ভ্রমণের বৃত্তান্ত
আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগের কথা আমরা কজন প্রকৃতি পাগল একসাথে চলেছি জয়চন্ডী পাহাড় এর ট্রেকিং এ। জঙ্গল পাহাড়ের ট্রেকিং এর জন্য পুরুলিয়া আদর্শ। অযোধ্যা পাহাড় জয়চন্ডী পাহাড় দুটোই একেবারে ঠিকঠাক জায়গা। জয়চন্ডী দিয়ে পুরুলিয়া ট্রেকিং এর সূচনা করতে চলেছি। রূক্ষ্ম প্রকৃতি ও সবুজ গাছপালা— এই জয়চন্ডী পাহাড় এর মেলবন্ধন! ধূসর পাথরের ভূমিরূপ আর পাহাড়ের গায়ে বিশাল বিশাল মহীরুহ পাথরের ফাটলের শিকড চারিয়ে প্রাণরস আহরণ করে চলেছে। অবাক বিস্ময় দেখছি ন্যাড়া পাথরের গায়ের শিকড়ের আঁকি-বুকি—– সবুজের ছত্রছায়া! এই পাথুরে মাটিতে শিউলি গাছের ঝোপ ভর্তি! শিরিষ বাঁশ মহুয়া চল্লা গাছের সমারোহ।সাদা ফুলে ছাওয়া একটা কাষ্ঠল লতা গাছগুলোকে সোহাগে জড়িয়ে রেখেছে। প্রজাপতি মৌমাছির মজলিস এখানে।
জয়চন্ডী পাশে একটা সমউচ্চতার পাহাড় আছে একদম ন্যাডা। একটিও গাছ নেই সেখানে। ধূসর বাদামি পাথরের ভূমিরূপ দেখলে বুক কেঁপে ওঠে।অথচ পাশের জয়চন্ডী সবুজ ও পাথরে মিলেমিশে বড় দৃষ্টিনন্দন।সরু পাথুরে পাকদণ্ডী পথ। পাহাড়তলীর একপাশে কটি মাত্র খড়ের চালের বসতি। আদিবাসী মানুষগুলো বড়ই আন্তরিক। আমাদের জল শুকনো খাবার নিয়ে যেতে বলল। আরো বললো পাহাড়চূড়ার গাছ তলাতে মা জয়চন্ডীর আটন ।আমরা যেন পূজা দি। ওই পাহাড়ের ওপরে একটা কুন্ড আছে। ওদের একজন আমাদের পথ প্রদর্শক হয়ে চলল। সরু পাকদণ্ডী একজন একজন করে উঠছি। সামনে “হপন “ওই আদিবাসী ছেলেটি! তার পেছনে সারিবদ্ধ আমরা পাঁচজন! যতই উপরে উঠছি প্রকৃতির সৌন্দর্যের ডালি আমাদের চোখের সামনে ফুটে উঠছে! অনেক নিচে পাহাড়তলীর মেঠোপথ, তালগাছ ,ধানক্ষেতের সোনালী সবুজ, চোখ জুড়িয়ে দিচ্ছে। মেঘমুক্ত নীল আকাশ ঝকঝক করছে!
“সাদা মেঘের গামছা ভাসে
আকাশ দীঘিতে ডুব জলে!”
সুনীল আকাশে চক্কর কাটা গেরোবাজের ডানা আশ্রয় করে বিবাগী মন। হারিয়ে যেতে চায় সেই নিঃসীম শূন্যে। একটানা না হেঁটে মাঝে-মাঝে বসে পড়ে বিশ্রাম নিচ্ছি। প্রায় তিন ঘন্টা চড়াই ভেঙ্গে পাহাড়চূড়ায় পৌছালাম। প্রায় সমতল হিল্টপ। পাথুরে জমিন ঝোপঝাড়ে ভরা। একটা চল্লা গাছের তলায় কয়েকটি সিঁদুর মাখানো মাকডা পাথর। এই ঝামাপাথর ই মা জয়চন্ডী র প্রতিরূপ । একটা ত্রিশূল পোতা আছে পাশে। আমরা একটু বিশ্রাম করেই ভূত ভৈরবী বনফুল শিউলি ফুল কুড়িয়ে এনে মাকে অর্পণ করলাম। সাথে নিয়ে যাওয়া বাতাসা সিঁদুর ধূপ দিয়ে মায়ের আরাধনা করলাম। স্হানীয় মানুষজন এই মাকে মা দুর্গার প্রতিরূপ হিসেবে পুজো করে। এবার শুরু হলো আমাদের বনভোজন। পাহাড়ের পাশের চূড়ায় একটি ছোট কুন্ডু। এখানেও একটি ত্রিশূল পোতা। পাথরের উনুন বানিয়ে তাতে শুকনো কাঠ পাতা দিয়ে আগুন জ্বালালাম। সঙ্গে নিয়ে যাওয়া উপকরণ দিয়ে সবজি খিচুড়ি তৈরি হলো। হপন কাঁচা শালপাতা সেলাই করে খাবার থালা তৈরি করল। সবাই একসাথে বসে খাওয়া শেষ করলাম। আস্তে আস্তে সূর্য পশ্চিম দিগন্তকে সোহাগের রক্ত রাগে রাঙিয়ে দিল। অপরূপ দৃশ্য! পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের এই অপরূপ চিত্রকল্প মনের পটে চিরস্থায়ী হয়ে রইলো। এবার নামার পালা। উতরাই এ নামতে পায়ের পেশিতে টান লাগে। হপন আমাদের অন্য একটি পথ দিয়ে নিয়ে এলো যাতে সময় বেশি লাগলেও উৎরাইয়ের ঢাল খুব খাডা নয়। আস্তে আস্তে যখন পাহাড়তলীতে পৌছালাম সারা চারাচর তখন সন্ধ্যার মায়াবী চাদরে মুখ ঢেকে ফেলেছে— সাথে সাথে ঠান্ডার চাবুক পডছে খোলা জায়গা গুলোতে।এক বুক খুশি নিয়ে ফিরে চললাম নিজস্ব যাপন বৃত্তে। মনের মনিকোঠায় আতর মাখা স্মৃতি কে সঙ্গে করে।