এই মাত্র বিকেল নেমেছে শান্ত, যেন উপত্যকায় শব্দহীন
গোলাপি এরোপ্লেনের অবতরণ।
আঙুরের মতো টসটসে কোমলতা চতুর্দিকে,
তোমার মধ্যে কী এক পরিবর্তনের ঝালর।
এই বিকেল চুমোয় চুমোয়
আচ্ছন্ন করে তোমাকে, তুমি নিজেকে সমর্পণ করো
বিকেলের হাতে, অনেক কিছু করার ইচ্ছে
তোমার ভেতরে নক্ষত্রের মতো জ্বলতে থাকে, অথচ কিছুই
করা হয় না। হাতের চিরুনি হাতেই
লগ্ন, নিশ্চল; চুল
ফুঁসতে থাকে জ্যৈষ্ঠের মেঘের মতো, তুমি
আয়নার সামনে নিঃসাড়। চুল আঁচড়ানো
স্তব্ধতায় স্থির, বিকেলে
গদ্য কবিতার চাল।
কখনো ছুটে যাও বারান্দায়, অবিন্যস্ত; আকাশ
ঝুঁকে থাকে তোমাকে
স্পর্শ করবে বলে। বাতাস জড়িয়ে ধরে
তোমাকে আঙুরলতার ধরনে আর
আমার আলিঙ্গনহীন আলিঙ্গন ছায়ার মতো
ঝোলানো রেলিঙ-এর ধারে। তোমার শরীরে
সেই ছায়া কাঁপতে কাঁপতে লেপ্টে যায় তোমার
অজ্ঞাতসারে, চাঞ্চল্য তোমাকে সার্কাস-সুন্দরীর
মতো নাচায়। বিকেল ওস্তাদ আলী আকবর খানের
পুরিয়া ধানেশ্রী হয়ে চুমুকে পান করে তোমার দেহলাবণ্য
বিকেল বললেই মনে পড়ে রেশমি রোদমাখা বটগাছ
এমন একটি বাড়ি যার প্রধান দরজার
ওপর পাথুরে সিংহ, চোখ-পাকানো, টানটান পেশী,
যে কোনো মুহূর্তে হতে পারে প্রাণবন্ত।
তুমি ছটফটিয়ে সময় কাটাও যেন
জালে আটকা পড়েছে হরিণী। কিছুতেই
ভেবে পাও না, কী তুমি করবে
এই মুহূর্তে যখন বিকেল বাঁশির সুর হয়ে
তোমাকে ডেকে যায় ঝাউবনের অযাচিত স্মৃতি নিয়ে। ঘর ছেড়ে
পা বাড়ানো আর না বাড়ানোর ভাবনায়
চেয়ারে বসে পা দোলাও
কিছুক্ষণ, তোমার দু’টি কাজল সাজানো চোখে
কোন দূর শতাব্দীর সঞ্চিত মায়া
মঞ্জুরিত। যে চুম্বন আমি মুদ্রিত
করে দিতে চাই তোমার ঠোঁটে বারংবার
আমার অনুপস্থিতিতে সেগুলোর অপচয়ের দাগ লেগে থাকে
বিকেলের গালে। তোমার পায়ের ঠোকরে
ওড়ে চুম্বনের ছাই। এই মন কেমন করা বিকেলে
আমার জন্যই তোমার মন উড্ডয়ন প্রিয়
পাখির মতো ডানা ঝাপটাচ্ছে কিনা,
জানি না।
প্রজাপতির মতো যার গোঁফ, সেই ফেরিঅলা
ডেকে যাচ্ছে এখন, তুমি তার ডাকের প্রতি
উদাসীন শুয়ে আছো বালিশে চুল এলিয়ে,
চুল উড়ছে পাখার হাওয়ায়। এই বিকেল গান গায়,
তার সুরে পাতা ঝরে। অস্থিরতা তোমাকে বেশিক্ষণ
থাকতে দেয় না বিছানায়। আমার কথা যাতে মনে
না পড়ে, সেজন্যে বইয়ের পাতা উল্টে পাল্টে
রেখে দাও টেবিলে, আদর করো সন্তানকে। তবু আমি
তোমার ভুলে-থাকার মেঘময়তাকে
উড়িয়ে ডেকে উঠি, যেমন তেজী নাবিক ‘ঐ যে শ্যামল মাটি
যাচ্ছে দেখা’ বলে উল্লাস ছুঁড়ে দেয় হাওয়ায়।
কতকাল ধরে এই বিকেল একটা ম্যুরাল এঁকে চলেছে
তোমার সত্তায়। রঙের নিচে চাপা
পড়ছে কত রঙ, সবাই দ্যাখে ত্বকের বাহার। দেখে নিতে চাই
সেই মুহূর্তটিকে, যখন তুমি কনে-দেখা আলোয়
ফ্রক ছেড়ে প্রথম শাড়িতে লুকোতে চেয়েছিল থরোথরো
তোমার মুকুলিত যৌবন এবং যে-রাতে
তোমার রুসমত হয়েছিল, আয়নায় ভেসে উঠেছিল
উপটন আর বেলফুলের ঘ্রাণময় নথ-পরা মুখ; সোহাগ রাতে
নক্ষত্রগুলো খুব নিচে ঝুঁকে তোমাদের ওপর
জাল বিছিয়ে দিয়েছিল কিনা, ঢোলকের বোল শুনে
চাঁদ নৌকা হয়ে বাসরে ভেসে
এসেছিল কিনা, জানতেই হবে। নইলে সিন্ধুশকুনের
ঝাঁক আমাকে ঠুকরে ঠুকরে কোপ্তার গোশত করে ফেলবে।
বিকেল তোমার ভালো লাগে; অসহ্য এই ভালো-লাগা
তোমাকে বের করে আনে ঘর থেকে, তুমি পা বাড়াও
কোলাহলের সামনে। তখন লালসার লকলকে জিভের
লেহন থেকে
হিংসার বিষদাঁত আর খুনী নখ থেকে,
ঘেন্নার নিষ্ঠীবন আর থকথকে পিচুটি থেকে কী করে
আড়ালে রাখবো তোমাকে?
তখন আমার পাশে অথবা মুখোমুখি
তুমি থাকো না, যেমন নিঃস্পন্দ শরীরে
থাকে না শ্বাস প্রশ্বাস।