বাদামী -13
ঝালুকবাড়ি থেকে রিকশা করেই কামাখ্যা রোড স্টেশন এসেছে। গুয়াহাটির ট্রেন ধরেছে। বুকের মধ্যে একটা গভীর শূন্যতা গ্রাস করেছে বাদামীকে।স্টেশন এ নেমেছে। পথে অসংখ্য যান, অগণিত মানুষজন, কিন্তু কোনো কিছুতেই বাদামী নেই।জগৎ থেকে মহাজাগতিক স্তরে সে পৌঁছে গেছে। শূন্যে,বহু দূরে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ। সেই শিকাগোর আকাশে। ঘরে ফিরে ই মনে হয়েছে স্নান করলে ভালো লাগবে। তাই করেছে। টি.কে.বি.র দেওয়া সেই খাম খানা নিয়েই শুয়েছে। রামরতিয়া এসে দাঁড়াল। অসময়ে শুতে দেখেই বুঝি চেয়ে আছে বাদামীর দিকে। –কি গো চা খাবে? -দে। চিঠিতে কী লেখা?যাই থাক,অমূল্য এ চিঠি। মনের একটা কুঠুরি বলল-প্রেমের স্বীকারোক্তি। অন্য কুঠুরি বলল-তুমি কি প্রেমের যোগ্য?নইলে তোমাকে ছেড়ে গেল কেন?আর ঠাঁই দিও না কাউকে। মনকে শক্ত কর ।মা ও বলেছিল মনকে শক্ত করতে। তাই করবে বাদামী। বাদামী কি প্রেমে পাগল হলো?কী এতো ভাবছে?5 খাম খানা খুললো না। যত্ন করে দেরাজে রেখে দিল। না খুলে ভালো ই করেছে। খুললে তো শেষ হয়ে যেত। বাদামীর ভালবাসা তোলা রইলো সযত্নে।তেমন দিন যদি আসে তবে ই খুলে দেখবে ঐ চিঠি। পি .এইচ ..ডি.উপাধি যারা পেয়েছে,তাদের নাম মোটা দাগে লেখা হয়েছে নোটিশ বোর্ড-এ। পরিস্কার অক্ষরে নিজের নাম দেখল বাদামী। সেই মানুষটার কথা বার বার মনে এসেছে, যার জন্য বাদামী হয়েছে ডক্টরেট বাদামী সিং। দেখতে দেখতে বছর পেরিয়েছে। ডক্টরেট বাদামী সিং এর নাম প্রফেসর এর পদে উন্নীত হয়েছে। নোটিশ বোর্ড এ প্রফেসরদের নামের লিস্টে নিজের নাম দেখার অনুভূতি একেবারে নতুন। চোখ ছাপিয়ে জল এসে গেল।মন বলছে, আমি কি এর যোগ্য?কার জন্য এতো উঁচুতে উঠলাম?মা,তুমি তো এই চেয়েছিলে। কোনো পুরুষ আমাকে অবহেলা না করুক। একটা পুরুষ শুধুই ভালবাসবে তোমার মেয়েকে। সে মানুষ এসেছিল। আবার চলেও গেছে। –এ কী?কী হয়েছে বাদামী? পিঠে হাত পড়তে সম্বিত ফেরে বাদামীর। প্রফেসর নবীন কুমার বরদলৈ দাঁড়িয়ে আছেন বাদামীর পেছনে। -না এমনি, চোখে জল এসে গেল। –তোমার তো আনন্দ হবার কথা। অবশ্য এটা আনন্দাশ্রুই হবে। তোমার বাবা মা খুব খুশি হবেন। –আমার কেউ নেই। –আহা,ভেরি স্যরি। ললাট লিখনে বিশ্বাসী নয় প্রফেসর বাদামী সিং। তাই সৌভাগ্য তাঁর পদচুম্বন করেছে। টার্ম অনুযায়ী প্রফেসর বাদামী সিং হেড অফ দা ডিপার্টমেন্ট হলেন। শিক্ষা আর পদের তকমা শান দিয়েছে তার রূপে।আভিজাত্যের সঙ্গে শিক্ষা মাখো মাখো হয়ে গেছে তার চিক্কন শরীরে। শুধু একবার দুবার ফিরে দেখার নয় সে রুপ। সে রুপে অবগাহন করতে মন টানে। কিন্তু কাছ ঘেঁষতে সাহস না পাবার মতো তাঁর রুপের ধার। রহিত আরও দুবার এসেছে। হরজিত এর কথা বলেছে। –আরে ইয়ার, একটু দয়া কর না বিগ ব্রাদারকে। হি ইজ টোটালি গন ম্যাড। –রহিত, আমি তোকে আগেই বলেছি ,আই কান্ট হেল্প। চা খাবি তো বলি। –না রে। উঠি। রহিত অনেকক্ষন হলো চলে গেছে। একটু খারাপ যে লাগছে না ঐ হরজিতের জন্য তা না। হরজিত আর মেয়ে পেল না?গুয়াহাটি শহরে কি মেয়ের অভাব?যাক্ গে ওর কথা ভেবে লাভ নেই। বাদামী যাকে মন প্রাণ দিয়েছে তাঁর মন ই রাখতে পারল না। একটা দীর্ঘশ্বাস বুক ঠেলে বেরিয়ে আসে। এবার কাজে মন দেওয়া যাক্। এম.এ তে ভর্তির জন্য প্রচুর অ্যাপ্লিকেশন জমা পড়েছে। চেক করে কাট ছাট করতে হবে। বেল টিপল বাদামী। –নারায়ণ, অ্যাপ্লিকেশন ফর্মের ফাইল টা দাও তো। ফাইল এগিয়ে দিয়েছে বাদামীকে। বাদামী ফাইল নাড়তে নাড়তে নারায়ণ কে চলে যেতে ঈশারা করে। –ম্যাডাম, চা দেবো? –না তুমি যাও। একের পর এক অ্যাপ্লিকেশন দেখতে দেখতে চোখ আটকে গেল একটা ফর্মে। ক্যান্ডিডেট এর নাম — অমৃতা সিং। ফাদার্স নেম এর জায়গায় —হর কিষণ সিং। অকুপেশন–সার্ভিস ইন রেলওয়ে। ডেজিগনেশন –ডিস্ট্রিক্ট ইঞ্জিনিয়ার। মাথাটা ঝাঁ ঝাঁ করছে বাদামীর। ঐ নাম টা দেখেই এমন হলো। ফাইল বন্ধ করার আগে ঠিকানা টা ভালো করে দেখে নিল। এই হর কিষণ নিশ্চই সে নয়। সে তো তেজপুর থাকতো। ঐ রাস্তার পাশেই বাদামীর যাতায়াতের পথ। পুরোনো ক্ষত টা কিলবিল করে ওঠে। মন বলছে প্রতিশোধের কথা। আজ ঘরে ফেরার সময় ঐ পথটা বেছে নিয়েছে। বাংলো বাড়ির আলো চোখে পড়ল। বাগানে দু’টো অবয়ব চোখে পড়ল। একেবারে ঝাপসা আলো তায় দুরত্ব, তবু ও বোঝা গেল একটি স্ত্রী জাতি অপরটি পুরুষ। চলন্ত ট্যাক্সিতে বসে একঝলক দেখা। পুরুষের সরু অবয়ব মেলে না সেই চওড়া ধাঁচের প্রতারকের সাথে। সারারাত ঘুড়পাক খেয়েছে কথা টা। রাতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটেছে। সকালেই ঐ বাড়িতে যাবে ঠিক করলো বাদামী। এ সময় টা অরুনা সিং এর বাগানের পরিচর্যা করার সময়। ভালো লাগে এই গাছ গুলোর যত্ন করতে। অরুনা বোঝে গাছগুলো ওর ছোঁয়ায় প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। প্রতিদান দিতে জানে গাছগুলো,কিন্তু ঘরের মানুষ গুলোর সে বোধ নেই। হঠাৎ ই নজর পড়ল গেটের দিকে। একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। ট্যাক্সির আরোহীনি নামলেন। গেট খুলতে দেখেই অরুনা আশ্চর্য হয়ে এগিয়ে গেল সেদিকে। কে হতে পারে এই ব্যক্তিত্বময়ী নারী! একেবারে অচেনা। তবে ওঁরহাসিটা বলছে সে অরুনাকে চেনে! ——-আসুন, আসুন। আপনাকে ঠিক—–। কথাটা শেষ করে না অরুনা। বাদামী অরুনার কথা ধরে নিয়ে বলে——- –চিনতে পারছেন না তো?চিনবেন না। তবে ইউনিভার্সিটি যাবার পথে রোজ আপনাকে দেখি। তখন আপনি গাছের সেবায় মহা ব্যস্ত। –আপনি ইউনিভার্সিটিতে কাজ করেন বুঝি? –হ্যাঁ। –চলুন, ভেতরে বসবেন। আমি যে কি!সেই থেকে দাঁড়িয়ে কথা বলে চলেছি। অরুনা ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসায় বাদামীকে। কথা থামেনা অরুনার। –মেয়ের আমার ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার সাধ। ইংলিশ এর হেড নাকি দারুণ কড়া। মেয়ে পরীক্ষায় বসতে চায় না। -আজ আর বসব না। ঘরখানা তো দারুণ সাজিয়েছেন। গেটে নেম প্লেট দেখলাম। একজন হর কিষণ কে চিনতাম, তিনি কিনা তা জানতে ইচ্ছে হলো। বুক সেলফের উপর রাখা আছে স্বামী-স্ত্রীর যুগল ছবি। ইচ্ছে করেই এগিয়ে গেল সেদিকে। ছবির কাছে যেতেই বুঝেছে,এ কোন হর কিষণ!!!!!