Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ভিস্তিওয়ালা || Roma Gupta

ভিস্তিওয়ালা || Roma Gupta

আগেকার দিনে, প্রায় পঞ্চাশ – ষাটের দশকে কালো চামড়ার বালিশের মতো ” মশক” ভরে জল নিয়ে যারা ফেরি করে বেড়াতো তাদের ভিস্তি বা ভিস্তিওয়ালা বলা হতো।
প্রাচীন ঢাকা শহরে ও কলকাতায় এই ভিস্তিওয়ালাদের বিশেষ প্রভাব ছিল। ঢাকাতে তাদের নিজস্ব পঞ্চায়েত ছিল। পঞ্চায়েত প্রধানকে বলা হতো নবাব ভিস্তি।
সেইসময় প্রতিদিন সকালে ভিস্তি আসতো পাড়ায় পাড়ায় চামড়ার বিরাট মশকে জল ভরে কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে।
বিকট গলায় হাঁক দিত ‘ভিস্তি আবে ‘ অর্থাৎ ভিস্তি এসেছে। মশকের মুখটা খুলে পয়সার বিনিময়ে কলসিতে ঢেলে দিত পানীয় জল। স্নানের জল, রান্নার জলও তারা মশকে করে গ্ৰাহকের বাড়ি পৌঁছে দিত। মশকের জল থাকতো খুব ঠাণ্ডা।
ভিস্তি কথার উৎপত্তি সম্পর্কে বলা হয় , ‘ভেস্ত’ বা ‘বেহস্ত” এই পার্সি শব্দ থেকে হয়েছে। যার বাংলা অর্থ ‘স্বর্গ’।
পশ্চিম এশিয়ার কৃষ্টি সংস্কৃতি অনুযায়ী মনে করা হয় , স্বর্গে রয়েছে প্রচুর নদী, খাল, বাগান। তখনকার দিনের মানুষের বিশ্বাস ছিল , ভিস্তিওয়ালা সব জল নিয়ে আসতো স্বর্গ থেকে।স্বর্গের পবিত্র জল তারা কষ্ট করে মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে, তাই তারা ভিস্তিদের স্বর্গের দূত বলেও মানতো।
ভিস্তিওয়ালাদের প্রাচীন ইতিহাস আছে।
১৫৩৯ সালে একসময় শের খান বিহারসহ মোগল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল জয় করে কনৌজের দিকে অগ্ৰসর হতে থাকে। ওদিকে আবার সম্রাট হুমায়ুন বাংলা জয় করে এগোচ্ছে আগ্ৰার দিকে।
গন্তব্য পথে বিহারের চৌসা নামক স্থানে শের খানের বিশাল বাহিনীর সম্মূখীন হন হুমায়ুন।
১৫৩৯ সালের ২৬শে জুন সম্রাট হুমায়ুন সৈন্যবাহিনীসহ
তাঁবুতে বিশ্রামকালে শের খান অতর্কিতে আক্রমণ করলে দিগ্ধিদিক না ভেবেই সম্রাট হুমায়ুন গঙ্গায় ঝাঁপ দেন।
নদীতে জলের প্রচন্ড স্রোতে ভেসে সম্রাট যখন হাবুডুবু খাচ্ছে তখন ত্রাণকর্তা হিসেবে হাজির হয় ভিস্তিওয়ালা নাজিম। সম্রাটকে সাহায্য করতে সে ছুড়ে দেয় তার খালি মশক। সম্রাট মশক আঁকড়ে ধরলে সে সাঁতরে তুলে আনে। হুমায়ুন খুশি হয়ে সেইসময় কথা দিয়েছিলেন, যদি তিনি আবার দিল্লির তখতে বসতে পারেন , তাহলে ভিস্তিওয়ালা যা চাইবে তিনি দেবেন। মসনদে হুমায়ুন বসলে সেই ভিস্তিওয়ালা উপহারস্বরূপ চেয়ে বসলেন সম্রাটের সিংহাসন। বাদশাহ হুমায়ুন নিজের মুকুট পরিয়ে দেন ভিস্তিওয়ালা নাজিমের মাথায়, বসালেন তাকে সিংহাসনে। তখন ভিস্তিওয়ালা সম্রাটকে আলিঙ্গন করে ফিরিয়ে দিলেন তাঁর মুকুট ও সিংহাসন।
বিংশ শতকের প্রথম দশকে এই পেশার লোক খুব দেখা যেত।’ দ্যা লাস্ট ওয়াটার ম্যান’ হিসেবে ভিস্তিওয়ালারা ইতিহাস বিখ্যাত।
ফরাসিতে ভিস্তিওয়ালাদের বলা হতো ‘সাক্কা’। প্রাচীন ঢাকার সিক্কাটুলীতে ছিল তাদের বসতি। সাক্কা থেকেই সিক্কাটুলী নাম। দিল্লিতে এরা যেখানে থাকতো সেটা সাক্কেওয়ালী গলি নামে পরিচিত ছিল।
থ্যাবড়া নাক, মাথায় কিস্তি টুপি এবং মিশমিশে কালো চাপদাড়িওয়ালা ভিস্তির কথা সাহিত্যে উল্লেখ আছে। রবীন্দ্রনাথ , সুকুমার সাহিত্যে এদের উপস্থিতির সন্ধান পাওয়া যায়।
সামসুর রহমান, হুমায়ুন আহমেদের রচনায় উল্লেখ আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “জুতো আবিষ্কার” কবিতায় এদের নামের উল্লেখ আছে। তিনি লিখেছেন, – ” তখন বেগে ছুটিল ঝাঁকে ঝাঁকে একুশ লাখ ভিস্তি পুকুর বিলে রহিল শুধু পাঁক, নদীর জলে নাহিকো চলে কিস্তি।
সুকুমার রায় তাঁর ন্যাড়া বেলতলায় ক’বার যায়”-ছড়াতে ভিস্তি প্রসঙ্গে লিখেছেন, ” লাখোবার যায় যদি সে যাওয়া ঠেকায় কি
সে “? ভেবে তাই না পাই দিশে নাই কি কিচ্ছু উপায় তার? একথা যেমনি বলা রোগা এক ভিস্তিওলা ঢিপ করে বাড়িয়ে গলা প্রণাম করল পায়ে তার।
সামসুর রহমান শৈশব স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে ভিস্তিদের সম্বন্ধে লিখেছেন, রোজ মশক ভরে দু’বেলা পানি দিয়ে যেত আমাদের বাড়িতে। কালো মোষের পেটের মতো ফোলা ফোলা মশক পিঠে করে আনতো ভিস্তি।তারপর মশকের মুখ খুলে পানি ঢেলে দিত মাটি কিংবা পিতলের কলসীর ভেতর। মনে আছে ওর থ্যাবড়া নাক, মাথায় কিস্তি টুপি, মিশমিশে কালো চাপদাড়ি আর কোমরে জড়ানো পানি ভেজা গামছার কথা “।
মশক মূলত ভিস্তিরাই তৈরি করতো। সাধারণত ছাগলের চামড়া দিয়ে তৈরি করা হতো। কোরবানি ঈদে ছাগল জবাই হলে তার চামড়া ছাড়িয়ে বাছাই করে মশক বানানো হতো। বিশেষ পদ্ধতিতে চামড়া থেকে জীবানু ও দুর্গন্ধ দূর করা হতো। তারপর ২০ ,২৫ দিন জলে ভিজিয়ে রেখে , তুলে শুকোবার পর চামড়াকে জলনিরোধী করবার জন্য মহিষের চর্বি ঘষে মসৃণ করা হতো। এরপর সাদা সুতোয় বিশেষ ধরনের মোম লাগিয়ে সেলাই করে তৈরি হতো মশক। এখনো চটি, জুতো সেলাইয়ের কাজে সেই ধরনের সুতো ব‌্যবহৃত হয়।
ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আমলে ঢাকা গ্ৰন্থ হতে জানা যায় থাকার ম্যাজিস্ট্রেট হেনরি ওয়াল্টারস তাঁর ১৮৩০ সালের আদমশুমারি ‘ সেনসাস অব দ্য সিটি অব ঢাকা’ য় মুসলমানদের যে পেশাভিত্তিক তালিকা তৈরি করেছিলেন, তাতে ১০টি ভিস্তির বাড়ির কথা উল্লেখ আছে।
সময়ের প্রগতির সাথে সাথে এরা অন্য বিভিন্ন ধরনের পেশায় চলে যায় আয়ের কারণে। কমতে থাকে তাদের সংখ্যা।
১৮৭৮ সালে ঢাকা পৌরসভায় গড়ে ওঠে বাড়ি বাড়ি জল সরবরাহের ব্যবস্থা।ক্রমে তা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে বিস্তারলাভ করে। কার্যত তখন থেকেই স্তব্ধ হয়ে যায় ভিস্তিদের পেশাদারী জীবন।
যদিও কোলকাতায় সোত্তর দশক পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় ভিস্তিদের দেখা মিলতো।
আগেকার দিনে যুদ্ধের সময় জল সরবরাহ করতো ভিস্তিরা।
আধুনিক যুগেও কিন্তু ভিস্তিওয়ালাদের অস্তিত্ব রয়েছে একটু অন্য নামে, “জল সরবরাহকারী ভারওয়ালা”।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress