Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

শেষ রাতে লীনার ঘুম হল

শেষ রাতে লীনার ঘুম হল বটে, কিন্তু সেই ঘুম দুঃস্বপ্নে ভরা, যন্ত্রণায় আকীর্ণ। বহুবার চটকা ভেঙে চমকে জেগে গেল সে। আবার অস্বস্তিকর তন্দ্রা এল! শেষ অবধি পাঁচটার সময় বিছানা ছাড়ল সে। কিছুক্ষণ আসন আর খালি হাতের ব্যায়াম করল। কনকনে ঠান্ডা জলে স্নান করল শাওয়ারের নীচে সঁড়িয়ে।

তবু চনমনে হল না সে। মনটা কেন যেন ভীষণ ভার। আজ নড়তে চড়তে ইচ্ছে করছে না।

খুব কড়া কালো কফি খেল সে দু’কাপ। গরমে জিব পুড়ে গেল, কিন্তু কফির কোনও শারীরিক প্রতিক্রিয়া অনুভব করতে পারল না সে।

একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে পায়ে চটি গলিয়ে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফটকের কাছে এল। কাল রাতে যে-গাড়িটাকে দেখা গিয়েছিল সেটা যে কোনটা, তা দিনের আলোয় চিনতে পারল না, ছোট গাড়ি, সম্ভবত ফিয়াট। এর বেশি আর কিছুই আন্দাজ করা যায়নি বারান্দা থেকে।

অবশ্য লীনার মনে হল, সে একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেছে। মধ্যরাতে কত লোক কত কাজে বেরোয়। সেরকম কিছুই হবে। মহেন্দ্র সিং নামক জোকারটি অবশ্য তাকে সাবধান করে দিয়েছিল। সেরকম সতর্কবাণী কি ববি রায় কিছু কম উচ্চারণ করেছে?

ববি রায়। এই চারটি অক্ষর ভাবতে আজ ভারী কষ্ট হল লীনার। যেসব পুরুষেরা মেয়েদের দাবিয়ে চলে, যাদের পৌরুষের অহংকার হিমালয়-প্রমাণ, যারা অতিশয় একদেশদর্শী সেইসব পুরুষ শৌভেনিস্টদেরই একজন হলেন ববি রায়। তবু লোকটাকে যদি সত্যিই কেউ খুন করে থাকে তবে আরও অনেক রাত্রি ধরেই লীনা ঘুমোতে পারবে না। বার বার দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙবে।

বাড়িতে থাকতে ভাল লাগছিল না লীনার। আজ সে সময় হওয়ার অনেক আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়বে বলে তৈরি হয়ে নিল।

আজ ব্রেকফাস্ট টেবিলে বহুকাল বাদে তার মা বলল, লীনা ডিয়ার, তোমাকে একটু রোগা দেখাচ্ছে কেন? বেশি ডায়েটিং করছ নাকি?

এ কথা শুনে লীনা ভারী কৃতজ্ঞ বোধ করল। যা হোক, তার মা তা হলে তাকে লক্ষ করেছে। তবে খুশি হল না লীনা, বলল, থ্যাংক ইউ ফর টেলিং।

তাদের বাড়িতে বাঁধানো বঙ্কিম, বাঁধানো রবীন্দ্রনাথ, বাঁধানো শরৎচন্দ্র আছে, তবু তাদের পারিবারিক বন্ধন বলে কিছু নেই। এ বাড়িতে কারও অসুখ হলে সেবা করতে নার্স আসে বা নার্সিং হোম-এ যেতে হয়। কারও কোনও ব্যক্তিগত সমসা বা সংকট দেখা দিলে তা শুনবার মতো সময় কারও নেই। সবাই এত স্বাধীন ও সম্পর্কহীন যে লীনার মনে হয় সে মরে গেলে এ বাড়ির কেউ কাদবে কি না।

গাড়িতে উঠে স্টার্ট দেওয়ার আগে লীনা খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। ববি রায়। চারটি অক্ষর আবার মনে বিষাদ এনে দিল আজ।

গাড়িটার জটিল প্যানেলের দিকে আনমনে চেয়ে রইল লীনা, বোধহয় বোয়িং ৭৬৭-এর প্যানেলও এরকমই। এত যন্ত্রপাতি, এত বেশি গ্যাজেটস একটা মোটরগাড়িতে যে কী দরকার!

গ্লাভস কম্পার্টমেন্টটা কোনওদিন খোলেনি লীনা। কী আছে ওটার মধ্যে?

লীনা অলস হাতে খোলার চেষ্টা করল। খুলল না, ওপরে একটা লাল বোম রয়েছে। সেটায় চাপ দিল লীনা, তবু খুলল না।

চিন্তিতভাবে একটু চেয়ে রইল সে। এই বুদ্ধিমান গাড়িটার সঙ্গে তার একটা সখ্য গড়ে উঠেছে ঠিকই। যদিও গাড়িটা পুরুষের গলায় কথা বলে, তবু প্রাণহীন বস্তুপুঞ্জকে মহিলা ভাবতেই ছেলেবেলা থেকে শেখানো হয়েছে লীনাকে। এ গাড়িটা সুতরাং মেয়েই। এই সখীর সব রহস্য লীনা ভেদ করেনি বটে, কিন্তু আজ এই গ্লাভস কম্পার্টমেন্টটা তাকে টানল। ববি রায় কি একবার বলেছিলেন যে, ওর মধ্যে একটা রিভলভার বা পিস্তল আছে? ঠিক মনে পড়ল না।

একটু নিচু হয়ে প্যানেলের তলাটা দেখল লীনা। নানা রঙের নানারকম সুইচ। গোটা চারেক হাতলের মতো বস্তু। কোনটা টানলে বা টিপলে কোন বিপত্তি ঘটে কে জানে!

লীনা গ্লাভস কম্পার্টমেন্টের তলায় সুইচের মতো একটা জিনিস চেপে ধরল আঙুল দিয়ে। প্রথমটায় কিছুই ঘটল না, তারপর হঠাৎ শ্বাস ফেলার মতো একটা শব্দ হয়ে, আস্তে করে ঢাকনাটা খুলে গেল।

ছোট্ট একটা বাক্সের মতো ফোকর, ভিতরে মৃদু একটা আলো জ্বলছে। লীনা উঁকি দিয়ে দেখল, ভেতরে একটা প্ল্যাস্টিকের ম্যাটের ওপর ঠান্ডা একটা সুন্দর পিস্তল শুয়ে আছে। পাশে একটা প্যাকেটগোছের জিনিস।

লীনা পিস্তল-বন্দুক ভালই চেনে। তার বাবার আছে, মায়ের আছে, দাদার আছে। এক সময়ে লীনা নিজেও শুটিং প্র্যাকটিস করেছে কিছুকাল। হাত বাড়িয়ে পিস্তলটা সে বের করে আনল।

বেশ ভারী, ৩২ বোরের পিস্তল। ক্রিপের ভিতর দিয়ে গুলির ক্লিপ লোড করতে হয়। দুটো অতিরিক্ত ক্লিপও রয়েছে ভিতরে। প্যাকেটের মধ্যে লীনা সে-দুটোও বের করে এনে দেখল। আর দেখতে গিয়ে পেয়ে গেল একটা চিরকুট। একটা প্যাকেটের মধ্যে সযত্নে ভাজ করে রাখা।

চিরকুটটা সামান্য কাঁপা-হাতে খুলল লীনা। ববি রায়ের হাতের লেখা অতিশয় জঘন্য। পাঠাদ্ধার করাই মুশকিল। ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশন সাধারণত এইরকম অবোধ্যভাবে লেখা হয়ে থাকে, যা কম্পাউন্ডার ছাড়া আর কেউ বোঝে না!

লীনা অতিকষ্টে প্রথম বাক্যটা পড়ল, এবং তার গা রি-রি করে উঠল রাগে। লেখা: মিসেস ভট্টাচারিয়া, ইফ ইউ আর নট অ্যান ইডিয়ট অ্যাজ আই হ্যাভ অ্যান্টিসিপেটেড দেন ইউ উইল ফাইন্ড দিস নোট উইদাউট মাচ ট্রাবল।

রাগের চোটে চিরকুটটা দলা পাকিয়ে ছুড়ে ফেলে দিতে যাচ্ছিল লীনা, তারপর মনে পড়ল, ববি বোধহয় বেঁচে নেই। যদি লোকটা মরেই গিয়ে থাকে তবে খামোখা রাগ করার মানে হয় না।

লীনা চিরকুটটা তার ব্যাগে পুরল। পিস্তল এবং গুলির ক্যাপ আবার যথাস্থানে রেখে দিল। তারপর গাড়িতে স্টার্ট দিল।

অফিসে পৌঁছে লীনা আগে সমস্ত মেসেজগুলো চেক করল। কয়েকটা চিঠিপত্র ফাইল করল। কিছুক্ষণ টাইপ করতে হল। কয়েকটা ফোনের জবাব দিয়ে দিল, তারপর ববির ঘরে ঢুকে দরজা লক করে দিল সে।

চিরকুটটা বের করে আলোর নীচে ধরল সে। অনেকক্ষণ সময় লাগল বটে, কিন্তু ধীরে ধীরে সে চিরকুটটার পাঠোদ্ধার করতে পারল। ইংরিজিতে প্রথম বাক্যটার পবে লেখা; আপনি যদি কোডটা পেয়ে থাকেন তবে নীল মঞ্জিলের কথা জেনে গেছেন। যদি না পেয়ে থাকেন তবে ধরে নিতে হবে আমার বরাত খারাপ। আর, আমার বরাত যদি ততদূর ভাল হয়েই থাকে, অর্থাৎ আপনি যদি নিতান্ত আকস্মিকভাবেই কোডটা আবিষ্কার করে ফেলে থাকেন তবে বাকি কাজটাও দয়া করে করবেন। মনে রাখবেন, অপারেশন নীল মঞ্জিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আরও মনে রাখবেন, মোটেই ইয়ারকি করছি না, আমার মৃত্যুর পর আপনার বিপদ বেড়ে যাবে। যতক্ষণ আমি বেঁচে আছি ততক্ষণ আমার ওপরেই ওদের নজর থাকবে বেশি। কিন্তু আমার মৃত্যুর পর… ঈশ্বর আপনার সহায় হোন। আপনার মস্তিষ্ক যথেষ্ট উন্নতমানের নয়, জানি, তবু নীল মঞ্জিলের জন্য আপনাকে বেছে নেওয়া ছাড়া আমার বিকল্প ছিল না। আপনি নির্বোধ বটে, কিন্তু সেইসঙ্গে যদি আবার ভিতুও হয়ে থাকেন, তবে ববি রায়ের আর কী করার থাকতে পারে? এই নোটটা অবিলম্বে পুড়িয়ে ফেলবেন।

লীনা চিরকুটটা পোড়াল বটে, কিন্তু তার আগে রাগে আক্রোশে সেটাকে ছিঁড়ে কুচিকুচি করল। মস্ত ছাইদানের ভিতর সেগুলোকে রেখে একজন বেয়ারার কাছ থেকে দেশলাই চেয়ে এনে তাতে আগুন দিল। আর বিড়বিড় করে বলল, গো টু হেল! গো টু হেল! আই হেট ইউ! আই হেট ইউ!

কিন্তু রাগ জিনিসটা বহুক্ষণ পুষে রাখা যায় না। তা একসময়ে প্রশমিত হয় এবং অবসাদ আসে।

নিজের চৌখুপি ঘরটায় চুপচাপ বসে থেকে লীনা রাতের অনিদ্রা আর রাগের পরবর্তী অবসাদে ঝুম হয়ে বসে রইল। নীল মঞ্জিলের জন্য ওই হামবাগটা তাকে বেছে নিয়েছে! ইস, কী আম্বা! উনি বললেই লীনাকে সব কিছু করতে হবে নাকি? লীনা কি ওঁর ক্রীতদাসী? সে দশটা-পাঁচটা চাকরি করে বটে, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়।

রোজকার মতোই দোলন এল বিকেল পাঁচটায়, লীনা নেমে এল নীচে। দু’জনে গাড়িতে চেপে বসল।

লীনা, আজও তুমি ভীষণ গম্ভীর।

গম্ভীর থাকার কারণ ঘটেছে, দোলন।

ঘটেছে নয়, ঘটে আছে। তোমার গাম্ভীর্যটা প্রায় পার্মানেন্ট ব্যাপার হয়ে গেছে। আজকাল তোমার কাছে আসতে ভয় করে।

তাই বুঝি! ঠিক আছে, চাকরিটা আগে ছেড়ে দিই তখন দেখবে আমি কেমন হাসিখুশি।

চাকরির জনাই কি তুমি গম্ভীর? এই যে শুনলাম, তোমার রগচটা বস এখন কলকাতায় নেই!

নেই, কিন্তু না থেকেও আছে। ইন ফ্যাক্ট আমার বস হয়তো এখন ইহলোকেই নেই।

দোলন একটু চমকে উঠে বলল, বলো কী?

খবরটা এখনও অথেনটিক নয়।

উড়ো খবর। তাহলে কী হবে লীনা?

কী করে বলব?

তোমার চাকরিও কি যাবে?

তা কেন? আমি কি ববি রায়ের চাকরি করি? আমি কোম্পানির এমপ্লয়ি। পুরনো বসের জায়গায় নতুন একজন আসবে।

তাহলে তুমি গম্ভীর কেন? ববি রায় তো তোমাকে খুব অপমান করতেন শুনি, সে বিদেয় হয়ে থাকলে তো ভালই।

চুপ করো তো বুদ্ধ! গাড়ি চালাতে চালাতে বেশি কথা বলতে নেই।

তা বটে।

লীনার চোখ জ্বালা করছিল। বুকটা এখনও ভার।

নকল দাড়িগোঁফ যে এত খারাপ জিনিস তা জানা ছিল না ইন্দ্রজিতের। আঠা যত শুকোচ্ছে তত টেনে ধরছে মুখের চামড়া। চুলকোচ্ছেও ভীষণ। তা ছাড়া এইসব দাড়িগোঁফের মেটিরিয়ালও নিশ্চয়ই ভাল নয়। বিশ্রী বোটকা গন্ধ আসছে। দুর্গাচরণ বলছিল, এইসব দাড়িগোঁফ সংগ্রহ করা হয় মৃতদের দাড়িগোঁফ থেকে। দুর্গাচরণটা মহা ফক্কড়।

গোঁফের একটা চুল নাকে বারবার ঢুকে যাচ্ছে। কয়েকবার হ্যাঁচ্ছো হয়েছে ইন্দ্রজিতের। পাগড়িটা মাথায় এঁটে দিয়ে দুর্গাচরণ বলেছিল, শোন বুদ্বু, কোনও শিখ ট্যাক্সি ড্রাইভারের গাড়িতে উঠবি না। তোর ছদ্মবেশটা শিখদের মতো হলেও তুই তো আর ওদের ভাষা জানিস না, বিপদে পড়ে যাবি।

খুবই সময়োচিত উপদেশ, সন্দেহ নেই। কিন্তু কপাল খারাপ হলে আর কী করা যাবে। গোটা পাঁচেক ট্যাক্সি ট্রাই করার পর যেটা তার নির্দেশ মতো যদৃচ্ছ যেতে রাজি হল সেই ড্রাইভারটা শিখ। বেশ বুড়ো মানুষ। সাদা ধবধবে দাড়ি। সাদা পাগড়ি, চোখে চশমা।

পাঞ্জাবি ভাষায় জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবে?

ইন্দ্রজিৎ ইংরেজিতে বলল, লং টুর। মেনি প্লেসেস।

ড্রাইভার কথাটা ভাল বুঝল না। শুধু বলল, অংরেজি?

এরপর আর ইন্দ্রজিতের সঙ্গে বেশি কথাবার্তা বলার চেষ্টা করেনি বুড়ো। তবে সারাক্ষণ রিয়ারভিউ মিরর দিয়ে সন্দেহাকুল চোখে তার দিকে নজর রাখছিল।

লীনার অফিসের সামনে বেলা সাড়ে চারটে থেকে ট্যাক্সি দাড় করিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল ইন্দ্রজিৎ। সেই ফাঁকে বুড়ো স্টিয়ারিং হুইলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে নিল খানিক। বাঁচোয়া।

ইন্দ্রজিৎ একবার ভাবল, ববি যদি মরেই গিয়ে থাকেন তাহলে আর এইসব ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার দরকার কী? তারপর ভাবল ববি রায় তাকে এই কাজের জন্য কঁড়িখানেক টাকা দিয়েছেন। গত ছ’ মাস ধরে ওই লোকটার দৌলতেই সে খেয়ে পরে বেঁচে আছে। মরে গিয়ে থাকলেও লোকটার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা কবাটা তার উচিত হবে না।

পাঁচটার পর লীনা গাড়ি নিয়ে বেরোতেই ইন্দ্রজিৎ বুড়োকে জাগিয়ে দিয়ে বলল, ফলো দ্যাট কার।

বুড়ো অবাক হয়ে বলল, কেন?

আঃ ডোন্ট টক।

বুড়ো বেশ অসন্তুষ্ট হয়েই গাড়ি ছাড়ল। আপনমনেই বকবক করতে লাগল।

ইন্দ্রজিৎ যতটুকু বুঝল, বুড়ো বলছে, অন্য ছোকরার সঙ্গে ছোকরির মহব্বত আছে তো তোমার কী বাপু? দুনিয়াতে কি ছোকরির অভাব? আর ও গাড়িওয়ালি ছোকরি তোমাকে পাত্তা দেবেই বা কেন?

ইন্দ্রজিতের কান লাল হয়ে গেল।

কলকাতা শহরে কোনও গাড়ির পিছু নেওয়া যে কী ঝামেলার কাজ, তা আর বলার নয়। জ্যামে গাড়ি আটকাচ্ছে, ঠেলাগাড়ি, রিকশা উজবুক মানুষ এসে ক্ষণে ক্ষণে গতি ব্যাহত করছে। বুড়োটা তেমন গা করছে না। সব মিলিয়ে একটা কেলো। তদুপরি লীনার গাড়িটা অতিশয় মসৃণ দ্রুতগতির গাড়ি।

তবু শেষ পর্যন্ত লেগে রইল ইন্দ্রজিৎ।

ওরা গঙ্গার ঘাটে নেমে ঘাসের ওপর বসল। ইন্দ্রজিতের ইচ্ছে ছিল, ট্যাক্সিটাকে দাঁড় করিয়ে রেখে তার মধ্যে বসে থেকে ওদের ওপর নজর রাখা।

কিন্তু বুড়োটা এ রকম অনিশ্চয় সওয়ারির হাতে আত্মসমর্পণ করতে নারাজ। রীতিমতো খিচিয়ে উঠে বলল, ভাড়া মিটিয়ে দাও, তারপর মোকরির পিছা করো। আমি বাহাত্তুরে বুড়ো এইসব চ্যাংড়ামিব মধ্যে নেই।

অগত্যা ভাড়া মিটিয়ে ইন্দ্রজিৎ গাড়লের মতো নেমে পড়ল।

ববি রায় তার ওপর লীনার রক্ষণাবেক্ষণের ভারই শুধু দেননি, এমন কথাও বলেছেন যে, সে ইচ্ছে করলে লীনার সঙ্গে প্রেম করতে পারে।

মেয়েটা দেখতে আগুন। কিন্তু বাধা হল, ওই ছোকরাটা। নিতান্তই অনুপযুক্ত সঙ্গী। কিন্তু মেয়েরা যখন একবার কাউকে পছন্দ করে বসে তখন তাদের গোঁ হয় সাংঘাতিক।

একটু দূরত্ব রেখে ইন্দ্রজিৎও ঘাসের ওপর বসল। তার পরনে স্যুট। বসতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। তার ওপর ঠান্ডা পড়ায় ঘাসে একটু ভেজা ভাব। অন্ধকার নামছে। কুয়াশা ঘনিয়ে উঠেছে। এই ওয়েদারে গঙ্গার ঘাটে প্রেমিক-প্রেমিকাদের মতো উন্মত্তরা ছাড়া আর কে বসে থাকবে?

ইন্দ্রজিতের যথেষ্ট পরিশ্রম গেছে আজ। ভোরবেলা প্লেন ধরতে সেই রাত থাকতে উঠতে হয়েছে। কলকাতায় পৌঁছতে যথেষ্ট বেলা হয়েছে, প্লেন লেট করায়। কুয়াশা ছিল বলে সময়মতো প্লেন নামতে পারেনি। ফলে, এখন ইন্দ্রজিতের একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছে।

লোকটাকে দেখেছ লীনা?

দেখেছি।

কী মতলব বলো তো!

বুঝতে পারছি না। তবে ওর দিকে তাকিয়ো না।

লোকটা কি বিপজ্জনক?

হতে পারে। তুমি বোসো। আমি আসছি।

কোথায় যাচ্ছ লীনা?

গাড়ি থেকে একটা জিনিস নিয়ে আসছি।

লীনা দ্রুত পায়ে গিয়ে গাড়িতে ঢুকল। তারপর গ্লাভস কম্পার্টমেন্ট খুলে পিস্তলটা বের করে আনল। আঁচলে ঢাকা দিয়ে পিস্তলটা নিয়ে এসে দোলনের পাশে বসে পড়ে বলল, এবার তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।

কী কাজ?

লোকটাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো, ও এখানে কী করছে।

তার মানে?

যাও না। ভয় নেই। আমার কাছে পিওল আছে।

পিস্তল!— বলে করে রইল দোলন।

ঠিক এই সময়ে একজন লম্বা ভদ্র চেহারার তরুণ কোথা থেকে এসে গেল। লীনার দিকে তাকিয়ে বলল, এনি ট্রাবল ম্যাডাম? আই অ্যাম হিয়ার টু হেলপ ইউ।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *