বৃহন্নলা
শেয়ালদা থেকে লালগোলা প্যাসেঞ্জারে উঠেছি।
কাচড়াপাড়া যাবো। লোকজনে ঠাসা।দরজার কাছেই আমি ঝোলানো হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে। পাশেই গা’ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কলকন্ঠে চারটে তরুনী। উগ্র সাজপোশাক,ঠোঁটে রক্তলাল লিপস্টিক।
ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে চলতে সুরু করেছে। আচমকা তীব্র চিৎকারে ঘাবড়ে গেলাম।
‘ হায় রামজী,মেরা বিটুয়া গির গয়ী,কোই তো বাঁচালে- মহা সোরগোল চারপাশে।কি ব্যাপার ! মহিলার পরিত্রাহি বুকফাটা আর্তনাদে বিষয়টি সামনে এলো। এক দেহাতী মহিলা ছোট ছেলে নিয়ে চলন্ত ট্রেনে উঠতে যাচ্ছিলো,ভিড়ে গুঁতোগুঁতি করে কোনরকমে উঠে পড়লেও অকস্মাৎ টাল সামলাতে গিয়ে শিশুটি কোল থেকে ছিটকে পড়ে গেছে। বেচারি মা বুক চাপড়াচ্ছে। কিন্তু , ভোজবাজির মতোই একটি মেয়ে তড়িৎগতিতে ঝাঁপিয়ে নেমে চিলের মতোই ছোঁ মেরে স্টেশন চত্বর থেকে শিশুটিকে বগলদাবা করে বিদ্যুৎগতিতেই ট্রেনে উঠে পড়লো।
ট্রেন তখনো স্টেশন চত্বর পেরোয়নি। ঘটনার আকস্মিকতায় কামরা শুদ্ধু লোকজনের বিস্ময়ের সীমা ছিলো না। কামড়াতে এতো যাত্রী ,অনেকেই শুনেছিলো মহিলার কান্না, কিন্তু সাহস করে চলন্ত ট্রেন থেকে নামার কল্পনাও কেউ করেনি।
শিশুটিকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিলো মেয়েটি, –নাও,তোমার ছেলে ,আর কেঁদোনা।
দেহাতী মহিলাটি কৃজ্ঞতায় জাপ্টে ধরে- হেই মা, তুই হামার লেড়কাকে বচায়ে দিলি,রামজী তুকে কৃপা করবেক মাঈ– মেয়েটি মৃদু হাসলো কেবল। ততোক্ষণে ওর সঙ্গিনীরা বকতে শুরু করেছে,কেন তুই এমন জীবনের ঝুঁকি নিস বলতো?যদি তোর কিছু হয়ে যেতো তাহলে? মেয়েটির মুখে মেঘের ছায়া নেমেই রোদ্দুর হাসে-সে ভাগ্য কি আমার আছেরে? মরন হলেতো ল্যাটাই চুকে যেতো।
আমিও কম অবাক হইনি। আজকাল পরের জন্য এমন মানসিকতা কজনার থাকে? মেয়েটি দুর্দান্ত সাহসী তো বটেই সেইসঙ্গে দৃঢ় মানসিকতার পরিচয়ও দিয়েছে।
ওদের টুকরো টুকরো কিছু কথা কানে যেতেই আমার তীব্র কৌতুহল জাগে। আমি ইচ্ছে করেই আলাপ শুরু করি, ওদের বাদাম, চানাচুর, দিয়ে – এতো বকছো কেন ওকে? দেখো ,কেমন মুখ ভার করে আছে। ওরা আমার কথা শুনে হাসলো। তারপর খেতে খেতে বললো– জানো,মাসি,ও বরাবর এমনি ডানপিটে। নিজের বিপদের কথা একটুও ভাবেনা।কারো কোন বিপদ দেখলেই উনি রক্ষা করতে ছুটেন,ওকে নিয়ে কি যে করি!জানো,গতমাসেই তো সেকি কান্ড!
আমি উদগ্রীব হয়ে বলি– তাই নাকি,কি কান্ড মা?
–এই ,ভালো হবে না বলছি,চুপ কর–
বন্ধুরা মেয়েটির দিকে চোখ পাকায়- কেন চুপ করবো? শোনো মাসি,আমরা একটি অনুষ্ঠান থেকে ফিরছি,এই শেয়ালদা থেকেই ট্রেন ধরে ফিরবো। দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ কানে এলো চেঁচামেচি,কি ব্যাপার! একটি মেয়েকে কতগুলো নচ্ছাড় টাইপের ছেলে ঘিরে ধরে মস্করা করছে।আর,মেয়েটি ভীষন ভয় পেয়ে বাঁচানোর জন্য চিৎকার করে চলেছে। আশপাশের মানুষগুলো,তাকিয়ে দেখছে কিন্তু মেয়েটির সুরক্ষায় এগিয়ে আসছে না।
আমরাও কিংকর্তব্যবিমূঢ়!
ওমা! আমাদের ইনি প্রচন্ড ক্ষেপে মারমুখী হয়ে ছুটে গিয়েই এক হ্যাচকা টানে মেয়েটিকে নিয়ে স্টেশনের ওয়েটিং রুমের দিকে ঢুকে গেলো।
বেশ কিছুক্ষণ পরে দেখি,মেয়েটির পরনে সালোয়ার কামিজের বদলে আমাদের বন্ধুটির আজকের অনুষ্ঠানে উপহার পাওয়া শাড়ি!
আমরা তো হতভম্ব! কি ব্যপার!
আমি বিস্মিত — কি হয়েছিলো মা!
ওরা বিষন্ন সুরে জানালো,মেয়েটি কলেজ থেকে বাড়ি যাবে বলেই স্টেশনে এসেছিলো। কিন্তু অকস্মাৎ ঋতুমতী হয়ে পড়াতে সালোয়ার লালছোপে ভরে যেতেই সে ভীত হয়ে পড়ে।আর,এমন সময়েই দুষ্ট কটি ছেলে ওকে নিয়ে উল্লাসে মেতে উঠে।হয়তো সেদিন মেয়েটির চরম সর্বনাশ হয়ে যেতো যদি না আমরা এসে পড়তাম।তাও,আমরাও তো কিছুই বুঝিনি,ওই মেয়েটির সম্মান রক্ষা করলো।
এমনকি সেদিন মেয়েটিকে নিজের টাকা খরচ করে নিরাপদে বাড়ি ফেরার ব্যবস্থাও করেছিলো।
আমি বিমোহিত হয়ে শুনছিলাম।কি সুন্দর মনের ব্যাপ্তি! জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা ,মা,তোমরা কোথায় থাকো? পলকে ওদের মুখে বেদনার মেঘ ঘনিয়ে উঠে।
প্রাণপনে নিজেদের সামলে হো- হো করে হেসে উঠে, –মাসি,তুমি বুঝি এদিকে নতুন গো?
আমি মাথা নাড়ি– হ্যাঁমা,আমি তো আসামে থাকি, বেড়াতে এসেছি । মেয়েগুলো হেসে ফেলে— তাই বলো,আমরা ঠিক ধরেছি।এভাবে কেউতো আমাদের সাথে গল্প করে না,খেতেও দেয়নাগো,সবাই তো জানে আমরা আসলে কী? চমক লাগে আমার– তোমরা আসলে কি মানে?
– আমরা সবাই হিজড়াগো,
–হি- জ- রা!
আমি টেনে টেনে বলি।কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলো অবশ্য ,আমি আগে কখনো কোন হিজড়াকে দেখিনি। ওরাই বলে–আমরা হিজরা ,জানিনা,কোন জন্মের অভিশাপে এই শাপগ্রস্থ জীবন পেয়েছি।আমাদেরকে ভদ্রলোকেরা বৃহন্নলাও বলে গো–
স্তম্ভিত আমি।
কথা তো নয়,যেন সূচীভেদ্য যন্ত্রণার হৃদয় নিংড়ানো অস্ফুট হাহাকার ঝরছিলো। সেই মেয়েটি আমার মুখ দেখে কি যেন ভেবে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো– তুমি ঠিক মায়ের মতো গো মাসি,তোমাকে ভুলবোনা। বলেই আচমকা এককামড়া লোকের সামনে প্রণাম করতেই বাকি মেয়েরাও । আমি কিছু বলতে যাবার আগেই ট্রেন স্টেশনে ঢুকলো–‘ কাচড়াপাড়া “।
দুমিনিট মাত্র দাঁড়ায় এখানে। একি! তাড়াহুড়ো করে নেমে পড়ি। আমার সম্বিত ফিরতেই তাকিয়ে দেখি– ট্রেন চলতে শুরু করেছে,আর,মলিন মুখে হাত নাড়ছে-বৃহন্নলারা!