মানবিক মন
নিউরোলজিস্ট পবিত্র সাহা বর্ধমান ম্যাডিকেল কলেজ থেকে পাশ করে সেখানকার গ্ৰামের সরকারি হসপিটালে চাকরি করে। প্রতিদিন ডেউলি প্যাসেঞ্জারী করে কোলকাতা থেকে বর্ধমান।
বাবা নিউরো পেসেন্ট ছিলেন। হঠাৎ স্ট্রোকে মারা যায়।
তাই তার নিউরোলজি নিয়ে পড়াশোনা করা।
স্ত্রী, মা ও এক সন্তান নিয়ে তার সংসার।
একদিন কাজ থেকে ফিরেছেন, দেখেন এক বৃদ্ধ স্টেশনে ঘুরে তার ছেলেকে খুঁজছে। সবাই জিজ্ঞাসা করছে, ছেলের নাম কি? আপনি থাকেন কোথায়?
বৃদ্ধ কিছুই বলতে পারছেন না।
ইতিমধ্যে এক ভদ্রলোক এসে বললো, সকালে যখন যাচ্ছিলাম তখন একটা ছেলে দেখি ওনাকে হাত ধরে এনে এখানে বসিয়ে আসছি বলে চলে গেলো। উনি এখনো বসে আছেন?
ছেলে ছেড়ে চলে গেল নাকি?
পবিত্র দাঁড়িয়ে সকলের আলোচনা শুনছে।
তারপর ট্রেন চলে আসাতে সে বাড়ি চলে আসে।
পরদিন রবিবার খুশির মেজাজে কাটে।
সোমবার দিন দুপুরের দিকে বর্ধমান প্ল্যাটফর্মে নেমে একটু হাঁটতেই দেখলো বৃদ্ধ বেঞ্চে শুয়ে আছে ,চোখ দিয়ে হাল্কা জল গড়াচ্ছে।
মনে ভাবলো সেদিন থেকে এখনো স্টেশনে পড়ে। বাড়ির কেউ নিয়ে যায়নি। পথ ভুলে চলে এসেছে নাকি বাড়ির কেউ বোঝা মনে করে বসিয়ে রেখে চলে গেছে!
হসপিটালে গিয়ে পবিত্র মন দিয়ে কাজ করতে পারছে না। কেবলই বৃদ্ধের কথা মনে পড়ছে।
রোগী দেখা ছেড়ে তাড়াতাড়ি
ফিরে এলেন স্টেশনে।
এসে বৃদ্ধর খোঁজ করছে, নজরে পড়লো বদ্ধ একটা লোককে কী বলছে লোকটা পাত্তা না দিয়ে চলে গেল।
পবিত্র ডাক্তারের খুব মায়া হলো। কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন আপনি কোথায় থাকেন? বৃদ্ধ কিছু বলতে পারেনা। শুধু একটাই কথা বাড়ি।
ডাঃ পবিত্র বললেন, ঠিকানা জানেন ? বলতে পারেনা।
বুঝলেন অ্যালঝাইমাস রোগী। স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে। নার্ভের পেসেন্ট।
মনে ভাবলেন, এমন লোককে কী করে ফেলে রেখে যায়! কী নিষ্ঠুর বাড়ির লোকজন!
তার নিজের বাবাও অ্যালঝাইমাস পেসেন্ট ছিলেন। পিতার কথা মনে পড়ায়
তিনি বৃদ্ধকে সঙ্গে নিয়ে চলে এলেন বাড়িতে।
ঘটনা বৃত্তান্ত সব ঘরে জানালে
স্ত্রী ও মা সকলে বললেন ভালো করেছো।
শুরু করলেন নার্ভের চিকিৎসা। বাড়ির সকলকে বললেন, বৃদ্ধ যেন কোনো সময়ে একা না থাকেন , কেউ যেন সঙ্গ দেয়, কখনো যেন ধমকে কথা না বলা হয় ওনার সঙ্গে। অ্যালঝাইমাস রোগী.ভুলভাল কাজ করতে পারেন ; কেউ যেন বিরক্ত না হয়।
সবসময় দেখভালের জন্য একটা আয়া রাখা হলো।
টানা এক বছর ট্রিটমেন্টের পর বৃদ্ধর স্মৃতি কিছুটা ফিরে আসে। কিন্তু ঠিকানা বা ফোন নম্বর কিছু বলতে পারেননা।
আরও অনেক দিন পর বাড়ির সামনে একটা পার্কে কিছু বয়স্ক লোক আড্ডা মারে সেখানে আয়াকে নিয়ে যেতে বলেন পবিত্র ডাক্তার।
বিকালে সেখানে যায় , সকলের সঙ্গ করে বৃদ্ধ অনেক স্বাভাবিক হয়।
এরপর বৃদ্ধকে বাড়ি ফিরিয়ে দেবার জন্য স্টেশনে, লোকবহুল স্থানে বৃদ্ধর ছবিসহ পোস্টার দেখে হয়, কেউ যদি চেনে যথাযথ প্রমাণ দিয়ে নিয়ে যাবেন।
দিন চলে যায় কিন্তু কেউই আসেনা।
এদিকে বাড়ির ছেলে চিন্টু দাদুকে ভালোবেসে ফেলেছে।
দাদুর সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক। সে ছাড়তে চায়না।
পাড়ার বয়স্করাও বলেন, পবিত্র তোমার মানবিকতার তুলনা হয়না।
একজন প্রসিদ্ধ ডাক্তার হয়ে স্টেশনে একজন অসহায়কে নিজের দায়িত্বে ঘরে এনে যেভাবে সুস্থ করে নবজীবন দিলে, ওনাকে তোমার কাছেই রেখে দাও। ভগবান তোমার মঙ্গল করবেন, তোমার কোনো অভাব রাখবেন না। কতদিন আর বাঁচবেন উনি?
তোমার বাবা মনে করে রেখে দাও। কখনো যদি কেউ খবর নিতে আসে বা উনি নিজে বাড়ি যেতে সক্ষম হন তখন না হয় যাবেন।
মা’ও সহমত জানালে , বৃদ্ধ তাঁদের কাছেই থাকে।