বাঞ্ছারাম ও ননীর মা
বয়স আমার চল্লিশ পেরোতেই শরীরে মেদ জমতে শুরু করেছে। ডাক্তারের পরামর্শ মতো আজকাল সন্ধ্যাবেলা হাঁটতে বের হই। প্রতিদিন বের হতে না পারলেও, প্রায়ই বের হই হাঁটতে। আধ-ঘন্টার মতো হাঁটা-হাটি করে, কোথায়ও বসে এককাপ চা পান করে বাড়ি ফিরি।
সেদিন সান্ধ্য ভ্রমণ সেরে ক্লান্ত হয়ে চায়ের দোকানে ঢুকে বেঞ্চিতে বসতে বসতে বললাম, “একটু জল খাওয়া তো বাবা বাঞ্ছারাম। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে!”
বাঞ্ছারাম, নিতাইযের চায়ের দোকানের হিন্দুস্থানী কর্মচারী। বয়স তার মোটেও বেশি নয়। বড় জোর তেরো-চোদ্দ বছর। বাঞ্ছারাম এক গ্লাস জল এনে দিয়ে আমাকে বলল, “লিজিয়ে, খাইয়ে! জল খাইয়ে!”
গ্লাসটা ওর হাত থেকে, হাত বাড়িয়ে নিতে গিয়ে দেখলাম, ওর চোখে মুখে ফিচকে হাসি। দেখে অবাক হয়ে জানতে চাইল, “ব্যপার কি কিরে? হাসির কি হল আবার?”
“বাঙালী লোগ খানা ভি খাতা হ্যায়, পানি ভি খাতা হ্যায়!” বলেই ব্যাটা ফ্যক প্যাক করে হাসতে লাগলো।
ননীর মা ঠিক সেইসময় সেখান দিয়ে ননীকে নিয়ে কোচিং ক্লাসে পৌঁছে দিতে যাচ্ছিল। সে আমাদের বাড়িতে বাসনমাজা ও ঘর মোছার কাজ করে। সে আমাকে বেশ ভক্তি শ্রদ্ধা করে। তাই, আমার সঙ্গে বাঞ্ছারামের ছ্যাবলামী করা দেখে, পিত্তি জ্বলে গেল তার। সে বলল, “কেন রে মুখপোড়া! বাঙালীরাই খালি জল খাতা হায়? খোট্টারা নেই খাতা – জল ছাড়াই বেঁচে থাকতা হায়!”
বাঞ্ছারাম তাকে বুঝিয়ে বলল, “পানি খায়া নেহি যাতা, পিয়া যাতা হ্যায়!”
“অ, তাই বুঝি! তা খাওয়া আর পিয়ার মধ্যে তফাৎ কেয়া হায় ভাই? বুঝাকে বোল দেও তো!”
তফাৎ যে আসলে কি সেটা বেচারা বাঞ্ছারামও জানতো না বোধহয়, তাই সে উত্তর খুঁজে না পেয়ে, কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে, শেষে তোতলাতে তোতলাতে বলল, “খানেকা মৎলব চাবা চাবাকে খানা। পীনে কি চিজ্ চাবায়া নেহি খাতা!”
ননীর মা তা শুনে বলল, “বুঝলাম। না চিবিয়ে গিলে খাওয়াকে পিনা বলে। তা ভাই ট্যাবলেট, মানে দাওয়াইও তো পানি কা সাথ গিলকে খাতা হায়। তুমলোগ দাওয়াই খাতা হায় নাকি পিতা হায়?”
ননীর মার কথাটা শুনে, বেশ কিছুটা হকচকিয়ে গিয়ে, মাথা চুলকে বাঞ্ছারাম বলল, “দাওয়াই লেতা হ্যায়!”
এবার ননীর মায়ের হাসি চাপার পালা। বলল, “বাঃ, প্রথমে খাতা হায়, তারপর পিতা হায়, শেষে কিনা লেতা হায়। হায় হায় হায়, আর কত রঙ্গ দেখায় গা ভাইয়া? …… আচ্ছা, ঘি, মাখন, এগুলো তো’ চিবাতা নেহি, তাহলে এগুলো কি খাতা না পিতা, নাকি লেতা বোলতা হ্যায়?”
বাঞ্ছারাম একেবারে বিচলিত বিপন্ন হয়ে মনে মনে হিসেব করে বলল, “চিবাতা নেহি! ইসকা মাতলাব পিতা হ্যায়!”
ননীর মা এবার, দু হাতের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল, “তুম ঘণ্টা জানতা হায়, সামঝা? এগুলো সবই খাতা হায়। ঐ গানটা শুনা নেহি , ‘ম্যায় নেহি মাখন খায়ো’। তুম শুনা নেহি এ গানা?”
বাঞ্ছারাম হার স্বীকার করে নিয়ে, ঘাড় নাচিয়ে সামনে পিছনে ঝুঁকিয়ে বলল, “জী!”
“সুতরাং হাম জল চিবাকে খায়গা না গিলকে খায়গা, সেটা হামারা মর্জি। তুমহারা আপত্তি করনে কা কোন হক নেহি হ্যায়, সামঝা!”
” জী সামঝা ” বলে বাঞ্চারাম হার স্বীকার করে নিয়ে, মুখ কালো করে দোকানের ভিতর ঢুকে পড়ল।
ননীর মাও আমার মান রক্ষা করতে পেরেছে ভেবে,গর্বিত ভঙ্গিতে পা ফেলে ননীকে নিয়ে কোচিং ক্লাসে পৌঁছে দিতে চলে গেল। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। জল খেয়ে নিয়ে, এককাপ লিকার চায়ের অর্ডার দিলাম।