বিস্মৃতির অতলে শোভনোদ্যান
জন্মের দ্বিশতবর্ষ পালিত হচ্ছে।আমার ছবির
গলায় রজনীগন্ধার মালা তাতে গোলাপ ঝুলছে।
টানটান করে সাদা চাদর বিছানো টেবিলের উপর মাঝখানে ছবিটি আর তার দু’পাশে ফুলদানিতে ফুলের তোড়া সাজিয়ে সামনে ধূপদানিতে সুগন্ধি ধূপে আমি মুগ্ধ।দেখি সারি
সারি চেয়ারে বসে দর্শক শ্রোতারা। সামনের
চেয়ারে বসে আছেন বিশিষ্ট কয়েকজন।তারা
মঞ্চে উঠে এসে প্রদীপ জ্বালিয়ে স্মরণসভা
শুরু করলেন।
টেবিলের পিছনে দেওয়াল জুড়ে বড় পর্দায় একটি জরাজীর্ণ বাড়ির দৃশ্য ঝুলিয়ে রেখেছে।
আমার দৃষ্টি পড়ে সেই দিকেই। সবাই ব্যস্ত বক্তৃতা শুনতে।সেই সুযোগে আমি খুঁটিয়ে দেখলাম ছবিটি।দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল।
ভগ্নপ্রায় দোতলা বাড়িটির দেওয়ালের চুনবালির
পলেস্তারা খসে পড়েছে। চুন সুড়কিতে গাঁথা ইটের পাঁজর বেরিয়ে গেছে।বাড়ি ঘিরে আগাছার
জঙ্গল ছেয়ে গেছে।দেওয়াল জুড়ে শিকড়ের কঙ্কাল ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিস্তারিত। লোহার বিম
মরিচা পরে ঝরঝরে।দেখে ‘হানাবাড়ি’ বলে মনে
হবে।তাও বাড়িটা কেমন চেনা চেনা লাগছে।জঙ্গল সরিয়ে নামধাম কিছু লেখা আছে কিনা
খুঁজছি। যদিও নামটা পেলাম কিছু অক্ষর মুছে
গেছে। এতো অবহেলা ও সংস্কারের অভাব দেখে মনে খুবই কষ্ট হল।তা সত্ত্বেও নামটা পড়ার
চেষ্টা করলাম।দেখলাম গায়ে লেখা আছে
‘শোভ দ্যা ‘ সাথে ঝুলছে নীল রঙের ভাঙাচোরা
বোর্ড।দুটো অক্ষর কিভাবে মুছে গেল ভাবছি। মুছে যাওয়া অক্ষর বসাতেই শূন্যস্থান
পূরণ করে ফুটে উঠল সেই শব্দ ‘শোভনোদ্যান’।
মনে পড়ে গেল এই নাম তো আমারই দেওয়া।
মঞ্চে তখন বক্তৃতা চলছে।সেই বক্তৃতা শুনেই মনে পড়ে গেল। আর নামটা বের করতে সহজ হয়।
বক্তৃতায় শুনলাম,বালির দেওয়ানগাজিতলা
এলাকায় বাড়িটি অবস্থিত। ২০০৬সালের মে মাসে ‘হেরিটেজ’ তকমা দেয় রাজ্য হেরিটেজ
কমিশন।ওই সময় রাজ্য সরকারের তরফে
বাড়ির সীমানা পাঁচিলের বাইরে তকমা আঁটা
বোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল।বোর্ড লাগানোই
সার।বাড়িটির সংস্কারে প্রশাসনকে আর উদ্যোগী হতে দেখা যায় নি। শুনে মনটা কেমন
ভেঙে গেল।
এরপর মঞ্চে উপস্থিত হলেন রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের চেয়ারম্যান। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,সম্প্রতি বালির কয়েকজন বাসিন্দা
ওই বাড়িটির সংস্কারের জন্য প্রশাসনের কাছে
আবেদন নিবেদন শুরু করেছে।বিষয়টি আমাদেরও নজরে এসেছে। ভেবে দেখেছি সত্যিই বাড়িটির সংস্কারের প্রয়োজন আছে।
একসময় তিনি অত্যন্ত গুণী মানুষ ছিলেন।
আপনারাই বলুন তিনিই তো বাঙালির গর্ব।সেই
হিসাবে কিছু যদি করা যায়। তিনি বললেন,কিছু স্থানীয় বাসিন্দাদের মনেও নানান প্রশ্ন জেগেছে।
১৪ বছর আগে তারা বাড়িটার সংস্কারের জন্য
আবেদন নিবেদন করায় তখন ‘হেরিটেজ’ তকমা
দিয়েছে। সেটা সংরক্ষণের জন্য আবার কেন
আবেদনের প্রয়োজন?তাদের আরও একটি প্রশ্ন,’তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায়’ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
তাঁর এই বাড়িটির আজ জীর্ণ দশা।ইচ্ছে করলে
রাজ্য প্রশাসন সংরক্ষণ করতে পারতো না?
প্রশ্ন দুটি শুনে আমি মনে মনে ভাবছি,এলাকা
বাসির কাছে তবে না জানি আমি কত প্রিয়।
এরপর মঞ্চে এলেন বিধায়ক। তিনিও বললেন,
বাড়িটি সংরক্ষণ করে সেখানে সংগ্রহশালা তৈরীর জন্য পৌরসভাকে বলা হয়েছিল।কিন্তু
পুরবোর্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় আর কিছু
হয়নি।তিনি নাকি এই বিষয় নিয়ে উচ্চস্তরে কথা
বলবেন।শুনে আমার ভাল লাগলো। মনে মনে
বললাম কথাটা তাড়াতাড়ি পারলেই হয়।কাজটি
শুরু হলেই বেশি খুশি হই।
এখন দ্বিশতবর্ষ চলছে। আমি তো জানি, আমার
লেখা ‘চারুপাঠ’ছিল তখনকার পাঠ্যপুস্তক। এই
পুস্তক থেকেই অর্জিত অর্থ দিয়ে বালিতে তৈরী
করেছিলাম এই ‘শোভনোদ্যান’।বাড়ির পাশাপাশি
আমি নিজেই হরেক প্রজাতির গাছের বাগান তৈরী করি এবং জীবাশ্ম, প্রবাল ও বিভিন্ন ধরনের পাথরের একটি সংগ্রহশালাও তৈরী করি।
এরপর, ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স
এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ — এর ভিজিটিং
প্রফেসর আমার উপরে গবেষণা করেছেন।
তাঁর কথায়,”বিদ্যাসাগর এই বাড়িতে এসে বলেছিলেন,এটা চারুপাঠের চতুর্থ সংস্করণ”।
হেরিটেজ বাড়ির বেহাল অবস্থা দেখে তিনিও ক্লিষ্ট।
বিদ্যাসাগরের কথা তুলতেই আমার মনে পড়ে গেল, ১৮৫৫ সালে বিদ্যাসাগর কলকাতায়
‘নর্মাল স্কুল’ স্থাপন করে প্রধান শিক্ষক পদে
আমাকেই নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু শারীরিক
অসুস্থতার কারণে ওই চাকরি আমি ছাড়তে
বাধ্য হই।ধর্মনীতি,ভূগোল, পদার্থবিদ্যাতেই
আমার আকর্ষণ ছিল।
শুনলাম ১৮৮৬ সালের মে মাসে এই বাড়ির সঙ্গে
আমার বিচ্ছেদ ঘটে। লবনাক্ত জল গড়িয়ে আসে গালে।ইসস আরও কত কাজ করব
ভেবেছিলাম। তা আর শেষ হল না,অসম্পূর্ণ থেকে গেল।কিন্তু যতটুকু আমি করেছি,তার এতো অবহেলা?দেখে আমি কষ্ট পেলাম।
আরও জানতে পারলাম বালি পুরসভার কোন
রেকর্ড এখন নাকি আর পাওয়া যায় না।অথচ
বালির শ্মশানে আমার দাহকার্য হয়।এও জানলাম, বালি ও কলকাতায় আয়োজিত আমার স্মরণ সভায় পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল যে,আধুনিক বিজ্ঞানের ধারণাকে সহজ
বাংলায় প্রকাশ করে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন
করা হবে।কিন্তু তার কিছুই হয়নি।’ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ গ্রন্থের লেখক
অক্ষয়কুমার দত্তকে শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মরণ সভার সমাপ্তি ঘোষণা করল। দুঃখ পেলাম, ভাবছি প্রশাসনের লোকজন কত অলস।
এতো কিছু শুনে আমার মনে তাই ছোট্ট প্রশ্ন —
জন্মের দ্বিশতবর্ষেও কি সাধারণ মানুষের কাছে
আমি বিস্মৃত থাকব?