দু চোখে আগুন, এক অশ্বারোহী
এখানে আমাদের চার দিন কেটে গেল। সারাদিন কাকাবাবু আর আমি ঘুরে বেড়াই, ফিতে নিয়ে মাপামাপি হয়। জঙ্গলের ভেতরেও চলে যাই। কাজ অবশ্য কিছুই হচ্ছে না, তবে বেড়ানো তো হচ্ছে। কাশ্মীরে অনেকেই বেড়াতে যায়, কিন্তু কেউ তো গুজর আর খশ জাতির লোকদের সঙ্গে তাদের গ্রামে থাকেনি।
এই জায়গার লোকেরা যে কী ভাল তা কী বলব! আমাদের সঙ্গে ওরা অসম্ভব ভাল ব্যবহার করে। ওরা অনেকেই আমাদের ভাষা বোঝে না, আমিও ওদের ভাষা বুঝি না, তবু কোনও অসুবিধে হয় না। হাত পা নেড়ে বুঝিয়ে দেওয়া যায়। একদিন আমার কোটের একটা বোতাম ছিড়ে গিয়েছিল, সেটা শেলাই করার জন্য আমি সূচ-সুতো চেয়েছিলাম। কিছুতেই আর সেটা ওরা বুঝতে পারে না। একবার নিয়ে এলো একটা গামলা, একবার নিয়ে এলো বঁটি। শেষ পর্যন্ত যখন বুঝতে পারল, তখন কোটটা ছোঁ। মেরে নিয়ে গেল আমার কাছ থেকে। একটু বাদেই ওদের বাড়ি থেকে বোতাম শেলাই করে আনল।
সন্ধেবেলাই বাড়ি ফিরে দরজা-জানলা সব বন্ধ করে থাকতে হয়। শীত এখানে বডড বেশি। খুব হাওয়া, সেইজন্য। ঘরের মধ্যে আমরা আগুন জ্বেলে রাখি। খাওয়া-দাওয়া বেশ ভালই হয়। গরম গরম মোটা মোট চাপাটি আর মুরগী ঝোল। হুদা তো আছেই, তাছাড়া গ্রামের একটি মেয়েও দিনের বেলা আমাদের রান্নাটান্না করে দেয়। কাশ্মীরের লোকেরা ভাল রান্না করে, তবে নুন দেয় বড় বেশি। বলে-বলেও কমানো যায় না। এরা সবাই এত বেশি নুন খায় যে আমাদের কম নুন খাওয়ার কথা বিশ্বাসই করতে পারে না। এরা ঝােলও বেশি খায়, তবে সেটা এতদিনে আমার অভ্যোস হয়ে গেছে।
সারাদিনটা আমার বেশ ভালই কাটে। সন্ধের সময়ও মন্দ লাগে না, তখন গ্রামের দু চারজন বুড়ো লোক আসে, আগুনের ধারে বসে গল্প হয়।
কিন্তু রাত্তিরটা আমার কাটতেই চায় না। ঘুম আসে না, খুব ভয় করে। চারদিক নিঝুম। মনে হয়, নিজের বাড়ি থেকে কোথায় কতদূরে পড়ে আছি। বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল বাবা-মার কাছ থেকে কোনও চিঠি পাইনি। আমারও লেখা হয়নি। পহলগাম থেকে লিখতাম। কিন্তু এখানে ধারেকাছে পোস্টাফিস নেই। বাড়ির জন্য মাঝে মাঝে মন কেমন করে। একটু একটু, বেশি না।
আমার কুকুরটার কথাও মনে পড়ে। এতদিন পর ফিরে গেলে ও কি আমায় চিনতে পারবে? মোটে তো দু সপ্তাহ হল এসেছি, অথচ মনে হয় যেন কতদিন কলকাতাকে দেখিনি। এইটাই বেশ মজার-বেড়াতে আসতেও খুব ভাল লাগে, আবার কয়েকদিন পরই কলকাতার জন্য মন ছটফট করে। রাত্তির বেলা ঘুম আসবার আগে যতক্ষণ একলা জেগে থাকি, তখনই কষ্ট হয় বেশি।
রাত্তিরে রোজ একটা শব্দ শুনতে পাই, সেটাই সবচেয়ে বেশি জ্বালায়। কী রকম অদ্ভুত শব্দ-অনেকটা ছুটন্ত ঘোড়ার পায়ের শব্দের মতন। কিন্তু শব্দটা মিলিয়ে যায় না। মনে হয় যেন একই জায়গায় দাঁড়িয়ে একটা ঘোড়া অনবরত দৌড়বার ভান করছে। কিন্তু আমি ঘোড়াদের স্বভাব যেটুকু বুঝেছি, তারা তো ওরকম কক্ষনো করে না।
জানলা খুলেও দেখার উপায় নেই। মাঝরাত্তিরের ঠাণ্ডা হাওয়া লাগলে নিঘাত নিউমোনিয়া। তাছাড়া একলা একলা জানলা খুলতে আমার ভয় করে। এদিকে ওর মধ্যে কাকাবাবু আবার ঘুমের ঘোরে কথা বলতে শুরু করেছেন। কার সঙ্গে যেন তর্ক করছেন কাকাবাবু। উঠে গিয়ে যে কাকাবাবুর গায়ে ধাক্কা দেব তা-ও ইচ্ছে করে না। বালিশে মুখ গুজে কান বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। আমার কান্না পাচ্ছিল।
প্রথম রাত্তিরে কাকাবাবুকে আমি ডাকিনি, দ্বিতীয় রাত্তিরে আর না ডেকে পারলাম না। কাকাবাবু ধড়মড় করে উঠে বসে বললেন, কী? কী হয়েছে?
আমি বিবৰ্ণ মুখে বললাম, একটা কী রকম বিচ্ছিরি শব্দ।
কাকাবাবু কান খাড়া করে শুনলেন। তারপর বললেন, কেউ ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে। এত ভয় পাচ্ছ কেন?
আপনি শুনুন। অনেকক্ষণ ধরে, ঠিক একই জায়গায় ঐ এক রকম শব্দ।
কাকাবাবু আর একটু শুনলেন। হালকাভাবে বললেন, ঘোড়ারই তো শব্দ, আর তো কিছু না! ঘুমিয়ে পড়ো—
আমাদের জানলার খুব কাছে।
কাকাবাবুর সাহস আছে খুব। উঠে গলায় কমফটার জড়ালেন। আর একটা কমফটার দিয়ে কান ঢাকলেন-ওভারকেটের পকেট থেকে রিভলভারটা বার করলেন। তারপর দেখলেন জানলা খুলে। টর্চ জেলে তাকিয়ে রইলেন বাইরে। দু এক মিনিট দাঁড়িয়ে রইলেন সেখানে। আবার জানলা বন্ধ করে এসে বললেন, ওটা কিছু নয়। নিশ্চিন্তে ঘুমো—
কাকাবাবু জানলা খুলে টর্চটা যখন জ্বেলেছিলেন, তক্ষুনি শব্দটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। জানলা বন্ধ করতেই আবার শুরু হল।
আমার গলা শুকিয়ে গেল। ফ্যাকাসে গলায় বললাম, কাকাবাবু, আবার শব্দ হচ্ছে!
হোক না। শব্দ হলে ক্ষতি কী আছে? যা চোখে দেখা যায় না, তার থেকে ভয়ের কিছু নেই।
কিন্তু—
আরে, এরকম পাহাড়ি জায়গায় অনেক কিছু শোনা যায়। রাত্তিরে সব আওয়াজই বেশি মনে হয়-তাছাড়া পাহাড়ের নানান খাঁজে হাওয়া লেগে কতরকম শব্দ হয়, কত রকম প্রতিধ্বনি-এ নিয়ে মাথা ঘামাবার কিছু নেই। ঘুমিয়ে পড়লে আর কিছুই শোনা যায় না।
আমি বললাম, কাকাবাবু, আমার যে কিছুতেই ঘুম আসছে না।
কাকাবাবু আমার খাটের কাছে এগিয়ে এলেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে, তুই চোখ বুজে শুয়ে থোক-আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি-তাতেই ঘুম এসে যাবে।
কিন্তু একথা শুনে আমার লজ্জা করল। আমি কি ছেলেমানুষ নাকি যে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে হবে? তা ছাড়া কাকাবাবু আমার জন্য জেগে বসে থাকবেন! আমি বললাম, না, না, তার দরকার নেই। এবার আমি ঘুমোতে পারব।
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, সেই ভাল। ভয়কে প্রশ্ৰয় দিতে নেই। এ তো শুধু একটা শব্দ, এতে ভয় পাবার কী আছে?
আমি আবার কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করলাম, ঠিক মনে হচ্ছে না ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ? আমাদের জানলার খুব কাছে?
কাকাবাবু আবার রিভলভারটা হাতে নিয়ে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কৌন হ্যায়?
কোনও সাড়া নেই। তবে শব্দটা এবার আর থামল না।
কাকাবাবু বললেন, এমনও হতে পারে—শব্দটা অনেক দূরে হচ্ছে। পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে মনে হচ্ছে খুব কাছে। এত শীতে বাইরে বেরুনো উচিত নয়, না হলে বাইরে বেরিয়ে দেখা যেত। আচ্ছা দেখা যাক, কাল কিছু ব্যবস্থা করা যায় কি না।
পরদিন সন্ধেবোলা গ্রামের বৃদ্ধরা এলেন আমাদের সঙ্গে গল্প করতে। বড় বড় মাগে চা ঢেলে খাওয়া হতে লাগিল। ঘরের এক কোণে আগুন জ্বলছে, মাঝে মাঝে আমি তার মধ্যে একটা দুটো কাঠ ছুঁড়ে দিচ্ছি। কাকাবাবু এ কথা–সে কথার পর দুজন বৃদ্ধকে ঐ শব্দটার কথা জিজ্ঞেস করলেন।
একজন বৃদ্ধ শুনেই সঙ্গে সঙ্গে বললেন, বুঝেছি। বাবুসাহেব, কাল তা হলে হাকো এসেছিল।
কাকাবাবু বললেন, হাকো কে?
কোনও কোনওদিন মাঝরাত্তিরে ঘোড়া ছুটিয়ে যায়। তবে ও কারুর ক্ষতি করে না।
অত রাত্তিরে ঘোড়া ছুটিয়ে কোথায় যায়?
বৃদ্ধ দুজন চুপ করে গেলেন। কাকাবাবু হাসতে হাসতে বললেন, তাছাড়া ঘোড়া ছুটিয়ে যায় না তো কোথাও! এক জায়গায় দাঁড়িয়েই তো ঘোড়া দাবড়ায়।
ও ঐ রকমই।
কাকাবাবু আমার দিকে ফিরে ইংরেজিতে বললেন, নিশ্চয়ই এবার একটা ভূতের গল্প শোনাবে। গ্রামের লোকেরা এইসব অনেক গল্প বানায়-তারপর শুনতে শুনতে ঠিক বিশ্বাস করে ফেলে।
কাকাবাবু বৃদ্ধদের আবার জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, হাকোকে দেখতে কী রকম? কমন্বয়েসী ছোকরা, না, বয়স্ক লোক? দিনের বেলা তার দেখা পাওয়া या না?
বৃদ্ধ দুজন চুপ করে গিয়ে পরস্পরের চোখের দিকে তাকালেন। তারপর ফস করে লম্বা লম্বা বিড়ি ধরিয়ে অন্যমনস্কভাবে ধোঁয়া টানতে লাগলেন। যেন তাঁরা ও বিষয়ে আর কিছুই বলতে চান না।
কাকাবাবু তবু ছাড়বেন না। আবার জিজ্ঞেস করলেন, এই যে আপনারা হাকো না কার কথা বললেন, রাত্তির বেলা ঘোড়া ছুটিয়ে যায়-তাকে দেখতে কী রকম?
একজন বৃদ্ধ বললেন, বাবু সাহেব, ও কথা থাক। হাকো আপনার ক্ষতি করবে না, শুধু শব্দই শুনবেন। আপনার ভয়ের কিছু নেই।
কাকাবাবু হেসে উঠে বললেন, শুধু শব্দ কেন, তার চেহারা দেখলেও আমি ভয় পাব না। আমি তো তার কোনও ক্ষতি করি নি? দিনের বেলা কেউ দেখেছে?
না, দিনের বেলা কেউ তাকে দেখেনি।
আপনি তাকে কখনও দেখেছেন? রাত্তিরে?
বৃদ্ধটি চমকে উঠে বললেন, বাবুসাহেব, তাকে কেউ দেখতে চায় না। হাকো-কে দেখলে কেউ বাঁচে না। হাকো-র চোখ দিয়ে আগুন বেরোয়-তার চোখের দিকে চোখ পড়লেই মানুষ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তবে দিনের বেলা সে আসে না, ইচ্ছে করে কারুর কোনও ক্ষতি করে না–
কাকাবাবু বললেন, হুঁ! চোখ দিয়ে আগুন বেরোয়। তাকে দেখতে কি মানুষের মতন না জন্তুর মতন? কোনও গল্প-টল্প শোনেননি? চোখের দিকে না। তাকিয়ে পেছন দিক থেকে যদি কেউ দেখে?
বৃদ্ধ বললেন, আমার ঠাকুদরি মুখে শুনেছি, একবার একটি মেয়ে তার সামনে পড়ে গিয়েছিল। হাকো তখন হাত দিয়ে চোখ ঢাকা দেয়। মেয়েদের সে খুব সম্মান করে। সেই মেয়েটি দেখেছিল, হাকো খুব সুন্দর দেখতে একজন যুবাপুরুষ, তিরিশের বেশি বয়েস নয়–খুব লম্বা, মাথায় পাগড়ি, কোমরে তলোয়ার–
তা সে বেচারা রোজ রাত্তিরে এখান দিয়ে ঘোড়া ছোটায় কেন?
এ তো শুধু আজকালের কথা নয়! কত শো বছর ধরে যে হাকো এ রকমভাবে যাচ্ছে, কেউ জানে না। হাকো ছিল একজন রাজার সৈন্য-লদাকের রাস্তা দিয়ে সে রাজার খৎ নিয়ে যাচ্ছিল। এক দুশমন তাকে একটা কুয়োর মধ্যে ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলে। সেই থেকে প্ৰায় রাত্তিরে–
কাকাবাবু চুরুট টানতে টানতে হাসিমুখে গল্প শুনছিলেন। হঠাৎ সোজা হয়ে বসলেন। ব্যস্তভাবে জিজ্ঞেস করলেন, কুয়োর মধ্যে ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলে? এখানে কুয়ো কোথায়? আমাকে দেখিয়ে দিতে পারেন?
বৃদ্ধ বললেন, না, সে আমরা কখনও দেখিনি। শুনেছি। এসব ঠাকুন্দা-দিদিমার কাছে-
আর একজন বৃদ্ধ বললেন, হ্যাঁ, আমিও শুনেছি ঐ সব জঙ্গল-টঙ্গলের দিকে বড় বড় কুয়ো আছে, একেবারে পাতাল পর্যন্ত চলে যায়-
কাকাবাবু বললেন, আমাকে নিয়ে যাবেন সেখানে? অনেক বকশিস দেব।
প্রথম বৃদ্ধ বললেন, না, বাবুসাহেব, আমি কোনওদিন কুয়োটুয়োর কথা শুনিনি। এদিকে জলই পাওয়া যায় না, তা কুয়ো থাকবে কী করে? পাহাড়ের গর্ত টর্ত হয়তো আছে, তাই লোকে বলে-
আমি হাকো সম্পর্কে আরও গল্প শুনতে চাইছিলাম। কিন্তু কাকাবাবুর আর কোনও উৎসাহ নেই। ওর সম্পর্কে। কাকাবাবু উত্তেজিত হয়ে বারবার সেই কুয়োর কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। বৃদ্ধ দুজনকে জেরা করতে লাগলেন, সারা গ্রামের কেউ কোনওদিন জঙ্গলের মধ্যে সেই কুয়ো দেখেছে কি না! বৃদ্ধ দুজন আর বিশেষ কিছুই বলতে পারলেন না। বকশিসের লোভ দেখিয়েও জানা গেল না কিছুই। মনে হলো, হাকো-র সম্পর্কে ওঁদের খুবই ভয় আছেহাকোর ধারেকগছে যাবার ইচ্ছেও নেই। ওঁদের।
সেদিন রাত্তিরবেলা কাকাবাবু টর্চ আর রিভলভার হাতে নিয়ে জানলার কাছে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। সেদিন। কিন্তু কোনও শব্দই শোনা গেল না। কাকাবাবু হেসে বললেন, আজ আমাদের ভুতমশাই বোধহয় বিশ্রাম নিচ্ছেন। রোজ কি আর সারারাত ঘোড়া চালানো যায়! তাছাড়া রিভলভার থাকলে ভূতও ভয় পায়।
পরের দিনও প্রথম রাত্তিরে কিছু শোনা যায়নি। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলাম সেই রহস্যময় ঘোড়সওয়ারকে-যার দু চোখ দিয়ে আগুন বেরোয়, তার নাম হাকো-কী করে যে লোক তার নাম জানল! আমি হঠাৎ হাকোর সামনে পড়ে গেছি,–। হাকো আগুন-জ্বালা চোখে তাকিয়েছে। আমার দিকে। আমি দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে-। ভয় পেয়ে আমার ঘুম ভেঙে গেল। তখন শুনলাম বাইরে সেই শব্দ হচ্ছে। কাকাবাবুকে ডেকে তুললাম। কাকাবাবু টর্চ জ্বেলে দেখার অনেক চেষ্টা করলেন। কিছুই দেখা গেল না। আওয়াজ অনবরত চলল। যতক্ষণ জেগে রইলাম, সেই খটু খটু খটু খটু শব্দ। হাকো যদি ভূত হয়, তাহলে ঘোড়াটাও কি ভুত! ঘোড়ারা মরলে কি ভূত হয়? আমার ভীষণ খারাপ লাগতে লাগিল। মনে হল, আর একদিনও এখানে থাকা উচিত নয়। কিন্তু কাকাবাবু কিছুতেই যাবেন না। হাকোর গল্প শোনবার পরই কাকাবাবুর এই জায়গাটা সম্পর্কে আকর্ষণ আরও বেড়ে গেছে।
সকালবেলা উঠলে কিন্তু ঐ সব কথা আর তেমন মনে পড়ে না। কতরকম পাখির ডাক শোনা যায়। নরম রোদুরে ঝকমক করে জেগে ওঠে একটা সুন্দর দিন। আবু তালেব আর হুদা দুটো ঘোড়া নিয়ে এসে হাজির হয়। মুখে সরল হাসি। তখন সব কিছুই ভাল লাগে।
আজকাল আর আমি ঘোড়া চালাবার সময় ওদের কারুকে সঙ্গে নিই না। নিজেই খুব ভাল শিখে গেছি। এক এক সময় খুব জোরে ঘোড়া ছুটিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। খানিকটা নিচে নেমে গেলে বেশ ভাল রাস্ত–সেখানে আর কোনও রকম ভয় নেই।
কাকাবাবু বললেন, এদিকটা তো মোটামুটি দেখা হল। চলো, আজ বনের ভেতরটা ঘুরে আসি।
আমি উৎসাহের সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। বনের মধ্যে বেড়াতে আমার খুব পছন্দ হয়। এদিককার বনগুলো বেশ পরিষ্কার। বাউ আর চেনার গাছ-ভেতরটা অন্ধকার হলেও রাস্ত করে নেওয়া যায় সহজেই।
সেদিন বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতেই সেই সাঙঘাতিক কাণ্ডটা হল। তারপর থেকেই আমাদের সব কিছু বদলে গেল। জঙ্গলের বেশ খানিকটা ভেতরে এসে আমরা পায়ে হেঁটে ঘুরছিলাম। কাকাবাবু এখানেও ফিতে বার করে মাপতে শুরু করেছেন। এতদিনে আমার বদ্ধমূল বিশ্বাস হয়ে গিয়েছিল যে এক একজন লোকের যেমন এক এক রকম বাতিক থাকে-তেমনি এই ফিতে মাপার ব্যাপারটাও কাকাবাবুর বাতিক। নইলে, এই জঙ্গলে ফিতে দিয়ে জায়গা মাপার কোনও মানে হয়?
জঙ্গলের মাটি বেশ স্যাৎসেঁতে। কাল রাত্তিরেও বরফ পড়েছিল, এখন বরফ বিশেষ নেই, কিন্তু গাছগুলো থেকে চুইয়ে পড়ছে জল। হাঁটতে গেলে পা পিছলে যায়। ফিতেটা ধরে দৌড়চ্ছিলাম, হঠাৎ আমি একটা লতা-পাতার ঝোপের কাছে পা পিছলে পড়ে গেলাম। বেশি লাগেনি, কিন্তু উঠতে গিয়েও পারলাম না উঠতে। জায়গাটা কী রকম নরম নরম। দূর থেকে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী হল, সন্তু, লেগেছে? আমি উত্তর দিলাম, না, না, লাগেনি। কিন্তু দাঁড়াতে পারছি না কিছুতেই। পায়ের তলায় শক্ত কিছু নেই। হঠাৎ আমি বুঝতে পারলাম, আমি নীচের দিকে নেমে যাচ্ছি। জায়গাটা আসলে ফাঁপা-ওপরটা ঝোপে ঢাকা ছিল।
চেঁচিয়ে ওঠবার আগেই লতা-পাতা ছিড়ে আমি পড়ে যেতে লাগলাম নীচে। কত নীচে কে জানে।
ভয়ের চোটে নিশ্চয়ই আমি কয়েক মুহুর্তের জন্য অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। কখন নীচে গিয়ে পড়লাম টের পাইনি। চোখ খুলে প্রথমেই মনে হল, আমি কি মরে গেছি না বেঁচে আছি? আর কি কোনওদিন মাকে, বাবাকে দেখতে পাব? মরে যাবার পর কী রকম লাগে তাও তো জানি না। চারদিকে ঘুট্ফুটে অন্ধকার। একটা পচা পচা গন্ধ। হাতে চিমটি কেটে দেখলাম ব্যথা লাগিল। কিন্তু ওপর থেকে পড়ার সময় খুব বেশি লাগেনি-কারণ আমার পায়ের নীচেও বেশ ঝোপের মতন রয়েছে। আস্তে আস্তে অন্ধকারে চোখ সয়ে যাওয়ায় একটু একটু দেখতে পাচ্ছি। তাহলে নিশ্চয়ই মরিনি! আমি একটা বড় গর্ত বা লুকনো কোনও কুয়োর মধ্যে পড়ে গেছি। ভয়ের চেয়েও, বেঁচে যে গেছি—এই জন্য একটু আনন্দই হল সেই মুহূর্তে। আরও গভীর গর্ত যদি হত, কিংবা তলায় যদি শুধু পাথর থাকত-তাহলে এতক্ষণে-। আমি চেঁচিয়ে ডাকলাম, কাকাবাবু, কাকাবাবু-
কাকাবাবু অনেকটা দূরে আছেন। হয়তো শুনতে পাবেন না। নীচ থেকে কি আমার গলার আওয়াজ পৌঁছুচ্ছে? ওপর দিকটায় তাকিয়ে দেখলাম, প্রায় অন্ধকার। লতা-পাতা ছিড়ে যাওয়ায় সামান্য যা একটু ফাঁক হয়েছে, তাতেই একটু একটু আলো।
তবে একটা খুব আশার কথা, ফিতের একটা দিক আমার হাতে তখনও ধরা আছে। অন্য দিকটা কাকাবাবুর হাতে। এইটা দেখে নিশ্চয়ই খুঁজে পাবেন।
শক্ত করে ফিতেটা এক হাতে চেপে রেখে আমি আর এক হাতে চার পাশটায় কী আছে দেখার চেষ্টা করলাম। গর্তটা বেশ বড়। একটা কুয়োর মতন, কিন্তু জল নেই। এই কুয়োতেই কি হাকো-কে মেরে ফেলা হয়েছিল? এটা কি হাকো-র বাড়ি?
ভয়ে আমার সারা গা শিরশিরিয়ে উঠলো। আমি আবার চেঁচিয়ে উঠলাম, কাকাবাবু! কাকাবাবু!
চেঁচাতে চেঁচাতেই মনে হল, কাকাবাবু এসেও কি আমাকে তুলতে পারবেন। এখান থেকে? খোঁড়া পা নিয়ে কাকাবাবু একলা কী করবেন? কেন যে আবু তালেব আর হুদাকে আজ সঙ্গে আনিনি। কাকাবাবু এখান থেকে ওদের গ্রামে ফিরে গিয়ে ওদের ডেকে আনতে আনতেই যদি আমি মরে যাই? মনে হচ্ছে যেন এর মধ্যেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। পচা পচা গন্ধটা বেশি করে নাকে লাগছে। আর বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারব না! আমি মরে গেলে আমার মায়ের কী হবে? মা-ও যে তাহলে কাঁদতে-কাঁদতে মরে যাবে!
গলা ফাটিয়ে আরও কয়েকবার আমি কাকাবাবুর নাম ধরে চেচালাম। এখনও আসছেন না কেন? হয়তো এখানকার কোনও শব্দ ওপরে পৌঁছয় না।
একটু বাদে আমার হাতের ফিতেয় টান পড়ল। কাকাবাবুর গলা শুনতে পেলাম, সন্তু? সন্তু?
এই যে আমি, নীচে—
ওপরে খ্যাঁচ-খ্যাঁচ শব্দ হতে লাগল, আমার গায়ে গাছ লতাপাতার টুকরো পড়ছে। কাকাবাবু ছুরি দিয়ে ওপরের জঙ্গল সাফ করছেন। খানিকটা পরিষ্কার হবার পর কাকাবাবু মুখ বাড়ালেন, ব্যাকুলভাবে বললেন, সন্তু তোমার লাগেনি তো? সন্তু, কথা শুনতে পাচ্ছ?
হ্যাঁ, পাচ্ছি। না, আমার লাগেনি।
উঠে দাঁড়াতে পারবে?
হ্যাঁ। আমি তো দাঁড়িয়েই আছি।
তোমার আশেপাশে জায়গাটা কী রকম?
কিছু দেখতে পাচ্ছি না। ভীষণ অন্ধকার এখানে।
আমিও কিছু দেখতে পাচ্ছি না। দাঁড়াও, একটু দাঁড়াও—
কাকাবাবু আবার ছুরি দিয়ে গাছপালা কেটে সাফ করতে লাগলেন। গর্তের মুখটা প্রায় সবই পরিষ্কার হয়ে যাবার পর কাকাবাবু বললেন, সন্তু, ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়াও! তোমার কোটের সামনের দিকটা পেতে ধরো, আমি আমার লাইটারটা ফেলে দিচ্ছি।
কোট পাততে হল না, এখন আমি গর্তের ওপর দিকটা স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি। কাকাবাবুলাইটারটা ফেলে দিতেই আমি লুফে নিলাম।
লাইটারটা জ্বালিয়ে দেখো, ওখানে কী আছে!
কাকাবাবু এই লাইটারে চুরুট ধরান। বেশ অনেকটা শিখা হয়। জ্বেলে চারপাশটা দেখলাম। গর্তটা বহু পুরনো, দেয়ালের গায়ে বড় বড় গাছের শিকড়। দেখলে মনে হয় মানুষেরই কাটা গর্ত। একদিকে একটা সুড়ঙ্গের মতন। তার ভেতরটা এত অন্ধকার যে তাকাতেই আমার গা ছমছম করল। বোঁটকা গন্ধটা সেদিক থেকেই আসছে মনে হল। 8SR
সে-কথা কাকাবাবুকে বলতেই তিনি উত্তেজিতভাবে বললেন, ঠিক আছে। কোনও ভয় নেই। আমি একটা দড়ি গাছের সঙ্গে বেঁধে আর এক দিক নীচে নামিয়ে দিচ্ছি, তুমি শক্ত করে ধরবে।
তখন আমার মনে পড়ল, আমাদের ব্যাগের মধ্যে তো নাইলনের দড়ি আছে। ভীষণ শক্ত, কিছুতেই ছেড়ে না। তাহলে আর ভয় নেই। দড়ি ধরেই আমি ওপরে উঠে যেতে পারব।
দড়িটা নীচে এসে পড়তেই আমি হাতের সঙ্গে পাক দিয়ে শক্ত করে ধরলাম। তারপর লাইটারটা নিভিয়ে দিয়ে বললাম, কাকাবাবু, অতি উঠছি ওপরে–
কাকাবাবু ব্যস্ত হয়ে বললেন, না, না, উঠে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি আসছি।
কাকাবাবুর তো খোঁড়া পা নিয়ে নীচে নামবার দরকার নেই। তাই আমি চেঁচিয়ে বললাম, না, না, তোমাকে আসতে হবে না। আমি নিজেই উঠতে পারব।
কাকাবাবু হুকুম দিলেন, তুমি চুপ করে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি এক্ষুনি আসছি।
সেই দড়ি ধরে কাকাবাবু নেমে এলেন। মাটিতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই ফিসফিস করে বললেন, সন্তু, এই গর্তের মুখটা চৌকো-এই সেই চৌকো। পাতকুয়ো! আমরা যা খুঁজছিলাম বোধহয় সেই জায়গা।
বিস্ময়ে আমার মুখ দিয়ে কথা বেরুল না। এই গর্তটা আমরা খুঁজছিলাম-এতদিন ধরে? কিন্তু কী আছে। এখানে? এখানে কি গুপ্তধন আছে?
কাকাবাবু সুড়ঙ্গটার কাছে গিয়ে উঁকি মেরে বললেন, এর ভেতরে ঢুকতে হবে। সন্তু, তুমি ভিতরে ঢুকতে পারবে?
কাকাবাবু এমনভাবে কথা বলছেন যেন এই গর্তটা তাঁর বহুদিনের চেনা। আমরা যে বিপদে পড়েছি, কাকাবাবুর ব্যবহার দেখে তা-ও বোঝা যাচ্ছে না। বরং বেশ একটা খুশি খুশি ভাব। এখান থেকে বেরুবার চেষ্টা করার বদলে তিনি ঐ বিচ্ছিরি সুড়ঙ্গটার মধ্যে ঢকুতে চান!
আমি কাকাবাবুর গা ঘেঁষে ওভারকেটটা চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার ভীষণ ভয় করছে। আমি মরে গেলেও ঐ অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকতে পারব না। কাকাবাবু একলা ঢুকলেও ভয়, কাকাবাবুর যদি কোনও বিপদ-টিপদ হয়ে যায়! কাকাবাবু নীচে নামবার সময় ক্রােচ দুটো আনেননি। ওঁর এমনি দাঁড়িয়ে থাকতেই কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু উনি কিছু গ্ৰাহ্য করছেন না
কাকাবাবু বললেন, দাঁড়াও, আগে দেখে নি, সুড়ঙ্গটা কত বড়।
কাকাবাবু লাইটারটা জ্বালালেন। তাতে বিশেষ কিছুই দেখা গেল না। শুধু জমাট অন্ধকার।
সন্তু, দ্যাখ তো, শুকনো গাছটাছ আছে কি না, যাতে আগুন জ্বালা যায়! শুকনো গাছও নেই। বরং সব কিছুই ভিজে স্যাঁতসেঁতে। পাথরের দেয়ালে হাত দিলেও হাতে জল লাগে।
কাকাবাবু অধীর হয়ে বললেন, কী মুস্কিল, আগুন জ্বালাবার কিছু নেই? টািৰ্চটা আনলে হত-বুঝবোইবা কী করে, দিনের বেলা-
আমি বললাম, কাকাবাবু, এখন আমরা ওপরে উঠে পড়ি বরং। পরে লোকজন ডেকে এনে দেখলে হয় না?
কাকাবাবু প্ৰায় ধমক দিয়ে বললেন, না! এসব লোকজন ডেকে এনে দেখার জিনিস নয়।
আমি বললাম, কাকাবাবু ঐ সুড়ঙ্গটার মধ্যে একটা বিচ্ছিরি গন্ধ!
কাকাবাবু নাকে বড় রকম নিঃশ্বাস টেনে বললেন, গন্ধ? কই, আমি পাচ্ছি। না তো! অবশ্য, আমার একটু সর্দি হয়েছে। গন্ধ থাক না, তাতে কী হয়েছে? কাকাবাবু কািট করে পকেট থেকে বড় একটা রুমাল বার করলেন। তারপর সেটাতেই লাইটার থেকে একটু পেট্রোল ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলেন। রুমালটা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। সেই আলোতে দেখা গেল। গুহাটা বেশি। বড় নয়। কাকাবাবু মাথা নিচু করে ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন, আমি দারুণ ভয় পেয়ে কাকাবাবুকে টেনে ধরে চেঁচিয়ে উঠলাম, কাকাবাবু, দ্যাখো, দ্যাখো-
গুহার একেবারে শেষ দিকে দুটো চোখ আগুনের মতন জ্বলজ্বল করছে। আমার তক্ষুনি মনে হল, হাকো বসে আছে ওখানে। আমি প্রথমেই ভেবেছিলাম, এটা হাকোর বাড়ি। ও বেরিয়ে এসেই আমাদের পুড়িয়ে ছাই করে দেবে।
কাকাবাবু একটু থমকে গেলেন। আমি ফিসফিস করে বললাম, হাকো! নিশ্চয়ই হাকোঁ! ওরা বলেছিল কুয়োর মধ্যে…
কাকাবাবু বললেন, ধ্যাৎ! হাকো আবার কী? তোর মাথার মধ্যে বুঝি ঐ সব গল্প ঢুকেছে।
তা হলে কী? চোখ দুটোতে আগুন জ্বলছে—
আগুন কোথায়? আলো পড়ে চকচক করছে।
তবে কি বাঘ? এত ঠাণ্ডা জায়গায় বাঘ থাকে না। খুব সম্ভব পাহাড়ি সাপ। পাইথন-টাইথন হবে। ভয়ের কিছু নেই। পাইথন তেড়ে এসে কামড়ায় না!
রুমালটা ততক্ষণে সবটা পুড়ে এসেছে। বিশ্ৰী গন্ধ আর ধোঁয়া বেরুচ্ছে সেটা থেকে। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে এসেছে, ধোঁয়ার জন্য আবার কাশি পেয়ে গেল।
কাকাবাবু হুকুম করলেন, সন্তু, তোমার পকেট থেকে রুমাল বার করো। আমি আগুন লাগিয়ে দিচ্ছি, তুমি ধরে থাকো ওটা। এক পাশে সরে গিয়ে হাতটা শুধু বাড়িয়ে দাও গুহাটার দিকে।
কাকাবাবু রিভলভারটা বার করে বললেন, বেচারাকে মারা উচিত নয়, ও চুপ করে বসে ছিল, আমাদের কোনও ক্ষতি করেনি। কিন্তু সাপকে তো বিশ্বাস করা যায় না। আমাকে যে ভেতরে ঢুকতেই হবে।
যদি সাপ না হয়?
সাপ ছাড়া আর কোনও জন্তু এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকে না।
কাকাবাবু সেই চোখ দুটো লক্ষ্য করে পর পর দুবার গুলি করলেন। হঠাৎ গুহাটার মধ্যে তুমুল কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। এতক্ষণ অন্ধকারে টু শব্দটিও ছিল না। এখন গুহাটার ভেতরে কে যেন প্ৰচণ্ড শক্তি নিয়ে দাপাদাপি করছে।
কাকাবাবু চেঁচিয়ে বললেন, সন্তু, সরে দাঁড়াও, গুহার মুখটা থেকে সরে দাঁড়াও। ও এখন বেরুবার চেষ্টা করবে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সাপটার বীভৎস মুখখানা গুহা থেকে বেরিয়ে এল। অনেকটা থেতলে গেছে। কাকাবাবু আবার দুটো গুলি ছুঁড়লেন।
আস্তে আস্তে থেমে গেল সব ছটফটানি। আমি উল্টো দিকের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি। তাড়াতাড়ি পিছু হটতে গিয়ে মাথা ঠুকে গেল দেয়ালে। এত জোরে বুক টিপটপ করছে যে মনে হচ্ছে কানে তালা লেগে যাবে। পা দুটো কাঁপছে থরথর করে।
কাকাবাবু এগিয়ে গিয়ে জুতোর ঠোক্কর দিয়ে দেখলেন সাপটার তখনও প্রাণ আছে কিনা। সেটা আর নড়ল না। আমি বললাম, ককাবাবু, যদি ভেতরে আরও কিছু থাকে? সাপ কিংবা অন্য জন্তুজানোয়ার সব একসঙ্গে দুটো করে থাকে না?
আর কিছু থাকলে এতক্ষণে বেরিয়ে আসত।
তারপরেই কাকাবাবু গুহাটার মধ্যে ঢুকে পড়লেন। আমি বারণ করার সময় পেলাম না। তখন দিশেহারা হয়ে গিয়ে আমিও ঢুকে পড়লাম পেছন পেছন।
এই রুমালটাও প্রায় পুড়ে এসেছে। হাতে ছেকা লাগার ভয়ে আমি সেটাকে ফেলে দিলাম মাটিতে। সেই আলোতে দেখা গেল। গুহার মধ্যে একটা মানুষের কঙ্কালের টুকরো পড়ে আছে। শুধু মুণ্ডু আর কয়েকখানা হাড়। একটা ভাঙা মাটির হাঁড়ি, একটা মস্ত বড় লম্বা বশ। আর একটা চৌকো তামার বাক্স।
কাকাবাবু সেই তামার বাক্সটা তুলে নিয়েই বললেন, সন্তু, শিগগির বাইরে চলে এসে। এই বদ্ধ গুহার মধ্যে আগুন জ্বালা হয়েছে, এখানকার অক্সিজেন ফুরিয়ে আসেছ। এক্ষুনি দম বন্ধ হয়ে আসবে। চলে এসো শিগগির…।
ঝোলানো দড়ি ধরে দেয়ালের শিকড়-ব্যাকড়ে পা দিয়ে একেবারে ওপরে উঠে এলাম। আগে আমি, তারপর কাকাবাবু। কাকাবাবু খোঁড়া পা নিয়ে কত কষ্ট। করে যে উঠলেন, তা অন্য কেউ বুঝবে না। কিন্তু কাকাবাবুর মুখে কষ্টের কোনও চিহ্ন নেই। আমিও তখন বিপদ কিংবা কষ্টের কথা ভুলে গেছি। বাক্সটার মধ্যে কী আছে তা দেখার জন্য আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারছি না। কত অ্যাডভেঞ্চার বইতে পড়েছি, এইরকমভাবে গুপ্তধন খুঁজে পাবার কথা। আমরাও ঠিক সেই রকম-বাক্সটার মধ্যে মণিমুক্তো, জহরৎ যদি ভর্তি থাকে–
কাকাবাবু টানাটানি করে বাক্সটা খোলার চেষ্টা করলেন। কিছুতেই খোলা যাচ্ছে না। তালা বন্ধও নয়, কিন্তু কীভাবে যে আটকানো তা-ও বোঝা যায় না। আমি একটা বড় পাথর নিয়ে এলাম। সেটা দিয়ে ঠুকে ঠুকে একটা কোণ ভেঙে ফেলা হল। বাক্সটা অবশ্য বহুকালের পুরনো, জোরে আছাড় মারলেই ভেঙে যাবে। ভাঙা দিকটা ছুরি ঢুকিয়ে চাড় দিতেই ডালাটা উঠে এল।
বাক্সটার ভেতরে তাকিয়ে আমি একেবারে নিরাশ হয়ে গেলাম। মণি, মানিক্য, জহরৎ কিছুই নেই। কেউ যেন আমাদের ঠকাবার জন্যই বাক্সটা ওখানে রেখে গেছে। বাক্সটার মধ্যে শুধু একটা বড় গোল পাথর, গায়ে শ্যাওলা জমে গেছে। কেউ বোধহয় আমাদের আগে ঐ গুহাটায় ঢুকে বাক্সটা খুলে মণিমুক্তো সব নিয়ে তারপর অন্যদের ঠকাবার জন্য পাথর ভরে রেখে গেছে।
কিন্তু আমি কিছু বলবার আগেই দেখলাম, কাকাবাবুর মুখে দারুণ আনন্দের চিহ্ন। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। ঠোঁটে অদ্ভুত ধরনের হাসি। কাকাবাবু চোখ থেকে চশমাটা খুলে ফেললেন। আমি ভাবলাম চশমার কাচ মুছবেন। কিন্তু তা তো নয়? মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে বাক্সটা হাতে নিয়ে কাকাবাবু হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন।