Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

সকালেও পিলুর জ্বরটা সারল না। মা গায়ে হাত দিয়ে বলল, দেখি। পিলু হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, বলছি তো জ্বর নেই। মা তবু কপালে হাত রেখে বলল, জ্বর আছে। বের হবে না কোথাও। সকালে কিছু খাবে না। দুপুরে বার্লি। পিলু রেগে গেল। বলল, কিছু খাব না! জ্বর আছে! সে মুখ ভেংচাল মাকে।—আমার শরীর, আমি বুঝি না, তুমি বোঝ।

অগত্যা আমার পালা। হাত দিয়ে দেখলাম, গায়ে জ্বর বেশ। বললাম, যা শুয়ে থাকগে। ঘোরাঘুরি করলে জ্বর বাড়বে।

বেশ রোদ উঠেছে। আকাশ পরিষ্কার। গাছপালা সকালের হাওয়ায় তিরতির করে কাঁপছে। কুকুরটা দু’দিন হল বাড়ি ফিরছে না। বাবার মতো কেমন বাউণ্ডুলে স্বভাবের। এক দণ্ড বাড়ি ঘরে তিষ্টোয় না। কেবল সারা মাঠ, এবং সড়কে ঘুরে বেড়াবে।

গতকাল আমাদের এমন একটা আতঙ্কের দিনেও কুকুরটা রাতে ফিরে আসেনি বলে পিলু বসে বসে গজগজ করছিল। আসলে আমরা বুঝতে পারি কুকুরটা কোথায় আছে খুঁজে দেখার নাম করে পিলু এখন একটু মাঠঘাটে অথবা গাছপালার অভ্যন্তরে ঘুরে আসতে চায়। আমি বললাম, ঠিক আসবে। যাবে কোথায়!

—এলে দেখ না কি করি। খেতে পাবে না ভেবে পিলুর মেজাজ চড়ে যাচ্ছে। কাউকে সকালে খেতে দেওয়া হোক পিলু এখন সেটাও চাইছে না। পিলুর জ্বরের সঙ্গে সামান্য সর্দি কাশি আছে। সামান্য বাসক পাতার রস দিলে খুব কাজে আসত। বাবা থাকলে কোন ঝামেলা ছিল না। ঠিক জঙ্গল থেকে এটা ওটা খুঁজে এনে রস করে দিতেন। অবশ্য বাবা অসুখের তিন-চারদিন না দেখে কিছু করার পক্ষপাতী নন। আমরা গত শীতে যে সামান্য জ্বর জ্বালায় ভুগেছি তাতে টের পেয়েছি, অসুখ-বিসুখে আমার বাবা বড়ই নিস্পৃহ। কেবল পাঁচদিনের মাথায় যখন সর্দি কফ বুক থেকে নড়ানড়ি করার নাম করছে না তখনই বাবা বলেছিলেন, বাসক পাতার একটা গাছ লাগানো দরকার। বাসক পাতা, তুলসীপাতা, শিউলীপাতা আর আদার রস, একটু লোহা পুড়িয়ে দেব। সব ঠিক হয়ে যাবে।

মা বলেছেন, বাসক গাছ কোথায়?

—আরে লাগালেই হবে।

—গাছ লাগাবে, বড় হবে, পাতা হবে, তবে রস হবে। সে তো এ-জন্মে হবে বলে মনে হচ্ছে না।

বাবা বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ধনবৌ তোমার জিভ বড়ই ক্ষুরধার। মা, বাবার এই উক্তিতে খুবই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল। জ্বরজ্বালা হলে লোকে ডাক্তার ডাকে। একটা কিছু করে। তা না করে মানুষটা কেবল বসে বসে হিতোপদেশ ঝাড়ে। কিছু বললেই জিভ ক্ষুরধার হয়ে যায়। উচিত কথা বলা যাবে না। মা আর অসুখ-বিসুখ নিয়ে বাবাকে একটা কথা বলেনি। ছ’দিনের মাথায় আমার বুকের কফ নড়ে উঠল। সাতদিনের মাথায় বেশ তরল হয়ে গেল। বাবা স্নান করতে বললেন। অবগাহন স্নান এবং অবগাহন স্নানের পরই শরীর কেমন ঝরঝরে হয়ে গেল। তারপর তিন দিন তিন রাত মানুষের শরীর সম্পর্কে প্রাচীন আয়ুর্বেদ চিকিৎসকরা কে কি বলে গেছেন, ফাঁকে ফাঁকে তা মার প্রতি সামান্য কটাক্ষ হেনে বলতেন, শরীরের নাম মহাশয়, বাকিটা বলতেন না। যেন ভাবটা এই বুঝে নাও আর সব।

বাবার চিকিৎসা শাস্ত্রে বেশ ব্যুৎপত্তি আছে এটা বোঝা গেল বিকেলবেলায়। বাবা বিকেলের ট্রেনে ফিরে এসে পিলুকে বাড়ি দেখতে পেয়ে ঘাবড়ে গেলেন। পিলু এমন নিরীহ শান্ত-শিষ্ট হয়ে জলচৌকিতে বসে আছে, আসলে পিলু না অন্য কেউ, যেন চশমা থাকলে খুলে দেখতেন। বাবার পোঁটলা-পুঁটলি এবার খুবই ছোট সাইজের। বাবা সামান্য নুয়ে বারান্দায় উঠে এলে পিলু বেশ ক্ষীণ গলায় বলল, মা, বাবা এসেছে। আমি ঘরে অঙ্ক করছিলাম। বাইরে বের হয়ে এলাম। আর মা রান্নাঘর থেকেই বলল, বসতে দে। বাবা বুঝতে পারলেন এবারের দোষ ত্রুটি একটু বেশি মাত্রায় হয়ে গেছে। মার অতিথিপরায়ণতা দেখেই বুঝি সেটা টের পেয়েছেন। বের হলে ঘরে ফেরা কবে হবে যেন তিনি নিজেও ঠিক জানেন না। ঘোরাঘুরি করার সময় মানুষজন, ট্রেনে ভ্রমণ, শিষ্যবাড়ির গুরু ভোজনে মনে থাকে না, বনভূমিতে একটা তাঁর আবাস রয়েছে। চিঠিপত্র দিতেও ভুলে যান। নাকি তাঁর মনে হয়, কালই তো ফিরছি, কাল আবার যে কি কালে গ্রাস করে ফেলে, কারণ রোজই তাঁর বাড়ি ফেরার উদ্যোগ আয়োজন করার সময়ই বুঝি মনে পড়ে যায়, লক্ষ্মণ মল্লিকের সঙ্গে কতদিন দেখা নেই, যখন এসেছেন, তখন ঘুরেই যাবেন। এমন সব বহুবিধ লক্ষ্মণ মল্লিক বাবার ঝোলায় রয়েছে। ফলে প্রতিদিনই একবার করে বাড়ি ফেরার তাগিদ, একবার করে লক্ষ্মণ মল্লিকদের তাগিদ। ফলে দুই তরফের ঠোকাঠুকিতে বাবার শেষ পর্যন্ত বুঝি চিঠি লেখাটাও হয়ে ওঠে না। বাড়ি ফিরেই বাবা টের পেলেন, মা আর ধনবৌ নেই, সুপ্রভা দেবী হয়ে আছেন। তখন সামান্য গলা খাকারি দিলেন। মেজ পুত্রটিকে বললেন, তোমরা সবাই ভাল আছ তো? মাকে জ্বালাওনি তো? তবু যখন ভেতর থেকে কোনো উচ্চবাচ্য নেই, আমাকে বললেন, মানুর কাছে গেছিলি? পরীক্ষা কবে জেনেছিস? আমি গেছিলাম কি গেছিলাম না ওটা বড় কথা নয়। আসলে বুঝি বাবা কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছেন না! মায়া তখন বলল, জান বাবা, ছোড়দাকে সিংগি মাছে আঙুল ফুঁড়ে দিয়েছে। দাদার জ্বর হয়েছে।

পিলু বলল, হ্যাঁ বলেছে, আমার জ্বর হয়েছে। না বাবা, কিছু হয়নি। মা আমাকে কিছু খেতে দিচ্ছে না।

বাবা এবারে বললেন, দেখি কোথায় ফুঁড়েছে।

মা ভেতর থেকেই খুবই নিরুত্তাপ গলায় বলল, দেখা, সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী এসেছেন, দেখা।

বাবার মুখটা খুবই অসহায় দেখাল। পিলুর আঙুলটা খুবই ফুলে আছে। বাবা মা’র বিদ্রূপ এতটুকু গায়ে মাখলেন না। আঙুল বিশিষ্ট চিকিৎসকের মতোই টিপে টিপে দেখলেন। তারপর বললেন, ভয় নেই সেরে যাবে। মায়া, একটা ছোট বাটি দিতে পারবি। কারণ বাবা এবং মায়ের মধ্যে অদৃশ্য খোঁচাখুঁচি আরম্ভ হলেই আমরা সংসারে ভীষণ গুরুত্ব পেয়ে যাই। বাবা এখন সব কথাই আমাদের সঙ্গে বলবেন। মাও। যেন বাবা মাকে চেনেন না। অথবা দুজনই দুই বিপরীত মেরুতে বসে অদৃশ্য সুতো জুড়ে আমাদের দিয়ে টরে টক্কা বাজাচ্ছে।

পিলু বলল, বাবা, কাল আমি ভাত খাব?

—খাবে।

বাবা এখন কল্পতরু। সুপ্রভা দেবী বুঝোক সংসারে তাঁর দাম কম নয়। পিলু বুঝি ভাবছে, আর কি চাওয়া যায়। মায়া তখন ছোট্ট একটা বাটি এনে দিলে বাবা কোথা থেকে অনেকটা ভেরেণ্ডার কষ নিয়ে এসে হাতে লেপ্টে দিলেন। বললেন, রাতে শোবার সময় আর একবার। সকালেও দেবে। আঙুলের ফোলা কমলে জ্বরও সেরে যাবে। পরদিন পিলুর জ্বর সেরে যাওয়ায় সুপ্রভা দেবী আবার সংসারে ধনবৌ হয়ে গেল। বাবাকে বলল, কিগো চানটান করবে না। কত বেলা হল? কখন ঠাকুরঘরে ঢুকবে!

বাবা জমিতে গাছপালা লাগাবার সময় কথা কম বলেন। আজ সকাল থেকেই গাছপালা লাগাবার কাজে ব্যস্ত। কত সব শেকড়-বাকড় নিয়ে এসেছেন তিনি, পোঁটলাপুঁটলি খুললে টের পেয়েছিলাম। একটাতেও প্রণামীর কাপড় কিংবা চাল ডাল বলতে কিছু নেই। ছোট ছোট অঙ্কুরের মতো গাছ আর শুধু শেকড়বাকড়। বাবা একটা মূল তুলে রোপণ করছেন আর কাঠি পুঁতে দিচ্ছেন। বলছেন এটা হল হরতকী গাছের চারা। এখানে পুনর্ণবার ঝাড়ু এদিকটায় থানকুনিপাতা, এখানে থাকল গন্ধ পাদাল। বাসকের ডাল লাগাবার সময় জায়গাটার উর্বরা সম্পর্কে সংশয় দেখা দিল। বাবা ডালটা তুলে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে গেলেন। অর্থাৎ কাঠা খানেক জমি জুড়ে তিনি আজ যাবতীয় ভেষজ রোপণে ব্যস্ত। কারো কথায় কর্ণপাত করার সময় এটা নয় বুঝে মা সটকে পড়েছে। কেবল পিলু পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল। কুকুরটা রাতে ফিরে এসেছে। সে পিলুর পায়ের কাছে বসে লেজ নাড়ছে।

বাবা গাছ লাগাবার সময় কোন গাছে কি ফল দেবে বলে যাচ্ছেন। আর কি ভাবে সংগ্রহ করেছেন, তিনি এই শেকড়-বাকড়ের জন্য কতদূর গিয়েছিলেন তার আদ্যোপান্ত বিবরণ। সব জায়গায় সব গাছ হয় না। কিন্তু এখানকার যা মাটি তাঁর ধারণা সব গাছই ফলবতী হবে। একটা অর্জুনের বিচি পুঁতে বললেন যদি গাছটা হয়, দেখবে কি সুন্দর তার ডালপালা। গাছের ছাল হৃদরোগের মহৌষধ। হালিশহরের পঞ্চানন কবিরাজ বীজ দিল। পঞ্চানন কবিরাজ বলল, কর্তা নিয়ে যান, সব সময় পাওয়া যায় না। সব বীজ থেকে গাছও হয় না। আমার কাছে এই অমূল্য রত্নটি পড়ে আছে এখন কাকে দিই ভাবছিলাম। আপনার মতো সদাশয় মানুষের হাতে বীজ কথা বলতে পারে। নিয়ে যান যদি কথা বলে। পিলুর দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখলেন। তারপর বললেন, তোর কি মনে হয়, গাছটা হবে তো?

পিলু বলল, তুমি লাগালে সব হয় বাবা।

পিলু এই কথাটা যেন আরও জোরে বলে, এমন ইচ্ছাতে বাবা বললেন, তুই কি শরীরে জোর পাস না?

পিলু বলল, পাই তো!

না, ভাল মনে হচ্ছে না। তোমার শরীরটা ঠিক হচ্ছে না পিলু, ভেতরে ভেতরে ঘুসঘুসে জ্বর হচ্ছে হয়তো। খাওয়া দাওয়া ভাল দরকার। দুধ খেতে হবে।

দুধ খেতে হবে বললেই আর খাওয়া হয় না। মানুষের ঘরবাড়িতে একটি সবৎসা গাভী কত দরকার পিলুর দিকে তাকিয়ে যেন সেটা মনে পড়ে গেল। বাবা তারপর কি ভাবলেন, দুপুরে খেতে বসে বললেন, বুঝলে ধনবৌ, সবই তো হয়ে গেল, চাঁপাকলার গাছও বড় হচ্ছে। এবারে কার্তিক অঘ্রানে ছড়া পড়বে। চাঁপাকলা দুধ হলে বেশ হয়। বারান্দায় খেতে বসে বাবার দুধ খাবার বাসনার কথা ভেবে মা’র চোখে কি যেন সংশয় দেখা দিল। বলল, এই তো ঘুরে এলে। কটা দিন অন্তত বাড়ি থাক। কারণ মা বুঝি বুঝতে পারে ঠিক সবৎসা গাভীর সন্ধানের অজুহাতে বাবা আবার বাড়ি থেকে উধাও হবার ধান্ধায় আছে।

–পিলুর দুধ খাওয়া দরকার। বাবা নিজের প্রয়োজনের কথা না বলে পুত্রদের প্রয়োজনের ওপর গুরুত্ব দিতে চাইলেন।

মা বলল, পাবে কোথায়?

সত্যি কথাটা ভেবেই খাবার ব্যাপারে বাবা অত্যধিক মনোযোগী হয়ে গেল।

এতগুলো টাকা একসঙ্গে—না ভাবা যায় না।

পিলু বলল, নবমী বলেছিল, একটা ছাগলের বাচ্চা দেবে বাবা। নিয়ে আসব?

এই নিয়ে বছরখানেক ধরে একটি ছাগলছানা আনার জন্য কতবার বাবার কাছে পিলু আর্জি পেশ করেছে। বারবারই বাবার প্রত্যাখ্যানে পিলু চেয়ে আনতে সাহস পায়নি। মোক্ষম সময় বুঝে আবার পিলু কথাটা পাড়ল।

বাবা বললেন, বামুনের বাড়ি এটা। বামুনের বাড়িতে ছাগল পোষে না!

সুতরাং যতই দুধের প্রয়োজন থাকুক একটা ছাগলছানা তার জন্য এনে হাজির করা যায় না। পিলু কি ভাবল কে জানে, ক’দিন পর ঠিক একটা ছাগলছানা বগলে করে নিয়ে এল। বাবা হয়ত প্রথম বকাঝকা করবে, পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন দরকার আপাতত ছাগলছানাটিকে বাবার চোখের সামনে থেকে কিছুদিনের জন্য সরিয়ে রাখা। আমাদের পাঁচ বিঘে ভূঁইর শেষ দিকে, যেখানে একটা ইঁটের ভাঙা পাঁচিল আবিষ্কৃত হয়েছে, যেখানে এখনও গাছপালার জন্য রোদ আসে না, তার পাশে নিরিবিলি একটা জায়গায় ভাঙা ইঁটের খুপরি বানিয়ে ফেলল পিলু। ছাগলের বাচ্চাটাকে কিছু ঘাস দিল খেতে। বাবা সারাদিন ওদিকটায় বড় যান না।

কেন যান না রহস্যটা অবশ্য অনেকদিন পর আবিষ্কৃত হয়েছিল। এবং যেহেতু সেদিকে যান না, পিলুর কাছে সব চেয়ে নিরাপদ মনে হয়েছিল জায়গাটাকে। সে বাড়ির দশটা কাজের কথাও ভুলে গেল। কখন ডেকে উঠবে কে জানে। এই ভয়ে সারাদিন ঘাসপাতা খাওয়াল গোপনে। বাবা যখন সন্ধ্যায় নিবারণ দাসের আড়তে জম্পেস করে আড্ডা দিতে রওনা হলেন তখনই পিলু ছাগলের বাচ্চাটাকে বগলে করে একেবারে বাড়ির মধ্যে।

এবং আমরা সবাই মিলে ঠিক করলাম, আপাতত বাচ্চাটাকে রান্নাঘরে রাখা যাক। ও-ঘরটায় বাবা পারতপক্ষে ঢোকেন না। কারণ এ এলাকার সবটাই সুপ্রভা দেবীর একান্ত নিজস্ব। ভেতরের দিকে ছোট বারান্দায় খাওয়া-দাওয়া হয়। বাবা শুধু দরজায় উঁকি দিলে দেখতে পাবেন। এতসব ভেবে বাচ্চাটাকে রাখা গেল ঠিক, কিন্তু হলে কি হবে, ছাগলের বাচ্চা, বুদ্ধি আর কতটা হবে, দুপুর রাতে সহসা ত্রাহি চিৎকার। বাবা ধড়ফড় করে উঠে গেলেন। আমরা সবাই। শেয়ালের উপদ্রব হতে পারে ভেবেও পিলু টু শব্দটি করছে না। কারণ বাবার কি মর্জি হবে কে জানে। তখনই বাবা বললেন, কিসে ডাকে।

মা বলল, তাই তো!

বাবার জীব-জন্তুর প্রতি মমতা এমনিতে একটু বেশি। সাপ-খোপের বেলায় এটা যথার্থ টের পেয়েছি। তিনি খুবই উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, তাড়াতাড়ি লম্ফটা জ্বাল ধনবৌ। মনে হচ্ছে শেয়ালে ছাগলের বাচ্চা ধরেছে। বাইরে বের হয়ে লম্ফের আলোতে কোথায় বাচ্চাটা খোঁজাখুঁজি করতে থাকলেন। কোথা থেকে এল, অথবা এখানে ব্যারেকে যে সুবাদার সাবের ছাগল রয়েছে, বাচ্চাটা তারও হতে পারে, পথ ভুলে চলে আসতে পারে, অন্ধকারে কোথাও ডাকছে তিনি হন্যে হয়ে খোঁজাখুঁজি করতে থাকলেন।

আশ্চর্য, পিলু আগের মতোই লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। সে উঠছে না, নড়ছে না।

পিলু জোরে জোরে নাক ডাকতে থাকল।

বাবা বললেন, কোথায় দেখছি না তো! রান্নাঘর থেকে বাচ্চাটা মানুষের সাড়া পেয়ে আরও জোর গলায় ব্যাঁ ব্যাঁ করতে থাকল। দু-তরফের ডাকাডাকিতে বাবাকে সত্যি কথাটা বলে দিলে এখন বেশ হয়, পিলুকে জব্দ করা যায়। পিলুর নাক ডাকানি বন্ধ করা যায়—তখনই মা বলল, দাঁড়াও। মনে হচ্ছে রান্নাঘরে আছে। মা রান্নাঘরে ঢুকে গেলে বাবাও ঢুকে গেলেন। বাচ্চাটা দেখে কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে থাকলেন বাবা। মেজ পুত্রটির কাজ, ছাগলের জন্য কত হরেক রকমের কচি ঘাস, ছেঁড়া আসন, জলের পাত্র সাদা রঙের একটা কচি বাচ্চার সেবাযত্নের বহর দেখে বাবা বোধ হয় ধীরে ধীরে সংবিৎ ফিরে পেলেন। কিছু বললেন না। সোজা শোবার ঘরে ঢুকে বললেন, হয়েছে, এবারে নাক ডাকা বন্ধ কর বাবাধন। সঙ্গে সঙ্গে পিলু কেমন নির্জীব হয়ে গেল। নাক ডাকল না আর।

বললেন, ওঠ। কথা আছে।

পিলু উঠে বসল।

বললেন, নাম এবার।

পিলু নেমে এল।

—কোথা থেকে চুরি করেছিস?

—চুরি না তো বাবা!

—তবে লুকিয়ে রেখেছিস কেন?

—তুমি দেখলে যদি কষ্ট পাও। বামুনের বাড়িতে ছাগল পুষতে হয় না যে বলেছিলে।

-–সত্যি, তবে নবমী দিয়েছে? না বুড়িটাকে ঠকিয়েছিস? না বলে কয়ে নিয়ে এসেছিস?

পিলু আমার দিকে তাকাল। পিলুর সাংঘাতিক বিপদের সময় আমি তার বড়দা হয়ে যাই। সেই একবার নবমীর কাছে আমাকে নিয়ে গেছিল। পিলুর প্রতি নবমীর ভক্তি স্বচক্ষে দেখেছি। পিলু আমার দিকে তাকিয়ে আছে—যদি আমি ওর হয়ে কিছু বলি।

বাবা ফের বললেন, একটা গরীব ভিখিরি বুড়ি, তিন কুলে কেউ নেই, জঙ্গলে থাকে, কত কষ্টে থাকে আর তুই না বলে না কয়ে……

পিলু বলল, আমাকে সত্যি দিয়েছে বাবা। চুরি করে আনিনি।

পিলুর অসহায় মুখ দেখে আমারও কষ্ট হচ্ছিল। বাড়িঘর হয়ে যাবার পর বাবা মাঝে মাঝে দু- এক ঘা আজকাল পিলুকে দিয়ে থাকেন। এই পুত্রটির উপদ্রবে দু-একজন পড়শী ইতিমধ্যেই নালিশ জানিয়ে গেছে। এখন বাবা বাড়িতে কিছুদিন আছেন বলে, মার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই এবং এই সূত্রে বাবার শাসনের অধিকার বোঝাই যাচ্ছে আজ একটু বেশি। মাও যে বলবে, হয়েছে থাক, নিয়ে যখন এসেছে থাক, নবমীকে জিজ্ঞেস করলেই হবে—সেই মাও কেমন চক্রে জড়িত হয়ে পড়ায় পিলুর হয়ে সাফাই গাইতে সংকোচ বোধ করছিল। অগত্যা আর কি করি, বললাম, না বাবা, পিলু, সেই ছেলেই নয়। নবমী ওকে দাঠাকুর ডাকে। নবমীকে পিলু ফল পাকুড় দেয়। পাতা কেটে দেয়। শুকনো কাঠ দিয়ে আসে। শীতে মরে যাবে ভেবে পিলু মাকে না বলে নবমীকে একটা পুরনো শাড়ি পর্যন্ত দিয়ে এসেছে। মারবে ভেবে মা তোমাকে কিছু বলেনি।

বাবা পিলুকে আর একটা কথাও বললেন না। সহসা পুত্রগৌরবে বাবার মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে দু-চোখ বাবার জলে ভার হয়ে গেল। বললেন, তোদের একটু ভাল কিছু খাওয়াতে পারি না। ছাগলের বাচ্চাটা বড় হয়ে যদি একটু তবু দুধ দেয়। তারপর কেমন দুঃখী মানুষের মতো নিজেকে মশারির মধ্যে গুটিয়ে নিলেন। আর বোঝাই গেল না, বাবা আমার এ-বাড়ি-ঘরেই আছেন; এ-বাড়িঘরেই থাকেন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *