Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

খাওয়া শেষ করে ববি রায় উঠলেন

খাওয়া শেষ করে ববি রায় উঠলেন, অতিশয় ধীর-স্থির এবং রিল্যাক্সড দেখাচ্ছিল তাকে। কিন্তু ববি রায়ের ভিতরে যে কম্পিউটারের মতো মস্তিষ্কটি আছে তা ঝড়ের বেগে কাজ করে যাচ্ছিল।

লবিতে বা বাইরে ওদের নজরদার আছে। সুতরাং হোটেলের বাইরে ওদের মোকাবেলা করা শক্ত হবে। তার চেয়ে হোটেলের ভিতরেই একটা ফয়সালা করে নেওয়া ভাল। নাছোড় এ দুটি লোককে না ছাড়ালে চলবে না।

খুব ধীর পায়ে গুনগুন করে বিদেশি গান গাইতে গাইতে ববি সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলেন, ঘর খুললেন, দরজা বন্ধ করলেন, তারপর দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

এসব কাজে যথেষ্ট ধৈর্যের দরকার হয়।

কিন্তু প্রায় চল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করার পরও কিছুই ঘটল না।

ববি রায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার দরজা খুলে বেরোলেন। করিডোর ফাঁকা! আততায়ীদের চিহ্নও নেই।

তা হলে?

ববি ধীর পায়ে হোটেল থেকে বেরোলেন। বোম্বেতে তার বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট বন্ধু আছে। একবার ফোন করলেই সাগ্রহে তারা তাকে এসে তুলে নিয়ে যাবে! পুলিশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও তিনি পেয়ে যেতে পারেন! ববি রায় যে এক মূল্যবা। মস্তিষ্ক এ কথা আজ কে না জানে! কিন্তু ববি রায় এও জানেন যে, ওভাবে কেবল বেঁচে থাকা যায়, কিন্তু কে বা কারা তাঁর পিছু নিয়েছে, কেনই বা, এসব কোনও দিনই জানা যাবে না। বিপদের বীজ থেকেই যাবে।

বোম্বে শহরে ট্যাক্সি পাওয়া সহজ। ববি ট্যাক্সি নিলেন। কোথায় যাবেন তা কিছু ঠিক করতে পারলেন না, চক্কর দিতে দিতে অবশেষে মেবিন ড্রাইভে এসে ট্যাক্সি ছেড়ে নামলেন। সমুদ্র তার চিরকালের প্রিয়। সমুদ্র তাঁর মাথাকে পরিষ্কার করে দেয়, তাকে চনমনে করে তোলে।

ফুটপাথ থেকে লাফ দিয়ে বাঁধের ওপর উঠে পড়লেন ববি রায়। অনেকটা অঞ্চল জুড়ে সমুদ্রের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে ভূখণ্ড। সেই আক্রোশে সমুদ্র ফুঁসে উঠে লক্ষ ফণায় ছছাবল মারছে অবিরাম। তলায় রাশি-রাশি কংক্রিটের টুকরো ফেলে সামাল দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। প্রবল তাড়নায় সমুদ্রের আছড়ে পড়া জল তীক্ষধার লক্ষ বিন্দু হয়ে ছুটে আসছে ওপরে। খরশান ফোয়ারার মতো, বাত্যাতাড়িত বৃষ্টির মতো ভিজিয়ে দিচ্ছে পথচারীকে।

ববি রায় সামান্য ভিজে গেলেন। জল ঘুরছে, দোল খাচ্ছে, ফেনিল হয়ে যাচ্ছে অবিরল পরিশ্রমে। তবু বিশ্রাম নেই, ক্লান্তি নেই, শ্রান্তি নেই।

বহুদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে চারপাশে। ববি রায় যতদূর লক্ষ করলেন, তার পিছু নেয়নি কেউ। কিন্তু ববি রায় জানেন, নজর ঠিকই রাখা হয়েছে তার ওপর।

হাঁটতে হাঁটতে বাঁধ শেষ হয়ে গেল। সামনেই চমৎকার একটি সি-বিচ। এই অবেলাতেও কত লোক স্নান করছে। বড় বড় ছেলেরা নির্লজ্জ ল্যাংটো হয়ে ঢেউয়ের মধ্যে দৌড়োচ্ছে। উড়ছে রঙিন বল। বড় বড় বর্ণালি ছাতার তলায় ঠান্ডা পানীয় নিয়ে বসে আছে মেয়ে এবং পুরুষ।

ববি রায় একটা খালি চেয়ার পেয়ে বসলেন। একটা ঠান্ডা পানীয় নিলেন। তারপর সমুদ্রের দিকে চেয়ে প্রায় সব কিছুই ভুলে গেলেন।

পানীয়টি শেষ হয়ে গেল এক সময়ে। ববি রায় ঘড়ি দেখলেন। তাড়া নেই। উঠলেন।

চড়া রোদ এবং তপ্ত বালিয়াড়ি থেকে উঠে আসা কম্পমান তাপে একটু ঝাপসা লাগল। তবু ববি রায় চোখের কোণ দিয়ে লক্ষ করলেন একটু দুরে আর-একটা ছাতার তলা থেকে দু’জন লোক উঠে পড়ল। এরা সেই দু’জন নয়, তবু এরাও মৃত্যুর প্রতিনিধি। ববি রায় জানেন।

পিছনের টেবিলে আরও একজন উঠে দাঁড়িয়েছে। ববি রায় তাকে লক্ষ করেননি। একটি মিষ্টি মেয়েলি কণ্ঠ বলে উঠল, হিঃ, নিড এ কম্প্যানিয়ন?

ববি রায় ফিরে মেয়েটিকে দেখলেন। নিম্নাঙ্গে একটা সাদা হাফপ্যান্ট গোছের, ঊর্ধ্বাঙ্গে একটা টিশার্ট, নীল সাদা আড়াআড়ি স্ট্রাইপের। দুটি উন্নত স্তন গেঞ্জি ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করছে। মেয়েটি ফরসা, বোধহীন লোল হাসি তার মুখে, চোখে লোভ। নইলে এক ধরনের সৌন্দর্যও ছিল। দেখতে তেমন খারাপ নয়। কোমরের চওড়া বেল্টে একটা পেতলের অক্ষর নজরে পড়ল ববির, সি। বয়কাট চুল হাওয়ায় আলুথালু।

ববি একটু শিস দিলেন, তারপর বললেন, কাম অন।

সব মানুষই কি নয় কম্পিউটারের মতো? কিছু ডাটা ফিড করা থাকে। সেই মতো চলে, যেমন ওই ভাড়াটে খুনিরা, তেমনি এই কলগার্লটি।

তিনি নিজে?

কে জানে, তিনি নিজেও হয়তো তাই।

বাড়ানো হাতে কোমরটা পেয়ে গেলেন ববি। শরীরটা যথেষ্ট নমনীয়, যথেষ্ট শক্তি রাখে। বয়সটাও ওর ফেবারে। কিছুতেই কুড়ির ওপর নয়।

তৃষ্ণার্ত গলায় মেয়েটি বলল, লেট আস হ্যাভ এ ড্রিংক ফাস্ট, আই অ্যাম থার্স্টি।

আই নো।

মালাবার হিলসের দিকে অনির্দেশ্য হাত তুলে মেয়েটি বলল, আই হ্যাভ এ জয়েন্ট ওভার দেয়ার। হেইল এ ক্যাব।

ববি রায় এসবই জানেন, কোনও বার-এ যাবে। খদ্দেরের পয়সায় মদ খাবে। ডিনার খেতে চাইবে। নিয়ে যাবে নিজস্ব ঘরে। পকেট ফাঁকা করে ছেড়ে দেবে। রুটিন।

ববি এসবে অভ্যস্ত নন, কিন্তু মেয়েটাকে কভার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। অন্তত একটা ডাইভারশন।

ট্যাক্সি সামনেই ছিল, দু’জনে উঠতেই মেয়েটি ঝুঁকে চাপা স্বরে ড্রাইভারকে একটা নির্দেশ দিল। ববি রায় সেটা চেষ্টা করেও শুনতে পেলেন না। সমুদ্র গজরাচ্ছে, হুড়হুড়িয়ে বইছে হাওয়া।

ববি হেলান দিয়ে আরাম করেই বসলেন। সর্বদাই তাঁকে বেঁচে থাকতে হয় বর্তমান নিয়ে। তার ভাবাবেগ বলে কোনও বস্তু নেই, ভয় তাঁর ভিতরে তেমনভাবে কাজ করে না, তাঁর ভিতরে কাজ করে অঞ্চ এবং কেবলমাত্র অঙ্ক।

ছোট কিয়াট গাড়িটা যখন গুড়গুড় করে চলছে তখন মেয়েটা ববির একটা হাত মুঠো করে ধরল। ববি বাধা দিলেন না দিতে ইচ্ছে হল না বলেই, তবে হাতখানার ভাষা অনুভূতির ভিতর দিয়ে বুঝবার চেষ্টা করতে লাগলেন। নরম ও উষ্ণ হাতখানা কি আগ্রহী? না কি ভীত? দ্বিধাগ্রস্ত?

তোমার নাম কী?

চিকা।

নামটা তো বেশ ভালই।

তোমার নাম?

ববি।

হাতটাকে আরও একটু নিবিড়ভাবে চেপে ধরলেন ববি! হাতটা কি তাকে কোনও তথ্য দিচ্ছে? দেওয়ারই কথা। পৃথিবীর সব জিনিসই সর্বদা কিছু না কিছু তথ্য দেবেই। শুধু সূক্ষাতিসূক্ষ্ম অনুভূতি দিয়ে তা বুঝে ওঠাই যা শক্ত।

গাড়িটা মালাবার হিলস বেয়ে উঠছে। অতি চমৎকার দৃশ্য চারদিকে। অত্যন্ত অভিজাত, নিরিবিলি, খোলামেলা।

ববি চিকার দিকে ঘুরে তাকালেন, এসব কাজের পক্ষে তোমার বয়স বড্ড কম। চিকা সামান্য চমকে উঠল কি? বলির দিকে চেয়ে অকপট বিস্ময়ে বলল, কোন সব কাজ?

ববি স্বগতোক্তির মতো বললেন, মেয়েদের যে কতভাবে ব্যবহার করে মানুষ! শুধু জন্মানোর দোযে মেয়েদের কত না কষ্ট!

বড্ড এলোমেলো হাওয়া, ঢেউয়ের শব্দ। চিকা বোধহয় ববির কথা ভাল শুনতে পেল না। কিন্তু ববির দুঃখিত মুখের দিকে চেয়ে কিছু অনুমান করে নিল। ঝুঁকে প্রায় ববির গালে শাস ফেলে বলল, তুমি কি দুঃখী মায়? বউ ছেড়ে, বুঝি? রাহা, বড় ছেড়ে গেলে প্রথম-প্রথম বড় কষ্ট হয়।

ববি মৃদু হেসে বললেন, ইউ আর এ থটরিডার।

একটা নাল ফিয়াট পিছু নিয়েছে তা বিয়ারভিউ আয়নায় দেখেছেন ববি।

চিকা এক ঘন হয়ে বসল। ববি নিজে পারফিউম মাখেন না কখনও। কিন্তু ফরাসি দেশে তিনি পারফিউমের নানা বিচিত্র ব্যবহারের কথা জানেন। কিছু পারফিউম আছে যা কামোত্তেজক। এই মেয়েটির শরীর থেকে ঠিক কেমই কোনও গন্ধ আসছিল, যা নাসারন্ধ্রকে স্ফীত করে এবং রক্তকণিকায় একটা অগ্নিসংযোগ ঘটিয়ে দেয়, দ্রুত করে দেয় হৃদস্পন্দন।

চিকা তাঁর কাঁধে মাথা রাখতেই ববি রায় মৃদু স্বরে বললেন, ইউ আর ইন ডেঞ্জার মাই ডিয়ার। মেয়েটি চকিতে মাথা তুলল, হোয়াট ড়ু ইউ মিন বাই দ্যাট?

মেয়েটিকে বালিকাই বলা যায়। এখনও শরীর ততটা পুরন্ত নয়। চোখে-মুখে এখনও পাপের ছায়া গাঢ় হয়ে বসেনি। জীবনটা এখনও এর কাছে নিতান্তই খেলা-খেলা একটা ব্যাপার। যদিও এই বয়সেই পেশাদার এবং সাহসিনী হয়ে উঠেছে তবু ববির ইচ্ছে হল না এবে কভার হিসেবে ব্যবহার করতে।

ববি ওর হাতখানায় মৃদু চাপ দিয়ে বললেন, আই অ্যাম নট এ গুড পিক, মাই ডিয়ার। এরপর যখন খদ্দের ধরবে একটু দেখেশুনে ধোরো।

মেয়েটি রাগ না। অবাক হয়ে বলল, “কি পাগল? তোমাকে তো আমার অনেকক্ষণ ধরেই ভাল লাগছিল। কেমন দুঃখী, একা, মাঝে মাঝে আনমনা হয়ে যাচ্ছিলে। ঠিক বুঝতে পারছিলাম তোমার বড় পালিয়ে গেছে। তখনই আমার মনে হল, তোমার জন্য কিছু করতে হবে। আমরা একসঙ্গে মাতাল হব, নাচব, ফুর্তি করব। এর মধ্যে বিপদের কী আছে?

ট্যাক্সি ধীর হয়ে এল। তারপর একটা ঝা-চকচকে বার কাম রেস্তোরাঁর সামনে থামল। ববি রায় দেখলেন, এ হচ্ছে একেবারে নষ্টভ্রষ্ট ছোঁড়াছুঁড়িদের বেলেল্লাপনা করার মতো জায়গা। একটা নির্জন গলির মধ্যে।

ট্যাক্সিভাড়া মিটিয়ে ববি মেয়েটির হাতে হাত ধরে ঢুকে গেলেন ভিতরে। নীল ফিয়ার্টটা নিশ্চিত থেমেছে কাছেপিঠে। ববি রায় ঘাড় ঘোরালেন না। আলো এত মৃদু যে, বাইরে থেকে ভিতরে ঢুকলে ঘুটঘুট্টি অন্ধকার বলে মনে হয়। মেয়েটি হাত ধরে টেনে নিয়ে না গেলে ববিকে কিছুক্ষণ হাতড়াতে হত চারদিকে।

কোণে একটা ফাঁকা একটেরে কিউবিকল। মেয়েটি খুব কাছ ঘেঁষে শরীরে শরীর লাগিয়ে বসল। রেস্তোরাঁয় খদ্দের নেই বললেই হয়।

কী খাবে? পুরুষেরা তো হুইস্কিই খায়। আমি খাব ভোদকা।

ববি শুধু বললেন, এনিথিং ইউ সে।

কাচের দরজাটা ঠেলে দু’জন লোক ঘরে ঢুকল! চারদিকে তাকাল। তারপর আবছা অন্ধকারে কোথাও বসে গেল।

মেয়েটি মৃদু স্বরে বলল, ইটস এ ম্যাড জয়েন্ট। রাতের দিকে এ জায়গাটা একেবারে ক্রেজি হয়ে যায়।

হ্যাঁ, এ হচ্ছে যৌবনের জায়গা। আমার মতে বুড়োদের নয়।

মেয়েটি ববির গালে একটা ঠোনা দিয়ে বলল, তুমি মোটেই বুড়ো নও। বোসো, আমি টয়লেট থেকে আসছি।

চিকা উঠে যেতেই ববি রায় দুটো জিনিস লক্ষ করলেন। চিকা তার হ্যান্ডব্যাগ সঙ্গে নিয়ে গেছে। সেটা স্বাভাবিকও হতে পারে। মেয়েদের অনেক সাজগোজের জিনিসও হ্যান্ডব্যাগে থাকে। দ্বিতীয়ত চিকা ড্রিংকসের অর্ডার দিয়ে যায়নি। টয়লেট কোনদিকে তা ববি রায় জানেন না, চিকা গেল ডানদিকে। বাইরে বেরোনোর দরজা ওইদিকেই।

ববি রায় পরিস্থিতিটা বুঝে নিলেন চাখের পলকে। ঠিক কম্পিউটারের মতোই। জিন এই রেস্তোরা তার কবরখানা হয়ে উঠতে পারে, যদি সতর্ক না হন তিনি।

ববি হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। আর এৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলেন, পিছনের কিউবিকলে একটা নড়াচড়ার শব্দ হল। ববি কিউবিকল থেকে বেরিয়ে এসে ফাঁকায় দাঁড়িয়ে ঘুরে মুখোমুখি হলেন দুটো লোকের।

এক সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশ মাত্র সময় পাওয়া যায় এসব ক্ষেত্রে। এই চকিত মুহূর্তেই ববি রায় বুঝে নিলেন তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা আদ্যন্ত পেশাদার, নিরাবেগ, অভিজ্ঞ খুনি।

কিন্তু তারা আক্রমণ করার আগেই যে ববি রায় আক্রমণ করবেন এটা বোধহয় ওরা ভাবতেও পারেনি। আর সেই বিস্ময়ের সুযোগটাই নিলেন ববি রায়।

তাঁর বুটের ডগা যখন প্রথম খুনির হাঁটুতে খটাং করে গিয়ে লাগল তখন হাড় ভাঙার নির্ভুল শব্দ পেলেন ববি রায়।

ওয়াঃ–বলে লোকটা ভেঙে পড়তে-না-পড়তেই দ্বিতীয় লোকটির দিকে লাফিয়ে উঠে বাইসাইকেল চালানোর মতো পা দু’খানাকে শূন্যে তুলে লাফিয়ে যে লাথিটা চালালেন সেটা এড়ানোর কোনও নিয়মই জানা ছিল। লোকটার। এত দ্রুত কেউ পা বা হাত চালাতে পারে তা এ দেশের পেশাদাররাও বোধহয় এখনও ভেবে উঠতে পারে না।

দ্বিতীয় লোকটা শব্দ করল না। পিষ্ট ব্যাঙের মতো হাত-পা ছড়িয়ে কার্পেটে উপুড় হয়ে পড়ে গেল।

প্রথম লোকটা হাঁটু চেপে বসা অবস্থায় এক অদ্ভুত ভয়ের দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল ববির দিকে। ববি একটু ঝুঁকে হাতের কানা দিয়ে তার মাথায় মারলেন। লোকটা ঢলে পড়ে গেল।

কয়েকজন বেয়ারা কিছু আন্দাজ করে এগিয়ে আসছিল এদিকে। ববি দাঁড়ালেন না, চোখ-সওয়া অন্ধকারে কয়েকটা টেবিল তফাতে সরে গেলেন।

টয়লেটের দরজায় দাঁড়িয়ে চিকা, ঘটনাস্থলের দিকে চেয়ে ছিল। এখোল না।

ববি রায় দরজার কাছ বরাবর এগিয়ে গেলেন। একবার ফিরে তাকালেন। কেউ তাকে লক্ষ করছে কি? করুক, এখন আর ক্ষতি নেই।

ববি দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন।

সেই ট্যাক্সিটা এখনও অপেক্ষা করছে। ববি রায় পিছনের দরজা খুলে ভিতরে উঠে বসলেন।

চলো।

ট্যাক্সি চলতে লাগল। ববি রায় তিক্ততার সঙ্গে ভাবলেন, এইভাবে সারাক্ষণ বেঁচে থাকার কোনও মানে হয়? এই শারীরিকভাবে বেঁচে থাকা এবং অবিরল দ্বৈরথ এটা কোনও ভদ্রলোকের জীবন নয়।

আপাতত পিছনে কোনও উদ্বেগজনক ছায়া নেই। কিছুক্ষণের জন্য তিনি নিরাপদ। কিন্তু খুব বেশিক্ষণ নয়।

মেরিন ড্রাইভে ট্যাক্সি বদলালেন ববি। তারপর হোটেলে ফিরলেন।

এখানে নিশ্চয়ই আরও দুটি ছায়া তার জন্য অপেক্ষা করছে!

করুক, ববি রায় তাদের সময় দেবেন।

অন্ধকার হয়ে এসেছে। ববি ঘরে ঢুকবার আগে সামান্য দ্বিধা করলেন। দরজাটা হাট করে খুলে দিয়ে একটু অপেক্ষা করলেন। কিছু ঘটল না।

ঘরে ঢুকে আলোগুলো জ্বেলে দিলেন, কেউ নেই।

অ্যাটাচি কেসটা গুছিয়ে নিলেন ববি। তারপর রিসেপশনে এসে বিল মেটালেন।

পাঁচতারা হোটেলটায় যখন নিজের ঘরে ফিরে এলেন ববি তখন রাত প্রায় ন’টা।

রাত সাড়ে ন’টায় লীনার ঘরের ফোন বেজে উঠল।

হ্যাল্লো।—একটি আহ্লাদিত কণ্ঠ বোম্বাই থেকে বলে উঠল, কেমন আছেন মিসেস ভট্টাচারিয়া? গাড়ি কেমন চলছে?

এত অবাক হল লীনা যে কথাই জোগাল না মুখে।

শুনুন মিসেস ভট্টাচারিয়া, আমার ফরেন ট্রিপটা বোধহয় ক্যানসেল করতে হচ্ছে। কিন্তু এখনও আমার ফেরার উপায় নেই।

লীনার সমস্ত শরীর রাগে বিদ্বেষে ক্ষোভে ঠকঠক করে কাঁপছিল। চাপা হিংস্র স্বরে সে বলল, ইউ… ইউ স্কাউন্ড্রেল, আপনি ওকে খুন করলেন? আপনাকে আমি পুলিশে দেব।

কাকে খুন করলাম মিসেস ভট্টাচারিয়া?

আপনি জানেন না?

মিসেস ভট্টাচারিয়া, যাকে রোজই দু-চারটে করে খুনখারাপি করতে হয় তার পক্ষে সব ক’জন ভিকটিমকে মনে রাখা কি শক্ত নয়?

ওঃ, ইউ আর হোপলেস!

এখন, নিজেকে একটু গুছিয়ে নিন। মনে করুন, আপনি একজন কম্পিউটার। তথ্য ছাড়া আপনার মধ্যে কোনও আবেগ বিদ্বেষ ক্ষোভ কিছুই নেই। শুধু তথ্যটি দিন মিসেস ভট্টাচারিয়া। কে খুন হল?

আপনি তাকে ভালই চেনেন। আপনি তাকে আমার পিছনে লাগিয়েছিলেন গোয়েন্দাগিরির জন্য। আপনি তাকে—

মিসেস ভট্টাচারিয়া, আপনি কি কুইজ মাস্টার? অবশ্য মেয়েদের ক্ষেত্রে মাস্টার হয় কি না আমি জানি না। মেইড বা মিস্ট্রেস হবে হয়তো। বাইদি বাই, আপনি ইন্দ্রজিতের কথা বলছেন?

হ্যাঁ।

সে খুন হয়েছে?

হয়েছে এবং তাকে খুন করেছেন আপনি।

ববি বিনা উত্তেজনায় বললেন, আপনি তার ডেডবডি দেখেছেন?

না, কিন্তু সবাই দেখেছে। তার অফিসে এখনও রক্ত পড়ে আছে।

খুনটা কখন হল?

বিকেলে। কা

জটা আমার পক্ষে একটু শক্ত মিসেস ভট্টাচারিয়া।

তার মানে?

আপনি যে কেন সব কথারই এত মানে জানতে চান! কাজটা বেশ শক্ত মিসেস ভট্টাচারিয়া, কারণ বম্বে থেকে কলকাতায় কাউকে খুন করার মতো ডিভাইস আমার মতো জিনিয়াসও আজ অবধি তৈরি করতে পারেনি।

আপনি বোম্বে থেকে কথা বলছেন?

হ্যাঁ মিসেস ভট্টাচারিয়া, বিশ্বাস না হয় আপনি লাইন কেটে দিয়ে কলব্যাক করতে পারেন।

আপনি সত্যিই বোম্বেতে?

হ্যাঁ। এবার ঘটনাটা একটু সংক্ষেপে বলুন তো, ফ্রিলগুলো বাদ দেবেন। চোখের জল, আহা-উহু, সেন্টিমেন্ট এসব কোনও কাজের জিনিস নয়। টেলিফোনের বিল বাড়বে।

আপনি… আপনি একটা…

তিন সেকেন্ড পার হয়ে গেল মিসেস ভট্টাচারিয়া।

মিসেস নয়। মিস…

আরও দু’ সেকেন্ড…

আপনি এরকম কেন বলুন তো?

আরও তিন সেকেন্ড…

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress