মধুপুরের রানী লবঙ্গ লতা
দূরের সানাইয়ের সুরে মুশরে পড়ছেন মধুপুর রাজা মলয় বাহন । কিন্তু আসল কথাটা রাজকুমারী লবঙ্গ লতাকে না বললে শান্তি নেই রাজা মলয় বাহনের । আর কয়েকদিন পর মধুপুর রাজ বাড়িতে সানা বাজবে । নিমন্ত্রিত দের আসা যাওয়া শুরু হবে । রাজ কুমারী লবঙ্গ লতাকে এখনও রাজা বলতে পারেন নি । কি করে বলবেন যে ,মা রে তোর বিয়ে একটা বুড়ো রাজার সঙ্গে হবে । দেখতে দেখতে বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে । রাজা মলয় বাহন ও চিন্তায় ভেঙে পড়ছেন। মনেও সুখ নেই রাজার মলয় বাহনের । কি ভাবে সুখ থাকবে ! শত্রু রাজ্যের রাজার সাথে লবঙ্গ লতার বিয়ে ! এই বিয়েতে মলয় বাহনের মত ছিল না । কিন্তু তিনি নিরুপায় । এই বৃদ্ধ বয়সে আর যুদ্ধ ভাল লাগে না মলয় বাহনের । তাই অবোধ রাজ দশরথের সাথে সন্ধি করতে চেয়েছেন। শক্তিশালি অবোধ রাজ সঙ্গে পেরে উঠবেন না বলেই সন্ধি করতে চান । কথাটা লুফে নিলেন অবোধ রাজ বললেন। – আরে , এতো খুব ভাল কথা । দুই রাজ্যের সন্ধি হোক বিবাহের মাধ্যমে । আমার ও তাই ইচ্ছা । – বললেন মলয় বাহন।
মলয় বাহন ভেবেছিলেন রাজা দশরথের পুত্রের সাথে লবঙ্গ লতার বিবাহ হলে মন্দ হবে না । অবোধ রাজপুত্র নব কুমার, লবঙ্গ লতার সুযোগ্য না হলেও অযোগ্য হবে না । রাজ কুমারী লবঙ্গ লতা কি যেমন তেমন সুন্দরী ! তার গুনের কদর সর্বজন বিদিত । সুর সম্রাজ্ঞী বললে ভুল বলা হবে না । খাস তানসেনের কাছে তালিম নিয়েছে কোকিল কন্ঠী লবঙ্গ লতা । রান্নায় দ্রৌপদী কেও হার মানায় লবঙ্গ লতা ।
পরে মলয় বাহন বুঝলেন যে ,রাজা দশরথ ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবেন নি । ছল করে মলয় বাহনের শপথ বাক্য নিয়েছিলেন ।
লবঙ্গ লতা কে এক বৃদ্ধ রাজা দশরথের হাতে তুলে দিতে হচ্ছে ,তা কি কম দুঃখের মলয় বাহনের ! অশক্ত পিতা বলেই তো এমন হচ্ছে ! কিন্তু এছাড়া আর পথ নেই মলয় বাহনের । দেশ বাঁচাবেন , না মেয়েকে বাঁচাবেন ? অবোধ রাজ দশরথ ছলনার আশ্রয় নিয়েছেন । শর্ত করিয়ে নিয়েছেন রাজা মলয় বাহন কে দিয়ে । মলয় বাহনের বুকে বাণ বিঁধল। যখন তিনি জানলেন যে বিয়েটা রাজ পুত্রের সাথে হবে না বিয়েটা হবে বৃদ্ধ রাজার সাথে । নিজেই বিয়ে করতে চান কন্যা সম লবঙ্গ কে। মর্মাহত মলয় বাহন রাজ কন্যা লবঙ্গ কে বললেন । -শর্ত ভঙ্গ হলে যুদ্ধ হবেই । তাই বিয়েতে রাজি হলাম। মা, লবঙ্গ, তোর বুড় বাবাকে ক্ষমা কর । লবঙ্গ- এ কথা কেন বলছো বাবা ? তুমি কি আমার খারাপ চাইবে বাবা ? মলয় বাহন কেঁদে ফেললেন । ভাগ্যের হাতে তিনি একটা পুতুল মাত্র । সত্যি কথাটা না বললে নরকেও ঠাঁই হবে না । মেয়েকে বললেন- লবঙ্গ, অবোধ রাজ দশরথ তোকে বিয়ে করতে চাইছেন । তাঁর পুত্রের কথা ভেবেই আমি রাজি হয়েছিলাম । তাই রাজা দশরথের হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলিয়েছিলাম । এখন আমি কি করি ! আলীম গড়ের নবাবের প্রস্তাবে অমত করে ঠিক করিনি । লবঙ্গ- নবাব কে তুমি মুসলিম বলেই বাতিল করেছ। মলয় বাহন- হ্যাঁ । কিন্তু এখন বুঝলাম যে ধর্মের থেকেও মানুষ বড় । দশরথ রাজ তো হিঁদু । হলে কি হবে আমার সঙ্গে এমন ছল করলেন ! মানুষের ভাল মন্দ তার ব্যবহারে । লবঙ্গ- চিন্তা কর না বাবা , সব ঠিক হয়ে যাবে । মলয় বাহন- ওরে, বুড়ো রাজাকে যদি তোর বিয়ে করতে হয়, তবে আমি আত্মঘাতী হব । লবঙ্গ- বাবা, তুমি যা চাওনা তা হবে না ।
মলয় বাহন- কিন্তু, এখন পিছিয়ে আসলে তো যুদ্ধ বেঁধে যাবে ! অন্য কোন রাজাও তোকে বিয়ে করতে চাইবেন না ঐ দশরথের ভয়ে ।
লবঙ্গ লতার বিবাহের দিন এগিয়ে আসছে । লবঙ্গের সখী ই তার পরামর্শ দাতা । সব শলা পরামর্শ সখীর সাথেই হয় । লবঙ্গ বলল- সখী, একটা উপায় তো বার করতে হয় । বিয়ের দিন তো এগিয়ে আসছে । কিছু একটা কর । সখী বলে- উপায় তো তুমি করবে । আমি শুধুই হুকুম তামিল করব । তোমার গুরুদেব কে খবর দেব ? লবঙ্গ- ঠিক বলেছিস তো ,কাগজ কলম আন। একটা চিঠি লিখছি। চিঠি নিয়ে চলে যা ।
মিয়াঁ তানসেন লবঙ্গ লতার সুরের গুরু । লবঙ্গ লতার চিঠি পেয়ে চলে এলেন মধুপুর রাজ বাড়িতে । সুরের আসর বসল । তার ই এক ফাঁকে লবঙ্গ লতা গুরুকে তার বিপদের কথা বলল । —গুরুদেব আপনি আপনার মঞ্জিলে আমাকে ডাকুন । আপনি না ডাকলে আমি তো যেতে পারি না । আমার বাবার কাছে নিমন্ত্রণের আর্জি পেশ করুন । নবাব কে ও নিমন্ত্রণ জানান । সামনের অমাবস্যা তে ই আমি যেতে চাই ।
মিয়াঁ তানসেন বললেন, – তাই হবে বিটিয়া রাণী ।
মলয় বাহনের কাছে লবঙ্গ লতার নিমন্ত্রণ জানিয়ে এলেন মিঁয়া তানসেন । বললেন- কোন চিন্তা করবেন না মহারাজ। মঞ্জিলের আসরে বিটিয়াকে আমাদের চাই । নবাব সাহেব কে ও নিমন্ত্রণ জানাবো । আমার গাড়ি এসে বিটিয়া কে নিয়ে যাবে ।
তানসেন এর নিমন্ত্রণ এ খুশি হলেন রাজা মলয় বাহন। কারণ নবাব সাহেব আসছেন ঐ আসরে । ভাবলেন ভালই হল বিয়ের আগে মেয়েটা একটু আনন্দ করুক।
রাজ কুমারী লবঙ্গ লতা সখীকে সাথে নিয়ে বসে আছে । সখীর মন ভাল নেই আজ । সখী লবঙ্গ লতার বিবাহের কথা শুনে ই মন ভারাক্রান্ত । অমন একটা মেয়ের বিয়ে কি না তার বাবার বয়সী রাজার সঙ্গে । কি করে মেনে নেবে । নাঃ। অসম্ভব । এর একটা বিহিত করতেই হবে । তাই রাজ কুমারীকে সখী বলল । -কি গো সখী, কি ঠিক করলে ? এই বিয়ে কি তুমি মেনে নেবে ?
লবঙ্গ লতা হাসতে হাসতেই বলল,- কি করি বল ? যাক গে একটা কথার উত্তর দে তো সখী । সখী- কি কথা তা বলবে তো ? লবঙ্গ লতা- এই যে মানুষ বলে, জাত গেল, ধর্ম গেল। এই বলে হৈ চৈ করে । এটা কি তুই মানিস? সখী- তোমার কাছে আসার আগে আমিও ঐ রকম ভাবতাম । এখন ভাবি বেজাত, বিধর্ম আমাদের ই বানান কথা । দেখ সখী ,ওদের শরীরে ও তো আমাদের মতই রক্ত বইছে । লবঙ্গ লতা বলল- তবে তুমিই বল সখী এত ভেদাভেদ কারা করে? আমাদের সমাজের লোকেরাই তো করে ? নিজেদের দল ভারি করতেই “জাতের নামে বজ্জাতি” করে । সখী আবার বলল- সখী লবঙ্গ লতা , তুমি গুরুজীর কাছে যেচে নিমন্ত্রণ নিলে কেন ? এর কি কোন কারণ আছে ? লবঙ্গ লতা- হ্যাঁ রে সখী । কারণ নিশ্চয়ই আছে । অবোধ রাজ দশরথ আমায় বিয়ে করলে আমার বাবা আত্মঘাতী হবেন । সখী বলল- কি করবে তাহলে ? লবঙ্গ লতা- তাই গুরুজীর সাহায্যে নবাব কাশেম আলীর সাথে কথা বলব । বলব যে , রাজা দশরথ ছল করে বাবাকে রাজি করিয়েছেন । তবে গানের আসরের পরে সে কথা বলব । নবাব ই পারবে রাজা দশরথ কে শাস্তি দিতে । সখী বলল- সখী লবঙ্গ, নবাব কাশেম আলী নাকি তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন ? মুসলিম বলেই কি রাজা মশায় নাকি রাজি হননি এই বিয়ে তে ? লবঙ্গ- হ্যাঁ। সখী বলল- সখী লবঙ্গ, তুমি তাঁকে বিয়ে করতে রাজি আছ সে কথাই কি বলবে ? মানে, তোমার তাঁর সাথে বিয়ে তে অমত নেই ,তা বলবে কি? লবঙ্গ লতা- ছিঃ ছিঃ। এমন কথা আমি মুখে ও আনতে পারব না । তবে হ্যাঁ তিনি যদি বলেন আমাকে বিয়ে করতে চান তবে আমি অমত করব না ।
আলীম গড়ের নবাব কাশেম আলী , মসনদ এ বসে আছেন । সভাসদ ও গুনী জন তার সভা অলঙ্কৃত করে আছেন । দেশ দেশান্তর থেকে গুনীজনেরা তাঁর সভায় আসেন । তিনি গুনীর সমাদর করেন বলেই কবি, সঙ্গীতজ্ঞ এসে ভীড় করেন। মুঠো মুঠো সোনা দানা ও কড়িতে ভরে দেন থলে । এত লোক সভায় আসেন কিন্তু নবাব কাশেম আলি যাকে ভক্তি করেন , তিনি অর্থাত মিঁয়া তানসেন আজও আসেন নি । অবশ্য সময়াভাবে তিনি পৌঁছাতে পারেন নি । এমন একজন বলেই মিঁয়া তানসেন তাঁর সভায় না আসায় কষ্ট হলেও বিরক্ত হন নি । বরং তানসেন এর অপেক্ষায় থেকেছেন ।
শৌর্যে বীর্যে নবাব কাশেম আলীর সমকক্ষ কেউ নেই । আজ ও তেমনি ,সভার মসনদে বসেই দেখলেন, মিয়া তানসেন তাঁর দরবারে বসে আছেন। নবাব কাশেম আলী তাঁর মসনদ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন । ছুটে গেলেন মিঁয়া তানসেন এর কাছে । তানসেন ও উঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে গেলেন নবাবের দিকে । নবাব কাশেম আলী বলেন, — বন্দেগী, মিঁয়া সাহেব । আপনি আমার সভায় এসে সভা অলঙ্কৃত করেছেন। আমি ধন্য হলাম ।
মিঁয়া তানসেন লজ্জা পেয়ে বলেন- নবাব সাহেব আর আমাকে লজ্জা দেবেন না । আসব আসব ভেবে ও আগে আসা হয়নি । তবে একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি । আমার মঞ্জিলে গুনী গায়কদের মজলিশ হবে । মধুপুরের রাজ কুমারী লবঙ্গ লতা ও সঙ্গীত পরিবেশন করবেন । আপনি সঙ্গীত রসিক তাই যদি সেদিন যদি আপনার পায়ের ধুলো আমার কুটিরে পড়ে তবে ধন্য হব । আগামী অমাবস্যায়। নবাব খুশি হয়ে দাঁড়িতে হাত বোলালেন । নবাবের সুন্দর চেহারা খুশিতে ঝলমল করে উঠল । খুশি হয়ে নবাব বললেন ,- অবশ্যই যাব । আগামী অমাবস্যায় !
মধুপুরের রাজকুমারী লবঙ্গ লতা কে নবাব কাশেম আলী বিয়ে করতে চেয়েছিলেন । পত্র পাঠিয়েছিলেন মধুপুরের রাজা মলয় বাহন কে। রাজা মলয় বাহন কোন উত্তর দেন নি । এই রকম ই এক মজলিশে নবাব লবঙ্গ লতাকে দেখেছিলেন । যেমন তার রুপ মাধুরী। তেমন ই তার গলার গমক । এখন ও সেই গান কানে লেগে আছে। ভাল লেগেছিল লবঙ্গ লতাকে। রাজা মলয় বাহন কে , তিনি উচিত শিক্ষা দিতেই পারতেন। রাজ কুমারী লবঙ্গ লতা কে তিনি জোর করেই বিয়ে করতে পারতেন ।কিন্তু নবাব কাশেম আলী তা করেন নি । যাক এবার তিনি রাজ কুমারীর মত আদায় করে নেবেন ।
ওদিকে অবোধ রাজ্যে সানাইয়ের সুরে ভরপুর রাজ্য। এ কি যে সে কথা! অবোধ রাজ পঞ্চম বার বিবাহ করতে চলেছেন। তাই দিনে রাতে এই সানাইয়ের সুর রাজ্যে । রাজ্যে ঢিঢি পড়ে গেছে যে মহারাজা আবার বিয়ে করতে চলেছেন । পাত্রী হল কন্যা সম মধুপুরের রাজ কন্যা লবঙ্গ লতা ।
অবোধ রাজ দশরথের সাথে পুত্র নবকুমারের বিবাদ হয়ে গেল । অবোধ রাজ দশরথ পুত্র নবকুমারকে বললেন- চোপ্ রও নবকুমার । আর একটা ও কথা বললে আমি তোমাকে ত্যজ্য পুত্র করব । ত্যজ্য পুত্র হবার ভয় নবকুমারের নেই । কিন্তু চুপ করে গেলেন রাজ কুমার নবকুমার । ভাবলেন এই বিবাহ বন্ধ করা জরুরি। বিবাদ করলে উল্টো ফল হবে ।
গর্দান যাবার ভয়ে স্ত্রী রাও মুখ খোলেনি । রাজা দশরথের, বড় রানী বাদে তিন রানী ঢুকছেন গোঁসা ঘরে। বড় রানীর গোঁসা ঘরে ঢোকার সময় নেই । তাহলে বিয়েটা কে বন্ধ করবে ? রাজাকে বড় রাণী বললেন ,মধুপুরের রাজার সাথে সন্ধি করতে চাও ? তবে নবকুমারের সাথে লবঙ্গ লতার বিবাহ দাও । খেপে উঠলেন রাজা । বললেন- কথার খেলাপ করতে পারিনা ।
রানী মহলে চলে এলেন বড় রানী । ভাবলেন ,কি করা যায় ! তবে কি রাজ কুমারী কে চুরি করে আনবেন? নবকুমারের সাথে তার বিবাহ দেবেন কি ! তখন রাজার বিবাহ কার সাথে হবে !
মধুপুরের চাঁদ ডুবে গেছে । ঘোর আঁধার চারদিকে। কোচওয়ান গাড়ি নিয়ে এল । খবর গেল অন্দর মহলে । মিঁয়া তানসেন গাড়ি পাঠিয়েছেন রাজকুমারী কে নিয়ে যেতে । রেশমী শাড়ি পরনে লবঙ্গ লতার । কানে , গলায়, হাতে, নাকের গহনায় হীরের ঝলক। লবঙ্গ লতার পাশে সখী দাঁড়ান। সখী বলল- সখী লবঙ্গ, তোমায় দারুণ দেখাচ্ছে । লবঙ্গ লতা- সখী, তোকে যা যা বলেছি মনে রাখিস। বাবা কে দেখিস ।
মধুপুরের রাতের রূপ এই প্রথম দেখল লবঙ্গ লতা । শুধুই ঘোড়ার খুড়ের খটাখট খটাখট খটাখট শব্দ । মনে হচ্ছে সৈন্য রা ঘোড়ায় চেপে যুদ্ধ জয়ে চলেছে । লবঙ্গ লতা মেয়ে বলে কি যুদ্ধ জয় করতে পারে না? অবশ্যই পারে । তবে সে যুদ্ধ অসি যুদ্ধ নয় । কৌশল করেই যুদ্ধ জয় করবে লবঙ্গ লতা । লবঙ্গ লতার পিতা অশক্ত হতে পারেন । তাই বলে রাজ কুমারী অশক্ত নয় । তাঁর বুদ্ধির ধার আছে । কে বলে নারী অবলা ! গর্জন টুকু ছাড়া নারীর সব আছে। ঝাঁসির রানী লক্ষী বাই কে লোকে কেন মনে রেখেছে? মা বেঁচে থাকলে আজ নিশ্চয়ই আশীর্বাদ করতেন লবঙ্গ লতা কে। বের হবার আগেই বাবা কে একখানা চিঠি লিখে এসেছে । মিঁয়া তানসেন কে ও সবিস্তারে চিঠি লিখেছে লবঙ্গ লতা । ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়াতেই মিঁয়া তানসেন এগিয়ে এলেন। সাদরে আসরে নিয়ে গিয়ে বসালেন লবঙ্গ লতা কে। প্রথমে আলাপ করালেন নবাব কাশেম আলীর সাথে । তানসেন বললেন—-বিটিয়া রাণী, এই যে নবাব সাহাব , কাশেম আলী । এরপর লবঙ্গ লতার পরিচয় দিলেন নবাব কাশেম আলী কে।—বন্দেগী-নবাব সাহাব এই হল মধুপুরের রাজ কুমারী লবঙ্গ লতা ।
এরপর একে সবার সাথেই পরিচয় করালেন লবঙ্গ লতার সাথে । সকলের মুগ্ধ দৃষ্টি । নবাবের মুগ্ধ দৃষ্টি টা যেন আশীর্বাদ বলেই মনে হল লবঙ্গ লতার । লবঙ্গ লতা ভেবেছিল নবাব মানেই বেশ গুরু গম্ভীর হবে । এই নবাব তো লবঙ্গ লতার থেকে বড়জোর পাঁচ ছয় বছরের বড় হবে । এঁকেই মধুপুরের রাজা মলয় বাহন মুসলমান বলে বাতিল করেছিলেন? লবঙ্গ লতার মনে হল বাবা বলেছিলেন “ভুল করেছি আমি” । শুধরে নেবে লবঙ্গ লতা ।
অবোধ রাজ দশরথ ছলনার আশ্রয় নিয়েছেন। বাবার অসহায়তার সুযোগ নিয়েছেন। সে শাস্তি তাঁকে পেতে ই হবে । লবঙ্গ লতা হাতিয়ার করবে নবাব কাশেম আলী কে।
লবঙ্গ লতা তানপুরার ছড়া টানতেই আসরের গুন গুনানি থেমে গেল । আশাবরী রাগ টাই ধরে ফেলল। বারো ঘন্টা আগের রাগ টা কি করে যে এসে গেল নিজেও ভাবতে পারে না লবঙ্গ লতা । হয়তো রাত বারোটা কে দিন বারো টা মনে হচ্ছে । পকড় দিয়েই শুরু করল লবঙ্গ লতা । তানপুরার ছড়ার সাথে গলায় সুর- রে মা পা নি ধা পা । সুরের গমক এ গম গম করতে লাগল সুরের আসর। বিস্তার সুরু হতেই ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল আসরে । মঞ্জিলের আঁকে বাঁকে । মীড় দিয়ে সুর জুড়তে লাগল । কোথায় গেল অমাবস্যা ! মনে হল রোদ্দুরে ঘর ভেসে যাচ্ছে । এবার শুরু হল দ্রুত লয় । ” আঁখিয়া লাগি রহত নিশ দিন ” । সাবাশ সাবাশ রব উঠল। সুরে ডুবে আছেন নবাব সাহেব । সকলে চলে গেলে ও তিনি বসেই আছেন । মিঁয়া তানসেন ভেতরে চলে গেলেন। বুঝি রাজ কুমারী কে কথা বলার সুযোগ করে দিলেন । লবঙ্গ লতার চোখ মুখ ধাঁরাল হয়ে উঠল । নবাব কে লবঙ্গ লতা বলল- নবাব সাহেব, গুস্তাফি মাফ্ । আমার একটা আর্জি আছে । নালিশ আছে। নবাব বললেন- তোমার নালিশ জানার আগে তোমাকে একটা অনুরোধ করব । রাখবে সেই অনুরোধ? লবঙ্গ লতা- আজ্ঞা করুন নবাব সাহেব । আপনি যা আজ্ঞা করবেন তা আমি মাথা পেতে নিলাম । আপনি যা চাইবেন তাই হবে । কথা দিলাম । নবাব কাশেম আলী বলেন- আগে শুনে নাও । আমি তোমায় বিবাহ করতে চাই । তুমি রাজী তো লবঙ্গ লতা? মাথা নেড়ে সায় দিয়েছে লবঙ্গ লতা । অর্থাত রাজী । নবাব খুশি হয়ে বলেন- এবার বল, কি বলতে চাও।
লবঙ্গ লতা দৃপ্ত কন্ঠে বলল- নবাব সাহেব, অবোধ রাজ দশরথ আমার বৃদ্ধ পিতা কে ছলনা করে আমাকে বিবাহ করতে চান । আমার পিতা ভেবেছিলেন অবোধ রাজ পুত্রের সাথেই আমার বিবাহ হবে । তাই আমার পিতা কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে তিনি বুঝতে পারেন যে অবোধ রাজ নিজে বিবাহ করতে চান । নবাব কাশেম আলী চিৎকার করে বলেন।- কি এতবড় সাহস! আমি ওর গর্দান নেব । লবঙ্গ বলল- না জাঁহাপনা , গর্দান নিলে শাস্তি হবে না । বরং ওর চার রানী বিধবা হয়ে যাবেন । আপনি ওর রাজ্য দখল করে ওকে শক্তি হীন করে দিন । নবাব কাশেম আলী বলেন- খাঁসা বুদ্ধি তো তোমার! তাই হবে । রাজকুমারী বিদায়ের আজ্ঞা নিলেন নবাবের কাছে। তারপর বলল- জাঁহাপনা, আসছে গুরু পুর্নিমায় আপনাকে পতি রুপে বরণ করব । মধুপুরে আপনার অপেক্ষায় থাকব । পরদিন সকালে দুই সখীর হাসাহাসি ঢলাঢলি। সাঁঝের বেলা মধুপুরে আলোর বন্যা বয়ে যাচ্ছে । মেয়ের হাসি দেখেই বুঝেছেন চারদিকে খুশির হাওয়া বইছে। মলয় বাহন মেয়ে কে বললেন–কি ব্যাপার লবঙ্গ মা, বুড়ো বাবা কে বলবি না ? আজ এত খুশির হাওয়া বইছে কেন? লবঙ্গ লতা বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল- তোমার কোন চিন্তা নেই বাবা । নবাব কাশেম আলী অবোধ রাজ্য দখল করবেন ।ওর বিষ দাঁত ভাঙ্গাবেন। রাজা আবার বললেন- লবঙ্গ, নবাব কি তোকে বিবাহ করার কথা বলেছেন? লবঙ্গ লতা কথাটা ঘুরিয়ে দিল । বলল- বাবা, নবাব মুসলমান বলে তো তুমি তাকে বাতিল করেছ । রাজা মলয় বাহন বললেন- ভুল করেছি রে মা । ধর্ম ধর্ম করে লাভ নেই রে মা । মনুষ্য ধর্ম ই বড় ধর্ম । আর বড় পরিচয় হল তাঁর স্বভাব । রাজা চলে যেতেই সখী বলল- রাজা মশায় কে সত্যি কথাটা বললে না ? লবঙ্গ লতা- বাবা কে আশা দিতে ভয় হয় । যদি আশা না মেটে । তবে বাবা খুব কষ্ট পাবে । বুঝলি কিছু ? সখী লবঙ্গ লতা কে জড়িয়ে ধরল । তার পর বলল।- সখী লবঙ্গ তোমার তো বর জুটল । তা তোমার এই সখীর কি বর জোটাবে না ? হাসতে হাসতেই বলল লবঙ্গ লতা- বর আছে রে । রানী হবি লো সখী ! ঐ দশরথের পঞ্চম রাণী । সখী বলল- ম্যাঁ গো ! মরে যাই ! শেষ অবধি একটা বুড়ো বর?তার চেয়ে ওর ছেলেটাকে দাও না ! লবঙ্গ লতা- আমি চিঠি লিখে দেব ।অবোধ রাজার বড় রানীকে দেখাবি । রাজি হবেন রাণী মা ।
সখী বলল- কি লিখবে গো সখী লবঙ্গ ।
লবঙ্গ লতা বলল- শর্ত থাকবে তোর সাথে , রাজকুমার নবকুমারের বিবাহ দিলে তবেই রাজা দশরথ কে আমি বিয়ে করবো না । লবঙ্গ লতা- শর্ত থাকবে তোর সাথে রাজ কুমার নবকুমারের বিবাহ দিলে তবেই রাজা দশরথ কে আমি বিয়ে করবো না । সখী, লবঙ্গ লতা কে জড়িয়ে ধরে বলল- এই না হলে কিসের রাজ কন্যা ! খাঁসা বুদ্ধি তোমার । রাজ্য চালাতে পারবে ।
রাতের আঁধারে সখী চলল অবোধ রাজ্যে । দূর থেকেই রাজ প্রাসাদ দেখা যাচ্ছে । সখী পেঁয়াদা দের সেখানেই দাঁড়াতে বলল । প্রাসাদে ঢুকতেই মুখোমুখি হল রাজ কুমার নবকুমারের সাথে । রূপে একেবারে কার্তিক যেন ।
রাজকুমার বললেন- কে যায় ? সখী বলল- মধুপুরের রাজ কুমারী লবঙ্গ লতার সখী । বড় রানীমার সাথে দেখা করতে চাই । রাজ কুমার- এস, আমার সাথে ।
আগে চলেছেন রাজ কুমার। পেছনে সখী চলেছেন । বড় রানীর ঘরের কাছে দাঁড়াল রাজকুমার । বলল- ভেতরে যাও ।
পাশা দেখাতেই বাঁদীরা বড় রানী মার খাঁস কক্ষে নিয়ে গেল সখী কে । বড় রানীমা লবঙ্গ লতার চিঠি পড়লেন । বললেন- তুমি কে? তুমি তো লবঙ্গ লতার সখী ? সখীর লাজুক ভাব দেখে রানীমা আবার ও বলেন – বড় মিষ্টি তো তোমার মুখ খানা ! মাথা নিচু করে রানীমা খসখস করে চিঠি লিখে ফেলেন । একখানা গহনার বাক্স দিলেন চিঠির সাথে ।
বললেন- মধুপুরের শিব মন্দিরে তোমাদের বিবাহ হবে । গহনাগুলো পড়ে আসবে । লবঙ্গ লতাকে চিঠিটা দিও । আর আমার আশীর্বাদ জানিও ।
তীর গতিতে ছুটছে সখী । ভাবতেই পারছে না সখী লবঙ্গ ওর কথা ভেবেই চিঠি লিখেছে । রানীমার গহনা যখন দিয়েছেন তখন নিশ্চয়ই তার পুত্র বঁধূর জন্য ই দিয়েছেন ! তার মানে রাজ পুত্রের সাথেই তাঁর বিয়ে । পেয়াদা দের পেছনে ফেলেই ছুটছেন। আনন্দে চোখে জল এসে যাচ্ছে ।
সখীর বাবা মধুপুর রাজ্যের মন্ত্রী ছিলেন । অবোধ রাজ্যের সাথে যুদ্ধে প্রাণ হারান তিনি । বাবার মৃত্যুর পর সখীর মা ও মারা যান । সেই ছোট্ট থেকেই সখী রাজ বাড়িতেই মানুষ হয়েছে । কেউ কোন দিন তাকে হেলা করে নি । লবঙ্গ লতার প্রাণের বন্ধু সখী । আজকের এই আনন্দ যার কাছে ঢেলে দেওয়া যায় সে হল লবঙ্গ লতা । সখীর প্রাণ লবঙ্গ লতা ।
রাজ বাড়িতে খবর এসেছে কাশেম আলী অবোধ রাজ্য দখল করেছেন । দয়া দেখিয়ে অবোধ রাজ কে রাজ রাজপ্রাসাদে থাকতে দিয়েছেন ।
মধুপুরে সানাই বেজে চলেছে । রাজ বাড়িতে বিবাহ বাসর বসেছে ।তিনটে আলাদা আসর করা হয়েছে।বিকেল পাঁচটার লগ্নে সখীর সাথেই অবোধ রাজ পুত্রের বিবাহ হল। শিব মন্দিরেই বিবাহ সারা হল । এবার তারা প্রথম আসনের ঘেরাটোপের মাঝে বসল ।দ্বিতীয় আসনের ঘেরাটোপে বসে আছে কনে । অবগুন্ঠনে ঢাকা কনে বসে আছেন । এবার অবোধ রাজ দশরথ এসে বরের আসনে বসলেন । সাত পাকের পর মালা বদল হল । তৃতীয় আসনের কনে ও অবগুন্ঠনে ঢাকা । আকাশে চাঁদ উঠেছে ।গুরু পুর্নিমার রাত । নবাব কাশেম আলী এলেন ঘোড়ায় চেপে বরকন্দাজ নিয়ে । মধু পুরের রাজা মলয় বাহন বললেন, জাঁহাপনা আসন গ্রহন করুন ।তখনই তৃতীয় আসনের কনের ঘোমটা একটু ফাঁক হল । নবাব বললেন, মহারাজ আপনি আজ্ঞা করলে আমি লবঙ্গ লতার পানি গ্রহন করব । আমি লবঙ্গ লতা কে বিবাহ করতে চাই । মলয় বাহনের চোখে জল এসে গেল । নিজের ভুল বুঝতে পারছেন এখন। একেই তিনি এখন জামাই করতে রাজি আছেন । কিন্তু তা এখন আর সম্ভব নয়। রাজা দশরথের সাথেই তাঁর কন্যার বিবাহ হচ্ছে।
হঠাৎই তৃতীয় আসন থেকে কনে লবঙ্গ লতা মুখের ঢাকা সড়িয়ে বলল- বাবা, তোমার কন্যাকে নবাবের হাতে সম্প্রদান কর। দশরথ দ্বিতীয় আসন থেকে চিৎকার করে উঠল। আমার সাথে তবে কার বিবাহ হল? এ বিবাহ আমি মানি না । কনের আসন থেকে বড় রানী মা অর্থাত অবোধ রাজের প্রথমা স্ত্রী ঘোমটা খুললেন। তিনিই নববঁধু বেশে অবোধ রাজ দশরথের পাশে বসে ছিলেন । তিনিই বললেন- আমার সাথেই আবার বিবাহ হল । এ বিয়ে না মানলে ও প্রথম বিবাহ তো মানো ?
চিৎকার করে উঠলেন রাজা দশরথ – তুমি?
তাহলে তোমার ই শয়তানি তে-
কথাটা শেষ হল না । নবাব ধমকে উঠলেন দশরথ কে- চোপ্ রও । স্ত্রীর সাথে কি ভাবে কি ভাবে কথা বলতে হয় তা জান না ? একটা কথা বলেছ কি আমি তোমার গর্দান নেব । চুপ করে গেলেন দশরথ। নবাব বললেন- তোমার ছেলে আর তার স্ত্রী কে ঘরে নিয়ে যাও । অবোধ রাজ্য আমি রাজকুমার নবকুমারকে যৌতুক হিসাবেই দেব ।
মলয় বাহনের চোখে জলের বাণ। লবঙ্গ লতার আর সখীর খুশির বাণ ডেকেছে তবুও দুজনের চোখে জল বাধ মানছে না ।কেন না আজ থেকে তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে । নবাব কাশেম আলীর সাথে লবঙ্গ লতা চলেছেন আলীম গড়ে ।
বছর ও পার হল না । মলয় বাহন মারা গেলেন । লবঙ্গ লতার কাজ বেড়ে গেল । একদিকে স্বামীর ঘর সামলানো অন্য দিকে স্বামী কে সৎ বুদ্ধি দেওয়া। অন্য দিকে মধুপুর রাজ্যের দেখভাল করা । তাই লবঙ্গ লতা ছয় মাস থাকেন মধুপুর আর বাকি ছয় মাস আলীম গড়ে স্বামীর পাশে থেকে রাজত্ব করেন।