Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ভৌত চশমা || Shirshendu Mukhopadhyay

ভৌত চশমা || Shirshendu Mukhopadhyay

ভৌত চশমা

বিকেলের দিকে বৈজ্ঞানিক গয়েশ সামন্তর মাথা ধরেছিল। মাথা ধরার আর দোষ কি? সারাদিন তিনি তাপহীন আগুন নিয়ে গবেষণা করেছেন। এখনো জিনিসটা তাঁর ধরাছোঁয়ার মধ্যে আসেনি। কিন্তু মনে হচ্ছে হবে, পৃথিবীতে-শুধু পৃথিবীতেই বা কেন–সারা বিশ্বজগতে একটা বিশাল বিপ্লব ঘটে যাবে তাহলে। অবশ্য তাপহীন আগুনে রান্না করা যাবে কিনা তা এখনো বলা যাচ্ছে না। তবে আলো জ্বলবে। যেমন জোনাকি পোকার আলো, যেমন বেড়ালের বা গরুর চোখের আলো, যেমন কিনা হাতঘড়ির ডায়ালের আলো। বৈজ্ঞানিক গয়েশ সেই সব আলো দেখেই তাপহীন আগুন আবিষ্কারের প্রেরণা পেয়েছেন। আবিষ্কৃত হলে সেই আগুনে অনেক কাণ্ড হবে। বাড়িতে আগুন লাগলেও বাড়ি পুড়বে না, সেই আগুন হাতে বা পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যাবে, তখন আগুন নিয়ে বাচ্চারাও খেলা করতে পারবে।

সাফল্যের খুব কাছাকাছি এসে গয়েশ খুবই উত্তেজিত। দীর্ঘদিন একটানা সাধনা করার পর খুব ক্লান্তও। তাই বিকেলের দিকে মাথা ধরা ছাড়ানোর জন্য তিনি গবেষণাগার থেকে বেরিয়ে এলেন একটু পায়চারি করার জন্য।

কিন্তু পৃথিবীটা বড় নোংরা। চারদিকে ধুলো, আবর্জনা, বদ গন্ধ, গণ্ডগোল, নাক কুঁচকে, চোখ বুজে, কানে আঙুল দিলেন তিনি। তারপর সোজা ছাদের গ্যারেজ ঘরে গিয়ে একটা মাঝারি রকেট বেছে নিয়ে তাতে উঠে বসলেন।

সোঁ করে চলে এলেন চাদে। এ জায়গাটায় এখনো তেমন ভীড়ভাট্টা নেই। বাতাসের অভাবে ধুলো-টুলো ওড়ে না, কোনো গন্ধও আসে না নাকে। তবে এখানেও হরেক রকম গবেষণাগার হয়েছে, বাড়িঘর তৈরি হচ্ছে, কৃত্রিম উপায়ে বাতাস, মাধ্যাকর্ষণ ও আবহমণ্ডল তৈরির চেষ্টা চলছে। লজ্জার কথা, চাষবাসের জন্যও নাকি তোড়জোড় হচ্ছে। এমনকি বৈজ্ঞানিকরা চাঁদের অভ্যন্তরে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জমাট বরফ গলিয়ে নদী তৈরির চেষ্টাও করছেন। ফলে চাঁদের বিশুদ্ধতাও আর বেশিদিন থাকবে না।

মহাকাশচারীর পোশাকে গয়েশ সামন্ত তার রকেট থেকে বেরিয়ে এসে চাঁদের নির্জন এক মস্ত পাহাড়ের তলায় পায়চারি করতে লাগলেন। তাপহীন আগুনের চিন্তায় তার মাথা গরম।

পায়চারি করছেন, এমন সময় সামনে টুক করে একটা ঢিল পড়ল। পৃথিবীতে এরকম ঘটনা হামেশাই ঘটে। দুষ্টু ছেলের অভাব নেই সেখানে। কিন্তু চাঁদের এই নির্জন পাহাড়তলীতে ঢিল মারে কে! গয়েশ অবাক হয়ে চারদিকে দেখতে থাকেন। হঠাৎ নজরে পড়ল মাটি থেকে হাত বিশেক ওপরে একটা গামলার মতো বিচ্ছিরি চেহারার শূন্যযান থেকে বৈজ্ঞানিক হারাধন খাড়া উঁকি মেরে তাকে দেখছে এবং ফিক করে হাসছে। হারাধনকে দু চোখে দেখতে পারেন না গয়েশ।

হারাধন জলগ্রহ নেপচুনে হাইড্রোইলেকট্রিক প্ল্যান্ট বানিয়ে সেখান থেকে প্রজেকটারের সাহায্যে পৃথিবীতে অঢেল বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করেছে। খুব রবরবা তার।

গয়েশ বিরক্ত হলেও ভদ্রতার খাতিরে হারাধনের দিকে চেয়ে একটু হাসলেন।

হারাধন তার গামলাটা নামিয়ে আনল। মহাকাশচারীর বর্মের মতো পোশাক পরা অবস্থাতেও হারাধন তার ঘাড় চুলকোবার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে গামলা থেকে মাটিতে নেমে এসে স্পিকিং টিউবের ভিতর দিয়ে বলল–কখন থেকে পোশাকের মধ্যে একটা ছারপোকা ঢুকে রয়েছে, জ্বালিয়ে খেলে।

গয়েশ তার কথা বলার যন্ত্রের ভিতর দিয়ে বললেন–স্পেশসুটে আজকাল বড্ড ছারপোকা হচ্ছে। আমাকেও প্রায়ই কামড়ায়। একজন মার্কিন সায়েন্টিস্ট সেদিন দুঃখ করে বলছিলেন তার একটা শখের স্পেশসুট নাকি উই পোকায় খেয়ে ফুটো করেছে, আর একটায় কঁকড়া বিছে বাসা বেঁধেছে, বোঝো কাণ্ড!

হারাধন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে–শুধু তাই নয়, পোকাগুলোকে কিছুতেই মারাও যাচ্ছে না। সবচেয়ে কড়া পোকা মারার ওষুধ দিয়েও কাজ হচ্ছে না। ভারী মুস্কিল।

পোকামাকড়ের কথা কিছুক্ষণ গম্ভীরভাবে আলোচনা করলেন দুজনে। তারপর হারাধন বলল–আজ বড় খাটুনি গেল গয়েশদা। নেপচুনে যন্ত্রপাতির কিছু গণ্ডগোল ছিল। সেই রাত বারোটা থেকে সারাদিন, এখনো হাতমুখ ধোয়ার সময় পাইনি।

গয়েশ আঁতকে উঠে বললেন–হাতমুখ কি চাঁদের জল দিয়ে ধোবে নাকি? সর্বনাশ, এখানকার জল কিন্তু ভীষণ ভারী, বিচ্ছিরি সব মিনারেল রয়েছে এই জলে।

হারাধন হেসে বলে–আরে না, আমি প্লটো থেকে হাতমুখ ধোয়ার বা স্নান করার জল আনি।

গয়েশ উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন–খাও কোন জল?

–নেপচুন, ও ছাড়া অন্য জল সহ্যই হয় না। আমাশা হয়ে যায়।

গয়েশ ম্লান মুখে বলেন–আমারও। নেপচুনের জলে শুনেছি অনেক ট্রেস এলিমেন্ট আছে। আমার জন্য খানিকটা পাঠিয়ে দিও তো। পেটটা কয়েকদিন ধরেই বড় ভুটভাট করছে।

হারাধন ম্লান মুখে বলে, ভুটভাটের কথা আর বোলো না দাদা। আমিও ওই ভুটভাটের রুগী। তারা কিছুক্ষণ পেটের গোলমাল আর জলবায়ু নিয়ে কথা বললেন।

হারাধন হঠাৎ বললেন–আরে ভাল কথা, ইনজিনিয়ারদের সব মাইনে বাড়ল শুনেছো নাকি!

বিরস মুখে গয়েশ বলেন–শুনছি তো তাই।

–তো আমাদের সায়েন্টিস্টদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা হল না। তাহলে এবারও?

–কৈ আর হল!

–এ ভারী অন্যায় গয়েশদা। তোমাকে এই বলে রাখছি, সরকার যদি সায়েন্টিস্টদের সঙ্গে সমার মতো ব্যবহার করে তবে কিন্তু তারা ধর্মঘট করতে বাধ্য হবে। এবার স্পেশ সায়েন্সের জন্য নোবেল প্রাইজ কাকে দিয়েছে জানো?

–না, গয়েশ খুব সতর্ক গলায় বলেন। আসলে তিনি শুনেছেন, ডিসেম্বর মাসের আগে যদি তিনি তাপহীন আগুন আবিষ্কার করতে পারেন তবে নোবেল প্রাইজ তাকেই দেওয়া হবে। মহাকাশযানে ব্যবহারের জন্য তাপহীন আগুনের বড়ই দরকার।

এবার তারা কিছুক্ষণ বেতন বৃদ্ধি এবং প্রাইজ নিয়ে কথাবার্তা চালালেন। তারপর হারাধন তাঁর গামলার মতো শূন্যযানে চড়ে চলে গেলেন হাত পা ধুয়ে বিশ্রাম নিতে।

চাঁদ থেকে আকাশের রঙ ঘোর কালো দেখায়। গয়েশ অন্যমনস্কভাবে আকাশের দিকে চেয়ে রইলেন। নিকশ কালো আকাশে প্রচণ্ড সেজে সূর্য জ্বলছে। আগুনকে তাপহীন করার পদ্ধতি যদি তিনি আবিষ্কার করতে পারেন তাহলে একদিন সূর্যের তাপকেও নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হবে না। ভ্র কুঁচকে এইসব ভাবতে ভাবতে আর অবিরল পায়চারী করতে করতে তার একটু খিদে পেল।

গয়েশের রকেটটা ঊর্ধ্বমুখ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রকেটের গায়ে চৌম্বক খিল দিয়ে একটা চমৎকার হালকা কাঁচতর শূন্যযান লাগানো। দেখতে অনেকটা পিরিচের মতো। গয়েশ পিরিচটা খুলে উঠে বসলেন। চোখের পলকে চাঁদের গবেষণাগারের কাছে লোকবসতির মধ্যে এসে নামলেন। ঢুকলেন মাটির তলার ক্যান্টিনে।

এখানে কৃত্রিম আবহমণ্ডল থাকায় স্পেশসুট খুলে ফেললেন গয়েশ। জল ছুঁলেন না, একটা রশ্মিযন্ত্রের কাছে গিয়ে সুইচ টিপে নানারকম রশ্মি দিয়ে হাত মুখ বীজাণুমুক্ত করলেন। তারপর মস্ত হলঘরে গিয়ে বসলেন। হলঘর একেবারে ফাঁকা। তবে প্রায় সিকি মাইল লম্বা হলের একেবারে শেষ প্রান্তে বুড়ো বৈজ্ঞানিক সাধন হাজরা বসে আপনমনে বিড়বিড় করছেন। ব্যর্থ ও উন্মাদ বৈজ্ঞানিকদের যে তালিকাটি গতবছর বেরিয়েছে। তাতে সাধনের নাম সবার ওপরে। লোকটা খুব সাংঘাতিক কিছু আবিষ্কার করার জন্য খুব গোপনে গবেষণা চালাচ্ছিল। আর সেই গবেষণা করতে করতেই কেমন যেন পাগলাটে আর একাচোরা স্বভাবের হয়ে গেল। পৃথিবীতে নিজের বাড়িতে আর যায় না। চাঁদের ক্যান্টিনেই সারাদিন বসে বসে সময় কাটিয়ে দেয়। তাকে কেউ ঘাঁটায় না।

গয়েশ বসতেই বেশ স্মার্ট চেহারার একটা রোবট বেয়ারা এসে টেবিলটা একটা ভ্যাকুয়াম যন্ত্রে পরিষ্কার করে দিয়ে বলল কী খাবেন?

গয়েশ বিস্বাদ মুখে ভাবতে লাগলেন। খিদে পেলেও তার মুখে রুচি নেই। কিছুই খেতে ইচ্ছে করে না, আবার সব কিছু পেটে সহ্যও হয় না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন–মুড়ি আর ছাগলের দুধ।

রোবট চলে গেল। একা মস্ত হলঘরটায় বসে কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করছিলেন গয়েশ। বড় ফাঁকা আর একা লাগছে। ওদিকে বহু দূরে বুড়ো বৈজ্ঞানিক সাধন হাজরা আপনমনে কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে হাঃ হাঃ করে হেসে উঠছে। এক একবার সেদিকে তাকিয়ে দেখছেন গয়েশ।

হঠাৎ একবার চোখে চোখ পড়তেই সাধন হাজরা হাতছানি দিয়ে ডাকল গয়েশকে। একটু দোনোমোনো করে গয়েশ উঠলেন। ভাবলেন পাগল হোক ক্ষ্যাপা হোক একজন সঙ্গী তো বটে।

কাছে গিয়ে বসতেই সাধন গয়েশের কানে কানে বলল–কাল অবশেষে জিনিসটা আবিষ্কার করেছি।

গয়েশ বললেন–কী?

–একটা চশমা। এটার নাম হল ভৌত চশমা। বলে সাধন পকেট থেকে একটা চশমার খাপ বের করে চশমাটা খুলে টেবিলে রাখে। গয়েশ দেখলেন, চশমাটায় নানারকম ক্ষুদে যন্ত্রপাতি লাগানো। কাঁচটা গাঢ় কালো। সাধন ফিস ফিস করে বলল, দেখবে?

গয়েশ অবাক হয়ে বলেন–কি?

সাধন বলে–বহুদিন ধরেই টের পাচ্ছি যে তেনারা আছেন। কিন্তু পৃথিবীর মানুষ যত সব বৈজ্ঞানিকদের পাল্লায় পড়ে কিছুতেই ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে চাইত না। তখনই ঠিক করেছিলুম, যেমন করে তোক একটা এমন যন্তর বের করতে হবে যা দিয়ে তেনাদের চাক্ষুষ দেখা যায়। তখন তো আর অবিশ্বাস করতে পারবে না! এতদিনে বের করেছি। দেখবে।

গয়েশ ব্যাপারটা ভাল করে বুঝবার আগেই হঠাৎ সাধন চশমাটা তুলে খপ করে পরিয়ে দেয় গয়েশকে। চশমাটাও এমন ব্যাদড়া যে চোখে বসে যেন আঠা হয়ে লেগে গেল।

প্রথমটায় গয়েশ কিছুই দেখতে পেলেন না অন্ধকার ছাড়া। তারপর দেখেন তার চারধারে হলঘরটা যেন একটা কালচে আলোয় ভরে উঠল। কিংবা ঠিক আলোও নয়, অনেকটা এক্স-রে-র মতো যেন দেখা যাচ্ছে সব কিছু দেখতে দেখতে হঠাৎ ভীষণ আঁতকে ওঠেন গয়েশ। এ কী? ফাঁকা হলঘরটা যে লোকে ভর্তি! শুধু ভর্তি নয়, একেবারে গিজগিজ করছে ঠাসাঠাসি সব মানুষ! শুধু মেঝেতে নয়, শূন্যে একেবারে সিলিং পর্যন্ত একের ঘাড়ে আর একজন চেপে বসে আছে। তারা ভাসছে ঘুরছে, হাঁটছে, হাসছে, হচছে, কথা কইছে, দেয়াল ফুঁড়ে খুশিমতো বেরিয়ে যাচ্ছে, আবার ঢুকছে।

গয়েশ চেঁচিয়ে উঠলেন–এ কী! এরা কারা?

কানের কাছে সাধন ফিস ফিস করে বলল–তেনারা। এখন বিশ্বাস হল তো! বড় যে ভূতে বিশ্বাস করতে না?

–ভূ–? বলে কোনোক্রমে অজ্ঞান হতে হতে নিজেকে সামলে নিলেন গয়েশ। চশমাটা এক হঁচকা টানে খুলে লাফিয়ে উঠে প্রাণপণে ছুটলেন হলঘরের দরজার দিকে। কোনোক্রমে স্পেশসুটটা পরে নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়লেন বাইরে। পিরিচে উঠে বিদ্যুৎবেগে চালিয়ে দিলেন সেটা রকেটের দিকে। আর সারাক্ষণ বড় বড় চোখ চেয়ে বিল গলায় বলতে লাগলেন–ভূ…ভূ…ভূ…ভূ…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *