বিন্তির কথা
সময়টা সত্তর কি বাহাত্তর সাল। ক্লাশ সেভেন টেভেনে পড়ি , তখন ছেলে মেয়ের একসঙ্গে স্কুল করা এক কথায় অসম্ভব। অল্প কিছু ইংরাজি মাধ্যমের স্কুল তখন কলকাতাতে ছিল যেগুলো কো-এড। আরও একটা কথা তখন পাড়াগুলো ছিল এক একটা একান্নবর্তী পরিবার। একথা বলার কারণ একটাই , বর্তমানে সেই সাবেকি পাড়া কালচার আর খুঁজে পাওয়া যায় না ।আরও একটা বিষয়, ইদানিং বেশকিছু উইচিংড়ে মার্কা জনগণ একটা পূণ্য উপাসনার দিনকে পাশ্চাত্যের চ্যাংড়ামো মার্কা একটা প্রেমের দিনের সঙ্গে এক করে ফেলেছে। এদের মত অত্যাধুনিক গণ্ডমূর্খ আর নেই। যাই হোক , সেই সময় ছেলে এবং মেয়েদের প্রেম থাকলেও তার বাস্তব রূপায়ণ হতই না বলে চলে । সবটাই মনে মনে আর আসা যাওয়ার পথের ধারে আড়চোখে চাওয়াতেই সীমাবদ্ধ ছিল। আমাদের পাড়াতে দু একটি নাকউঁচু বা অমিশুকে পরিবার বাদে অন্যদের বাড়িতে পাড়ার লোকেদের প্রবেশ ছিল জলভাত। আমাদের পাড়াতেও সরকার আর পাল বংশ ছিল ঠিক এইরকম। অন্যদিকে ব্যানার্জী বাড়ি ছিল এক্কেবারে উল্টো মেরুর। বনেদি পরিবার, পৈত্রিক ব্যবসা , অঢেল অর্থ , প্রাসাদের মত বাড়ি থাকলেও এই দুই বাড়ির লোকগুলো ছিল আটপৌরে। সরস্বতী পুজোর দিনে থাকত অঢেল ভোগ খাওয়ার ব্যবস্থা। আমরা অনেকেই নিজের বাড়ির পুজো ছেড়ে ব্যানার্জী বাড়িতে সকাল থেকে পরে থাকতাম। কাগজের শিকল বানিয়ে আটকানো, টুনি লাইট লাগানো, ফল ধুয়ে দেওয়া ,অনেক কাজ থাকত। জ্যেঠু আর জেঠিমার নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতাম। সেইরকম এক বছর তাকে দেখলাম। ” বিন্তি ” , ব্যানার্জীদের কাজের লোক মানদা পিসির মেয়ে। বয়স হয়ত তখন চার কি পাঁচ। কালো গায়ের রং হলেও মুখটা খুব মিষ্টি ছিল। ছাদে প্যান্ডেল খাটিয়ে পুজো হত। বিন্তি এককোণে চুপ করে বসে পুজো দেখত। অঞ্জলি দিত। ব্যানার্জীদের ছোট ছেলে বাপ্পা আমার সমবয়সি। ও অন্য স্কুলে পড়ত, কিন্তু পাড়ার বন্ধু হিসেবে খুব কাছাকাছি থাকতাম দুজনে। বছর গড়ায়, বিন্তি ওই একদিনই বাপ্পাদের বাড়িতে আসে। বাপ্পার বাবা এইরকম একবছর পুজোতে বিন্তির হাতেখড়ি দিল। জেঠিমা মানদা পিসিকে আদেশ দিলেন রোজ বিন্তিকে নিয়ে আসতে, তিনি পড়াবেন। মানদা পিসি বলেছিল এত ছোট মেয়ের কি রোজ রোজ ডেলি প্যাসেঞ্জারি করা কি সম্ভব ? অগত্যা বিন্তির পাকাপাকি ঠাঁই হল ব্যানার্জী বাড়িতে। বাপ্পার নিজের বোন নেই। আমরা ইলেভেনে যখন বিন্তি ভর্তি হল রাজরাজেশ্বরী স্কুলে ফাইভে। ক্রমশ বিন্তি শুধু পদবি অক্ষুন্ন রেখে বকলমে প্রিয়া ব্যানার্জী হয়ে উঠল। জেঠিমা, বাপ্পা আর মাঝেমাঝে জ্যেঠুর শিক্ষাদানে হয়ে উঠতে লাগল লেখাপড়াতে চৌখস। স্কুল বদল হল, গেল লি কলিন্স স্কুলে। আমরা কলেজের শেষ বছরের পরীক্ষা দিলাম আর বিন্তি ফার্স্ট ডিভিশন পেয়ে মাধ্যমিক পাশ করল। ইতিমধ্যে তিনবারের চেষ্টাতে বাপ্পা ডাক্তারি পড়তে ঢুকল, আমরা কেউ আর্টস কেউ কমার্সেই রইলাম। সময়ের স্রোতে ভেসে আমরা সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছি , বাপ্পা ইন্টার্ন, বিন্তি প্রেসিডেন্সিতে ভূগোল নিয়ে সেকেন্ড ইয়ার অনার্স। মানদা পিসি কাজ ছেড়ে দিয়েছে, শরীর খারাপ বলে, তবে মাঝেমধ্যেই আসে, একটা গোটা দিন কাটিয়ে ফিরে যায়। বিন্তি এখন পুরোদস্তুর শহুরে, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার গন্ধ সে কবেই পুঁছে ফেলেছে। বিএসসি পার্ট ওয়ানে দুরন্ত রেজাল্ট করল বিন্তি। আমি কোচবিহারের পোস্টিং, বন্ধুরা যে যার মত কক্ষপথ খুঁজে নিয়েছে, বাপ্পা চন্ডীগড়ে পিজি করছে, ব্যানার্জী বাড়ির সরস্বতী পুজো জৌলুস হারিয়েছে, খবর পাই।
কি ভাবছেন বিন্তির জীবনের ইচ্ছেপূরণের গল্প ফেঁদেছি ? আর একটু দেখি বরং।
বাপ্পা চান্স পেল চেরিংক্রশ হসপিটাল, লন্ডনে, গবেষণা করতে। পড়তে গেল, বছরে একবার বাড়ি আসে, কালি পুজোর সময়, ভাইফোঁটা সে বিন্তির হাতে নেবেই, তাই। আমি তখন পুরুলিয়াতে, বাপ্পা এলো একটা অবাঙালী বিষাক্ত কিটকে নিয়ে। ছেলেটা উত্তরপ্রদেশের, কর্মসূত্রে আফ্রিকার কোন এক দেশে থাকে, ডেপুটেশনে ইংল্যান্ডে যায় আর কি ভাবে যেন বাপ্পার সঙ্গে পরিচয় হয়। সেই মনোহর বলে পুরুষের প্রবেশ ব্যানার্জী বাড়িতে। বিন্তি তখন মাস্টার্সের বেড়া সসম্মানে টপকে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের চেষ্টা করছে কিন্তু ওই যে মদনদেবের কৃপা। বিয়ে হয়ে গেল, এসেছিলাম, খাটাখাটুনিও করেছিলাম। জ্যেঠু বেশ কয়েক বছর আগেই মারা গিয়েছিলেন। জেঠিমার শরীর ভাল যাচ্ছিল না। বিয়ের পরে বাপ্পা মা’কে নিয়ে বিলেত চলে গেল, ব্যানার্জী বাড়ি অন্ধকার হল। বিন্তি লন্ডন হয়ে আফ্রিকার কঙ্গো ঘুরে উত্তরপ্রদেশের গ্রামের শ্বশুরবাড়িতে থিতু। তার লেখাপড়া ,ক্যারিয়ারের অপমৃত্যু হল। মনোহর স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে লন্ডনে ছিল, মেয়াদ শেষ হতেই পাততাড়ি গোটাল। বাপ্পাদের জীবন থেকে বিন্তি হারিয়ে যেতে লাগল। ওর শ্বশুরবাড়ির কোন আতাপাতা জানা নেই। আমাকে ফোনে সব বলল এমনকি মনোহর কঙ্গোতে যে হসপিটালে ছিল তার চুক্তি শেষ হতে ও চলে গেছে দেশে এইটুকু খবর সম্বল। এ তো খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজা। আমি তখন আরামবাগের এস ডি ও, কপাল ঠুকে ডি এমকে ধরলাম। প্রথমে বিরক্ত হলেও একঘন্টা সময় দিয়ে সব শুনলেন। বললেন কাজটা রিয়েলি টাফ তবে উনি চেষ্টার ত্রুটি রাখবেন না। বাপ্পা সব শুনে এমারজেন্সি ছুটি নিয়ে কলকাতাতে এল, মা’কে মেম বৌয়ের কাছে রেখে। ডি এম দশ মিনিট সময় দিলেন। বাপ্পার কথা থেকে বেশ কিছু নোট নিয়ে বাড়ি যেতে বললেন। ফের চরৈবেতি। কেটে গেল সাত আট মাস। বাপ্পা ঝিমিয়ে গেছে। আমিও ভুলতে বসেছি, ডি এম ততদিনে রাজস্ব দপ্তরের সেক্রেটারি। একদিন দুপুরে হটাৎই ফোন। পরেরদিন দেখা করতে যা খবর পেলাম। কঙ্গোতে চাকরি করত বলে মনোহরের খোঁজ তাড়াতাড়িই পাওয়া গেছে কিন্তু বনিবনা না হওয়ার জন্য বিন্তি তার শ্বশুরবাড়ি ত্যাগ করেছে বহুদিন হল এবং মনোহর বিন্তির বাড়ি ত্যাগের পরে থানাতে ডায়েরিও করেছে। এইটুকু খবর উনি পেয়েছেন, মনোহরের ঠিকানা আমাদের দিচ্ছেন আমরা যেন সরজমিনে তদন্ত করে আসি ,কারণ মনোহরদের বাড়ির রেকর্ড ভাল নয়, কোন অসুবিধে হলে ফোন করতে যাতে উনি সর্বতভাবে সাহায্য করতে পারেন। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাতেই বাপ্পাকে সব জানালাম। চিন্তিত বাপ্পা বলল সে ছুটি নিয়ে তাড়াতাড়িই কলকাতাতে আসবে। সাতদিনের মাথায় বাপ্পা এল। ডি এম সাহেব লক্ষ্ণৌতে ডি আই জিকে বলে রেখেছিলেন। দুজনে দেখা করতে উনি এক লিয়াঁজো অফিসারকে আমাদের সঙ্গে জুড়ে দিলেন। শুরু হল বিন্তিকে খোঁজা। মনোহররা যাদব সম্প্রদায়ের। অঢেল বিত্তের মালিক। সে এখানে আর থাকে না, ওর ভাইরা ছিল। যা বলল তার সারকথা , মনোহর বিন্তিকে এখানে রেখে ফের বিদেশ চলে যায়, ওর মন মানসিকতার সঙ্গে এদের পরিবারের মিল না হবার জন্য একদিন তুমুল কথা কাটাকাটি হয় আর তার পরেই বিন্তি বাড়ি ছেড়ে চলে যায় ওর সমস্ত গয়না আর কিছু জামাকাপড় নিয়ে। দু তিন অপেক্ষার পরে ওরা থানাতে ডায়েরিও করে, সেই কাগজ দেখলাম। মনোহর খবর পেয়ে এসে বাড়িতে তুমুল ঝামেলা করে সেও চলে যায় আর তারপর থেকে সে কোনও যোগাযোগ রাখে না। সব শুনে আমরা হতবাক। যদিও আমার মনে বিষয়টা নিয়ে একটা খটকা লাগছিল। হোটেলে ফিরে বাপ্পাকে আমার মনের কথা বললাম। সেও বুঝলো। দুদিন পরে ফের গেলাম। একই কথার পুনরাবৃত্তি। চিন্তিত মুখে দুজনে গ্রাম ঘুরছি, হটাৎই আখ ক্ষেতের ভেতর থেকে একটা দেহাতী লোক আমাদের ডাকল। কাছে যেতেই সে যা বলল তা শুনে আমাদের চোখ কপালে। ওর কথার সারমর্ম হল, গ্রামটা সবদিক থেকেই পশ্চাদপর, তার মধ্যে মনোহররা পয়সাওয়ালা এবং গুন্ডাবাহিনী পোষে। তাই ভয়ে বা ভক্তিতে এলাকার মানুষদের কাছে ওরা জমিদার। ওরাও অল্প শিক্ষিত,তার মধ্যে মনোহর ডাক্তারি পাশ করাতে ওদের মান ইজ্জত বেড়ে যায় শতগুণ। আরও দাপট বাড়ে। আর মনোহর একটা ব্যবসা আরম্ভ করে। সে ওই ডিগ্রি ভাঙিয়ে বিয়ে করে আনে, মেয়েটার সর্বনাশ করে তার গয়নাগাঁটি কেড়ে নিয়ে হয় তাড়িয়ে দেয় না হলে খুন করে বডি লোপাট করে, শুধু তাই নয় ওর পরিবারের সকল পুরুষরা মেয়েটাকে উপভোগ করত। এরপরে যখন আর আশেপাশের গ্রাম বা শহর থেকে ও মেয়ে পেল না তখন দেশের বাইরে চাকরি নিয়ে চলে গেল আর সেখানে জাল বিছিয়ে ব্যবসা শুরু করল। ইতিমধ্যে ওর এক কাকা বিধায়ক আর এক পিসে সাংসদ হওয়াতে ওদের প্রতাপ এতটাই বেড়েছে যে কেউই প্রতিবাদ করতে পারে না। পুলিশ প্রশাসনকে ওরা কিনে রেখেছে, নামিদামি উকিল ওদের চাকর, কত বাবা মা মেয়ের খোঁজ করে হয়রান হয়ে গেছে কিন্তু ওদের কিছুই হয়নি। ইদানিং ওরা দু’গ্রাম পরে আরেক বাহুবলি উমর শেখের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, মেয়েগুলোকে গুষ্টিশুদ্ধু ভোগ করে ওর কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। তোমাদের দেখছি বেশ কিছুদিন ধরে, গ্রামে তো কোন কথা চাপা থাকে না, তাই বলছি উমর শেখকে ধরলে তোমাদের মেয়ের সন্ধান পেলেও পেতে পারেন এখানে পাবে না। আর ওরা যদি জানতে পারে আমার কথা তাহলে আমার দিন শেষ, যাও যাও, এখান থেকে এবার চলে যাও। লোকটা আখ ক্ষেতের জঙ্গলে হারিয়ে গেল, আমরা বিমূঢ়। ফিরে এলাম লক্ষ্ণৌতে। ফের জানালাম পুলিশকে, একটু ইতস্তত করে বাহিনী পাঠাল। ধরা পড়ল উমর শেখ, মনোহরের টিকিও পাওয়া গেল না। জারি হল রেড অ্যালার্ট। উমর শেখের কাছ থেকে খবর পেলাম বিন্তির, ছবি দেখে সে চিনতে পেরেছিল। বিন্তিকে উদ্ধার করলাম পুণের এক পতিতালয় থেকে। তখন মোটামুটি অর্ধউন্মাদ। আমি আর বাপ্পা ওকে এনে একটা হোমে রাখলাম। ধীরে ধীরে সুস্থ্য হতে লাগল বিন্তি। এক জারজ কন্যার মা আজ ফের সমাজের মূল স্রোতে ফিরতে পেরেছে। আজ বিন্তি একটা স্কুলের শিক্ষিকা। আমাদের সকলের চোখের মনি বিন্তির মেয়ে রিনি। বিন্তির ইচ্ছে ও কলেজের প্রফেসর হবে। আমরা তো আছি, তোমরা থাকবে তো বিন্তির পাশে ?