Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বিগ্রহ রহস্য || Syed Mustafa Siraj » Page 3

বিগ্রহ রহস্য || Syed Mustafa Siraj

বাইনোকুলারে পাখির ঝাঁকটিকে দেখেই চঞ্চল হয়েছিলেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। লাল ঘুঘুপাখির ঝাঁক। ইদানীং এই প্রজাতির ঘুঘু দেশে বিরল হয়ে এসেছে। এরা পায়রাদের মতো আঁক বেঁধে থাকে। ক্যামেরায় টেলিলেন্স এঁটে দূরত্বটা দেখে নিলেন। কিন্তু কুয়াশা এখনও তোদকে ঝাপসা করে রেখেছে। কাছাকাছি না গেলে ছবি তোলা অসম্ভব। তাই সাবধানে গুঁড়ি মেরে এগোতে থাকলেন।

কাছিমের পিঠের গড়ন একটা পাথুরে মাটির ভাঙা। খবুটে ঝোঁপঝাড়ে ডাঙা জমিটা ঢাকা। লাল ঘুঘুর কঁক ঝোঁপগুলোর ডগায় বসে সম্ভবত রোদের প্রতীক্ষা করছে।

প্রাকৃতিক ক্যামাফ্লোজ ব্যবস্থা সত্যিই অসামান্য। খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালেও আনাড়ি চোখে পাখিগুলোকে আবিষ্কার করা কঠিন। ঝোপের রঙের সঙ্গে ওদের ডানার রঙ একাকার হয়ে গেছে। এখানে-ওখানে ছোটবড় পাথরের চাঙড়, ক্ষয়াটে চেহারার গাছ কিংবা ঝোঁপ–খুব সাবধানে সেগুলোর আড়ালে গুঁড়ি মেরে কর্নেল এগিয়ে যাচ্ছিলেন। এবার একটা নিচু জমি। পাথরের ফাঁকে কাশঝোঁপ মাথা সাদা করে দাঁড়িয়ে আছে! কিসে পা জড়িয়ে গেল কর্নেলের এবং টাল সামলানোর মৃদু শব্দেই লাল ঘুঘুর ঝক চমকে উঠল। নিঃশব্দে উড়ে গেল।

ওরা উড়ে যাওয়ার মুহূর্তে কর্নেল নিজের পায়ের দিকে তাকিয়েছিলেন। ছাই-রঙা ন্যাকডাকানির মতো কী একটা জিনিস। কিন্তু পাখিগুলোর দিকেই মন থাকায় বাইনোকুলারটি দ্রুত চোখে রেখেছিলেন। ঝকটি উড়ে চলছে বসতি এলাকার দিকে। গাছপালার আড়ালে ওরা উধাও হয়ে গেল বাঁদিকে পুরনো একটা লালবাড়ি ভেসে উঠল। তারপর চমকে উঠলেন কর্নেল। লালবাড়ির দোতলায় দক্ষিণের বারান্দায় ভিড়। এক দঙ্গল পুলিশ।

তাহলে সত্যিই কিছু ঘটল–এবং এত দ্রুত?

পা বাড়ানোর আগে সেই জিনিসটার দিকে একবার তাকালেন। ন্যাকড়াকানি নয়, একটা ছাই-রঙা পশমি মাফলার। ছেঁড়াফাটা। মাফলারটা শিশিরে নেতিয়ে গেছে। তারপর মাকড়সার জাল লক্ষ্য করলেন। জালটাও ভেঁড়া। তার মানে, তার পায়ে জড়িয়ে যাওয়ার সময় পা থেকে ঝেড়ে ফেলেছিলেন। তখন মাকড়সার জালটা ছিঁড়ে গেছে।

একটা ছেঁড়াফাটা মাফলার এখানে পড়ে আছে এবং তার ওপর মাকড়সা জাল বুনেছে, এটা কোনও ঘটনা নয়। এর চেয়ে জরুরি লালবাড়িটার দোতলার বারান্দায় ভিড় এবং পুলিশ। কর্নেল কী ভেবে মাফলারটি তুলে নিতে গিয়ে একটু দ্বিধায় পড়লেন। নিলেন না। হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে চললেন লালবাড়ির দিকে।

পেছন ঘুরে বাড়িটার গেটে পৌঁছে দেখলেন, ভেতরের লনে পুলিশের গাড়ি এবং একটা অ্যামবুলেন্স গাড়িও দাঁড়িয়ে আছে। গেটে দুজন কনস্টেবল পাহারা দিচ্ছিল। কর্নেলকে দেখে তারা কর্তব্যপরায়ণ হয়ে উঠল। একজন গম্ভীর গলায় বলল–আভি কিসিকো অন্দর যানা মানা হ্যায়, সাব!

কর্নেল নরম গলায় বললেন–কৈ খতরনাক হুয়া, ভাই?

–সুইসাইড কেস। কনস্টেবলটি বগলে লাঠি দিয়ে খৈনি বের করল। তারপর খৈনি ডলতে ডলতে ফের বলল–এক-দো ঘণ্টা বাদ আইয়ে, কিসিকো সাথ মুলাকাত মাংতা তো? আভি হুকুম হ্যায়, কৈ চুহা ভি নেহি ঘুসে। সে নিজের রসিকতায় নিজেই হাসতে থাকল।

অন্য কনস্টেবলটি বলল–কাহা সে আতা হ্যায় আপ?

কর্নেল অন্যমনস্কভাবে বললেন কলকাত্তাসে।

–ইয়ে বাঙ্গালি বাবুকো সাথ আপকা জান পহচান হ্যায়?

জরুর। দীনগোপালবাবু মেরা দোস্ত হ্যায়।

–তব আপ যানে সকতা। যাইয়ে, যাইয়ে! উনহিকা কৈ ভাতিজা সুইসাইড কিয়া বহৎ খতরনাক।

খৈনি ডলছিল যে, সে গুম হয়ে তার সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে রইল। কর্নেল সোজা লনে গিয়ে ঢুকলেন। বারান্দায় প্রভাতরঞ্জন দাঁড়িয়েছিলেন। কর্নেলকে দেখে অবাক চোখে তাকালেন। দ্রুত বললেন–আপনি?

কর্নেল নমস্কার করে বললেন–আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

প্রভাতরঞ্জন নড়ে উঠলেন। চমক-খাওয়া গলায় বললেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার? বুঝেছি। তাহলে আপনিই সেই ভদ্রলোক? দীনুদাকে আপনিই কী আশ্চর্য! মাথা-মুণ্ডু কিছু বোঝা যাচ্ছে না। দীপু আর অরুণকে ইরিগেশান বাংলোয় আপনার খোঁজ নিতে পাঠিয়েছিলুম। ওরা এসে বলল, খবর ঠিক। কিন্তু কী আশ্চর্য! প্রভাতরঞ্জন এলোমেলো কথা বলছিলেন। কর্নেল তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন–কে সুইসাইড করেছে শুনলাম?

–শান্ত। দীনুদার এক ভাইপো। প্রভাতরঞ্জন কর্নেলের আপাদমস্তক দেখতে দেখতে বললেন–কিন্তু আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। এসব কী হচ্ছে, বুঝতে পারছি না। আপনিই বা হঠাৎ কোত্থেকে উদয় হয়ে দীনুদাকে–আরে! ও মশাই! যাচ্ছেন কোথায় আপনি?

কর্নেল বসার ঘরে ঢুকে ডানদিকে সিঁড়ি দেখতে পেলেন। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকলেন। পেছনে প্রভাতরঞ্জন তাকে তাড়া করে আসছিলেন। গ্রাহ্য করলেন না কর্নেল।

ওপরে যেতেই সরডিহি থানার সেকেন্ড অফিসার ভগবানদাস পাণ্ডে সহাস্যে ইংরেজিতে বলে উঠলেন–আপনাকে এ বাড়িতে দেখে অবাক হয়েছি ভাববেন না কর্নেল! তবে তেমন কিছুই ঘটেনি। নিছক আত্মহত্যা। দীনগোপালবাবু নিরাপদেই আছেন। তার এই ভাইপো সম্পর্কে আমাদের হাতে কিছু খবর অবশ্য আছে। তার আত্মহত্যার কারণ ব্যাখ্য করা যায়। চুড়ান্ত হতাশা আর কি! পলিটিক্যাল এক্সট্রিমিস্টদের ফ্রাস্ট্রেশন।

দুজন ডোম ততক্ষণে শান্তর মৃতদেহ কড়িকাঠ থেকে নামিয়েছে। কর্নেল ঘরে ঢুকে বললেন–মিঃ পাণ্ডে! জানালাগুলো খোলা হয়নি দেখছি!

–কী দরকার? পাণ্ডে বললেন।–দেখছেন তো, নিছক আত্মহত্যা। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। লাথি মেরে ভাঙা হয়েছে।

কর্নেল দক্ষিণের জানালাটা আগে খুললেন। তারপর খাটের পাশ দিয়ে এগিয়ে পশ্চিমের জানালার কাছে গিয়ে বললেন–মিঃ পাণ্ডে, বডি নিশ্চয় মর্গে পাঠানো হবে?

–নিশ্চয়। দ্যাটস আ রুটিন ওয়ার্ক।

কর্নেল জানালাটা লক্ষ্য করছিলেন। বললেন–এটা আপনাদের কারুর চোখে পড়া উচিত ছিল, মিঃ পাণ্ডে!

পাণ্ডে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। ভেতরে ঢুকে বললেন কী, বলুন তো?

এই জানালার তিনটে রড নেই।

দীপ্তেন্দু, অরুণ এবং প্রভাতরঞ্জন ব্যাপারটা দেখছিলেন। দীপ্তেন্দু আস্তে বলল রডগুলো বরাবরই নেই। জ্যাঠামশাই বাড়ি মেরামত করতে চান না। এই জানালাটার কথা আমি ওঁকে বলেছিলাম। উনি কান করেননি।

কর্নেল জানালার পাল্লা দুটো ঠেলে দিয়ে বললেন–জানালাটা ভেতর থেকে আটকানো যায় না। ছিটকিনিও কবে ভেঙে গেছে দেখছি।

পাণ্ডে একটু হেসে বললেন–পুরো বাড়িটারই তো এই অবস্থা। কিন্তু হঠাৎ জানালা নিয়ে আপনার মাথাব্যথা কেন, কর্নেল?

কর্নেল জানালা দিয়ে ঝুঁকে নিচেটা দেখছিলেন। বললেন পাশেই ছাদের পাইপ!

–তাতে কী? পাণ্ডে একটু গম্ভীর হয়ে বললেন।–আত্মহত্যার সমস্ত চিহ্ন আমরা এখানে পাচ্ছি। কড়িকাঠের সঙ্গে মাফলারের ফঁস লটকে শান্তবাবু ঝুলে পড়েছেন। ওই দেখুন, একটা চেয়ার উল্টে পড়ে আছে।

–কোনও সুইসাইড নোট পেয়েছেন কি?

না। পাণ্ডে বললেন।–সবসময় সবাই লিখে রেখে আত্মহত্যা করে না। কর্নেল শান্তর মৃতদেহের দিকে তাকালেন। বললেন–এটা আত্মহত্যা নয় মিঃ পাণ্ডে, নিছক খুন। লক্ষ্য করুন, গলায় ফাঁস বেঁধে ঝুললে মানুষের জিভ যতটা বেরিয়ে পড়ার কথা, ততটা বেরিয়ে নেই।

সবাই চমকে উঠেছিল। প্রভাতরঞ্জন মাথা নেড়ে বললেন–কী আশ্চর্য! তাও তো বটে।

তাছাড়া এভাবে আত্মহত্যার আরও কিছু স্বাভাবিক চিহ্ন থাকে। মলমূত্রও বেরিয়ে যায়। একটু রক্তক্ষরণের চিহ্নও থাকে। দম আটকে ফুসফুস ফেটে গেলে সেটাই স্বাভাবিক। কর্নেল পাণ্ডের দিকে ঘুরে বললেন–মিঃ পাণ্ডে, শান্তবাবুকে কেউ খুন করে ঝুলিয়ে রেখে পালিয়ে গেছে। আশা করি ছাদ থেকে নেমে যাওয়া পাইপ পরীক্ষা করলে কিছু সূত্র মিলবে।

নীতা ব্যালকনির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। কর্নেলের কথায় সে মুখ ফেরাল এবং কর্নেলের চোখে চোখ পড়তেই আস্তে বলল–ওই মাফলারটা…

সে হঠাৎ থেমে গেলে কর্নেল বললেন–শান্তবাবুর নয়। তাই না?

প্রভাতরঞ্জন অবাক চোখে ভাগনীর দিকে তাকিয়ে বললেন–বলিস কী? কী। করে বুঝলি?

নীতা বলল–কাল রাত্তিরে শান্তদার গলায় ওই ডোরাকাটা মাফলার ছিল না।

দীপ্তন্দু নড়ে উঠল।মাই গুডনেস! শান্তর গলায় একটা ছাইরঙা মাফলার দেখছি মনে পড়ছে।

অরুণও বলল দ্যাটস্ রাইট। আমারও মনে পড়ছে। অ্যাশ কালার মাফলার!

বসে সে অতি উৎসাহে শান্তর বিছানার দিকে প্রায় লাফ দিয়ে এগোল। কম্বল উল্টে খাটের তলা চারদিক থেকে খুঁজে তারপর শান্তর কিটব্যাগ হাতড়াতে থাকল। শেষে হতাশ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল।

কর্নেল পাণ্ডের উদ্দেশে বললেন–কিছু ধস্তাধস্তির চিহ্ন স্পষ্ট। শান্তবাবু ঘুমন্ত অবস্থায় খুন হননি। মর্গের রিপোর্টে সবকিছু জানা যাবে। তবে একটা ব্যাপার। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, তাড়াহুড়ো করে খুনী নিজের মাফলারটাই কাজে লাগিয়েছে। তারপর শান্তর মাফলারটা কারও চোখে পড়ে থাকবে। তার মানে, শান্ত মাফলারটা গলায় জড়িয়ে শুয়ে ছিল না। কেউ শোবার সময় মাফলার গলায় জড়িয়ে রাখে না যদি না তার গলাব্যথা বা ঠাণ্ডার অসুখ থাকে।

পাণ্ডে সায় দিয়ে বললেন–হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন।

-মাফলারটা চোখে পড়ার মতো জায়গায় রাখা ছিল! কর্নেল বললেন।

বলে বিবর্ণ দেয়ালে পেরেক পুঁতে আটকানো একটা ব্র্যাকেটের দিকে আঙুল নির্দেশ করলেন। কাঠের তৈরি জীর্ণ ব্র্যাকেট। এ ধরনের ব্র্যাকেট ভাঁজ করা যায়। একটা দিক মরচে ধরা পেরেক থেকে উপড়ে একটু বেঁকে ঝুলে রয়েছে। অন্যদিকে একটা বাদামি রঙের জ্যাকেট ঝুলছে। জ্যাকেটটা শান্তরই। সেটা কোনোরকমে ঝুলছে মাত্র।

প্রভাতরঞ্জন বললেন কী আশ্চর্য! আপনার চোখ আছে বটে কর্নেলসায়েব।

কর্নেল প্রশংসায় কান করলেন না। বললেন একঝটকায় মাফলারটা টেনে নিয়ে খুনী পালিয়ে গেছে। ওটা থাকলে এটা সুইসাইড কি না, তা নিয়ে কারও সন্দেহ জাগত। খুনী সেই ঝুঁকি নিতে চায়নি।

অরুণ বলল–কিন্তু বডি মর্গে গেলেই তো…।

তাকে বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন–মর্গের রিপোর্ট পাওয়া সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ততক্ষণে খুনী উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে নিপাত্তা হওয়ার সুযোগ পেত।

এবার প্রভাতরঞ্জন বিরক্ত হয়ে বললেন–হেঁয়ালি! কিছু বোঝা যায় না। আমারও মশাই ক্রিমিনলজিতে একটু-আধটু পড়াশোনা আছে। রাজনীতি করে জেল খেটেছি বিস্তর। জেলেও ক্রিমিনালদের সঙ্গে মেলামেশার স্কোপ ছিল। কথাটা হলো, প্রতিটি খুনের একটা মোটিভ বা উদ্দেশ্য থাকে। একটা হলো, পার্সোনাল গেন-ব্যক্তিগত লাভ। অন্যটা হলো গিয়ে প্রতিশোধ বা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা। হা-হঠাৎ রাগের বশেও মানুষ মানুষকে খুন করে, কিংবা দৈবাৎ নেহাত থাপ্পড় মারলেও মানুষ মারা পড়তে পারে। কিন্তু এটা কোনও ডেলিবারেট মার্ডার নয়।

অরুণ বলল–মামাবাবু, উনি ডেলিবারেট মার্ডারের কথাই বলছেন কিন্তু মাইন্ড দ্যাট!

পাণ্ডের তাড়ায় শান্তর মৃতদেহ নিয়ে ততক্ষণে দুজন ডোম এবং কনস্টেবলরা বেরিয়ে গেল। প্রভাতরঞ্জন বললেন–সেটাই তো হেঁয়ালি! শান্তকে কে কী উদ্দেশ্যে খুন করবে?

দীপ্তেন্দু বলল-শান্তর শত্রু থাকা সম্ভব, মামাবাবু! ওর অনেক ব্যাপার ছিল যা আমরা জানি না।

পুলিশ অফিসার বললেন, ওর নামে রেকর্ডস আছে এখানকার থানায়।

কর্নেল ঘরের ভেতরটা খুঁটিয়ে দেখছিলেন। পশ্চিমের জানালায় গিয়ে উঁকি মেরে ফের ছাদের পাইপটা দেখে নিয়ে বললেন–দীনগোপালবাবু কোথায়? ওঁকে দেখছি না যে?

পাণ্ডে বললেন–নিজের ঘরে শুয়ে আছেন। আপনি আসার মিনিট কুড়ি আগে বাইরে থেকে ফিরে এই সাংঘাতিক ঘটনা দেখে ওঁর অবস্থা শোচনীয়। এখন ওঁকে ডিসটার্ব করা উচিত হবে না।

–একা আছেন নাকি?

প্রশ্নের জবাব দিল নীতানা ঝুমা বউদি আছেন। ডাক্তারবাবু আছেন।

পাণ্ডে একটু হেসে বললেন রুটিন জব, কর্নেল। সঙ্গে ডাক্তার নিয়েই এসেছিলাম। বডি পরীক্ষা করেই বলেছেন, বহুক্ষণ আগেই মারা গেছেন শান্তবাবু।

কর্নেল বললেন–ডাক্তারবাবু কোনও সন্দেহ করেননি?

না তো। পাণ্ডে গম্ভীর হলেন এবার।–ওঁর কাছেও এ একটা রুটিন জব। কিন্তু আপনি যে পয়েন্টগুলো তুলেছেন, তাছাড়া মাফলারের ব্যাপারটাও গুরুত্বপূর্ণতাতে মনে হচ্ছে, কিন্তু গোলমেলে ব্যাপার আছে। পারিবারিক কোনও ব্যাপার থাকাও স্বাভাবিক।

অরুণ আপত্তি করে বলল–অসম্ভব।

দীপ্তেন্দু বলল। অসম্ভব। আমাদের পারিবারিক কোনও গণ্ডগোল নেই।

প্রভাতরঞ্জন জোর দিয়ে বললেন–এই ফ্যামিলির ব্যাকগ্রাউন্ড আপনারা জানেন না। তাই এ প্রশ্ন তুলছেন। তবে আমারও একটা প্রশ্ন আছে মিঃ পাণ্ডে।

বলে তিনি কর্নেলের দিকে আঙুল তুললেন।–এই ভদ্রলোক সম্পর্কে প্রশ্ন।

কর্নেল একটু হাসলেন। বলুন।

দীনুদা বলাছল, আজ মর্নিং ওয়াকে গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, আপনি ওঁকে বলেছেন, আমি আপনার হিতৈষী। এর মানেটা কী?

–হিতৈষী শব্দের মানে বরং অভিধানে দেখে নেবেন।

প্রভাতরঞ্জন চটে গেলেন। আপনি আমাকে অভিধান দেখাবেন না। যেচে পড়ে কলকাতা থেকে এসে কাউকে বেমক্কা ‘আমি আপনার হিতৈষী’ বলার মানেটা কী? কে আপনি?

পাণ্ডে হাসলেন। কর্নেলের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন–তাহলে আপনার সরডিহিতে আবির্ভাবের কিছু কারণ আছে। যাই হোক, প্রভাতবাবু। আপনি কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের নাম শোনেননি বোঝা যাচ্ছে।

প্রভাতরঞ্জন জোরে মাথা নেড়ে বললেন–না দেশে বিস্তর কর্নেল আছেন।

পাণ্ডে কিছু বলার আগে নীতা বলে উঠল-মামাবাবু, উনি একজন প্রখ্যাত প্রাইভেট ডিটেকটিভ। তাছাড়া, উনি যেচে পড়ে এখানে আসেননি। আমিও ওঁকে বাসস্টপের লোকটার কথা বলে এখানে আসতে অনুরোধ করেছিলাম।

প্রভাতরঞ্জন গুম হয়ে এবং সে শব্দে শ্বাস ছেড়ে বললেন–তোর পেটে পেটে এত বুদ্ধি। প্রাইভেট গোয়েন্দা লাগিয়েছিস–ভালো। কিন্তু কেমন গোয়েন্দা উনি যে, এই সাংঘাতিক অপঘাত ঠেকাতে পারলেন না? এবার দীনুদার কিছু হলে কি তুই ভাবছিস উনি ঠেকাতে পারবেন?

কর্নেল চুরুট জ্বেলে ব্যালকনিতে গেলেন। বাইনোকুলারে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে সেই মাফলার-পড়ে-থাকা জায়গাটা দেখতে থাকলেন। নিচু জায়গাটা ঝোপের আড়াল হয়ে আছে। কিন্তু কোথাও কোনও লোক নেই।

পাণ্ডে তার কাছে গিয়ে বললেন বাসস্টপের লোকটা। ব্যাপারটা কী, কর্নেল?

কর্নেল একটু ভেবে বাইনোকুলার নামিয়ে বললেননীতা, এঁকে ব্যাপারটা আগে তোমার জানানো উচিত ছিল।

পাণ্ডে নীতার দিকে তাকালেন। সেই সময় প্রভাতরঞ্জন বলে উঠলেন– আমি বলছি। সমস্তটাই রীতিমতো রহস্যজনক। পুরো ব্যাকগ্রাউন্ডটা আপনার জানা দরকার।

বাড়ির পশ্চিমে ছাদের পাইপের অবস্থা জরাজীর্ণ। কর্নেল এবং পুলিশ অফিসার পাণ্ডে নিচে গিয়ে লক্ষ্য করছিলেন, তখনও প্রভাতরঞ্জনের ব্যাকগ্রাউন্ড বর্ণনা থামেনি। পাণ্ডে পাইপের খাঁজে পা রেখে ওঠার চেষ্টা করতেই ঝরঝর করে খানিকটা মরচে আর চুনবালি ঝরে পড়ল। দেয়াল থেকে হুক উঠে গেল। অমনি প্রভাতরঞ্জন কর্নেলের সামনে হাতমুখ নেড়ে ঘোষণা করলেন–ইউ আর রং কর্নেলসাহেব।

পাণ্ডে দুহাত থেকে ময়লা ঝেড়ে বললেন হা! এ পাইপ বেয়ে কেউ উঠলে আছাড় খেত। পাইপটাও আস্ত থাকত না।

কর্নেল দোতলায় শান্তর ঘরের জানালার কাছাকাছি পাইপের একটা জায়গা দেখিয়ে বললেন–পাইপটা আস্ত নেই, মিঃ পাণ্ডে! খানিকটা ভেঙে গেছে।

নিচের দিকে দেয়াল ঘেঁষে ঘন ঝোঁপ। পাণ্ডে বেটন দিয়ে ঝোঁপগুলো ফাঁক করে দেখে বললেন–কিছু মরচে ধরা লোহার টুকরো আছে দেখছি। তবে এগুলো আপনা-আপনি খসে পড়তেও পারে।

কর্নেল ঝোপের দিকে ঝুঁকে টুকরোগুলো দেখছিলেন। প্রভাতরঞ্জন তার পাশ গলিয়ে কয়েকটা টুকরো কুড়িয়ে নিলেন। বললেন–আপনি তো মশাই ডিটেকটিভ। ডিটেকটিভদের নাকি অগুনতি চোখ থাকে। আমার মাত্র একজোড়া চোখ। বলুন, এগুলো টাটকা ভাঙা? এই দেখুন, একটুতেই মুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে। ষাট বছর আগে তৈরি ঢালাই লোহার পাইপ। মরচে ধরে ক্ষয়ে–এই রে! সর্বনাশ!

প্রভাতরঞ্জনের আঙুল কেটে রক্তারক্তি। অরুণ, দীপ্তেন্দু, নীতা একটু তফাতে দাঁড়িয়ে ছিল। অরুণ দৌড়ে এসে বলল এখনই এ টি এস নিন মামাবাবু! মরচে ধরা লোহায় কেটে গেলে টিটেনাস হয় শুনেছি।

পাণ্ডে বললেন–ওপরে ডাক্তারবাবু আছে। নিশ্চয় তার কাছে এ টি এস পেয়ে যাবেন।

আঙুল চেপে ধরে প্রভাতরঞ্জন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলেন। ঝোপের গায়ে রক্তের ফোঁটা জ্বলজ্বল করছিল। দীপ্তেন্দু বলল-মামাবাবুর সব তাতেই বাড়াবাড়ি। কাল রাত্তিরে কী কাণ্ডটা না করলেন বলে অরুণদা!

পাণ্ডে জিজ্ঞেস করলেন-কী ব্যাপার?

অরুণ গত রাত্তিরের সব ঘটনা বলল। পাণ্ডে একটু হেসে বললেন– আপনাদের এই মামাবাবুর সব ব্যাপারে বড্ড বেশি উৎসাহ দেখছি। একসময় পলিটিক্স করতেন। আমাদের রেকর্ডে আছে।

দীপ্তেন্দু হাসবার চেষ্টা করে বলল–সেটাই তো সমস্যা! পলিটিসিয়ানদের মুখের জোর যতটা, ততটা প্র্যাকটিক্যাল সেন্স থাকে না। অন্তত মামাবাবুর ছিল না। অরুদা, আজ ভোরের মজার ব্যাপারটা বলোনি কিন্তু!

অরুণ বলল জ্যাঠামশাইকে সারা রাত পাহারা দেওয়ার পর ভোর প্রায় চারটে নাগাদ মামাবাবু হুকুম দিলেন, যথেষ্ট হয়েছে। এবার সব শুয়ে পড়ো গে। আমি একা পাহারা দেব। তারপর উনি বসার ঘরের সোফায় দিব্যি শুয়ে পড়লেন। হাতে নবর বল্লম। এদিকে জ্যাঠামশাইয়ের মর্নিং ওয়াকের অভ্যাস আছে। ঘুমন্ত মামাবাবুর হাত থেকে বল্লমটা নিয়ে লনে পুঁতে চলে গেছেন। মামাবাবু টেরও পাননি। হঠাৎ জেগে দেখেন বল্লম নেই। যাই হোক, নব বল্লম পুঁততে দেখেছিল। নইলে মামাবাবু হুলুস্থুল বাধিয়ে দিতেন ফের।

দীপ্তেন্দু বললবাধিয়েও ছিলেন। আমাদের ডেকে তুলে সে এক হুলুস্থূল কাণ্ড।

পাণ্ডে বললেন–শান্তবাবু গণ্ডগোল শুনে নেমে আসেননি তখন?

নীতা মৃদু স্বরে বলল–নিচে হৈচৈ শুনে আমি শান্তদার ঘরের দরজায় নক করেছিলাম। ডেকেছিলামও। সাড়া পাইনি। তখন ছটা বেজে গেছে।

তার মানে, তখন শান্তবাবু আর বেঁচে নেই! পাণ্ডে কথাটা কর্নেলের উদ্দেশে বললেন।

কর্নেল অন্যমনস্কভাবে বললেন–ঠিক তাই।

পাণ্ডে বললেন–যদি মর্গের রিপোর্টে দেখা যায় এটা সত্যিই মার্ডার, তাহলে তো ব্যাপারটা অদ্ভুত হয়ে ওঠে। শান্তবাবুর ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। ছিল। এদিকে আপনি বলছেন, খুনী এই পাইপ বেয়ে পালিয়েছে। কিন্তু পাইপের অবস্থা তো দেখছেন। ধরা যাক, খুনী কাল রাত্তিরে কোনও সুযোগে শান্তবাবুর ঘরে ঢুকে খাটের তলায় লুকিয়ে ছিল। তারপর কাজ শেষ করে এই পাইপ বেয়ে নেমে গেছে। কিন্তু নামতে গেলে পাইপ ভেঙে পড়তই।

কর্নেল বললেন–পুরোটা ভেঙে পড়েনি। কিন্তু খানিকটা ভেঙেছে।

বলে কর্নেল বাইনোকুলারে পাইপটার ওপরদিকটা দেখতে থাকলেন। কিছুক্ষণ দেখার পর বাইনোকুলারটা পাণ্ডের হাতে গুঁজে দিলেন।–দেখুন! দেখলেই বুঝবেন, আমি ঠিকই বলেছি।

পাণ্ডে বাইনোকুলারে পাইপের ওপরদিকটা দেখে হাসতে হাসতে বললেন– বিশাল স্তম্ভ।

–ভাঙা অংশটা দেখুন।

–দেখছি। বিশাল গহুর।

–হ্যাঁ। কিন্তু বিশাল গহ্বরের কিনারা লক্ষ্য করুন।

করছি।

কিছু বুঝতে পারছেন না?

–না তো!

–মিঃ পাণ্ডে, কিনারার রঙ ঘন কালো নয় কি?

হা। ঘন কালো। বলে পাণ্ডে বাইনোকুলার কর্নেলকে ফিরিয়ে দিলেন। চাপা শ্বাস ফেলে ফের বললেন-বুঝেছি, টাটকা ভাঙা। তা না হলে কিনারাতেও মরচে ধরে এমনি লালচে হয়ে থাকত।

কর্নেল প্রজাপতি ধরা জালের স্টিক নিচের একটা ঝোপের পাতায় ঠেকিয়ে বললেন প্রভাতবাবুর যেমন আঙুল কেটে রক্ত পড়ল, খুনীরও সম্ভবত আঙুল কেটে গিয়েছিল মিঃ পাণ্ডে! এই কালচে লাল ফোঁটাগুলো হঠাৎ দেখলে মনে হবে পাতার স্বাভাবিক ফুটকি বা ছোপ! নানা প্রাকৃতিক কারণে উদ্ভিদের পাতায় এমন স্পট পড়ে। কিন্তু এগুলো তা নয়, রক্ত! খুনীরই রক্ত।

পাণ্ডে ঝোপের পাতাগুলো দেখছিলেন। বললেন–রক্ত বলেই মনে হচ্ছে। আশেপাশে আর কোনও ঝোপের পাতায় এমন ছোপ নেই।

কর্নেল বললেন–মরচে ধরা পাইপের রঙের সঙ্গে রক্তের ছোপ মিশে গেছে। তাই পাইপের গায়ে রক্তের ছোপ খালি চোখে ধরা পড়ই না। কিন্তু আমার বাইনোকুলারে ধরা পড়েছে।

পাণ্ডে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন এবার।–খুনীকে সনাক্ত করার মতো একটা চিহ্ন পাওয়া গেল। বলে পা বাড়িয়ে হঠাৎ ঘুরে একটু হাসলেন কিন্তু যদি মর্গের রিপোর্ট বলে যে, নিছক দম আটকেই মারা গেছেন শান্তবাবু? স্রেফ সুইসাইড?

কর্নেল আস্তে বললেন–দেখা যাক। তারপর তিনি লনের দিকে চললেন।

ততক্ষণে অ্যামবুলেন্সে শান্তর মৃতদেহ হাসপাতালে চলে গেছে। পুলিশ অফিসার পাণ্ডে কর্নেলের উদ্দেশে হাত নেড়ে চলে গেলেন। গেটের সেপাই দুজন তার জিপের পেছনে উঠে বসল। জিপটা চলে গেল। দীপ্তেন্দু, অরুণ ও নীতা সামনের লনে কর্নেলকে ঘিরে দাঁড়াল।

অরুণ, বলল–আমার একটা থিওরি আছে কর্নেল সরকার!

-বলুন।

–এটা একটা মার্ডার ট্র্যাপ। খুনের ফঁদ। কেউ শান্তকে খুন করতে এই। ফাঁদটি তৈরি করেছিল, অবশ্য যদি এটা সত্যিই খুনের কেস হয়।

দীপ্তেন্দু তাকে সমর্থন করে বলল–আমারও তাই মনে হচ্ছে। এখানে আমাদের সবাইকে জড়ো করে কেউ শান্তকে খুন করলে পুলিশ স্বভাবত আমাদেরই কাউকে না কাউকে সন্দেহ করবে।

কর্নেল বললেন–কেন?

জ্যাঠামশাইয়ের প্রপার্টির আমরাই উত্তরাধিকারী। দীপ্তেন্দু যুক্তি দেখিয়ে বলল।–সংখ্যায় একজন কমলে বাকি উত্তরাধিকারীদের শেয়ার কিছুটা বাড়বে। পুলিশ তো এই লাইনেই দেখবে ব্যাপারটা।

অরুণ একটু হাসল। অবশ্য পুলিশের রেকর্ডে শান্তর অনেক কীর্তি লিস্ট করা আছে। কলকাতা থেকে আরও রেকর্ড আনাবে। তবে আমি যা বলছিলাম, মার্ডার ট্রা্যপ! এখানে–মানে জ্যাঠামশাইয়ের বাড়িতে শান্তকে মার্ডার করা সোজা। নিরিবিলি জায়গা। যে কোনও সময় ওকে একলা পেয়ে যাবার চান্স বেশি।

নীতা বলল–কিন্তু আমাদের সবাইকে এখানে ডেকে জড়ো না করে শুধু শান্তকে একা ডাকতে পারত। বাসস্টপের লোকটার কথা ভুলে যাচ্ছে অরুদা!

ভুলিনি। ওই লোকটাই তো ফঁদ। অরুণ গলা চেপে বলল।–আমাদের জড়ো করার উদ্দেশ্য হলো–দীপু যা বলছিল, আমাদের ঘাড়েই দোষ চাপানো।

দীপ্তেন্দু বলল–নীতু, তুই এই প্রাইভেট ডিটেকটিভদ্রলোককে এনে ভাল করেছিস। তোর বুদ্ধি আছে। আমরা জানি, শান্তকে আমরা কেউ খুন করিনি। বলে সে কর্নেলের দিকে তাকাল।আমরা চাই, যদি সত্যি শান্ত খুন হয়ে থাকে, আপনি খুনীকে বের করুন। আপনার ফি একা নীতু কেন দেবে? আমরা সবাই শেয়ার করব। কী অরুদা?

অরুণ বলল–নিশ্চয়!

কর্নেল বাইনোকুলারে আকাশে হাঁসের ঝাঁক দেখতে থাকলেন। মীতা চোখ টিপে আস্তে, বলল-উনি ফি নেন না। ফি নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না।

এতক্ষণে ডাক্তারবাবুকে বেরুতে দেখা গেল। ঢ্যাঙা মানুষ, একটু কুঁজো হয়ে হাঁটেন। নবর হাতে তার ডাক্তারি বগ। কর্নেলকে আড়চোখে দেখতে দেখতে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন গেটের দিকে নবও যেতে যেতে কয়েকবার ঘুরে কর্নেলকে দেখছিল।

ওপরে দীনগোপালের ঘরের জানালায় প্রভাতরঞ্জনকে দেখা গেল। বললেন– অরু! ডিটেকটি ভদ্রলোককে বল, দীনুদা কথা বলবেন। ও মশাই! দয়া করে একটু দর্শন দিয়ে যান।

মুখে তেতো ভাব। গলার স্বর আঁঝালো। নীতা দ্রুত বলল মামাবাবু ওইরকম মানুষ, কর্নেল! প্লিজ, ওঁর কোন কথায় অফেন্স নেবেন না।

কর্নেল হাসলেন। না, না। ব্যর্থ রাজনীতিকদের আমি খুব চিনি।

অরুণ ও দীপ্তেন্দু এক গলায় সায় দিয়ে বলল–ঠিক বলেছেন।…

দোতলায় পুবদিকের ঘরটা বেশ বড়। সেকেলে আসবাবপত্রে ঠাসা। প্রকাণ্ড খাটে কয়েকটা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে ছিলেন দীনগোপাল। খাটের পাশে জানালার কাছে একটা গদি আঁটা চেয়ারে প্রভাতরঞ্জন। দুই হাতের আঙুলে ব্যান্ডেজ বাঁধা। কর্নেল ঢুকলে দীনগোপাল বাঁকা মুখে বললেন–হিতৈষী মশাইয়ের বসতে আজ্ঞা হোক। নীতু, তুইও বস। দীপু, অরু! তোরা এখন ভিড় করিস নে। মর্গে গিয়ে দ্যাখ গে কী হচ্ছে। আর বউমা, নব বোধ করি ডাক্তারবাবুকে পৌঁছে দিতে গেছে–তুমি চা বা কফি যাই হোক, এক পট তৈরি করে আনো।

ঝুমা চলে গেল। তার পেছনে অরুণ ও দীপ্তেন্দু। কর্নেল বসলেন দরজার কাছে একটা চেয়ারে।

দীনগোপাল বললেন নীতু! তুই গোয়েন্দা ভাড়া করেছিস শুনলাম!

নীতু মুখ নামাল।

–তোর গোয়েন্দামশাই আমার হিতৈষী। খুব ভালো। দীনগোপাল আরও বাঁকা মুখে বললেন। তখন আমাকে অমন একটা উটকো প্রশ্ন করলেন কেন, জিজ্ঞেস কর তো তোর গোয়েন্দামশাইকে।

নীতা বলল–কী প্রশ্ন?

কর্নেল মুখে কাচুমাচু ভাব ফুটিয়ে বললেন–নিছক একটা কথার কথা! এ বয়সে এখানে একলা আছেন–দেখাশোনার লোক নেই, মানে আত্মীয়-স্বজনের কথাই বলছি আর কী! স্রেফ কৌতূহল মাত্র!

–থামুন! দীনগোপাল ধমকের স্বরে বললেন।–এতক্ষণে বুঝতে পারছি, কিছুদিন ধরে আপনিই আমাকে ফলো করে বেড়াচ্ছেন। ঝোপে ঝাড়ে, গাছপালার আড়াল থেকে। এদিকে নীতু ব্যাপারটা দিব্যি চেপে রেখে আমাকে ভোগাচ্ছিল।

নীতা ব্যস্তভাবে বললনা জ্যাঠামশাই! আমি তো কর্নেলের সঙ্গে আমার আসার আগের দিন কনট্যাক্ট করেছি। আর আপনি হ্যালুসিনেশান দেখছেন তার কতো আগে থেকে।

দীনগোপাল কর্নেলকে চার্জ করলেন কী মশাই? নীতু ঠিক বলছে?

কর্নেল বললেন–একেবারে ঠিক। আজ তেসরা নভেম্বর। নীতা আমার কাছে গিয়েছিল ৩০ অক্টোবর।

দীনগোপাল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন–শুনলাম আপনি বলেছেন শান্ত সুইসাইড করেনি। খুনী আগে থেকে লুকিয়ে ছিল। শান্তকে মেরে কড়িকাঠে লটকে ভাঙা জানালা দিয়ে পালিয়েছে–পাইপ বেয়ে!

-হ্যাঁ, দীনগোপালবাবু। ঠিক তাই।

কিন্তু প্রভাত বলছে, পাইপের যা অবস্থা পুরোটা ভেঙে পড়ার কথা। পুলিশও তাই নাকি বলছে। দীনগোপাল চোখ বুজে ঢোক গিলে শোক দমন করলেন। ভাঙা গলায় ফের বললেন আমি কিছু বুঝতে পারছি না। এসব কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে। শান্ত যদি সুইসাইড করে–এখানে এসে কেন করবে? যদি কেউ তাকে খুন করে থাকে–তাই বা কেন করবে? আর কলকাতার বাসস্টপে কেন কোন ব্যাটাচ্ছেলে আমার ভাইপো-ভাইঝিদের বলে বেড়াবে আমার বিপদ, সরডিহি চলে যাও?

প্রভাতরঞ্জন বললেন–তোমার ব্যাপারটা সম্ভবত হ্যালুসিনেশান নয় দীনুদা। এটাও একটা রহস্য। একেবারে গোলকধাঁধায় পড়া গেল দেখছি।

বলে কর্নেলের দিকে কটাক্ষ করলেন।নীতা ডিটেকটিভ এনেছে। দেখা যাক, উনি কিছু জট ছাড়াতে পারেন নাকি।

কর্নেল একটু হাসলেন!–জটের খেই যতক্ষণ অন্যের হাতে, ততক্ষণ আমি নিরুপায় প্রভাতবাবু।

প্রভাতরঞ্জন ভুরু কুঁচকে বললেন–কার হাতে?

–একটা লোকের হাতে–আমি সিওর নই। তবে তাই মনে হচ্ছে।

প্রভাতরঞ্জন দীনগোপালের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন–সে আবার কে?

–সম্ভবত যে আড়াল থেকে দীনগোপালবাবুকে এক সপ্তাহ ধরে ফলো করে বেড়াচ্ছে।

দীনগোপাল সোজা হয়ে বসে বললেন–কেন ফলো করে বেড়াচ্ছে?

–এ প্রশ্নের উত্তর একমাত্র আপনিই দিতে পারেন দীনগোপালবাবু!

দীনগোপাল চটে গেলেন।–পারি না। কারও পাকা ধানে এই ইহ জীবনে আমি মই দিইনি!

কর্নেল একটু চুপ করে থেকে বললেন–মানুষের জীবনে এটাই ঘটে থাকে দীনগোপালবাবু! নিজেই জানে না যে, সে কী জানে। অর্থাৎ নিজের অগোচরে মানুষ কিছু ইনফরমেশন বা তথ্য বয়ে নিয়ে বেড়ায় এবং নিজের অগোচরে সেই তথ্য ফাঁস করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বসে। তখন সেই তথ্য যার পক্ষে বিপজ্জনক, সে চঞ্চল হয়ে ওঠে। বাধা দিতে মরিয়া হয়।

দীনগোপাল কান করে শুনছিলেন। শ্বাস ছেড়ে বললেন–ফিলসফি! আপনি শুধু গোয়েন্দা নন, দেখছি ফিলসফারও বটে! খুব ভাল গোয়েন্দা এনেছে নীতু। লেগে পড়ুন আদাজল খেয়ে।

প্রভাতরঞ্জন বললেন–না দীনুদা। ওঁর কথাটা ভাববার মতো।

–তুমিও তো ফিলসফার। ভুলে গিয়েছিলাম কথাটা।

প্রভাতরঞ্জন জোরে মাথা নেড়ে বললেন–উঁহু হুঁ হুঁ! ফিলসফি নয়, ফিলসফি নয়। প্র্যাকটিক্যাল ব্যাপার।

দীনগোপাল একটু চটে গিয়ে বললেন–কী প্র্যাকটিক্যাল ব্যাপার? আমি এমন কিছু জানি না, যা কারও পক্ষে বিপজ্জনক। আমি এমন নতুন কিছু করে যাচ্ছি না যে তাতে কারও বিপদ ঘটবে। যদি বা জানি কিংবা নতুন কিছু করি, তাতে শান্তর বিপদ কেন ঘটল?

-আহা, না জেনেও তো কত লোক সাপের মাথায় পা দেয়।

দীনগোপাল আরও চটে বললেন–মলো ছাই! কোথায় শান্ত কিসে পা দিল? আর আমি পা দিতে যাচ্ছি কোথায়? একটা চোখে একটু ছানি পড়েছে বলে আমি কি কানা?

প্রভাতরঞ্জন মিঠে গলায় বললেন–সেবার তুমি বলছিলে উইলের কথা ভাবছ। আমি তোমাকে বললাম, কাউকে বঞ্চিত না করে উইল করো। তুমি বললে, দেখা যাক। তুমি নীতুকে বেশি স্নেহ করো, জানি। নীতু আমারই ভাগনী। তো–এমনও হতে পারে তুমি নীতুর নামে উইল করবে প্ল্যান করেছ, এতেই কারুর ব্যাঘাত ঘটতে চলেছে।

সেটা সাপের মাথায় পা দেওয়া হলো বুঝি? দীনগোপাল অন্যমনস্কভাবে বললেন-উইলের প্ল্যান করার কথা ঠিকই। অ্যাটর্নির সঙ্গে কথাবার্তা পাকা। কিন্তু ধরো, সম্পত্তি যার নামেই দিই, তাতে কার কি তথ্য ফাস হবে? তাছাড়া দীপু, অরু, ওদের বাপের প্রচুর পয়সা। ওরা আমার কানাকড়ির মুখ চেয়ে নেই। শান্তর অবশ্য পয়সাকড়ি ছিল না। কিন্তু সে পয়সাকড়ির ধারই ধারত না। তাছাড়া ও এখন বেঁচে নেই।

প্রভাতরঞ্জন গুম হয়ে বললেন, দুটোকে লিংক আপ করা যাচ্ছে না! কর্নেলসাহেব! বলুন এবারে? আপনিই কিন্তু হিন্ট দিয়েছেন।

কর্নেল কী বলতে যাচ্ছেন, দীনগোপাল পুবের জানালার দিকে সরে গিয়ে আচমকা হাঁক দিলেন–কে ওখানে?

প্রভাতরঞ্জন হন্তদন্ত হয়ে গিয়ে উঁকি দিলেন। কর্নেলও সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। বাইনোকুলারে চোখ রেখে এগিয়ে গেলেন। ঘন গাছপালার জঙ্গল হয়ে আছে ওদিকটাতে। তার ওধারে টালি-খোলার বস্তি। আরও গাছ। মাঝে মাঝে পোড়ো খালি জমি এবং নতুন দোতলা-একতলা বাড়ি।

দীনগোপাল অভ্যাসমত আস্তে বললেন–হ্যালুসিনেশান। তারপর ঠোঁটের কোনায় বাঁকা হেসে কর্নেলের উদ্দেশে বললেন–আপনার সেই আড়ালের লোকটাকে দেখতে পাচ্ছেন না দূরবীনে?

কর্নেল তখনও তন্নতন্ন খুঁজছেন। কোনও জবাব দিলেন না। পাঁচিলের পূর্ব দক্ষিণ কোণে একটা অংশ ভাঙা। সেখানে ডালপালা দিয়ে বেড়া করা হয়েছে। বাইনোকুলারে এক পলকের জন্য বেড়ার ফাঁক দিয়ে একটা কালো কুকুরের মুখ বিশাল হয়ে ভেসে উঠল, প্রকাণ্ড লকলকে জিভ। তারপরই ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হলো। একটু পরে আবার কুকুরটা দেখা গেল এক সেকেন্ডের জন্য। বাইনোকুলারে সবকিছু বড় আকারে দেখা যায়। কুকুরটা আরেকটা ঝোপের আড়ালে চলে গেল।

প্রভাতরঞ্জন ব্যস্তভাবে চাপা স্বরে বললেন–কিছু দেখতে পাচ্ছেন?

কর্নেল চোখ বাইনোকুলারে রেখেই বললেন–হ্যাঁ। একটা কালো রঙের কুকুর।

কালো কুকুর! দীনগোপাল চমকে ওঠা গলায় বললেন।–হু নব বলেছিল বটে।

কালো কুকুরটা অ্যালসেশিয়ান বলে মনে হয়েছিল কর্নেলের। এবার ফাঁকা জায়গায় তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। পশ্চিম দিকে হেঁটে চলেছে। উঁচু নীচু মাঠে কখনও আড়াল হয়ে যাচ্ছে কুকুরটা। কর্নেল ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে বারান্দায়। গেলেন। তারপর আবার বাইনোকুলারে কুকুরটাকে খুঁজলেন। দেখতে পেলেন না আর। কিন্তু এবার খোলামেলা একটা উঁচু জমির মাঝখানে একটা বেঁটে গাছের কাছে একটা লোক দেখতে পেলেন।

রোদে কুয়াশা মেখে আছে। তার ভেতরে আবছা ভেসে উঠল লোকটার চেহারা। খোঁচা-খোঁচা দাড়িগোঁফ, মাথায় মাফলার জড়ানো, গায়ে খাকি রঙের সোয়েটার–মোটেও ধোপদুরস্ত নয়, পরনে যেমন তেমন একটা ফুল প্যান্ট।

এরকম কোনও লোক সরডিহির মাঠে ঘোরাফেরা করতেই পারে। কিন্তু কালো অ্যালসেশিয়ানটা তার কাছে পৌঁছুতেই ঘটনাটি তাৎপর্য পেল।

কুকুরটা আর লোকটা তখনই জমিটার ঢালে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেল। প্রভাতরঞ্জন কর্নেলের কাছে এসে আগের মতো ব্যস্তভাবে বললেন-কুকুরটাকে ফলো করছেন? কোথায় যাচ্ছে?

কর্নেল কোনও জবাব দিলেন না। ঝুমা কফির ট্রে নিয়ে এল এতক্ষণে। কর্নেল চোখ থেকে বাইনোকুলার নামিয়ে ঘরে ঢুকলেন। দেখলেন, দীনগোপাল বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছেন। চোখ বন্ধ। মুখ ভীষণ গম্ভীর। কর্নেল ডাকলেন–দীনগোপালবাবু!

চোখ না খুলেই দীনগোপাল বললেন-বলুন।

–আমি আপনার কাছেই কিছু শোনার আশা করছিলুম।

কী ব্যাপারে?

–কালো কুকুরটার ব্যাপারে।

–দীনোপাল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন। রুক্ষ স্বরে বললেন আপনি তো গোয়েন্দা! আপনিই খুঁজে বের করুন, দেখি আপনার বাহাদুরি।

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন কুকুরটার মালিককেও আমি দেখতে পেয়েছি, দীনগোপালবাবু! ভদ্রলোক, মাঠে অপেক্ষা করছিলেন–কুকুরটাকে পাঠিয়ে রোজকার মতোই আপনাকে ভয় দেখাতে চেয়েছিলেন।

দীনগোপাল তাকিয়ে রইলেন। কিছু বললেন না। ঝুমা চুপচাপ কফির পেয়ালা তুলে দিচ্ছিল প্রত্যেকের হাতে। প্রভাতরঞ্জন কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন মাথামুণ্ডু কিছু বোঝা যায় না! আড়ালের কোনো লোকের কথা বলছিলেন? সেই লোক নাকি? কে সে? বলে দীনগোপালের দিকে ঘুরলেন। ও দীনুদা, একটু ঝেড়ে কাশো তো! এ যে বড্ড হেঁয়ালিতে পড়া গেল দেখছি।

দীনগোপাল ধমক দিলেন। চুপ করো তো। সবতাতে নাক গলানো অভ্যাস খালি।

প্রভাতরঞ্জন গুম হয়ে গেলেন। একটু পরে আস্তে বললেন–নাক কি সাধে গলাচ্ছি? আমার মাথার ভেতরটায় চর্কির মতো কী ঘুরছে। যন্ত্রণা শুরু হয়েছে মাথায়।

কর্নেল বললেন–আপনার হাতেও।

প্রভাতরঞ্জন চমকে উঠে বললেন–কী? তারপর বিষণ্ণ হাসলেন।–হ্যাঁ, হাতেও ব্যথা।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress