মানুষের ঘরবাড়ি (Manusher Ghorbari) – প্রথম খণ্ড – 17
এভাবেই আমি বড় হচ্ছিলাম। আমার মান-সম্মান বোধ এখন নানাভাবে আমাকে বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। লক্ষ্মীর আঁচল নিয়ে কাড়াকাড়ির বিষয়টা মাঝে মাঝে আমাকে এখনও তাড়া করে। থিতু হয়ে কোথাও যেন বসতে পারি না। কেবল মনে হয়, ওটা আমি কী করতে যাচ্ছিলাম। আমরা দু’জনই এ বাড়ির আশ্রিত। কেউ দেখে ফেললে কী না জানি হত।
জানালায় বসে আছি। সামনে বড় একটা নিম গাছ। শীত বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। কুয়াশাচ্ছন্ন সব। সামনের রেল-লাইনের ওপারটা দেখা যাচ্ছে না। সব আবছা মতো হয়ে আছে। আজকাল লক্ষ্মী আবার আমার ঘরে আসছে। সেদিনের সেই সব কথার পর লক্ষ্মী আমাকে কিছুদিন এড়িয়ে চলত। এমনকি ভিতর বাড়িতে জলখাবার দিলে, লক্ষ্মীর গলা পেতাম। মাস্টার তোমার খাবার দেওয়া হয়েছে। ভিতরে গেলে লক্ষ্মীকে দেখতে পেতাম না। সব সময় এদিক ওদিক সে অদৃশ্য হয়ে থাকত। কখনও অভিমানবশে ভিতরে না গেলে নটু পটু আমার জলখাবার নিয়ে আসত। ভারি অভিমানে ভুগতাম। লক্ষ্মীর তো কত কাজ। সে হয়ত সময়ই পাচ্ছে না, দরজার ওপাশ থেকে আমাকে ডেকে দিয়েই অন্য কোন ঘরে ঢুকে গেছে। দেবস্থানে কত রকমের কাজ থাকে। মন্দিরের চাতাল থেকে রান্নাবাড়ি ধোওয়া-মোছার কাজটা লক্ষ্মীর। ঘরে ঘরে ঝাড়পোঁছ দেওয়া, সবার জামাকাপড় কাচা, মায় আমার স্নানের জল তোলার কাজটা সে ইচ্ছে করেই হাতে নিয়ে নিয়েছে। তাকে আমি সব সময় দেখতে পাব আশা করা ঠিক না। তবু আমার মনে হত লক্ষ্মী আমার চোখের সামনে আসতে চাইছে না। দেখা হলে চকিতে, একবার চোখ তুলেই খুব জরুরী কাজের ভান করে তার সরে পড়াটা আমার মান-সম্মানে বড় লাগত। লক্ষ্মীর কাছে বোধহয় আমি খুব ছোট হয়ে গেছি।
এর মধ্যে একদিন লক্ষ্মী আমাকে দেখে ফিক করে হেসে দিয়েছিল। লক্ষ্মীর চোখ এমনিতেই বড়। হাসলে আরও বড় দেখায়। এতে ওর নারী মহিমা বাড়ে সে বুঝতে পারে। আমার ভিতরের কাতর ভাবটা কি লক্ষ্মী টের পেয়ে গেছে! ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছি। চোখে মুখে এমন কোন ভাব কি ফুটে উঠছে? না’লে মজা করে এমন হাসার কী দরকার লক্ষ্মীর। আজ যদি লক্ষ্মী জলখাবার দিতে আসে সেই আশায় বসে আছি।
নটু পটু বড়দিনের ছুটি বলে মাসির বাড়ি গেছে। সামনে পরীক্ষা। পড়ার চাপ খুব। এক দিন ছাত্র পড়াবার কাজটা সকালে নেই বলে নিজের পড়ায় একটু বেশি মনোযোগ দেব ভাবছি। কিন্তু মাথার মধ্যে লক্ষ্মীকে একা পাওয়ার সুযোগটা বড় বেশি দাপাদাপি করছে। পড়ায় মন দিতে পারছি না।
মনে মনে পড়ার চেষ্টা করছি। পাতার পর পাতা উল্টে যাচ্ছি। মাথায় কিছু ঢুকছে না। ঘরে ঢোকার আগে লক্ষ্মী বেশ দুপদাপ শব্দ করে। সে যে আসছে জানান দেয়।
জোরে পড়লে তার দুপদাপ শব্দ শুনতে পাব না। তাই মনে মনে পড়া। এমন একটা বিতিকিচ্ছি চিন্তা মাথায় থাকলে কিছুতেই পড়া হয় না। লক্ষ্মীকে কথাটা বলা দরকার। ও ভুল বুঝলে আমার মনুষ্যত্বে কোথায় যেন লাগে। বার বার লক্ষ্মীর সঙ্গে কিভাবে কথা শুরু করব, কিভাবে বলব, লক্ষ্মী আমি কিন্তু তোমার কথায় ভারি রেগে গিয়ে কাজটা করে ফেলেছিলাম। আমার অন্য কোন ইচ্ছে ছিল না। তুমি আমাকে খারাপ ভেব না। এইসব কথার মধ্যেই মনে হয় ভেতরে আমার কোন খারাপ ইচ্ছে ছিল। এ সময় কেমন অপরাধবোধে আরও ম্রিয়মাণ হয়ে গেলাম। লক্ষ্মী জলখাবার দিতে এলেও কথাটা বলতে পারতাম না। সেই ঘটনার পর থেকে কতবার যে ভেবেছি লক্ষ্মীকে একা পেলে সব বুঝিয়ে বলব। দেখার সঙ্গে কী অন্য কোন ইঙ্গিত ছিল তার কথায়। লক্ষ্মী নিজেকে ছোটজাতের মেয়ে ভাবে। তার দু’বার বিয়ে এবং বৈধব্য দুই ঈশ্বর নির্দিষ্ট। কোন মানুষই তার কপালে সয় না। সে আর আমাকে তার সঙ্গে জড়াতে চায় না। মেয়েটা এখনও তার বালিকা বয়সই পার করতে পারেনি। চোখে মুখে বালিকা বয়সের ছাপ খুব বেশি একটা না থাকলেও বোঝা যায়, বয়সে ও আমার ছোটই হবে। এই বয়সেই লক্ষ্মী জীবনের সেই রহস্য জেনে গেছে। যা ভাবলে আমার চোখ মুখ লাল হয়ে যায়। কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে।
মনে মনে বললাম, আমি তোমাকে আমার সঙ্গে জড়াব কেন। তোমার এত আস্পর্ধা হয় কী করে। তারপরই মনে হল, কথাটা জোর করে বলছি। বাড়ির একজন গৃহশিক্ষকের পক্ষে একজন ঝি- মেয়ের সঙ্গে জড়ানোটা অসমীচীন। সে বোধ আমার প্রকট। ভাবলাম লক্ষ্মীকে সেভাবেই কথা বলব। —তুমি এতটা আশা করলে কী করে। তোমার আস্পর্ধা খুব দেখছি। তারপরই মনে হল, যাই বলি না কেন, ওকে এমন রূঢ় কথা কখনও বলতে পারব না। আমার সে সাহসই নেই। আস্পর্ধা কথাটা বার বার বিড় বিড় করে বকছি। আর বুঝতে পারছি লক্ষ্মীর প্রতি প্রবল এক আকর্ষণ বোধ করছি। মানুষের যে কী হয়! ও কখনও আমার জামা প্যান্ট ঠিকঠাক করে না রাখলে, বই খাতা তুলে তাকে সাজিয়ে না রাখলে কষ্ট পাই। লক্ষ্মী নিজেই যে কাজটা হাতে তুলে নিয়েছিল তা নিয়ে তার আবার অবহেলা কেন। আঁচল কাড়াকাড়ির পর থেকে রোজ কলেজ থেকে ফিরে ভেবেছি, আজ সব কিছু ঠিকঠাক দেখব। আমার পাজামা গেঞ্জি চেয়ারে ভাঁজ করা, আমার লন্ডভন্ড বইয়ের জঙ্গল আর নেই। সব সাজিয়ে গুছিয়ে লক্ষ্মী ছিমছাম করে রেখেছে। ফিরে এসে দেখতাম, না লক্ষ্মী এই ঘরেই ঢোকেনি। লক্ষ্মীর কোন সাড়া শব্দ নেই বাড়িতে। যে মেয়েটা এত চোপা করত সব কাজে সে কেমন ভারি নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। কোথায় অদৃশ্য হয়ে আছে।
আর তখনই মনে হল কেউ আসছে। তাড়াতাড়ি আলোয়ানটা ভাল করে জড়িয়ে নিলাম এবং পাঠ্য বইয়ের ওপর উপুড় হয়ে পড়লাম। বড় মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করছি, কোন বাহ্যজ্ঞান নেই এমন অভিনয় আর বুকে বড় টিপটিপ শব্দ—লক্ষ্মীই হবে। লক্ষ্মী আমার জলখাবার হাতে ঘরে ঢুকছে। আমি তাকাচ্ছি না। কে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে জানি না, পড়াটা ক্রমে আরও জোরে উচ্চস্বরে অন্য এক লয়ে উঠে যাচ্ছে।
লক্ষ্মী ডাকল, মাস্টার তোমার জলখাবার।
—রাখ। এই পর্যন্ত। লক্ষ্মীকে দেখে যে আমি চঞ্চল হয়ে উঠেছি এবং আমার কিছু কথা আছে ওর সঙ্গে ভুলেই গেছি। আসলে এটাই আমার স্বভাব। আবেগ বড় বেশি। যেন লক্ষ্মীকে এখন কিছু বললেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। পড়ার চেয়ে খাওয়াটা আমার বড় নয়, তুমি এখন যাও—অবশ্য সবটাই মনে মনে—লক্ষ্মী গেল না। দাঁড়িয়ে থাকল। হয়ত এক্ষুনি ঝামটা মেরে কথা বলবে, ওঠো ওঠো—কি ছিরি ঘরের। বাড়িতে কে দেখত। কিন্তু লক্ষ্মী কিছু বলছে না। দাঁড়িয়েই আছে। বললাম, লক্ষ্মী তুমি অতি তরলমতি বালিকা। কথাগুলি আমার কানেই কেমন যেন শোনাল। যেন আমি বলছি না, প্রৌঢ় কোন মানুষ কথাটা বলছে। সাধু ভাষা প্রয়োগে কি বেশি সুবিধা, এতে কী কথাবার্তার গুরুত্ব বাড়ে।
লক্ষ্মী বলল, বৌদি বলেছে, শরীর খারাপ, রান্না-বাড়িতেই আজ খেয়ে নেবে।
কেমন আচমকা ঠোক্কর খেলাম। দেবস্থানে দু’ভাবে রান্নার ব্যবস্থা। সরকারী, বেসরকারী। সরকারী রান্না তীর্থযাত্রীদের জন্য। যারা দেবস্থানে মানত দিতে আসে তারা টাকা দিয়ে প্রসাদ পায়। আর বাড়ির মানুষজনের রান্না বৌদি নিজ হাতে করেন। নটু-পটুর ছুটি। শুধু আমারই কলেজ —দশটায় ভাত-ডাল-মাছ।
বৌদির শরীর ভাল না কেন?
সে আমি জানব কি করে?
কি হয়েছে?
আমাকে তরলমতি বললে কেন, বলব না।
তরলমতি বালিকাই তো?
না বলবে না। আমি বালিকা নই।
তবে তুমি কি?
আমি লক্ষ্মী। কেমন গম্ভীর গলায় কথাটা বলল।
এতক্ষণে আমার মধ্যে যে উত্তেজনা ছিল, তা অনেকটা প্রশমন হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবে থাকলে বুঝি সবই গুছিয়ে বলা যায়। বললাম, লক্ষ্মী সেদিন তুমি কী না ভাবলে! তোমার সঙ্গে কথা ছিল।
লক্ষ্মী বলল, কোনদিন।
ঐ তো সেদিন। তুমি ঠিক কিছু ভেবেছ।
ভাবব না! ওভাবে কেউ আঁচল নিয়ে কাড়াকাড়ি করে। আমি মেয়েমানুষ না। তোমার বুদ্ধি- সুদ্ধি কবে হবে মাস্টার। কেউ দেখে ফেললে কী হত।
তুমি আমাকে ছেলেমানুষ বললে কেন?
মাস্টার তোমার ভারি গুমর। এত গুমর ভাল না।
লক্ষ্মী কি মনে করিয়ে দিতে চায়, সে এ বাড়ির মাস্টার বলে যা তা করতে পারে না। বললাম, গুমরের কী দেখলে?
বৌদি কত করে বলল, তোমার ভাইটিকে নিয়ে আসতে, তুমি কিছুতেই আনলে না। লক্ষ্মীকে কী করে বোঝাই আমরা খুব গরীব। আমার পোশাক-আশাক দেখেও তো বুঝতে পারে। ভাইটা যেভাবে এ বাড়িতে এসেছিল, তা দেখেও বুঝতে পারে। কিন্তু বুঝতে না চাইলে কী করতে পারি। ভাইটার খাবার বিষয়ে কাণ্ডজ্ঞান বড় কম। সুস্বাদু খাবার পেলে সে আর উঠতে চায় না। লোভে পড়ে যায়। রোজই এসে তবে জানালায় উঁকি দিয়ে বলবে, দাদারে আমি। গরীব বলে আমাদের কাণ্ডজ্ঞানের অভাব আছে কেউ টের পেলে আমার বড় লাগে।
—সেজন্য তুমি রাগ করেছ?
—রাগ। রাগের কী দেখলে।
—না এই যে তোমাকে আর দেখা যায় না।
–তোমার সামনে হাবার মতো সব সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে নাকি!
—তার মানে?
—তুমি মনে কর আমি কিছু বুঝি না। তোমার সঙ্গে আমার কথা বলাই অন্যায় হয়েছে। —তুমি যাও লক্ষ্মী। আমার পড়া আছে।
—যাব কেন। যাব না। দাঁড়িয়ে থাকব। তোমার কথাতে যাব? তোমার বাড়ি?
—লক্ষ্মী তোমার চোপা করার স্বভাবটা গেল না।
আমার কোন কথাই সে গ্রাহ্য করে না। তক্তপোশে পা দুলিয়ে বসল। ওর খালি গা। প্রকৃতির সুষমা ওর শরীরে। শাড়ির আঁচল দিয়ে আশ্চর্যভাবে গা ঢেকে রাখে। এতটুকু আলগা স্বভাবের না। এ ঘরে এলে আরও বেশি। উঠতি বয়সে এ-সব বোধহয় হয়। কিন্তু এ মুহূর্তে আমার কোন শ্লথ আচরণ লক্ষ্মীকে আস্কারা দিতে পারে, আমি বললাম, তুমি যাবে না?
কী কথা আছে বললে!
এমনই হয়, কথা বড় হারিয়ে ফেলি। আমার কিছু বলা হয় না। কেবল বললাম তুমি আমাকে
খারাপ ভেব না।
—তুমি কী মাস্টার! ওঠো, তোমার প্যানপ্যানে স্বভাব যাবে না। আমার অনেক কাজ। বলে লক্ষ্মী ঝাঁটা নিয়ে এল। ঘর-দোর ঝাঁট দেবে। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকল। বলল, খাও। না খেলে ঝাঁট দি কি করে?
সামনের রাস্তায় রিকশা যাচ্ছে। নিমগাছ থেকে পাতা ঝরছে। একটা ইঞ্জিন গেল হুশ শব্দ করে। তখন লক্ষ্মী বলল, তোমার এই কথা!
আর কি কথা আশা করে লক্ষ্মী। বললাম, তুমি এখানে কবে থেকে আছ?
—মনে নেই।
—আমি তোমাকে খুব কষ্ট দি। সেদিন সত্যি কী যে হ’ল।
—তোমার রামায়ণ পাঠ আমার ভাল্লাগে না। তাড়াতাড়ি খাও। দাদা পুজার ঘরে ঢুকবে। চান করবে। জল তোলা আছে।
–পরে ঝাড় দিও।
–না, এক্ষুণি দেব। তোমার কি ড্যাং ড্যাং করে কলেজে যাবে। আমার মতো খাটতে, বুঝতে ঠ্যালা।
—তুমি আর আমার জল তুলবে না। বিলে চান করে নেব।
—তুলব কি না পরে ভাবব। খাওয়া হ’ল। বাব্বা, মানুষ বটে একখানা। সব সময় গাড়ি রেডি। মনের মধ্যে কী আছে তোমার মাস্টার।
—তুমি জলখাবার নিয়ে আসতে না কেন। ঠিক আমাকে খারাপ ভেবেছ?
—এই তোমার বুদ্ধি মাস্টার। তুমি আমার কী করেছ। বল কী করেছ। খারাপ ভাবব কেন বল। —ভাবনি তো।
না, না, না।
আমার মুখে এতক্ষণে কেমন প্রসন্ন হাসি খেলে গেল। বাটিটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, রাগ ছিল ঠিক।
—রাগ।
–বা রে কলেজ থেকে ফিরে দেখতাম, আমার ঘরে তুমি ঢোকইনি।
—ঢুকি আর চোরের দায়ে ধরা পড়ি।
—একথা কেন?
–তুমি জান না মাস্টার, নটুর দামী কলমটা পাওয়া যাচ্ছে না।
—তার তুমি কী করবে?
—আমি তো সব করি। দিদি বৌদি ঠেস দিয়ে বলল, তুই করিস, তুই জানিস না, কে জানে?
—ঠিকই তো বলেছে।
—বারে চুরি গেলে আমি কী করব। সব দোষ আমার। বেশ তোমরা। বৌদিকে বলেছি, আর কুটো গাছটি নাড়ব না। সব নবাব। কেউ হাত নেড়ে খাবে না। বই আর গুছিয়ে দি তো আমার নামে কুকুর পুষ।
—তুমি নিয়েছ বৌদি ভাবতেই পারে না। তোমার ওটা ভুল।
—ভুল কি ঠিক সত্যি জানি না মাস্টার। আমরা ছোট জেতের মেয়ে। আমরা সব করতে পারি। আচ্ছা বল, কালীর থানে বাস করে কেউ চুরি করতে পারে। পাপ হবে না?
–এজন্য আসতে না?
—হ্যাঁ। বলে লক্ষ্মী চোখ তুলে তাকাল। শ্যামলা মেয়ের চোখে সেই মায়াবী দৃষ্টি। বললাম, ভিতরে গেছি, তুমি নেই। ডাক শুনি, তুমি নেই। ভাবতাম কী না জানি করে ফেললাম। কোথায় থাকতে?
—তোমার সামনে আসতে লজ্জা লাগত।
—কেন?
—বারে বৌদি যদি ভাবে আমি নিয়েছি তবে তুমি ভাববে না। মেয়েটার ছ্যাঁচড়া স্বভাব ভাববে না। লজ্জা করে না।
আমার ভীষণ হাসি পেল এ জন্য। বললাম, আর আমার মাথায় কত বিদঘুটে চিন্তা তোমাকে নিয়ে। জান, ক’রাত আমার ঘুম হয়নি?
আসলে এত কথা লক্ষ্মীর সঙ্গে আমার—কারণ, এই বাড়িতে লক্ষ্মীর সঙ্গে যেন কোথায় এক গোপন আত্মীয়তা আমার ক্রমে গড়ে উঠেছে। মন খুলে ওর সঙ্গে কথা বললে, কেমন হাল্কা বোধ করি। এ-ক’দিন কী যে গেছে। ভাইটা দুপুরে না খেয়ে চলে যাবার পর লক্ষ্মী আমাকে নানাভাবে হেনস্থা করেছে। মাস্টার তোমার কাজটা ভাল হয়নি। ছেলেমানুষ কতটা পথ হেঁটে দাদাকে দেখতে এয়েচে আর তাকে তুমি না খাইয়ে পাঠিয়ে দিলে। বৌদি খুব রাগ করেছে। খেতে বসে আমি যে খেতে পারছিলাম না, লক্ষ্মী তাও টের পেয়েছে। এবং কখন দু’ফোঁটা চোখের জল পড়েছিল, লক্ষ্মীর চোখ থেকে তাও এড়িয়ে যায়নি। একটা মেয়ে যখন এত আমার দেখে বেড়ায় তখন গভীর এক বন্ধুত্ব আপনা থেকেই বুঝি গড়ে ওঠে। লক্ষ্মী ক’দিন এড়িয়ে চলায় মনটা যে ভার হয়েছিল, সব জেনে কেমন হালকা হয়ে গেল। বললাম, ঠিক ভাইকে নিয়ে আসব! তুমি সামলিও। লক্ষ্মী কেমন ত্যারচা করে তাকাল। বলল, একটা আজগুবি দাদাকে সামলাচ্ছি, আর তার ভাইকে পারব না। দেখই না এনে।
ভাইটা সেই ঘটনার পর থেকে এদিকটায় আর একদিনও মাড়ায়নি। ইস্কুল নেই বলে তার অফুরন্ত সময়। বাড়িতে বই-খাতা-পেনসিল বাবা কিনে দিয়েছে এই পর্যন্ত। কাছে-পিঠে স্কুল নেই—শহরের স্কুলে ভর্তি করে দিতেও বাবা ভরসা পাচ্ছেন না। যেন ভাইটা দূরের রাস্তা চিনে ফেললে আর বাড়ি ফিরতে চাইবে না। ওর ওপর বাবার ভরসা কম। যেন বাবার আপ্তবাক্য, বড়টা আগে মানুষ হোক, পরে ছোটটার কথা ভাবা যাবে।
আসলে, আমার মনে হয়, বাবা ধরে নিয়েছেন, পিলুর যে বিদ্যা-বুদ্ধি ওতে করে যজন যাজনের কাজটা ভালই চলে যাবে। সবাই চাকরি-বাকরি খুঁজলে পৈতৃক ধারাটা রক্ষা করবে কে। ধর্ম নিয়ে চিন্তা-ভাবনা বাবার বড় প্রবল। বিদেশ-বিভূঁইয়ে এসে পুজো-আর্চার লোক না থাকলে গেরস্থের মঙ্গল হবে কি করে। ফলে পিলু যা পড়ছে ওতেই বাবা খুশি। বাড়ির গৃহদেবতার পূজা এখন পিলু বেশ নিপুণভাবেই করতে পারে। উপনয়ন দেশেই হয়ে গেছিল বলে রক্ষা। বাবা পিলুকে তিনবেলা আহ্নিক পাঠেরও অভ্যাস করিয়েছেন। মানুষ ধর্মবিমুখ হয়ে উঠছে। বড়টারও ঈশ্বরপ্রীতির অভাব, মেজটাকে আর তিনি বোধহয় আলগা করে দিতে সাহস পাচ্ছেন না।
মাঝে এক রোববারে বাড়ি গিয়ে টের পেয়েছিলাম, পিলুর অভিমান হয়েছে। সে দাদাকে দেখে আগের মতো কোন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেনি। সে ব্যাজার মুখে আমাদের খোঁড়া গরুটাকে নিয়ে মাঠে চলে গেল। বাড়ি গেলে পিলু আমাকে অজস্র খবর দেয়। মা-বাবা কথা বললে রেগে যায় তখন। দাদাকে জরুরী খবর দেবার সময় বাবার সব প্রশ্নই তার কাছে অর্থহীন। মা’র মুখের উপর কথা বলার অভ্যাস তারই আছে। মা কিছু বললেই তার স্বভাব বলা, তুমি চুপ করতো মা। দাদা বুঝলি, ল্যাংরা বিবির হাতাতে সুধন্য ছিপ ফেলে এত বড় মাছ তুলেছে। বলে সে তার দু-হাত প্রসারিত করে বলত, আমিও ধরব। রাজবাড়ির পেয়াদাকে বলেছি, ওকে একটা টিয়ার বাচ্চা দেব। ও রাজি। তারপর সে কি করে হোতার সাঁকোর নিচ থেকে বড় একটা বেলে মাছ ধরেছিল, কবে নবমী বুড়ির খবর নিয়ে ফেরার সময় দুটো ঝুনো নারকেল পেয়েছিল এবং তালের শাঁস কাটতে গিয়ে হাত জখম করেছিল এই সব খবর।
সেদিন বেশিক্ষণ বাড়ি থাকতে পারিনি। বেলায় বেলায় ফিরতে হয়। বনজঙ্গলের ভেতর দিয়ে একা ফিরতে ভয় করে। ফেরার সময় পিলুর সঙ্গে দেখাই হয়নি। মনটা কেমন খুঁতখুঁত করছিল। কালীবাড়িতে ফিরে যাবার সময় ভাইটার সঙ্গে দেখা হবে না ভাবতেই কষ্ট হচ্ছিল। গরু নিয়ে মাঠে কী করছে? ডাকাডাকি করেও সাড়া পাইনি। ফিরে আসার পর মনে হয়েছিল ইচ্ছে করেই পিলু লুকিয়ে আছে। বাড়ি থেকে দাদাটা চলে না গেলে সে ফিরবে না।
শীতের বিকেল। আমি বাড়ি যাচ্ছি। আজ বাড়িতে রাতে থাকব। বেশি দূর না অথচ কদিন মা বাবা ভাইবোনদের দেখতে না পেলে কেমন মনমরা হয়ে যাই। আমার এই বিষণ্ণতা সবার আগে টের পায় লক্ষ্মী, রাতে হয়ত বিছানা করে দিচ্ছে মশারি টাঙাচ্ছে। আর ফাঁকে ফাঁকে আমাকে চুরি করে দেখছে। কখনও বলছে বাবাঠাকুর আজ মা কালীর থানে মুতে দিয়েছে।
বাবাঠাকুরের সম্পর্কে আগের মতো ভীতি আর আমার নেই। তিনি মন্দিরেই সারাদিন পড়ে থাকেন নেংটি পরনে। নেপালী বুড়োর মতো দেখতে। রঙ ফর্সা। ধবধবে। কত বয়স কেউ জানে না। থুতনিতে গুণলে গোটা তিনচার দাড়ি। পুজো দেবার সময় দেবীর প্রতি পেছন ফিরে বসে থাকেন। আর হরদম দেবীর সঙ্গে বচসা, কখনও ছেলেমানুষের মতো কান্না, কখনও হাতে মণ্ডা নিয়ে দেবীর জিভে ঠেসে দেওয়া, খা মাগী খা, আর ঢং দেখাস না। বাবাঠাকুরের কৃপা আছে আমার প্রতি। ক্ষণে ক্ষণে মন্দির থেকে হাঁক আসে, মাস্টার। হাঁক এলে আর কথা নেই, ছুটে যেতে হবে। তিনি আমাকে দাঁড় করিয়ে হাতে মণ্ডা দেবেন। কখনও কুমারসম্ভব আউড়ে যাবেন, তিনি আমাকে কখনও জিভ ভেংচাবেন। আবার হাঁক, বদরি। সঙ্গে সঙ্গে বদরিদা হাজির। বদরিদা থানের সেবাইত তখন কে বলবে! ডাকবেন বউমা, তিনিও হাজির। সবাই হাজির হলে শীতের রাতেই সবাইকে নিয়ে রওনা। তিনি গঙ্গাস্নানে যাচ্ছেন। কার হিম্মত আছে মুখের উপর বাবাঠাকুরকে কোন প্রশ্ন করে। সেই বাবাঠাকুর দেবীর থানে মুতে দিয়েছে। মন্দিরের সামনে সারবন্দী গাড়ি দেখলেই বোঝা যায় মানুষটার কোথায় একটা বড় রকমের মাহাত্ম্য আছে। হাতে কঞ্চি নিয়ে তাড়া করছেন সব ক’টা ধনাঢ্য পরিবারকে। আমার তখন কেমন ভারি মজা লাগে। আমি আশ্রিত জেনে বাবাঠাকুর আমার প্রতি অন্যরকম। কখনও তিনি এমন ব্যবহার করেন যেন ইয়ার-দোস্ত। আমার তখন ভারি লজ্জা লাগে।
কথায় সাড়া না দিলে কখনও লক্ষ্মী বলেছে, মাস্টার তোমার মন ভাল না। মন ভাল না থাকলে পড়ায় মন বসবে কী করে। বাড়ি থেকে ঘুরে এস।
বাবাঠাকুর অন্তর্যামী। তিনি যা টের পান না, লক্ষ্মী তা কত সহজে টের পায়। সব সময় ভয় বাড়ির কার না কিছু আবার হল। ভয় বেশি পিলুটার জন্য। যা স্বভাবের ছেলে। জঙ্গলটায় সাপখোপের বড় উপদ্রব। শীতকাল বলে সে ভয়টা কম। তবু সে যা একখানা ছেলে কোথায় কি ধরতে গিয়ে কার গলা চেপে ধরবে—ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল কতক্ষণে বাড়ি পৌঁছাব।
এখানে সব গাছই বড় বেশি লম্বা এবং প্রাচীন। দেবদারু গাছের জঙ্গল। কোথাও বড় বড় শিশু গাছ, ডালপালা মেলে পথটাকে ছায়াচ্ছন্ন করে রেখেছে। বড় সুন্দর পথ। কোনো তরুণের পক্ষে এমন পথ ধরে হেঁটে যাওয়া বড় অভিজ্ঞতার বিষয়। বার বার পথটা অতিক্রম করে দেখেছি, সে প্রতিবার নতুন হয়ে দেখা দেয়। পায়ের নিচে ঝরে পড়া পাতার খসখস শব্দ। ঝিঁঝি পোকার ডাক। কান পাতলে গভীরে আরও সব শব্দমালা উঠে আসে। কখনও কখনও থমকে দাঁড়িয়ে যাই। আশ্চর্য সব পাখির ডাক শুনি, ব্যাঙের ক্লপ ফ্লপ শব্দ। কখনও অদুরে কাঠ কাটার একটানা বিচিত্র শব্দতরঙ্গ—সব মিলে এই বনভূমিতে বেঁচে থাকাটাকে গেমাঞ্চকর মনে হয়। এই বনভূমির এক পাশে আমরা যত বড় হয়ে উঠছি ততই জায়গাটার আকর্ষণে পড়ে যাচ্ছি।
বাড়ি ফিরে দেখলাম ঠিক পিলু বাড়ি নেই। মা কল থেকে জল আনতে গেছে। বাবা গেছেন নিবারণ দাসের বাড়ি। মায়া বলল, জানিস দাদা, নিবারণ দাসের মা-টা না মরে গেছে।
ছোট ভাইটা আমাকে দেখেই দৌড়ে এসে হাঁটু জড়িয়ে ধরল। কোলে উঠতে চায়। ওকে কোলে তুলে নিলে দেখলাম রাস্তায় ছুটে গেছে মায়া। আমাদের বাড়িটা পার হয়ে কিছুদূরে আরও দু-তিনটে বাড়ি হচ্ছে। লোকজনও এসে গেছে। এরাই প্রথম আমাদের প্রতিবেশী এখানে। মায়ার সঙ্গে কারো কারো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। ভাইটাকে আমার জিম্মায় দিয়ে সে যেন কিছুটা হাল্কা হয়ে গেছে। রাস্তায় কি করে যে ওর সমবয়সী আরও দুটো মেয়ে জুটে গেল। ওরা এক্কাদোক্কা খেলছে। খেলার চেয়ে আমাকে দেখার ওদের বেশী আগ্রহ। এ সময় মায়া যে বড় অহংকারী হয়ে উঠবে জানা কথা। তার দাদাটা কলেজে পড়ে— কত বড় কথা।
দাদা বাড়ি এলে সবাই উৎল্প হয়ে ওঠে। মায়ার লাফানো, ছুটে যাওয়া এবং ঘুরে ফিরে গানের সুরে ছড়া কাটা সবটাই আজ একটু বেশি বেশি হবে। আমি বাড়ি ফিরলে মায়া পিলু কীভাবে যে সেটা প্রকাশ করবে ঠিক ওরা বুঝে উঠতে পারে না। যেমন মায়া এখন ছড়া কাটছে—উলু উলু মাদারের ফুল, বর এসেছে কতদূর, বর এসেছে বাঘনাপাড়া, ওলো বউ রান্না চড়া। এ-সব কথার সঠিক অর্থ মায়া হয়তো ভাল করে বোঝেই না—কিন্তু আমার কাছে এই ছন্দমালা, নতুন এক জগৎ তৈরি করে দেয়। নিরিবিলি আমি গোয়ালঘরের ধারে বকনা বাছুরটার পাশে দাঁড়িয়ে থাকি। ভাইকে কোলে নিয়ে বাছুরটাকে আদর করি। মাকে দেখতে পাই কলসী কাঁখে ফিরছে পুলিশ ক্যাম্প থেকে। মায়া তার আগেই খবরটা দিতে ছুটে গেছ। এবং বুঝতে পারি মা’র জল নিয়ে ফেরার ছন্দ আরও আরও দ্রুত হয়ে উঠছে। তার বড় ছেলে বাড়ি এসেছে—এমন সুসংবাদে স্থির থাকতে পারছে না মা।
আমাকে দেখেই মা’র মুখ ভারি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মা’র কপালে বড় সিঁদুরের ফোঁটা। লাল পেড়ে শাড়ি পরনে। একটা সুতীর চাদর গায়ে। জলে কাঁখের কিছুটা অংশ ভিজে গেছে। চুল খোঁপা বাঁধা। কত চুল। শীতেও মার কপাল ঘামছে। জলের কলসি রেখেই হাঁক-ডাক শুরু করে দিল, মায়া তাড়াতাড়ি কর মা। সাঁজ লাগা। আলো জ্বাল। বাসন পড়ে আছে। পিলু আসে নি। তুই কতক্ষণ।
বললাম, এই ত এলাম। পিলু গেছে কোথায়?
—তোর বাবা বাড়ি না থাকলে এত বাড় বাড়ে।
—আবার কিছু করল নাকি?
বারান্দার জলচৌকিতে বসে কথাটা বললাম।
—দুপুরে বের হয়েছে, এখনও ফেরার নাম নেই। গরুটা কোন্ মাঠে দিয়েছে কে জানে।
—দেখে আসব?
—কোথায় খুঁজবি।
আসলে মা চায় তার বড় ছেলে বাড়িতেই থাক। ঘোরাঘুরি সহ্য হবে না। মা’র কত স্বপ্ন আমাকে নিয়ে। প্রতিবেশীদের কাছে আমার কথা মা’র মুখে লেগেই থাকে। আমার কাছে এসে পৈঁঠায় পা মেলে বসল মা। বলল, গোপাল করের মা তোকে দেখতে চেয়েছে। কাল একবার যাস। মায়া নিয়ে যাবে।
—আমাকে আবার দেখার কি হল।
—ঠাকুরকর্তার বড় ছেলেকে দেখবে দেখবে করছে।
বাবা বাড়িঘর বানাবার পর সেই কবে থেকেই গাঁয়ের লোক, আত্মীয়স্বজনদের চিঠি লিখে চলেছেন। চলে এস। সুমার একটা বনে মানুষজন ঘরবাড়ি বানিয়ে যাচ্ছে। জমি সস্তা। একশো টাকা দিলে এক বিঘা জমি। অনাবাদী উরাট, মানুষের হাত লাগলে কী না হয়। পাশে পুলিশ ক্যাম্প। পরে বাদশাহী সড়ক।
সড়কটা মুর্শিদাবাদের দিকে চলে গেছে। সেই মুর্শিদাবাদ, নবাব সিরাজ, মীরজাফরের দেশ। কিছু দূরে রেল লাইন। পরে শহর। পাশে ভাগীরথী। মা গঙ্গা। মরলেও শান্তি। গঙ্গার পাড়ে দাহ। জীবনের সর্ব সার জননী জাহ্নবী। চাল সবজি সস্তা। চালের মন চোদ্দ পনের টাকা। জলের অভাব নেই। পুলিশ ক্যাম্পে টিউবওয়েল আছে। পুনর্বাসন দপ্তর থেকে শুনতে পাচ্ছি আমাদের ঘরবাড়ির পাশে টিউকল করে দেওয়া হবে। সেই এক কথা, সঙ্গে জল হাওয়া মাটি ঈশ্বর থাকলে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য আর কী লাগে। গোপাল কর বাবার দেশ বাড়ির যজমান। খুব শৈশবে, একবার কার যেন বিয়ে উপলক্ষে বাবা আমাকে সঙ্গে নিয়েছিলেন। রাত্রিবাস। আর ভালমন্দ খাওয়া। যে-জনই আসুক সাষ্টাঙ্গে প্ৰণিপাত। কেমন আড়ষ্ট হয়ে থাকতাম। জল-চৌকিতে বসিয়ে পা ধুইয়ে দেওয়া, পাদোদক খাওয়া, এ সবের মধ্যে গোপাল করের মা, সংসারের মঙ্গল নিহিত আছে বুঝি ভাবত। আমার তখন প্রাণান্ত। গোপাল করের বাবার বাজারে ছিল বড় মসলাপাতির দোকান। চক মেলানো উঠোন। বড় পুকুর—বড় মাছ আর লক্ষ্মীর কৃপা সর্বত্র। সাদা ফরাসে নিয়ে বসানো, গুরুদেবের মতো ভক্তি এবং এই করে জীবনে কেবল সম্মান আদায়ের পালা। বাবাই জমি দেখে দিয়েছেন। গোপাল কর লোকজন লাগিয়ে জঙ্গল সাফ করছে। এখানটায় যেই আসে, দু-চারদিন আমাদের বাড়িতে অবস্থান, বাবা তখন খান না-খান, বুঝতে দেন না, অভাব অনটন আছে সংসারে। যে করেই হোক অতিথি সৎকারের কোনো ত্রুটি থাকত না।
সুতরাং সেই ছোট্ট ছেলেটি কত বড় হয়েছে দেখার আগ্রহ গোপাল করের মা’র হতেই পারে। আর এই করে নিজের মধ্যে কে যেন আরও বড় একটা সম্ভ্রমবোধ গড়ে দিয়ে যায়। পিলুটা বোঝে না, হা-ভাতের মতো গিললে বৌদি, লক্ষ্মী, এমন কি নটু পটু পর্যন্ত ভাববে- আমার বাবা সত্যি বড় অভাবী মানুষ!
তখনই মনে হল, পিলুর সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। গরুটা ছাড়া। গরুটাকে তাড়িয়ে আনছে। দড়ি মাটিতে সেচরাচ্ছে। পিলু হুটহাট করছে। চাদরের তলায় হাত। মা চিৎকার করছে, ওরে পিলু, গরুটা সব সাবাড় করবে। ফুলের গাছগুলির পাশে কঞ্চির বেড়া। সেখানে ডাঁটার চারা বড় হচ্ছে। ঢেঁড়সের বিছ লাগানো। দুটো পটলের লতা বাড়ছে। বাবার সবজির বাগান। যেভাবে গরুটাকে আম্মা করে দিয়েছে সব মুড়িয়ে খাবে।
মা’র চিৎকারে পিলুর মধ্যে কোন ত্রাসের সৃষ্টি হয় না। সে কি সামলাতে ব্যস্ত চাদরের নিচে। অগত্যা আমাকেই ছুটে যেতে হল গরুটাকে ধরতে। বাবার আর পিলুর সর্বক্ষণ সেবাযত্নে কে বলবে গরুটার এক সময় অস্থিচর্মসার ছিল।
সেই আদরের গরুটির প্রতি পিলুর অবহেলা, নির্ঘাত সে অন্য বড় কিছু হাতের কাছে পেয়ে গেছে। আমাকে ছুটে যেতে দেখেই বলল, দাদারে।
দাদারে এই শব্দ অনেক কিছুর অর্থ বহন করে। আমার সেদিকে এখন খেয়াল নেই। গরুটা বাবার সবজি বাগান আবার নষ্ট না করে দেয়। দিলে বাবা মনঃকষ্টে ভুগবেন। মুখে কিছু বলবেন না। সব কর্মফল ভেবে বাবা হুঁকো খেতে বসবেন। এই সব পরিচিত দৃশ্য থেকে বাড়িটাকে রক্ষা করার জন্য ছুটে গেলাম এবং গরুটাকে দড়ি ধরে টানতে টানতে যথাক্রমে বেঁধে দিলে, পিলু ফের ডাকল, দাদারে।
এই ধরনের ডাকে পিলুর কাছে কোন বিস্ময়কর খবর আছে বুঝতে পারি। আগেরবারের আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টা আর পিলুর মধ্যে নেই। বললাম, গরুটাকে ছেড়ে দিলি, যদি কিছুতে মুখ দিত!
পিলুর যেমন স্বভাব, সে আমার অভিযোগ এতটুকু মন দিয়ে শুনল না। চাদর সামান্য ফাঁক করে সন্তর্পণে কিছু গোপনে দেখাবার চেষ্টা করল। যা দেখলাম, তাতে কোনো প্রাণীর লেজটেজ বলে মনে হল। কাঠবিড়ালী হতে পারে। এর আগে একটা কুকুরছানা, এবং ছাগশিশু নিয়ে বাড়িতে মা বাবা বেশ অশান্তি করেছিলেন। প্রাণীমাত্রেই বাবার কাছে ঈশ্বরের অংশ। তাকে অযথা কষ্ট দিতে নেই। পিলুর পাল্লায় যে-কোন প্রাণীর জীবন সংশয় হতে পারে, বাবার এমন ধারণা।
বনবাদাড় থেকে আবার কি একটা ধরে আনল কে জানে।
বললাম, ওটা কিরে।
পিলু মুখে আঙুল দিল। অর্থাৎ খুব গোপন। সে চায় না মা’র কানে কিংবা অন্য কেউ শুনতে পাক।
প্রথম হেফা সামলাতে পারলে পিলু জানে তার আর ভয় নেই। শোরগোল একদিন দুদিন। পরে বাবা পর্যন্ত খোঁজখবর নেবেন, কেমন আছে তারা।
তখন শীতের হাওয়া বইছিল। কনকনে ঠাণ্ডা! পিলু কোন রকমে চাদর আর একটু ফাঁক করে যে বস্তুটি দেখাল তাতে তাজ্জব বনে গেলাম। ডাকলাম, মা মা!
—মাকে ডাকছিস কেন?
—কোথা থেকে ধরলি।
— লেংরি বিবির হাতা থেকে।
মা’র কাছে ছুটে গেলাম। মা ঠাকুরঘরে প্রদীপ জ্বালাতে ব্যস্ত। বললাম, দেখ এসে পিলু আবার কী একটা ধরে এনেছে!
আসলে অন্ধকারে ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না, তবে ওটা যে পিলুর সগোত্র বুঝতে কষ্ট হয়নি। এতদিন সে যা যেখানে পেয়েছে তুলে এনেছে। অভাবী মানুষের সন্তানেরা বুঝি এমনই হয়ে থাকে। বাইরের কুটোগাছটি পর্যন্ত সংসারের জন্য দরকার মনে হয়। পিলু এ সব বিষয়ে খুব সতর্ক। কিন্তু হেন বস্তুটি সংসারে উপদ্রব বাড়াবে শুধু। মা বলল, কী আবার এনেছে!
—হনুমানের বাচ্চা ধরে এনেছে।
মায়া শোনামাত্র দু-লাফে ঘর থেকে বের হয়ে বলল, কোথায় রে?
মা যেমন করে থাকে, আর্ত গলা—অ মা কী বলছিস তুই! কোথায় পেল!
—এস না, দেখ এসে।
বাচ্চাটা পিটপিট করে তাকাচ্ছিল। পিলুর বুকের কাছে খামচে ধরে আছে।
যেন শত টানাটানি করলেও ওটাকে তুলে আনা যাবে না।
আর মা আমি মায়া যখন গোয়ালঘরের কাছে পিলুকে খুঁজতে গেলাম তুখন দেখি সে নেই, নিমেষে হাওয়া।
—পিলু কোথায় গেলি!
দূরের বনঝোপ থেকে উঁকি মেরে বলল, মা আমাকে মারবে না তো।
মা বলল, আগে এস বাড়িতে, তারপর দেখছি।
–আমি যাব না।
—ওটা ওর মা’র কাছে দিয়ে আয়। আর অভিশাপ কুড়াস না বাবা।
পিলু সেখান থেকেই বলল, আমি পালব মা।
–পড়াশোনা নেই, ঐ নিয়েই থাক।
আমি ফের ডাকলাম, তুই আয় না। মা দেখবে।
মা’র দেখার আগ্রহ কতটা বুঝতে পারছি না। এ-অঞ্চলটায় হনুমানের বড় উপদ্রব। ধেড়ে সব হনুমান কখনও মানুষকে তাড়া করে। কামড়ে দেয়। পেঁপে, কলা কিংবা মটরশাক যা কিছুই বাবা লাগান না কেন, হনুমানের উৎপাতে কিছু রাখা যায় না। সব সময় উচাটনে থাকতে হয় মায়াকে। বাবা বাড়ি থাকলে বাবাকে। কোথায় কী খেল, কী তুলে নিল, সর্বক্ষণ সবার অস্বস্তি। লাউ, কুমড়ো কিছুই রাখা যায় না। একবার পাটের সব কচি ডগা খেয়ে জমি সাফ করে দিয়েছিল। বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলেন। পিলু গুলতি মেরে একবার একটা হনুর পা খোঁড়া করে দিয়েছিল, বাবা এতেও ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন। রাম-রাবণের যুদ্ধে হনুমানের কি ভূমিকা ছিল সে প্রসঙ্গ টেনে এনে বলেছিলেন, তোমাকে তাড়াতে বলেছি, খোঁড়া করে দিতে বলিনি। আজ তোমার ভাত নেই। দুপুরে সত্যি পিলুকে সেদিন খেতে দেওয়া হল না। বাবার কাছে এটা পাপের প্রায়শ্চিত্ত। নাহলে ঈশ্বর ক্ষমা করবেন না, তাঁর মেজ পুত্রটিকে। সেই ছেলে একটা হনুমানের বাচ্চা কব্জা করে এনেছে ভাবতেই বাবার হয়তো মাথা গরম হয়ে যাবে। পিলু আগে থাকতেই সংসারে বাবা বাদে সবাইকে সপক্ষে টানতে চায়। নাহলে যেন এই বাচ্চাটা সম্বল করে যে দিকে দু’চোখ যায় সে চলে যাবে।
মা কী ভাবল কে জানে। মেজ পুত্রটির কী খেয়াল হবে শেষ পর্যন্ত ভাবতেই বোধ হয়, ডাকল, আয়, দেখি, কী করে ধরলি রে!
পিলু বোধ হয় এতক্ষণে আশ্বস্ত হল। সে রাস্তা পার হয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। মা হারিকেন নিয়ে এল উঠোনে। পিলু চাদরের তলা থেকে বের করতেই একটা বৃহৎ আকারের গিরগিটির আকারে সেটা মা’র দৃষ্টিগোচর হল। মা বলল, ছিঃ ছিঃ তোর ঘেন্না-পিত্তি নেই। ছাড়, ছেড়ে দে।
ও আর ছাড়ে! বারান্দায় উঠে জলচৌকিতে বসে বলল, দুটো ধাড়িতে কামড়া কামড়ি করছিল। মা, হলুদবাটা আছে? সে বাচ্চাটাকে কিছুতেই আর চাদরের নিচ থেকে বের করছে না। ঠাণ্ডা লাগতে পারে, এই আশঙ্কায় বোধ হয় সে আর বেরই করত না। কিন্তু মায়া, ছোট ভাইটা দেখার জন্য হামলে পড়েছে। আর তখনই মনে হল জামায় ক’ফোঁটা রক্তের দাগ।
—ও মা রক্ত! মায়া হতবাক হয়ে কথাটা বলল।
পিলু বলল, মারব। মারব বলছি। কোথায় রক্ত।
—এই যে।
মা আমি ঝুঁকে দেখলাম। খুব বেশী রক্তপাত না হলে এভাবে জামায় রক্তের দাগ লাগে না। পিলুর মুখে কোন বিকৃতি নেই। মা কিছুটা হতভম্ব। আমি বললাম, দেখি দেখি। বলে জামা টানাটানি করতে গেলে পিলু বলল, কামড়ে দিয়েছে। কী করব? বলছি হলুদবাটা আছে কিনা। সে তিরিক্ষি মেজাজে জামা জোরজার করে নামিয়ে নিলে মা’র যেন হুঁশ হল। ততক্ষণে আমরা ক্ষতস্থানটা দেখে ফেলেছি। এই নিয়ে সে কেমন নির্বিকারভাবে বসে আছে। হনুমান দেখা আমাদের মাথায় উঠে গেল। মা চুন-হলুদ গরম করতে গিয়ে শুরু করে দিয়েছে রামায়ণ পাঠ। আমার মরণ হয় না কেন? ভগবান আমাকে নেয় না কেন। তোরা মরতে পারিস না কেন। হাড় জুড়ায়, এত জ্বালা কার সহ্য হয়!
পিলুর এসব কথায় ভ্রুক্ষেপ নেই। সে বারান্দায় কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার মনোযোগ অন্যদিকে। একটা কাপড়ের পাড় হাতের কাছে পেয়ে গেল। কিভাবে বাচ্চাটাকে কব্জা করেছে—কি ধরনের অভিযানে বের হলে একটা হনুমানের বাচ্চা সংগ্রহ করা যায়, তার বিস্তারিত গল্প আমাকে ও মায়াকে শুনিয়ে যাচ্ছে। কোথায় তারিফ করবে তা না, কেবল পেছনে লাগবে। বাচ্চাটা বড় হলে এমন ট্রেনিং দেবে, একটা হনু আর বাড়ি আসতে সাহস পাবে না। কুকুরের মতো। কুকুর চোর ছ্যাঁচোড় তাড়া করে— কুকুরের মতো জ্ঞাতিশত্রু যেমন থাকে না, হনুর বেলাতেও তাই হবে। ঘর-বাড়ি রক্ষার্থেই সে এটা করেছে। মা কেন যে বোঝে না।
পিলুর এমন ধারণায় আমিও বিশ্বাসী হয়ে উঠলাম। আমাদের পোষা কুকুরটার জন্য কেউ বাড়িতে ঢুকতে সাহস পায় না। কুকুরটা এখন বাড়ি নেই। ঠিক বাবার সঙ্গে ভ্রমণে বের হয়েছে। পিলুই কুকুরটাকে সতর্ক করে দিয়েছে যেন—বাবা, কোথায় যান দেখে রেখ। কি করেন দেখে রেখ। কারণ বাবার মতো বাউণ্ডুলে মানুষের খোঁজখবর না রাখলে কোথায় আবার উধাও হবেন কে জানে। বাবার ঐ এক স্বভাব। শহরে গেল, মানুকাকা বলল, একটা ফর্দ করে দিতে হবে ধনদাদা। কার ফর্দ, কিসের ফর্দ এবং কোন যজমান, কি নাম, জাত কি, এসব জানাজানির জন্য সেদিন হয়তো ফিরলেনই না। ফর্দ করে দিয়ে শ্রাদ্ধ থাকলে, কি শুভকাজ থাকলে সব নিষ্পন্ন করে তাঁর বাড়ি ফেরা। বাড়িতে একটা খবর যে দিতে হয়, বাবার ধারণায় এটা আসে না। কুকুরটা বাড়ি ফিরে এলে, চুপচাপ এবং শান্ত থাকলে বুঝতে হবে, বাবা কোন কাজের খবর পেয়ে কোথাও গেছেন। আর ডাকাডাকি করলে ধন্দ আসবে মনে—তখন পিলুর কাজ বাবাকে খুঁজতে বের হওয়া। দাসের আড়তে, বাজারে, চন্দর দোকানে, অথবা মানিক সরকারের কুঠিতে খোঁজ-বাবা এয়েছিলেন? না ত’। আড়তে খোঁজ, বাবা এয়েছিলেন? হ্যাঁ এয়েছিল। মাকে বলবে, তিনি কাল সকালে ফিরবেন। গেছে আউসগ্রামে। শান্তি- স্বস্ত্যয়ন আছে। বাড়ি এসে পিলুর খবর দেওয়া—মা, বাবা আউসগ্রামে গেছেন। ওখানে শান্তি-স্বস্ত্যয়ন আছে। মা তখন বুঝতে পারে পিলুর আনা সেই বাচ্চা কুকুরটা এত বড় না হলে কে নজর রাখত এই বাউণ্ডুলে মানুষটার প্রতি। ঘরে তিষ্ঠতেই চায় না। পিলুর ওপর মা’র তখন মায়া বেড়ে যায়। বড় বিবেচক। বাপ যার বাউণ্ডুলে তার এমন সুপুত্র থাকবে একজন মা হয়তো আশাই করতে পারেনি। এখন তবু কমেছে। সেই দেশ থেকে আসার পর, বাবা কতবার যে একদিনের জন্য বের হচ্ছি বলে মাসাধিককাল ঘরে ফিরতেন না! ফিরলে মা’র অভিযোগ, আমিও যাব বের হয়ে। তুমি পার, আমি পারি না। বাবা তখন কাঁচুমাচু মুখে বলতেন, আরে বোঝ না কেন, এ ক’দিন যে দেশ-বাড়ির মানুষজন খুঁজে বেড়িয়েছি, তা কি এমনি এমনি। ঐ তো বামন্দির প্রফুল্ল সরকার নবদ্বীপে বাড়ি করেছে। আমাকে দেখে কি খুশি। ছাড়তেই চায় না। কর্তা আর ক’টা দিন থেকে যান। ভাল-মন্দ খাওয়া। দেশ থেকে এসে তো সব ভুলেই গেছি।
মা’র উত্তর—তাই কর। সংসারটা উচ্ছন্নে যাক। এত লম্বা জিভ হলে হয়। বাড়ির কথা একবার ভাবলে না!
—ঐ তো ধনবৌ, তোমার বুদ্ধি কম। আমি খাই মানে তো একটা লোকের খাওয়া বেঁচে যায় সংসারে। দুর্দিনে একটা মানুষের আহার বেঁচে গেলে কত সুবিধা বল।
এখন আর বাবার এতটা ঘুরে বেড়াবার সখ নেই। ঘরবাড়ি হয়ে যাওয়ায় থিতু হয়েছেন কিছুটা। তবু পিলুর সংশয় থাকে বলে কুকুরটাকে বাবার নিরাপত্তার খাতিরে রেখে দিয়েছে। বাবা আর না বলে না কয়ে ভেগে যেতে পারবেন না। যার বাবা এমন পেটুক তার সন্তানেরা আর কতটা ভাল হতে পারে। পিলুকে কোন আশায় কালীবাড়ির সুস্বাদু খাবারের খোঁজ দেব সে তো তবে আর বাড়িমুখোই হতে চাইবে না। লক্ষ্মী বোঝে না। বৌদিও বলে দিয়েছে তোমার ভাইকে নিয়ে আসবে। মা’র প্রসাদ নেবে। একবার খেতে পেলে—সরু সুঘ্রাণ আতপ চালের ভাত, ছাঁকা তেলে বেগুন ভাজাভাজা সোনা মুগের ডাল, পাঁঠার মেটে চচ্চড়ি, মাংস, চাটনি, মণ্ডা, সন্দেশ, যেখানে প্রসাদে এই বরাদ্দ এবং তার আলাদা স্বাদ—পিলু কোন মুখে বাড়ি আসবে। দেবস্থানে কত উপরি লোক পড়ে থাকে, প্রসাদ পায়, সেও না হয়——আর সেতো নটু পটুর মাস্টার মশাইর ভাই। তার ইজ্জত আলাদা। বলা যায় না, একবার ছাড়পত্র পেয়ে গেলে এবং পিলুর যা সংসারী বুদ্ধি, বৌদি হয়তো বলেই বসবেন, মাস্টার, তোমার ভাইটিও এখানে থাক। দেবস্থানে আহার নয়, প্রসাদ। কি যেন কথা আছে, যে খায় চিনি, যোগান চিন্তামণি, ভাববার কিছু নেই। পিলু কালীবাড়িতে উঠে এলে দেখা যাবে সেই এক নম্বর মানুষ হয়ে গেছে। আর বাবাঠাকুরের নজরে পড়ে গেলে তো হয়েই গেল। পিলুকে রাতারাতি আর এক বামাক্ষ্যাপা না বানিয়ে দেয়। এতসব ভেবে পিলুকে সবার আড়ালে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে- ছিলাম। আসলে আমার সেই মানসম্মান বোধ—বড় হতে হতে যে আমাকে ক্রমে গ্রাস করছে। আমার বাবা খেতে ভালবাসেন, আমার ভাই খাবার গন্ধ পেলে আর সেখান থেকে নড়তে চায় না—এসব জানাজানি হলে আমার মানসিক কষ্ট বাড়ে।
মা তখন পিলুর ক্ষতস্থানে চুন-হলুদ বাটা গরম করে লাগাচ্ছে। মায়া ঝুঁকে আছে। ক্ষতস্থানটা দেখে আমার মাথা ঘুরছে। আর পিলু সেই হনুর গলায় পাড় বেঁধে দিচ্ছে। বাচ্চাটা লাফাচ্ছে। চিঁ চিঁ করে ডাকছে। বাঁশ বেয়ে উপরে উঠছে আবার লাফিয়ে পিলুর ঘাড়ে পড়ছে। সামনে হারিকেন ছিল। সেটাতে আবার না লাফিয়ে পড়ে। ভয়ে হারিকেনটা সরিয়ে রাখতেই দেখি, একটা লম্বা ছায়া বারান্দায় উঠে আসছে। বাবা। বাবা বারান্দায় আস্ত একটা হনুর বাচ্চা দেখে বোধহয় কিঞ্চিৎ বিভ্ৰমে পড়ে গেছিলেন। তারপর মগজের মধ্যে বিষয়টা একটু খেলে যেতেই বললেন, এটা কি পশুশালা?
বাবার গগনভেদী প্রশ্নে আমরা সবাই তাকালাম।
—এটা কি পশুশালা?
পিলু আমাদের দিকে তাকাচ্ছে।
—জবাব দিচ্ছ না কেন? যেন যারা হনুটাকে ঘিরে বসেছিল সবার কাছে প্রশ্নটা। মা যেন পাত্তাই দিচ্ছে না।—দাঁড়া, লাগানো হয়নি। লাগছে? লাগবে না। তুই মানুষ, না অপদেবতা।
বাবার দিকে আমি ভয়ে তাকাচ্ছি না। পিলু ঘাড় গোঁজ করে বসে আছে। হনুর বাচ্চাটা বাবাকে দেখেই পিলুর জামার নিচে লুকিয়ে পড়েছে। বাচ্চাটা পিলুর জামার নিচটা কি করে যে নিরাপদ জায়গা ভাবছে বোঝা যাচ্ছে না।
বাবার হুংকার, বাড়িটা আমার, না তোমাদের?
মা পিলুকে বলল, নে এবার ঘরে নিয়ে বেঁধে রাখ! হাত-পা ধুয়ে পড়তে বোস।
পিলুর সাহস এখন অনেক। সে মাতৃআজ্ঞা পালন করছে। মা সহায় থাকলে সংসারে তার ভাবনা কম! এ কথার পর বাবাও কেমন নিজের অধিকার সম্পর্কে একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে মতো বললেন, পিলু বাবা একটু তামাক সাজ।
বাবা বারান্দার এককোণায় আসন পেতে বসলেন। দেখে মনে হয় সংসারে এ-মুহূর্তে তিনি খুবই আলগা মানুষ। যেন কারো সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। যাঁর স্ত্রী যা দেবী সর্বভূতেষু, তাঁর আর বেশি আশা করা ঠিক না। হনুর বাচ্চাটা সংসারে কি উপকারে আসতে পারে—পিলু কেন যে ওটাকে ধরে আনল। প্রাণিকুলের প্রতি পিলুর এই অহরহ নৃশংস ব্যবহার বাবাকে বোধহয় আপৎকালে পীড়া দিচ্ছে। হুঁকাটি এগিয়ে দিলে, বাবা বললেন, দেখছিস তো কী সুখে আছি?
আমি বাড়ি থাকি না, আমি কলেজে পড়ি, বাবা আমাকে মাঝে মাঝে বিদ্বান, বুদ্ধিমান ভেবে থাকেন। আমার কাছে তাঁর এই অভিযোগ কাকে লক্ষ্য করে বুঝতে কষ্ট হয় না। বললাম, পিলুকে হনুতে কামড়েছে।
—কামড়েছে! বলেই লাফ দিয়ে উঠে পড়লেন। কোথায় কোথায়, দেখি। পিলু এসময় বাবার সহানুভূতি কব্জা করতে দৌড়ে কাছে গেল। জামা তুলে দেখাল। বাবা হারিকেনের আলোতে ক্ষতস্থানটা দেখলেন। তারপর পিলুর নাড়ি দেখলেন। —জ্বর জ্বর বোধ হচ্ছে না ত?
—না।
—বমি বমি ভাব?
না।
—মাথা ধরেছে?
–না।
—ক্ষুধার উদ্রেক হয়েছে?
—হ্যাঁ।
—কী খেতে ইচ্ছে হচ্ছে?
—ভাত, মাংস।
–ভাল। ভয় নেই। দেখি তোমার হনু কি বলে?
–ও তো কামড়ায়নি।
—তবে কে?
—ওর ধাড়িটা।
বাবার এত প্রশ্ন মা’র কাছে বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছিল। পিলু বাবার এত প্রশ্নে কিছুটা সম্মতি আদায় করতে পরেছে ভেবে খুব খুশির সঙ্গে বলল, আর হনু আমাদের ফল-পাকুড় খেতে পারবে না বাবা।
মায়া বলল, তুমি যে বলেছিলে বাবা একটা কমলালেবুর গাছ লাগাবে।
বাড়িতে বাবা সব রকমের ফল-পাকুড়ের গাছ লাগিয়েছেন। এমন কি একটা আঙুরলতা পর্যন্ত। হলে কি হবে, হনুতে নষ্ট করে দিয়ে যায় বলে বাবার সব গাছ লাগানোর পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। বাবা বলেছিলেন, সবই তো হল, কেবল একটা কমলালেবুর গাছ, আখরোটের গাছ, আপেলের গাছ বাকি। যা মাটি, একেবারে সাক্ষাৎ জননী। যা লাগাবে তাই হবে। কতকালের পতিত জমি, জননী জন্মভূমি।
এবারে হনুটা আসায় মায়ার মনে হয়েছে আর সমস্যা নেই, হনুতে নষ্ট করবে না, বাবা ইচ্ছে করলেই কমলালেবু এবং আপেলের গাছ পুঁতে দিতে পারেন। জল, হাওয়া, মাটি— বড় কথা নয়, বাবার লাগানোটাই বড় কথা। বাবার হাতে গাছ বড় ফলবতী হয়। আমাদের ধারণা এমন এবং মাও বাবার এই সাফল্য সম্পর্কে কোনদিন ঠেস দিয়ে কথা বলেনি। বাবা বললেন, একবার আন দেখি, রামের দোসরকে।
পিলু সার্কাসের খেলোয়াড়ের মতো হনুটাকে বাবার সামনে ছেড়ে দিল। বেশ লম্ফঝম্ফ করছে। পিলুর মনে হচ্ছিল, যেন নাচ দেখাচ্ছে বাবাকে। তার মনে হল, বাবা ঠিক আগের মতো তার কাজের বুদ্ধিমত্তা অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। সে একটু বেশি খুশি হয়ে বলে ফেলল, বাবা ঘুঙুর এনে দেবে?
—ঘুঙুর?
—ঘুঙুর। মানে পায়ে বেঁধে দেব।
—কবে শুনব, তুমি একটা ভালুকের বাচ্চা ধরে নিয়ে এসেছ। তার জন্য চাই ডুগডুগি। তোমার জননীটি তোমার মাথা খাচ্ছে। তোমার এই দোসরটি সংসারে উপদ্রবের শামিল। এটা তোমার জননীর বোঝা উচিত।
পিলু বলল, মা শুনছ?
—তোমার মাকে বলিনি ত? তোমাকে বলেছি। তাঁকে আবার ডাকছ কেন?
পিলু বলল, ছেড়ে দেব?
–তোমার মাকে জিজ্ঞেস কর। আর শোন, বলবে- আমি কেবল আড্ডা দিই না।
নিবারণ দাসের মার বৃষোৎসর্গ শ্রাদ্ধ হবে। তার ফর্ম, তার বৃষকাঠ, তার বৃষ কেমন হবে সব জায় করে দিতে হল। দুপুরে বের হয়েছি, ফিরেছি রাত করে। কাজের মানুষের এটা হয়। সব সময় ঘরে এসে মা মনসা দেখলে কারো ভাল লাগে না।
মা রান্নাঘরে। ভাত বসিয়ে কিছু কাঠকুটো আনতে গেছে গোয়ালের চাল থেকে। মা শুনে গেল। কথা বলল না। মা কাঠকুটো নিয়ে গেল। কথা বলল না। এটা আমার ভাল লাগছিল না। হনুর বাচ্চাটাকে নিয়ে প্রথম মা’র আর্তনাদ, পরে নিজের সংসারে আর একজন অতিথি ভেবে চুপচাপ, বাবা প্রথমে নারাজ, পরে মা’র মর্জির কথা ভেবে চুপচাপ—এখন দু’জনের একজন যা বলবে, অন্যজন তার বিপরীত। মা যদি বলে এক্ষুনি বিদায় কর, বাবা বলবে, আহা ছেলেমানুষ ধরে এনেছে, থাক না। আমি না হয় একজোড়া ঘুঙুর এনেই দেব।
মা বলবে, না আমার এত জ্বালা সহ্য হয় না। ছেলের জন্য আমি কথা শুনব কেন!
বাবা বলবেন, তুমি জননী! তুমি শুনবে না তো কে শুনবে। মার তখন গলায় ধার উঠবে। রাখ তোমার মিষ্টি মিষ্টি কথা। ওতে চিঁড়ে ভিজবে না।
—চিঁড়ে না ভিজুক, মুড়ি ভিজুক।
বাবার এমন কথায় মা আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। আমাদের ডেকে বলবে, শোন তোর বাবা- ঠাট্টা করছে। আমাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা। দিন রাত খেটে মরি, কেউ কুটোগাছটি নাড় না। যার যেখানে খুশি যাও। যখন খুশি ফের। একটা তো বাড়ির বাইরে বার হল, আর একটা সারাদিন বন-বাদাড়ে, আমি কি বাড়ির ঝি-বাঁদী। আমাকে ঠেস দিয়ে কথা। তারপর বাবা হয়ত বলবেন, চণ্ডীপাঠ শুরু হয়ে গেল রে।
মা’র তখন আরও উত্তপ্ত ভাব। বাবা মাকে রাগিয়ে দিয়ে যে মজা উপভোগ করেন, আমরা তা পারি না। আমার মনে হয় কেবল, মা বাবা কেন যে এত ঝগড়া করে। কোথাও গেলে ফিরতে একটু দেরি হতেই পারে। তা না, কেন দেরি। কেন বাড়িঘরের কথা মনে থাকে না। আমরা তোমার কেউ না। দিনকাল খারাপ, কার মনে কি আছে কে জানে। কিছু হলে সব তো জলে ভাসবে।
অবশ্য এখনও মা চুপচাপ। কুরুক্ষেত্র শুরু হবার সূচনাপর্বের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আসলে মা কি আজ হনুর বাচ্চাটা আসায় প্রসন্ন। তখনই বোঝা যায় স্নেহ কত নিম্নগামী। ছোট ভাইটা এখন হাঁটতে পারে না শুধু, দৌড়াতেও পারে। হনুর বাচ্চাটা অবলা জীব, যেমন কুকুরের বেলায় কিংবা সেই ছাগশিশু মা’র সেবা যত্নে ওরা বড় বেশি তাড়াতাড়ি বাড়ে। আমরা খাই না খাই, ওদের খাওয়া নিয়ে মা’র বড় চিন্তা। মা’র কাছে এরা আমাদের চেয়েও বড় কাছের। মা বলবে, সবাই উড়ে যাবে। এরা যায় না। কুকুরটা তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।
ঠিক এ-সময়ে মায়ার আবার বাবাকে তাড়া, অ বাবা, বাবাগো কমলালেবুর গাছ একটা লাগাও না।
—সব হবে। হয়ে তো যাচ্ছে। কী বাকি থাকল।
বাবার এটা বাড়িঘর করার পর একটা আপ্তবাক্য। মাকে শুনিয়ে বলা। তোমার মা’র তো কেবল নাই নাই ভাব। সংসারে কার না অভাব থাকে। লাখপতিরও থাকে। তোমার বাবার তো থাকবেই।
তখনই মা’র গলা পাওয়া গেল।—এই আপ্তবাক্য সার করেই থাক। বাবার আগের আপ্তবাক্য ছিল, সে কি দেশ ছিল মশাই। খাওয়ার ভাবনা নেই। শোয়ার ভাবনা নেই। দ্বিতীয় আপ্তবাক্য – রণসাজে আছি। রণসাজ মানে এক স্টেশন থেকে আর এক স্টেশনে। এক পোড়োবাড়ি থেকে আর এক পোড়োবাড়ি। কখনও কোনো আত্মীয়ের আশ্রয়ে। জমি-জায়গা দেখার নাম করে উধাও। হাতের সম্বল শেষ। একটু জায়গা নেই ঘরবাড়ি বানাবার। হয়তো গোটা দিন নিরন্নই কেটে গেল, অভাবের জ্বালায় মা’র গঞ্জনা শুরু হলে, সোজা কথা, রণসাজে আছি। একদম নাই-নাই করবে না। মা, অন্নপূর্ণার ভাণ্ডার কখনও খালি থাকে না। সব হবে। একটু সবুর কর।
শেষে এই বন জঙ্গলে পতিত জমিতে মার শেষ সম্বল অবলম্বন করে উঠে আসা। গৃহদেবতা খুঁজে আনা থেকে ঘরবাড়ি সহ খোঁড়া গুরুটা পর্যন্ত আমার কৃতী বাবার কর্মক্ষমতার সাক্ষ্য। সুতরাং মা’র কথাতে বাবা রুষ্ট হতেই পারেন। দুধ ঘি না হোক, ডাল ভাত সংসারে এখন রোজই হয়। গৃহদেবতার নামে যারা মাসোহারা পাঠায়, তাদের কেউ কেউ ইদানীং টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেওয়ায় অভাবটা আবার জাঁকিয়ে বসেছে। বাবা বলেন, সবারই খরচ বাড়ছে, না পারলে দেবে কোত্থেকে! বাবার ঐ স্বভাব, কোন মানুষের ওপর তাঁর অভিমান নেই। মা বলবে, নির্বোধ হলে এমনই হয়।
—আমি নির্বোধ। শুনছিস কী বলছে!
—বলব না! যে যা দেবে তাই নেবে। এই তো শ্রাদ্ধ করাবে। সব হবে, শুধু ঠাকুরের দক্ষিণার বেলায় হাত সরে না। কত বলি এক পয়সা দু পয়সা নেবে না। কি আকাল চারদিকে! এক পয়সা দু পয়সার কোন দাম আছে?
এটা ঠিক, বাবার পুজো-আর্চার বিষয়টা জপতপের মতো। সাধনার মতো। ফললাভে কিঞ্চিৎ নির্মোহ। দক্ষিণা কে কি দিল বড় কথা নয়। নিষ্ঠাই বড় কথা। ধর্মবিমুখ মানুষেরা এই যে এখনও এতটা করছে, এটা যেন বাবার পুণ্যফলে।
—পয়সাটা বড় হল, ধর্মাধর্মের কথা ভাবলে না।
আপনে বাঁচলে বাপের নাম। ধর্মটাই তুমি দেখ। সারা জীবন এক ভড়ং। আমরা পুরোহিত বংশ। আমাদের অন্য কোন কাজ সাজে! –সাজে না তো বোঝ। বড়টা পরের বাড়িতে, ছোটটা বন-বাদাড়ে— আর দুটো কী হবে কে জানে। মা রান্নাঘরে বসে গজগজ করছিল।
আসলে এ দেশে আসার পর মানুকাকা বাবার দু-দুটো কাজ ঠিক করে খবর পাঠিয়েছিলেন। খাগড়ার বাজারে মল্লিকদের বড় মুর্শিদাবাদী সিল্কের দোকান। দোকানে খদ্দের সামলানোর কাজ। দ্বিতীয় কাজটা দোকানের খাতা লেখা। দুটো খবরেই বাবা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। মানু কী ভেবেছে, আমি জলে পড়েছি। বংশের একটা মান-ইজ্জত নেই।
সেই এককথা মা’র। সুযোগ এলেই খোঁটা দেবার স্বভাব। সুযোগ হাতছাড়া করতে মা রাজি না। মান-ইজ্জত ধুয়ে জল খাও। এত মান-ইজ্জতের কথা বলছ, বড়টাকে তো বাস কণ্ডাকটার করতে চেয়েছিলে।
—বাস কণ্ডাকটার! কে বলেছে বাস কণ্ডাকটার?
—বাসে ঘণ্টি তবে কে বাজায়? ভাগ্যিস পালিয়েছিল—না’লে বহরমপুর-জঙ্গলী-পাইটকাবাড়ি। তোমার মুখে বড় কথা সাজে না।
—মানুষ তো ছোট কাজ থেকেই বড় হয়। আলামোহন দাসের নাম শুনেছে কিনা তোর মাকে জিজ্ঞেস করত। বাবা এবার সরাসরি মাকে প্রশ্ন না করে আমাকে কথাটা বললেন।
পিলু বলল, আমি জিজ্ঞেস করে আসব বাবা?
—না। তুমি পড়তে বস। রামের দোসরের বেলায় মাতৃ আজ্ঞা শিরোধার্য, পড়ার বেলায় ওটা হয় না কেন?
অগত্যা বললাম, তোমরা এবার থামবে কি-না বল। এমন করলে এক্ষুনি চলে যাব। আর আসব না। এই কি দিনরাত তোমরা ঝগড়া করবে। আগে না হয় আমরাই ছিলাম বনটায়, এখন তো সব দেশ থেকে খবর দিয়ে আনিয়েছ। কত ভাল আছ চিঠিতে লিখেছ। এই যদি অবস্থা, তবে ওরা কি ভাববে?
—তোমার মা এটা বোঝে না। দেয় না, দেয় না করেও তো যজমানরা কম দেয় না। এই যে নিবারণ দাসের বাড়িতে কাজ, তাতে একবেলা তোমার মা বাদে সবার ভোজন। একজনের ভোজনে কত লাগে। ষোড়শ শ্রাদ্ধে দু-পাঁচ পয়সা করে দক্ষিণা দিলে কত হয়। পুরোহিত দক্ষিণা, ভোজন দক্ষিণা, ভোজ্যদ্রব্য মিলে কত হয় —কাঁচাকলা, কাঁচা হলুদ, আলু, বেগুন ভোজ্যপত্রে দিলে সব মিলে কত হয়?
মা আর কোন জবাব দিচ্ছে না। আসলে আজকাল মা আমাকে সমীহ করতে আরম্ভ করেছে। আমি পচ্ছন্দ করি না ভেবেই মা নিজে থেকেই রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কাঠকুটো দিয়ে রান্না। এক হাতে মা রান্না বাটনা বাটা সব করে যাচ্ছে। বারান্দা থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম। আগুনের আভায় মা’র মুখ কেমন রক্তাভ হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে। মা কী কাঁদছে।
বাবাও বোধহয় সেটা লক্ষ্য করেছেন। বাবা সহসা কেমন বড় অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন। তাড়াতাড়ি উঠে বারান্দা থেকে উঠোনে নামলেন। কেমন জনান্তিকে বলা, কান্নার কী হল। আমি কি কোন রূঢ় কথা বলেছি। মা’র তখন ফুঁপিয়ে কান্না। আমি বুঝতে পারি, মা’র কষ্ট আমি পরের বাড়িতে পড়ে আছি। বাবার সাধ্য নেই, আমাকে কাছে রেখে পড়ায়। মা’র সাধ্য নেই কলেজে যাবার সময় রান্না ভাত আমার সামনে বেড়ে দেয়। কষ্টটা সেখানে। বাবা আর একটু সংসারী হলে মা’র বোধ হয় এতটা অভিমান থাকত না। বাবার নির্বুদ্ধিতার জন্য বোধ হয় মা আমার ফুঁপিয়ে কাঁদছে। পৃথিবীতে বাবার মতো ভাল মানুষদের বুঝি এমন হয়। আমাকে হঠাৎ তখন বাবা ইশারায় ডাকলেন। কাছে গেলে বললেন, তুমি মা’র কাছে গিয়ে বস। কথা বল। তাতে কিছুটা হাল্কা বোধ করবে। বলে বাবা অন্ধকারে হাত-পা ধুতে কালীর পুকুরের দিকে হেঁটে গেলেন। সংসারে বাবাকে মনে হচ্ছিল তখন বড় একা। এ সংসারের জন্য মা’র কান্নাটা আমরা চোখে দেখি। বাবার কান্নাটা কখন কোথায়, আমরা সেটা টেরও করতে পারি না। আমার বাবা দেশ-ছাড়া হয়ে কত অসহায় দিন যত যায় তত বুঝি।
আমাদের এই বনভূমিটায় আগে গাছপালা, জঙ্গল আর কত রকম লতানে গাছে ভর্তি ছিল। বছর তিনেকের মধ্যে কত ফাঁকা হয়ে গেছে! এখন নবমী বুড়ির বনটায় না গেলে বোঝা যায় না এখানে সত্যি কোন গভীর বন থাকতে পারে। বড় বড় আমবাগান, কোথাও মণীন্দ্র কাঁটার ঘন জঙ্গল, বাঁশের বন, কত রকমের সরীসৃপ আর পাখি। খরগোশ টিয়া আর নানা জাতের সাপ। সবই কেমন ক্রমে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এবারে শীতটা যেন আরও বেশি। গাছপালার একটা ওম থাকে। ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে বলে, মাঠের ওপর দিয়ে শীতের কনকনে হাওয়া সহজেই বাড়িঘরে ঢুকে যেতে পারে।
সকালবেলায় ঘুম ভাঙলে এটা আজ যেন বেশি টের পেলাম। ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। পাশে কাঁথা মুড়ি দিয়ে পিলু অঘোরে ঘুমাচ্ছে। বাবা দু-বার ডেকে গেছেন, মা ডেকেছে। কিন্তু শীতের কাঁথা আমাদের ছাড়তে না চাইলে কী করি! ঘরের ওদিকের মাচানে মায়া কাঁথার ফাঁক দিয়ে হনুর বাচ্চাটা কী করছে দেখছে। পিলু ওর জন্য একটা বস্তা, কিছু ছেঁড়া ন্যাকড়া এবং খড় বিছিয়ে রেখেছিল। সেগুলো এখন সারা মেঝেতে ছড়াছড়ি। সকালে যে মা উঠেই ক্ষেপে যায়নি রক্ষে। ডাকলাম, পিলু ওঠ। এই পিলু, দেখ কাণ্ড হনুটার।
হনুর কথায় ধড়ফড় করে উঠে বসল পিলু। সে নেমেই হনুটাকে ঘরের খুঁটি থেকে খুলে বারান্দায় বের হয়ে গেল। শীতে কাঁপছে হনুটা। পিলু উঠোনে নেমে গেল। দরজা দিয়ে সব দেখা যায়। কিছু খুঁজছে। রোদ ওঠেনি। রোদ উঠলে সে হয়তো হনুটাকে নিয়ে রোদ পোহাত। তারপরই সাদুল্লা আমগাছটার নীচে ধোঁয়া দেখতে পেলাম। পিলু আগুন জ্বেলেছে। এই শীতের ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা পাবার এমন জাদুমন্ত্র পিলুরই একমাত্র জানা। গুটি গুটি আমিও উঠে গেলে দেখতে পেলাম, বাবা কালীর পুকুর থেকে স্নান করে ফিরছেন। বাবাকে দেখলে মনেই হবে না, এটা মাঘ মাসের শীতকাল। একজন সৎ ব্রাহ্মণের পক্ষে প্রাতঃস্নান খুবই দরকার। এতে শরীর প্রফুল্ল থাকে। জরা-ব্যাধি-মৃত্যু কাছে আসতে ভয় পায়। আর ওংকারস্য ব্রহ্মঋষি এমন সব নাভি থেকে তুলে আনা মন্ত্রোচ্চারণে বাবা আমার এখন তদচিত্ত। কিন্তু এত সকালে স্নান কেন? নিবারণ দাসের মা’র শ্রাদ্ধের কাজ আগামীকাল। হাতে বড় কাজ এলে প্রাতঃস্নানের অভ্যাস আছে বাবার। মা’র কাছে গুরুত্ব পাবার অথবা আদায় করার এটা মোক্ষম অস্ত্র।
আসলে আমার মনে হয়, বাবা সকালে স্নান করে ভিজা গামছা পরে তারে যে কাপড় মেলে দিচ্ছেন, হুহু কনকনে শীতে বাবা যে এতোটুকু ঘাবড়ে যাচ্ছেন না, পুত্রদের দেখাবার প্রলোভনে, এই দেখ, তোমরা আগুন জ্বেলেছ শীত থেকে আত্মরক্ষার্থে, আর আমি শীতের বুড়িকে কলা দেখিয়ে খালি গায়ে খড়ম পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। যেন এটা এক ধরনের কচ্ছু সাধনার ফল। মা’র অবশ্য মাঝে মাঝে ইতিমধ্যে গলা পাওয়া যাচ্ছে। – ও মায়া, তোর বাবার কাপড়টা দে। চাদরটা দে। ঠাণ্ডা লাগবে। কিন্তু বাবা কিছুতেই সেদিকে যাচ্ছেন না। ঠাকুরঘরে ঢুকে কোশাকুশি বের করে দিচ্ছেন। ভিজা গামছা পরেই ফুল তুলছেন। মায়া হাতে চাদর এবং কাপড় নিয়ে বাবার পিছু পিছু ঘুরছে।
মা ঘাট থেকে বাসি বাসন-কোসন মেজে যখন ফিরে এল তখনও বাবা ফুল তুলছেন। এত ফুলের কি দরকার বোঝা যাচ্ছে না। কাল রাতে আমার জননী এবং পিতৃদেব উভয়ে বেশ তর্কে মেতে গেছিল। আজ সকালে পিতৃদেব কত ধার্মিক এবং কর্মঠ তার প্রমাণ দেবার একটা প্রয়াস চলছে বোঝা যাচ্ছে। শরীরে দিব্য প্রভাব না থাকলে যে এমন হাফ নাঙ্গা সন্ন্যাসী হয়ে কনকনে শীতে ঘোরা যায় না, জননী আমার সেটা বুঝুক। জননী এবার সোজা কাঠমালতী গাছটার কাছে গিয়ে বলল, অনেক বাহাদুরী দেখেছি। এবারে দয়া করে কাপড়-জামা গায়ে দাও। এই মায়া, বাকি যা ফুল আছে তুলে রাখ। নাও। বলে চাদর এবং কাপড় দিলে বাবা সুড়সুড় করে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলেন।
বাসি বাসন-কোসন ধুয়ে মা’র হাত নীল। এক ঝটকায় বাবার বাহাদুরী ভেঙে মা আমার আগুন পোহাতে আসছে। দেশ-বাড়িতে যে সু-সময় ছিল, এখানে এসে তা কতটা হারিয়েছি, মায়ের রক্তশূন্য হাতই যেন তার প্রমাণ। মা বলল, ও পিলু, দেনা দুটো পাতা। আগুনের মধ্যে মা হাত ঢুকিয়ে অর্ধদগ্ধ পাতাগুলি নেড়েচেড়ে দিল। বোঝাই যায় ঠাণ্ডায় অসাড় হয়ে আছে হাত।
মাকে বললাম, আজ প্রাতঃস্নান!
—বামুনের খোঁজে যাবে।
–বামুনের খোঁজে কোথায় যাবে?
—তোমার মানুকাকার কাছে।
পিলু বলল, কেন আমরা?
—তোমরা মিলে তিনজন।
—আমি যাচ্ছি না। ও-সব শ্রাদ্ধফাদ্ধের নেমন্তন খেতে আমার ভাল লাগে না।
বাবা ঠিক শুনেছেন।—কী বললে।
আমি যাব না বাবা।
কেন যাবে না? না গেলে আমার মুখ থাকবে কি করে। বলে এসেছি তিনজন তো দাসমশাই হাতেই আছে। আর বাকি ন’-জন ঠিক যোগাড় করে আনব।
বাবা বলতে বলতে কাছে এলেন। কিন্তু আগুনটার কাছে ঘেঁষে দাঁড়ালেন না। আগুনের কাছে ঘেঁষে দাঁড়ালে যেন ব্রাহ্মণত্বের অপমান। আগুনে রক্তের ঘনত্ব নষ্ট হয়। রক্ত তরল হয়ে যায়। বামুন নিজেই আগুন। সে মুখ হাঁ করলে আগুন বের হয়। অগ্নিদেবতা সর্বশাস্ত্রে একমাত্র ব্রাহ্মণকেই ভয় করেছে। আগুন এবং আমার বাবার মধ্যে যে রেষারেষি আছে তা এ সময়ে বেশ বোঝা গেল। বাবা বর্ণা মে বিশ্বাসী, ব্রাহ্মণ বর্ণশ্রেষ্ঠ। অগ্নিদেবতা বর্ণশ্রেষ্ঠ। যেন দুই কুলীনে লড়ালড়ি। মা বলল, আগুন পোহাও না। শীতে তো দাঁতকপাটি হচ্ছে।
বাবা যেমন অন্য সময়ে অগ্রাহ্য করেন মা’র কথা, এখনও তাই করলেন। বের হচ্ছেন শুভকাজে, বামুন খুঁজে বের করা বাবার কাছে শুভ কাজেরই শামিল। সক্কালবেলায় আর মা’র সঙ্গে শাস্ত্র আউড়ে কী হবে! তেল-নুন ছাড়া যে মহীয়সী কিছু বোঝে না, তাকে বুঝিয়েও লাভ নেই। বরং এ সময় লায়েক পুত্রটির সঙ্গে কথা বললে কাজে আসবে। আমার দিকে তাকিয়ে বাবা বললেন, কাল নেমন্তন্ন রক্ষা করে কালীবাড়ি যাবে।
মা বলল, যাবি না কেন। ভাল-মন্দ খাবি। দক্ষিণা পাবি।
বাবা বললেন, নিবারণ দাসের মা তোমাদের জাত সাপের বাচ্চা মনে করত।
আমি বললাম, তা করত।
পিলু বলল, বুড়ি আমাকে মোয়া নারকেলের নাড় হাতে দিয়ে হাঁটু গেড়ে প্রণাম করত।
বাবা বললেন, কেন করত?
মা বলল, কেন করত ও কি করে বলবে?
—পুণ্য। পুণ্য সঞ্চয়! বিলু পিলু সবাইকে ভাবত এক একখানা সাক্ষাৎ কার্তিক ঠাকুর। ওরা না খেলে দাসের মা’র আত্মা শান্তি না পেলে মুক্তি পাবে কী করে। আত্মার সদ্গতি বলে কথা। তুমি যাবে। আমার দিকে তাকিয়ে বাবা কথাটা বললেন।
শেষ অস্ত্র এখন ছাড়া দরকার। বললাম, পড়ার ক্ষতি হবে।
হনুটা ঠিক সে সময় বাবার পায়ের কাছে লাফিয়ে পড়ল। বাবার কোঁচা ধরে টানতে থাকল। পিলু এতে মজা পায়। বাবা বললেন, ওতো দেখছি আমাকে লঙ্গা করতে চায়। বলে বাবা আরও দু’পা পিছিয়ে বললেন, দু’দিনে তোমার পড়ার কতটা ক্ষতি হতে পারে। রাজসূয় যজ্ঞ তো নয়। যে ঘোড়া ছেড়ে দিয়েছ, দিগ্বিজয়ে বের হতেই হবে।
বাবা জানেন না, আমার কাছে এটা দিগ্বিজয়েরই শামিল। কিন্তু জানি বলে লাভ নেই। কিছু এদিক ওদিক বললেই, বাবার এক কথা—উড়তে শিখে গেছ, এখন আর আমরা তোমার কে?
আসলে এই শ্রাদ্ধ, শুভকাজে বাবার পিছু পিছু যেতে আমার কেমন লজ্জা লাগে। অথচ এই লজ্জার বিষয়টা কাউকে এখন বলতে পারি না। যেখানেই যাই, মনে হয় সবাই আমাকে দেখছে। ফ্রক পরা মেয়ে যদি সে বাড়িতে ঘোরাঘুরি করে কেমন ভ্যাবলাকান্ত হয়ে যাই। কাজের বাড়িতে ওরা ঠিক থাকে। আর আড়ালে ওরা আসবে দেখবে। কেউ জানালায় দাঁড়িয়ে দেখবে। বলবে, ঠাকুরমশাইর বড় ছেলে কলেজে পড়ে। আমার এসব ভাল লাগে না। অথচ আগে বাবার পিছু পিছু আমি কি না দৌড়েছি। কেবল মনে হত বাবা আমাদের না আবার একা ফেলে চলে যান। যা একখানা ভুলোমনের বাবা।
আগুন, শীতের কনকনে ঠাণ্ডা, সোনালী রঙের নিস্তেজ রোদ তার গাছপালার মধ্যে পিলুর বোধ হয় সহসা পরলোক সম্পর্কে মনের মধ্যে প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে। এসব বিষয়ে সে বাবার চেয়ে কাউকে বড় মনে করে না। বছরকার পঞ্জিকা নিবারণ দাস দেয়। কালুবাবুর মা’র শ্রাদ্ধে একখানা গীতা পাওয়া গেছে। একবার কী কারণে, শম্ভু ঘোষের পুত্রের বিবাহে বাবা কিছু বেশী পুরোহিত বিদায় পেয়ে ছিলেন। ফেরার সময় শহর থেকে কৃত্তিবাসী রামায়ণ এবং কাশীরাম দাসের মহাভারত কিনে এনেছিলেন। মা দেখলে অপচয় ভেবে গজগজ করবে ভয়ে বলেছিলেন, এও শম্ভু ঘোষ দিল। আমাদের ডেকে বলেছিলেন, মাকে বলতে যেও না, কিনে এনেছি। পুত্রদের সামনে বাবার মিছে কথা বলতে বোধহয় দ্বিধা দেখা দিয়েছিল মনে। মিছে বিষয়টা সংক্রামক ব্যাধির মতো। পিলুকে এত করেও বাবা সত্যবাদী করে তুলতে পারছেন না। এটা একটা আপসোস। এতে বোধহয় বাবার ঈশ্বরও কুপিত হন। নানা দিক ভেবেচিন্তেই আমাদের কথাটা বলেছিলেন। সামান্য দু-খানা ধর্মগ্রন্থ নিয়ে সংসারে অশান্তি হোক বাবা বোধ হয় চাননি। তবু মাকে মিছে কথা বলার জন্য বাবার বোধহয় ভেতরটা খচখচ করছিল। আসল রহস্যটা আমাদের কাছে পরিষ্কার করে দিয়ে তিনি কিছুটা হাল্কা হয়েছিলেন। পরে বলেছিলেন, তোমার মা’র মেজাজ বুঝে একসময় কথাটা পাড়া যাবে। তোমরা মাকে কিছু বলতে যেও না। বাবার হেনস্থা হবে ভেবে আমরা মাকে শেষ পর্যন্ত ধর্মগ্রন্থ কেনার বিষয়টা গোপন করে গেছিলাম।
সুতরাং পিলুর ধারণা বাবার অগাধ পাণ্ডিত্য। বাবা গীতা পাঠ করেন। নতুন চণ্ডী একখানা কে দেবে এমন বলে আসছেন বাবা। বাবার নিজস্ব একটা পুঁটুলি আছে। নতুন গামছা দিয়ে সেটা সব সময় বাঁধা থাকে। একমাত্র পুঁটুলিটা মা’র হাটকানোর অধিকার আছে। ওটা পুত্র সন্তানেরা ধরলে বাবা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। শুভকাজ, দিনক্ষণ দেখে দেওয়া বাবার নিত্য কাজ। যারা জানতে আসে কিছুক্ষণ ঠাকুরকর্তার পায়ের কাছে বসে যায়। বাবার ঈশ্বরতত্ত্ব শুনতে তারা ভালবাসে। মহীরাবণ বধে রামের পাতাল প্রবেশ, মহীরাবণের পুত্র আহীরাবণ আরও কী সব এবং সেই যুদ্ধের বর্ণনার সময় রামের দোসর হনুমানের একটা ক্ষুদ্রকায় মাছি হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি বোধহয় পিলুর মধ্যে পুলক সঞ্চার করে। সে তখন পড়ে না। বাবার গল্প পাট শোনে। তখন রান্নাঘরে মার মুখ থমথমে। সক্কালবেলায় মায়া পিলু পড়ছে, আর উনি ভক্তদের ধর্মপাঠ করাচ্ছেন। কি আক্কেল মানুষটার! মাঝে মাঝে মা ডাকবে, এই পিলু পড়। বাবা এক দণ্ডে চুপ মেরে যান, ভক্তরা উঠে যায়। পিলু বাবাকে ছাড়ে না, তারপর কী হল বাবা? বাবা বললেন, এখন পড়, পরে শুনবে।
পিলুর পড়ায় মন বসে না। বাবার কথাবার্তা সবাই এত গভীর আগ্রহ নিয়ে শোনে, আর মা’টা কী। মাঝে মাঝে পিলু ক্ষেপে গিয়ে বলবে, তুমি চুপ কর মা। কিচ্ছু তুমি বোঝ না।
মা’র এক কথা, ওরে পিলু কথায় চিড়া ভেজে না। পড় বাবা। জীবনটা তো নিজের বাপকে দিয়ে বুঝছিস।
এই সব কারণে বাবার প্রতি পিলুর ধর্ম বিষয়ে মৃত্যু বিষয়ে সম্ভ্রমবোধ গড়ে উঠেছে। সে বলল, বাবা নিবারণ দাসের মা এখন কোথায় আছে?
—কোথায় আছে মানে?
—এই মরে গিয়ে যাবে কোথায়? তুমি যে বল কিছুই বিনষ্ট হয় না।
—দাসের মা পঞ্চভূতে লীন হয়েছেন।
—পঞ্চভূতটা কি বাবা?
—ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। এই হল গে তোমার পঞ্চভূত। মানুষ সেখানেই মরে গিয়ে মিলে যায়।
ক্ষিতিটা কি বাবা?
এই যে বিশ্ব চরাচর দেখছ, শস্যক্ষেত্র দেখছ সব ক্ষিতি।
—অপ?
—অপ হচ্ছে জল।
—মা বলল, তুমি না বামুনের খোঁজে যাবে? কখন আহ্নিক করবে। কখন খাবে? দুপুরে ফিরবে, না রাতে?
বাবা বললেন, দেখলি ত। কোন জ্ঞানের কথা হলেই তোর মা’র চণ্ডী পাঠ শুরু হয়ে যায়। তোর মা’র দুঃখ স্বয়ং শিবেরও সাধ্য নেই দূর করে।
—এক শিবের জ্বালায় প্রাণ অতিষ্ঠ, আর এক শিবে শুধু দক্ষযজ্ঞ হবে। এবারে দয়া করে আহ্নিকে বস গিয়ে। দুটো মুখে দিয়ে আমাকে উদ্ধার কর। কোথাও গেলে তো আর বাড়ির কথা মনে থাকে না।
বাবা অগত্যা হাঁটা দিলে পিলু ডাকল, বাবা।
—পিছু ডাকবে না শুভকাজে বের হচ্ছি।
—বাবা, শ্রাদ্ধ করলে কি হয়?
—মানুষের আত্মার সদ্গতি হয়।
—সদ্গতিটা কি বাবা?
এই যে—মাকে উদ্দেশ্য করে বলা। তোমার সন্তানের দিব্যজ্ঞান সঞ্চার হচ্ছে। সামলাও।
—বল না বাবা।
—মানুষ মরে গেলে আত্মা ঘোরাঘুরি করে।
—কোথায়?
—এই চারপাশে।
—দাসের মা’র আত্মা কোথায়?
বাড়ি-ঘরের চারপাশেই ঘোরাফেরা করছে। মায়া কাটাতে কষ্ট হয়। শ্রাদ্ধে অন্নদান, জল দান করা হয়। আত্মা সংসারের টানাটানি থেকে তবে মুক্তি পায়। পিলুর চোখমুখ দেখলে এখন কে বলবে, এই ছেলে বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। পাখি সরীসৃপের সঙ্গে বন্ধুত্ব। বনের গাছপালার সঙ্গে কথা বলে। মৃত্যু বিষয়টা সাময়িকভাবে তাকে কেমন কাতর করে রেখেছে। এত সুন্দর ঘরবাড়ি বনভূমি ছেড়ে চলে যায় মানুষ। সেও মানুষের পরিণতির কথা ভেবে খানিকক্ষণ কেমন মুহ্যমান হয়ে থাকল।
আগুন নিভে গেছে। ঠাকুরঘরে বাবা আহ্নিক করছেন। মা উনুনে দুধ গরম করছে। মায়া বাটি নিয়ে হাজির। –আমি দুধ কলা দিয়ে মুড়ি খাব মা
মা’র এক কথা, না। তেল মুড়ি মেখে দিচ্ছি খেয়ে নাও। খাওয়া ছাড়া তোমরা কিছু বোঝ না। তোমার বাবাকে দিয়ে কিছু থাকবে না।
—বাবাকে এতটা দুধ দেবে। আমাদের একটুকুন দেবে না?
—মানুষটা বের হবে, ফিরবে কখন ঠিক নেই। তোদের কষ্ট হয় না!
বাবা আহ্নিক করতে করতেই বললেন, দাও। ওরা খেলেই আমার খাওয়া হল। আত্মার কথায় আমারও কেমন একটা খটকা লাগল। আত্মা বুকের মধ্যে থাকে। ধুকধুক করে। মৃত্যুকালে ওটাই উড়ে যায়। আমার মা বাবা সবার আত্মা এক সময় উড়ে যাবে ভাবতেই জীবন সম্পর্কে কিঞ্চিৎ বৈরাগ্য উদয় হল। আর নিজের কথা ভেবে কেমন ষোল আনা বৈরাগ্য উদয় হবার সময় দেখলাম পিলু হনুটাকে কাঁধে নিয়ে গোয়ালঘরের দিকে যাচ্ছে। চারপাশে তাকালাম। সব কিছুর মধ্যেই আত্মার অবস্থান। কাউকে হেলা করা ঠিক না। হনুটার সেবাযত্ন দরকার। পিলুকে ডেকে বললাম, খেতে দিলি না?
পিলু বলল, দেব।
পিলু দিক না দিক, আমার দেওয়া দরকার। আত্মা মানুষের মধ্যেও থাকে, হনুর মধ্যেও থাকে। আত্মা না থাকলে কোন কিছুই নড়েচড়ে না। আত্মাকে তোয়াজে রাখা দরকার ভেবে একখানা আস্ত গাছপাকা বর্তমান কলা হনুর বাচ্চাটার জন্য ঘর থেকে বের করে নিলাম। পিলু দু’ একবার যে না ভেবেছে, ঘরের গাছপাকা কলার কথা তা নয়। কিন্তু সে জানে ধরলে মা তাকে আস্ত রাখবে না। দাদা দিলে মা কিছু বলবে না। সেই আশায় সে বোধহয় ঘোরাঘুরি করছে। আমার হাতে আস্ত পাকা মর্তমান কলা দেখে ওর কোনো বিশ্বাস জন্মায়নি। ও ভেবেছে, ওটা আমিই খাব। আমি খেলে, তারও খাওয়া দরকার। সে চিৎকার করে বলল, মা, দাদা কলা খাচ্ছে। আমিও খাব।
আসলে এই অজুহাতে সে আস্ত একটা পাকাকলা হস্তগত করতে চায়। ওর অধিকারের বস্তুটি সে খেল কী হনুতে খেল কারো কিছু বলার নেই।
আমি বললাম, আমি খাচ্ছি না। হনুটাকে দেব।
—সত্যি দিবি?
—হ্যাঁরে। বলে আমরা দু’জনে হনুটাকে মধ্যমণি করে বসলাম। কলা খাওয়ালাম। দুই ভাইয়ে দাসের মা’র মৃত্যু নিয়ে কথা বললাম।
পিলু, বলল, এই আছে এই নেই। কেমন লাগে নারে দাদা। বুকের মধ্যে থাকে। আবার থাকে না। আত্মাটা বুকের মধ্যে টিপটিপ করে।
আমি বললাম, আসলে, ওটা হার্ট।
—হার্ট মানে?
—বুকের মধ্যে থাকে। সব রক্ত ওতে ঢুকে যায় আবার বের হয়ে আসে।
—কেন যায় আসে?
এতটা অবশ্য জানা নেই। বললাম, আসে যায়, রক্ত শোধন করে।
—তুই জানিস না দাদা, ওখানে ওটা পাখি। মরে গেলে উড়ে যায়। চোখে দেখা যায় না। হাওয়া হয়ে যায়। আমি এমন একটা ঘর বানাব দেখবি, পাখিটা উড়ে যেতে পারবে না। ঠোক্কর খেতে খেতে আবার নিজের জায়গায় ঢুকে যাবে। একটুকু ফাঁক থাকবে না। হাওয়া ঢুকতে পারবে না। ঘরে হাওয়া ঢুকতে না পারলে ওটা বের হবে কোন্ পথ দিয়ে। কাউকে মরতে দেব না।
পিলুর ভাবনা ভারি আজগুবি। তবু জানি, সে এই ঘরবাড়ির মৃত্যু নিয়ে ভাবছে। বাবা, মা, মায়া, ছোট ভাই-এর জন্য ওর কেমন ভারি টান ধরে গেল। সবাইকে রক্ষা করার জন্য সে নিজের মতো করে একটা পৃথিবীর কথা ভাবছে। ওভাবে যে আটকানো যায় না, বলে কোন লাভ নেই। বড় হলে বুঝতে পারবে। তারপরই মনে হল কী বুঝতে পারবে? মৃত্যুই শেষ! তারপরে আর কিছু নেই। বাবার ঘরবাড়ি পড়ে থাকবে, গাছপালা বড় হবে, আরও বড় হবে—বাবার সেই ছবিটা ভাবতে আমার মধ্যে কেমন ভয় ধরে গেল। যে কোন মানুষের মৃত্যুই বোধহয় শেষ পর্যন্ত প্রিয়জনে এসে শেষ হয়। বাবা লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন, সাদা চাদরে বাবার শরীর ঢাকা—বাড়ির গাছপালা বাতাসে দুলছে, বাবা নেই অথচ বাড়িঘর গাছপালা এবং শস্যক্ষেত্র একইভাবে আকাশের নীচে জেগে থাকবে। পিলু তার নিজের মতো করে এখন বাড়িঘরের সব কিছুকে রক্ষার নিমিত্ত বেহুলা লখীন্দরের মতো কোনো আবাসের কথা ভাবছে। আমার ভারি হাসি পেল। বললাম, ঘরটা কোথায় বানাবি ঠিক করেছিস? আসলে নিজের ভেতরের দুর্বলতা পরিহার করার জন্য ওকে এমন প্রশ্ন করলাম এবং হাসলাম। যেন পিলুকে চাঙ্গা করতে চাইছি। ও নিয়ে ভাবতে নেই। ও নিয়ে ভাবলে বেঁচে থাকা যায় না।
ভাবলেই কি হয়। বাবা এখন বের হবেন। আমার ভিতরেও আত্মা নিয়ে নানা রকমের প্রশ্ন। এই সময় প্রশ্নটা বাবাকে করলে রেগে যাবেন না তো? কেন জানি বাবার কাছে আজ আমার আত্মা সম্পর্কে প্রশ্ন রাখতে ইচ্ছে হল। বাবার কথাবার্তায় অদ্ভুত এক আত্মদর্শন আছে। এই আত্মদর্শনের জন্য বাবাকে বললাম, একটা কথা বলব?
—তোমার আবার কী কথা? বাবা বের হবার আগে মৌজ করে চোখ বুজে তামাকু সেবন করছেন।
—বললাম, মানুষ এত করছে, আত্মাকে ধরে রাখতে পারছে না কেন?
—বাবা কিছুক্ষণ কী ভাবলেন। তারপর বললেন, ওকে ধরে রাখার কী আছে?
—না এই যে মানুষ মরে যায় তাকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়, আর কিছু থাকে না।
—কেন স্মৃতি থাকে।
—স্মৃতি সব নয়।
বাবা বললেন, কিছুই শেষ হয়ে যায় না। তারপর গম্ভীর গলায় শ্লোক উচ্চারণ করলেন, ন জায়তে ম্রিয়তে…। বলে তিনি বোঝালেন, আত্মার জন্ম নাই, মৃত্যু নাই, আত্মা কোন কিছু হতে উদ্ভুত নয়। আত্মা জন্মরহিত, নিত্য, শাশ্বত, চিরবিদ্যমান। দেহ বিনষ্ট হয়, কিন্তু আত্মার বিনাশ নেই।
তারপর বাবা দুর্গা দুর্গা বলে বামুন খুঁজতে বের হলেন। আত্মার যদি এই প্রকৃতি তবে দ্বাদশ বামুনের জন্য বাবার এই যাত্রা কেন বুঝে উঠতে পারলাম না। বাবাকে আজ কেন জানি ভারি রহস্যময় মানুষ বলে মনে হল। চুপচাপ, কিছুটা হেঁটে বাড়ি পার হয়ে একটা জলার ধারে গিয়ে বসলাম। সামনে বিস্তীর্ণ শস্যক্ষেত্র। সেখানে চাষীরা শীতের সবজি লাগাবার জন্য হালচাষ করছে। বুঝলাম মৃত্যু জীবনের কাছে শেষ কথা নয়।
শস্যক্ষেত্র চাষ-আবাদ দেখতে দেখতে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, এমন সুন্দর পৃথিবীতে আমি একদিন থাকব না। আমি থাকব না, মা থাকবে না, বাবা থাকবেন না, একদিন সবাইকে তীর্থযাত্রার মতো সব ছেড়েছুড়ে বের হয়ে পড়তে হবে। দাসের মা এখন কোন্ জায়গাটায় আছে। কেমন বিশ্বাস করতে ভাল লাগছে হাওয়ার মধ্যে মিশে আছে। দাসের বাড়ির চারপাশে ঘোরাঘুরি করছে। অন্নদান, জলদান হলেই মুক্তি পাবে। মৃত্যুর পর আমি নিজেও বোধ হয় বনভূমিটা ছেড়ে কোথাও যেতে পারব না। ঘরবাড়ির চারপাশে ঘোরাঘুরি করব। আমাকে কেউ দেখতে পাবে না, অথচ আমি সবাইকে দেখতে পাব।
তখনই পেছনে এসে কেউ দাঁড়াল। তাকালাম। মা। –তোকে কখন থেকে ডাকছি, শুনতে পাচ্ছিস না?
বুঝলাম দাসের মা’র মৃত্যু, বাবার দেওয়া আত্মার পরিচয়, এই চাষ-আবাদ এবং মানুষের জীবনযাপন, তার শেষ পরিণতির কথা ভেবে খুবই অন্য নস্ক হয়ে পড়েছি। এক ফাঁকে ছোড়দির মুখও উঁকি দিয়ে গেল। ছোড়দিটা কে, বাড়ির কেউ জানে না। লক্ষ্মী যে এত কথা বলে সেও জানে না। অবশ্য বাবাকে ছোড়দি চিঠি না দিলে আমার বোধহয় ফিরে আসা হত না। পরে ছোড়দির চিঠিটা পড়ে দেখেছি। বিলু এখানটায় আছে। আমাদের ড্রাইভার সামসুরের সঙ্গে পাশের একটা গ্যারেজে থাকে। ওকে নিয়ে যাবেন। সঙ্গে ঠিকানা লিখে দিয়েছিল। বাবা চিঠি পেয়ে বর্ধমান গেলে ছোড়দিকে দেখিয়ে বললেন, এই তোমার ছোড়দি। ছোড়দি যে আমার বয়সী, ফ্রক পরে, আমাকে নিয়ে গাড়িতে হাওয়া খেতে বের হয় আবার কখনও সাইকেলের পেছনে নিয়ে মাঠে হারিয়ে যেতে ভালবাসে, বাবা জানত না। ছোড়দির কতটুকুন বয়স। অথচ কি পাকা কথা। না, না বিলু পড়বে। বিলু তুমি পড়াশোনা না করলে মানুষ হবে কী করে। বড় হবে কী করে। যেন সে ছোড়দির কথা রাখার জন্যই পড়াশোনা করবে। বড় হবে। নাহলে যা অবস্থা, তাতে কাজে লেগে পড়া দরকার। অভাবের তাড়নাতে মা’র কান্নাকাটি মাঝে মাঝে কেমন পড়াশোনার বিষয়ে উদাসীন করে তোলে।
মা বলল, বাড়ি আয়। খাবি। মার পিছু পিছু বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকলাম।
মা আর কোন কথা বলছে না। মা যেন সেই কবে থেকে জেনে গেছে, তার প্রথম সন্তান বিলু বড় হয়ে গেছে। বিলু এই যে মাঝে মাঝে চুপচাপ থাকে, জলার ধারে এসে বসে থাকে, তা অন্য এক সুদূর পৃথিবীর ঘ্রাণ। মা তার বালিকা বয়সে যা টের পেয়েছিল, বিলু তার বয়স বাড়তেই সেটা টের পেয়ে গেছে। মা’র মুখ দেখলেই টের পাই, পিলু যতটা মা’র কাছের, আমি যেন আর ততটা নই। কলেজে পড়ার জন্য বাড়িছাড়া হবার দিনটিতে মা’র কী কান্না। পিলু পর্যন্ত বুঝিয়েছে, তুমি মা কাঁদছ কেন! এইতো বনটা, তারপর কারবালা, কাশবন। কাশবন পার হলে রেল-লাইন। লাইনে উঠলেই মন্দিরের ত্রিশুল দেখতে পাবে। খবর নেবার জন্য আমি এক দৌড়ে যাব, আর এক দৌড়ে আসব।
আমি জানি মা’র কষ্টটা কোথায়। মা’র কাছ থেকে আমি আলগা হয়ে যাচ্ছি। ছোড়দি, লক্ষ্মী, আমার জগতে এসে গেছে। বড় হতে হতে আরও আসবে। শেষে আমি এক বিচ্ছিন্ন মানুষ। নাড়ির টান ছিঁড়ে যাবে। আর এক নারীর ছবি আমার মধ্যে খেলা করে বেড়াচ্ছে, মা সেটা বোধ হয় বুঝতে পারে।
মা বলল, কলা দিয়ে মেখে খা। পিলুকে শুধু মুড়ি তেল দিয়ে মেখে দিয়েছি। মায়াকেও। আমার জন্য বাবার বরাদ্দ দুধ থেকে সামান্য দুধ তুলে রেখেছিল। পিলু গাঁইগুঁই করছে মনে মনে। দাদাটা একদিন দু’দিন থাকবে। সব ভাল মন্দ খাবে। আমি দেবস্থানে ভাল-মন্দ খাই মা’র বিশ্বাস হয় না। বললাম, পিলুকে একটু দাও। কলাটা ভেঙে পিলুকে দিলে সে বলল, নারে দাদা, তুই খা। তোকে তো মা এখন রোজ হাতে ধরে কিছু দিতে পারে না। পিলু মাঝে মাঝে সত্যি বড় বিবেকবান মানুষ হয়ে যায়। তখন মনে হয় সেই বাবার জ্যেষ্ঠ সন্তান। আমি কনিষ্ঠ। বললাম, হয়েছে, নে খা তো।
মায়া বলল, আমাকে দে দাদা।
একটা কলা আমরা তিন ভাইবোনে ভাগ করে খেলাম। গাছের আস্ত একটা কলার কাঁদি নামানো আছে। সবটাই বিক্রি হবে। নরেশ কুণ্ডু দাম-দরও দিয়ে গেছে। দামটা পেলে বাজারের পয়সা হয়। এই করে আমাদের সংসার চলে। হনুটাকে আমি হাতে ধরে কলা খাইয়েছি বলে মা কিছু বলেনি। পিলু ধরলে কুরুক্ষেত্র বেধে যেত। কত অল্প বিষয় নিয়ে মা’র যে মাথা গরম হয়ে যায় কখনও কখনও -না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
মা বলল, এই সেদিন, তোর দাসের মা এসেছিল। কত কথা।
মানুষ মরে গেলে বোধহয় তার কথা বলতে সবাই ভালবাসে। মা আমাদের খেতে দিয়ে নিজে একটুখানি মুড়ি জলে ভিজিয়ে খেয়ে নিচ্ছিল। খুবই ছোট রান্নাঘর ওপরে তালপাতার ছাউনি। প্রতি বছরই বাঁশের খুঁটি দিয়ে ঘরটা বানাতে হয় বাবাকে। মা লেপে মুছে তকতকে করে রাখে। গরুর দুধ ছোট ভাইটার জন্যও আলাদা করে তুলে রাখা হয়। বেশি দুধ হলে, বিক্রি হয়। এ-বিষয়ে বাবার সঙ্গে মা’র ভারি মতান্তর। বামুনদের বাড়িতে দুধ কবে কে বিক্রি করেছে! মা’র কথা—রাখ তোমার বামুনের বাড়ি। দুধ বিক্রি হলে হাতে কিছু পয়সা হয়। মা মাছ না হলে খেতে পারে না। এয়োতি মাছ না খেলে সংসারে অমঙ্গল ঢোকে। বাবা তখন আর টু শব্দ করে না। কারণ এ বিষয়ে বাবারও সংস্কার আছে বড় রকমের। বামুনের গরু দুধ দেবে, সে দুধ বিক্রি হবে বড় কথা, না, বামুনের বউ মাছ ভাত খাবে বড় কথা। দুই টানা-পোড়েনের মধ্যে বাবা দুধ বিক্রির বিষয়টা মেনে নিয়েছিলেন। এখন গরুটার দুধ কমে যাওয়ায় গাছের কলা, পেঁপে বিক্রি হয়। তালের দিনে তাল। কিংবা সবজি ভাল হলে তাও বিক্রি। লাউ, কুমড়ো বাবার হাতে খুব ফলে। পাঁচ বিঘের মতো জমিটার বিঘেখানেক বাদে আর সবই এখন সাফ। ওদিকে বড় বড় দুটো শিশু গাছ আছে। হাতে টাকা জমলে গাছ কেটে একটা তক্তপোশ আর দুটো জলচৌকি বানাবার ইচ্ছে আছে মা’র। বলতে গেলে মা’র জীবনে এখন এটা একটা বড় রকমের স্বপ্ন।
হঠাৎ মা’র দিকে তাকিয়ে কেমন সংকোচে পড়ে গেলাম। মা তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আজকাল মা আমাকে গোপনে দেখে। গোপনে চুরি করে এই দেখাটার মধ্যে কোথায় যেন মা’র একটা অহংকার তৈরি হয়। আসলে আমার মধ্যে মা বোধহয় বাবার তরুণ বয়সের ছবিটা দেখতে পায়। মা চোখ নামিয়ে খুব ধীরে ধীরে বলল, তুই যেদিন হলি, কী বৃষ্টি। তোর বাবা বাড়ি নেই। শ্বশুরমশাই শুকনো কাঠ সব তুলে রেখেছিলেন বারান্দায়। আঁতুড়ঘরে সব লাগে। আমার জন্মদিনটার কথা বলে মা কেমন আত্মপ্রসাদের হাসি হাসল। একজন মানুষ পৃথিবীতে এভাবেই আসে। বড় হয়। মা না থাকলে আমার কী হত। আমি তো জন্মাতামই না। নিথর এক অন্ধকারে আমার আত্মা শুধু ঘোরাফেরা করত। জন্মরহস্য বড় গভীর। ছোড়দি কেন জানি ফের সামনে দিয়ে আঁচল উড়িয়ে চলে গেল। কী বড় হবে তো। আমার কথা মনে থাকবে তো। ছোড়দির চোখেও মা হবার গোপন আকাঙক্ষা লক্ষ্য করলাম। সব ভাবতে গিয়ে আমার চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে বুঝতে পারছি। কান ঝাঁ ঝাঁ করছে। আমি আর মা’র সামনে বসে থাকতে সাহস পেলাম না। যা এত পবিত্র, যা আমার পৃথিবী আগমনে সহায়তা করেছে সেই বিষয়টা এত অপরাধপ্রবণ করে তোলে কেন যেন কোন পাপ চিন্তা করছি। কোনরকমে খেয়ে মা’র কাছ থেকে দ্রুত দৌড়ে পালালাম।
এই ঘর-বাড়ির প্রতি বাবার মত আমারও কেমন একটা মোহ জন্মে যাচ্ছে। বাবার লাগানো গাছপালা বড় সজীব। ওরা ক্রমেই আকাশের দিকে মাথা তুলে দিচ্ছে। হাওয়ায় গাছের পাতা নড়ে ভাল নড়ে। যেন গাছপালাগুলি হাওয়ায় নড়েচড়ে তারাও আমাদের মতো বেঁচে আছে বড় হচ্ছে প্রমাণ করে। বেশি হাওয়া দিলে ডালপালা নুয়ে যায়। যেন বাবার কাছে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। বলতে চায়, আমরাও তোমার সন্তান-সন্ততি। সার জল দিচ্ছ, আগাছা সাফ করে দিচ্ছ, বড় হতে মানুষের যা লাগে, আমরাও তাই পাচ্ছি। আমরা বুঝতে পারি, গাছের ডালপালা ভাঙলে বাবা কেন এত রেগে যান। —দিই তোমার একটা হাত ভেঙে, দিই তোমার কান ছিঁড়ে। বুঝবে লাগে কিনা। বাবার এই তিরস্কারে টের পাই যারা বাড়ছে তারা সবাই এই ঘর-বাড়ির প্রিয়জন। আর এ জন্যই বুঝি গাছপালাগুলি আমাদের ঘর-বাড়ির চারপাশে সবুজ এক অকৃপণ সমারোহ সৃষ্টি করে চলেছে। যে কেউ ঢুকে গেলে ভাবতে পারে একটা তপোবনে ঢুকে গেলাম। এখন এই গৃহে মায়া যেন শকুন্তলার মত ঘুরছে ফিরছে। তার কাজের শেষ নেই। সে সকাল হলে ফুল তোলে। স্থলপদ্ম গাছটা কত বড় হয়ে গেছে। শীতের সময় বাবা সূর্যমুখীর চারা লাগান। এত ফুল ফুটতে শুরু করে যে তখন মনে হয় হলুদ এক প্রজাপতির দেশ। কত রঙবেরঙের প্রজাপতি উড়ে আসে। বাবার খুব এতে আনন্দ হয়। প্রজাপতি ফড়িং কীটপতঙ্গ সব মিলে তখন বাবার একটা ভিন্ন গ্রহ। তবু বাবা কেন? যে বাড়ি থেকে বের হলে সহজে আর ফিরতে চান না এটা আমার মাথায় আসে না।
সকালে বের হয়েছেন, এখনও ফেরার নাম নেই। শুধু বলা, নিবারণ দাসের মা’র আদ্যশ্রাদ্ধ। মধ্যাহ্নে ব্রাহ্মণ ভোজন। নিবারণ দাস তাঁর মা’র আত্মার সদ্গতির জন্য ব্রাহ্মণ বিদায়ের ব্যবস্থা করেছেন। শহরে ন’জন বামুন মানুকাকাই ঠিক করে দেবে। মানুকাকা শহরটায় কতকাল থেকে আছে। সবার নাড়ী নক্ষত্র তার জানা। তবু বাবা দুপুরে ফিরলেন না। বাবা না এলে মাও খাবে না। কত বলেছেন, ধনবৌ আমার জন্য বসে থেক না। দেরি দেখলে খেয়ে নিও। মানুষের সঙ্গে দেখা হলে কুশল জিজ্ঞেস করতে হয়। পরিবারের খবরাখবর নিতে হয়। মানুষের ভাল-মন্দ জানার আগ্রহ না থাকলে টান জন্মাবে কেন। দুদিনের পান্থশালা, সবার সঙ্গে যত পার একটু গল্প-গুজব করে নাও। এতে জীবনের প্রসারতা বাড়ে। অভাব গায়ে এঁটুলির মতো আটকে থাকতে পারে না।
এ দেশে আসার পর মানুষকে খবর দেবার মতো তাঁর কিছুই ছিল না। এখন কত খবর তাঁর। দেখা হলেই বলা, বিলুটা তো কলেজে পড়ছে। মেজটা পুজা-আর্চা করতে পারে। বাড়িতে আমলকী গাছটা যে সারা বছর ফল দেয় সেটাও একটা বড় খবর। এবারে সূর্যমুখী ফুলের আকার-প্রকার নিয়েও কথা হবে। খোঁড়া গরুটার জাত ভাল। দুধ দুইয়ে সেটা তিনি টের পেয়েছেন। কারো কোনো জমি ফাঁকা পড়ে থাকলে নানারকমের গাছের কথা বলবেন। বাড়ি আছে গাছপালা নেই বাবা সেটা ভাবতে পারেন না। জমির কোন্ দিকটায় কী গাছ পোঁতা হবে তারও এক তালিকা দেবেন। ফলের গাছ বাড়ির উত্তরের দিকে, পশ্চিমে নারকেলের গাছ। সামনে ফুলের গাছ। দেশী ফুলের প্রতি বরাবর আগ্রহ বাবার। শ্বেত জবা, রাঙা জবার গাছ, ঝুমকোলতা কিংবা অপরাজিতার লতা কখন কি লাগাতে হয় বাবার চেয়ে যে কেউ বেশি ভাল জানে না তা প্রমাণ করতে দরকার হলে খাটাখাটনি করে কলম বানিয়ে পৌঁছে দেবেন। যেন বাড়িটা সুন্দর করে তোলার দায় লোকটার না, বাবার।
মা গজগজ করলে বলবেন, গাছটা যদ্দিন বাঁচবে, আমি তদ্দিন ও বাড়িতে, বোঝ না কেন? লোকে টের পায় আমার গাছ সত্যি কথা বলে।
মা বলবে, একেই বলে নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো।
বাবা বলবেন, একেই বলে জীবন। জীবন কখনও একা থাকতে পারে না।
—রাখ তোমার আদিখ্যেতা। খাওয়া নেই, নাওয়া নেই, এতক্ষণ ওই করে এলে।
—না না। ওটা ঠিক না। দই চিঁড়া-মুড়ি খেয়েছি। কী খুশী রতনবাবু।
বাড়ির গাছগুলিতে বর্ষাকাল এলেই বাবার কলম ধরানো। ভাল জাতের আম, জাম, জামরুল যত গাছপালা সবার ডালে ডালে কলম বানাবার এক উৎসব লেগে যায় তখন। কে কোন্ গাছের কলম চেয়েছে বাবার কাছে একটা তালিকা থাকে। ভুল করে কেউ নিতে না এলে নিজে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসবেন। সেখানেই শেষ নয়। কলমটা লাগাবার প্রক্রিয়া কি, মাটিতে সবুজ সার দিতে হয়, কতটা গর্ত সব ঠিকঠাক করে তবে ফেরা। বাড়ি ফিরে গাছতলা দিয়ে যাবার সময় বলবেন, দিয়ে এলাম তোমার ছানাপোনাকে। খুব আদরযত্ন করছে। এই করেই শেষ হলে তবু কথা ছিল। তা না, ফাঁক পেলেই আবার ঘুরে দেখে আসেন। দেখে আসা, আদরযত্ন হচ্ছে কিনা, না রুগ্ন হয়ে গেল। এমন একজন যার বাবা তিনি যে বের হলে দুপুরে ফিরতে পারেন না সেটা আমাদের এতদিনে ঠেকে শেখা উচিত ছিল।
মা রান্নাঘরের দাওয়ায় বাবার পথ চেয়ে বসে আছে। পিলুকে একবার পাঠিয়েছে বাদশাহী সড়কে, যদি দূর থেকে দেখা যায়। শীতের বেলা পড়ে আসে। সব ঠাণ্ডা হয়ে যায়। মা আঁচল পেতে বারান্দায় শুয়ে থাকে। মায়া বারবার ডাকে, ও মা ওঠো। খেয়ে নাও না। তুমি তো জানই বাবা এমন করে। খেয়ে নাও না।
ছোট ভাইটা মা’র শিয়রে বসে আছে। সেও মাকে ঠেলছে। মা এবং মায়া যতটা বোঝে আমরা ততটা বুঝি না। সেও বোধহয় ঠেলে ঠেলে মাকে বলছে, মা ওঠো। মা মা।
আসলে মা কেন খাচ্ছে না বুঝি। বাবার ওপর রাগ অভিমান এবং ক্ষোভে মা বিপর্যস্ত। ভেতর থেকেই খাবার ইচ্ছেটা থাকে না। রাস্তাঘাটে কত রকমের বিপদ ওঁত পেতে থাকে। যাবার সময় বলেও গেছে, এসে খাব। আর কিনা সাঁজ লেগে গেল তবু ফেরার নাম নেই। আমাকে ডেকে বলল, একটু এগিয়ে দেখ না বাবা। বলে উঠে বসল। পিলু কখনও কখনও সদয় হলে জল এনে দেয়, পুলিশ ক্যাম্প থেকে। আজ মা’র অবস্থা দেখে, সবই যে তাকে করতে হবে বুঝতে পারছে। পিলু কলসীটা মাথায় নিয়ে বলল, আয় দাদা, বাবাকে দেখে আসি। দেখে আসার জন্য যখন পুলিশ ক্যাম্প পার হয়ে যেতেই হবে, তখন জলটা নিয়ে এলে মা’র কাজে সামান্য সুরাহা হবে।
এছাড়া পিলুর ধারণা, বাবা বাড়ি না থাকলে মা’র যে বৈরাগ্য দেখা যায় সবকিছুতে পুত্রদের কাজেকর্মে উৎসাহ দেখলে তাতে ভাটা পড়তে পারে। বাবা বাড়ি না থাকলে পিলু খুবই সুপুত্ৰ বনে যায়। নিজে থেকে জলটা নিয়ে আসার এটাই তার প্রেরণা। সে তার সব সময়ের সঙ্গী হনুটাকেও কাছ থেকে আলগা করে ফেলল। পেয়ারা গাছটার ডালে তাকে বেঁধে জলের কলসী নিয়ে ফের ডাকল আমাকে। —চল না দাদা। জল তুই পাম্প করে দিবি।
মা ফের বলল, বিলু যা না বাবা, এগিয়ে দেখ একটু। জল আনা না আনার বিষয়ে মা’র কোন এখন মাথাব্যথা নেই। মানুষটা এখনও ফিরল না-কি ভাবে। এতবার কথা খেলাপ কেউ করে! তারপরই কি ভেবে যেন মা’র মুখ ভারি বিষণ্ণ হয়ে যায়। বোধহয় কোন অমঙ্গল চিন্তা মাথায় ঢুকে যায় তখন। এ সময় মাকে প্রবোধ দেবার ভরসা আমার। যাবার সময় বললাম, পঞ্চানন তলায় খোঁজ নেব মা?
কেমন জলে পড়ে গেছে মতো বলল মা, যা ভাল মনে হয় কর।
ইদানীং বাবা বোধহয় একটু বেশি গৃহাগত প্রাণ হয়ে পড়েছিলেন। অথবা এও হতে পারে অনেক দিন পর বাবা ফের বাড়ি ফেরার ব্যাপারে মা’র সঙ্গে কথা খেলাপ করেছেন। যে মানুষটা ভারি বিবেচক হয়ে উঠেছিল, সেই ফের এমন অদায়িত্বশীল হতে পারে ভেবে বোধহয় মা কষ্ট পাচ্ছে।
পঞ্চাননতলা গেলে কলসীটা সঙ্গে নেওয়া যায় না। বাদশাহী সড়কে উঠে করাত কল পার হয়ে গেলে বোর্ডের রাস্তা। রাস্তাটা রেল লাইন পার হয়ে শহরের দিকে গেছে। মোড়ে কয়েক ঘর উদ্বাস্ত জমি-জমা কিনে বাড়ি করেছে। বাবার বলতে গেলে এটা দ্বিতীয় জমিদারী। সব ক ঘরই বাবার যজমান। ওখানে গেলে বাবার কোন খবর পাওয়া যেতে পারে। অগত্যা দুই ভাই মিলে বাপের খোঁজে বের হলাম। রাস্তায় পিলু বলল,পঞ্চাননতলায় খোঁজ না পেলে মানুকাকার বাড়ি যাব। শীতের সন্ধ্যায় দু’ক্রোশ পথ অনায়াসে হেঁটে যাওয়া যায়। আর দু’জন একসঙ্গে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় বেশ একটা রোমাঞ্চ বোধ করি। এই রাস্তাটা দিয়ে আমরা এতবার শহরে গেছি, চোখ বেঁধে দিলেও বাড়ি ফিরতে অসুবিধা হবে না।
পুলিশ ক্যাম্পটা এখন প্রায় খালি। ম্যাগাজিন কোয়ার্টারে মাত্র একজন সেন্ট্রি পাহারা। কালীপুকুরের দক্ষিণ পাড়টায় অফিসারদের কিছু কোয়ার্টার। ওদের ছেলেপিলেরা বাগানে ছুট বসত্তি খেলছে। পিলু বাবার খোঁজে বের না হলে এখন এদের মধ্যে রাজার মতো বিরাজ করত। ওকে দেখে কেউ কেউ দৌড়ে এল। সে ওদের পাত্তা দিল না। বলল, বাবাকে খুঁজতে যাচ্ছি।
—তোর বাবা আবার উধাও হল।
—উধাও হবে কেন!
—এই যে বলিস বাবাটাকে নিয়ে আমাদের হয়েছে মুশকিল। ক’দিন বাদে বাদে বেপাত্তা।
—বাবা তো কাজে যায়। কাজে গেলে দেরি হতেই পারে।
আমার সামনে পিলু এদের কথা বরদাস্ত করতে চায় না। সে আমাকে নিয়ে জোরজার করে রাস্তায় উঠে গেল। পুলিশের প্যারেড শেষ হয়ে যাবে এবার। বিউগিল বাজছে। এই বিউগিল বাজলেই আমরা আমাদের সময় ঠিক করে নি। পাঁচটা বাজে! আবার ফল-ইনের সময় বিউগিল বাজবে। আমরা শহরে গেলে ফিরতে ন’টা বেজে যেতে পারে। পুলিশ ক্যাম্পের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। তখন সেন্ট্রি হাঁকে, হু কামস্ দেয়ার। পিলু বলবে, আমি, আমি পিলু। সঙ্গে সঙ্গে সেন্ট্রি ঠিক বুঝতে পারে, বন-জঙ্গলের মধ্যে যে ঠাকুরকর্তা বাড়ি ঘর বানিয়েছে, পিলু তার ছেলে। পিলু ফের বলবে, আমার সঙ্গে দাদা আছে। বাবাকে খুঁজতে শহরে গেছিলাম। এগুলো আমার পরিচিত দৃশ্য—কাজেই রাত হলেও খুব একটা ভয় থাকে না।
কিন্তু আমাদের বেশি দূর যেতে হল না। করাত কলটার কাছেই রাস্তাটা বাঁক নিয়েছে। এই বাঁকটার মুখে দাঁড়ালে পঞ্চাননতলার বড় বটগাছটা দেখা যায়। তার নীচে রাস্তাটা বাঁক খেয়ে একটা গেছে শহরে অন্যটা ইষ্টিশনে। সাইকেল রিকশাটা কিছুক্ষণ আড়াল করে রেখেছিল মোড়টা, ওটা সরে যেতেই পিলু বলল, ঐ দেখ বাবা আসছে। সাঁঝবেলার একটা লাল আভা থাকে। অনেক দূরের বস্তু বোধহয় তখন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমার নজরে আবছা মতো একটা মিছিল ভেসে উঠল। একদল মানুষ প্রায় মিছিল করে আসছে। এদের মধ্যে আমার বাবা আছেন, আমি ঠিক ঠাওর করতে পারছি না। বললাম, কী আন্দাজে বলছিস? কোথায় বাবা?
—ওদের মধ্যে ঠিক দেখবি বাবা আছে।
পিলু কী হাওয়ায় বাবার ঘ্রাণ পায়। আমি কিছুই ঠাওর করতে পারছি না, অথচ পিলু অনায়াসে পারছে। বাবার কাছ থেকেও আমি বোধহয় আলগা হয়ে যাচ্ছি। পিলুর এখনও সেটা হয়নি। পিলুর জীবনে কোন ছোড়দির আবির্ভাব হতে এখনও অনেক দেরি। এসব ভেবে পিলুর ওপর আমার খুব হিংসা হল। বললাম, তুই বড় আজেবাজে বকিস।
আর তক্ষুনি দুটো ট্রাক সাঁ সাঁ বেগে ধেয়ে আসছে। দানবের মতো কেমন খাব খাব করতে করতে আসছে। পিলু আমার হাত ধরে টানতে টানতে জমিতে নেমে গেল। সে জানে এদের কোন মায়া দয়া নেই। কীট-পতঙ্গের মতো ওরা মানুষকে দেখে। তার দাদাটির হয় বাস ড্রাইভার, না হয় ট্রাক ড্রাইভার হবার কথা ছিল। শেষ পর্যন্ত বাবার পরিকল্পনা মতো তার দাদাটি যে সে-রাস্তায় হাঁটেনি এতে এখন সে গর্বিত। কারণে অকারণে সে তার বন্ধুদের বলতে ভালবাসে, দাদা আমার কলেজে পড়ে। এই কলেজে পড়ার সঙ্গে পিলুর কোথায় যেন সম্ভ্রমবোধ জড়িত। ট্রাক দুটো ঠিক যখন আমাদের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল, পিলু মুখ ভেংচে দিল। ওর ভারি রাগ ট্রাক ড্রাইভারদের ওপর। কবে কাকে চাপা দিয়েছিল, সেই রাগ সে পৃথিবীর তাবৎ ট্রাক ড্রাইভারদের ওপর পুষে রেখেছে। একটা কিছু হাতে নিয়ে সে ঢিল ছুঁড়তে যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি আমি হাত ধরে ফেললাম, এই কী করছিস। ওরা যদি গাড়ি থামিয়ে আমাদের তাড়া করে।
—ধুস। পারবেই না।
কেন পারবে না বুঝতে পারি। পিলু শশকের চেয়ে দ্রুত দৌড়াতে পারে। আমিও পারি। কিছুটা ছুটতে পারলেই নবমী বুড়ির বনটা পাওয়া যাবে। সেখানে ঢুকে গেলে কার সাধ্য নাগাল পায়। যেন বড় বড় গাছগুলি দাঁড়িয়ে সেই দানবের মতো ট্রাক ড্রাইভারদের হাত থেকে তাকে এবং তার দাদাকে রক্ষা করবে। চোখের পলকে সে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারবে, সেটা সে ভালই জানে। তবু আমার কথায় যেন নিরস্ত হল। বাবাকে খুঁজতে যাচ্ছি, এ সময় উটকো ঝামেলা বাধানো যে ঠিক হবে না, পিলু সেটা বুঝে হাত থেকে ঢিলটা ফেলে দিল। তারপর আমাকে সঙ্গে নিয়ে ফের রাস্তায় উঠে বলল, ঐ দেখ। আমি মিছে কথা বলি না।
ট্রাক দুটো দেখে আমরা বেশ অনেকটা দূরে সরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। ট্রাক দুটো চলে যাবার পর রাস্তায় উঠতে গিয়ে তা ধরা গেল। আমি একা থাকলে বোধহয় এতটা হত না। কিন্তু পিলুর যে নিজের চেয়ে দাদার জীবনের জন্য বেশি মায়া। তার কিছু হলে তেমন ক্ষতি নেই, কিন্তু দাদার কিছু হলে বাবার ঘর-বাড়ি নিঃস্ব হয়ে যাবে সে বোধ প্রবল। টানতে টানতে এতটা দূরত্ব তৈরী করার এটাই মোক্ষম কারণ। রাস্তায় উঠে গেলে কয়েক মিনিটের মধ্যে আমরা বাবার নাগালও পেতে পারি। পিলু আমার দিকে তাকিয়ে কি দেখল, মিছিলটা আরও কাছে এসে গেছে। পিঙ্গু তারপর দৌড়াতে থাকল। মিছিলটার মধ্যে আমার বাবা যে সত্যি আছেন এবার আর অবিশ্বাস করার উপায় রইল না। মিছিলের মধ্যে বাবাকে দাদার আগে আবিষ্কার করার নেশায় তাকে পেয়ে বসেছে।
পিলু ঠিক আবিষ্কার করেছে। সে মিছিলের শেষের লোকটির হাত থেকে কী একটা যেন নিয়ে নিল। তারপর হাত তুলে ডাকল, দাদারে।
আমি হাত তুললাম না। পিলুর ছেলেমানুষী আমার সাজে না। রাস্তার এক পাশে খুব ধীর স্থির চিত্তে বাবা যে সত্যি আছেন দেখার জন্য দাঁড়িয়ে থাকলাম।
উত্তরের ঠাণ্ডা হাওয়া আমার চাদর উড়িয়ে নিচ্ছিল। পিলুর একটা হাফ শার্ট গায়ে। ওর শীত কম। সে দৌড়ায় বলে শীত কম লাগতে পারে। এও হতে পারে সে শরীরে ঠাণ্ডা লাগলে চঞ্চল হয়ে ওঠে। স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারে না। কেবল লাফায়। এ-গাছের ও গাছের পাতা ছেঁড়ে। ডাল ভাঙে। বাড়িতে যা করতে পায় না, রাস্তায় বের হলে সেটা পুষিয়ে নেয়।
কাছে এলে দেখলাম, পিলুর হাতে নতুন একটা গামছার পুঁটুলি। বাবা বামুন খুঁজতে গিয়ে নিজেও কিছু উপার্জন করে ফিরছেন। হয়তো চণ্ডীপাঠ, কিংবা কোনো বাড়িতে বামুনের অভাবে মঙ্গলচণ্ডীর পূজা, অথবা বিপদনাশিনীর ব্রত করে ফিরছেন। বাবার পুঁটুলিটা পিলুর অধিকার করার কারণ, ওতে চাল-ডাল কিছু আনাজপাতি সহ দক্ষিণার এক পয়সা দু’পয়সা লুকিয়ে থাকতে পারে। বাড়ি গেলে সে প্রথমে বারান্দায় ওটা খুলে হাঁটকাবে—যদি মিলে যায়। মিলে গেলে সে তামার পয়সাটা হস্তগত করবে। মা মায়াও উপুড় হয়ে পড়বে। যার হাতে ঠেকবে, সেই তার উত্তরাধিকারী। পয়সা দখলের জন্য তখন বাড়িতে হলুস্থুল কাণ্ড। বাবা, বারান্দায় বসে তখন প্রসন্ন চিত্তে হুঁকো খাবেন।
বাবা ডাকলেন, বিলু এদিকে এস।
মিছিলটা থেমে আছে।
বাবা বললেন, প্রণাম কর। পিলু প্রণাম কর।
বাবার এই এক বাই। বাড়িতে, রাস্তাঘাটে স্ববর্ণের কোন মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে, প্রণাম না করলে বাবা রাগ করেন। আমার এ-সব ভাল লাগে না। এই রাস্তায় কেন। বাড়ি গেলে করা যাবে। আমার পছন্দ নয় হুটহাট প্রণাম করা, কিন্তু বাবার অবাধ্য হতে বাধে। বামুনেরা দাঁড়িয়ে আছেন। ন’জন ন’রকমের। একজন আবার এত কুঁজো যে সোজা হয়ে দাঁড়াবার শক্তিটুকু পর্যন্ত নেই। তিনি আমাকে ঘাড় বাঁকিয়ে দেখলেন। যেন কিছুটা জিমনাস্টিকের খেলা দেখাচ্ছেন। কিম্ভুতকিমাকার সব মানুষ। একজন অনবরত খক্খক্ করে কাশছিলেন। খালি পা চারজনের। একজনের পায়ে খড়ম। তিনজনের টায়ারের চটি। একজনের কেডস জুতো। মাথায় লম্বা এবং নাতিদীর্ঘ টিকি। দু’জনের টিকিতে জবাফুল বাঁধা। বয়স সবারই আমার পিতৃদেবকে ছাড়িয়ে। ছেঁড়া নামাবলী, সাদা চাদর, তালিমারা কালো পশমের সোয়েটার। কনকনে শীতে কুঁজো মানুষটার হাতের লাঠি কাঁপছে।
পিলু লাইনবন্দী বামুনদের প্রণাম করছে। সবাই রাস্তা থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। পিলুর সব কিছুতেই চট-জলদি ব্যাপার। সে দ্রুত প্রণাম সেরে হাতে পোঁটলা নিয়ে ছুটল। মাকে খবরটা দিতে যাচ্ছে। বাবা তো ফিরছেনই, সঙ্গে সেই বামুনের বাহিনী। কাল শ্রাদ্ধ। আজ শীতের রাতে এরা কোথায় থাকবে, খাবে কি, কোথায় বসতে দেওয়া হবে, বাবার মাথায় এ-সব আছে বলে আমার ধারণা হল না। ভয়, নিষ্ঠাবান বামুনের অভাবে দাসের মা’র আবার সদ্গতির না বিড়ম্বনা হয়। আত্মা নিয়ে বোধহয় বাবা বিড়ম্বনার মধ্যে আছেন। আত্মা না প্রেতাত্মা। আত্মার তৃপ্তি বিধানে বড় কর্মতৎপর এখন তিনি। তুষ্ট না হলে এই আত্মাই প্রেতাত্মা হয়ে বাবার বাড়িঘরে ভর করতে পারে। এই ভয়ে বোধহয়, শুধু নেমতন্ন করে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেননি, সঙ্গে লোটা-কম্বলের মতো ঝুলিয়ে এনেছেন।
আমার প্রণামের পালা।
প্রশঃ তোমার জ্যেষ্ঠ সন্তান।
—আমার না, ওঁর? বাবা আকাশের দিকে আঙুল তুলে দেখালেন। বাবার স্বভাব এই। নিজের বললে পাছে ঈশ্বর কুপিত হন ভয়ে, ওঁর বলে রেহাই পান। এতেই যে যার সার কথা বুঝে নেয়। আশীর্বাদ, বেঁচে থাকো বাবা। দীর্ঘজীবী হও। পিতৃদেবের মুখ উজ্জ্বল কর। কেউ মাথায় হাত রেখে মন্ত্র উচ্চারণও করলেন।
যাঁর পায়ে কেডস এবং পোশাকে একটু বেশি ধোপদুরস্ত অর্থাৎ যিনি এঁদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত দেখতে, প্রশ্ন করলেন—তুমি কলেজে পড়ছ?
বাবা তাহলে তাঁর বাহিনীকে পুত্রের গৌরবময় অধ্যায় শুনিয়ে রেখেছেন।
বললাম, হ্যাঁ।
তিনি আমার প্রতি হৃষ্টচিত্তে তাকিয়ে আছেন। বাবা বললেন, ইনি পঞ্চতীর্থ কুলদাচরণ। বিশিষ্ট পণ্ডিত। আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে বাবার কর্মক্ষমতা জাহির করতে চাইলেন। তিনি শুধু ব্রাহ্মণ ভোজনে সাদামাটা বামুনই আনেননি। সঙ্গে একজন পঞ্চতীর্থও নিয়ে এসেছেন। বাবা কি আগে থাকতেই বাড়ির আবহাওয়া টের পেয়ে গেছেন। আগে থাকতেই আমাকে সতর্ক করে দিলেন, মাকে বুঝিও। তিনি যেন কলহে প্রবৃত্ত না হন।
বাবার বাহিনী হাঁটতে শুরু করেছে। দীর্ঘকায়, ক্ষীণকায় এবং অস্থিচর্মসার এই ব্রাহ্মণকুলকে নিয়ে বাবা আমাদের থাকবার ছোট ঘরটায় সামলাবেন কী করে বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মা’র অপ্রসন্নতা বাড়বে। সেই ভয়েই বোধহয় বললেন, বিলু পা চালিয়ে যা। একটু দৌড়ে যা। তেনাদের হাত মুখ ধোবার জল তুলে রাখ। সন্ধ্যা আহ্নিক জপতপ আছে।
আমি দৌড়ালাম। বাড়িতে এতগুলো লোকের আহারের কি ব্যবস্থা হবে বুঝতে পারছি না। সারাদিন মা তো উপবাসেই আছে। এমত অবস্থায় এই বাহিনী, এমন প্রশ্ন করতে পারে। বলতে পারে, তোর বাবার কি মতিচ্ছন্ন হয়েছে। একটু জোরে বললেই কানে যেতে পারে। বিষয়টি বাবার কাছে খুব পরিষ্কার বলেই কেমন চোখে-মুখে শঙ্কা দেখতে পেলাম। বাবার জন্য এসময় কষ্টের উদ্রেক হতেই দেখলাম ক্যাম্পের মধ্যে ঢুকে গেছি। মা তো বুঝবে না, বাবা তাঁর বাড়িঘরের মঙ্গলার্থেই কোন ঝুঁকি নিতে সাহস পাননি। দ্বাদশ ব্রাহ্মণ ভোজন না করালে দাসের মা’র আত্মার মুক্তি ঘটবে না এমন বিশ্বাস যাঁর, সঙ্গে লোটা-কম্বলের মতো ঝুলিয়ে না এনে করেনটা কী। তিন চার ক্রোশ হেঁটে কেউ যদি শেষ পর্যন্ত আসতে রাজী না হয়। দাসের হয়ে যখন কাজটার ভার নিয়েছেন তখন তা নির্বিঘ্নে শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাবার স্বস্তি নেই। বাড়ি ঢুকতে আমারও ভয় লাগছিল। পিলু ততক্ষণে বাহিনীর খবর ঠিক মাকে পৌঁছে দিয়েছে। এতগুলো মানুষ বিনা নোটিশে বাবা বাড়ি নিয়ে ঢুকলে জননীর পক্ষে যে প্রকৃতিস্থ থাকা দুরূহ বুঝতে আমার কষ্ট হল না। ঘরে চাল ডাল বাড়ন্ত থাকাটা একজন সংগ্রামী মানুষের লক্ষণ। বাবা কথাবার্তায় এটা মাকে বুঝিয়ে দিতে কসুর করেন না। সেই সংগ্রামী মানুষ যে যখন তখন একটা বাহিনী নিয়ে ঢুকতেই পারে—তাঁর হক আছে, ঢুকবার মুখে বাবার এমন একটা হম্বিতম্বি চেহারা দেখতে পায় এবং এতেই যত অশান্তি সৃষ্টি হতে পারে। বাড়ির এই অশান্তি বাইরের লোক টের পাক আমি পিলু কেউ চাই না। এখন কলসী কলসী জল আনা দরকার। ক্যাম্পের কল। বেশ দূর। কত জল লাগবে কে জানে। জপতপে বসলে কী হবে। কোথায় বসবে। সরু বারান্দা—ন’জন বামুন আড়াআড়ি বসলে পাত পাতার জায়গা থাকবে না। উঠোনে—কিন্তু যা হিমেল হাওয়া, ঠাণ্ডাতে সেই কুঁজো লোকটা পর্যন্ত বাবার ঘরবাড়িতে শেষ নিশ্বাস না ত্যাগ করে। ভোজনের লোভেই এতটা হেঁটে আসা, চোখমুখ দেখে ঠিক টের পেয়ে গেছি।
বাড়িতে বারান্দায় একটা হারিকেন জ্বলছে। কারো সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। কী ব্যাপার। এমন একটা উদোম ঘরবাড়ি— হাট করে সব খোলা, মা, মায়া গেল কোথায়? পিলুটা। ডাকলাম, পিলু, পিলুরে। ডাকলাম মা, মায়া? কোন সাড়া নেই। ঘরে নেই, রান্নাঘরে নেই, গোয়ালে থাকতে পারে না। ঠাকুরঘরে নেই। গেল কোথায়! তখনই গোয়ালঘরের পাশ দিয়ে বাড়ির দিকে যাবার পথটায় পিলুর গলা পেলাম। ছুটে গেলে দেখলাম অন্ধকারে মা মায়ার হাত ধরে দাঁড়িয়ে। মা’র পাশে ছোট ভাইটা। পিলুর খবর শোনার পরই মা যা দেবী সর্বভূতেষু হয়ে গেছে। গৃহত্যাগের হুমকি। পিলু সাধাসাধি করছে, মা তুমি যেও না। বাবা তো চিরটা দিন এমন। বাবা ফিরুক না। সব শুনে না হয় যেও। তুমি খেলে না মা?
আমি মা’র কাছে গিয়ে বললাম, বাড়ি চল। মা বলল, তোরা গিয়ে থাক। আমি থাকব না। আমার বুঝি শরীর না।
—আমরা সব করব। তবু চল।
—ঘরে এক মুষ্টি বেশি চাল নেই। কিচ্ছু নেই। এতগুলো লোককে কী খাওয়াবে তোর বাবা?
—বাবা আসুক তো। দেখ না কী হয়।
—কী হবে আবার। বলবে যাও না, ধীরেনের বাড়িতে, ধারকর্জ মানুষ কত করতে পারে। তোর বাবার কী সে বোধ আছে!
আমি জানি, মাকে কোনরকমে দুটো মুখে দেওয়াতে পারলে সব অভিমান রাগ জল হয়ে যাবে! বাবা ফিরে আসায় মা’র দুশ্চিন্তা দূর হয়েছে, কিন্তু আক্রোশটা যায়নি। মা’র এটা হয়। বাবার উপর সব আক্রোশ মেটাবার একটাই পথ। মা অনশন করে বাবার উপর সব আক্রোশ মেটায়। যে-ভাবে হোক, বাহিনী ঢোকার আগে মাকে খেতে বসাতে হবে। বললাম যদি এক্ষুনি না ফের আমিও বাড়ি ছেড়ে পালাব।
আমার পালানোটাকে মা ভয় করে। ত্রাসের মধ্যে পড়ে যায়। একবার পালানোতেই মা তা টের পেয়েছে। মা’র বিশ্বাস এটা আমার স্বভাবে আছে। কোষ্ঠীতেও লেখা আছে। এমন কথায় মাকে খুব কাহিল দেখাল। বলল, যা যাচ্ছি।
— না, এক্ষুনি।
—আমার ভাল লাগছে নারে।
–তুমি এখন যাবে। যাবে কিনা বল?
—তোর বাবা খেল না!
—বাবা ঠিক খেয়েছে।
–কী করে বুঝলি।
—মুখ দেখে। মুখ দেখলে আমি বুঝতে পারি।
মা আমার সঙ্গে হাঁটতে থাকল। বাড়ি ফিরে মাকে ঠেলতে ঠেলতে রান্নাঘরে নিয়ে গেলাম। পিলু জল ভরে দিল। মায়া ভাত বেড়ে দিল। মা মাথা নিচু করে খাচ্ছে। বাইরে রাতের অন্ধকার। আকাশে নক্ষত্র ফুটে উঠেছে। গরুটা হাম্বা করে ডাক দিল। কুকুরটা রান্নাঘরের দরজায় বসে মার খাওয়া দেখছে। এ সময়েই রাস্তায় বাবার গলা খাকারি শোনা গেল। রাবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে জানান দিচ্ছেন তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে হাজির। পিলু বারান্দার হারিকেনটা হাতে নিয়ে দৌড়ে গেল। মা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, যা এগিয়ে দ্যাখ। ওনাদের বসতে দে। আমি খেয়ে জল আনতে যাচ্ছি। আমার মা মুহূর্তে একেবারে অন্য নারী হয়ে গেল।
শেষ পর্যন্ত বাবা কত বড় কৃতী মানুষ তার প্রমাণ পাওয়া গেল। বাবা ওনাদের বসতে দিয়ে বলল, জামা-কাপড় ছাড়ুন, হাত-পা ধোন। ক্লান্তি দূর করুন—আমি আসছি। পিলু খড়-বিচালি পেতে তার উপর লম্বা তালপাতার চাটাই ফেলে দিয়েছে। সব বামুনেরই একখানা গামছার পুঁটুলি সঙ্গে। ওতে জামাকাপড়। পিলু মা’র সঙ্গে হারিকেন নিয়ে ক্যাম্পে যাচ্ছে। মাকে বললাম, আমি যাচ্ছি। তোমায় আর অসময়ে খেয়ে জল টানতে হবে না। বড় একটা মাটির জালাতে জল ভরা হচ্ছে। বাবা, মাকে একটা কথা না বলে চলে গেল। দু-পক্ষই তেতে আছে এখনও বোঝা যাচ্ছে।
বাবা যখন এলেন তখন একেবারে অন্য মানুষ। সঙ্গে নিবারণ দাস এসেছে। তার গৃহভৃত্য মাণিক এসেছে। মাণিকের মাথায় ন’জন বামুনের সিধা। মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, কর্তামা, সামান্য ভোজনের আয়োজন কর্তাদের জন্য যদি করে দেন। মাথার সেই বড় বেতের কাঠাটা আমরা দু ভাইয়ে নামাতে পারছিলাম না, এত ভারি। মা’র মুখ ভারি প্রসন্ন হয়ে গেছে। ডাল, সবজি, তেল, নুন, শুকনো লঙ্কা যাবতীয় সব কিছু। পেল্লাই কাঠাটা টানতে টানতে দু-ভাই ঘরে নিয়ে গেলাম। মা বলল, পিলু বাবা বসে থাকিস না। মায়া ইদিকে আয়। এগুলো আলাদা করে নে।
বাবার তখন গম্ভীর গলা, পিলু তোমার মাকে বল, বেশি কিছু করতে হবে না। মুগের ডাল, বেগুন ভাজা, ফুলকপির ডালনা, চাটনি। মাণিক দই নিয়ে আসছে। কী বলেন, রাতের ভোজন এতেই হয়ে যাবে। বাহিনীর দিকে তাকিয়ে কথাটা ছুঁড়ে দিলেন। আবার ডাক, পিলু, দেখতো ব্যাগে তামাকের গোলা আছে।
পিলু বলল, দাদা যা না, বাবার কাছে থাক। কত কিছুর এখন দরকার পড়বে। আসলে মুহূর্তে ঘরবাড়ির ছবি কত পাল্টে যায়। মা এক হাতে সবজি কাটছে। এক হাতে সরু চালের ভাত বসিয়ে দিয়েছে। কাঠের আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। দুটো উনুনে রান্না। মায়া এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে। বাকা তাঁর বাহিনীর সঙ্গে তখন শাস্ত্র আলোচনায় মত্ত। কে বলবে তিনি এ-বাড়ির মানুষ। অতিথি অভ্যাগতের মতো তিনিও হুঁকা খাচ্ছেন আর ধর্মশ্লোক নিয়ে বিতর্ক জুড়ে দিয়েছেন। দেখে মনে হবে আবার না বামুনে বামুনে লাঠালাঠি লেগে যায়।
পিলু মাকে এক ফাঁকে এসে বলল, বাবার কত বুদ্ধি।
মা বলল, হ্যাঁ বুদ্ধি না ছাই।
—তুমি মা বোঝ না! ওরা না এলে আমরা এত ভাল খেতে পারতাম! ভোজ শুধু কাল নয়, আজও।
মা বলল, যা তো বাবা, ঠাকুরের বৈকালিটা দিয়ে আয়। তোর বাবা সময়ই পাবে না। সারাদিন মানুষটার বড় খাটাখাটনি গেছে। পিলু চলে যেতেই ফের ডাক। মা এ সময় বড় আস্তে কথা বলছেন। মা যে গলা চড়ালে রাস্তা থেকে শোনা যায়, এ মাকে দেখে কে আর বিশ্বাস করবে। পিলু এলে বলল, তোর বাবাকে একটু ডেকে দে।
পিলু বলল, বাবা ডাকছে।
বাবার গায়ে একটা খদ্দরের চাদর। পায়ে খড়ম। পুষ্ট গোঁফ। বাবা আমার বড় সুপুরুষ। কাছে এলে মা ফিসফিস করে বলল, তুমি একটু দই মুড়ি খাও। কখন রান্না হবে। পেটে তো কিছু নেই বুঝতে পারছি। বলেই মা,রাবার দিকে চকিতে তাকাল। মাথার ঘোমটা সামান্য টেনে দিল। বুঝি মার এই সুন্দর চাউনি বাবাকে ঘরবাড়ির জন্য আরও দীর্ঘায়ু করবে। বাবার পৃথিবীটা কত ভরাট এ মুহূর্তে দু’জনের কাছাকাছি থাকার মধ্যে টের পেলাম। আমার মা, আমার বাবা সুখে-দুঃখে বড় কাছাকাছি। পিলুকে আজ আর পায় কে। বনভূমির মধ্যে এতগুলি মানুষের উপস্থিতি, ধর্ম আলোচনা, আকাশের অজস্র নক্ষত্র, এবং ফলপাকুড়ের গাছ সহ পেছনের বনভূমি নিয়ে আজ বড় বেশি চঞ্চল। এমন সুসময় মানুষের জীবনে বড় কম আছে। পিলুর কাজেকর্মে ছোটাছুটি দেখলে তা আজ বড় বেশি বোঝা যায়।
.
এভাবে বৈশাখ মাস এসে গেল।
মাঝে একদিন পিলুকে সঙ্গে এনেছিলাম। বৌদি, বদরিদা, নটু, পটু, লক্ষ্মী সবাই এতে খুশি। সারাটা সকাল আমাকে পড়তে দেয়নি। নটু পটুও পিলুকে অজুহাত খাড়া করে পড়া থেকে উঠে গেছে।
এই দেবস্থান অনেকটা জায়গা জুড়ে। সামনে রেললাইন, পাশে আমবাগান, পেছনে ঝিল। উত্তরে বড় বড় সব অশ্বত্থের ছায়া। বটের ঝুরি নেমে জায়গাটাকে এক গভীর অরণ্য সৃষ্টি করেছে। পিলু যতক্ষণ ছিল এই সব বড় বৃক্ষের নিচে ঘুরে বেড়িয়েছে। সকালে মুড়ি, মণ্ডা, সন্দেশ কলা খেয়েছে। সকালের খাওয়াটা আমাদের লক্ষ্মীর জিম্মায়। এত দিয়েছিল যে পিলু যতই খেতে ভালবাসুক—এত খাওয়া কঠিন। কিন্তু লক্ষ্মী শুনবে না। পিলুর রাক্ষুসেপনা ধরা পড়বে ভয়ে সেবারে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম লক্ষ্মী এটা বোঝে। যাতে পিলুর কোন কারণে কম না হয় সেজন্য লক্ষ্মী সতর্কতার খাতিরে জামবাটি ভরে সব দিয়েছিল। লক্ষ্মীকে বলেছিলাম, অতটা দিলে, খেতে পারবে না। নষ্ট করবে।
লক্ষ্মী আমার কথায় কোন কর্ণপাত করেনি। পিলুকে বলেছিল, খাও। লজ্জা কর না। দাদাটা তোমার খাওয়া পছন্দ করে না।
পিলু বড় বড় চোখে শুধু দেখছিল। খাওয়া পেলে সে খুব চুপচাপ খেতে ভালবাসে। বড় বড় চোখে তাকায় আর গোগ্রাসে খায়। রাস্তায় নিয়ে আসার সময় বলেছিলাম, রাক্ষসের মতো খাস না। রয়ে সয়ে খাস।
খাওয়ার প্রথমদিকে বোধহয় মনে ছিল কথাটা। কিন্তু খেতে খেতে কখন ভুলে গেছে। ভাল খাবার পাতে পড়লেই মনে হয় কেউ ওরটা কেড়ে নেবে। সে প্রায় বলতে গেলে গিলতে আরম্ভ করেছিল। লক্ষ্মী খেতে দিয়ে অন্য দিন চলে যায়। আজ গেল না। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পিলুর খাওয়া দেখছিল। নটু পটুর এই সব মণ্ডা খেতে খেতে অরুচি ধরে গেছে। মন্দিরে জমা থাকে সব। সকালে বৌদি দেবী দর্শনের সময় বের করে আনেন। সবার জলখাবার ও থেকেই হয়। নটু পটু মাঝে মাঝে বাড়ির মধ্যে ঢুকে হল্লা জুড়ে দেয়। খাব না, রোজ রোজ এক খাবার, খাব না। তখন তেল-মুড়ি, কাঁচা লঙ্কা দিলে ওরা বড় কৃতার্থ হয়ে যায়। পিলুর রোজ তেল-মুড়ি—আজ মিঠাই মণ্ডা। সে সত্যি বড় বেশি গিলছে। আমাদেরটা প্রায় পড়েই আছে, আর পিলুর ভরা জামবাটি শেষ। লক্ষ্মী আমার দিকে একবার ত্যারচা চোখে তাকাল। পিলুকে যে বারণ করব, এ-ভাবে খাস না, খেতে নেই, সে উপায়ও নেই।
লক্ষ্মী বোধহয় আবার কিছু আনতে গেল।
ভেতরে আমার প্রচণ্ড রাগ। তুই বুঝিস না কেন মাস্টারের ছোট ভাই তুই। কিন্তু রেগে গেলে খারাপ দেখাবে। শুধু বললাম, পিলু আর খাস না। দুপুরে যে বড় রকমের ভোজ আছে ও-কথা বলতে পারিনি। সামনে নটু পটু। ওদের কাছে পিলুর খাওয়াটা বড় নয়, পিলুকে নিয়ে কতক্ষণে আমার জিম্মা থেকে বের হয়ে যাবে। কী করে যে পিলুকে একা পাওয়া যায়। অগত্যা নটু পটুকে বললাম, দেখে আয় ত বদরিদা কী করছে।
ওরা চলে গেলে বললাম, মারব এক থাপ্পড়। পাজি হতভাগা এত খেলি।
পিলু বলল, বারে দিলে খাব না।
দুপুরে কত বড় ভোজ। আর তুই….।
পিলু জিভ কামড়ে বলল, ইস, ভুলেই গেছি রে দাদা।
—লক্ষ্মী তোকে আবার মিঠাইমণ্ডা দেবে। খাস না কিন্তু।
—আর খাই। সে-যেন খুবই আহাম্মকের মতো খেয়েছে এমন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। এলে, পিলু ছুটে পালাল। খাব না বলতে তার লজ্জা লাগে। জীবনেও এ-কথা বলার সুযোগ পায়নি। চলে গেলে লক্ষ্মীকে বললাম, নিয়ে যাও। দুপুরের খাওয়াটা ওর আর মাটি কর না। লক্ষ্মী কী বুঝল কে জানে। বলল, ছেলেমানুষ খাবে। ঘুরে বেড়ালেই হজম হয়ে যাবে। দুপুরের খাওয়া মাটি করার জন্য ওকে এত দিইনি মাস্টার। লক্ষ্মী সব বাটি, গেলাস হুড়মুড় করে তুলে নিলে বুঝতে পারলাম, লক্ষণ ভাল না। ডাকলাম, এই লক্ষ্মী শোন।
—কী তুমি কিছু ভাবলে না তো!
–ভাবব! বলে আর দাঁড়াল না। লক্ষ্মীকে নিয়ে এই এক মুশকিল। ও কোন ভুল করলে সেটা কিছুতেই শুধরে দেওয়া যাবে না। ওর একটা কারণ, সে বালবিধবা এবং দেবস্থানে পড়ে আছে বলে সবাই তাকে হেনস্থা করে। সব সময় ওর মধ্যে অন্যের উপর প্রভাব বিস্তারের একটা প্রবল ইচ্ছে থাকে।
পিলু আসা মাত্রই সেটা শুরু হয়েছে। ভেতরে ওর কোথাও একটা খালি জায়গা আছে। সেখানে কখন কে যে জায়গা করে নেবে বোঝা যায় না। বোধহয় পিলুকে দিয়ে জায়গাটা ভরাট করতে চেয়েছিল। এ-কথার পর সে পিলুর আর কোন খোঁজখবরই করেনি। এমন কী আমি পিলু, বদরিদা, নটু, পটু যখন বারান্দায় খেতে বসলাম, লক্ষ্মী একবার ভুলেও এদিকটায় ঘুরে যায়নি। বৌদি এক হাতে সব করতে থাকলে, একবার শুধু বদরিদা বলেছিলেন, লক্ষ্মী কোথায়? বৌদি বলেছিলেন, গোলাঘরে আঁচল পেতে শুয়ে আছে। কে এখন ওর মুখ নাড়া শুনবে।
লক্ষ্মীর মুখনাড়াকে বৌদিও ভয় পায়। ডাকেননি। বদরিদা আর কিছু বলেন নি। আমার কিন্তু প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল ভেতরে ভেতরে। দাসী বাঁদির কাজ করিস, তোর এত মুখনাড়া থাকবে কেন। বৌদির উপর রাগ হল, এত ভাল মানুষ হলে তোমার সংসার চলবে কী করে। তারপরই মনে হল, কারণটা কী পিলু? সেই খাওয়া নিয়ে কথা বলায় কী লক্ষ্মী অভিমান করে শুয়ে আছে? এর এই মান অভিমান নিয়ে প্রশ্ন করার কেউ নেই। অসুখ বিসুখ হতে পারেনা সে প্রশ্ন করারও কেউ নেই। বৌদিও সাহস পায় না। ওর মুখনাড়ার ভয়ে। খুব বেশি বাড়াবাড়ি করলে বদরিদা যাবেন। এক ধমক, ওঠ, ওঠ বলছি। যাও খাওগে। তখন লক্ষ্মী সুড়সুড় করে উঠে পড়বে। খাবে আর কাঁদবে। এ দৃশ্য ওর আমি কতদিন দেখেছি। আমার কথায় কেউ আঁচল পেতে গোলাঘরে শুয়ে আছে ভাবতেই মনটা কেমন চঞ্চল হয়ে উঠল। এক অসহায় নারী অফুরন্ত স্নেহের ভাণ্ডার নিয়ে দেবস্থানে পড়ে আছে। কতবার তার প্রমাণ পেয়েছি। পিলুর খাওয়া নিয়ে লক্ষ্মীকে ও-ভাবে না বললেই ভাল হত। খাচ্ছি আর নিজেকে বার বার ধিক্কার দিচ্ছি। বৌদি শুধু একবার বলেছিলেন, এ কী বিলু তুমি কিছুই খাচ্ছ না। কী বলব! একদিন পিলুকে না খাইয়ে পাঠিয়ে দেবার পর খেতে পারছিলাম না, খেতে খেতে গোপনে কাঁদছিলাম। লক্ষ্মীর জন্য তেমনি এক আমার কষ্ট। দেবস্থানে এক মারমুখী নারীর ছবির মধ্যে কোনো গোপন সৌন্দৰ্য এ-ভাবে লুকিয়ে থাকে সেদিন টের পেয়েছিলাম। সবার অলক্ষ্যে সেই গোলাঘরে গিয়ে ডেকেছিলাম, এই লক্ষ্মী আজ আবার না খেয়ে থাকবে না তো?
সহসা দেখেছিলাম, লক্ষ্মী আঁচল তুলে লাফিয়ে উঠেছিল। বলেছিল আমার দায় পড়েছে না খেয়ে থাকতে। তারপর শাড়ি সামলে সুমলে যাবার সময় মুখের উপর রেগে বলে গেছিল, তুমি আমাকে কী ভাব ঠাকুর।
লক্ষ্মীর আমাকে এই প্রথম ঠাকুর বলে সম্বোধন। এটা সম্মানের না অসম্মানের বুঝতে পারিনি। পরেও লক্ষ্মী আমাকে একা পেলে বলেছে, ঠাকুর, আর পড়ে আমায় উদ্ধার করতে হবে না। রাত অনেক হয়েছে শুয়ে পড়। রাত জাগলে শরীর খারাপ করবে।
অথবা বলত, ঠাকুর বিয়ে থা কর। সুন্দর মতো ঠাকরুণ আসুক, পুজো দেব।
—কাকে?
—তোমাকে না গো, আমার প্রাণের ঠাকুরকে।
মাঝে মাঝে মনে হত, লক্ষ্মীর কী মাথায় গোলমাল আছে। বড় বেশি বেপরোয়া। বয়স অনুযায়ী বেশি পাকা পাকা কথা বলে। লক্ষ্য করেছি, আমি বাড়ি যাব বললে, লক্ষ্মী কেমন জলে পড়ে যায়।
—আমাদের বুঝি পছন্দ না ঠাকুর।
—এ কথা কেন?
—এই যে ছুটি হলেই বাড়ি যেতে ইচ্ছে হয়। আমাকে নিয়ে যাবে?
—যাবে তুমি?
—যাব না কেন! একদিনও তো বললে না যেতে!
পরে মনে হল, আমি লক্ষ্মীকে একটা বনজঙ্গলের ভেতর দিয়ে বাড়ি নিয়ে যেতে পারি না। কি যেন সংকোচ। অথচ লক্ষ্মী কত সহজে বলল, যাবে। আমি নিজেও না বুঝে কথাটা বলেছি। লক্ষ্মী আমার সঙ্গে যেতে চাইলেই নিয়ে যেতে পারি না। আর লক্ষ্মীর যা স্বভাব, হয়তো গিয়ে ভেতর বাড়িতে তখনই বলবে মাস্টারের সঙ্গে যাচ্ছি। আজ ফিরব না। জলটল যা লাগে তুলে নিও। লক্ষ্মী বললে দোষের হবে না। তার স্বভাব সবাই জানে। কিন্তু আমার উপর বাড়ির মানুষদের ভরসা নাও থাকতে পারে। কী আক্কেল তোমার মাস্টার, একটা সোমত্ত মেয়েকে একা বনজঙ্গলের ভেতর দিয়ে নিয়ে যেতে চাও। তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে বললাম, চল না একদিন। বৌদি, দিদি, নটু, পটু, তুমি সবাই। সবাইকে নিয়ে বেড়িয়ে আসি।
—সবার সঙ্গে কেন যাব ঠাকুর? যেতে হয় তোমার সঙ্গে যাব। যা কপালে থাকে হবে।
আমার চোখমুখ কেমন ঝাঁ ঝাঁ করছে। লক্ষ্মীর আকারে-ইঙ্গিতে কথাবার্তা কেমন আমাকে নাড়া দেয়। বেশ গম্ভীর গলায় বললাম, সে হয় না।
—হয় না কেন!
—কিছু একটা হলে?
—কী হবে।
–হতেও তো পারে।
—তুমি আমাকে খেয়ে ফেলবে বুঝি?
–হতেও পারে।
লক্ষ্মীর সঙ্গে থেকে আমি নিজেও পেকে যাচ্ছিলাম। লক্ষ্মী কি ধরতে পারে। আসলে আমার মুখ যতই নবীন সন্ন্যাসীর মতো দেখাক, আমি তা নই। আমিও বড় হয়ে গেছি। আমারও একটা ছোট্ট মত বালিকাকে সঙ্গী পেতে ইচ্ছে করে। এই বয়সটার কী ধর্ম লক্ষ্মীর বোধহয় তা নখদর্পণে। কলেজে আমার বয়সী একটা সুন্দর মেয়েকে দেখার জন্য কতদিন যে কলেজ টাওয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছি। আবার চোখ তুলে যদি আমাকে দেখতে পায় মেয়েটা। নাম জানি না। নাম জানার সাহসও ছিল না। ওর সঙ্গে আমার কোন ক্লাস হয় না। কেন যে ওদের সেকসনে আমি ভর্তি হলাম না। কো- এডুকেশন কলেজ। মেয়েটিকে যখনই দেখি তখনই ভারি নতুন মনে হয়। আমার মতো লম্বা। পাতলা চেহারা। লালপেড়ে শাড়ি পরনে। পায়ে নীল রঙের চটি। শীতের দিনে র্যাপার গায়ে যখন সে সিঁড়ি ধরে কেয়াফুলের গাছটার পাশে হারিয়ে যায় তখন কেমন এক শূন্যতায় ভুগি। আমার মুখ দেখে লক্ষ্মী কী টের পায় তার ঠাকুর ভালবাসার কাঙাল।
লক্ষ্মী হঠাৎ জোরে হেসে দিল, সে সাহসই তোমার নেই।
আমি আর একটা কথা বলতে সাহস পেলাম না। লক্ষ্মী এর পর কী ভাবে আমার সঙ্গে কথা বলবে বুঝতে পারছিলাম না। অথচ সেই একদিন, আমি ওর মুখ দেখতে গেলে, কি কাতর গলা, না মাস্টার না, আমার সঙ্গে জড়িয়ে যেও না। তোমার অমঙ্গল হবে।
আসলে আমার এই ঘরটা বিকেলের দিকে ‘খালিই পড়ে থাকে। এ বাড়িতে সবারই দিবানিদ্রার অভ্যাস। রাতে শিবা-ভোগের জন্য বারটা পর্যন্ত জাগতে হয় এটা এ-বাড়িতে থাকার পরেই বুঝে গেছি। এখন বুঝে গেছি, কলেজ থেকে সকাল সকাল ফিরলে লক্ষ্মী খুশি হয়। সে যেন অপেক্ষা করে থাকে। সে কী সত্যি মনে মনে তার প্রাণের ঠাকুর ভেবে নিয়েছে। নাহলে এত সেবাযত্ন, আমার যে বাবুয়ানি, সব কিছু ফিটফাট, চুল লম্বা, এবং একদিন কী ভেবে দাড়ি কামাব কিনা ভাবতেই লক্ষ্মীর উদয়। লক্ষ্মীকে বললাম, নাপিত এলে বল ত। নাপিত মাঝে মাঝে আসে। বদরিদার দাড়ি কামিয়ে যায়। মন্দিরের চত্বর দিয়ে ঢোকে এবং দাড়ি কামিয়ে আবার ফিরে যায়। সাবান ব্রাশ, গরম জল, খুর, সব লক্ষ্মীর জিম্মায় থাকে। লক্ষ্মী আমাকে খবরটা দিতে পারে ইচ্ছে করলে। লক্ষ্মী বলল, এ-কিগো, তুমি কি বুড়ো হয়েছ?
—বুড়ো হলেই বুঝি দাড়ি কামায়।
—দাড়ি কামালে তোমাকে বিশ্রী দেখাবে। ঠাকুর তোমার এ-মতি কেন!
—আচ্ছা লক্ষ্মী, তুমি আমায় ঠাকুর ঠাকুর কর কেন?
—মানুষের ঠাকুর থাকে না?
—তুমি তো আমার সঙ্গে ঝগড়া কর কেবল।
—ঠাকুর আমিও তোমার মতো ভালবাসার কাঙাল। বলেই ছুট লাগিয়েছিল। সবাই ঘুমাচ্ছে। ভেতরের দুটো দরজা পার হয়ে লক্ষ্মী এখন কোথায় যেতে পারে জানি। সে ঝিলের ঘাটলায় গিয়ে বসে থাকবে। রান্নাবাড়ি পার হয়ে পেছনের মাঠটায় পড়লে ঝিলের ঘাটলা দেখা যায়। সেখানে লক্ষ্মী নেই। সে ভালবাসার কাঙাল, আমিও। লক্ষ্মীর জন্য মায়া লাগে, মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে যাই, আবার কলেজের সেই সমবয়সী মেয়েটাও আমাকে কেমন মুহ্যমান করে রাখে। সে একবার চোখ তুলে দেখলেই সারাটা দিন আমার যে কী ভাল কাটে।
লক্ষ্মী ঝিলের ঘাটলায় নেই, অশ্বত্থের নিচে নেই, রেললাইন ধরে হেঁটে কোথাও যেতে পারে— লাইনে উঠে দেখলাম নেই, ফিরে এসে মন্দিরে ঢুকতে যাব, দেখি লক্ষ্মী মন্দিরের দরজার সামনে সিঁড়িতে মুখ নিচু করে বসে আছে। বাবাঠাকুর তাঁর ঘরে বসে পুরনো সব ধর্মপুস্তক ঘাঁটাঘাটি করছেন। লক্ষ্মীর প্রতি তাঁর স্নেহ প্রবল। লক্ষ্মীকে দেখলে তিনি মন্দিরের দরজা খুলে বসেন। বলেন, কী খেলি হারামজাদী। অথবা এমন অবস্থায় দেখলে, ভোগের প্রসাদ তুলে হাতেও দিতে পারেন। ভোগের প্রসাদ খেতে ইচ্ছে হলে লক্ষ্মী এখানটায় এসে বসে থাকে জানি। আজ তার কিছুই নেই। কেমন একা এই বিশ্বে লক্ষ্মীর এই নিমগ্ন স্বভাব আমাকে পীড়া দিচ্ছিল। এখানে কিছু বলাও যায় না। বাবাঠাকুর শুনতে পাবেন। কিসে কি রোষ জন্মায় বাবাঠাকুরের, এত দিন থেকেও টের পাইনি। বরং ভয়ে এড়িয়ে চলি মানুষটাকে।
আমি চলে যাচ্ছিলাম। তিনি কীভাবে যে সব টের পান। ডাকলেন এই বিলু কাকে খুঁজছিস? —কাউকে না বাবাঠাকুর।
—মিছে কথা বলছিস?
—না বাবাঠাকুর কাউকে নয়।
লক্ষ্মী আমার দিকে তাকাল। আমার চোখে এক অসহায় তরুণের ছবি দেখে বুঝি মায়া হল তার। বলল, বাবাঠাকুর মন্দিরের শান কী ঠাণ্ডা গো। এখানে পড়ে থাকতে মন চায়।
বাবাঠাকুর বললেন, আরে বেটি তুই! বলেই তিনি শ্যামাসঙ্গীত গাইতে থাকলেন। এই মানুষটির এক এক সময় এক এক ভাব। যেন লক্ষ্মীর মুখে সাক্ষাৎ বিশ্বজননী দর্শন করছেন, ক্ষ্যাপা মা আমার বলে এমন আত্মমগ্ন হয়ে গেলেন যে আমাদের দু’জনের পক্ষেই সরে পড়ার এটা প্রকৃষ্ট সময়। লক্ষ্মী চোখ টিপে বলল, পালাও পালাও না’লে এক্ষুনি কে জানে বাবাঠাকুরের কী মতি হবে। হয়তো গঙ্গাস্নানে যাবেন বলবেন। কার সাধ্য আছে বলে, না যাব না। নতুবা নীলকুঠির মাঠে। মন্দির থেকে বের হয়ে গাছপালার নিচে অথবা মাঠের মধ্যে দিয়ে তিনিও হেঁটে যেতে বলবেন। কার সাধ্য আছে বলে, না যাব না।
তখন কুমারসম্ভব কিংবা কিংস লিয়ার থেকে আবৃত্তি। এমন গম্ভীর গলা যে বিশ্বচরাচরে মানুষের অস্তিত্ব বড় অর্থহীন লাগে। আমার ছোট হৃৎপিড়ে অথবা রক্তের ভেতরে যে সুন্দর তরুণী কেবল ভেসে বেড়ায়—সে কথা মনে থাকে না। অকিঞ্চিৎকর মনে হয় জীবন, সব কিছু অর্থহীন। মৃত্যু মানুষের আর এক নিবিড় বন্ধুত্ব, দূরের কথা বলে। মানুষটার কাছে গেলেই এমন টের পাই। বড় ভয় লাগে বাবাঠাকুরকে। বাবাঠাকুরের চোখ রক্তবর্ণ। চুল সাদা। নড়বড়ে দুটো দাঁত ঠোঁটের উপর ঝুলে থাকে। পরনে গেরুয়া কৌপিন। গায়ের চামড়া কোঁচকানো এবং শ্বেত চন্দনের মতো সাদা। কখনও গম্ভীর, কখনও উত্তাল, আবার কখনও ভারি ছেলেমানুষ। কোন এক উত্তরায়ণের সকালে বাবাঠাকুর যৌবনে গৃহত্যাগ করেছিলেন। ধন-সম্পদ সুন্দরী পত্নী বিশাল জমিদারি পরিত্যাগ করে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। বদরিদা তাঁর সাক্ষাৎ পান লক্ষ্মণঝোলায়। বদরিদা কফের ধাতের মানুষ। সেখানে মরণাপন্ন হলে বাবাঠাকুর শিয়রে হাজির এবং আরোগ্যলাভ।
বাবাঠাকুর সম্পর্কে এই দেবস্থানে এমন সব অলৌকিক কাহিনী কত আছে। লক্ষ্মী ফাঁক পেলে সেই সব কাহিনী শোনায়। মন্দিরে তিনি থাকেন না। রাত হলে নিমগাছটার নিচে শুয়ে থাকেন। শিবা ভোগের সময় উঠে যান। তখন তাঁর গলার সেই বিচিত্র ডাক- আয় আয় মা। সেই ডাকে দুটো সাদা রঙের শেয়াল ঝিল থেকে উঠে আসে এবং ভোগ খেয়ে চলে যায়। বাবাঠাকুরের কোন কাজে এ পরিবারের ত্রুটি থাকলে ক্ষেপে যান। দেবস্থান ত্যাগ করে দূরের ব্রহ্মময়ী কালীবাড়িতে আশ্রয় নেন। তখন শিবাভোগ নিয়ে ভোগান্তির শেষ থাকে না। সেই অপার্থিব দুই প্রাণী, একমাত্র বাবাঠাকুরের আহ্বানেই সাড়া দেয়। অন্য কেউ ডাকলে তারা আসে না। বদরিদা সংসারের অমঙ্গল আশঙ্কায় কাতর হয়ে পড়েন। বাবাঠাকুরের পায়ের কাছে গিয়ে দিনের পর দিন হত্যে। বাবাঠাকুরের মর্জির বিরুদ্ধে যাবার সাহস এ পরিবারের কারোর নেই। সুতরাং লক্ষ্মী চোখ টেপায় পা টিপে টিপে সরে পড়লাম। আর তখুনি সিংহের মতো গর্জন, পালাচ্ছিস বিলু!
থমকে গেলাম। চাতাল এবং বিশালকায় প্রাঙ্গণ জুড়ে মন্দিরের কারুকাজ করা ছাদের নিচে বাবাঠাকুরের কণ্ঠ বজ্রধ্বনির মতো শোনায়। আমি যে বাবার ছেলে, তার পক্ষে এই নিনাদ অবহেলা করা খুবই শক্ত। পা টিপে টিপে আবার এগিয়ে যেতে হল। বললেন, তোর ভাইটাকে দেখালি না।
আমার ভাইটা এ বাড়িতেই আছে। কিন্তু কোথায় আছে জানি না। নটু পটুর সঙ্গে কোথায় ও ঘুরে বেড়াচ্ছে। লক্ষ্মীর খোঁজে গিয়ে ভাইয়ের কথা ভুলে গেছিলাম। বললাম, কোথায় যে গেল!
লক্ষ্মী বলল, দেখগে মাস্টার ছাড়াবাড়ির গাছে ওরা ওয়া ওয়া খেলছে।
দেবস্থানের দক্ষিণ দিকটায় একটা বড় ছাড়াবাড়ি। সেখানে শীতের সময় শহর থেকে লোকজন আসে বনভোজন করতে। রথও দেখা, কলাও বেচা। সেখানে যেতেই শুনতে পেলাম কে যেন গাইছে, গাঁয়ের ধারে শান্ত নদীটি। কে গায়, ভারি মিষ্টি গলা তো। নটু পটু কখনও গান গায় বলে জানি না। কোনও রাখাল বালকের মতো গলার স্বর চারপাশে ব্যাপ্ত। উদার, উদাস, মায়াবী। পিলু কখনও গান গায় বলে জানি না। তবে কে গায়। ডাকলাম, পিলু আছিস? সঙ্গে সঙ্গে সেই ছাড়াবাড়ির কোনও অদৃশ্য স্থান থেকে যে গানের সুর ভেসে আসছিল তা থেমে গেল। আবার ডাকলাম, নটু পটু। এবারে জবাব, আমরা এখানে মাস্টারমশাই। গাছের উপর থেকে কেউ কথা বলছে। বড় বড় সব আম, জাম, জামরুলের গাছ। একটা গাছ মাটির সঙ্গে কিছুটা সমান্তরাল হয়ে উপরে উঠে গেছে। গাছটার কাণ্ডটার উপর দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওঠার মতো উপরে উঠে যাওয়া যায়। গাছটার তিনটি ডাল তিন দিকে ডালপালা মেলে দিয়েছে। ওরা তিনজন গাছের ডালে বসে গাছপাকা আম সব সাবাড় করছে।
বললাম, কে গান গাইছিল রে?
নটু বলল, আমি না মাস্টারমশাই।
পটু বলল, আমি না।
পিলুও বলল, আমি গাইনি দাদা।
গান গাওয়াটা যে লায়েক হয়ে যাওয়ার শামিল, অপরাধ, ভব্যতার লক্ষণ না, তিনজনই সেটা বুঝে ফেলেছে। বয়সটাই এমন যে সবকিছু সহজেই অস্বীকার করা যায়। কিন্তু এত সব ভাববার সময় নেই। বাবাঠাকুর বসে আছেন। বললাম, পিলু চল, বাবাঠাকুরকে প্রণাম করবি। পিলু কেমন ভূত দেখে আঁতকে ওঠার মতো বলল, আমি যাব না দাদা। বাবাঠাকুর ইচ্ছে করলে চোখের পাকে সব ভস্ম করে দিতে পারে। আমি যাব না, ভয় করে।
—বাবাঠাকুর মানুষকে ছাগল ভেড়া গরু বানিয়ে দিতে পারে।
ওর হাত ধরে বললাম, আয়। বাবাঠাকুর সাধুসন্ত মানুষ। তোকে এ সব কে বলেছে।
—কে বলবে আবার। আমি জানি।
পিলুর মনের মধ্যেও নানারকম ভয় তবে বাসা বেঁধে থাকে। ফকির আউল বাউল দরবেশ সাধুসন্ত সবাই ভিন্ন মার্গের জীব। এরা খুশিমত সবকিছু করতে পারে। এরা না পারে এমন কিছু নেই। দেবস্থানে ছাড়া-পাঁঠা অনেক বিচরণ করে বেড়ায়। যাদের মানত থাকে, অথচ বলি দেবার প্রথা নেই, তারা মায়ের নামে পাঁঠা ছেড়ে দিয়ে যায়। পাঁঠার পাল ঘুরে বেড়ায় দেবস্থানের এই ছাড়াবাড়ি অথবা রেল লাইনের ধারে। সন্ধ্যা হলে চাতালে ফিরে আসে। সময় মতো বলি হয় না বলে ভোমরা পাঁঠার সংখ্যা অনেক। এইসব দেখেই পিলুর ধারণা, এই দেবস্থানে এত পাঁঠা যখন, বাবাঠাকুরের কাজ না হয়ে যায় না। কোপে পড়ে গেলেই পাঁঠা। তারপর ঢাক গুড় গুড়-ট্যাং ট্যাং ফাঁসির বাজনা, আর এক কোপে গলা ফাঁকা।
পিলু কিছুতেই যেতে চাইছে না। প্রায় হাড়িকাঠে পাঠা টেনে নিয়ে যাবার মতো ধরে নিয়ে যাচ্ছি। নটু বলছে, বাবাঠাকুর খুব ভাল। তুই যা। তোকে দেখবি হাত ভরে মণ্ডা দেবে।
পিলু, যে পিলু ভাল খাবারের নামে পাগল সেই কিনা, নিমগাছটার নিচে আসতেই আমার হাত কামড়ে দিল। আমি বললাম, এই কী করছিস! আঃ বলে হাত ছেড়ে দিতেই দু-লাফে সে রেল লাইন পার হয়ে ছুট লাগাল। যত ডাকি, তত সে দৌড়ায়। মাঠে নেমে ডাকলাম, পিলু যাস না। কে শোনে কার কথা। আসলে সব নষ্টের গোড়া এই নটু পটু। বললাম, ঠিক তোরা বাবাঠাকুরের নামে লাগিয়েছিস।
সঙ্গে সঙ্গে দু’জনই একসঙ্গে এক বাক্যে বলে উঠল, আমি না আমি না, পটু। আমি না আমি না, নটু।
দাঁড়া দুটোকেই আজ মজা দেখাব। লক্ষ্মী দূরে দাঁড়িয়েছিল। বললাম, লক্ষ্মী একটা ভাল দেখে কঞ্চি নিয়ে এস ত। এরা বড্ড মিছে কথা বলতে শিখেছে।
ছিটকিলার ঝোপ থেকে সরু মতো একটা ডাল ভেঙে নিয়ে এল লক্ষ্মী। মাস্টারের যা মর্জি, মুহূর্তে রাগ জল হয়ে যেতে পারে। সে দৌড়ে গেল। এবং নিমেষে পাতা ডাল ভেঙে লকলকে বেতের মতো বস্তুটি আমার হাতে দিয়ে বলল, ছাল-চামড়া তুলে দাও মাস্টার। জীবনেও যেন আর মিছে কথা না বলে।
পটু একটু গোঁয়ার প্রকৃতির। সে বলল, মারুক না মারুক। তোমাকে লক্ষ্মীদি দেখ কী করি!
লক্ষ্মীকে চোখ রাঙানোতে আমার কেমন ইজ্জতে লাগে। আমার সামনে লক্ষ্মীকে শাসানো হচ্ছে!
লক্ষ্মী বলল, কী আস্পর্ধা মাস্টার। তোমার সামনে আমাকে এ কথা বলল। এ ছোঁড়া বড় হলে কী হবে!
বলব না! আমি বলছি, বলিনি।
ওরা জানে, এক মাসে আমি ওদের উপর একদিনই মাত্র রোষে এলোপাথাড়ি মেরেছি। নটু পটু দেবস্থানে আসা এক পুণ্যার্থীর সন্তানকে কটু কথা বলে গালিগালাজ করেছিল এবং অভিযোগ দু’-একটি অশ্লীল কথাও সঙ্গে বলেছে। আমার ছাত্রের হেন অশালীনতা যেন আমাকেই বিদ্ধ করেছিল। ওরা আমার ছাত্র, ছাত্রের এই আচরণ, তার গৃহ-শিক্ষকটি না কী জানি। সেইহেতু আমি একজন বাউন্ডুলে বাবার জ্যেষ্ঠ সন্তান হওয়া সত্ত্বেও প্রহার একটু মাত্রাতিরিক্ত করে ফেলেছিলাম। বদরিদা কিংবা বৌদি এ নিয়ে বরং আমাকেই পরে সমর্থন করেছেন। এই দুই চঞ্চল বালককে যে বশে আনতে পেরেছি তাতেই তাঁরা খুশি। কিন্তু পরে বড় কষ্ট হয়েছিল। নিজেই গেঁদাল পাতার রস লাগিয়ে দিয়েছিলাম। এবং আরোগ্যলাভে যা সেবাযত্ন সবই আমি করেছি। এতে এই দুই বালক আমার প্রতি যেমন ভালবাসা বোধ করে, তেমনি আবদার রক্ষার্থে যখন তখন ছুটি চায়। আমার কথার উপর আর কারো কথা নেই। এই কম বয়সে এত বেশি শাসন করার অধিকার পাবার ফলেই বোধহয় নিজের মধ্যে কোন স্বৈরাচারী তৈরি হয়ে যায়। ভিতরটা আমার রাগে গোঁ গোঁ করছিল। কিন্তু ভয়, শুরুটা জানি, শেষটা জানি না। মাত্রাতিরিক্ত হয়ে না যায় এই ভয়ে অনেকদিন শাসনের নামে লকলকে বেতের ডগা মাথায় ছুঁয়ে ভয় দেখাবার চেষ্টা করি, বেশি দূর এগোই না। বারবারই মনে রাখার চেষ্টা করি, শত হলেও আমি এদের আশ্রিত।
বললাম, তুই বলিসনি তো, কে বলেছে?
পটু চুপ।
লক্ষ্মী বলল, তুমি মাস্টার যেমন। এ ছোকরাই বলেছে। দেখছ না চোখ মুখ। চোখ মুখ দেখে আমার মনে হয় না পটু বলেছে। তা না হলে সে এতটা বেয়াড়া হয়ে উঠত না। লক্ষ্মী কিন্তু নাছোড়বান্দা। মাস্টারের সামনে তাকে শাসিয়েছে। যদি কিছু না বলি, আমি জানি লক্ষ্মী আমাকে নেবার জন্যও তৈরি হয়ে আছে। তোমার মাস্টার কিস্যু হবে না। একটা শয়তান এত্তটুকুন ছোঁড়াকে তুমি সামলাতে পার না, তোমার মুখের সামনে শাসায়, তুমি আবার করবে মাস্টারি। তোমারও আখের ঝরঝরে,
এদেরও আখের ঝরঝরে।
সমূহ উভয়সংকট থেকে নিজেকে ত্রাণ করার কি উপায় ভাবছিলাম। বললাম, নটু তুই পিলুকে বাবাঠাকুরের নামে ভয় দেখিয়েছিস? পিলু যে চলে গেল বাবা ঠাকুরকে প্রণাম না করে, তিনি কী ভাববেন বল ত?
আমার নরম কথাবার্তা শুনে লক্ষ্মী মুহূর্তে ক্ষেপে গেল। বলল, নাও হয়েছে। দাও আমার কঞ্চিটা। বলে সে আমার হাত থেকে প্রায় হ্যাঁচকা মেরে সেই প্রহার দেবার বস্তুটি কেড়ে নিল। তারপর যেন অমাদের চেনেই না, এমন করে চারদিকে দেখতে দেখতে বলল, মাস্টারি ছেড়ে রাখালি করগে। যার যা মানায়।
লক্ষ্মীর কথায় আমার মাথা গরম হয়ে গেল।
—তাই করব।
—তাই কর না, কে বারণ করেছে। এখানে মরতে এলে কেন?
পটু বলল, লক্ষ্মীদি ভাল হচ্ছে না। তোমার বাড়ি? তুমি বলার কে? তুমি আর কখনও মাস্টারমশাইকে এমন কথা বলবে না। খুব খারাপ হবে বলে দিচ্ছি। লক্ষ্মী ততোধিক ক্ষেপে গিয়ে বলল, তোর বাড়ি? তোর খাই? তোর পরি? তুই বলার কেরে?
—আঃ লক্ষ্মী কী হচ্ছে।
—কী না, কী বলে। দাদাকে না বলেছি—তুই আমাকে এ কথা বলতে পারলি পটু। আমি দেবস্থানে পড়ে আছি বলে, যা মুখে আসে তাই বলবি। লক্ষ্মী আঁচল চাপা দিয়ে ঝরঝর করে কাঁদছে।
পটু বলল, দেখলেন মাস্টারমশাই—আমি কী বলেছি। আপনাকে কী না বলেছে, পটু বদরিদার ভয়ে চোখ-মুখ কেমন শুকনো করে ফেলেছে।
—লক্ষ্মী তুমি কিছু মনে কর না। ছেলেমানুষ।
—মনে করব না, একশোবার মনে করব। তোমার সামনে যা-তা কথা বলল, আর তুমি কিছু বললে না।
লক্ষ্মীর সঙ্গে আমাকেও জড়াচ্ছে। লক্ষণ ভাল না। লক্ষ্মীর চোপাকে সবাই ভয় পায়। আমিও পাই। বেশি আর এগোনো ঠিক না। —দুটো খেতে পরতে দিস বলে এত কথা। লক্ষ্মী গজগজ করছে। গাছকোমর বাঁধা ওর শাড়ি। গায়ে ব্লাউজ নেই। পায়ে সে কখনও কিছু পরে না। পরার নিয়ম নেই। সে বাড়ির একাই সব সামলায় বলে বৌদি বরং একটু বেশি তোয়াজেই রাখে। সুতরাং এ-হেন তাজা বাঘিনীকে শান্ত না করলে মাস্টার ছাত্র মিলে সবার উপরই কৈফিয়ত তলব হতে পারে।
লক্ষ্মীকে বুঝ দেবার জন্য বললাম, দেখ না দুটোকে আজ কী করি। তুমি যাও।
—আমি যাব না। এখানে দাঁড়িয়ে থাকব। কি করতে পার, কর দেখি।
—আমি বলেছি কিছু করব?
—বললে না, এক্ষুনি তো বললে, যাও।
খুবই মুশকিল। কোন কথাই বলা যায় না; আমার উচিত ছিল, মারি না মারি দু-ঘা লাগাই। শুধু এটুকু হলেই লক্ষ্মী প্রসন্ন হবে। ওর প্রসন্নতা রক্ষার্থে অগত্যা বললাম, পটু তুই বড় বাড় বেড়েছিস। দাঁড়া। হাত পাত।
পটু এ সব বিষয়ে সব সময় প্রস্তুত থাকে বলে সে হাত পাততে বিন্দুমাত্র দেরি করল না।
লক্ষ্মী বলল, থাক হয়েছে। আর বলবি না তো?
পটু বলল, বলব।
লক্ষ্মী নিজেই আবার কি ভেবে বলল, মাস্টার আজ রাত বারটা তক পড়াবে। ঝিমুনি এলেই মার। ছোঁড়ার তেজ দেখ।
পটু এবারে উল্টো আক্রমণ করে বসল, তুমি মাস্টারমশাইকে অপমান করেছ।
—ও মা অপমান কি গ আবার!
বললে না, রাখালি করগে।
কথাটা লক্ষ্মীর বলা ঠিক হয়নি। লক্ষ্মী যে অন্যায় কথা বলেছে বোঝা উচিত। বাড়ির একজন গৃহশিক্ষককে এভাবে অপমান করলে ছাত্রদের লাগবার কথাই। বললাম, লক্ষ্মী তুমি অন্যায় করেছ। এটা তোমার ধৃষ্টতা।
—অন্যায় করেছি, বেশ করেছি। সত্যি কথা বললে তেনার রাগ। যা সত্যি ত্রিসংসার লয় পেলেও বলব। লক্ষ্মী কাউকে পরোয়া করে না। ধেষ্টতা! যত আদিখ্যেতা—কথার কি ছিরি।
লক্ষ্মী হার না মানায় মনে মনে খুবই দমে গেলাম। নটু পটুকে বললাম, চল আমরা বেড়িয়ে আসি। লক্ষ্মী বলল, যাও না। কোন্ চুলোয় যাবে যাও। একটু হেঁটে গেলে লক্ষ্মী দেখলাম পিছু পিছু আসছে।
নটু বলল, তুমি আসছ কেন?
—তোদের সঙ্গে যাচ্ছি না।
কিন্তু বিপদ, দুই ছাত্রকে নিয়ে যেদিকে গেলাম, লক্ষ্মীও সঙ্গে সঙ্গে সেদিকে গেল। সঙ্গ ছাড়ছে না।
পটু বলল, কি বেহায়া দেখছেন।
লক্ষ্মীকে বললাম, বাড়ি যাও। কত কাজ তোমার। বৌদি খোঁজাখুঁজি করবেন। লক্ষ্মী দাঁড়িয়ে আছে।
বুঝতে পারলাম, কিছুতেই কাছছাড়া হবে না। যা বলব লক্ষ্মী তার বিপরীত কাজ করে প্রমাণ করবে, সে সব করতে পারে। এ-বাড়িতে তার জোর এই ভাবী উত্তরাধিকারীদের চেয়ে কম নয়। আমার সঙ্গে লক্ষ্মীর এ-ভাবেই জীবন কাটছিল। সেদিন সন্ধ্যায় কিছুতেই কথা বলব না, স্থির করেছি। লক্ষ্মী বড় কটু কথা সহজেই বলতে পারে। রাখালি করতে পার না কথাটা আমার খুব লেগেছে। লক্ষ্মীর মুখে এমন কথা সাজে না। ওর সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ না করলে আরও মাথায় চড়ে বসবে। লক্ষ্মী আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। কথা বললাম না। নটু পটু আজ লক্ষ্মীকে দেখেই বেশি পড়ায় মনোযোগ দিয়েছে। ওর বড় লাগানি -ভাঙানির স্বভাব। এখন দুপক্ষের মধ্যে চরম অবস্থা বিরাজ করছে। পড়াশোনায় এতটুকু গাফিলতি দেখলেই ভিতরবাড়িতে খবর পৌঁছে দেবে, পড়ছে না। গল্প করছে। তিনটেই ফাঁকিবাজ। শত হলেও বদরিদা মানুষ। নৃপ কর্ণেন পশ্যতি। এ-ভয়টা আমাদের তিনজনেরই আছে।
লক্ষ্মী একটা জগে খাবার জল রেখে গেল। কেউ আমরা তাকালাম না। সাঁজ লাগার পর থেকে লক্ষ্মীর কাজ থাকে না। সে বারান্দায় পড়ে পড়ে ঘুমোয়। আজ লক্ষ্মীর কী হয়েছে কে জানে, আমাদের মশারিটা নিয়ে নিচে বসল। আমরা তিনজন একই তক্তপোশে শুই, ঘুমাই, বিছানার চাদর থেকে বালিশের ওয়াড় কাচাকাচির কাজ লক্ষ্মীর। সে অন্য সব কাজের ফাঁকে এই কাজটা অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে করে থাকে। সন্ধ্যার পর ভোঁসভোঁস করে ভেতর বাড়ির বারান্দায় পড়ে ঘুমোয় বলে রাতে ওকে বড় এ-ঘরটায় দেখা যায় না। আজ একটু ভিন্ন রকমের মতি দেখছি। আমাদের পাশেই ঠিক নিচে মেঝেতে মশারি রিপু করতে বসে গেল। নটু পটু একবার চোখ তুলে ওদের লক্ষ্মীদির ব্যাপার-স্যাপার দেখতে গেলে ধমক লাগালাম, পড়। কী দেখছিস! ওরা উচ্চস্বরে দুলে দুলে পড়ছে। আমি একটা ট্রায়াল ব্যালেন্স নিয়ে পড়েছি। কিছুতেই মিলছে না। লক্ষ্মী যেন এখানটায় বসে থেকে তার জোর দেখাচ্ছে। আসলে আমরা তিনজন কিছুই পড়তে পারছিলাম না। যতই মনোযোগী হবার চেষ্টা করি না কেন লক্ষ্মীর এই জেদ আমাদের তিনজনকেই পীড়া দিচ্ছে।
নটু বলল, স্যার বাইরে যাব।
ওদের এ-সময় একটু বেশি প্রকৃতির ডাক পড়ে। বললাম, যা।
তারপর কিছুক্ষণ বাদে দেখলাম, বৌদি দরজায় মুখ বাড়িয়েছেন। লক্ষ্মীকে দেখে বললেন, তোর এখানে কি! ভিতরে আয়। নটুর কাজ। সে মাকে দিয়ে লক্ষ্মীকে সরিয়ে নিয়ে গেল। যাবার সময় লক্ষ্মী দাঁতে সূচের সুতো কাটতে গিয়ে কটমট করে আমাদের দিকে তাকাল। যেন বলে গেল, ঠিক আছে। বাবুদের কত ধানে কত চাল দেখব। এ-ব্যাপারে পালের গোদাটি আসলে আমি তা বোধহয় মনে মনে ভেবে নিয়েছে লক্ষ্মী। আমার পরামর্শেই নটু ভেতর বাড়িতে খবর দিয়ে এসেছে। লক্ষ্মী চলে যাবার পর আমরা তিনজন গোল টেবিল বৈঠকে বসলাম। কী করা যায়! যে ভাবে বাড় বাড়ছে তাতে আমাদের মান-সম্মান নিয়ে টিকে থাকাই কঠিন। ওর বোধহয় আমার উপর কী করে একটা দাবি জন্মে গেছে। সেই দাবি থেকেই হয়ত এমন কথা বলতে সাহস পায়।
নটু বলল, স্যার আমরা যদি লক্ষ্মীদিকে এ-ঘরে ঢুকতে বারণ করে দি।
বুকের মধ্যে কেমন একটা খোঁচা খেলাম।
পটু বলল, আমাদের কাজ আমরাই করে নেব।
পরদিন সকালে লক্ষ্মী এসে দেখল আমি মশারির দড়ি খুলছি। পটু ঘর ঝাঁট দিচ্ছে। নটু বালিশ বিছানা ভাঁজ করে একপাশে রাখছে। যাও এবারে বোঝ। কোন কাজ নেই। বইখাতা সব ঠিকঠাক করে আমরা মাঠে নেমে গেলাম। আমাদের সকালের দাঁত মাজা হাত মুখ ধোওয়া সব ঝিলের ঘাটলায়। লক্ষ্মীকে জল এনে রাখার কাজটা থেকেও রেহাই দিলাম। জামাপ্যান্ট নিজেই কাচাকাচি করে ভাত, ডাল, মাছভাজা খেয়ে যে যার কলেজ স্কুল। লক্ষ্মীকে যাবার সময় দেখলাম, মন্দিরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘলা আকাশের মতো মুখ ভার করে রেখেছে।
আর কলেজ থেকে ফিরে দেখলাম, ঘরটা ভণ্ডুল মামার বাড়ি হয়ে বসে আছে। সব ছত্রখান। মেজাজ কার ঠিক থাকে। গেঞ্জি পাচ্ছি না। তোয়ালে নেই। এ-সব না থাকলে লক্ষ্মীর কাছে খোঁজ করতে হয়। লক্ষ্মীর পাত্তা নেই। পটু বলল, দেখলেন কী করেছে!
—কে করছে?
—লক্ষ্মীদি, আবার কে?
—ওর এত সাহস!
—কেউ কিছু বলে না। না আর পারা যাচ্ছে না।
লক্ষ্মী ঠিক এ-সময় নগর নন্দিনীর মতো ঘরে ঢুকল। হাতে ঝাঁটা নিয়ে ঘর সাফ করল। বালিশ চাদর তোষক নিজের মতো গোছগাছ করে রাখল। বইপত্র তুলে তাকে সাজিয়ে রাখল। অর্থাৎ এ- সব কাজের অধিকার তার। অন্য কেউ করলে সহ্য করবে কেন। অধিকার বলে কথা। নটু পটু বোধহয় আমার উপর আস্থা হারিয়ে তাদের অভিভাবকের কাছে চলে গেল নালিশ করতে। লক্ষ্মীর কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। বললাম, তুমি ভাল করলে না। বদরিদাকে কী বলব!
—যা বলবার আমি বলব। তোমাকে কিছু বলতে হবে না।
বদরিদা ডেকে পাঠালেন। বললেন, কী হয়েছে তোমাদের। লক্ষ্মী, তুই ওদের পেছনে কেন লেগেছিস?
—ওমা! কী বলেন গো দাদা। আমি কী করেছি। ওনারা নিজেরাই করবেন। ঘর ঝাড় দেবেন, বিছানা তুলবেন, ঘাটলায় গিয়ে দাঁত মাজবেন—আমার থাকা কেন তা’লে। কাজের নামে তেনারা ফাঁকি দেন। পড়ার নামে ফাঁকি আমি সইতে পারব না।
তার মানে লক্ষ্মী বদরিদাকে বোঝাতে চাইল, পড়ায় মন নেই আমাদের। এটা ওটা করে সময় কাটিয়ে দেওয়া। বদরিদা বললেন, এ-সব কাজ যদি তোমরাই কর, তা’লে লক্ষ্মীই স্কুলে যাক। তোমরা সাফসোফের কাজে লেগে পড়। উল্টো ফল। নটু পটু এদিকটা বোধহয় একেবারেই ভাবেনি। এবং আমরা তিনজনই মুখ শুকনো করে যখন বের হয়ে এলাম, তখন লক্ষ্মী মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বারান্দায় হাসছে। লক্ষ্মীর দিকে তাকিয়ে নটু পটু জিভ ভেংচে দিল। লক্ষ্মী ওদের না ভেংচে আমাকে ভেংচাল। আমি ভাবলাম, আর কথা না। সত্যি কথা বলা বন্ধ হয়ে গেল লক্ষ্মীর সঙ্গে। আমরা তিনজনের একটা ফ্রন্ট, লক্ষ্মী একা একলা একটা ফ্রন্ট। আমরা তিনজনই লক্ষ্মীকে আড়ি করে দিলাম। লক্ষ্মী শেষ পর্যন্ত এমনভাবে জব্দ করবে যদি আগে জানতাম।
শনিবার বিকেলবেলাতে বাড়ি যাই। রোববারের বিকেলে ফিরে আসি। কলেজ থেকে ফিরে দুটো মুখে দিয়ে বাড়ি যাব বলে জ্যামাপ্যান্ট পরছি। দেখি লক্ষ্মী হাজির। নিজে থেকেই বলল, তুমি কথা না বললে তো বয়ে গেল। আমি তোমার সঙ্গে যাব।
—কোথায় যাবে?
—কেন তোমাদের বাড়িতে।
—তুমি আমার সঙ্গে কোন কথা বলবে না। তোমাকে আমি নিতে পারব না সঙ্গে। আঁচলের তলা থেকে একটা পুঁটুলি বের করে লক্ষ্মী টেবিলে রাখল। না নাও, এটা সঙ্গে নাও। পিলুকে দেবে।
—কিছু নিতে পারব না। লক্ষ্মী বলল, ঠিক আছে। সে পুঁটুলিটা ফের আঁচলের মধ্যে লুকিয়ে ফেলল।
আমার সন্দেহ হল কেমন। পুঁটুলিতে কী আছে? যে-ভাবে আঁচলের নিচে লুকিয়ে রেখেছে তাতে সংশয় হবারই কথা। দাদা বৌদি জানলেন না, লক্ষ্মী গোপনে দিতে এসেছে, ফের প্রশ্ন না করে পারলাম না, ওতে কী আছে।
লক্ষ্মীও তেরিয়া হয়ে বলল, কী আছে বলব না।
—ধুস যত্ত সব, এক লাফে তক্তপোশ থেকে নেমে বাইরে বের হয়ে গেলাম। লক্ষ্মীকে বললাম, দরজা বন্ধ করে দাও। লক্ষ্মী কথা বলল না। সেও বাইরে বের হয়ে এল। ওর পায়ে তোড়া, হাতে রুপোর চুড়ি। চুল সুন্দর করে পরিপাটি করে খোঁপা বাঁধা। চুলে তেল বেশি দেওয়ায় মুখটা বড় বেশি চকচক করছে। উঁচু বারান্দা থেকে আমি লাফ দিয়ে রাস্তায় নামলাম, লক্ষ্মীও ঠিক আমার মতো লাফ দিয়ে নিচে নামল। এ তো আচ্ছা ঝামেলা।
—তুমি আমার সঙ্গে যাবে না।
—যাব না।
তবু হাঁটছে। কী করি। সঙ্গে পুঁটুলি। মন্দিরের রাস্তা থেকেই এবার আর না পেরে বললাম, ডাকব বদরিদাকে? ডাকব বৌদিকে।
—ডাক না। আমি বলেই এয়েছি।
—তুমি বলে এয়েছ যাবে? আমাদের বাড়ি যাবে?
নটু পটুর মতো কিংবা পিলুর মতো লক্ষ্মীর যখন তখন ডাহা মিথ্যা কথা বলার স্বভাব। এ- মেয়ের কথায় আস্থা রাখা দায়। একবার বৌদিকে না হয় বদরিদাকে বলা দরকার। মন্দিরের দরজা দিয়ে চাতাল পার হয়ে ভেতরে বাড়িতে ঢুকে বৌদিকে বললাম, দেখুন লক্ষ্মী কী করছে। আমাকে জ্বালাচ্ছে।
—এই তো খুব ভাল মেয়ের মতো বলে গেল তোর সঙ্গে যাবে।
—আমি ওকে নিয়ে যেতে পারব না বৌদি!
—এ কী কথা বিলু। কেউ যেতে চাইলে নিতে হয় না? কবে থেকে বলছে, মাস্টারের বাড়ি দেখতে যাব। মাস্টারের মা বাবাকে দেখে আসব। আর কত যত্ন করে কত কিছু সঙ্গে নিয়েছে!
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললাম, যাক, হয়ে গেল।
হয়ে গেল কি রে?
–হয়ে গেল। জ্বালাবে।
—তুই বড় স্বার্থপর বিলু। মেয়েটা তোর জন্য এত করে আর তুই….।
আমার সত্যি আর কিছু বলার নেই। বের হয়ে আসছি, বৌদি বলছেন, এতদিন আছিস, কৈ একদিনও তো বললি না, বৌদি আমাদের বাড়ি চলুন। তোর দাদাকে নিয়ে গেলি না। একদিন তোর মা বাবাকেও নিয়ে এলি না। তোর এত কিসের অহংকার রে।
লক্ষ্মীর নামে অভিযোগ করতে এসে এত কথা শুনতে হবে বুঝতে পারি নি। এটা ঠিক বৌদিকে বলা হয়নি, দাদাকেও না। মা বাবা কিংবা মায়াকে কোনদিন নিয়ে আসিনি। বৌদি বোঝেন না, ওখানে গিয়ে দাঁড়াবে কোথায়? ঘরের মধ্যে দুটো বাঁশের মাচান, কিছু মেটে হাঁড়ি, কলসি, একটা পেতলের কলস, টিনের চাল আর চিড়িয়াখানার মতো যত সব জীবজন্তুর বাস। একটা হনুও ইদানীং পিলু আমদানি করেছে। আমার বাবার বাড়িঘরের সঙ্গে এই দেবস্থানের কত তফাত বৌদি একদিন গেলেই টের পেয়ে যাবেন। আমাদের দুরবস্থা কেউ টের পেলে, আমার কেমন লাগে। এমনকি গরুটাও আমাদের খোঁড়া। এই যে লক্ষ্মী যাবে, গিয়েই টের পাবে সত্যি আমার বাবা পৃথিবীর কত বড় উদ্বাস্তু। সে এসে সব বললেই হয়ে গেল। বাইরে এসে মাথাটা এত উত্তপ্ত হয়েছিল যে কিছুই খেয়াল নেই। গোঁয়ারের মতো হেঁটে যাচ্ছি। কোন হুঁশ নেই। রেললাইনে উঠতেই মনে হল, লক্ষ্মীর যাবার কথা। না নিয়ে গেলে কথা হবে। পেছনে তাকালাম। দেখি লক্ষ্মী নিঃশব্দে ভীতু বালিকার মতো আমার পেছন পেছন আসছে। পুঁটুলিটা ভারি সযত্নে বুকের মধ্যে দু-হাতে চেপে রেখেছে। বড় করুণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
খুব গম্ভীর গলায় বললাম, হয়েছে। এবারে পা চালিয়ে হাঁট। পা চালিয়ে না হাঁটলে রাত হয়ে যাবে। নবমী বুড়ির বনটা সাঁজ লাগার আগে পার হতে হবে।
লক্ষ্মী মাথা নিচু করে বলল, আমি জানি।
—কী জান?
—জানি।
এখন রহস্যময় কথাবার্তা লক্ষ্মীর আমার একদম ভাল লাগছে না। কোনদিন একা কোনও সমবয়সী মেয়েকে নিয়ে খালি মাঠপ্রান্তর পার হয়ে যাবার অভ্যাস নেই। ছোড়দির সাইকেলের পেছনে বসে একবার দামোদর নদ পার হয়েছিলাম। ছোড়দি ছিল অভিভাবকের মতো। তখন ভেতরটা এত অপরিষ্কার ছিল না। রেললাইন ধরে যেতে যেতে মনে হল, লক্ষ্মী নিজেও একটা পুঁটুলি। দেবস্থান ছাড়া তার আর কোথাও বোধহয় এ-ভাবে একা একজন উঠতি যুবকের সঙ্গে মাঠ পার হয়ে যাওয়া হয়নি। মন্দির চোখের আড়ালে পড়ে যেতেই দেখলাম লক্ষ্মী কেমন প্রকৃতির মধ্যে চঞ্চল হয়ে উঠেছে। গরম ভাপ উঠছিল, সেটা কমে গিয়ে ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। সামনে সেই কাশবন। মাইলখানেকের মতো এটার ভেতর দিয়ে দু’জনকে যেতে হবে। ভিতরে ঢুকতেই কেমন গা আমার শিরশির করছিল। লক্ষ্মী আগে আগে বেশ পা চালিয়ে হাঁটছে। ওর পায়ে রুপোর তোড়া। ঝমঝম করে বাজছিল। একবার ইচ্ছে হল, পুঁটুলিতে কি আছে দেখি। চাইলেই সযত্নে লক্ষ্মী পটুলি খুলে সব এক এক করে দেখাবে। আমি দেখতে চাই, অথচ দেখাতে বলার সাহস নেই। জীবন এই প্রথম নিজেকে ভয় পেতে শুরু করেছি। নিজের উপর আস্থা রাখতে পারছি না। পুঁটুলি খুলে দেখার লোভ সংবরণ আমাকে করতেই হবে।
লক্ষ্মী হাঁটছে আর অজস্র কথা বলছে। দু’জন তাজা যুবকর সঙ্গে লক্ষ্মীর সহবাসের ছবির কথা কেবল মনে আসছে আমার। লক্ষ্মী বলছিল, দেখ, দেখ ঠাকুর, মেঘের টুকরো কেমন তালপাতার পাখা হয়ে যায়।
কাশবনের ফাঁকে মাথা তুলে তাকালে নিরন্তর এক আকাশ, টুকরো মেঘের ছবি। লক্ষ্মীর কাছে এই সব টুকরো মেঘ শীতল পাখা হয়ে গেছে। ভিতরে এক দাবদাহ এই নারীর, কোথায় যেন সবুজ এক অরণ্য খুঁজে মরছে। কত প্রশ্ন তার, মানুষ মরে যায় কেন? আকাশে তারারা কোথা থেকে আসে। এই ফুল, ফল সবুজ ঘ্রাণ কে পৃথিবীতে ছড়িয়ে রাখে? এই অবোধ বালিকার কোনো প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর দিতে পারিনি। গোপনে এক অপার আনন্দ অনুভব করছিলাম। কেবল মনে হচ্ছিল, এমন নিরন্তর নির্জন গভীর ছায়ার মধ্যে দিয়ে লক্ষ্মীকে নিয়ে যেন অনন্তকাল হাঁটি। কিন্তু লক্ষ্মীর সেই রহস্যময় কথা, ‘জানি’ কি জানে লক্ষ্মী? লক্ষ্মী কি আমার সব ইচ্ছের কথা জানে। আমার চোখ-মুখ দেখে সব টের পায়। তার পুঁটুলিটা যে যথেষ্ট ভারি এতক্ষণে তা আমিও টের পেয়েছি। বললাম, ওটা দাও আমার হাতে।
লক্ষ্মী বলল, না। আমার কোন কষ্ট হচ্ছে না।
কী আছে ওতে?
—কত কিছু।
—দেখাবে?
—দেখবে!
গরমে আমরা দু’জনেই ঘামছিলাম। লক্ষ্মী বলল, আর কতটা?
—বেশী দূর না। কারবালা রাস্তার কাছে এসে গেছি।
লক্ষ্মী চোখ তুলে আমাকে দেখল, তারপর পুঁটুলিটা নিচে রেখে মাথায় হাত দিয়ে বসল। লক্ষ্মীর এই বসাটা কেমন অভাগা রমণীর মতো। পুঁটুলিটা খোল, বলতে আর কেন জানি সাহস হল না। লক্ষ্মী তবু নিজেই সব খুলে দেখাল। একটা ঠোঙায় প্রসাদ, দুটো কাগজী লেবু, একটা ছোট ইঁচড়, দুটো তার গাছের আম, কিছু করমচা ফুল, কয়েকটা পাকা তেঁতুল। পাশে কলাপাতায় মোড়া কিছু একটা।
—ওটার মধ্যে কী আছে?
লক্ষ্মী ওটা খুলতে ইতস্তত করছিল। ফের বললাম, দেখাও। এতটা যখন দেখালে, এটাও দেখাও।
লক্ষ্মী কলাপাতা খুলে ফেলতেই আমি ভয়ে আঁৎকে উঠলাম। একটা কচি ছাগশিশুর মুন্ডু। আজ শনিবার। বলির পাঁঠার মহাপ্রসাদ পিলুর জন্য বৌদির কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছে বোধহয়।
লক্ষ্মী বলল, এই নিয়েছি সঙ্গে।
পিলু কী দুঃখ করে লক্ষ্মীকে বলে গেছে আমাদের বাড়িতে মহাপ্রসাদ কতদিন হয় না। সেই কবে একবার পিলু দুটো খরগোশ মেরে এনেছিল, তারপর দু’বার বাবা দুটো পাঁঠার মাথা নিয়ে এসেছিলেন, এবং সে কবেকার কথা। আমরা এখানে সেখানে তবু ভালমন্দ খাই। মা, মায়ার ভাগ্যে তাও জোটে না। লক্ষ্মী হয়তো তাই মনে রেখেছে। তবু এমন জনহীন একটা কাশের জঙ্গলের মধ্যে মুন্ডুটার ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকার মধ্যে যেন বড় অভিশাপের ভঙ্গী আছে।
বললাম, এটা না নিলেই পারতে।
লক্ষ্মী পোঁটলাটা বাঁধতে বাঁধতে হাসল।
—এই নিয়ে যাচ্ছি।
যেন বলতে যাচ্ছিল, এই আমি, টক, ঝাল, মিষ্টি। সঙ্গে ছোট্ট এক ছাগশিশুর মুন্ডু। আমার ভেতরেই এরা বাস করে ঠাকুর। তুমি আমাকে অবহেলা কর না।