Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বিজয়নগরের হিরে || Sunil Gangopadhyay » Page 4

বিজয়নগরের হিরে || Sunil Gangopadhyay

চোখ মেলার পর সন্তু দেখতে পেল আকাশে কয়েকটা তারা ঝিকমিক করছে। চারপাশে জমাট বাঁধা অন্ধকার। দু-এক মিনিট সন্তু আকাশের দিকেই তাকিয়ে রইল। সে যে কোথায় শুয়ে আছে তা নিয়ে চিন্তাও করল না।

একটু-একটু করে ঘুমের ঘোর কেটে তার মাথাটা পরিষ্কার হতে লাগল। সে চিত হয়ে শুয়ে আছে। পাশের দিকে হাত চাপড়ে বুঝতে পারল, বিছানা নেই, পাথর ও ঘাস। এটা তা হলে কোন্ জায়গা?

চারপাশে ঝিঝি ডাকছে। আকাশ ছাড়া আর কোনও দিকে কিছু দেখা যাচ্ছে। গাছের ডালপালার মধ্যে বাতাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে মাঝে-মাঝে। এটা কি তা হলে কোনও জঙ্গল?

প্রায় খুব কাছেই একটা শেয়ালের ডাক শুনে ধড়মড় করে উঠে বসল। শেয়ালটা হঠাৎ এত জোরে ডেকে উঠেছে যে, তার বুকটা ধক করে উঠেছে। এদিক-ওদিক হাত চালিয়ে সে একটা পাথরের চাঁই খুঁজে পেয়ে সেটা ধরে বসে রইল।

কিন্তু শেয়ালটা তাকে কামড়াতে এল না। শুকনো পাতার ওপর দৌড়োবার শব্দ শুনে বোঝা গেল, সেটা দূরে চলে যাচ্ছে।

শেয়ালটার ডাক শুনে চমকাবার জন্যই তার মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গেল একেবারে।

এবারে সে মনে করবার চেষ্টা করল কী কী ঘটেছে। সকালবেলা সবাই মিলে বেড়াতে আসা হল হামপিতে। মোহন সিং তাদের খাতির করে বসাল একটা তাঁবুতে। কাকাবাবুকে ডেকে নিয়ে গেল, ওদের শরবত খেতে দিল। তারপর? আর কিছু মনে নেই।

ওই শরবতের মধ্যে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল!

ওরা কি মৃত ভেবে সন্তুকে এই পাহাড়ি জঙ্গলে ফেলে দিয়ে গেছে?

সন্তু নিজের গায়ে হাত বুলোল। তার নাক দিয়ে নিশ্বাস পড়ছে। তা হলে সে মরেনি। উঠে দাঁড়িয়ে সে দু-তিনবার লাফাল। না, তার শরীরে ব্যথা-ট্যথাও কিছু নেই। সে শুধু অজ্ঞান হয়ে ছিল এতক্ষণ।

অন্য সবাই কোথায় গেল?

অন্ধকারটা এখন অনেকটা চোখে সয়ে গেছে। একটু-একটু জ্যোৎস্নাও আছে। অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে গাছপালা। এই বনে শেয়াল ছাড়া আরও কোনও হিংস্র জন্তু আছে নাকি? পাথরের চাঁইটা সন্তু আবার তুলে নিল মাটি থেকে।

কাকাবাবুর অসম্ভব সাহস। বাঘের গুহায় মাথা গলাবার মতন তিনি মোহন সিং-এর নাম করেই হামপির মধ্যে ঢুকলেন। তারপর মোহন সিং-এর সঙ্গেই নির্ভয়ে কোথায় চলে গেলেন! কাকাবাবুও কি ওই শরবত খেয়েছেন? মোহন সিং আগেই কাকাবাবুকে সরিয়ে নিয়ে গেল। কাকাবাবু থাকলে বোধহয় একচুমুক দিয়েই ওই শরবত যে বিষাক্ত তা বুঝতে পারতেন।

জোজো আর রঞ্জনদার কী হল? রিঙ্কুদি সবটা খায়নি। রঞ্জনদা খেয়েছে দেড় গেলাস। সর্বনাশ!

এখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে কোনও লাভ নেই। জায়গাটা ঢালু মতন। মনে হচ্ছে কোনও পাহাড়ের মাঝামাঝি জায়গা। এখান থেকে নামতে হবে।

একটুখানি যেতেই সন্তুর পায়ে কিসের যেন ধাক্কা লাগল। পাথর কিংবা গাছ নয়, কোনও জন্তু কিংবা মানুষ!

প্রথমে ভয় পেয়ে সন্তু ছিটকে সরে এল। কিন্তু প্রাণীটা কোনও নড়াচড়া করছে না দেখে সে ভাবল, তাদেরই দলের কেউ হতে পারে। হ্যাঁ, মানুষই, একপাশ ফিরে শুয়ে আছে। প্যান্ট পরা।

কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে সে মানুষটির মুখে হাত বুলিয়ে দেখল দাড়ি নেই। তার মানে রঞ্জনদা নয়। তা হলে জোজো।

সে ধাক্কা দিয়ে ডাকতে লাগল, জোজো, এই জোজো, ওঠ।

কোনও সাড়াশব্দ নেই। সন্তু নাকের নীচে হাত নিয়ে দেখল, নিশ্বাস পড়ছে। গাটা ঠাণ্ডা নয়। তা হলে জোজোও বেঁচে আছে।

বেশ কয়েকবার ধাক্কা দেবার পর জোজো হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, কে? কে? কে? কে?

সন্তু বলল, ভয় নেই, আমি! আমি! উঠে বোস!

জোজো বলল, আমি কে? কে আমি?

সন্তু বলল, আমায় চিনতে পারছিস না? উঠে বোস। এখানে সাপ-টাপ থাকতে পারে।

সন্তু জানে যে জোজো সাপের কথা শুনলেই দারুণ ভয় পায়। কিন্তু এখন সে তা শুনেও উঠল না। কাতর গলায় বলল, সন্তু, আমার মাথাটা পাথরের মতন ভারী হয়ে আছে। আমায় টেনে তোল। আমি উঠতে পারছি না, এত জলতেষ্টা পেয়েছে যে গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

সন্তু তাকে ধরে-ধরে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল, এটা একটা পাহাড়, এখানে জল কোথায় পাব? চল, নীচে নেমে দেখি!

আমি হাঁটতে পারব না রে, সন্তু! পায়ে জোর নেই। বুকটা ধড়ফড় করছে?

চেষ্টা করতেই হবে। আমাকে ধরে আস্তে-আস্তে চল। কাকাবাবু কোথায়? জানি না! রঞ্জনদাদেরও খুঁজতে হবে। ভাগ্যিস তোকে পেয়ে গেলুম!

আমার মাথাটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। আমি আর বাঁচব না, কিছুতেই বাঁচব না এবার। মা-বাবার সঙ্গে আর দেখা হবে না! এই অন্ধকারের মধ্যে তুই কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস আমাকে?

অত ভেঙে পড়িস না, জোজো। পাহাড়ের নীচে গেলে একটা কোনও রাস্তা পাওয়া যাবেই। সত্যি, আমার অন্যায় হয়েছে। তুই এবার আসতে চাসনি, তোকে আমি প্রায় জোর করে নিয়ে এসেছি। এরকম যে কাণ্ড হবে ভাবতেই পারিনি। এবার তো শুধু বেড়াবার কথা ছিল।

আমরা এই পাহাড়ের ওপর এলুম কী করে? আমরা কতদিন অজ্ঞান হয়ে ছিলুম? আজ কত তারিখ?

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না এখনও!

খানিকটা নেমে আসার পর সন্তু দাঁড়াল। জোজোকে প্রায় পিঠে করে বয়ে আনতে হচ্ছে বলে সে হাঁপিয়ে গেছে। মাঝে-মাঝে শুকনো পাতার ওপর খরখর শব্দ হচ্ছে, তা শুনে চমকে-চমকে উঠতে হয়। মানুষ না কোনও জন্তু? হঠাৎ দূরে আর-একটা শেয়াল ডেকে উঠতেই জোজো ভয় পেয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরল সন্তুকে।

সন্তু বলল, সিধে হয়ে দাঁড়া, জোজো। তুই আর-একটু হলে আমাকে ফেলে দিচ্ছিলি! শেয়ালের ডাক চিনিস না? শেয়াল আমাদের কী করবে?

জোজো বলল, যদি এই জঙ্গলে বাঘ থাকে?

বাঘ থাকলে এতক্ষণে আমাদের খেয়ে ফেলত অজ্ঞান অবস্থাতেই!

পাহাড়ের ওপর দিকে বাঘ থাকে না, নীচের দিকে থাকতে পারে!

তা বলে কি আমরা নীচে নামব না? শুধু-শুধু ভয় পেয়ে কোনও লাভ নেই। সব সময় বাঁচার চেষ্টা করতে হয়। এবার তুই নিজে নিজে হাঁটতে পারবি না?

হ্যাঁ পারব।

আমি ভাবছি, রঞ্জনদারা কোথায় গেল? আর সবাইকেও এই পাহাড়েই। ফেলে দিয়ে গেছে? কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে খুঁজব কী করে?

চেঁচিয়ে ডাকব?

ওরা যদি এখনও অজ্ঞান হয়ে থাকে? তবু ডেকে দেখা যাক!

দুজনে একসঙ্গে গলা মিলিয়ে চিৎকার করতে লাগল, রঞ্জনদা! রিঙ্কুদি!

কাকাবাবু!

বেশ কয়েকবার গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়েও কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। কাছাকাছি দু-একটা গাছের পাখিরা ভয় পেয়ে ডানা ঝটপটিয়ে উঠল।

জোজোর হাত ধরে সন্তু বলল, দিনের আলো না ফুটলে জঙ্গলের মধ্যে ওদের খোঁজা যাবে না। বরং তার আগে আমরা নীচে নেমে দেখি, অন্য কোনও সাহায্য পাওয়া যায় কি না! আমার হাত ছাড়িস না!

জোজো বলল, আমি জলতেষ্টায় মরে যাচ্ছি। আমার বুক ফেটে যাচ্ছে! মনে হচ্ছে তিন-চারদিন জল খাইনি।

আর খানিকটা নামতেই জঙ্গলের মধ্যে একটা রাস্তা পাওয়া গেল। সামান্য জ্যোৎস্নার আলোয় সেই রাস্তা ধরে-ধরে ওরা এগোতে লাগল। পাহাড়টা বেশি উঁচু নয়, টিলার মতন। সমতলে পৌঁছতে আর ওদের দেরি হল না।

সামনেই ওরা দেখতে পেল একটা নদী। জলে কেউ নেমেছে, সেই আওয়াজ হচ্ছে। একটুখানি এগিয়ে একটা বড় গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সন্তু দেখল, একটা কোনও জন্তু জল খাচ্ছে, সেটা কুকুরও হতে পারে, শেয়ালও হতে পারে, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। একবার জন্তুটা এদিকে মুখ ফেরাল। আগুনের গোলার মতন জ্বলজ্বল করে উঠল তার চোখ।

জন্তুটা ওদের দেখতে পেল কি না কে জানে, কিন্তু এদিকে তেড়ে এল না। হঠাৎ জল খাওয়া থামিয়ে সে নদীটার ধার দিয়ে দৌড়ে চলে গেল।

সন্তু আর জোজো কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জন্তুটা অনেক দূর চলে যাবার পর জোজো ফিসফিস করে বলল, লেপার্ড? হায়না? উলফ?

সন্তু বলল, বুঝতে পারলুম না। চল, আমরাও জল খেয়ে নিই!

জোজো আঁতকে উঠে বলল, এই নদীর জল খাব? নোংরা, পলিউটেড, কত কী থাকতে পারে।

সন্তু বলল, খুব বেশি তেষ্টার সময় ওসব ভাবলে চলে না।

জোজো তবু বলল, এইমাত্র একটা জন্তু যে-জল খেয়ে গেল, আমরা সেই জল খাব?

সন্তু বলল, এই হাওয়াতেই তো জন্তু-জানোয়াররা নিশ্বাস নেয়, তা বলে কি। আমরা নিশ্বাস নেব না? তুই যদি জল না খেয়ে আরও কিছুক্ষণ থাকতে পারিস তো থাক, পরে ভাল জল খুঁজে দেখব।

সন্তু চলে গেল নদীর ধারে। হাঁটু গেড়ে বসে এক আঁজলা জল তুলে দেখল, বেশ টলটলে আর স্বচ্ছ। নদীতে স্রোত আছে। সেই জল সন্তু মুখে দিল, তার বিস্বাদ লাগল না। সে পেট ভরে জল খেয়ে নিল। এবার জোজোও ছুটে এসে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল। জন্তুদের মতনই। চোঁ-চোঁ করে জল টানতে লাগল ঠোঁট দিয়ে। খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। প্রায় দু-তিন মিনিট পরে সে মুখ তুলে বলল, আঃ, বাঁচলুম! সাধে কী বলে জলের আর-এক নাম জীবন! জল খেতে-খেতে আমি আর-একটা কী ভাবলুম বল, তো সন্তু?

কী?

তোর খিদে পাচ্ছে?

সেরকম কিছু টের পাচ্ছি না। অজ্ঞান অবস্থায় বোধহয় খিদে থাকে না।

কিন্তু আমরা যদি তিন-চারদিন না খেয়ে থাকতুম, তা হলে খালি পেটে এতটা জল খেলেই গা গুলিয়ে উঠত, পেট ব্যথা করত। আমরা সকালে বেশ হেভি ব্রেকফাস্ট খেয়েছিলুম, পুরি-তরকারি, তারপর শুধু দুপুর আর রাত্তিরটা খাওয়া হয়নি। খুব সম্ভব একদিনের বেশি কাটেনি।

এটা বোধহয় তুই ঠিকই ধরেছিস?

নদীর ওপারে দ্যাখ, এক জায়গায় মিটমিট করে আলো জ্বলছে, একটা ঘর রয়েছে।

নদীটা বেশি চওড়া নয়। প্রায় একটা সরু খালের মতন। কতটা গভীর তা অবশ্য বলা যায় না। জলে বেশ স্রোত আছে, হেঁটে পার হবার চেষ্টা করে লাভ নেই। সন্তু এক্ষুনি এটা সাঁতরে চলে যেতে পারে, কিন্তু জোজোর কী হবে? জোজো সাঁতার জানে না! কতবার জোজোকে সন্তু বলেছে সাঁতারটা শিখে নিতে।

সন্তু চারপাশটা দেখে নিয়ে বলল, আমার যতদূর মনে হচ্ছে, নদীর ওপার দিয়েই আমাদের যেতে হবে। হসপেট থেকে মপি আসবার পথে আমরা কোনও পাহাড় দেখিনি। হামপিতে ঢোকার আগে আমি হামপির পেছন দিকে কয়েকটা টিলা লক্ষ করেছিলুম। সেইরকম একটা টিলাতেই আমাদের ফেলে দিয়ে গিয়েছিল। ভেবেছিল বোধহয় অজ্ঞান অবস্থাতেই আমাদের শেয়াল-টেয়াল ছিঁড়ে খাবে।

জোজো বলল, অত সহজ নয়! আমাদের মেরে ফেলা অত সহজ নয়! অ্যাই সন্তু, তুই তখন বললি কেন রে, তুই এবারে আমাকে জোর করে এনেছিস? আমি নিজের ইচ্ছেতেই এসেছি! এসেছি তো কী হয়েছে? এ তো অতি সামান্য বিপদ! জানিস, একবার আফ্রিকায় আমি আর আমার এক মামা কী অবস্থায় পড়েছিলুম? নরখাদকেরা আমাদের দুজনকে একটা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে…

সন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, বুঝেছি, বুঝেছি, তুই এখন আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছিস। কিন্তু এখন এই নদীটা পার হওয়া যাবে কী করে?

জোজো বলল, নো প্রবলেম। নদীটার ধার দিয়ে দিয়ে হাঁটি, কোনও একটা জায়গায় নদীটা শেষ হয়ে গেছে নিশ্চয়ই!

সন্তু বলল, নদীর শেষ খুঁজতে গিয়ে যদি সমুদ্রে পৌঁছে যাই? শোন, তোকে আমি পিঠে করে নিয়ে যেতে পারি। আমার লাইফ সেভিংসের ট্রেনিং আছে। কিন্তু তার আগে তোকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে, তুই জলে নেমে ভয় পাবি না, ভয় পেয়ে আমার গলা আঁকড়ে ধরবি না! তা হলে কিন্তু তোকে আমি ফেলে দেব!

জোজো বলল, ঠিক আছে। এ তো অতি সহজ ব্যাপার। আমি আলতো করে তোর পিঠটা ছুঁয়ে থাকলেই ভেসে থাকতে পারব। আমি প্রায় থ্রি-ফোর্থ সাঁতার জানি। একবার ক্যাম্পিয়ান সাগরে…

সন্তু আবার তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, থ্রি-ফোর্থ সাঁতার বলে কিছু হয়। হয় কেউ সাঁতার জানে, অথবা জানে না। এখন বেশি কথা বলার সময় নেই। জুতো খুলে ফ্যাল!

জোজো বলল, ওটা কী রে, সন্তু?

ওদের বাঁ পাশে নদীর জলে একটা ঝুড়ির মতন কী যেন ভাসছে। সাধারণ। ঝুড়ির পাঁচ-ছ গুণ বড়। সন্তু সেদিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, ইউরেকা! আর জামা-প্যান্ট ভেজাতে হল না। এটা তো একটা ডিঙি নৌকো। আমি কোনও গল্পের বইতে পড়েছিলুম, সাউথ ইন্ডিয়ার কোনও-কোনও নদীতে নৌকোগুলো হয় গোল-গোল। বুঝতে পেরেছি, এটা একটা খেয়াঘাট, তাই নৌকোটা এখানে বাঁধা রয়েছে।

সন্তু আগে নৌকোটাতে উঠল, তারপর জোজোর হাত ধরে টেনে নিল। দেখলে মনে হয় গোল ঝুড়িটা মানুষের ভারে ড়ুবে যাবে, কিন্তু ওঠার পর বোঝা গেল, সেটা বেশ মজবুত। কিন্তু বৈঠা হাতে নিয়ে চালাতে গিয়ে সন্তু মুশকিলে পড়ে গেল। বালিগঞ্জ লেকে সন্তু অনেকবার রোয়িং করেছে, কিন্তু এরকম গোল নৌকো তো কখনও চালায়নি। এটা খালি ঘুরে-ঘুরে যায়, সামনের দিকে এগোয় না।

সন্তু বলল, এটা চালাবার আলাদা টেকনিক আছে, ঠিক ম্যানেজ করতে পারছি না। এক কাজ করা যাক। তুই নৌকোটাতে বোস, আমি জলে নেমে এটাকে ঠেলে-ঠেলে নিয়ে যাচ্ছি।

জোজো শিউরে উঠে বলল, তুই জলে নামবি? যদি এই নদীতে কুমির থাকে?

সন্তু বিরক্ত হয়ে বলল, কী পাগলের মতন কথা বলছিস? এইটুকু ছোট নদীতে কুমির থাকবে? একটু আগে আমরা এটা সাঁতরে পার হবার কথা ভাবছিলুম না?

জোজো বলল, তা ঠিক। কিন্তু নৌকো দেখলে আর জলে নামার কথা মনে থাকে না।

সন্তু জামা আর জুতো খুলে নেমে গেল নদীতে। নদীটা খুব অগভীর নয়, স্রোতের টানও আছে বেশ। সন্তু সাঁতার দিতে-দিতে নৌকোটাকে ঠেলতে লাগল। কাজটা খুব সহজ না হলেও খানিকবাদে ওরা পৌঁছে গেল অন্য পারে।

নদীর এদিকে ঘাটেও একটা এইরকম গোল নৌকো বাঁধা। বোঝা গেল, এটা ফেরিঘাট, দুদিক থেকে লোকেরা এসে নিজেরাই নৌকো চালিয়ে পারাপার করে।

এপারে একটা ছোট্ট মন্দির, তার মধ্যে আলো রয়েছে। একটা বড় মাটির প্রদীপে মোটা করে পাকানো সলতে জ্বলছে। ভেতরের ঠাকুর ফুল-পাতা দিয়ে একেবারে ঢাকা, দেখাই যায় না। কোনও মানুষের সাড়াশব্দ নেই।

ওরা মন্দিরের পেছনটায় একটা কুঁড়েঘর দেখতে পেল। সেখানে একটা বিছানা পাতা রয়েছে, কিন্তু কোনও লোক শুয়ে নেই। বোধহয় এটা মন্দিরের পুরুতঠাকুরের ঘর, কিন্তু আজ রাত্তিরে তিনি অন্য কোথাও গেছেন। দরজাটা খোলা। একটা হ্যারিকেন টিমটিম করছে।

সেই ঘরের মধ্যে গোটা-তিনেক সাইকেল। শিকল দিয়ে বাঁধা। সন্তু সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। একটা সাইকেল পেলে অনেক সুবিধে হয়।

সন্তু বলল, এখানে কোনও লোক থাকলে তাকে বলে কয়ে একটা সাইকেল ধার নিতাম!

জোজো বলল, না বলেও ধার নেওয়া যায়। পরে ফেরত দিলেই হবে।

ঘরের দরজা খুলে রেখে গেছে, এদেশে কি চুরি-টুরি হয় না?

আমরা একটা সাইকেল নিলে উনি ঠিক বুঝতে পারবেন, আমরা চুরি করিনি। বিপদে পড়ে ধার নিয়েছি। কাকাবাবুদের খুঁজে বার করা দারুণ জরুরি এখন আমাদের কাছে, তাই না?

শিকল দিয়ে বাঁধা, তাতে তালা লাগানো। খুলব কী করে?

ও তো একটা পুঁচকে তালা, ভাঙতে পারবি না, সন্তু?

আমি তালা ভাঙা কখনও শিখিনি। তুই পারবি? একটা হাতুড়ি-টাতুড়ি পেলেও হত।

জোজো এগিয়ে গিয়ে বিছানা থেকে বালিশটা তুলে ফেলল। তার তলায় একগোছা চাবি। একগাল হেসে জোজো বলল, দেখলি, বুদ্ধি থাকলেই উপায় হয়। এর মধ্যে নিশ্চয়ই এই তালারও চাবি আছে।

সন্তু একটা একটা করে চাবি লাগিয়ে তালা খোলার চেষ্টা করতে লাগল। জোজো উঁকি দিল খাটিয়ার নীচে। সেখানে অনেক হাঁড়ি বাটি রাখা। একটা-একটা করে টেনে সে দেখল, কোনওটার মধ্য চাল, কোনওটার মধ্যে ডাল। একটা হাঁড়িতে বাতাসা। জোজো একমুঠো বাতাসা মুখে পুরে বলল, সন্তু, খেয়ে নে, আগে খেয়ে নে! বেশ ভাল খেতে, কপূর দেওয়া আছে, চমৎকার গন্ধ!

সন্তু মুখ ফিরিয়ে বলল, এই, ওগুলো খাচ্ছিস? ওগুলো পুজোর বাতাসা মনে হচ্ছে!

জোজো বলল, তাতে কী হয়েছে? পুজো দেবার পর সেই প্রসাদ তো মানুষেই খায়। আমাদের যা খিদে পেয়েছে, একটু কিছু খেয়ে গায়ের জোর করে নেওয়া দরকার। ওই দ্যাখ, জলের কলসিও আছে।

তালাটা খোলা হয়ে গেছে। সন্তু লোভ সামলাতে পারল না। সেও কুড়ি-পঁচিশটা বাতাসা খেয়ে নিল। জোজো কলসি থেকে জল গড়াতে গড়াতে বলল, পুরুতমশাই লেখাপড়াও জানে। এই দ্যাখ, পাশের টুলে বই-খাতা রয়েছে। একটা কলমও আছে। আমরা একটা চিঠি লিখে রেখে গেলে উনি নিশ্চয়ই ঠিক বুঝবেন!

সন্তু বলল, এটা ভাল আইডিয়া, লিখে দে একটা চিঠি। ইংরিজিতে লিখিস।

জোজো খাতা থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, পুরুতমশাই-এর ইংরিজি কী রে?

সন্তু একটা সাইকেল বার করতে করতে বলল, প্রিস্ট! তাড়াতাড়ি কর। দু-তিন লাইনে সেরে দে।

সন্তু সাইকেলটা নিয়ে এল রাস্তায়। এতক্ষণ বাদে তার মনটা একটু হাল্কা হয়েছে। সাইকেলে তাড়াতাড়ি হামপি পৌঁছনো যাবে। একবার রাস্তা ভুল হলেও অন্য রাস্তায় ফিরতে অসুবিধে হবে না।

জোজো বেরিয়ে এসে বলল, বিছানার ওপর চাপা দিয়ে এসেছি, ফিরলেই চোখে পড়বে। আমি কিছু এক্সট্রা বাতাসাও পকেটে নিয়ে এসেছি। পরে কাজে লাগতে পারে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, তুই সাইকেল চালাতে জানিস?

জোজো অবজ্ঞার সঙ্গে বলল, সাইকেল? আমি মোটরবাইক চালাতে জানি খুব ভাল। কিন্তু সাইকেলে প্র্যাকটিস নেই।

সন্তু বলল, বুঝেছি। পেছনে ক্যারিয়ার নেই, তুই সামনের রডের ওপর বোস।

সাইকেলে আলো নেই। অল্প-অল্প জ্যোৎস্নায় রাস্তাটা মোটামুটি দেখা যাচ্ছে। খানিকটা দূর এগোতেই ওরা দূরে একজন লোককে দেখতে পেল, এদিকেই আসছে।

সন্তু বলল, ওই বোধহয় পুরুতমশাই!

জোজো বলল, কোনও কথা বলার দরকার নেই। জোরে চালিয়ে চলে যা! ফিরে গিয়ে তো চিঠিটা পড়বেই। অবশ্য যদি ইংরিজি পড়তে পারে।

আমি গোটা-গোটা অক্ষরে লিখেছি।

সন্তু লোকটির পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। লোকটি কোনও সন্দেহ করেনি।

আরও খানিকটা দূর যাবার পর বোঝা গেল, ওরা ভুল পথে আসেনি। সামনে এক জায়গায় বেশ কয়েকটা আলো দেখা যাচ্ছে। ওই জায়গাটা হামপি হলেও লোকজন আছে নিশ্চয়ই। তাদের খোঁজখবর নেওয়া যাবে।

সেই আলোর দিকে লক্ষ রেখে আরও কিছুটা আসার পর দেখা গেল একটা মন্দিরের চূড়া। একটা কিসের শব্দও শোনা যাচ্ছে। আকাশের দিকে তাকালে মনে হয়, এখন রাত দেড়টা-দুটো অন্তত হবেই।

সন্তু বলল, মন্দিরের কাছে অত আলো, লোকজন জেগে আছে মনে হচ্ছে, তা হলে ওটাই নিশ্চয়ই সেই শুটিং-এর জায়গা।

জোজো বলল, একেবারে সাইকেল নিয়ে হুড়মুড়িয়ে ওখানে পৌঁছনো কি ঠিক হবে? মোহন সিং আমাদের যদি আবার দেখে ফেলে?

সন্তু বলল, ঠিক বলেছিস। শেষ পর্যন্ত সাইকেল নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে।

আলোর অনেকটা কাছে এসে ওরা সাইকেল থেকে নেমে পড়ল। মন্দিরের দিক থেকে বেশ কিছু লোকের অস্পষ্ট গুঞ্জন ভেসে আসছে, আরও একটা অন্যরকম আওয়াজ। কিছু একটা চলছে ওখানে।

সন্তু সাইকেলটা একটা ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রাখল। তারপর চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে বলল, আমরা দুজন একদম পাশাপাশি না হেঁটে একটু দূরে-দূরে থাকব, বুঝলি? একজন ধরা পড়লে আর-একজন তবু পালাতে পারব। যে করেই হোক, পুলিশে খবর দিতেই হবে। মোহন সিং-এর এতবড় দলের বিরুদ্ধে তো আমরা দুজনে কিছু করতে পারব না!

জোজো একটু অভিমানের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, আমি ধরা পড়লেও তুই। পালিয়ে যাবি?

সন্তু বলল, দুজনেই চেষ্টা করব ধরা না পড়তে! এখানকার অবস্থাটা একটু দেখে নিয়ে হসপেট থানায় আমাদের পৌঁছতেই হবে।

মন্দিরের এই পাশটা দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। গেটের বাইরে রাইফেল নিয়ে বসে আছে চার-পাঁচজন পুলিশ। তারা ঘুমে ঢুলছে।

জোজো ফিসফিস করে বলল, ওই তো পুলিশ। ওদের কাছে গিয়ে বললেই তো হয়, মোহন সিং আমাদের বিষ খাইয়েছিল।

সন্তু একটু চিন্তা করে বলল, উঁহুঃ, ওদের কাছে বলে লাভ নেই। ওরা সাধারণ কনস্টেবল, মোহন সিং ওদের ভাড়া করে এনেছে। ওরা আমাদের কথা বিশ্বাস করবে না। থানায় গিয়ে ডায়েরি করাতে হবে যে, কাকাবাবু, রিঙ্কুদি, রঞ্জনদাদাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাতে ওরা অ্যাকশান নিতে বাধ্য।

পুলিশগুলোকে এড়িয়ে আমরা ভেতরে ঢুকব কী করে?

পাঁচিলের পাশ দিয়ে দিয়ে চল। অন্য কোনও ঢোকার জায়গা আছে কি না খুঁজতে হবে। ওরা আমাদের দেখলে মোহন সিং-এর হাতে ধরিয়ে দেবে।

দেওয়াল ঘেঁষে-ঘেঁষে খানিকটা যেতেই দেখা গেল, এক জায়গায় দেওয়ালটা একেবারে ভাঙা। সেখানে কাঁটাতার দেওয়া রয়েছে। কিন্তু কোনও পাহারাদার নেই।

সন্তু একটা কাঁটাতার তুলে ধরল, জোজো সেই ফাঁক দিয়ে গলে গেল। তারপর সন্তুও ঢুকে পড়ল।

মন্দিরের সামনের চাতালে একটা বড় ফ্লাড লাইট জ্বলছে। একদল লোক খন্তা-শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়ে চলেছে। লোকগুলোর চেহারা মোটেই কুলিদের মতন নয়, প্যান্ট-শার্ট পরা। এর মধ্যেই একটা কুয়োর মতন গর্ত খোঁড়া হয়ে গেছে সেখানে।

জোজো বলল, এটাই তা হলে বিঠলস্বামীর মন্দির। এর সামনে সিনেমার জন্য সেট তৈরি হচ্ছে বলেছিল না?

সন্তু অনেকটা এগিয়ে লোকগুলোকে ভাল করে দেখল। বিরজু সিং ছাড়া চেনা আর কেউ নেই।

বেশ খানিকটা দূরে মাঠের মধ্যে আর-একটা আলো দেখা গেল। সেটা ইলেকট্রিকের আলো নয়, মশাল। সন্তু আর জোজো এগিয়ে গেল সেদিকে। সেই জায়গাটা যেন তাদের চুম্বকের মতন টানল।

মাঠের মধ্যে সিংহাসনের মতন একটা চেয়ার পাতা। তার ওপরে জরির পোশাক পরে রাজা সেজে বসে আছে এক থুথুরে বুড়ো। তার মুখ-ভর্তি পাতলা-পাতলা সাদা দাড়ি, তার ভুরু পর্যন্ত পাকা। সেই বৃদ্ধ রাজা কিন্তু দিব্যি আরাম করে একটা সিগারেট টানছে।

তার পায়ের কাছে পড়ে আছে একজন মানুষ। নীল রঙের নাইলনের দড়ি দিয়ে তার সারা শরীর পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধা। একপাশে পড়ে আছে একজোড়া ক্ৰাচ। কাকাবাবু!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress