Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ব্রন্টি || Buddhadeb Guha

ব্রন্টি || Buddhadeb Guha

দিনের কাজ প্রায় শেষ, এবার উঠব অফিস থেকে। ঘড়িতেও সাড়ে পাঁচটা বাজে। গজেন আর ঘোষ ছাড়া আর কেউই নেই এখন। আমি উঠলেই জমাদার ঘর পরিষ্কার করবে। দারোয়ান আজকের মতো তালা-টালা লাগিয়ে দিয়ে যাবে বাইরে।

এমন সময় ইন্টারকম-এ ঘোষ বলল, একজন ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, স্যার। বলছেন, আপনার বন্ধু। নাম বরুণ চ্যাটার্জি। অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই।

বরুণ চ্যটার্জি? আমার বন্ধু?

মনে পড়ছে না ওই নামের কোনো বন্ধুকেই। রাত সাড়ে সাতটাতে বলা নেই কওয়া নেই অফিসে এসে হাজির হল কে? কী দরকার? আমি চিনিই না। বলে দাও, এমন অসময়ে দেখা হবে না। আমি এক্ষুনি বেরিয়ে যাব। পরে একদিন অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে যেন আসেন।

পরমুহূর্তেই আবার ইন্টারকম চ্যাঁ চ্যাঁ করে উঠল।

উনি যেতে চাইছেন না স্যার। বলছেন, কোনো কাজে আসেননি, এমনিই এসেছেন। আপনার সঙ্গে কলেজে পড়তেন নাকি। ওঁর ডাকনাম ব্রন্টি।

ব্ৰন্টি? ও হো ব্রন্টি। তাই বল।

আচ্ছা, দু-মিনিট লাগবে আমার। আমি ডিকটেটেড ম্যাটারগুলো দেখে, সই করে দিয়েই ডাকছি। একটু বসতে বলো।

এমিলি ব্রন্টির উইদারিং হাইটস পড়া আর ব্রন্টির সঙ্গে পরিচয় আমার প্রায় একই সময়। তাই-ই ওর নামটি এ জীবনে ভোলার নয়। টাইপ করা চিঠিগুলোতে চোখ বোলাতে বোলাতে ভাবছিলাম। ব্রন্টি। ব্রন্টির ভালো নাম যে বরুণ চ্যাটার্জি, তা ভুলেই গেছিলাম। মনে থাকার কথাও ছিল না। আমরা সকলেই ওকে ব্ৰন্টি বলেই ডাকতাম।

বন্ধু বলতে ঠিক যা বোঝায়, ও তা ছিল না। শুধু আমারই নয়। ও কারোই বন্ধু ছিল না। কারো বন্ধু হওয়ার যোগ্যতা বা মানসিক সমতা ওর ছিল না। ক্ষমতাও বোধহয় ছিল না। কলেজে প্রথম দুবছর শুধু একসঙ্গে কতগুলো কমন ক্লাস করেছি। ব্ৰন্টিচিরদিনই ভুলে-ভালা। ট্রাউজারের মধ্যে এমনভাবে শার্টটাকে ঔজত যে, পিছন দিকে অথবা সামনে দিকেও অনেকখানি শার্ট বেরিয়ে। থাকত। যতদূর মনে আছে, খুব বড়ো পরিবারের অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে ছিল ও। ওদের। প্রাসাদের মতো পৈতৃক বাড়িতেও গেছিলাম একদিন। চমৎকার অ্যাকসেন্টে ডান হাতের তর্জনী নাড়িয়ে কথা বলত। বেশিই ইংরেজিতে। কিন্তু ওর বেশিরভাগ কথারই কোনো মানে ছিল না। মনে হত, ও কাল্পনিক কোনো সঙ্গীর সঙ্গে কথা বলছে।

আমার আর-এক সহপাঠি, রুদ্র, গত সপ্তাহে একদিন ফোন করেছিল বম্বে থেকে। নানা কথার পর বলছিল, ব্রন্টির নাকি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। অবশ্য জানি না, কবেই বা ওর মাথার ঠিক ছিল।

–তোর সঙ্গে দেখা হয়েছে কি রিসেন্টলি?

–না তো! কলেজ ছাড়ার পর আর দেখাই হয়নি। কী করে রে ব্রন্টি এখন? রুদ্রকে শুধিয়েছিলাম।

–করার মতো কিছুই তো করত না। বি-এ পরীক্ষাটাও তো দিল না শেষ পর্যন্ত। কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হয়ে গেছিল, হঠাৎ, মনে নেই তোর?

টাইপ-করা চিঠিগুলো সব সই করে, গজেনকে ডেকে বললাম, কাল সব যাবে ডাকে। আর যিনি ঘোষবাবুর কাছে বসে আছেন, তাঁকে এবারে ডাক। ঘোষবাবুকেও চলে যেতে বল। তুইও ব্রিফকেসটা ড্রাইভারকে নামিয়ে দিয়েই বাড়ি চলে যা। আমি একটু পরই উঠব। দারোয়ানকে বলে যাস।

চেয়ার থেকে উঠে দরজা খুলে দেওয়ার আগেই ব্রন্টি ঢুকল। চেহারাটা অবিকল সেইরকমই আছে, তবে রোদে জলে ময়লায়, তেলচিটে তেলচিটে এই-ই যা। চুলে ও জুলপিতে পাক ধরেছে যদিও, কিন্তু বয়সের ছাপ পড়েনি এখনও তেমন। ননাংরা শার্ট আর ট্রাউজার। শার্টটা ঠিক সেইরকমভাবে গোঁজা। সামনে পেছনে খাবলা খাবলা বেরিয়ে আছে।

ব্ৰন্টি বলল, হ্যাল্লো নাটু, হাউ নাইস টু হ্যাভ মেট উ্য আফটার এইজেস। বললাম, বোসো, বোসো।

ও বসে বলল, থ্যাঙ্কস। হাউ ইজ লাইফ?

–চলে যাচ্ছে। নাথিং টু গ্রাম্বল অ্যাবাউট।

–খুব সুখী তাহলে। ইস সুখী হওয়া কী কঠিন! আমি যদি হতে পারতাম।

–তুমি কি করছ এখন ব্রন্টি?

–আমি? সেইমথিং–। সেইম ওল্ড থিং।

–কোথায় আছ তুমি? আই মীন, কোন কোম্পানিতে? না-কি ব্যবসা-ট্যাবসা বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী?

ব্ৰন্টি সেই ছেলেবেলারই মতো আমার দু-চোখে ওর দু-চোখ রেখে নির্ভেজাল গলায় বলল, আছি মানে, আছি ঠাকুরদারই বাড়ির দোতলার বারান্দারই এক কোণে। এখন সবই ভাগাভাগি হয়ে। গেছে। থাকার ঘর, ভালোবাসা, মন, রান্নাঘর, হৃদয়ের তাপ, সব। ছোটোকাকার সখের কুকুরের নাতির নাতি আর আমার জায়গা হয়েছে একই কোণে। ফারস্ট ক্লাস আছি নাটু। কুকুরের ক্যারেকটার স্টাডি করছি, এক্কেবারে খুবই কাছ থেকে। কুকুরটা একেবারে ডোসাইল। লেজ মাড়ালেও কাউকে কামড়ায় না, অনেকটাই মিডল-ক্লাস ডোসাইল মানুষদেরই মতো। একটা থিসিস তৈরি করব ঠিক করেছি। আ কমপ্যারেটিভ স্টাডি।

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকেই ও বলল, এক গ্লাস জল হতে পারে? বিব্রত হয়ে বললাম, ইস, সকলেই চলে গেল যে! আচ্ছা, আমিই দিচ্ছি। দাঁড়াও–

ঘরের কোণের ছোট্ট ফ্রিজ খুলে ওকে জল ঢেলে দিলাম।

ফ্রিজটা যখন খুললাম, তখন ব্রন্টি বলল, কিছু খাবার হতে পারে? যা হোক কিছু? আমি জেনারেলি লাঞ্চটা ফিরপোতেই করি। আজ করা হয়নি। সময়ই হয়নি।

ফিরপো? অবাক হলাম, আমি। মনটাও খারাপ হয়ে গেল ফিরপোর কথাতে। এখন একটা বাজার বসেছে সেখানে। কলকাতা যদিও ফিরপো ছাড়া কানা হয়ে গেছে। কিন্তু কবে বন্ধ হয়েছে ফিরপো। বছর কয়েক হতে চলল ব্রন্টির মাথা সত্যিই খারাপ।

লজ্জিত গলায় বললাম, খাবার? না, খাবার তো রাখি না ফ্রিজে। শুধু চিজ আছে একটু, খাবে?

–চিজ খাই না। আরে। মাখন আছে দেখছি এক প্যাকেট। হতে পারে?

–আমাদের ক্যান্টিনের মাখন। শুধুই মাখন।

এগিয়ে দিতে দিতে, অ্যাপোলজিটিক্যালি বললাম আমি।

–খাব, খাব। রোজই মাখন খাওয়া উচিত আমার।

জান, নাটু, শরীরে খুবই লাবণ্যর অভাব ঘটেছে। লাবণ্য তো বিয়েও করল না আমাকে। সে-সব ছোটোবেলার কথা। তোমাকে কি কখনো বলেছিলাম লাবণ্যের কথা? জানি না। লাবণ্যর কোনো সাবস্টিট্ট হয় না, হল না। দাও, মাখন দাও। লাবণ্য। হাঃ হা। আমাদের ছিল কাফ-লাভ। আজকাল তো ডগ আর বিচদের যুগ। কী বল? হিঃ। হিঃ। ডোন্টু থিংক সো?

একমুহূর্ত চুপ করে থেকেই বলল, একটু প্রেম, ভালোবাসা, হতে পারে?

একথার উত্তর হয় না। চুপ করে রইলাম।

ব্লন্টি মাখনের প্যাকেটটা খুলে, চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠেই, বলতে গেলে প্রায় চুষেই পুরো প্যাকেটটা একেবারে সড়াৎ করে খেয়ে ফেলল, আমি ডিশ চামচ বের করার আগেই। তারপর। যেটুকু মাখন হাতে লেগেছিল, সেটুকুও দু-গালে মেখে নিয়ে বলল, ন্যাপকিন দেবে নাকি একটা?

ড্রয়ার খুলে ন্যাপকিন দেওয়ার আগেই ও জামাতে ও ট্রাউজারে হাত মুখ সব মুছে ফেলল। চোখ কুঁচকে বলল, শার্ট আর ট্রাউজারটাও একটু লাবণ্যময় হোক। কী বল? হোক। লাবণ্য-নির্মূল জীবন অন্তত আমূল লাবণ্যে ভরে থাকুক। আ-মূল। মাই ফুট। ওয়াট আ সাবস্টিচ্যুট। দ্যাট লাবণ্য, অ্যান্ড দিস।

মনে পড়ে গেল, কলেজে থাকাকালীন ব্রন্টি আধুনিক কবিতা লিখত। ও একবার লিখেছিল, প্রিয়তমা, দেখা হবে আমাদের নিশ্চয়ই গতকাল।

গ্রেট পোয়েট! আমাদের ব্রন্টি! প্রমিস ছিল, কারণ ওর মধ্যে দুর্বাধ্যতার গ্রেটনেস ছিল।

মনে পড়ে গেল, একদিন লাইটহাউস সিনেমার উলটোদিকের বইয়ের দোকান থেকে দা ফ্লাইট অফ দা পাইড হর্নবিলস বলে একটা পেপাকব্যাক বই হঠাৎ কিনে তাতে ও নিজে হাতে লিখে। দিয়েছিল টু ডিয়ার নাটু। আই কুড ডু নো বেটার এন্ড দিস আই বিলিভ।

ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, piedhornbills সম্বন্ধে তোমার বুঝি খুব ইন্টারেস্ট।

ও বলেছিল, দুস। কে জানে? কোনো পাখি-টাখি হবে হয়তো। শিংওয়ালা কোনো জানোয়ারও হতে পারে। হু কেয়ারস?

-সে কী? তাহলে, হঠাৎ আমাকে এই বইটি কিনে প্রেজেন্ট করলে?

–জান না? আজ বোদলেয়ারের জন্মদিন যে। প্রত্যেক কবিকেই আজ উদার হতে হয়। দিস ইজ মাই ওয়ে অফ রিমেম্বারিংদা পোয়েট।

আড়াইশ গ্রাম মাখন খেয়ে লাবণ্যময় হয়ে উঠেব্ৰন্টি বলল, তোমার ছেলে-মেয়ে কী?

-মেয়ে বড়ো। ছোটো ছেলে।

–মেয়ে কত বড়ো? বিয়ে দিয়েছ?

–বয়স হয়নি মেয়ের। মাত্র এগারো বছর। তাছাড়া, বিয়ে তো আস্তে আস্তে উঠেই যাচ্ছে। এখন তো লিভ-টুগেদারের দিন।

–জানি। তবু, আমি পুরোনো দিনের লোক। আমি বিয়েতে আজও বিশ্বাস করি। আমি কিন্তু বিয়েই করব। এবং করলে, তোমায় নেমন্তন্ন করব। তোমার মেয়েকেও।

–কবে হবে? তোমার বিয়ে?

–হাঃ? দ্যাটস আ মিলিয়ন ডলার কোয়েশ্চেন। লাবণ্য নেই। নো হোয়্যার ইন দা ওয়ার্লড। আই হোপ, য়ু নো, হোয়াট আই মিন। লাবণ্য, ইজ আ মাচ ওয়াইডার, ডিপার, ওয়ার্ড। লাবণ্য, বুঝলে নাটু শি ইজ আ সিম্বল। শি ইজট জাস্ট মাই গার্ল। অর, ফর দ্যাট ম্যাটার, এনিবডিজ এলস গার্ল ইদার, শি ইজ আ সুপারলেটিভ এলিমেন্ট, আ কনসেপ্ট, হু মুভস আওয়ারসেলভস ফ্রম উইদিন। মুভস হেভেন অ্যান্ড আর্থ।

একটু চুপ করে থেকে আরেক ঢোক জল খেয়ে বলল, বাই দা ওয়ে, নাটু, আমার এক বোন বলছিল তুমি নাকি আজকাল গল্প লেখা বাংলায়? ফিকশান? বই লেখ? তুমি? নাটু সেন? অফ ওল পার্সনস?

হেসে বললাম, বাংলা সাহিত্য কোন পর‍্যায়ে নেমে এসেছে তাহলে বুঝতেই পারছ! নইলে, নাটু সেনও গল্প লেখে?

–হাঃ। আই লাইক ইট। তোমার সেন্স অফ হিউমার এখনও ঠিক সেইরকমই আছে। ভেরি ফিউ উইল পুল সাচ আ ফাস্টওয়ান অন হিমসেলফ। গ্রেট। বাই দা ওয়ে! হোয়াটস ইওর নেক্সট প্রজেক্ট? অ্যান অটোবায়োগ্রাফি অফ অ্যান ইডিয়ট? অর ফর আ চেঞ্জ, দ্যাট অফ আ মেগালোম্যানিয়াক?

এরও উত্তর হয় না। প্রজেক্ট দু-টিই ভেবে দেখার মতো। চুপ করে রইলাম।

গাড়ি কিনেছ?

কোম্পানি দিয়েছে। বহুদিন।

–ফ্ল্যাট কিনেছ?

–না। বাড়িই তৈরি করছি, সল্ট লেকে।

–নিজের বাড়ি? বাঃ।

–ফরেনে গেছ?

–গেছি একবার।

–কোথায়?

–ব্যাংকক।

–বাঃ। তবে তো গেছই।

–ক্লাবের মেম্বার হয়েছ?

–হ্যাঁ। অনেকদিন।

–কোন ক্লাব?

–ক্যালকাটা ক্লাব।

–তোমার বিয়ের তারিখে ইংরিজি কাগজের পার্সোনাল কলামে তোমার শালির শুভেচ্ছা ছাপা হয়?

–হ্যাঁ। হয় বই কী। শালি ছাড়া আরও অনেকেরই হয়।

এবার মনে মনে আমি বিরক্ত হয়ে উঠছিলাম।

–বাঃ। তবে তো তুমি একজন সম্পূর্ণ মানুষ। টোটাল। সাকসেস তো একেই বলে। কনগ্রাচুলেশনস। জীবনে তোমার আর কীই-বা চাইবার থাকতে পারে? বাঙালির বাচ্চাদের পক্ষে ঢের করেছ। যুগ যুগ জীও। তোমাকে দেখে ছোটোকাকার পেডিগ্রি গ্রেট-ডেন কুকুরের নাতির নাতি পর্যন্ত লজ্জা পাবে। সাববাশ।

কথা ঘুরিয়ে বললাম, তুমি কী কর ব্রন্টি, এখনও খুলে বললে না তো?

–সেইমথিং। বললাম তো। ওঃ খুলে বলিনি বুঝি এখনও? আউচ। দ্যাট বাটার অফ ইয়োরস, রিয়্যাল গুড।

ব্ৰন্টি আরেকটা ঢেকুর তুলল।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, একটা জেলুসেল হতে পারে?

না। নেই। সরি।

ডোন্ট বদার। তোমরা যাকে করা বল তেমন কিছুই করি না আমি। আই অ্যাম সিম্পলি স্যাম্পেলিং লাইফ। গত পঁচিশ বছর ধরে এইই করছি। গ্রেট ফান। নিজের জীবন কুরে কুরে খেয়ে দেখছি ভুট্টার দানার মতো। স্বাদ চাখছি। দেখছি। নোন্তা না মিষ্টি। এক্সপেরিমেন্ট করে। দেখছি, জীবন সলিড, না লিকুইড না গ্যাসি? আই রিয়ালি ডু স্যাম্পল মাই ও-ওন লাইফ। ঠিক কীভাবে বলব জানি না, ধরো যদি বলি, অ্যাজ আ টি-টেস্টার স্যাম্পলস টি। সামথিং ভেরি মাচ অ্যাকিন টুদ্যাট। বুঝলে নাটু। আই এনজয় মাইসেলফ, থরোলি এনজয়, এভরি মিনিট অফ মাই লাইফ। একটা শামুকের মতো, দার্জিলিং-এর রেলগাড়ির মতো। আর তোমরা?

তোমরা সবাই জেট প্লেন। টাকা, নাম, যশ, সিকিওরিটি এসবেরই পেছনে দৌড়ে বেড়াচ্ছ। তাই না? তোমাদের করুণা করি আমি। তোমরা সকলেই–তুমি, রুদ্র, শ্যামল, আ প্যাক অফ স্টুপিড উস।

–আর তুমি? নিজে? তুমি নিজে কি করছ, করলে জীবনে?

–নাটু। আমি রেললাইনেরপাশের টেলিগ্রাফের তারে বসে থাকা ছোট্ট, ননডেসক্রিপ্ট ফিঙে। করার মতো কিছুই করি না আমি। তোমাদের দেখে মজা পাই। তোমরা কেউই জান না, জানবার সময়ই পেলে না যে, লাইফ ইজ ফর লিভিং। তোমাদের জীবন, জীবনই নয় যে, সে একটা অভ্যেস। ইয়েস। ইয়োরস ইজ ওনলি অ্যান অ্যাপলজি ফর আ লাইফ। হোয়াট আ শেম।

বলেই ব্ৰন্টি বলল, কুড়িটা টাকা হতে পারে? খুবই ক্ষিদে পেয়েছে। লাবণ্য তার অস্তিত্বে এবং অনস্তিত্বে মাঝে মাঝেই আমার মধ্যে বড়ো ক্ষিদের উদ্রেক করে। কী দারুণ বাংলা বললাম, দেখলে। তোমার সঙ্গগুণেই কি? গ্রেট।

কুড়ির জায়গায় ওকে এক-শোটা টাকা দিলাম। বললাম, তোমাকে বেশিই দিলাম, যাতে তোমার বার বার না আসতে হয়। সত্যিই আমি খুবই ব্যস্ত থাকি। উইদাউট অ্যাপয়েন্টমেন্টে কারো সঙ্গেই দেখা করতে পারি না। কিছু মনে কোরোনা ব্রন্টি।

ফেয়ার এনাফ। বলল, ব্রন্টি। ফেয়ার এনাফ। তুমি কী বলতে চাইছ বুঝেছি। আর হয়তো আসব না। কিংবা কী জানি, আসতেও-বা পারি। তোমার মাখন বড়ো ভালো। লোকে মাখন দেয়, আমি নেব।

তারপরই বলল, পঁচিশ বছর পর কলেজের বন্ধুর সঙ্গে দেখা হল। আরও জাস্ট দেড়শটা টাকা কী হতে পারে? পার ইয়ারে তাহলে দশ টাকা করে হবে। হিসেবে গোলমাল কোরো না। আমার অ্যাডিশনাল ম্যাথস ছিল। অঙ্কে ভুল হয় না।

–আজই ব্যাঙ্ক থেকে হাজার টাকা তুলেছিলাম। তাই-ই দিতে পারছি তোমাকে।

ব্ৰন্টি হাসল। বলল বড়োলোকেরা এমন বলেই থাকে। দু-নম্বর কী এক নম্বর টাকা, তাতে ভিখিরির কী এসে যায়? দু-নম্বর টাকা হাত বদলালেই তিন নম্বর হয়ে যায়, তাও জান না? নাও, দাও, দাও, আরও দেড়-শোটা টাকা দাও, ফর ওল্ড টাইমস সেক। হতে পারে?

টাকা তুলেছিলাম প্রয়োজন ছিল বলেই। তবু, নাও।

টাকাটা যেই দিলাম, অমনি তা পকেটে পুরে হঠাৎই উঠে পড়ল ব্রন্টি। ডান হাতের তর্জনী নেড়ে বলল, নেভার এক্সপ্লেইন ইওর কনডাক্ট। ন্যো। নট ইভিন টু ইওরসেলফ।

পরমুহূর্তেই, যেমনই আচমকা এসেছিল তেমনই আচমকা উধাও হয়ে গেল ও।

অনেকক্ষণ হতভম্বর মতো চেয়ারে বসে রইলাম। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছিল না। সত্যিই কি ব্ৰন্টি? আমাদের কলেজের বন্ধু ব্রন্টিই?

নীচে নেমে যখন আমি গাড়িতে উঠলাম, তখন দেখি ব্ৰন্টি আমারই অফিসের নীচের জিলিপি সিঙাড়ার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে শুকনো শালপাতার দোনায় দু-হাতে রস আর আলু প্রায় মাখামাখি করে সিঙাড়া জিলিপি খাচ্ছে। পাশে দাঁড়িয়ে একটা ষাঁড় ওকে নিবিষ্টমনে লক্ষ করছে।

ষাঁড়টা হঠাৎ চলি-কি-চলি না করে চলতে আরম্ভ করল, রাস্তা থেকে আবর্জনা কুড়িয়ে খেতে খেতে। জনস্রোত তাকে ধাক্কা দিতে লাগল। ধাক্কা দিতে লাগলব্ৰন্টিকেও। ব্ৰন্টি তখন তার। টুকরো করে ভেঙে-খাওয়া নিজের জীবনেরই একটি টুকরোর মতো সিঙাড়া-জিলিপি স্যাম্পলিং করছিল। আমি যেন শুনতে পেলাম বাঁ-হাতের চেটোয় শালপাতার দোনা ধরে ডান হাত দিয়ে খেতে খেতে ও বলছে, লিভিং ইজ গ্রেট ফান। উ্য ওনলি হ্যাভ টু ফ্লোট উইথ ইট। নেভার ট্রাই টু স্যুইম এগেইনস্ট লাইফ।

ষাঁড়টা চলেছে সোজা। এবার সেন্ট্রাল এভিনিউতে গিয়ে পড়বে। তার মুখ বড়োবাজারের দিকে।

বি আ ফ্লোটসাম।

কে যেন বলল, কানের পাশে।

তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। টাকাটা, কোনো ব্যাপারই নয়। ও আবারও টাকা চাইবে, শুধুমাত্র এই ভয়েই ব্ৰন্টিকে আমি আসতে বারণ করিনি। ও আসলে ভীষণ, ভীষণই খারাপ লোক।

দারোয়ানকে বলে দিতে হবে যাতে ওকে আর কোনোদিনও ঢুকতে না দেয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress