মাংরা সর্দার সন্তর্পণে এগোচ্ছে
সবার নজরে পড়ে গেল মাংরা সর্দার সন্তর্পণে এগোচ্ছে। একটা লাঠি সম্বল করে সাপটার মোকাবিলা মানে মৃত্যুকে ডেকে আনা। কুলিরা সব নিরাপদ জায়গায় সরে দাঁড়িয়েছে। এইসময় নারীকণ্ঠে চিৎকার উঠল, মাংরাকে ফিরে আসতে বলছে। গলাটা কার বুঝতে পারল না মাংরা, এখন তার নজর গাছগুলোর তলায়। উবু হয়ে হাঁটছে সে। অজগর হলে যে কোনো সময় এক ঝটকায় শুইয়ে দেবে তাকে। সেইটে হতে দিলে চলবে না। সাহেবের গলা শুনতে পাচ্ছে সে, হুকুম করছেন ফিরে যেতে। কান দিল না সে। না, এই মুহূর্তে কোনো আদেশ শুনবে না মাংরা।
এ ব্লকে চা গাছের তলাটায় যথেষ্ট আগাছা জমে গেছে। বাজপাখীর মত মাটি হাতড়াচ্ছিল সে চোখ দিয়ে। আর একটু এগোতেই সে স্থির হল। সাপটা তাকে দেখছে! একটা গাছের গুঁড়ি শুধু লেজে পাকিয়ে ধরে অনেকটা এগিয়ে এসেছে শরীরটা। আচমকা ঘাম জমতে লাগল শরীরে। এরকম মোটা আর লম্বা সাপ সে জীবনে দেখেনি। নির্ঘাৎ কিছু একটা খেয়েছে সাপটা। কারণ পেটের কাছটায় বেঢপ ফুলে আছে ওর। চোখাচোখি হতেই আস্তে আস্তে হাঁ করল সাপটা। মুখের গহ্বর এবং জিভ দেখে চকিতে সতর্ক হয়ে গেল মাংরা। ওই মুখ তার মত মানুষকে সহজেই অর্ধেকটা গিলে নিতে পারে। এই সাপ ফণা তোলে না কিন্তু নিজের পরিধির মধ্যে অত্যন্ত দ্রুত ঝাঁপিয়ে গিলে নিতে পারে। কিংবা বিদ্যুতের মত লেজ ছুঁড়ে শিকারকে পাকে পাকে জড়িয়ে চাপ দিতে পারে যতক্ষণ তার হাড়গোড় না ভেঙে যায়। বেশ কিছুক্ষণ চোখে চোখ রাখল ওরা। পেছনে কুলিদের গলায় কোনো শব্দ নেই। হঠাৎ সাপটার কী হল বুঝল না মাংরা, মুখটা সরিয়ে নিচ্ছে। একটু একটু করে শরীরটাকে আড়ালে নিয়ে যাওয়ার মতলব। পিছু হটছে ওটা, এই সময় ঝট করে একমুঠো মাটি তুলে ছুঁড়ে দিল মাংরা। ভেজা মাটির দলা থপাস করে সাপটার চোখের ওপর পড়ে ঘুঁটের মত বসে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মরিয়া হয়ে সাপটা শন শন করে অনেকটা দূর মাথা সোজা করে এগিয়ে এল। কিন্তু চোখে দেখতে পাচ্ছে না ওটা। দুহাতে লাঠিটা ধরে ঝাঁপিয়ে পড়ল মাংরা। মাথা সরাবার আগেই ঠিক গলার কাছটাতে লাঠিটাকে আড়াআড়ি ফেলে ওটার দুই প্রান্তে দুই পা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। আচমকা আক্রমণে সাপটা যে কয় পলক ঘাবড়েছিল সেইটে কাজে লাগাল মাংরা। প্রাণপণে লেজ ব্যবহার করবে জানে মাংরা। মাথা অকেজো হয়ে গেলে ওর বড় অস্ত্র। এক ঝটকায় তাকে ফেলে দিতে পারে লেজের আঘাতে। শরশর করে লেজটা খুলে আসছে গুঁড়ি থেকে। প্রচণ্ড গতিতে লেজটাকে ওপরে তুলতে গিয়ে বাধা পেল সাপটা। একটা চা-গাছের ডালে লেজটা আটকে গেল আঘাত করতে গিয়ে। মাংরা দেখল ডালটা পাটকাঠির মত ভেঙে গেল একবারই। এবার লেজটাকে সে গুটিয়ে আনছে। আক্রমণের ধারা পালটাচ্ছে ঠিক ওই জন্যেই তৈরি ছিল মাংরা। লেজের ডগাটা নাগালে আসামাত্র খপ করে ধরে সোজা হয়ে দাঁড়াল সে। পায়ে তলায় মাথা লাঠিতে আটকানো আর দুহাতের মুঠোয় লেজ, সাপটা প্রাণপণে শরীর দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরতে চেষ্টা করছে। প্রচণ্ড সেই শক্তির সঙ্গে যুঝতে পারছিল না মাংরা। একটু শিথিল হলেই মৃত্যু, মাংরা কোনরকমে শরীরটাকে সাপের পেটের নাগালের বাইরে রাখছিল।
এসময় হইহই বেড়ে গেল। দৃশ্যটা দূর থেকে সবাই দেখেছে। সাপটা এখন কব্জায় বুঝে ছুটে এল অনেকে। মুহূর্তেই দড়িতে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা হয়ে গেল সাপটা। কয়েকজন মাংরাকে ধরে ধরে খোলা জায়গায় নিয়ে এল। সমস্ত শক্তি নিঃসাড় হয়ে গেছে তার। শরীর ঝিম ঝিম করছে, চোখ ঝাপসা। ম্যানেজার এগিয়ে এল, ইয়েস সর্দার, তুমি খুব সাহসী। তোমার জন্যে আমি গর্ব বোধ করছি। এর জন্যে তুমি বকশিশ পাবে।
দুটো হাত জড়ো করে মাংরা কৃতজ্ঞতা জানালো কোনরকমে। কিন্তু মনে মনে বলল, এ তোমার কি রকম বিচার। আমি সর্দার আর আমার সম্মান নেই? পারত ওই ছোঁড়ারা এরকম একটা কাজ করতে?
ভিড় জমেছে সাপটাকে নিয়ে। দড়ি বাঁধা সাপটা সত্যি প্রকান্ড। হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠল মাংরা। তারপর চিৎকার করে বলল, কামমে লাগ যাও সব, জলদি। মাংরার মুখ চোখ এখন একজন সর্দারের যেমন হওয়া উচিত তাই। যথেষ্ট সময় নষ্ট হয়েছে আর নয়। লেবাররা তো বটেই ছোটসাহেব পর্যন্ত লোকটার এই রকম পরিবর্তন দেখে অবাক হয়ে গেলেন। পাতিবাবুকে বললেন, হি ইজ আওয়ার অ্যাসেট। ওকে অফিসে পাঠিয়ে দেবেন বিকেলে। তারপর দড়িতে বাঁধা বিশাল সাপটাকে নিজের গাড়ির পেছনে ঝুলিয়ে বীরবিক্রমে ফিরে গেলেন।
না। সাপটাকে ধরেও মেজাজ ঠিক হল না মাংরার। বিকেলে গুদামের পাশে সাহেবের অফিসে যাওয়ার সময় ভেবেছিল সিরিলকে ডেকে জিজ্ঞাসা করবে ওই মরদ-ছাড়া বেশরম মেয়েছেলেটা যা বলল তা সত্যি কিনা! সিরিল যদি স্বীকার করে তাহলে এই মুহূর্তেই সম্পর্ক ত্যাগ করবে। ওরকম ছেলের কোনো প্রয়োজন নেই তার। হপ্তায় যে টাকা পায় তা তো জামাকাপড় আর ভুটানের মদ খেতেই চলে যায়। এইসব মেয়ের পেছনে ঢালছে কিনা কে জানে! ওর কাছ থেকে তো একটা পয়সাও নেয় না মাংরা! তার সংসারের অবস্থা এককুড়ি সাল আগে যেমন ছিল এখনও তাই। ছেলেকে তাড়িয়ে দিলে কোনো সমস্যা নেই শুধু একটি ছাড়া। বাগান থেকে ছুটি হয়ে গেলে মাথা গোঁজার জায়গা থাকবে না। নইলে ছেলে যদ্দিন চাকরি করবে তদ্দিন তাকে কোয়ার্টার ছাড়তে কেউ বলবে না। তা এরকম ছেলের আশ্রয়ে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভাল। সে নিজে কোনোদিন শুকরাবুড়োকে অপমান করেনি, ভাবতেও পারে না। আর এ হারামি ছেলের কান্ড দ্যাখো, ওই মেয়েটাকে নিজের বাপের পেছনে লেলিয়ে দিচ্ছে। আজ না হয় কোয়ার্টার হয়েছে ইটের দেওয়াল টালির ছাদ। আরে এককুড়ি সাল আগেও তো মাটির ঘরে খড়ের ছাদের তলায় থাকত ওরা। তাই থাকবে না হয়। বাগানের বাইরের জঙ্গলের মধ্যে একটা ঘর তুলে নেবে। কিংবা এখানে থাকবেই না। বুড়ো বাপকে নিয়ে সেই টেবুয়াতে চলে যাবে। বাপের কথা যদি ঠিক হয় তাহলে সেটাই তো তাদের দেশ। নিশ্চয়ই দু-একজন আত্মীয়কে খুঁজে বের করে নেওয়া যাবে। শেষের সিদ্ধান্তটা রাগের মাথায় মনে এলেও ব্যাপারটা নিয়ে বেশি ভাবতে যুৎ পায় না মাংরা। গুদামের সামনে দাঁড়িয়ে সে একটু আড়ষ্ট হল। যদি সত্যি হয় ব্যাপারটা! হাতের লাঠিটা বগলে নিয়ে এক পা এক পা এগোতে অন্তত তিনটে লোকের প্রশংসা শুনতে হল। ওরকম বড় সাপ সে একা ধরল কী করে! কত বড় হিম্মত থাকলে এরকম সাহস দেখানো যায় এই সব কথাবার্তা। সারা বাগান আজ তার হিম্মতের কথা জেনে গেছে। অত বড় সাপটাকে যে ধরেছে তাকে এখন সবাই সম্মান করবে। এই সময় যদি সে ছেলের কাছে অপমানিত হয় তাহলে– মাংরা ফিরে এল। যা হবার ঘরে গিয়েই হবে।
একটা কড়কড়ে পাঁচ টাকার নোট বকশিশ পেল সে ছোটসাহেবের কাছ থেকে। মাংরা জানে ওই সাপটার চামড়া এতক্ষণ ছাড়ানো হয়ে গিয়েছে। বাজারে ওই চামড়ার দাম অনেক। অন্তত দুই-তিনজোড়া জুতো হয়ে যাবে। তিন সাহেবের পায়ে শোভা পাবে সেগুলো। এর আগের সাহেবরা হরিণ বা বাঘ পেলে চামড়া খুলে নিয়ে কত কি করত। মাংরা শুনল ছাল ছাড়িয়ে মাংসটা পাঠিয়ে দিয়েছে। পাঁচ টাকা হাতে নিয়ে খুশি হতে পারল না মাংরা। সিরিল হলে ছুঁড়ে ফেলে দিত। বলত, একটা আদমির জীবনের দামে জুতো বানাচ্ছ আর তার জন্যে মোটে পাঁচটা টাকা। আর বাপ হলে আনন্দে মাথা নাড়ত। সাহেব যে খুশি হয়ে দিয়েছে এই তো কত। না দিলে কিছু বলার ছিল? সাপটা যেহেতু বাগানে ছিল তাই তার মালিক তো সাহেবই। কিন্তু মাংরা চুপচাপ নিয়ে নিল। তারপর সেলাম করে খোয়া ছড়ানো পথ দিয়ে হেঁটে এল বাজারে। কামিনগুলো এখন খালি ঝুড়ি নিয়ে ফিরে যাচ্ছে যে যার বাড়িতে। গুদামের শিট বদল হচ্ছে। মাথার ওপর পাখিদের চিৎকার। পিচের রাস্তার দুপাশে লম্বা লম্বা গাছের সারি। চা বাগানের মধ্যে যখন সে হাঁটে তখন একধরনের গন্ধ পায়। সে গন্ধটা নাকে এলেই বুক জুড়িয়ে যায়। আর এখন পিচের রাস্তায় হাঁটার সময় গাড়ির হুসহাস শব্দে নিজেকে গুটিয়ে গুটিয়ে পা ফেলতে হয়। রামচন্দ্রের দোকানটা এত দূরে যে ফুরোতেই চায় না পথটা।
সব জিনিসের দাম বাড়ছে, মালের দাম তো বাড়বেই। তবে ঠিক যারা পুরনো খদ্দের তাদের সঙ্গে এরা জালিয়াতি করে না। এক নম্বরটা দেবেই। আগে পাঁচ টাকা হলে সাঁতার কাটা যেত, এখন নেশাটা জমব জমব হয় মাত্র। কিন্তু আজকে অন্য রকম ব্যাপার হল। সবাই সাপটার গল্পটা শুনতে চায়। যেচে অনেকেই খাওয়াতে লাগল তাকে। নিজেকে খুব বিরাট মানুষ বলে মনে হতে লাগল তার। গল্পটা বারংবার বলতে বলতে একটু একটু করে অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কী করবে মাংরা। সেই সময় কে একজন মেয়েটার কথা তুলল। শুধু সাপ ধরা নয়, নিরি যে তাকে অমন হুমকি দিয়েছিল সেটাও রাষ্ট্র হয়ে গেছে। কথাটা ভুলেই গিয়েছিল মাংরা। সাপের গল্প আর পেটে মাল পড়ায় অন্য রকম মেজাজে ছিল। এখন কেউ একজন বলতেই আর একটা গলা খ্যানখেনিয়ে বলল, আমি হলে শালা সাপ না ধরে আগে ওই মেয়েটাকেই ধরতাম। মেয়েছেলে হল মেঘের মত। বৃষ্টি হবার আগেই যত হম্বিতিম্বি করে। কথাটা শোনা মাত্র মাংরা চোখ ঘুরিয়ে বুকু সর্দারকে খুঁজল। ভাটিখানার সামনে বিরাট উঠোনটায় ওরা সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে খাচ্ছো। মাঝে মাঝে কুপি জ্বালিয়ে ছোলাভাজা বিক্রি হচ্ছে। তারই আলোয় মানুষ দেখা এবং চেনা বেশ কষ্টকর। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পা নড়বড়ে হয়ে গেল। জব্বর খাওয়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মাথায় আবার আগুন জ্বলল যে। শালা বুকুকেই খতম করবে সে। মেয়ে যখন ওর, দায়িত্ব ওকেই নিতে হবে। টলতে টলতে পুরো উঠোনটা পাক দিল সে। না বুকু সর্দারকে সে চিনতে পারছে না। বুকু শালা আসেনি। রোজ আসে আর আজই বাদ। হঠাৎ ওর মনে পড়ল, পকেটে এখনও পাঁচটা টাকা ঠিকঠাক আছে। এটাও তো লজ্জার টাকা। এটাকেও খতম করা দরকার। যে কটা বোতল পেল সব নিয়ে বসল মাংরা।
রামচন্দ্রের খদ্দের বাগানের কুলি কামিন। অনেক অনেক বছর হয়ে গেল এই দোকান। একটা গোপন চুক্তি থাকায় সাহেবদের কাছে লীজের অংশ চলে যায়। নইলে আজ তাকে দ্যাখে কে। এই কুলিদের পয়সায় তার পেট্রোল পাম্প, লরি, বাস, জমিজমা। আগে ছোঁড়ারা লাইনে হাঁড়িয়া খেত। এখন ভুটানের মাল খায়। সেটার বিক্রি রামচন্দ্রের হাত দিয়ে। তবে সরাসরি এই আস্তানা থেকে নয়। সবাই জানে পুলিসও খবর রাখে কিন্তু মুখ খুলবে কোন্ শালা! তবে কুলিদের মধ্যে একটু অন্য রকম ভাব দেখা যাচ্ছে। ব্যাপারটা ভাল নয়। জোয়ান যুবক-যুবতীরা আর আসছে উঠোনে বসতে। এখন ভিড় শুধু প্রৌঢ় আর বৃদ্ধদের। মেয়েছেলেরা লজ্জার বয়স পেরিয়ে তবে আসে। এই করলে ব্যবসা উঠে যাবে। দু-একটা মেয়ে যারা শরীর বেচে তাদের এখানে আনলে কেমন হয় এই চিন্তা রামচন্দ্রের হয়েছে। সাহেব হ্যাঁ বললেই ব্যাস, কেল্লা ফতে। তখন যুবকগুলো আসবেই, ফুল এবং মধু–একজোড়া আকর্ষণ।
খেতে খেতে এক সময় শুয়ে পড়ল মাংরা। মাথার ভেতর পরিষ্কার হয়ে গেছে। ঠিক সেইসময় মেয়েছেলেটা এসে দাঁড়াল। মাংরা দেখল কোথায় সাপ ধরেছে বলে সোহাগ করবে না চোখ জ্বলছে হিলহিলিয়ে। হাত নেড়ে পাশে বসতে বলল সে। সিরিলের মা ধূপ করে পাশে বসে কান্নার গলায় বলল, তোমাকে ছুঁড়িটা ওই কথা বলল আর তুমি শুনে গেলে? কী রকম মরদ তুমি?
মাংরা গায়ে না মাখার গলায় বলল, হাম বুড্ডা হো গ্যায়া।
সিরিলের মা থুতু ফেলল এক দলা, থু থু। তারপর ব্যবহৃত বোতলগুলোর দিকে হাত বাড়াল।
বেহেড মাতাল হয়ে দুজনে যখন ভাটিখানা থেকে বের হল তখন চাঁদ মাথার ওপরে, দোকানের আলো নিভে গেছে। সারাদিনের পর এখন আকাশ নির্মল। হাঁটুর তলায় পা দুটো নেই, দড়াম করে পড়ে গেল মাংরা। পড়ে বলল, নিরিকো হাম শাদী করেগা। সিরিলের মা চিৎকার করল কথাটা শুনে। তার নেশা হলেও এখনও শক্ত আছে। এ বুড়োটা নেশার ঝোঁকে বলেটা কি! ওই ছুঁড়িকে বিয়ে করবে। ইচ্ছে হল বেধড়ক পেটায় লোকটাকে। কিন্তু এই অবস্থায় সেটা কী করে সম্ভব! লোকটার যে হুঁশই নেই। খানিকক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি করে সে হাত ধরে টানতে লাগল মাংরাকে। টেনে হিঁচড়ে পথ চলতে লাগল। মাঝে মাঝে মাটিতে গড়িয়ে কখনও হামা দিয়ে মাংরা বউয়ের সঙ্গে চলতে লাগল। কখনও হুঁশ এলে সোজা হয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করে আর তখনই মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে, হাম উসকো শাদী করেগা। এ বুড্ডি ভাগো! আচমকা বউ-এর শরীরে একটা লাথি বসিয়ে মাটিতে পড়ে যায় মাংরা। পুরোটা রাস্তা এইভাবে মার খেয়ে স্বামীকে টেনে নিয়ে আসে সিরিলের মা। নিজের ঘরের দরজায় যখন পৌঁছয় তখনও সিরিলের ট্রানজিস্টর বাজছে। বিদেশি সুরের সঙ্গে শুয়ে শুয়ে পা নাচাচ্ছে সিরিল। এত রাতেও তার পরনে প্যান্ট, নেশা হলেও কিন্তু হুঁশ আছে। গোলমাল শুনে হাতে যন্ত্রটা ঝুলিয়ে বাইরে আসে বেরিয়ে। আর তখনই উঠে দাঁড়ায় মাংরা। টেনে টেনে বলে হাম উসকো শাদী করেগা। বাপের অবস্থা দেখে সিরিল বিরক্ত হয়েছিল, এখন সংলাপ শুনে সে হো হো করে হেসে উঠল। আর এতক্ষণ সহ্য করার পর মাংরার বউ-এর ধৈৰ্য্যচ্যুতি হল। ঘরের ভেতর থেকে ঝাঁটা এনে বেধড়ক মারতে লাগল স্বামীকে। পথে আসতে আসতে যত মার খেয়েছে সব ঝেঁটিয়ে উসুল করে নিচ্ছিল সে। তাই দেখে সিরিল ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, শালা, সব থার্ড কেলাস আদমী!
.
বিনাগুড়ি ক্যান্টনমেন্টের পাশে নতুন গজিয়ে ওঠা বাজারে ফরেন জিনিস পাওয়া যায়। ইন্ডিয়ার মালের চেয়ে বেশ সস্তা। টাকা থাকলে সব কিনে ফেলত সিরিল। রেডিও টেপ-রেকর্ডার জামা প্যান্ট দাড়ি কামাবার মেসিন আরো কত কি। দেখে শুনে ও একটা স্ট্রেচের প্যান্ট আর ব্যানলনের গেঞ্জি কিনেছে। ঠিক অমিতাভ বচ্চনের মত লাল কালো মেশানো। বাজারের পানের দোকানের আয়নায় দেখেছে জব্বর লাগে। প্রায় পঞ্চাশ টাকা বেরিয়ে গেল অবশ্য–জিন্দেগি মে এইসাই তো যাতা হ্যায়–ফিন আতা ভি হ্যায়। এখন ওই সবের ওপর চওড়া বেলট কোমরে এঁটে হাতে রেডিও ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে সে যখন হাঁটে তখন মনে হয় হিন্দি ছবির হিরো যাচ্ছে। জীবনে দুটো শখ সিরিলের। বিনাগুড়ি বাজারহাটে যত হিন্দি ছবি আসে সেগুলো দেখা আর ভুটানের রামের বোতল খাওয়া। গুদামে কাজ করে যে টাকা পায় সেগুলো পকেটে বেশিদিন থাকতে চায় না তার। এতদিন দুনম্বর টাকার ধান্ধা ছিল না, কিন্তু মনে হচ্ছে এখন দরকার। বাপকে পয়সা দিতে হয় না, দিলে সব হাফিস হয়ে যেত। শোলের ডায়ালগ মুখস্থ সিরিলের। যখনই সুযোগ পায় পা ফাঁক করে আমজাদের গলা নকল করে সে আওড়ায়। তখন মদেসিয়া মেয়েপুরুষগুলো তার দিকে ভগবান দেখার চোখ করে তাকিয়ে থাকে। বাগানের মেয়েগুলোর কাছে সিরিল এক নম্বর হিরো।
আজ রবিবার। হাটবার। আশেপাশের চা-বাগানের মেয়েপুরুষ ভিড় জমিয়েছে বাজারে খোলা মাঠে৷ মাইকে গান, বিজ্ঞাপন বাজছে। মেলা মেলা ব্যাপার। সিরিল ট্রানজিস্টার হাতে হাঁটছিল। কিশোরকুমারের গানে অজান্তেই লিপ দিয়ে যাচ্ছে সে। ফ্রান্সিস ওরাওঁ-এর কোয়ার্টারে যেতে হবে। কাল গুদামে একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। ফ্রান্সিস কী বলে দেখা দরকার।
পড়াশুনা করেনি বলে এখন মাঝে মাঝে আফসোস হয় সিরিলের। বুড়া বাপ না হয় একদম গেঁয়ো ছিল বাপটাও যে হাফ-গেঁয়ো। নইলে তাকে জোর করে মিশনারিদের কাছে পাঠাতে পারত? যেমন ফ্রান্সিস গিয়েছে। তাহলে সিরিল আজ ফ্রান্সিসের মত বাবু বনে যেতে পারত।
মাত্র দুবছর আগে হল ব্যাপারটা। আগে বাবুদের চাকরি করত বাঙালিরা। কোনো বাবুর ছুটি হয়ে গেলে তার ছেলে কাজে লাগত। কোনোরকমে ম্যাট্রিক পাস করে নিলেই হল। এটাই নিয়ম ছিল। কিন্তু নতুন য়ুনিয়ন বলতে আরম্ভ করল বাবুর কাজে কুলিদেরও নিতে হবে। সিরিল নতুন যুনিয়নে তখন একজন মাতব্বর হয়ে গেছে। নেতা ফেতা নয় কারণ চা বাগানের য়ুনিয়নের নেতা হয় শহরের লোক। যা হোক, কুলির ছেলেরা ম্যাট্রিক পাস করলে তাকেও ওই বাবুর চাকরিতে নিতে হবে এই দাবীতে সাহেবের সঙ্গে দেখা করল ওরা। দুতিন দিন খুব ঝামেলা হল। শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেল সাহেব। সেই সুবাদে ফ্রান্সিস কাজ পেয়ে গেল, বাবুর চাকরি। চা বাগানের ইতিহাসে এমনটি হয়নি। বিনাগুড়ির মিশনারিদের স্কুলে কোনো রকমে ম্যাট্রিক পাস করে বসেছিল ফ্রান্সিস। বেচারা কুলির কাজেও যেতে পারছিল না আবার অন্য চাকরিও পাচ্ছিল না। যেদিন ফ্রান্সিস কাজ পেল সেদিন তাদের কি বিজয়োল্লাস। বাবুরা সব গম্ভীর মুখে রয়েছে। মদেসিয়া ওরাঁও-এর ছেলেরা যাদের এতদিন ওরা মানুষই মনে করত না তারা আজ সমান সমান, চেয়ারে বসবে, পাশাপাশি বাবুদের কোয়ার্টারে থাকবে এটা মেনে নিতে মন চাইছিল না। তখন থেকেই সিরিলরা ঠিক করেছিল যদি কেউ কটুক্তি করে তাহলে তাকে ছেড়ে দেবে না। এ চাবাগান কার? যারা রক্ত দিয়ে চা তৈরি করছে বছরের পর বছর, যাদের ওপর শুধু হুকুমের চাবুক চলেছে তারাই আজ সংখ্যায় ভারী। এই বাগানের বাবু যদি পনেরো জন হয় তবে কুলি হবে কমসে কম পনেরশ। এক ফুঁয়ে উড়ে যাবে ওরা। যাক্, মনে যাই হোক মুখে কিছু বলেননি বাবুরা। ফ্রান্সিস ছোট গুদামবাবুর কাজে লেগে গেল। লাইন থেকে উঠে বাবুদের পাশাপাশি কোয়াটারে চলে গেল। কুলিদের ভরসা বাড়ল। এই করে একদিন সাহেবের চাকরিতেও হয়তো মদেসিয়াদের দেখা যাবে। সিরিলের হাঁটার অভ্যেস দুলে দুলে এবং যেন খানিকটা উড়ে উড়েই। পিচের রাস্তায় কিছুটা হাঁটলে বাঁয়ে ডাইনে বাবুদের কোয়ার্টার। সেদিকে তাকিয়ে হাঁটতে গিয়ে পেছনে হর্ন বাজল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল সে ছোটা সাহেব। সেলাম করবে না ভেবেও হাতটাকে ঠেকাতে পারল না সে। ছোটসাহেব চলেই যাচ্ছিলেন কিছুদূর গিয়ে গাড়ি থামালেন। সিরিল একটু অবাক হল। বাগানের সাহেবদের ধারে কাছে ঘেঁষতে চায় না সে। সব শালা যেন এক একটা আমজাদ খান। সিরিল বাঁ দিক দিয়ে সরে যাবে বলে পা বাড়াতেই গাড়িটা ব্যাক করে পাশে এসে দাঁড়াল। ছোটসাহেব মুখ বেরে করে বললেন, তোর নাম কিরে? –
সিরিল।
মাংরা সর্দারের ছেলে না তুই? জি।
সবাইকে যেসব জ্ঞান দিচ্ছিস নিজে তা বুঝিস?
মানে?
কাল একটা মেয়ে তোর বাবাকে অপমান করেছিল। সে বলল তুই নাকি ওভাবে কথা বলতে শিখিয়েছিস। নিরি না কি যেন নাম–।
নিরি! সিরিল আস্তে আস্তে উচ্চারণ করল নামটা।
ছোটসাহেব বললেন, এই বাগান তোর মায়ের মত। এমন কিছু করিস না যাতে এর অপমান হয়। যে খাবার দেয় তাকে সম্মান জানানো উচিত। কথা শেষ করেই হুস করে চলে গেল গাড়িটা। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল সিরিল। কী বলতে চাইলেন ছোটসাহেব? কোনো সাহেব যে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে এসব কথা বলতে পারে তাইতো বিশ্বাসযোগ্য না। বড়সাহেব হলে? ভাবাই যায় না।
এই ছোটসাহেব নোকটা অদ্ভুত। লোকটা নাকি গরিব ঘরের ছেলে। ভাল পড়াশুনা করে ট্রেনিং ফ্রেনিং নিয়ে সাহেব হয়েছে। অন্য সাহেবরা ওকে তাই ভাল নজরে দেখে না। এই চা বাগানে আগে একটাই য়ুনিয়ন ছিল। এখন তিনটে, এখন যারা মন্ত্রী তাদের য়ুনিয়নই বেশি জোরদার। প্রতিবারই এরকম হয়। কিন্তু একটা ব্যাপার নিয়ে কুলিদের মধ্যে ফিসফাস হচ্ছে। প্রথম থেকে কুলি য়ুনিয়নের মাথায় বসে আছে শহরের পলিটিক্যাল বাবুরা। গোলমাল হলে তারা যেন দয়া করে আসেন, সাহেবের বাংলোয় বসে কথা বলেন, একটা মিটমাট করে দিয়ে চলে যান। এই ব্যাপারটা পাল্টাতে হবে। সিরিল এবং তার বন্ধুরা এখন মাল কামায়। ভোটের আগে পার্টির কাছ থেকে পয়সা নেয় আর মনে মনে গালাগালি দেয়। মন্ত্রীত্ব যে দলের কব্জায় আসে তাদের য়ুনিয়নে ঢুকে যেতে ওদের সময় লাগে না। কিন্তু এসব করে মাঝে মাঝে পকেট ভারী হলেও মন কেমন করে। ওই যে ছোটসাহেব কথাটা বলে গেল, যে খাবার দেয় তার ইজ্জত বাঁচাতে হবে। সিরিলদের ধারণা, পলিটিক্যাল বাবুরা এসবের ধার ধারে না।
ট্রানজিস্টারটা হাতে বেজেই যাচ্ছিল। সিরিল গেটটা খুলল। বিরাট কোয়ার্টার। চারপাশ তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। ফ্রান্সিস বাবু হবার পর এখানে এসেছে। মনে পড়ে, প্রথম দিন সে যখন এই কোয়ার্টারের দখল নিয়েছিল সেদিন কয়েকশ কুলি মিছিল করে এসেছিল ওর সঙ্গে। সিরিল ট্রানজিস্টারটা বন্ধ করে বারান্দায় উঠে চিৎকার করে ফ্রান্সিসকে ডাকল।
একটা বছর পাঁচেকের হাফ প্যান্ট পরা ছেলে দরজায় উঁকি মেরে ভেতরে ছুটে গেল। তারপর একটা বছর পনেরোর ছুকরি এসে জিজ্ঞাসা করল, কী চাস?
ফ্রান্সিসকে ডাক।
বাবু নাম জিজ্ঞাসা করল।
বাবু! সিরিলের খেয়াল হল এ মেয়েটাকে সে কখনো দ্যাখেনি। এ ফ্রান্সিসকে বাবু বলছে কেন? সিরিল জিজ্ঞাসা করল, তোর ঘর কোথায়?
হাসিমারা।
এখানে কী করিস?
কী আর করব। খানা পাকাই, ঘরের কাম করি।
ও, ফ্রান্সিসকে বল সিরিল এসেছে।
মেয়েটি ভেতরে চলে যেতেও সিরিল মাথা পরিষ্কার করতে পারছিল না। ফ্রান্সিস বাড়িতে কাজের লোক রেখেছে অন্য বাবুদের মতন। আর এনেছে একদম হাসিমারা থেকে যেখানে কেউ তাকে চেনে না। এসব ভাবতে ভাবতেই ফ্রান্সিস এল। পাজামা আর সার্ট পরেছে। ওকে দেখে অবাক হল যেন, বলল, কী খবর? গুদামে কিছু গোলমাল হয়েছে?
সিরিল দেখল এই সময়ে মধ্যেই ফ্রান্সিসের চেহারার বেশ পরিবর্তন হয়েছে। মদেসিয়াদের কালো চামড়ার ওপর একটা চকচকে পালিশ লেগেছে। এমন কি সে যে এই প্রথম বাড়িতে এল সেটা না ভেবে অন্য বাবুদের মত কাজের কথা বলছে।
সিরিল বলল, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
কী কথা?
সেদিন গুদামে তুমি বুধুয়ার সঙ্গে ওরকম কথা বলেছ এটা সবাই ভালভাবে নেয়নি। তুমি কি তোমার জাতভাইকে স্বীকার করছ না আজকাল?
এসব কথা কেন?
কারণ সবাই তোমাকে বাবু বলে ভাবতে শুরু করেছে।
হাসল ফ্রান্সিস, আমি তো বাবুই। ছোট গুদাম বাবু।
কিন্তু সেটা তোমাকে করল কে? আমরা যদি সাহেবকে গিয়ে না ধরতাম তাহলে তুমি এই চাকরি পেতে?
তুই কী চাস?
আমি চাই তুমি আমাদের লোকের মত কাজ করবে।
বাঃ, বহুৎ আচ্ছা! তোমরা ফাঁকি দেবে, কাম করবে না, আর আমি তাই দেখে চোখ বুঁজে থাকব? আমাকে তাই মাইনে দেওয়া হয়? আমি যখন বাবুর চাকরি করছি তখন একজন বাবু যে ভাবে কাজ করে আমি তাই করব। আর এ কথা তুই বলতে এসেছিস কেন? আমার সঙ্গে য়ুনিয়নের এ ব্যাপারে পরিষ্কার কথাবার্তা হয়ে গেছে।
কোন্ য়ুনিয়ন?
আমাদের য়ুনিয়ন। বাবু য়ুনিয়ন।
সিরিল আর দাঁড়াল না। ফ্রান্সিস সম্পর্কে ওর বাবাই এখন বলে–দাঁড় কাক ময়ূরের পেখম পাছায় গুঁজে ময়ূর সেজেছে। সিরিলের মনে হল, সাজাসাজি নয়, ফ্রান্সিস সত্যিকারের ময়ূর হয়ে গেছে। এখন ওর কোনো জাত নেই। শালা অতক্ষণ তার সঙ্গে কথা বলল কিন্তু একবারও বসতে বলল না। কুলি লাইনের অনেকেই মনে করে ফ্রান্সিস তাদের লোক–এই ভুলটা ধরিয়ে দেওয়া দরকার।
নদী পেরোলেই হাট শুরু। আগে ছোট ছিল এখন বাড়তে বাড়তে নদী অবধি চলে এসেছে। দুপুর অবধি শাকসবজি আর সাপ্তাহিক প্রয়োজনে সবাই ঘোরাফেরা করে। দুপুরের পর থেকেই হাটের চেহারা যায় পালটে। তখন চারপাশে মেলার আমেজ। মেয়েরা আসে সেজেগুজে। নানান শখের জিনিস বিক্রি শুরু হয়ে যায়। মাইকে হিন্দি গান বাজে। যেন রমরমে ব্যাপার।
এ সিরিল! চিৎকারটা শুনে সিরিল চারপাশে চোখ বোলালো। চেনাশোনা প্রায় সবাই, কিন্তু যে ডাকছে তাকে দেখতে পেল না সে। আরো কয়েক পা যাওয়া মাত্র সেই চিৎকার। সিরিল গলাটা চেনে, রসিকতা ও তরফই শুধু করবে এরকা হতে দেওয়া যায় না। সে চটপট বাঁ দিকে পাঁপড়ের দোকানে দাঁড়ানো মেয়েটার কাঁধে হাত রেখে বলল, তোকে আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে রে!
মেয়েটা এমন অবাক হয়ে গেল যে ঘাড় ঘুরিয়ে ওকে দেখতেই লাগল কিছুক্ষণ। হাতে পাঁপর আধখাওয়া অবস্থায় রয়েছে, ঠোঁটের চারদিকে তার তেল চকচক করছে। অন্য লাইনের মেয়ে, এর আগে কয়েকবার দেখেছে কিন্তু এভাবে কথা বলার মত সম্পর্ক নয়। মেয়েটি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, নেশা করেছিস না?
সিরিল হাতটা সরাল না, সুন্দর জিনিস কি নেশা করে দেখতে হয়? ওটা দেখেই তো মানুষের নেশা হয়। কয়েকদিন আগে অমিতাভ বচ্চনের মুখ থেকে শোনা এই ডায়লগটা। তেমনি কায়দা করে আবৃত্তি করল সে। মেয়েটা এতে আরো ঘাবড়ে গেল। কোনরকমে পাঁপরটা দু টুকরো করে বড়টা সিরিলের দিকে এগিয়ে ধরে বলল, নে, খা।
সিরিল বাঁ হাতের দুই আঙুলে কায়দা করে সেটা তুলে নিয়ে বলল, আবার যখন দেখা হবে তখন যা খাওয়াব তুমি খাবে তো? এটাও অমিতাভ বচ্চনের সংলাপ। কথাটা শেষ করে উত্তরের জন্যে না দাঁড়িয়ে ও ভিড় বাঁচিয়ে হাঁটতে লাগল। মেয়েটি ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের মনে বলে উঠল, শালে বদমাস, অমিতাভ বন্ গেলেক!
সামনে তাকাতেই সিরিল হেসে ফেলল। কোমরে হাত রেখে নিরি দাঁড়িয়ে আছে। মুখ থমথমে, চোখে আগুন। বড় জোর মাস ছয়েক জানা-শোনা হয়েছে কিন্তু নিরি এমন ভঙ্গি করে যে মনে হয় সারাজীবন একসঙ্গে আছে। মেয়েটা সুন্দর। ওকে যদি জিনত আমন কিংবা হেমা মালিনীর মত পোশাক পরানো যেত তো চোখ জ্বলে যেত সবায়ের। এখনও সেই আদ্যিকালের প্যাঁচ দেওয়া শাড়ি আর তার ওপর আংরা পরে। তা শাড়িটা যদি বাঙালি মেয়েদের মত পরত তাহলেও কথা ছিল। সিরিল মানসনেত্রে নিরিকে জিনত আমনের পোশাকে দেখে শিহরিত হল। শালা ওর মরদটা নিশ্চয়ই তিন নম্বরের হারামি, নইলে এই রকম বউকে সামলাতে পারে না। বড় কষ্ট মেয়েটার–একে দেখার পর থেকেই সিরিলের মনে হচ্ছে এই চা-বাগানের সব কিছু বেশ ভাল।
আমি ডাকছি শুনতে পাচ্ছ না? নিরি ফুঁসে উঠল।
ডাকলেই শুনতে হবে?
সব পুরুষ সমান। ওই মেয়েটার মধ্যে কী আছে এমন যে আমার ডাক শুনবে না!
ওকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে আসব? ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েটাকে খুঁজল সিরিল।
সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত এগিয়ে এসে সিরিলের হাতে প্রচণ্ড চিমটি কাটল নিরি। ওর মুখ থেকে চিৎকারটা বেরুনো মাত্র সবাই এ দিকে তাকাল। হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, এরকম চিমটি যে বিনাগুড়িতে গেলে শেখা যায় তা জানতাম না, উঃ!
অ্যাই! নিরি আর একবার আক্রমণ করতে উদ্যত দেখে সিরিল দ্রুত সরে দাঁড়াল। তারপর হাত বাড়িয়ে বলে উঠল, দাঁড়াও দাঁড়াও, জব্বর খবর আছে। কাল রাত্রে মাংরা সর্দার সবাইকে ডেকে বলেছে তোমাকে শাদী করবে হা-হা হা। তাহলে তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কী দাঁড়াল যেন।
কথাটা এমন মজা করে বলা যে হাটের মানুষগুলো হো হো করে হেসে উঠল শুনে। কেউ কেউ আবার সম্পর্কটা চেঁচিয়েও বলে দিল। শোনামাত্রই নিরি বড় বড় পা ফেলে হিন্দুপাড়ার রাস্তায় হাঁটতে শুরু করল। দ্রুত যে চোখের জলের বন্যা ওর দিকে ধেয়ে আসছে তাকে সামলাবার জন্যে ওকে কষ্ট করে লড়তে হচ্ছিল। হাটের মানুষজন, দোকানের তাবু টাঙানো দড়ি–কিছুই আর চোখের সামনে নেই। ওর শুধু এটুকুই মনে হচ্ছিল এ রকম অপমানিত সে কখনও হয়নি। এই একহাট মানুষের সামনে সিরিল যে ঠাট্টাটা ওর সঙ্গে করল তা বিনাগুড়ির স্বামীর ঘর থেকে চলে আসার সময় যা ঘটেছিল তার থেকে অনেক জ্বালাকর। অথচ আজ সকাল থেকে ও ভাবছে কখন হাটে সিরিল আসবে! সে ঠিক করেছিল সিরিলকে বলবে কাল রাগের মাথায় মাংরা সর্দারকে যেকথা সে বলেছে সেটা বলা ঠিক হয়নি। আজ সিরিলের সঙ্গে মাংরা সর্দারের কাছে গিয়ে সে ক্ষমা চাইবে বলে ঠিক করেছিল। বুড়ো মানুষ, তার ওপর লোকটা সিরিলের বাবা, ক্ষমা চাইতে কোনো লজ্জা নেই। কিন্তু দেখা হওয়া মাত্রই সিরিল ও কথা বলল কেন? নিজের বাপকে নিয়ে ওর সঙ্গে রসিকতা! হন হন করে হাঁটতে লাগল নিরি।
এই পরিবর্তন, নিরির অমন চলে যাওয়ামাত্র সিরিল বুঝেছিল যে কথাটা বলা ঠিক হয়নি। কেন যে সবাই অত অল্পে মন ভার করে কে জানে। কাল রাত্রে বাপ নেশার ঘোরে কথাটা বলছিল বার বার, মা যখন ধোলাই দিচ্ছিল তখনও সেই বাক্যিটা মুখ থেকে সরছিল না–এই নিয়ে খুব হাসি-তামাসা হয়েছিল। নেশার ঘোরে মানুষ নাকি সত্যি কথা বলে। তাহলে মাংরা সর্দারের নিরির ওপর মনে মনে লোভ ছিল। কথাটা কেউ জানাতে মায়ের রাগ আরো বেড়ে গিয়েছিল। সিরিলের কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই বেশ মজাদার বলে মনে হয়েছিল। লোকমুখে বাগানের ভেতর বাবা আর নিরির গোলমালটা সে শুনেছিল। প্রতি মুহূর্তে সে সতর্ক হয়েছিল বাবা ওকে আচ্ছাসে ঝাড়বে। খামোকা একটা মেয়ের ঝুঁটি ধরার কোনো অধিকার বাবার নেই। সেটা করলে ও রকম ব্যবহার তো পাবেই। নিরি যে ফোঁস করে উঠছে তাতে সে খুশি। দাদু বলে আগে নাকি যে-কোনো মেয়েকে যখন তখন সাহেবরা তুলে নিয়ে গিয়ে মা বানিয়ে ছেড়ে দিত। কারো কিছু বলার ক্ষমতা ছিল না। দাদুর কথা শুনলে মনে হয় এটাই সেকালে স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। বাবা অতটা মনে করে না কিন্তু সাহেবদের কাছ থেকে শিখেছে যে কাজ আদায় করতে গায়ের জোর ফলাতে হবে। সে ছেলে কিংবা মেয়ে হোক তাতে কিছু এসে যায় না। বাড়িতে দুদণ্ড থাকতে ইচ্ছে করে না সিরিলের। সব্বাই যেন ধুঁকছে। হাঁড়িয়া খাওয়া পানসে চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কেউ কিছু জানে না। শুধু তার বাড়িই নয়, লাইনের অন্যান্য ঘরগুলোরও ওই এক দশা। আজ সকালে মাংরা সর্দার তাকে কিছু বলল না। উলটে মা ঘ্যানর ঘ্যানর শুরু করল। নিরি নাকি একটা বাজে ধরনের মেয়ে। স্বামীর ঘর করতে তো পারেইনি উলটে এর ওর তার সঙ্গে ঘুরছে কিন্তু কাউকে শাদী করছে না। সিরিলের মত ছেলে ইচ্ছে করলে কত ভাল ভাল মেয়েকে বিয়ে করতে পারে। এই তো তেলিপাড়ায় একটা মেয়ে আছে। বাঙালি বাবুদের স্কুলে দুই তিন ক্লাস পড়েছে। শাড়িটাড়ি পরে বাঙালিদের মতন। তাকে বিয়ে করে সুখে থাকতে পারে। কিন্তু ওই বেশরম মেয়েটার পাল্লায় পড়লে তার সব যাবে। এসব কথা তাকে শুনিয়ে বলা, সামনাসামনি নয়। আর সেটা শোনার পর নিরি সম্পর্কে অন্যরকম ভাবতে শুরু করল। মেয়েটার সঙ্গে তার আলাপ আছে, ঘনিষ্ঠতাও একটু কিন্তু ঠিক প্রেমট্রেম হয়নি। এর একটা অন্যতম কারণ নিরি হিন্দি সিনেমা দ্যাখে না। যে মেয়ে হেমা মালিনীকে দ্যাখেনি তার সঙ্গে ডায়লগ বলে সুখ নেই। বরং চুনাভাটি বাগানের নেপালি দারোয়ানের মেয়ে প্রেমকে তার পছন্দ খুব। জামাকাপড় কথাবার্তা দেখলে মনে হয় একদম ফিল্ম থেকে মাটিতে নেমে এসেছে। হাসে যেন হেমা মালিনী, হাঁটে যেন জিনত আর কথা বলে রেখার মতন। কিন্তু মুশকিল হল বাজার-হাট বিনাগুড়ি যেখানেই ও সিনেমা দেখতে যাক মৌমাছির মত একগাদা মালদার ঘিরে থাকে। তাই প্রেম আর ফিলিমস্টার ওর কাছে একই রকম।
নিরির চলে যাওয়া নিয়ে প্রথমে মাথা ঘামায়নি সিরিল। এইসাই তো হোতা হ্যায়। কিন্তু কয়েক পা হাঁটতেই যাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল তারা বেশ উত্তেজিত। এই চা বাগানের সবচেয়ে শক্তিশালী য়ুনিয়নের ওরা সক্রিয় কর্মী। এরা সিরিলকে অনেকবার দলে টানতে চেয়েছে কিন্তু ততদিনে সিরিল শাঁসটা বুঝে গিয়েছে! যতক্ষণ না তোমার দল মন্ত্রিত্ব পাচ্ছে আমি তার মধ্যে নেই।
হাটের একপাশে টেনে নিয়ে গেল ওরা সিরিলকে। একজন সিরিলকে অভিনন্দন জানাল নিরিকে ঐভাবে তৈরি করার জন্যে। অত্যাচার করলে নিজের বাবাকেও যে ছেড়ে দেবে না এই সাহস এখন সমস্ত শ্রমিকের দরকার। ওরা ভাবছে নিরিকে নিয়ে একটা সভা করবে বড় মাঠে। নিরির সাহস যাতে অন্য মেয়েরা পায় সেই জন্যে এ রকম সভা হওয়া দরকার। কারণ সামনে খুব খারাপ সময় আসছে। মালিকের মতলব বোঝা যাচ্ছে না। বাগানে যে লাভ হয় তার সবই তো মালিকের ব্যাঙ্কে যায়। এবার বিশ পার্সেন্ট বোনাস চেয়েছে য়ুনিয়ন। যদি রফা না হয় তাহলে বাগান বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এজন্যে সমস্ত শ্রমিককে এক করা দরকার। সিরিল যেন আর গা এলিয়ে না থেকে য়ুনিয়নের সঙ্গে সক্রিয় সহযোগিতা করে। এ ব্যাপারে নিরিকে ও বুঝিয়ে সভায় আসতে রাজি করাক।
আগে হলে চটপট মনের কথা প্রকাশ করত সিরিল। আজকাল ভাববার সময় নেয় সব কিছুতেই। এতে অনেক সময় অপ্রিয় হবার দায় থেকে বাঁচা যায়। এর মধ্যে ওদের একজন বলল, তোরা শাদী করছিস কবে?
শাদী?
হুম। তোর মদৎ না থাকলে নিরি কখনো মাংরা সর্দারকে অপমান করতে পারে? তা আজ কী হল? একটু আগে দেখলাম মেয়েটা হিন্দুপাড়ায় রাস্তায় কাঁদতে কাঁদতে হেঁটে যাচ্ছে। আরে বাবা মেয়েটাকে ঘরে নিয়ে যা না বউ করে তাহলেই সব মিটে যায়। চাঁদ আকাশে ছাড়া থাকলে মেঘ তাকে ঢাকবেই!
ঠিকই তো! আর একজন টিপ্পনি কাটল, মাথার ওপর স্বামী নেই তাই এর ওর মাথা খাবেই তো মেয়েটা। তোর উচিত আর দেরি না করা।
ওদের কাছ থেকে সরে এসে সিরিল কিছুক্ষণ বুঝতে পারছিল না তার কী করা উচিত। নিরিকে ওর ভাল লাগে কিন্তু বিয়ে করার কথা চিন্তাও সে করেনি। তার ওপর মেয়েটার একটা স্বামী বেঁচে আছে বিনাগুড়িতে, সে শালা ঝামেলা পাকাতে পারে। কিন্তু মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ওদিকে গিয়েছে কেন। ওই রাস্তায় মানুষজন এমনিতেই বেশি যেতে চায় না। একটু ইতস্তত করে সিরিল হাট ছেড়ে হিন্দুপাড়ার দিকে পা বাড়াল।
কিন্তু ব্যাপার স্যাপার ক্রমশ ঘোরালো হয়ে যাচ্ছে। বোনাসের দাবি নিয়ে এবার একটা জব্বর লড়াই হবে কোম্পানি আর শ্রমিকদের মধ্যে এসব অনেকদিন থেকেই শোনা যাচ্ছিল। কোম্পানি দিয়েছে সাড়ে আট পার্সেন্ট, য়ুনিয়ন চাইছে বিশ। দেড় গুণ। শালা, রক্ত দিয়ে চা তৈরি করি আমরা আর লাভের গুড় একলাই খাবে তোমরানা, এ হয় না। কিন্তু কাম বন্ধ হলে সেটা কতদিন চলবে। একটা শ্রমিক যদি তিনশ টাকা রোজগার করে তার দশ টাকাও মাসের শেষে ধার হয়। আর যদি এক মাস বন্ধ চলে তো হয়ে গেল। মালিকরা সেটা জানে বলেই এত জোর পায়। কিন্তু এবার কোন আপোস না, ইয়ে চা বাগান হামারা হ্যায়, আমাদেরও অংশ দিতে হবে এর লাভের। খুব জোর মালিক বাগান বিক্রি করে দিতে পারে। নতুন মালিককেও তো এটা মানতে হবে। দশটা বাঙালি বাবুকে রাতারাতি তাড়িয়ে নতুন বাবু বসাতে পারে কোম্পানি কিন্তু দেড় দু হাজার কুলি সরালে কাকে দিয়ে বাগান চালাবে? এর আগে একবার এ রকম হয়েছিল। কোম্পানির সঙ্গে গোলমাল লেগেছিল য়ুনিয়নের দার্জিলিং-এর কাছে এক বাগানে! বহুৎ ভারী ঝামেলা। কোম্পানি বাগান বন্ধ করল। সবাই বাগান থেকে পাতি তুলে এক জায়গায় জমা করে নিয়ে অন্য বাগানের কাছে সস্তায় বিক্রি করতে চাইল। অন্য বাগানের মালিক প্রথম প্রথম এ রকম পাতি দু হাতে কিনলেও পরে কি কারণে পিছিয়ে গেল। চায়ের পাতা তো আর মুখে ফেলে খাওয়া যায় না? অনেক মেশিনের কসরৎ ওকে দামি করে তোলে। সেই মেশিনটাই যদি তুলে নিয়ে যায় কোম্পানি তাহলে চা বাগান তো মাঠ হয়ে যাবে। হঠাৎ সিরিলের খেয়াল হল ওরা কেউ চাষবাস জানে না। সেই টেবুয়া থেকে চলে আসার পর, চাষবাসের আর প্রশ্নই ওঠেনি। এখন তার নিজের পক্ষেও চাষ করা অসম্ভব। বাপ তো প্রায় বুড়োই হয়ে গেল। এই চা-বাগান না থাকলে তার রোজগারের একমাত্র পথ হাটে বাজারে মাল বওয়া। না, এই চা-বাগানই তাদের প্রাণ, এটাকে মেরে ফেলে তারা বাঁচতে পারে না। দাদু যে টেবুয়াতে ফিরে যাওয়ার কথা সব সময় বলে, তা নিছক পাগলামি বলে মনে হয় সিরিলের। টেবুয়াতে ফিরে গেলে খাবটা কী! সেখানে তো চা-বাগান নেই।
চৌমাথা পার হতে গিয়ে মনে ঢেউ উঠল। অম্বিকার দোকানে আজ করনেশন রামটা আসার কথা। ভুটানের রাজার অভিষেকের সময় এই ব্র্যান্ডটা বাজারে ছেড়েছিল সামচির ডিস্টিলারি। প্রথম প্রথম খুব ডিম্যান্ড ছিল, চোখেই দেখা যেত না। এখন অম্বিকা মাঝে মাঝে আনায়। পানের দোকানের আড়ালে বারো টাকায় বোতল বিক্রি করে।
কোনো রকমে লোভ সামলাল সিরিল। সন্ধের পর দেখা যাবে। আগে নিরির ব্যাপারটা সামলানো যাক। পেট্রল পাম্প ছাড়িয়ে নির্জন পথটায় পড়ল সে। ছায়া ছায়া চার ধার। খুব চুপচাপ বলে পাখির গলা স্পষ্ট শোনায়। সিরিল ভেবেই পাচ্ছিল না এখানে নিরি কী জন্যে আসতে পারে। পিচের রাস্তাটা ছোট্ট বাঁক নিয়ে দু পাশে চা বাগান রেখে চলে গেছে বানারহাট বিনাগুড়ির দিকে। তবে কি ও বিনাগুড়িতে হেঁটে ফিরে যাচ্ছে? দূরত্ব এমন কিছু নয়। তিন ক্রোশ পথ হেঁটে অনেকেই যায়। কিন্তু সামান্য একটা রসিকতা শুনে ফেলে আসা স্বামীর ঘরে আবার ফিরে যাবে মেয়েটা? সিরিলের মনে হল তাই যদি যায় তো যাক। শান্তি না পাক স্বস্তিতে থাকুক। পরক্ষণেই খেয়াল হল যে স্বামীকে এত ঘেন্না করে ও চলে এল তার কাছে ফিরে যাওয়া মানে স্বেচ্ছায় নিজেকে মেরে ফেলা–কি একটা সিনেমায় এ রকম ঘটনা সে দেখেছে। ডায়লগটা ছিল, বিষ খেলে মানুষ জানার আগেই মরে যায়–আর এ মরণ তিলে তিলে প্রতি মুহূর্তের যন্ত্রণা নিয়ে। সিরিলের শরীরটা গরম হয়ে গেল। ও যদি যায় তো যেতে পারে কিন্তু যাবার আগেই সিরিল একবার প্রশ্ন করবে। যদি যাবেই তো এল কেন?
দু পাশে বড় বড় গাছ, কিছু জঙ্গল–মাঝে মাঝে হুম হাম গাড়ি ছুটে যাওয়া। বিকেল ফুরিয়ে আসছে। ডুয়ার্সে এখন বাঘ নেই। কিন্তু হাতির উপদ্রব বেশি। মাঝে মাঝে একলা হওয়া হাতি এসে জোর ঝামেলা করে। হিন্দুপাড়ার এই রাস্তায় মানুষ আসছে না ও রকম এক হাতির জ্বালায়। বুড়ো হওয়ায় দল ছাড়া হাতিটা শয়তানের চেয়ে বেশি বুদ্ধি ধরে। তিন তিনটে মানুষকে মেরেছে এক মাসে। হিন্দুপাড়ার এই জঙ্গলটা তার এলাকা। সাহেব শিকারি আনিয়েও ওকে মারতে পারেনি। জঙ্গলে খাবার না পেয়ে হাতির দল মাঝে মাঝে কুলি লাইন এমনকি এক রাতে বাজারের চৌমাথায় নেমে এসেছিল। তখন তাদের সামনে অতি মূর্খও দাঁড়াবে না। শিকারিরা আসার পরই সেই হাতিটা এমন গা ঢাকা দিয়েছিল যে কেউ আর তার সাড়াশব্দ পায়নি। কিন্তু সে আছে এখানেই। তাই সন্ধ্যে হয়ে আসা সময়ের নির্জন পথটায় নিরির দেখা যদি সে পায় তাহলে আর রক্ষে নেই এটা ভাবতেই সিরিলের বুকের রক্ত চলকে উঠল। বিনাগুড়ি নয়, নিরি কি ইচ্ছে করে এ রাস্তায় এসেছে? হাতিটা ওকে দেখতে পাক এটাই কি বাসনা?
পিচের রাস্তাটা এখন নাকবরাবর সিধে। অন্তত আধ মাইল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। না, নিরি নেই। ওর হাট থেকে চলে আসা আর সিরিলের রওনা হওয়ার মধ্যেও সময়ে কি একটা মেয়ে আধ মাইল যেতে পারে? অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিল সে। নিরিকে যদি দেখতে না পায় আর। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় বিনাগুড়িতে পৌঁছে যাবে ও। সেখানে গিয়ে যদি শোনে নিরি চলে এসেছে তাহলে চুপচাপ ফিরে আসবে। ফিরে আসতে পারে যদি হাতিটার সঙ্গে দেখা না হয়।
একটু একটু করে কুয়াশা জমছে রাস্তায়। ফগ লাইট জ্বালাচ্ছে গাড়িগুলো! এখন অবশ্য গাড়ির সংখ্যা কম। শীত লাগছে সিরিলের। হাতের রেডিও আবার খুলতে গিয়ে মন পাল্টালো। গানের শব্দ শুনে হাতিটা যদি কাছাকাছি থাকে তবে আর দেখতে হবে না।
সিরিলের মনে হল রাস্তা না দেখে দু পাশের চা বাগানগুলো দেখলে হয়। কেউ যদি ইচ্ছে করে লুকোতে চায় তাকে ভগবানও খুঁজে বের করতে পারবে না। কিন্তু তবু–। চট করে বাঁদিকের। নীচু-ডাল একটা কাঁঠাল গাছে উঠে পড়ল সে। ট্রানজিস্টরকে বেলটের হুকে আটকে তর তর করে অনেকটা ওপরে উঠে চার পাশে চোখ বোলাতে লাগল। এদিকটা চা বাগান বেশি চওড়া নয়। শ দুয়েক গজ পরেই ফরেস্ট শুরু। সন্ধ্যে নামল বলে। হতাশ হয়ে নামবার আগে বিন্দুটা চোখে ঠেকল। ভাল করে ঠাওর করতে গিয়ে মেরুদণ্ডে কনকনানি টের পেল সিরিল। অন্তত পাঁচ মিনিটের পথ ছাড়িয়ে চা বাগানের ওপাশে জঙ্গলে যেটা স্থির কালো জমাট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেটা যে ওই একলা হাতিটাই এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ সে। অমন স্থির হয়ে আছে কেন হাতিটা? আরো কয়েক মিনিট সে লক্ষ্য করল। এত নিশ্চল যে চট করে মনে হবে জঙ্গলেরই একটা অংশ। তার সঙ্গে যে দূরত্ব তাতে বিপদের কোনো আশংকা নেই। তাছাড়া এত ওপরে হাতি নাগালও পাবে না। কিন্তু তেমন হলে সারা রাত সে আটক থাকলে পারে এখানে–সেটাই সমস্যা কিন্তু হাতিটা নড়ছে না কেন? কি দেখছে? হঠাৎ চিৎকার করে উঠল সিরিল। গাছের ডালে বসে দুটো হাতে মুখের দু পাশ ঢেকে উৎকট শব্দ বের করল। সেই সঙ্গে ট্রানজিসটার চালিয়ে দিল পুরো শক্তিতে। আর এটা করতেই সে চমকে উঠল। হাতিটা নড়ে উঠেছে। যেন কোনো কিছুতে একাগ্রতা ভাঙতেই তার চাঞ্চল্য। এক পা এগিয়েই মত পরিবর্তন করল। সিরিল বিস্ময়ে ওর পাহাড়ের মত আকৃতিটা স্পষ্ট দেখতে পেল এবার। হয়তো কোনো বিপদের গন্ধ পেয়েই ঘুরে গেল হাতিটা। তারপর জঙ্গল ভাঙতে ভাঙতে উল্টোদিকে দৌড় শুরু করল। কিছুক্ষণ পর তার চিহ্ন দেখা গেল না, শব্দও মিলিয়ে গেল। এবার সিরিলের চোখ যার দিকে সে কিন্তু তাকে দেখতে পাচ্ছে না। নিরির লম্বা শরীরটা এখন সোজা দাঁড়িয়ে হাতিটার কাছ থেকে ওর দূরত্ব পঞ্চাশ গজও ছিল না। এত কাছাকাছি গিয়েও বোধ হয় হাতিটাকে দ্যাখেনি নিরি। ওখানে নিশ্চয় একটা ছোট ঝরনা আছে যেগুলো চা বাগানের মধ্যে দিয়ে চুপচাপ বয়ে যায়। নিরিকে এতক্ষণ দেখা যায়নি কারণ সে ঝরনার পাশে বসেছিল। হাতিটা অবশ্যই তাকে দেখেছে। কিন্তু দেখেই খেপে গিয়ে আক্রমণ করেনি, তারিয়ে তারিয়ে দেখছিল। কিন্তু ওখানে গিয়ে বসা মানে মৃত্যু ফণায় চুমু খাওয়া নিরি কি তা জানত না?
নিরি ঘাড় ঘুরিয়ে সামনে পেছনে তাকাচ্ছে। ততক্ষণে সে বুঝতে পেরেছে তার যম কত কাছে ছিল! চিৎকার করেছে কিনা শুনতে পায়নি সিরিল কিন্তু হঠাৎ পাগলের মতো দৌড়তে দেখল শরীরটাকে। আতঙ্কিত হলে যেভাবে মানুষ দৌড়ায়। সিরিল গাছ থেকে নেমে চা বাগানের মধ্যে ঢুকে পড়ল। যদিও হাতিটা এখন দৃষ্টিসীমার মধ্যে নেই তবু এ রকম অবস্থায় যে কোনো রকম দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। রাস্তাটার আড়াআড়ি চা-বাগানের মধ্যে দৌড়ে যাচ্ছে নিরি। সিরিল চিৎকার করে তাকে ডাকল। হঠাৎ যেন পাথর হয়ে গেল মেয়েটা! দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখল। সিরিল বুঝতে পারল ভীষণ অবাক হয়ে গেছে মেয়েটা। দূরত্বটা অনেক হলেও সিরিলকে সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। সিরিল কাছাকাছি হতেই নিরি এক ঝটকায় নিজেকে সচেতন করে আবার পাগলের মত দৌড়তে লাগল। হঠাৎ এ রকম কাজের পেছনে কি যুক্তি থাকতে পারে বোধগম্য না হওয়ায় সিরিল আরো গতি বাড়িয়ে সামনে চিৎকার করে ওকে ডাকতে লাগল।
চা-বাগানের মধ্যে যে পায়ে চলার পথ সেগুলো গোলকধাঁধার মত। স্বচ্ছন্দে অনেকটা ঘুর ঘুর করা যায়। এই নির্জন সন্ধ্যা হওয়া সময়টা দুটো শরীর সেই গোলকধাঁধার পথে ছুটতে ছুটতে ক্রমশ কাছাকাছি হয়ে এল। মাথার ওপর ঘরে-ফেরা পাখির অজস্র চিৎকার, শরীরের ওপর দিয়ে ফিনফিনে কুয়াশারা গড়িয়ে যাচ্ছে। সিরিল এক সময় নিরির কাধ ধরে থামাতে চাইল। এতক্ষণে ওরও বেদম অবস্থা। আটক হওয়া মাত্রই নিরি প্রচণ্ড এক ঝটকায় নিজেকে সরিয়ে নিতে চাইল। সিরিলের হাত সরিয়ে দিয়ে সে যখন সরে যাচ্ছে তখন সিরিল আবার তাকে ধরল, কি হল তোমার–এমন করছ কেন?
মুখে কোনো উত্তর না দিয়ে সজোরে নিজেকে মুক্ত করল নিরি। প্রচণ্ড রাগ হয়ে গেল সিরিলের। আশ্চর্য বেয়াদপ মেয়ে তো! রাগ হলে সিরিল নিজেকে সামলাতে পারে না। সজোরে চড় মারল সে নিরিকে। মুখ সরিয়ে নেওয়ায় আঘাতটা জোরালো হল না। কিন্তু প্রতিক্রিয়া হল মারাত্মক। বাঘিনীর মত ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরি। মেয়েটা বেশ শক্তি ধরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুটো শরীর ধস্তাধস্তি করে পরস্পরকে আঘাত করার চেষ্টায় নিয়োজিত হল। এর মধ্যে সিরিলের ট্রানজিসটারটা মাটিতে বেল্ট থেকে খুলে পড়ে গেছে। কাপড় খানিকটা ছিন্ন হয়ে অসংলগ্ন নিরি ক্রমশ হিংস্র হয়ে উঠেছে। পরস্পরের আঘাতগুলো নির্দ্বিধায় চলছিল। সিরিলের মাথায় এখন কোনো যুক্তি কিংবা আবেগ কাজ করছিল না। একটি অবাধ্য মেয়েকে শক্তির মাধ্যমে সমুচিত শিক্ষা দেওয়াই প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এর মধ্যে নিরি তাকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। সিরিলের আঘাতে ওর ঠোঁটের কোল রক্তাক্ত। হঠাৎ নিরি শক্ত হয়ে গেল। এ রকম নিশ্চল হয়ে যাওয়া মাত্র সিরিলের সমগ্র সত্তা চমক খেল। সে আবিষ্কার করল তার একটি হাত নিরির অর্ধ উন্মুক্ত স্তনের ওপর। এতক্ষণ যে রকম শারীরিক সংঘর্ষ চলছিল তা থেকে এই অনুভূতিটা আলাদা। সিরিলের সমস্ত শরীরে আঘাতের বেদনা ছাড়িয়ে এক অন্য রকম অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল। মেয়েদের স্তন। সম্পর্কে তার এই বয়সে অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে মনে হল তার শরীরে অজস্র জোনাকি জ্বলছে আর নিভছে। এই যে নিরির নিথর হয়ে যাওয়া, একি আহ্বান? কারণ নিরির দুটো চোখ এখন বন্ধ। রক্তে ভেজা লাল ঠোঁটের কোণের অদ্ভুত সুখের ভাঁজ। হাতের মুঠোয় দুটো নরম স্বপ্ন পরম আবেগে লালন করতে করতে সিরিল আবিষ্কার করল তার পিঠের ওপর দুটো সাপের মত হাতের আঁটোসাঁটো বাঁধন আরো তীব্রতর হচ্ছে। যে দুটো হাত এতক্ষণ আক্রমণে ভয়ঙ্কর ছিল তাই এখন ফুলের ডালের মত থরথরিয়ে কাঁপছে। সিরিল একটু একটু করে ডুবতে লাগল। এই উন্মুক্ত নির্জন চরাচরে, পাখির চিৎকার আর কুয়াশার চাদর মোড়া চা-বাগানের সরু রাস্তায় সে নিরির ঝরনায় পাথরঠোকা মাছের মত ঘুরে বেড়াতে লাগল পরম বিস্ময়ে। তার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন অতি যত্নে নিরি আগলে আগলে নিয়ে যাচ্ছে চরম লক্ষ্যের দিকে। কেউ কোনো কথা বলছে না। কথা যখন মরে যায় তখনই বোধহয় এই রকম আনন্দ জন্ম নেয়। নিরির শরীরে নিজেকে প্রবলভাবে আবিষ্কার করল সিরিল।
টিপিয়ে টিপিয়ে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় কুয়াশারা পালাচ্ছে। আকাশটা যেন অতি দ্রুত নীচে নেমে এসেছে। চারপাশে এখন দৃষ্টি যায় না। অন্ধকার গাছের মাথা থেকে বুঝুরু করে মাটিতে ঝরছে। চোখের দৃষ্টি সহজ হলে সিরিল দুহাতের অঞ্জলিতে নিরির মুখ ধরে পরমতৃপ্তিতে চুম্বন করল। নিরির গলায় একটা অস্ফুট আদুরে শব্দ যার মানে পৃথিবীর কোনো কথায় ব্যক্ত করা যায় না। সিরিল শব্দটাকে উপভোগ করে উঠে বসতে গেল। কিন্তু নিরির হাতের বাঁধন শিথিল হতে চাইছে না।
সিরিল বলল, এবার উঠব।
চোখ না খুলে নিরি পাখির মত নরম গলায় বলল, না।
কেন?
আরো একটু থাকো।
বৃষ্টি পড়ছে।
পড়ুক।
রাত হচ্ছে।
হোক।
সিরিলের মনের কোথাও যে চিন্তাটা ছিল না হঠাৎ সেটা উদয় হতে সে শক্ত হল। সেই একলা হাতিটা দুদ্দাড় করে ছুটে পালালেও যদি আবার চুপচাপ ফিরে আসে? ওর মতন ধূর্ত প্রাণী এ তল্লাটে কখনো আসেনি। এখন যদি সে এখানে উপস্থিত হয় তাহলে এ অবস্থায় ওদের কিছুই করার থাকবে না। স্বচ্ছন্দে একটা পা যদি ওদের শরীরে তুলে দেয় তাহলে ওকে আর নিরিকে হয়তো আলাদা করে চেনাও যাবে না। এভাবে শুয়ে থাকা মানে মৃত্যুকে ডেকে আনা। এতক্ষণের উত্তেজনায় যে চিন্তা একবারও মাথায় আসেনি, সেটা সিরিলকে অস্থির করল।
যেন খুব জেদী ছেলেকে ভোলাবার গলায় সে বলল, ওঠো।
ন্ না।
সেই হাতিটা এ অঞ্চলেই আছে। যদি আসে তাহলে মরে যেতে হবে।
যাব।
মানে?
আজ থেকে তো আমি মরেই গেলাম।
সেই বৃষ্টিঝরা সন্ধ্যায় চা-বাগানের মাটিতে নিরির দুহাতের বাঁধনে শুয়ে সিরিল বুক ভরে ভালবাসা নিতে লাগল। ওর হঠাৎ মনে হল দাদু একদম ভুল কথা বলে। এই চা বাগান, যার গন্ধ এখন নাক জুড়ে, নিরি থাকলে তা কখনো বিদেশ হয়?
কুলি লাইনে রটে গেল ছোট সাহেব চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। ব্যাপারটা এতখানি অবিশ্বাস্য যে চট করে কেউ মানতে চাইল না। খবরটা শুকরা বুড়ো কানে গেলে সে হকচকিয়ে গেল। আজ সকাল থেকে কুলি লাইন অন্য একটা ব্যাপারে টগবগে ছিল। সন্ধ্যায় পঞ্চায়েতের মিটিং ডাকা হয়েছে বুকু সর্দারের অনুরোধে। লাইনের সব চেয়ে বুড়োর মানুষ হিসেবে শুকরাকে সে সময় থাকতে হবে। পঞ্চায়েত বসে এই গাছতলায় মাচাটাকে ঘিরে। বুকু সর্দারের সমস্যা ওর মেয়েকে নিয়ে। মেয়ে জামাই-এর ঘরে যাবে না আর জামাই মাঝে মাঝেই এখানে এসে ঝামেলা। করছে। মেয়ের বদলে এটা ওটা দাবি করছে। পঞ্চায়েতের মিটিং বলেই শুকরা একটু আগে গোটা দুয়েক নিটোল বিড়ি পেয়েছে বুকুর কাছে। খেতে মায়া হল বলে সে দুটো দুকানে খুঁজে রেখেছে সে। রেখে উবু হয়ে বসে ছিল মাচায়। আর মাঝে মাঝে চিৎকার করছিল, মালা– এ মালা! ত্রিসীমানায় মেয়েটার চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল না যদিও। ঘড়ির টিকটিকের মত এক নাগাড়ে ডাকাটা থামাল সে একটা ধমকে। ধমকটা নাতির সেটা বুঝতে পেরে কুঁকড়ে বসল সে।
সিরিল ধমকালো, নিজের গলা কানে যায় তোমার?
হারামি এক নম্বরের হারামি। বিড় বিড় করল শুকরা।
খামোকা গালাগালি করছ কেন?
বেশ করব একশবার করব! শালারা নিজেরাই খাবে আমাকে দেবে না। আরে আমি না থাকলে তোর বাপ জন্মাত? তুই জন্মাতিস? এখন যে তোর এত বোলচাল সে আমারই জন্যে এটা মনে রাখিস?
কী হল তোমার? শর্টকাট করো মাইরি।
মাংস এসেছিল না ঘরে?
মাংস?
শালা আকাশ থেকে পড়ল যেন। তোর বাপ যে সাপটাকে মেরেছিল তার মাংস এসেছিল? সেটা গেল কোথায়? এই বুড়োটার কথা না-হয় ছেড়েই দিলাম, ওই ছুঁড়িটাকেও দিলি না? আরে ও তো নিজের বোন। সব নিজেরাই সাঁটালি! হ্যাঁরে, সাপটার শরীরে চর্বি ছিল?
থুঃ থুঃ! শালা যত জংলী আদমীকো ঝামেলা! তুম আদমী হ্যায় না পাজামা? সাপের মাংস কি ভদ্রলোক খায়? সব ফেলে দিয়েছি আমি।
ফেলে দিয়েছিস? হায় কপাল! সাপের মাংস খেলে জীবন বাড়ে, যৌবন লম্বা হয়। তিন তিনটে মেয়েকে কাহিল করে দিতে পারতিস একা, ও ভগবান, কি গাধা!
একটা মেয়েকে পারি না তো তিনটে, সাপের মাংস দেখলেই ঘেন্না করে। যখন জংলী ছিলে তখন খেতে। এখন ভদ্রলোক হতে হলে ওসব খাওয়া চলবে না।
ভদ্ররলোক? কে ভদ্দরলোক?
কেন আমরা।
আমরা? তুই! খিলখিল করে ফোকলা মুখে হাসি উপচে এল। কিছুতেই বাগ মানে না, ভেঙেচুরে যাচ্ছে হাসির দমকে, শেষে সেটা কাশিতে গিয়ে শেষ হল। কাশতে কাশতে দম বন্ধ হবার জোগাড়। কোনোক্রমে সেটা থামলে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে শুকরা বুড়ো বলল, মদেসিয়ারা ভদ্রলোক? তাহলে বাবুরা কী?
ওরা ভদ্রলোক!
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল শুকরা, আমরা আর ওরা এক?
আলবৎ এক।
আমি থাকব না এখানে। আমি চলে যাব। পাপ, পাপে ভরে গেছে জায়গাটা নইলে তুই একথা মুখে আনিস! হাত বাড়িয়ে লাঠিটা নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করল শুকরা বুড়ো। সিরিল হাসছিল, কোথায় যাবে? তোমার গ্রাম টেবুয়াতে?
হাঁ হাঁ জরুর। টেবুয়া আমার গ্রাম। আমার বাপ জন্মেছে তারও বাপ। এ চা বাগান আমাদের জায়গা নয়। এখানে নকরির জন্যে এসেছিলাম। এখানে তোরা ভদ্দরলোক হচ্ছিস, সাহেব চাকরি ছেড়ে দিয়ে মদেসিয়া হয়ে যাবে বোধহয়। ওরে নাতি, তুই আমাকে একটা ভিক্ষে দে। কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল শুকরা বুড়োর গলা।
কী?
আমাকে ইস্টিশানে নিয়ে গিয়ে রাঁচির রেলে তুলে দে।
তুলে দিলে যেতে পারবে?
সে পারব।
টিকিট?
চকিতে সামলে নিল শুকরা বুড়ো। মাটিতে পোঁতা টাকাটার কথা জিভে এসে গিয়েছিল প্রায়। মুখে বলল, রেলবাবুর পায়ে পড়ব।
ওখানে গিয়ে কী করবে? খাবে কী? দেখবে কে?
ওখানকার মাটি জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকব।
ব্যাস! তাতেই পেট ভরবে?
ভরবে রে ভরবে। সে মাটি কি তাই তুই জানিস না। যাবি আমার সঙ্গে?
ধ্যুৎ। আমি এখানে জন্মেছি, আমার বাপ জন্মেছে এখানে, এ জায়গাটাই আমার দেশ। চা পাতার গন্ধ নাকে না গেলে সে জায়গাটাকে বিদেশ ঠেকে। শোন বুড়ো, তোমার কোথাও যাওয়া চলবে না। অন্তত আজকের রাতে আগে নয়।
কেন? আজকের রাতে কী?
আঃ, ভুলে গেলে পঞ্চায়েত বসবে না?
তোর বাপের কী?
বাপের না আমার!
বুকু সর্দারের মেয়ে মরদের-ঘর করবে না তার মধ্যে তুই এলি কোত্থেকে?
হাসল সিরিল, রাত্তিরে ঢিবরি জ্বালা হয় কেন? ঘর আলো করতে তো! সেটা দিনের বেলা জ্বলে না কেন? না সূর্য উঠে গেছে তাই।
তার মানে? শুকরা বুড়ো রহস্য বুঝতে পারে না।
সিরিল এক হাতে বুড়োর মাথাটা জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, আমার রক্ত ওর শরীরে দিয়ে দিয়েছি। সূর্যটা আমি, বুঝলে।
প্রায় ঝটকা মেরে সোজা হয়ে দাঁড়াতে চেষ্ট করল শুকরা, দেবার আগে আমাকে একবার জিজ্ঞাসা করলি না কেন?
কেন? এসব কেউ কাউকে বলে নাকি?
আমি মেয়েটাকে একটু ভাল করে দেখতাম আগে।
হো হো করে হাসতে লাগল সিরিল, দেখো আজ রাত্রে, ওই যা, তুমি তো আবার রাত্রে দেখতেই পাও না। তবু–। আর হ্যাঁ, একথা কাউকে বলো না, যদি শুনি বলেছ তাহলে তুলব আর আংরাভাসায় ফেলে দেব।
আর যদি না বলি, তাহলে রেলে চড়িয়ে দিবি, বল, কথা দে।
বেশ দেব। অন্তত যে যেখানে গেল সুখী হয়, যার যেটা দেশ সে সেখানে যাক। কিন্তু আমি যাব না, এটা আমার দেশ।
না, এটা বাংলার দেশ। সাহেবদের আর বাবুদের জায়গা।
সাহেব, সাহেব কে? এই ছোট সাহেব, গাড়ি চালাত বাংলোয় থাকত হুকুম করত আগে হলে চাবুক মারত সে আজ থেকে সেসব আর কিছুই থাকবে না। একদম বাজারকা আদমি হো যায়ে গা।
কেন? লোকটা কি পাগল না বোকা? কক্ষনো শুনিনি এমন কথা। লোকটা কি গান্ধী মহারাজের চেলা?
সেটা আবার কে? মেয়েছেলে আবার মহারাজ হয় নাকি? গান্ধী তো মেয়ে-ছেলে, এই দেশের রানি। ওর পার্টির লোকদের তত শক্তি বেশি। না তার কেউ নয় ছোটাব। ঠিক আছে, এখন তো আর সাহেব থাকছে না ছোট সাহেব, আমি নিজের মুখে জিজ্ঞাসা করব কেন চাকরি ছাড়ল? আঁ! বিড়ি খাবে?
ঘাড় নাড়ল শুকরা বুড়ো,না। দুটো চোখের পাতা বন্ধ করে ভাবতে বসল সে। এটা কি কখনো সম্ভব? ম্যাকফার্স সাহেব, গেলি সাহেব, ওনিল সাহেব, কি কি ভারী ভারী চেহারা সব–কেউ কি কখনো বুড়ো হবার আগে চাকরি ছেড়ে চলে গেছে? কালে কালে কি হল! গান্ধীবাবার নাম শুনেছিল সে অনেক আগে। নাকি সাহেবদের তাড়াতে চায়। বাংলোয় বসে সাহেবরা নাকি এইসব বলে হাসিঠাট্টা করত। তার চেহারা দ্যাখেনি শুকরা। অথচ আজ নাতি বলল সে নাকি মেয়েছেলে, এই দেশের রানি। তাহলে তার বয়স কত? মেয়েছেলে বলেই কি এতদিন বেঁচে আছে! তা কি করে হয়! তাহলে তো ও মেয়েটাও এখন বেঁচে থাকত! অনেক দিন পরে পাঁজর ঝাঁপিয়ে নিঃশ্বাস ছিটকে বেরিয়ে এল। মৃত স্ত্রীর মুখটা মনে পড়ে না আজকাল। কিন্তু তার স্পর্শ গন্ধ সব যেন অনুভবে ছড়িয়ে। নাতি বলেছে রেলে তুলে দেবে। যীশু প্রভু যীশু, তোমার অসীম দয়া। চোখ খুললো বুড়ো, কেউ নেই সামনে। সিরিলটা কোন ফাঁকে উঠে গেছে। যাওয়ার সময় বলারও প্রয়োজন মনে করে না। মানুষ বলে ভাবে না তাকে। আবার ভদ্দরলোক হবার ইচ্ছে। চিৎকার শুরু করল শুকরা বুড়ো, মালা, এ মালা–আ। কয়েকটা মিনিট পার হয়ে গেল ডাকের তালে তালে, পায়ের শব্দ হল। নাতিনিটা ছুটে আসছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, খাও।
দুটো শুকনো রুটি হাতে নিয়ে নাতনির মুখের দিকে তাকালো বুড়ো। মালার দু কানের লতিতে হলুদ মাখা কাঠি বেঁধানো। কান ফুটিয়েছে ও।
চা বাগানের মাঝখানে বেশ কিছুটা জায়গা খাসমহলের দখলে। ওখান যারা বাস এবং ব্যবসা করে তারা চা বাগানের অধীনে নয়। যা কিছু হাট বাজার দোকানপাট সব এখানেই। সরকার নিয়মিত খাজনা আদায় করে থাকেন। পাকিস্তান হবার পর একটু একটু করে মানুষজন এখানে এসে বেশ জমজমাট করে তুলেছে। ন্যাশনাল হাইওয়ের দুপাশে এই ছোট্ট বসতিতেই ভাটিখানা। ছোটসাহেব সেখানেই একটা কারখানা খুলল। মোটরসারাই-এর কারখানা। লোকটাকে এখন আর চেনা যায় না। যখন খাটে তখন সারা শরীরে কালি মেখে মিস্ত্রি হয়ে যায়। এই কাজটা এত ভাল জানা ছিল, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। একদিন সিরিল গেল তার সঙ্গে দেখা করতে।
অবশ্যই এই কদিন ছোটসাহেবকে কম হাঙ্গামা পোয়াতে হয়নি। দলে দলে বাগানের কুলিরা। এসে ভিড় করেছে কারখানার সামনে। অবাক হয়ে দেখেছে ছোটসাহেবের পরিবর্তন। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেননি অনেকে। এরকম হয়? যদিও আর চা বাগানে নেই তবু লোকে এমনকি বাবুরাও ওকে ছোটসাহেব বলেই ডাকছে। অন্য নাম ভাবা মুশকিল। কুলিরা দেখেছে ছোটসাহেবকে মোটেই অখুশি দেখাচ্ছে না। শিস দিয়ে কাজ করছে। মাঝে মাঝে ওদের সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছে। দশ-বারোটা লোককে কারখানায় কাজ দিয়েছে। বিস্ময় বেশিদিন জীবিত থাকে, শেষে এটাও গা সওয়া হয়ে গেল। কিন্তু ছোটসাহেব কেন চাকরি ছাড়ল এটা অনেকের কাছে স্পষ্ট হল না। নানান গল্প ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। চা-বাগানে আজকাল চুরি না করলে চাকরি যায় না। ছোট সাহেব কি চুরি করেছে? সাহেবরা চুরি করে এটা সর্দাররা জানে, কিন্তু ওটা এত বড় চুরি যে তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। এতো আর গুদাম থেকে পাতি কোঁচড়ে বেঁধে চুপচাপ সরে পড়া নয়। ছোটসাহেব কারখানা খোলার পর দেখা গেল অন্যান্য সাহেবরা সামনের বড় রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে চলে যান, এককালে যে চিনতেন তা ভাবগতিকে দেখে বোঝা যায় না। আর একটা মজার ব্যাপার দেখা গেল। এতকাল বাংলোয় ছোটসাহেব একা ছিল কিন্তু চাকরি ছেড়ে দেবার পর কারখানার ওপর যে ঘরখানা ভাড়া করে আছে সেখানে প্রতি শনিবার এক বুড়ি জলপাইগুড়ি থেকে এসে থাকে আবার রবিবার বিকেলে চলে যায়। সবাই জেনে গেল ওই বুড়ি নাকি ছোটসাহেবের মা।