জড়ুল এবং বিগ্রহ
রাস্তায় গিয়ে বললাম, হঠাৎ উঁকিল ভদ্রলোককে ওই অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন কেন?
কর্নেল একটু হেসে বললেন, গ্র্যাব রেয়ার আর্টস্ বেস্ট।
ভ্যাট! খালি হেঁয়ালি করা অভ্যাস আপনার।
ওয়ার্ডগেম ডার্লিং, ওয়ার্ডগেম!
কথা বললে আরও হেঁয়ালি বাড়বে। তাই চুপ করে গেলাম। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ট্যাক্সির কাছে গিয়ে কর্নেল বললেন, আলিপুর কোর্ট। যাবেন নাকি?
ট্যাক্সি ড্রাইভাররা, বরাবর দেখে আসছি, কর্নেলের কথায় না করে না। পাদরিসুলভ চেহারার জন্য, কিংবা বিদেশি সায়েবের দেশি নমুনায় বশীভূত হয় কি না কে জানে!
আলিপুর কোর্ট চত্বরে নেমে কর্নেল পকেট থেকে হরিবাবুর সেই কার্ডটা বের করে দেখে নিলেন। তারপর হাঁটতে শুরু করলেন। ভিড়ে ভরা সংকীর্ণ রাস্তা, পাশে একটা ড্রেন। একটা ঝাকড়া গাছের তলায় তেরপল টাঙানো ছিল। সেখানে একটা টেবিল-চেয়ার এবং টেবিলে একটা ছোট্ট টাইপ রাইটার। কর্নেল সেখানে দাঁড়ালে এক তরুণ ছুটে এল। হরিকাকুকে খুঁজছেন স্যার? হোটেলে এক্ষুনি খেতে গেলেন। এসে পড়বেন শিগগির। একটু ওয়েট করুন।
কর্নেল বললেন, তুমি কি হরিবাবুর অ্যাসিস্ট্যান্ট নাকি?
আমি স্যার এখানে সবাইকে হেলপ করি।
কী হেল্প করো?
হেলপ্ বোঝেন না স্যার?
কর্নেল হাসলেন। বুঝলাম। কিন্তু ধরো, আমার হঠাৎ এখনই একটা চিঠি লেখানোর দরকার। তুমি কি হেল্প করতে পারবে?
ওই তো মাখনদা টাইপ করছে। চলুন ওখানে।
নাহ্। আমার বাংলায় একটা চিঠি লেখাতে হবে।
এখানে তো বাংলায় টাইপ হয় না স্যার! নাকি হয়–দাঁড়ান, জিজ্ঞেস করে আসি।
হাতের লেখাই চলবে। খুলে বলি। তা হলেই বুঝবে। কর্নেল আমাকে দেখিয়ে বললেন, এই ভদ্রলোক অবাঙালি ব্যবসায়ী। ইংরেজিও ভাল জানেন না। তা না হলে এঁকে দিয়েই লেখাতাম। একটু বুঝিয়ে লিখতে হবে। আর এই দেখ, আমার হাতের অসুখ। সব সময় খালি কঁপে।
কর্নেলের হাতের কাঁপুনি দেখে আমি হতবাক।
স্মার্ট তরুণটি বলল, খামে না পোস্টকার্ডে না ইনল্যান্ডে?
কর্নেল কাঁপা কাঁপা হাতে পকেট থেকে একটা পোস্টকার্ড বের করে দিলেন। বললেন, আমার কাজের লোক বিষ্ণু দেশে গেছে। খুব অসুবিধে হচ্ছে। শিগগির আসতে লেখ। এমন করে লিখতে হবে যেন চিঠি পেয়েই চলে আসে। একটু তাড়াতাড়ি করতে হবে ভাই। ওই পোস্ট অফিসে পোস্ট করে চলে যাব। ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখেছি।
তরুণটি তক্ষুনি পোস্টকার্ডে দ্রুত কলম চালাল। এক মিনিটেই এক পৃষ্ঠা ভরিয়ে ফেলল। পরে পৃষ্ঠায় আধমিনিট। তারপর চোখ নাচিয়ে বলল, এমন লিখলাম স্যার, চিঠি পেয়েই–হুঁ। ইতি–আপনার নাম বলুন।
শিবপদ মজুমদার, ব্যস! আর কিছু না। ঠিকানা লেখো : বিষ্টুচরণ ধাড়া। গ্রাম আর পোস্ট অফিস গোবিন্দপুর। জেলা বর্ধমান। পিনকোড জানি না।
পোস্টকার্ড নিয়ে কর্নেল তাকে একটা পাঁচটাকার নোট দিলেন। সে টাকা পকেটস্থ করে বলল, হরিকাকু জানতে পারলে রাগ করবে। আপনারা কেটে পড়ুন স্যার। ওর আসার সময় হয়ে গেল।
তুমি হরিবাবুকে কিছু বলবে না। তা হলেই হল।
আমার মাথা খারাপ?
কর্নেল হন্তদন্ত ড্রেন ডিঙিয়ে চলতে থাকলেন। তারপর একটা ট্যাক্সিও ৪ গেল। ট্যাক্সিতে চেপে বললাম, ব্যাপারটা কী?
কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, দৈবাৎ একটা চান্স পেয়ে গেলে ছাড়ি না। তবে আমি ঠিক এটাই ভেবে রেখেছিলাম। কোর্ট এলাকা বড় বিচিত্র, জয়ত। কত রকমের পেশার লোক ঘুরে বেড়ায়।
হেঁয়ালি শুনে চুপ করে গেলাম। কর্নেল পোস্টকার্ডে মন দিয়েছেন।
ইলিয়ট রোডের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে কর্নেল বললেন, এ বেলা আমার এখানে তোমার লাঞ্চের নেমন্তন্ন। বিকেলে দুজনে একসঙ্গে একবার বেরুব। কিন্তু না, কোনও প্রশ্ন কোরো না। শুধু চুপচাপ দেখে যাও। কেমন?
কর্নেল আমার কাধ চাপড়ে দিলেন। তারপর টেবিলের ড্রয়ার খুলে হরিবাবুকে লেখা লালকালির সেই চিঠিটা বের করে পোস্টকার্ডের লেখার পাশে রাখলেন। হাতে আতসকাঁচ। একটু পরে বললেন, ওই ছোকরা দারুণ চৌকস। হুমকি দেওয়া চিঠিটা ওর হাতেরই লেখা। খামের ঠিকানা অন্য কারও হাতের লেখা। যে হরিবাবুকে হুমকি দেওয়া চিঠিটা ওই ছোকরাকে দিয়ে লিখিয়েছে, সে খুব। সতর্ক। তাই হরিবাবুর ঠিকানাটা নিজের হাতে লিখেছে। পুলিশ যদি হাতের লেখা সনাক্ত করে শেষ পর্যন্ত ছোকরাটিকে পাকড়াও করে, বিপদটা ওর ঘাড় দিয়েই যাওয়ার চান্স ছিল। কিন্তু শেষমেশ হতটা কী? ছোকরাটির তো ওই ধরনেরই পেশা। তবে দেখ জয়ন্ত, ছোকরা বলা মানে গাল দেওয়া। ছেলেটি ভাল বাংলা লেখে। হয়তো খুব গরিব বলে বেশি লেখাপড়ার চান্স পায়নি। কিন্তু চলতি বাংলা চমৎকার আসে ওর হাত দিয়ে। ইচ্ছে করলে ছেলেটি লেখক হতে পারত এবং তোমার চেয়ে অনেক ভাল গদ্য লিখত, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই।
গম্ভীর হয়ে বললাম, আমি কোনও প্রশ্ন করব না কিন্তু। আপনার নির্দেশ।
আমিই তোমার হয়ে প্রশ্ন তুলছি। ছেলেটি হরিবাবুকে কাকু বলে। তাকে হুমকি দেওয়া চিঠি সে লিখল কেন? এর উত্তর হল, চিঠিতে কাকেও সম্ভাষণ করা হয়নি। কাজেই চিঠিটা যে হরিবাবুকে লেখা হচ্ছে, ছেলেটি জানত না। প্রশ্ন উঠবে, ছেলেটি এমন চিঠি লিখতে রাজি হল কেন? না–ছেলেটি জানে কোর্টের পরিবেশে ক্রিমিন্যালরাও ঘোরাফেরা করে। দ্বিতীয়ত, ছেলেটির টাকার দরকার। ওই পরিবেশটাই টাকা রোজগারের নানা ধান্দা-সুযোগ সামনে এনে দেয়। সেই সুযোগ যারা ওখানে ঘোরাফেরা করে, তারা ছাড়ে না। ছেলেটিও ছাড়েনি।
এবার বললাম, ছেলেটি আপনার কেসে মূল্যবান সূত্র।
হ্যাঁ। তবে এখন এই সূত্রের দিকে আমি হাঁটছি না। কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চুরুট ধরালেন। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, তোমার প্রশ্ন ছিল, শচীন্দ্রলাল মুখার্জি নিজের বৈমাত্রেয় ভাইকে চুরির দায়ে ফাঁসানোর জন্য যে বিগ্রহ চুরি করেছিলেন, তা আমি জানলাম কী করে? বিগ্রহ চুরির কথা আমি জানতাম না। তা শোনার পর আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে ওঁর প্রতিক্রিয়া বুঝতে চেয়েছিলাম।
কী বুঝলেন?
ওঁর ক্ষতস্থানে আঘাত করেছি। চিন্তা করো জয়ন্ত! আফটার অল, আমি। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। আমার এই চেহারা এবং ব্যক্তিত্বনা, হেসো না, তুমি বাস্তবতার দিক থেকে চিন্তা করেযতই বদরাগী এবং দুদে আইনজীবী হোন কিংবা অভিজাতবংশীয় হোন, কোনও ভদ্রলোক ওই ভঙ্গিতে অভদ্রভাবে আমাকে বেরিয়ে যেতে বা দারোয়ান ডেকে বের করে দেওয়ার কথা তৎক্ষণাৎ মুখ দিয়ে উচ্চারণ করবেন না। তর্ক করতেন ক্রুদ্ধভাবে। কিংবা আমাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু আমি কথাটা শেষ না করতেই উনি হিংস্র হয়ে উঠলেন। তার মানে, আমার মুখোমুখি আর একমুহূর্ত বসে থাকার ক্ষমতা ওঁর ছিল না। আমি সাধারণ মানুষ হলে অন্য কথা ছিল। কিন্তু আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। আমি উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার ছিলাম। আমাকে–
হ্যাঁ। আপনার কথায় যুক্তি আছে।
এবার আমার থিওরি হল, শচীনবাবু বিগ্রহ নিজেই চুরি করে কোনও বিশ্বস্ত লোকের হাত দিয়ে তরুণবাবুর বাড়িতে পাচার করেই পুলিশে খবর দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বস্ত লোকটির হাত থেকে বিগ্রহ অন্য হাতে চলে যায়। কিংবা এমনও হতে পারে সেই লোকটিই বিগ্রহ আত্মসাৎ করে মিথ্যা কথা বলে শচীনবাবুকে। ক্রুদ্ধ শচীনবাবু তাকে বরখাস্ত করে তাড়িয়ে দেন।
হরিবাবু সেই বিশ্বস্ত লোক নন তো?
এক্ষেত্রে সম্ভাবনা ৯৯ শতাংশ বলা চলে।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে হরিবাবুকে কেউ হুমকি দিয়ে শ্যামবাবুর নোটবই চাইছে। তার মানে, হরিবাবুর হাত থেকে শ্যামবাবু তা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়েছিলেন। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনও কারণে বেচতে পারেননি। লুকিয়ে রেখেছেন।
কর্নেল বললেন, হুঁ, বলে যাও!
তাহলে নোটবইয়ের ওয়ার্ডগেমে এমন কোনও সংকেত আছে, যা থেকে শ্যামবাবুর লুকিয়ে রাখা বিগ্রহের খোঁজ মিলবে। এবার কিন্তু তৃতীয় একটি পার্টি এসে যাচ্ছে।
আসছে বটে! কর্নেল হঠাৎ হেসে উঠলেন। ওয়ার্ডগেম ছেড়ে এখন আমরা থিওরিগেম বা তত্ত্বক্রীড়ায় রত হয়েছি। বাজে জল্পনা ডার্লিং, জল্পনা! বলে হাঁক দিলেন, ষষ্ঠী! আমরা খেতে বসব।
ষষ্ঠী পর্দার ফাঁকে মুখ বাড়িয়ে বলল, সব রেডি বাবামশাই!…
খাওয়ার পর ভাতঘুম আমার বহু বছরের অভ্যাস। ডিভানে লম্বা হয়েছিলাম। কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে একটা গাদা বইয়ের পাতায় মনোনিবেশ করেছিলেন। কতক্ষণ পরে কর্নেলের ডাকে উঠে বসলাম। সাড়ে তিনটে বাজে। শীতের দিনে সাড়ে তিনটে মানে বিকেল। উঠে পড়ো। গরম কফি খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নাও। একটু পরে বেরুব।
ষষ্ঠী কফির ট্রে রেখে গিয়েছিল। কর্নেল কফি তৈরি করে আমাকে দিলেন। নিজেরটা তৈরি করে চুমুক দিয়ে বললেন, বরমডিহিতে দেখা সেই তুর্কি ঘোড়সওয়ার সম্পর্কে কিছু তথ্য পেলাম।
সেই অলক্ষুণে প্রজাপতিটা?
অলক্ষুণে কী বলছ ডার্লিং! মধ্যএশিয়ার এই প্রজাতির প্রজাপতি এদেশে আমদানি করেছিলেন স্বয়ং মুগল বাদশাহ্ জাহাঙ্গির। তার একটা চিড়িয়াখানা ছিল। ফুল বাগিচায় ওই প্রজাপতি–
কর্নেলের কথা শেষ হল না। ডোরবেল বাজল। একটু পরে ষষ্ঠীর পাশ কাটিয়ে হরিবাবু ঘরে ঢুকলেন। ধপাস করে সোফার কোনায় বসে ফোঁস করে শাস ফেলে বললেন, নিয়ে গেল স্যার! ওঃ! কী বাঁচা যে বাঁচলাম। আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে আজ সকাল-সকাল চলে এলাম কাজ ছেড়ে।
কর্নেল বললেন, নোটবইটা?
আজ্ঞে! লোকটার চেহারা স্যার একবারে মস্তানমার্কা। এন বি এনেছ বলমাত্র হাতে তুলে দিলাম। চলে গেল। সাহস করে মুখ তুলে তাকাতে পারিনি। পেছনটা দেখেছি। ওঃ! কী বাঁচা বাঁচলাম ঠাকুরই জানেন!
কর্নেল হাঁকলেন, ষষ্ঠী! একটা পেয়ালা দিয়ে যা। গেস্ট এসেছেন। একটুখানি খান হরিবাবু! উত্তেজনা দূর হবে। নার্ভ চাঙ্গা হবে।
হরিবাবু রুমাল বের করে মুখ মুছলেন। ষষ্ঠী একটা পেয়ালা দিয়ে গেল। কর্নেল পট থেকে কফি ঢেলে দুধ চিনি মিশিয়ে ওঁর হাতে তুলে দিলেন। হরিবাবু চুমুক দিয়ে বললেন, আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ জানাব স্যার! আচ্ছা হরিবাবু, রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ আপনার হাতছাড়া হয়েছিল কীভাবে?
হরিবাবু চমকে উঠলেন। গলায় কফি আটকে কাশতে শুরু করলেন। চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছিল। সামলে নিয়ে বললেন, বি-বিগ্রহ স্যার?।
হ্যাঁ। অ্যাডভোকেট শচীনবাবু আপনাকে বিগ্রহ তরুণবাবুর বাড়িতে কোথাও লুকিয়ে রেখে আসতে বলেছিলেন। কর্নেল হাসলেন। নানা। লুকোবার কিছু নেই। যা হবার তা হয়ে গেছে।
স্যার! শচীনবাবু আপনাকে তা-ই বলেছেন?
বলেছেন। আপনি কফি খেতে খেতে বলুন। উত্তেজিত হবেন না! হরিবাবু কফির পেয়ালা টেবিলে রেখে বললেন, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়। আর উলুখাগড়ার প্রাণ যায়, সেই অবস্থা। আমি স্যার অত রাত্রে ছোটবাবুর বাড়ি ঢোকার সাহস পাইনি। এইটুকু দুটো বিগ্রহ বেদিতে আটকানো। ব্যাগে ভরা ছিল। রাত্রে বাসায় নিয়ে গিয়ে রেখেছিলাম। দিনের বেলা কোনও এক ছলে ছোটবাবুর বাড়িতে রেখে আসার ইচ্ছে ছিল। সেই রাত্রে শ্যামা আমার বাসায় ছিল। বদমাস শ্যামা কী করে টের পেয়েছিল জানি না। ভোরবেলা বাথরুমে গেছি। তারপর এসে দেখি শ্যামা নেই। বিগ্রহও নেই।
কিন্তু শ্যামবাবুর নোটবইটা বিগ্রহের ছবির পেছনে পাওয়া গেল। এর ব্যাখ্যা কী?
সেটাই তো বুঝতে পারছি না স্যার!
আপনি কফি খান। আপনার আর ভয় কিসের? নোটবই দিয়েছেন। হ্যাঁ, কফি খান।
হরিবাবু আড়ষ্ট হাতে কফির পেয়ালা তুলে নিলেন। তাঁকে নার্ভাস দেখাচ্ছিল।
কর্নেল বললেন, আপনি সকালে গিয়ে শচীনবাবুকে ঘটনাটা জানিয়েছিলেন। তাই না?
আজ্ঞে। শুনেই উনি আমাকে চড়থাপ্পড় মেরে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। পুলিশে দেবেন বলে শাসাচ্ছিলেন। কিন্তু আমি আসল কথা ফাঁস করে দিতে পারি ভেবে অত দূর এগোননি।
আপনার নাকের বাঁ-পাশের জডুলটা কতদিন আগে অপারেশন করেছে?
হরিবাবু চমকে উঠলেন। জ-জডুল সার?
হ্যাঁ। জডুল। শচীনবাবু বলছিলেন, আপনার জডুল অপারেশন করাতে বলতেন। আপনি নাকি ভয়ে অপারেশন করাননি। আপনার সেই বরমডিহির গ্রুপ ফোটোতে জডুলটা দেখেছি। কবে অপারেশন করালেন?
হরিবাবুর নাকের বাঁ-পাশে একটুখানি ক্ষতচিহ্ন দেখতে পেলাম। কাল ওটা লক্ষ্যই করিনি।
হরিবাবু বললেন, বছরখানেক আগে স্যার! মরিয়া হয়ে অপারেশন করিয়েছি।
ভাল করেছে। বড় মোটা জড়ুল ছিল। তাই ছবিতে চোখে পড়েছিল।
হ্যাঁ স্যার! মাঝে মাঝে ফেঁড়ার মতো টনটন করত।
কফি খান। আর চিন্তা কী? বলে কর্নেল নিজের পেয়ালা শেষ করে চুরুট ধরালেন। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, শ্যামবাবুর নোটবইটা আমি খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেছি। নোটবইয়ে বিগ্রহ লুকিয়ে রাখার গোপন সূত্র ছিল। আমি তার অর্থ উদ্ধার করেছি।
হরিবাবু আবার চমকে উঠলেন। কোথায় লুকোনো আছে বুঝতে পেরেছেন?
হুঁউ। বরমডিহিতে শচীনবাবুর বাড়িতেই লুকোনো আছে।
হরিবাবু তাকিয়ে রইলেন। নিষ্পলক চাউনি।
কর্নেল বললেন, জয়ন্ত এবং আমি নোটবইয়ে লেখা ওয়ার্ডগেম থেকে সূত্র টের পেয়েছি। জয়ন্ত, তুমি ওঁকে বুঝিয়ে দাও সূত্রটা। তোমার সংখ্যাভিত্তিক হিসেবও দাও।
আমি কর্নেলের কথার লক্ষ্য কী বুঝতে পারছিলাম না। তবু কর্নেল য়ামার হাতে প্যাড গুঁজে দিলে আমি আগের মতো ইংরেজিতে শ্যামবাবুর গ্র্যাব রেয়ার আর্টস বেস্ট শব্দগুলো সাজালাম। তারপর সংখ্যাগুলোও সাজিয়ে ফেললাম। যোগ করে দেখালাম ১৬০ হচ্ছে।
এবার কর্নেল বললেন, শচীনবাবু বলছিলেন, বরমডিহিতে নাকি ওঁর বাড়ি দুইতলায় মোট ২০টা ঘর। ১৬০-কে ২০ দিয়ে ভাগ করলে ৮ হয়। ৮ নম্বর ঘরের মেঝেয় তাহলে বিগ্রহ পোঁতা আছে।
হরিবাবু শুকনো হাসি হাসলেন। আজ্ঞে আমি স্যার ওসব সাতে-পাঁচে নেই। শচীনবাবুদের বিগ্রহ। ওঁদের বলুন। উদ্ধার করে পুজো দিক। আমি উঠি স্যার। নমস্কার।
হরিবাবু চলে যাওয়ার পর বললাম, বেচারাকে খামোকা ভড়কে দেওয়ার কারণ কী? নিরীহ ছাপোষা মানুষ!
কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, আমার থিওরি যাচাই করে নিলাম। শুধ। এটাই জানা গেল না, শ্যামবাবু নোটবইটা ওখানে রেখেছিলেন কেন? যদি বিগ্রহের সঙ্গে সম্পর্কই থাকবে, তা হলে–নাহ। মাথামুণ্ডু কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
কোথায় বেরুবেন বলছিলেন যে?
বেরুব। বলে কর্নেল পোশাক বদলাতে ভেতরের ঘরে ঢুকে গেলেন।