Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

প্রস্রবণের মুকুরোজ্জ্বল জলে একটি চঞ্চল ছায়া পড়িল। দিবাস্বপ্ন ভাঙিয়া নির্বাণ উঠিয়া বসিল; ইতি আসিতেছে।

ইতির দেহে একটি মাত্র শ্বেতবস্ত্র। পঞ্চ হস্ত পরিমিত একটি দুকূলপট্ট কটি ও নিতম্ব বেষ্টন করিয়া সম্মুখে বক্ষ আবরণপূর্বক গ্রীবার পশ্চাতে গ্রন্থিবদ্ধ রহিয়াছে; স্কন্ধ ও বাহুমূল উন্মুক্ত। তাহার রুক্ষ কেশভার সুকৃষ্ণ নহে, রৌদ্ররশ্মি পড়িয়া অঙ্গারাবৃত অগ্নিশিখার ন্যায় আরক্ত প্রভা বিকীর্ণ করিতেছে।

লঘুপদে সঙ্কীর্ণ পয়োধারা উল্লঙ্ঘন করিয়া ইতি নির্বাণের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল; মুষ্টিবদ্ধ হস্ত পশ্চাতে রাখিয়া বলিল, চক্ষু মুদিত কর।

নির্বাণ চক্ষু মুদিত করিল।

হাঁ কর।

নির্বাণ মুদিত চক্ষে মুখ ব্যাদান করিল।

ইতি তাহার মুখে মুষ্টিধৃত গুবাক ফলের মতো একটি ক্ষুদ্র দ্রব্য পুরিয়া দিয়া হাসিতে হাসিতে তাহার পাশে বসিয়া পড়িল, বলিল, এখন বল দেখি, কি খাইতেছ?

নির্বাণ চিবাইতে চিবাইতে চক্ষু মেলিয়া বলিল, শর্করা-কল। কোথায় পাইলে?

ইতি তখন নির্বাণের গা ঘেঁষিয়া বসিয়া কোথায় শর্করা-কন্দ পাইল তাহা বলিতে আরম্ভ করিল। বালুর নিম্নে মাটি আছে, নানা জাতীয় বিচিত্র বীজকণা সেখানে গিয়া সঞ্চিত হয়। তারপর একদিন প্রকৃতির মন্ত্র কুহকে অঙ্কুরিত হইয়া আলোকের সন্ধানে ঊর্ধ্বে উঠিতে আরম্ভ করে। কেহ বালু ভেদ করিয়া উঠিতে পারে, কেহ পারে না। বালুকার গর্ভে তাহাদের ফল-কন্দ বর্ধিত হইয়া প্রচ্ছন্ন জীবন যাপন করে। কিন্তু ইতির চক্ষে আবরণ পড়ে নাই। সে দেখিতে পায়। বালু খুঁড়িয়া এই সব রস-পরিপুষ্ট স্বাদু উদ্ভিজ হরণ করিয়া আনে। খর্জুর ভিন্ন যাহাদের

অন্য খাদ্য নাই, তাহাদের মুখে ইহা অমৃততুল্য বোধ হয়।

সানন্দে চর্বণ করিতে করিতে নির্বাণ বলিল, তুমি খাও নাই?

ইতির চক্ষু অর্ধনিমীলিত হইয়া আসিল, সে অধরোষ্ঠের একটি বিমর্ষ ভঙ্গিমা করিয়া বলিল, আর কোথায় পাইব? একটিমাত্র পাইয়াছিলাম।

নির্বাণের চর্বণক্রিয়া বন্ধ হইল; সে ইতির প্রতি বিস্মিত চক্ষু ফিরাইল। ইতিও চক্ষু পাতিয়া পরম তৃপ্তিভরে নির্বাণের বিস্ময়বিমূঢ় মুখ ক্ষণেক নিরীক্ষণ করিয়া লইল, তারপর কৌতুকবিগলিত কলহাস্য করিয়া তাহার কোলের উপর লুটাইয়া পড়িল।

নির্বাণ এতক্ষণ যেন আত্মবিস্মৃত ছিল, এখন বিদ্দাহতের মতো চমকিয়া শিহরিয়া উঠিল। ঠিক এই সময় পশ্চাৎ হইতে বজ্রগম্ভীর আহ্বান আসিল—নির্বাণ!

প্রথমে নির্বাণের মনে হইল, এই ধ্বনি যেন তাহার মস্তিষ্কের মধ্যেই মন্দ্রিত হইয়াছে। তারপর সে মুখ ফিরাইয়া দেখিল, মূর্তিমান তিরস্কারের ন্যায় ভিক্ষু উচণ্ড বক্ষ বাহুবদ্ধ করিয়া অদূরে দাঁড়াইয়া আছেন।

সভয়ে অপরাধ-কুণ্ঠিত দেহে নির্বাণ উঠিয়া দাঁড়াইল। উচণ্ড অঙ্গারগর্ভ চক্ষু তাহার উপর স্থাপন করিয়া গভীর কণ্ঠে একবার বলিলেন, ধিক্!

নির্বাণের মুখ হইতে সমস্ত রক্ত নামিয়া গিয়া মুখ মৃতের মতো পার হইয়া গেল। সে আড়ষ্টভাবে দাঁড়াইয়া রহিল।

উচণ্ড সঙেঘর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিলেন, যাও! স্থবির তোমাকে আহ্বান করিয়াছেন।

যন্ত্রচালিতের ন্যায় নির্বাণ প্রস্থান করিল।

ইতি এতক্ষণ নির্বাক্‌ বিভিন্ন-ওষ্ঠাধরে ভূমির উপর বসিয়া ছিল, এখন বিস্ফারিত নেত্র উচণ্ডের মুখের উপর নিবদ্ধ রাখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।

নির্বাণ সঙ্ঘমধ্যে অন্তর্হিত হইয়া গেলে উচণ্ড প্রজ্বলিত চক্ষু ইতির দিকে ফিরাইলেন, তাহার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া কর্কশ কণ্ঠে কহিলেন, স্কন্ধ আবৃত কর।

ইতি চকিতে নিজ অঙ্গের প্রতি দৃষ্টি ফিরাইল, তারপর আবার উচণ্ডের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া ধীরে ধীরে কণ্ঠলগ্ন বস্ত্র স্কন্ধের উপর প্রসারিত করিয়া দিল।

ভীষণ ভ্রূকুটি করিয়া উচণ্ড প্রশ্ন করিলেন, সঙ্ঘের অলিন্দ পরিষ্কৃত করিয়াছ?

হাঁ অজ্জ, করিয়াছি।

জল সঞ্চয় করিয়াছ?

হাঁ অজ্জ, করিয়াছি।

ফল সংগ্রহ করিয়াছ?

হাঁ অজ্জ, করিয়াছি।

উচণ্ড অধর দংশন করিলেন। ইতিকে শাসনাধীনে আনা অসম্ভব—সে নারী, ভিক্ষুসঙ্ঘে ভিক্ষুণীর স্থান নাই। উচণ্ড তাহার সর্বাঙ্গে একটা অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া দ্রুত সঙ্ঘের অভিমুখে চলিলেন। ইতি দুই চক্ষে দুর্ভেয় দৃষ্টি লইয়া চিত্রার্পিতের ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিল।

ওদিকে নির্বাণ স্থবিরের সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছিল, তাঁহার চরণ স্পর্শ করিয়া বলিল, বন্দে।

স্থবির তাহার পৃষ্ঠে হস্তাৰ্পণ করিয়া স্নেহার্দস্বরে আশীর্বচন করিলেন—আরোগ্য।

নির্বাণের অপরাধ সঙ্কুচিত চিত্ত বোধ হয় স্থবিরের নিকট তীব্র ভৎসনা প্রত্যাশা করিতেছিল, তাই তাঁহার স্নেহসিক্ত বচনে তাহার হৃদয় সহসা দ্রবীভূত হইয়া গেল, চক্ষু বাষ্পচ্ছন্ন হইয়া উঠিল। সে স্থবিরের পদপ্রান্তে বসিয়া পড়িল।

স্থবির তখন ধীরে ধীরে বলিলেন, নির্বাণ, তোমার উপাধ্যায়ের নিকট জানিতে পারিলাম তুমি উপসম্পদা গ্রহণে অভিলাষী। ইহা সত্য?

নির্বাণ যেন কূল পাইল, অবরুদ্ধ স্বরে বলিল, হাঁ ভদন্ত, আমাকে উপসম্পদা দান করিয়া সঙেঘ গ্রহণ করুন।

স্থবির কিছুকাল নীরব রহিলেন; তারপর বলিলেন, নির্বাণ, তুমি সদ্ধর্মে শিক্ষা লাভ করিয়াছ; সঙ্ঘে প্রবেশ করিতে হইলে নশ্বর আসক্তি কামনা ত্যাগ করিয়া আসিতে হয়, ইহা নিশ্চয় তোমার

অপরিজ্ঞাত নহে। সঙেঘর বিধি-বিধান অতি কঠোর, তুমি পালন করিতে পারিবে?

এই সময় উচণ্ড প্রবেশ করিয়া নীরবে এক পার্শ্বে দাঁড়াইলেন; নির্বাণ অবনত মস্তকে বলিল, হাঁ ভদন্ত, পারিব।

না পারিলে পাতিমোক্ষ দণ্ড গ্রহণ করিতে হইবে—বিনয়পাঠে অবশ্য তাহা অবগত আছ?

আছি, ভদন্ত।

স্থবির তখন করুণ বচনে বলিলেন, বৎস, ব্যাধতাড়িত পশু গুহার মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে, ত্রিতাপক্লিষ্ট মানব নিষ্কৃতির কামনায় ধর্মের অনুরাগী হয়। বুদ্ধের সঙ্ঘ সেরূপ স্থান নহে। যাহার অন্তরে বৈরাগ্য এবং নির্বাণ-তৃষ্ণা জন্মিয়াছে, সে-ই সঙেঘর অধিকারী। তুমি এই সকল বিচার করিয়া উত্তর দাও।

গলদশ্রু নির্বাণ যুক্তকরে বলিল, আমি সঙেঘর আশ্রয় ভিক্ষা করিতেছিসঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি। আমাকে উপসম্পদা দান করুন।

গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া স্থবির বলিলেন, বুদ্ধের ইচ্ছাই পূর্ণ হউক।

জলদগম্ভীর স্বরে উচণ্ড প্রতিধ্বনি করিলেন, বুদ্ধের ইচ্ছা পূর্ণ হউক।

অতঃপর বিধিমত প্রশ্নোত্তরদানপূর্বক ভিক্ষাপাত্র ও ত্রি-চীবর ধারণ করিয়া কেশ মুণ্ডিত করিয়া নির্বাণ ভিক্ষুধর্ম গ্রহণ করিল। সংসারে আর তাহার অধিকার রহিল না।

ভিক্ষু উচণ্ডই নির্বাণের আচার্য রহিলেন; নাম পরিবর্তন প্রয়োজন হইল না। ছায়া পরিমাপ ইত্যাদি বিধি সমাপ্ত হইবার পর উচণ্ড বিজয়োদ্ধত কণ্ঠে কহিলেন, বুদ্ধ জয়ী হইয়াছেন, মার পরাভূত হইয়াছে। ভিক্ষু, নিজ পরিবেণে গমন কর। অদ্য হইতে নারীর মুখদর্শন তোমার নিষিদ্ধ।

নতনেত্রে নির্বাণ নিজ পরিবেণে প্রবেশ করিল।

স্থবির নিজ মনে বলিতে লাগিলেন, হে শাক্য, হে লোকজ্যেষ্ঠ, আমাদের ভ্রান্তি অপনোেদন কর, অজ্ঞানমসী দূর কর, সম্যক দৃষ্টি দান কর—

তিন দিন নির্বাণ নিজ পরিবেণ হইতে বাহির হইল না। আর ইতি! দেহবিচ্ছিন্ন ছায়ার মতো সে সঙ্ঘভূমির উপর দিবারাত্র বিচরণ করিয়া বেড়াইতে লাগিল।

সঙ্ঘের প্রত্যেক অধিবাসীর পরিবেণ স্বতন্ত্র। সঙ্ঘারামের উপরিতলে যে-কয়টি প্রকোষ্ঠ ছিল তাহার একটিতে ইতি রাত্রিযাপন করিত; অলিন্দের অন্য প্রান্তে তিনটি বিভিন্ন কক্ষে নির্বাণ উচণ্ড ও স্থবির বাস করিতেন। স্থবিরের অনুমতি ব্যতীত একের প্রকোষ্ঠে অন্যের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।

নির্বাণের সহিত ইতির আর সাক্ষাৎ হয় না। ইতি সঙ্ঘের কাজ করে, আর নানা অছিলায় নির্বাণের পরিবেণের সম্মুখ দিয়া যাতায়াত করে। কখনও দেখে, নির্বাণ পুঁথি লইয়া নিমগ্নচিত্তে অধ্যয়ন করিতেছে; কখনও বা দেখিতে পায়, উচণ্ড তাহাকে উপদেশ দিতেছেন। কদাচিৎ নির্বাণ গবাক্ষের বাহিরে দৃষ্টি প্রসারিত করিয়া চিন্তায় নিমজ্জিত হইয়া থাকে। ইতির পদশব্দে তাহার চেতনা হয় না। ইতি নিশ্বাস ফেলিয়া সরিয়া যায়।

ভিক্ষু উচণ্ডের মন কিন্তু শান্ত হইতেছে না; কোথাও যেন একটা মস্ত ভ্রান্তি রহিয়া গিয়াছে। নির্বাণ যতই কঠোরভাবে নিজেকে নিগৃহীত করিয়া সঙ্ঘ-ধর্মে আত্মনিয়োগ করিতেছে, তাঁহার অন্তরে সংশয় ও দ্বন্দ্ব ততই মাথা তুলিতেছে। নির্বাণকে সঙ্ঘের শাসনে আবদ্ধ করিয়াও তাঁহার অভীষ্ট সিদ্ধ হইল না—ইতি ও নির্বাণের মধ্যস্থিত আকর্ষণ-রজু দূরত্বের ফলে দৃঢ়তর হইল মাত্র। কুশাগ্রবৎ সূক্ষ্ম ঈর্ষা ক্রমশ কণ্টক হইয়া উচণ্ডকে ক্ষতবিক্ষত করিয়া তুলিল। আপন অজ্ঞাতে নির্বাণকে তিনি নিবিড়ভাবে ঘৃণা করিতে আরম্ভ করিলেন।

একদিন মধ্যরাত্রে চন্দ্রের আলোক গবাক্ষপথে নির্বাণের পরিবেণে প্রবেশ করিয়াছিল; অন্ধকার কক্ষে শুভ্র সূক্ষ্ম চীনাংশুকের মতো এক খণ্ড জ্যোৎস্না যেন আকাশ হইতে স্খলিত হইয়া পড়িয়াছিল। নির্বাণের চোখে নিদ্রা নাই, সে ঐ গবাক্ষর দিকে চাহিয়া ভূ-শয্যায় শয়ান ছিল।

নিস্তব্ধ রাত্রি; সঙেঘর কোথাও একটি শব্দ নাই। নির্বাণ নিঃশব্দে শয্যা ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল; তারপর ছায়ামূর্তির মতো অলিন্দ উত্তীর্ণ হইয়া সঙ্ঘের বাহিরে উপস্থিত হইল।

খর্জুরকুঞ্জতলে জ্যোৎস্না-তরলিত স্বল্পান্ধকার যেন ইন্দ্রজাল রচনা করিয়া রাখিয়াছে। ঊর্ধ্বে খর্জুরশাখা ক্বচিৎ তন্দ্রালস মর্মরধ্বনি করিতেছে, নিম্নে প্রস্রবণের উৎসমুখে উদ্গত জলের মৃদু কলশব্দ। চারি দিকে অপার মরুভূমির উপর চন্দ্ররশ্মির শীতল প্রলেপ। নির্বাণের বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া একটি দীর্ঘশ্বাস পড়িল। এই দৃশ্য তাহার চিরপরিচিত; কিন্তু আজ আর ইহার সহিত তাহার কোনও সম্বন্ধ নাই—সে বহু দূরে চলিয়া গিয়াছে।

নির্বাণ!

প্রস্রবণের কলধ্বনির মতোই মৃদু কণ্ঠস্বর। চমকিয়া নির্বাণ ফিরিয়া চাহিল। শুভ্র বালুকার উপর বায়ুতাড়িত কাশপুষ্পের ন্যায় ইতি তাহার পানে ছুটিয়া আসিতেছে! তাহার চরণ যেন মৃত্তিকা স্পর্শ করিতেছে না; চন্দ্রকরকুহেলির ভিতর দিয়া স্মিতক্ষুধিত মুখখানি অস্পষ্ট দেখা যাইতেছে।

না—না–না দুই হস্তে চক্ষু আবৃত করিয়া নির্বাণ পলায়ন করিল। ঊর্ধ্বশ্বাসে নিজ পরিবেণে প্রবেশ করিয়া অধোমুখে ভূতলে পড়িয়া ঘন ঘন নিশ্বাস ত্যাগ করিতে লাগিল।

ফিরিবার সময় নির্বাণের পদপাত সম্পূর্ণ নিঃশব্দ হয় নাই; অন্য পরিবেণে আর একজনের নিদ্রাভঙ্গ হইয়াছিল।

পরদিন মধ্যরাত্রে আবার চন্দ্ররশ্মি নির্বাণের গবাক্ষ-পথে প্রবেশ করিয়া দুর্নিবার শক্তিতে বাহিরের পানে টানিতে লাগিল। নির্বাণ অনেকক্ষণ নিজের সহিত যুদ্ধ করিল—কিন্তু পারিল না। মোহগ্রস্তের মতো খর্জুরছায়াতলে গিয়া দাঁড়াইল!

নির্বাণ!

ইতি তাহার পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। কিন্তু আজ আর নির্বাণ পলাইল না; সমস্ত দেহের স্নায়ুপেশী কঠিন করিয়া অন্য দিকে মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

নির্বাণ, আর তুমি আমার সহিত কথা কহিবে না?

নির্বাণ উত্তর দিল না; কে যেন তাহার কণ্ঠ দৃঢ়মুষ্টিতে চাপিয়া ধরিয়াছে।

ইতি সশঙ্ক লঘু হস্তে তাহার বাহু স্পর্শ করিল।

নির্বাণ, আর তুমি আমার মুখ দেখিবে না?

ইতির কণ্ঠস্বরে শক্তি নাই—ভাঙা ভাঙা অধোচ্চারিত উক্তি। নির্বাণের স্নায়ু কঠিন দেহ অল্প অল্প কাঁপিতে লাগিল।

নির্বাণ, একবার আমার পানে চাও–ইতি চিবুক ধরিয়া নির্বাণের মুখ ফিরাইবার চেষ্টা করিল।

স্নায়ুপেশীর নিরুদ্ধ বন্ধন সহসা যেন ছিড়িয়া গেল; জ্যা-মুক্ত ধনুর ন্যায় নির্বাণের উৎক্ষিপ্ত একটা বাহু ইতির মুখে গিয়া লাগিল। ইতি অস্ফুট একটা কাতরোক্তি করিয়া অধরের উপর হাত রাখিয়া বসিয়া পড়িল।

নির্বাণ ব্যাকুল চক্ষে একবার তাহার পানে চাহিল। তারপর—না না—আমি ভিক্ষু—আমি ভিক্ষু—আমি ভিক্ষু–

অন্ধের মতো, উন্মাদের মতো নির্বাণ সে স্থান ছাড়িয়া চলিয়া গেল।

একজন অলক্ষিতে থাকিয়া এই দৃশ্য দেখিলেন। কিন্তু তাঁহার অশান্ত চিত্ত আশ্বস্ত না হইয়া আরও দুবার ক্রোধে আলোড়িত হইয়া উঠিল। মার পরাভূত হয় নাই। সঙ্ঘ অশুচি হইয়াছে। এ-পাপ দূর করিতে হইবে—নচেৎ বুদ্ধের ক্রোধানলে সঙ্ঘ ভস্মীভূত হইবে।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress