাহার। মানুষের সঙ্গে তাঁর এত সদ্ভাব যে তিনি না করতে পারেন না। তিনি আজ ফিরবেন কিনা, এই প্রশ্ন করা দরকার।
পিলু বলল, বাবা নাও ফিরতে পারেন।
—পিলু তুই জানিস বাবা আজ কালীবাড়ি গেছিলেন সকালে।
মা বলল, গিয়েছে তো কী হয়েছে। রোজ খবর পাঠালে না গিয়ে পারে?
—কেন গেছিলেন জান? আর খবরই বা এত কিসের। মা বলল, কী জানি, তোর মানুকাকা এয়েছিল। কী সব পরামর্শ করছিল।
—যাই করুক, আমি বলে দিলাম, কিছু করব না।
মা খুব হতভম্ব হয়ে গেল। বাড়ি এলে কখনও মেজাজ দেখাই না, কিংবা এমনিতেও আমি নাকি চাপা স্বভাবের ছেলে, তার পক্ষে উগ্র মেজাজ দেখানোটা মার কাছে বিভ্রান্তিকর। মা বলল, তোর হয়েছেটা কী!
বলতে পারি না, কারণ বিষয়টা নিয়ে আসলে কেউ কোনো কথাবার্তা বলছে কি না তাও তো জানি না। কিন্তু হয়ে গেলে কিছু করারও থাকবে না। কারণ আমার নিজস্ব মত আছে একটা, বাবা, কাকা বিশ্বাসই করতে পারবেন না। ওঁরা অভিভাবক, আমার ভালমন্দ ওঁরাই বুঝবেন। আমি কী করব না করব ওঁরা ঠিক করবেন। আমার একটাই পথ, দেশান্তরী হওয়া তখন। কিন্তু বার বার দেশান্তরী হলে কিছুই ঠিকমতো করা যায় না। আর কিছু না হোক আমার গ্র্যাজুয়েট হওয়াটা একান্ত দরকার। সেটা হলে কিছুটা মানুষের কাছাকাছি যাওয়া যাবে। আর মিমি বলেছে, আমার ওটা নাকি সত্যি কবিতা হয়েছে। তবু আমি এমন একখানা মানুষ, নিজের চেয়ে পরের মতামতকে বেশি প্রশ্রয় দিই। মিমির মতামতকে অবিশ্বাস করতে পারি না। ফলে জীবনে কবিতা লেখার দুঃসাহস জেগে গেছে।
বাবা রাতেই ফিরলেন। আমাকে দেখে বললেন, কখন এলি।
—বিকেলে।
—গেছিলাম হরিষের বাড়ি।
কোথায় তিনি গেছিলেন আমি জানতে চাই না। কালীবাড়ি কেন হুট করে গিয়ে হাজির তাই জানতে চাই। শত হলেও বাবা, গুরুজন, কেন গেছিলেন প্রশ্ন করতে পারি না। কথাটাকে কিভাবে ঘুরিয়ে বলা যায়, কীভাবে শোভন হবে এমন ভাবতে ভাবতেই অনেকটা সময় কেটে গেল। সকালবেলায় কাজের মানুষ বাবা বের হয়ে যেতে কতক্ষণ। বললাম, আপনি কালীবাড়ি গেছিলেন?
—হ্যাঁ।
কী করতে বলি কি করে। চুপ মেরে গেলাম।
বাবা তাঁর পুত্রের স্বভাব জানেন। পুত্র দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন করতে দ্বিধা বোধ করছে ভেবেই যেন বলা, তোমার মানুকাকা বলে গেলেন একবার যেন যাই। শত হলেও তুমি ওখানটায় আছ, আমার একবারও যাওয়া হয়নি। গেলে তিনি খুব খুশি হবেন ভেবেই যাওয়া।
আপনাদের কি কথা হয়েছে বলি কি করে! বললে কতটা বেয়াদপি হবে আমি জানি। আমার চেয়ে পিলু সেটা বেশি জানে। দাদাটা কী। বাবা কী করতে গেছিলেন জানতে চায়। দাদা তো কখনও বাবার মুখের উপর কথা বলতে পারে না। পারে না বলেই ভীরু কাপুরুষের মতো কেবল পালায়! বাবাই বললেন, আমাদের অনেক খবরাখবর নিলেন। তোর খুব প্রশংসা করলেন। তোকে নিয়ে আমি কী ভাবছি জানতে চাইলেন।
—আর কিছু না।
—আর তেমন কিছু তো বলেন নি। প্রসাদ এল খেলাম। বাড়ির জন্য দিয়েছে। মানুষটি বড় সজ্জন।
বাবা কেমন উদাস চোখে আমার দিকে তাকালেন এবার, তোমার কী কিছু হয়েছে?
—কী হবে?
—এই অসুখ বিসুখ!
বুঝলাম একটু সামান্য ট্যারা কথাতেই বাবা আমার মধ্যে কোন অসুখের খোঁজ পেয়েছেন। আর বেশি কিছু বলা আমার পক্ষে আরও কঠিন। চুপচাপ বাড়ি থেকে বের হয়ে নবমী বুড়ির জঙ্গলের দিকে এগোলাম। পিলু আমাকে বনটা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। কুকুরটা সঙ্গে আসে। নবমী বুড়ির বনটাই পিলু আর আমার মধ্যে বিচ্ছেদ টেনে দেয়। দুজন দু-পাশে থাকি। পিলু রহস্যময় খবর থাকলে আমাকে বলে। সেও এবারে তেমন বেশি কিছু বলল না। এখন মিমি ভরসা ছাড়া আমার আর কোন উপায় রইল না।
সেদিন কলেজ করে বাড়ি ফিরছি। একটু দেরি হয়েছে ফিরতে। জানি লক্ষ্মী বার বার এসে দাঁড়াবে রাস্তায়। পূজার ছুটি হয়ে গেল বলে ঘুরে ফিরে এসেছি। নিরঞ্জন আজ চা খাওয়াল। নিরঞ্জন, নিখিল, প্রশান্ত ছুটি হয়ে গেল বলে একটি দুঃসাহসিক কাজ করেছে। কারবালার দিকটায় আমরা চারজনেই গেছি। পকেটে আমাদের একটা সিগারেট এবং একটা কাঠিসহ দেশলাই। কার পকেটে থাকবে সেই নিয়ে কিছুক্ষণ দুশ্চিন্তা গেছে। নিখিল বরাবরই গোঁয়ার। সেই ভার নিয়েছিল শেষপর্যন্ত। ঘন বনের মধ্যে ঢুকে সিগারেটে টান এবং কিছুক্ষণ খকখক করে কাশি এবং এতবড় নিষিদ্ধ কাজ গোপনে সেরে ফেরা। কম কথা না। দেরি একটু বেশিই হয়েছে। সাঁজ লাগার সময়। দরজা খুলে ঘরে ঢুকতে দেখি লক্ষ্মী দাঁড়িয়ে। পুজোর নতুন শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে। শাড়ি কুচি দিয়ে পরা। ব্লাউজ গায়ে। চুল খোঁপা করে বাঁধা। খুব কাছে গেলে লক্ষ্য করা যায় চুরি করে মুখে সামান্য পাউডারও মেখেছে।
আমি দেখে অবাক। বললাম, কী সুন্দর তুমি লক্ষ্মী। তারপরই মনে হল কথাটা বলা ঠিক না। মিমির আকস্মিক আচরণের পর কেমন একটা অপরাধ বোধে লক্ষ্মীর সঙ্গে এতদিন ভাল করে কথা বলতেও পারিনি। লক্ষ্মীও কেমন নিস্তেজ হয়ে গেছে যেন। আর চোপা করে না। চুপচাপ সারাদিন কাজ করে যায়।
সেই সুন্দর হাসিটিও লক্ষ্মীর মিলিয়ে গেছে। পুজোর আর বাকি নেই। শরৎ কালের আকাশ— এই বৃষ্টি, এই রোদ, এমনই ছিল তার মেজাজ। এখন শুধু মেঘটুকু আছে, রোদের উজ্জ্বলতা হারিয়েছে লক্ষ্মী। লক্ষ্মী কি আমার ভেতরের দ্বন্দ্ব বুঝতে পেরেছে। সে তো আমার মুখ দেখে সব বুঝতে পারে বলেছে। মিমির আকস্মিক আচরণও কী লক্ষ্মী টের পেয়ে গেছে। কিন্তু ভেতরে এমন একটা পাপবোধ খেলা করে বেড়ালে সহজভাবে কথাও বলা যায় না। আমিও যেন লক্ষ্মীকে কিছুটা এড়িয়ে যেতে থাকলাম। আগে ওর সঙ্গে ঝগড়া করলে এড়িয়ে যাওয়া ছিল এক রকমের—এখন অন্য রকমের। লক্ষ্মীকে ক’দিন লক্ষ্য করলাম, বিকেলে সে আজকাল সাজগোজ করতে ভালবাসে। তার পক্ষে সাজগোজ করা বেমানান। সে যেন পারলে পায়ে আলতা পরতেও চায়। লোকনিন্দা ভয়ে সে সেটা পরে না। কখনও একা একা দাঁড়িয়ে থাকে মন্দিরের সামনে।
একদিন বললাম, লক্ষ্মী অষ্টমীর দিন শুনছি গান বাজনা হবে। বড় বড় ওস্তাদরা আসবেন! সবাই বাবাঠাকুরের ভক্ত।
লক্ষ্মী বলল, হবে। আর কিছু না বলে তাকিয়ে থাকল মাটির দিকে।
—খুব আনন্দ করা যাবে, কী বল।
লক্ষ্মী তাকাল না আমার দিকে। যেন অন্য কাউকে বলছে, অষ্টমীর দিন আমাকে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যাবে? আমি নটু পটু তোমার সঙ্গে ঠাকুর দেখব।
এইরে বলে কী মেয়েটা। সঙ্গে সঙ্গে বললাম, লক্ষ্মী তুমি জান আমার বাবার সঙ্গে বদরিদার কী কথা হয়েছে?
—না তো। আমি রান্নাবাড়িতে জল তুলছিলাম। তোমার বাবা এয়েছেন শুনে একবার ছুটে গিয়েছিলাম। দাদা যে ধমক লাগালো তোর এখানে কীরে। আর থাকা যায় মাস্টার বল!
এরপর সত্যি থাকা যায় কী করে। পুজো আসছে, অথচ মনটা ভালো নেই। সব বিস্বাদ লাগছে। বন্ধুদের সব খুলে বললে যেন ভাল হত। ওরা পরামর্শ দিতে পারত। ছুটি হয়ে গেছে, সবাইকে এক সঙ্গে পাওয়া যাবে না। একমাত্র লালদিঘির ধারে প্রশান্তর কাছে যেতে পারি। কিন্তু যা নিয়ে পরামর্শ করব তার কোনো ভিত্তিই খুঁজে পাচ্ছি না। আমাকে এখন পর্যন্ত কেউ বলেইনি, তোমাকে মন্দিরের পুরোহিত করা হবে। সবটাই আন্দাজে। পুজোর সময় এলে কী যে আনন্দ, চারপাশের গাছপালা মানুষজন দেখেই টের পাওয়া যায় পূজা এসে গেছে। এবারে ক্রমেই সেটা কেমন বিস্বাদে পরিণত হতে থাকল।
লক্ষ্মী ফের বলল, মাস্টার যাবে ত।
কী যে বলি। দু’জন দুরকমভাবে আমাকে কব্জা করতে চায়। মিমির সুযোগ বেশি। মন্দিরের চাতালে গানের আসর। লোকজন ভর্তি চারপাশটা। আলো জ্বলবে সারা রাস্তায়। মানুষজন গভীর রাত পর্যন্ত চলাচল করবে। মিমি অনায়াসে আমাকে নিয়ে এক ফাঁকে রেল-লাইন ধরে হাঁটতে শুরু করতেই পারে। অষ্টমী পুজো বলে কথা। রাতে বিরেতে নারী পুরুষ একসঙ্গে হাঁটতে শুরু করতে পারে। লক্ষ্মীকে কী বলব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।
—বুঝতে পারছি তোমার ইচ্ছে নেই মাস্টার।
—থাকবে না কেন! তবে কি জান—
ঠিক আছে, জানতে চাই না। বলে লক্ষ্মী মন্দিরের চাতালে উঠে গেল।
আর অষ্টমী পুজোর দিনই সেই লোমহর্ষক ঘটনা ঘটল। আসরে মানুষজন গিজগিজ করছে। উচ্চাঙ্গ সংগীত—এর তাল লয় আমি কিছু ঠিক বুঝি না। নটু পটু ওদিকটায় যায় নি। তবু শহর থেকে এয়েছে সব বনেদি মানুষেরা। রাস্তার সামনে গাড়ি রিকশা সব দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে দোকানপাটও বসে গেছে। চিনাবাদাম ভাজা বিক্রি হচ্ছে। এবং হরেকরকম খাবার। লোকজন রেললাইন ধরে উঠে আসছে, ঠাকুর দেখতে বের হয়ে, একবার এখানটায় দাঁড়িয়ে যাচ্ছে সবাই।
নটু পটু শুয়ে পড়েছে। ভিতর বাড়িতে কেউ নেই, ফাঁকা। কেবল, নটুর পিসি বারান্দায় বসে আছে। মন্দির চত্বরে ফরাস পাতা। তবলা ডুগি হারমোনিয়াম তানপুরা আরও কত সব বাদ্যযন্ত্র। মাথায় টুপি সিল্কের পাঞ্জাবি গায় মুখে পান সহ সব ওস্তাদ গাইয়েরা সামনে। আমি ওদিকটায় যাবই না ঠিক করেছি। কারণ ও-সব গান আমার ভাল লাগে না। মিমিরা এসেছে। সে যেন আমাকে দেখে প্রথম চিনতেই পারল না। ওর দাদু বরং বললেন, আসুন বসে পড়িগে। লোকটা আমার এমন পেছনে লাগল কেন বুঝতে পারি না। বাবাঠাকুর তো আমার খোঁজ করছেন না, তোমার অত মাথা ব্যথা কেন?
গান খুব জমে উঠছে। খেয়াল হবে। ঠুংরিও হতে পারে। সে যাই হোক আমার কিছু আসে যায় না।
নিজের ঘরে মিমির অপেক্ষাতে বসে আছি। সে আসবে। এই কামনা আমাকে কেমন কিঞ্চিৎ উতলা করে তুলছে। অথচ এসে যে-ভাবে আমাকে অবজ্ঞা দেখাল, তাতে করে বেশি আশা করাও ভাল না। দুটো কারণে আমার প্রতীক্ষা, এক, মিমি কাজটার কতদূর এগোল, দুই, মিমি রেললাইন ধরে হেঁটে যাব বলতে কি বোঝাতে চায়। তা ছাড়া ওর বাবা মা, দাদু লোকলজ্জা মান সম্মানের প্রশ্নও আছে। তবু কিসের লোভে যেন আমার চুপচাপ একা একা বসে থাকা। একবার মন্দির প্রাঙ্গণে ঢুকে দেখলাম, লক্ষ্মী বৌদির পাশে বসে গান শুনছে। গান শুনছে না, মন্দিরে হত্যা দিয়েছে! চোখ দেখলেও বোঝা যায় যেন ইহজগতে নেই কিংবা কত যেন মগ্ন সে। দূরে দাঁড়িয়ে দরজা থেকে আর দেখলাম মিমি ওর দাদুর পাশে নেই। বুকটা আমার ছাঁত করে উঠল। তাড়াতাড়ি রাস্তায় নেমে আমার ঘরের বারান্দায় উঠে এলাম। দেখলাম মিমি দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কাঁপছিলাম।
মিমি বলল, এই মাস্টার যাবে?
মিমিকে বললাম, তুমি বলেছ?
মিমি বলল, এস না যাই। বলে লাফিয়ে রাস্তায় নামল।
আমার শরীরে কী যে কাঁপুনি। দাঁত ঠকঠক করছে। আমি কোনরকমে বললাম, মিমি, আমার কথার কী হল।
মিমি আবার আমার হাত টেনে ধরল, এস না।
আমি বললাম, শোন মিমি, তুমি কী চাও আমি জানি না। কিন্তু…।
মিমি আমাকে কথা বলতে না দিয়ে সোজা রেললাইনে উঠে গেল। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। একটা মেয়ের এত দুর্জয় সাহস হয় কী করে! পেছনে ছুটে গেলাম, শোনো মিমি, যেও না।
মিমি বলল, যাব। যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাব। তুমি আস না আস যাব।
রেললাইন ধরে পূজা দেখতে যারা যাচ্ছে তাদের সংখ্যা ক্রমে কমে আসছিল। এত রাতে মিমি কিছু একটা যদি করে বসে। বাড়িতে এমন কী কিছু ঘটেছে, নাকি পাগলের মতো সে উদভ্রান্ত হয়ে গেছে। শরীরের শিরা উপশিরায় উষ্ণতা খেলা করে বেড়ালে এমন হতেই পারে। দৌড়ে গেলাম। পাশে যেতেই বলল, বোস মাস্টার।
—কিন্তু কেউ যদি খোঁজ করে?
—কেউ করবে না, সবাই জানে আমি ভিতর বাড়িতে শুতে চলে গেছি।
—কেউ তবু জানতে পারে। তুমি কি চাও বল! এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক না।
—কী সুন্দর আকাশ।
—আচ্ছা মিমি, এতরাতে কাব্য করার সময়!
—মাস্টার, তোমার কিছু হয় না?
—কী হবে।
–এই যে সুন্দর রাত—এমন কিছু যা তোমাকে পাগল করে দেয় মাঝে মাঝে।
—মিমি, এখন ওঠ। আমার ভয় করছে। আমি আশ্রিত জন।
মিমি হা হা করে হেসে উঠল।
পাশাপাশি দুজনে বসে আছি। সামনে মন্দির। গান ভেসে আসছে। আর তার শব্দমালা তান লয় বড় মধুর। আমার মধ্যে যে কাঁপুনি ভাবটা ছিল সেটা কমে গেছে। এত আলো যে দিনের মত লাগছে। তবু নিরিবিলির কারণ যে রাত গভীর। মিমি কেমন শুয়ে পড়তে চাইছে। আমার হাত টেনে বলছে, কী ঠান্ডা হাত তোমার। তোমাকে মন্দিরের পুরোহিতই মানায়।
মিমির পাগলামি আমার ভাল লাগছিল না। বড়ঘরের মেয়েরা বরং পর্দার আড়ালেই থাকে। কিন্তু আধুনিকতা এক পুরুষের, বোধ হয় মিমিকে খ্যাপা বানিয়ে দিয়েছে। মিমির পক্ষে শোভা পেলেও আমার পক্ষে শোভা পায় না। মেয়েরা এক একজন এক এক রকমের। লক্ষ্মী কোনোদিন ও ধরনের জেদ ধরতে সাহসই পেত না।
সহসা মিমি উঠে দাঁড়াল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখছ কে গেল!
—কে!
—দেখ না। ঐ যে চলে যাচ্ছে।
ছায়ার মতো কেউ জঙ্গলের মধ্যে নেমে গেল।
মিমি ওঠো আমি চললাম। মিমি হাত ধরে ফের হ্যাঁচকা টান মেরে আমাকে তার সংলগ্ন করে ফেলল। এবং আমার কী হল জানি না। আমিও কেমন পাগলের মতো মিমিকে পাশের একটা গাছের আড়ালে টেনে নিয়ে গেলাম সঙ্গে সঙ্গে। তারপর সেই যে ভাল লাগে না বোধ, আমার মধ্যে নতুন করে এক ঝড়ের সংকেত তুলে দিয়েছিল, মুহূর্তে তা মহাপ্রলয়ের রূপ নিতেই মিমির কাতর গলা, না মাস্টার না আর না। আমি পারব না। তুমি গাছের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক। আমাকে লতার মতো জড়িয়ে রাখ। আর কিছু না।
এক হ্যাঁচকায় আমি ছুঁড়ে দিলাম মিমিকে। গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকার আমার সাধ্য নেই। মিমি কী চায়? আমাকে যা খুশি তাই করবে! কেমন এক ঘৃণাতে আমার চোখ জ্বালা করতে লাগল। দৌড়ে সোজা জঙ্গলের পথ ধরে নিজের ঘরে এসে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে সেই হাহাকার খবর আমার কানে এসে পৌঁছাল। ভিতর বাড়িতে ছুটোছুটি- কে যেন কাকে ডাকতে যাচ্ছে। পটু এসে ডাকছে স্যার শিগগির আসুন। লক্ষ্মীদি বিষ খেয়েছে। সেই দাবদাহের মতন খবর কেমন আমাকে মুহূর্তে পঙ্গু করে ফেলল। আমি নড়তে পারছিলাম না। কেবল বললাম লক্ষ্মী এটা তুমি কী করলে! পটু খবরটা দিয়েই ভেতরে চলে গেল। আমার যেন কোনো দিশা নেই। হতভাগ্য যুবক আমি। লক্ষ্মীর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ভয় হচ্ছে। আমার মঙ্গল হবে ভেবেই কী সে চলে যাবে ঠিক করেছে। ছুটে গেলাম। ডাক্তার ডাকতে সুজন চলে গেছে সাইকেলে। লক্ষ্মীর দরজা ভাঙা। ভিতরে লক্ষ্মী পুজোর শাড়ি পরে শুয়ে আছে। পায়ে আলতা। মাথায় সিঁদুর। চোখ দুটো আধবোজা। ঠোটের কোণে সেই বিষণ্ণ হাসিটুকু। আমার আর দাঁড়াবার সাহস থাকল না। আমি ফিরে যাচ্ছিলাম ঠিক কিন্তু জানি পায়ে আমার আর এতটুকু জোর নেই। একটা মেয়ে একজন মানুষকে মরে গিয়ে এমন পঙ্গু করে দিতে পারে জীবনে এই প্রথম এটা টের পেলাম।
.
পুলিস, হাসপাতাল, মর্গ এবং দাহ এই নিয়ে দুটো দিন কেটে গেল আমার। লক্ষ্মী নেই। বদরিদার সঙ্গে আমিও যেখানে যাবার গেছি। বাবাঠাকুর দেবীর ঘরে শুয়ে থাকেন। বের হন না। দেবস্থান লক্ষ্মী বিহনে কেমন কাঙাল হয়ে গেল। ভেতরের শোকতাপ ধরা পড়ে যায় ভেবে খুব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছি। আমি তো লক্ষ্মীর কেউ না। লক্ষ্মীর জন্য আমার শোকতাপ শোভা পায় না। কিন্তু হলে কি হবে, খাবার সময় খেতে পারছি না, শোবার সময় শুতে পারছি না। নিজের ভেতরে নিজে ছটফট করে মরছি। শুলেও ঘুম আসছে না। আর কেমন ভয় ভয় লাগছে। জানালা বন্ধ করে শুই-তবু যেন রাতে লক্ষ্মী এসে পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘুম এলে ভেঙে যায়—দুঃস্বপ্ন দেখে ধড়ফড় করে উঠে বসি। কেমন ঘামতে থাকি। ঘুমের মধ্যে লক্ষ্মী যেন আরও বেশি পেয়ে বসে আমাকে। সে আমকে পুঁটলি খুলে দেখায়—এই দেখ মাস্টার—দেখতে পাই, সেই ইঁচড়, করমচা, কাগজি লেবু আর তার পাশে কচি কলাপাতায় মোড়া কাটা এক ছাগশিশুর মুন্ডু। মুন্ডুটা ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে আমার দিকে। চিৎকার করে উঠি, সরাও, সরাও ওগুলো। লক্ষ্মী হেসে বলে, কেন ভয় পাও? তারপর আরও জোরে হেসে ওঠে।—এই মিলে আমি মাস্টার। ভয় পাও কেন? আমি তো কারো কোন অনিষ্ট করি নি। তাহলে আমি কেন সারাজীবন একা হয়ে থাকব।
সকালে নটুই ভিতর বাড়িতে খবর দিল, মাস্টারমশায় ঘুমের মধ্যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। বৌদি আমাকে ডেকে বললেন, তোর কি হয়েছে রে?
—কিছু হয়নি ত?
—রাতে নাকি চিৎকার করিস। কাঁদিস?
—কাঁদব কেন? মিছে কথা। হতেই পারে, দুঃস্বপ্ন দেখে আমি হয়তো চিৎকার করি। কিংবা বোবায় ধরতে পারে। দুঃস্বপ্নটা দেখার পর আমি যে আর ঘুমাতে পারি না কাউকে বলাও যায় না।
তখনই বৌদি বললেন, দুদিনে কি চেহারা করেছিস। খেতে বসলে খেতে পারিস না। তুই কি ভয় পাস।
আমি কিছু বলছি না দেখে বললেন, ভয়ের কি আছে। দেবস্থানে আছিস, কোন অশুভ প্রভাব এখানে ঢুকতে পারে না। তা-ছাড়া বাবাঠাকুর একা পড়ে থাকেন, কই তিনি তো ভয় পান না। তুই পুরুষ মানুষ, তোর এত ভয় থাকবে কেন।
আমি পুরুষ মানুষ, আমার ভয় থাকবে কেন—বৌদি ঠিকই বলেছেন। তা ছাড়া দেবস্থানে অপমৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু সব সমান। তবু কি করে বোঝাই, অন্ধকার হলেই মনে হয় লক্ষ্মী আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে। নড়ছে না। যত বলি, যাও, তত বলে, তোমার বাড়ি তোমার ঘর! আমি যাব কেন।
লক্ষ্মী মরে গিয়ে আমাকে ভারি ফ্যাসাদে ফেলে গেল। শোক প্রকাশ করতে পারলে মন হালকা হয়। সে সুযোগ নেই। ফলে আমি ঘুম নাওয়া খাওয়ার কথা কেমন ভুলে যেতে থাকলাম। বৌদি কেমন ভয় পেয়ে একদিন কাছে ডেকে বললেন, বিলু তুই বাড়ি যা। মা বাবার সঙ্গে থাকলে মনটা হালকা হবে।
এতদিন যেন মনেই ছিল না, আমার বাড়িঘর আছে। বাবা মা আছে। পিলুর মতো ভাই আছে। বিকেলেই বাড়ি রওনা হলাম। এই রাস্তা দিয়ে কতবার যাওয়া আসা করেছি। আগের মতো সবই ঠিকঠাক আছে। সেই কাশফুলের মাঠ, সেই কারবালার সড়ক, সেই দেবদারু গাছ, এবং ইঁটের ভাটা, নবমী বুড়ি—সব সব এক—তবু আমি যেন আলাদা মানুষ। বাড়ি ঢুকতেই মায়া কেমন ত্রাসের গলায় চিৎকার করে উঠল, মা দাদা কি হয়ে গেছে দ্যাখ।
মা ঘর থেকে বের হয়ে কেমন জলে পড়ে গেল। একি চেহারা করেছিস! বাবা বাড়ি নেই, পিলু বাড়ি নেই। আমি ধীরে ধীরে বারান্দায় উঠে বসে পড়লাম। পায়ে যেন এতটুকু আর শক্তি নেই।
মা পাশে বসে বলল, তোর কি হয়েছে? জ্বর। কপালে হাত রেখে বুঝল, জ্বর হয়নি। আবার বলল, বলবি ত কি হয়েছে! চোখ মুখ শুকিয়ে করেছিস কি। মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল, শিগগির তোর বাবাকে ডাক।
মা আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল, আর বলছিল, তোর কোনো অসুখ করেনি ত।
ধীরে ধীরে বললাম, না মা। আমি ভাল আছি।
এই ভাল থাকার লক্ষণ। কেমন গুম মেরে গেছিস।
বললাম, জান লক্ষ্মীটা না মরে গেছে।
—লক্ষ্মী মরে গেছে। বলিস কি!
–বিষ খেয়ে মরে গেছে।
—কি বলছিস তুই। এমন মেয়ে কখনও বিষ খেয়ে মরতে পারে।
—মরল ত!
পিলু বাড়ি ঢুকছে। মা বলল, জানিস লক্ষ্মী নাকি বিষ খেয়ে মরে গেছে।
আমি হাসলাম। বললাম, নাকি বলছ কেন!
পিলু বলল, যা, হতেই পারে না। লক্ষ্মীদি বলেছে আবার আমাকে যেতে। ওদের গাছের কাঁচামিঠে আম রেখে দেবে। আমের দিনে আমি যাব বলে এয়েছি।
বলার ইচ্ছে হল, লক্ষ্মী সবাইকে কথা দিয়ে কথা রাখত। কিন্তু ওকে কথা দিয়ে কেউ কোনো কথা রাখেনি। তাই রাগ করে চলে গেল। বাবা এলেন, শুনলেন। বাবার সেই এক কথা, ভবিতব্য। কিন্তু আমার দিকে তাকিয়ে বোধহয় তিনি আর বেশিক্ষণ ভবিতব্যের উপর ভরসা রাখতে সাহস পেলেন না। আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে বললেন, কতদিন মনে হয় তুমি চান খাওয়া করনি! ঘুমাও নি।
—করেছি ত!
মা বলল, ওর কিছু হয়েছে। এমনভাবে ও কখনও কথা বলে না।
বাবা কি ভাবলেন কে জানে। বললেন, লক্ষ্মীর প্রেতাত্মা কি তোমাকে তাড়া করছে! বাবা এ-সব বোঝেন কি করে জানি না। প্রেতাত্মা তাড়া না করলে, ওকে আমি অন্যমনস্ক হলেই দেখতে পাই কেন। রাতে শুলে মনে হয় মশারির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। গভীর রাতে দুঃস্বপ্ন দেখি। সে পোঁটলা খুলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
বাবা বললেন, রাতে ঘুম হয় না তোমার। ঘুম হলে সব সেরে যাবে।
মা বলল, ওসব শুনছি না। তুমি ওকে শরৎ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও।
মাকে প্রবোধ দিলাম, মিছিমিছি এত ভাবছ কেন বুঝি না।
মা কেমন কেঁদে ফেলল কথা বলতে গিয়ে তুই তো এমন ছিলি নারে।
আমি উঠে ঘরের ভিতরে ঢুকে গেলাম। ভিতরে যাবার সময় শুনলাম, বাবা মাকে বলছেন, অত অধীর হলে চলে না ধনবৌ।
বাবা এবার ভিতরে ঢুকে আমার পাশে বসলেন। কি ভেবে বললেন, তুমি কি আজকাল কোন দুঃস্বপ্ন দেখছ। অপমৃত্যু তেমন ভয়ের কিছু নয়। তবে মানুষের উচিত না, আত্মঘাতী হওয়া। লক্ষ্মী বড় ভুল করেছে। বেঁচে থাকার মতো জীবনে বড় কিছু নেই। এ-জীবন তো আর তুমি দ্বিতীয়বার পাচ্ছ না।
বাবার কথার মধ্যে কেমন অসংগতি ধরা পড়ছে। বাবাই বলেছেন, আত্মার বিনাশ নেই, আবার আজ তিনিই বলছেন, এ-জীবন তো আর তুমি দ্বিতীয়বার পাচ্ছ না। কিন্তু আমার মন ভাল নেই। বাবার সঙ্গে তর্ক করার স্পৃহা নেই। আমি বিছানায় লম্বা হয়ে গেলাম। বাবা ফের বললেন, কি হয়েছে খুলে বল। সব প্রকাশ করতে পারলে হালকা বোধ করবে। মা-বাবার কাছেই একমাত্র সব কথা খুলে বলা যায়।
বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল, আমার অবস্থা দেখে তাঁর মুখও কেমন শুকনো দেখাচ্ছে। এতটা বাবাকে ভেঙে পড়তে কখনও দেখিনি। মা পিলু মায়া দরজায় দাঁড়িয়ে। বাবা বললেন, এই তোরা যা। পিলু মায়া উঠোনে নেমে গেল। এখন পাশে মা বাবা। তবু আমি কিছু বলছি না দেখে বাবা উঠে বের হয়ে গেলেন। মাকে যাবার সময় মনে হয় আমার সম্পর্কে কিছু বলে গেলেন। আর এলেন সন্ধ্যা করে। সঙ্গে নিয়ে এলেন, একটা নিমগাছের চারা। মা ডাকল, যা তোর বাবা ডাকছে।
আমার কিছু ভাল লাগছে না মা।
বাবা ফের ডাকলেন, বয়স হচ্ছে। একা পারি না। আয় না।
এরপর আর শুয়ে থাকতে পারলাম না। বাবা এই প্রথম মনে করিয়ে দিলেন, তাঁর বয়স হচ্ছে। উঠে গেলে বললেন, গাছটা এই কোণায় লাগিয়ে দে। গর্তটা হাঁটু সমান করবি। পিলু এসে আগ বাড়িয়ে করতে গেলে বাবা বাধা দিলেন—সবটাতেই তোর বাড়াবাড়ি। তুই তো অনেক গাছ লাগিয়েছিস। বিলুকে একটা অন্ততঃ গাছ লাগাতে দে। তারপর বাবা নিমগাছের গুণাগুণ বলতে থাকলেন। নিমের হাওয়া ভাল। বাতাসের বীজাণু নাশ করে। নিমপাতার গন্ধে মশার উপদ্রব বাড়তে পারে না। পাকা নিমফল খেতে নানা রকম পাখি উড়ে আসবে বাড়িটায়। নিমের বড় গুণ অশুভ কোন প্রভাব থেকে বাড়িঘরকে রক্ষা করে। তারপর বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, যত্ন করে লাগাও। গাছটা যেন বাঁচে। এতে তোমার কর্মমোচন হবে। গাছটাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব তোমার।
এক হাঁটু গর্ত করার পর বাবাকে বললাম, হয়েছে?
—তুমিই বল হয়েছে কিনা?
—মনে হচ্ছে ঠিকই আছে।
মা একটা হারিকেন নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে। এই অসময়ে আমাকে দিয়ে কেন গাছটা লাগাচ্ছেন মা বুঝতে পারছে না। তবু আমার ত্রাসের চেহারা দেখে বোধহয় এখন বাবার সঙ্গে মা তর্কে প্রবৃত্ত হতে চাইছে না।
গাছটা লাগাবার পর বাবা বললেন, তোমার কিছু বলার থাকলে একে বল। যদি দুঃস্বপ্ন দেখে থাক, একে বল।
পরদিন ভোরে বাবা আমাকে একখন্ড জমি দেখিয়ে বললেন, জমিটা কুপিয়ে ফেল। আগাছা তুলে ফেল।
সারা সকাল আমি কাজটা করলাম। বাবা পিলুকে এদিকে একদম ঘেঁষতে দিতে চাইছেন না।
বাবা বললেন, পালংয়ের বীজ লাগিয়ে দাও। দু’দিন বাদ দিয়ে জল দেবে রোজ। মনে করে কাজটা করবে।
এই প্রথম বাবাকে দেখছি, আমাকে একদন্ড বসতে দিচ্ছেন না। বাড়িটায় যে আগাছা হয়েছে তাও আমাকে দিয়ে তিনি সাফ করালেন। জমিতে মুনিষ চাষ দিতে এলে আমি বাবার সঙ্গে জমির সব আগাছা সাফ করে দিলাম। বাবা এ-কথা সে-কথার ফাঁকে একসময় বললেন, মনে রেখ কাজই হল গে পরমায়ু। বাবা পরদিন আমাকে বললেন, যাও বাজারে। তোমার পছন্দ মতো মাছ কিনে এন। তোমার মা অনেকদিন থেকে বলছে আমসির ডাল খাবে। সেরখানেক মটর ডাল এন।
এ-ভাবে কাজের মধ্যে থাকতে থাকতে এক সকালে আমার মনে হল, আমি আর দুঃস্বপ্ন দেখছি না। সেই প্রেতাত্মার ভয়ও আমার কেমন কেটে গেছে। চোখ মুখ আমার আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। বাবা খেতে বসে বললেন, বা সুন্দর বাজার করেছিস। তুই কি করে জানিস, আমি পটল ভাজা খেতে এত ভালবাসি। এখন তো পটলের সময়ও না।
বাবা পরদিন নিমগাছটার পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকলেন। কাছে গেলে বললেন, গাছটা তোর লেগে গেছে। আর ভয় নেই। এখন আর জল দিতে হবে না। বাবা সেদিনই নিজের বাড়িতে প্রথম শনিপূজার জন্য সওদা করে ফিরলেন। দুধ, চাল কলা নারকেল সব আমি পিলু বাবা একসঙ্গে বাজার থেকে নিয়ে এলাম। মা মায়া এক এক করে সব ঘরে নিয়ে তুলে সাজিয়ে রাখছে। তারপরই পিলুর সেই ডাক- দাদারে যাবি।