বলাই সান্যাল
০৫.
বিকালবেলা বলাই সান্যাল পায়চারি করছিল আবগারিবাড়ির কাছে। তার নিজেরও বাড়ি বটে। যে রাস্তাটার একপাশে পুকুরের ধার ঘেঁষে ঘন চিতে গাছের বেড়া। আর একদিকে বাঁশঝাড়। রাস্তাটা দক্ষিণে কানা, আবগারির পুরনো দোতলা বাড়িতেই শেষ। উত্তরে এসে বাঁয়ে বেঁকে স্টেশনে গিয়েছে। পশ্চিমে বাঁক নিয়ে গিয়েছে গ্রামের অভ্যন্তরে।
ইনস্পেক্টরের ইউনিফর্ম ছিল না বলাইয়ের। খাকি প্যান্টের সঙ্গে সাদা শার্ট। তেরাস্তার মোড় পর্যন্ত তার গতি। সে চিন্তিত নয়। বিষণ্ণ। ব্যস্ত নয়, কেমন যেন উদাস ও গম্ভীর। লক্ষ করল না, ছাদের আলসের ধারে দাঁড়িয়ে মলিনা তাকে দেখছে। মলিনার পিছনে, নারকেল গাছের সারি। গাছের মাথায় ছুঁয়েছে বিশাল কালো একখণ্ড মেঘ। মলিনা যেন উজ্জয়িনীর প্রাসাদ শিখরে বিরহিণী যক্ষিণী।
বলাই মলিনার কথাই ভাবছিল। কিছুক্ষণ আগেই তাদের কথা কাটাকাটি হয়েছে। মলিনার যেন ধ্যানের নায়ক-নায়িকা চিরঞ্জীব আর দুর্গা। হয়তো বলাই যতখানি ভাবছে, ততখানি নয়। তবু চিরঞ্জীব আর দুর্গার প্রতি তার যেন সবল সমর্থন। যেন কী এক বিচিত্র আকর্ষণ তার। আর এই। কথাটা যতই ভাবে, ততই মনে হয়, মলিনার নিজের জীবনের কোথায় একটি অপূর্ণতা আছে। একটি ব্যথা-ধরা শূন্যতা। সেটা যে শুধু নিঃসন্তান নারী জীবনের শুন্যতা, তা নয়। কিংবা জীবনের এই অসার্থক দিকটা জড়িয়েই সেটা যেন ভালবাসার শূন্যতা। যে-শূন্যতার দায় বুঝি বলাই ইচ্ছে করলেই এড়িয়ে যেতে পারে না। যদিও মলিনা নিঃসংশয়ে, নিঃশেষে ভালবেসেছে বলাইকে। তবু সেই চিরকালের ব্যথাটা বুঝি একটু বেশি করেই বাজে তার। স্বামীর মধ্যে মনের মানুষের পূর্ণ রূপ সে খুঁজে ফিরেছে। কে তা পায়। কজনা পায়, কে জানে। বলাই নিজে জানে, মলিনার পথে কত বাধা সেখানে। বলাইয়ের চিন্তা, বলাইয়ের জীবিকা, কোনওটাই মলিনার মনের মতো নয়। ভাবাযোগপূর্ণ যে-রোমান্টিক জীবনের স্বপ্ন দেখেছে সে তার ছেলেবেলা থেকে, সে স্বপ্নটা বোধহয় কখনওই বাস্তব রূপ পেল না। বলাইকে যদি ভাল না বাসত, তা হলে ফাঁকি দিয়ে হেসে দিন কাটাতে পারত। কী নেই বলেই তুচ্ছ প্রেমের কথায়ও বড় ব্যাকুল হয়ে ওঠে মলিনা। চিরঞ্জীব আর দুর্গার কথায় তার দীর্ঘশ্বাসও যেন প্রসন্নতায় ভরে ওঠে। যাদের জীবনের প্রেম দূরের কথা, কোনও নৈতিক সমর্থনও খুঁজে পায় না বলাই।
বিষণ্ণ উদাস বলাই পায়চারি করতে করতে এ সব কথা ভাবছিল। আর ঠিক সেই সময়েই চিরঞ্জীব পায়ে-হেঁটে যাচ্ছিল স্টেশনের দিকে! এরকম কয়েকবারই হয়তো দেখা হয়েছে দুজনের। চেনেও দুজনে পরস্পরকে। কেউ কখনও কথা বলেনি। কারণ চিরঞ্জীব কোনওদিন অক্রূর দের মতো আভূমি নত হয়ে, নমস্কার করে আবগারি দারোগাকে তোশামোদি করেনি।
আজ সহসা বলাই ডেকে বসল চিরঞ্জীবকে, শুনুন।
চিরঞ্জীব চলতে চলতেই, ভ্রূ কুঁচকে মুখ ফেরাল। বলাই বলল, আপনাকেই ডাকছি, একটু শুনুন।
আলসের ধার থেকে সরে পালাতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল মলিনা। চিরঞ্জীবকে সে মাত্র একদিন দেখেছিল। তবু চিনতে পারল। তার বুকের মধ্যে ধকধক করতে লাগল উত্তেজনায়। কী করতে চায় বলাই?
চিরঞ্জীব থমকে দাঁড়িয়ে বলল, বলুন।
একটু সন্দিগ্ধ কিন্তু অপ্রতিভ হল না চিরঞ্জীব। বলাইয়ের চোখের দিকে তাকাল সে। বাঘ না বলে বোধ হয় উপায় ছিল না তাকে। একহারা বলিষ্ঠ, চওড়া কাঁধ, উশকো-খুশকো চুল আর তীক্ষ্ণ সন্ধানী চোখ, সব মিলিয়ে কেমন একটা কঠিন ঋজুতা। বলল, আসুন না, অফিসে একটু কথা বলা যাক। আপত্তি আছে?
রীতিমতো ভদ্র আমন্ত্রণ। এক মুহূর্ত ভাবল চিরঞ্জীব। বলাই হেসে বলল, নির্ভয়ে আসতে পারেন।
চিরঞ্জীব বলল, জানিনে কী কথা বলতে চান। চলুন!
পথে যে দু একজনের আনাগোনা না ছিল, তা নয়। তারা থ হয়ে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা লক্ষ করল। অফিস-ঘরে কেউই ছিল না। কাসেম বসেছিল দেউড়ির বাঁধানো রকে, সেও অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে উঠে চুপ করে রইল। কেবল আপাদমস্তক দেখল একবার চিরঞ্জীবের।
বলাই অফিসে ঢুকে বলল, বোধহয় ভুল করিনি, আপনি চিরঞ্জীব ব্যানার্জি তো?
–হ্যাঁ।
বসুন।
চিরঞ্জীব বসল। বলাই কোনও ভূমিকা না করেই বলল, প্রত্যক্ষভাবে না দেখলে হয়তো বিশ্বাস করা কঠিনই হত। কিন্তু কেন এ পথে এলেন বলুন তো?
চিরঞ্জীব এক মুহূর্ত বোধহয় হকচকিয়ে গেল। প্রায় ভূতের মুখে রাম নামের মতো শোনাল কথাগুলি। পরমুহূর্তেই তার ঠোঁটের কোণ দুটি বেঁকে উঠল। বলল, আপনার জেনে কোনও লাভ নেই স্যার।
-কেন?
–জেনেই বা কী করবেন? এরকম কত ব্যাপার ঘটছে জেনেই বা কে কী করছে?
বলাই বলল, তা ঠিক। অক্রূর দের মতো লোক হলে আমি কিছুই জিজ্ঞেস করতাম না। আপনাকে বলেই জিজ্ঞেস করছি। আপনাদের মতো ছেলেরা এ লাইনে এলে আর বাকি থাকল কী?
চিরঞ্জীব হেসে বলল, সবাই কি লাইন ঠিক রেখেছে এ দেশে? কেউ কি রেখেছে বলতে পারেন? আমার তো ধারণা যাদের যে লাইনে যাবার কথা ছিল, সবাই তার উলটো পথ ধরেছে। নিজে থেকে ধরেনি, কপালে জুটে যায় বোধহয়।
বলাইয়ের মনে হল, কথাটা তার ওপরেও হয়তো প্রযোজ্য। শৈশবে কৈশোরে যৌবনের শুরুতে সেও তো কত স্বপ্ন দেখেছিল। কত স্বপ্ন। স্বপ্নগুলি হয়তো মধ্যবিত্ত মনের বাঁধা-ধরা ছকের মধ্যেই ছিল। কিন্তু আবগারি বিভাগটা একেবারে সেই ছকের মধ্যে দেখতে পায়নি। প্রথম যেদিন চাকরিতে যোগ দিয়েছিল, সেদিন টেরও পায়নি, তার পথ গিয়েছে বদল হয়ে। চাকরি জীবনের নতুনত্বের স্বাদ বরং খানিকটা অ্যাডভেঞ্চারিস্ট করে তুলেছিল। সে মনে-প্রাণে একজন আবগারি অফিসার হতে চেয়েছিল। কিন্তু মলিনার স্পর্শে এসে সে জানল, এ জীবিকা তার কাম্য ছিল না। অথচ আজ আর কোনও উপায় নেই। সুরেশবাবুর কথা ভাবতেও ভয় করে তার। একজন অভিজ্ঞ বয়স্ক আবগারি অফিসারের পরিণতি সে দেখেছে। আরও দেখেছে। কিন্তু সে সব এখন আর ভাবতে চায় না বলাই।
কিন্তু চিরঞ্জীবের কথার মধ্যেও অযৌক্তিকতা ছিল। যদিও, চিরঞ্জীবের সামনে বসে এ ভাবে কথা বলতে এখনও মন দ্বিধাবোধ করছে। সঙ্কোচ হচ্ছে। একটা পরাজয়ের সূক্ষ্ম খোঁচা যেন লাগছে কোথায়। তবু সে বলল, সকলের লাইন ওলটপালট হয়নি। আপনাদের অক্রূর দের এটাই তো স্বাভাবিক লাইন। নয় কি? তাদের নিয়ে কথা বলতে চাইনে। তাদের যদি লাইন কিছু থেকে থাকে, তবে এইটাই। লাইন আসলে কিছুই ছিল না, ওলটপালটের প্রশ্নও নেই। যাদের পথের কথা ভাবা ছিল, তবু, ওলটপালট হল, তাদের বিষয়ই বলতে ইচ্ছে করে। মেনে নেব আপনার কথা। দিনরাত্রি জীবন ও জীবিকার এই পড়ে পড়ে মার খাওয়া দেখছি। কিন্তু এ পথে কেন চিরঞ্জীববাবু?
চিরঞ্জীবের ঠোঁটের কোণে হাসিটা হাসি নয়। বাঁকা ছুরির ঝিলিক। বলল, তিলে তিলে মরণের ভাল পথগুলোও দেখেছি স্যার। যার পেট ভরল না, তবু ঘরের ইজ্জত গেল, তার মরণের দুঃখের কথা খবরের কাগজে পড়তে আমার ঘেন্না করে। মাপ করবেন স্যার, আমি চলি।
বলতে বলতেই উঠে দাঁড়াল চিরঞ্জীব। বলাই দেখল, চিরঞ্জীবের দু চোখে অঙ্গারের জ্বলুনি। জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো দপদপে তার সারাটা মুখই। যেন ধোঁয়ানো আগুন সহসা দমকা বাতাস লেগে, গনগনিয়ে উঠেছে।
বলাই তাড়াতাড়ি বলল আর একটু বসুন, আর একটু। চোলাইকরদের ডেকে বসানো আমার রীতি নয়। কিন্তু আপনার সঙ্গে আমি একটু কথা বলতে চাই। একটু বসুন। আমি আপনার সব কথা জানতে চাই। আপত্তি না থাকলে, একটু বসুন।
চিরঞ্জীব না বসেই বলল, বলার মতো কিছু নেই আমার সান্যালবাবু। কিছু চাপা নেই, কিছু খোলাও নেই। এ কোনও বেকায়দার চালের খেলা নয়। আমার ঘরের ঘুঁটি আপনি যেদিকে চালবেন, সব গিয়ে এক জায়গায় উঠবে। ম’র হতেই হবে! যার পেট ভরা খিদে রইল, ইজ্জতও গেল, সে হল বারোয়ারিতলায় পুজোর ঢাকের মতো। যে আসে, সবাই একবার করে চাঁটি মেরে যায়। তাকে সবাই উপদেশ দেয়। তবু ঢাক তো। খোল থাকবে, চামড়াটা ফেঁসে যাবেই। আপনিও স্যার দুটো চাঁটি মেরে বোল্ তুলতে চান তুলুন। ঢাক ঢাকই থাকবে।
বলাই খানিকটা স্তব্ধ বিস্ময়ে থ হয়ে রইল যেন। শুধু ঝোঁকের বশে নয়, চিরঞ্জীবের যুক্তিও আছে। যতটা স্থূল সে মনে করেছিল, ততটা স্থূল নয়। বলাই বলল, যার যেখানে কষ্ট, সে-ই সেটা বোঝে সবচেয়ে বেশি। আপনাকে আমার বোঝানোর কিছু নেই। কিন্তু এটা কি আপনাকে আর কেউ মনে করিয়ে দেয় না, আপনি ছিলেন এ অঞ্চলের একজন নেতা!
নেতা নয় স্যার, কর্মী।
যেন ভুল সংশোধন করে বলল, চিরঞ্জীব, আর আমিই সেটা সবচেয়ে ভাল জানি, ও রাস্তা আমার জন্য ছিল না। যারা না খেয়ে মরেছে, যাদের জন্য কৃষক-সমিতির নিশান নামিয়ে শ্রদ্ধা দেখিয়েছি, তাদের জ্বালা তাইতেই জুড়িয়েছে, আমি বিশ্বাস করিনে।
বলতে বলতে ভ্রূ কুঁচকে উঠল চিরঞ্জীবের। হঠাৎ মনে হল, এ সব কথা কেন সে আবগারি ইনস্পেক্টরের সঙ্গে আলোচনা করছে। ক্রশ-বেল্টকে সে বরাবর বিদ্বেষের চোখে দেখে এসেছে। এদের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস তার মজ্জায় মজ্জায়। যে কথা সে শ্রীধরদা কিংবা আর দশজনের সঙ্গে আলাপ করতে পারে, সে কথা বলাইয়ের সঙ্গে আলাপে তার শুধু অনিচ্ছা নয়। রাগ হচ্ছে তার। তাই সে তাড়াতাড়ি বলল, কিছু মনে করবেন না স্যার, একটা কথা বলব?
বলুন।
–আপনি দারোগাগিরি করছেন না রাজনীতি করছেন!
একটু খোঁচা লাগল বলাইয়ের। কিন্তু সে হজম করল সেটা। লক্ষ কথার রাশ টেনে সে বলল, যে-নীতিই বলুন, এ সব আপনাকে বলেই বলছি। অল্প বয়স আপনার। আপনার কুখ্যাতির তুলনায় অনেক ছেলেমানুষ আপনি। আপনি লেখাপড়া শিখেছেন—
–আমার চেয়ে অনেক বেশি লেখাপড়া জানা, অনেক বড় লোককে আমি অনেক খারাপ কাজ করতে দেখেছি। হয়তো সামান্য লেখাপড়া শিখেছিলুম। কিন্তু ওটা কিছু নয়।
–আপনি যে লাইনে এসেছেন, সে লাইনে অনেক কিছু। তারপরে আপনাদের ফ্যামিলি ট্র্যাডিশনটা কি কিছু নয়? হুগলি জেলার ইতিহাসে আপনাদের বংশের নাম দেখা যায়। আর আপনি
বলাই দেখল চিরঞ্জীব দরজা পার হয়ে সিঁড়িতে পা দিয়েছে চলে যাবার জন্যে। বলাই ছুটে গিয়ে বলল, চলে যাচ্ছেন যে?
চিরঞ্জীবের মুখখানি যেন পুড়ে গিয়েছে, বুকের আগুনেরই ধাক্কা বুঝি তার চোখের তারা দুটি ঝাপসা করে তুলেছে প্রায়।
সে যেন ফিসফিস করে বলল, আপনি কি আমাকে ঠাট্টা করছেন ফ্যামিলি ট্র্যাডিশনের কথা বলে? ফ্যামিলি? আমাদের ফ্যামিলি? ওর আবার জেলার ইতিহাসে নাম?
বলতে বলতে গলা রুদ্ধ হয়ে এল চিরঞ্জীবের। প্রায় চুপি চুপি ভাঙা গলায় সে বলল, জানেন না, আমাদের ট্র্যাডিশন আজকে মহকুমা শহরের বারোয়ারি বাজারে বিকোয়? তাতে এ দেশের কোথায় কতটুকু এসে গেছে? আপনি আমার সঙ্গে মিছে এ ভাবে কথা বলছেন। আমি মদ চোলাই করি, স্মাগল করি, আপনি আমার সঙ্গে সেই ভাবেই ট্রিট করুন। আমি যাচ্ছি।
দাঁড়ান।
বলাই সামনে এসে দাঁড়াল চিরঞ্জীবের। অফিস-ঘরের উঠোনটা ফাঁকা। উঠোনের উলটোদিকে সাবর্ডিনেট স্টাফদের ঘর। ঘর বন্ধ। এস-আই অখিলবাবুর নেতৃত্বে একদল আজ দুপুরেই কোথায় বেরিয়ে গিয়েছে। কাসেম সবই শুনছিল দেউড়ির গলিতে দাঁড়িয়ে। এবার সে বলাই ও চিরঞ্জীব, দুজনকেই দেখতে পেল।
বলাইয়ের মুখেও উত্তেজনার ছাপ। সে বলল, দাঁড়ান। সে ভাবে যদি আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারতাম, ভালই হত। পারছিনে বলে, নিজেরই দোষ দিচ্ছি। হয়তো না জেনে আপনার কোনও বিশেষ স্থানে আমি ঘা দিয়েছি। কিন্তু আপনি এ পথ ছেড়ে দিন চিরঞ্জীববাবু। আপনাকে আমি অনুরোধ করছি।
চিরঞ্জীব তীব্র চাপা গলায় হেসে উঠল।
বলাই বলল, হাসবেন না। আপনি অনেক শত্রুবৃদ্ধি করেছেন। আপনি, হাটে বাজারে, আপনার নামে, কৃষক-সমিতির নতুন পোস্টার দেখেছেন?
দর্পিত ক্রুদ্ধ বাঘের মতো গর্জন করে উঠল চিরঞ্জীব, দেখেছি। পোস্টার দেবে, তাও আমি জানতুম। মুরোদ বড় মান স্যার। দেখা যাক, শ্রীধর দাস বিপ্লবী আমার কী করতে পারে?
মিথ্যে নয়, কৃষক-সমিতির থেকে চিরঞ্জীবের নাম করে পোস্টার দিয়েছে কৃষক-সমিতি। বিমলাপুরের মিটিং-এ এই শ্রীধরদা বিষোদগারণ করেছিলেন তার বিরুদ্ধে। বলেছিলেন, শুধু কৃষক-সমিতি থেকে বিতাড়ন নয়? ওকে গ্রাম থেকে, এ অঞ্চল থেকে তাড়াতে হবে। বাস করা অসম্ভব করে তুলতে হবে এইসব শ্রেণীর লোকেদের। এদের সঙ্গে কথা বন্ধ করতে হবে। সামাজিক সম্পর্ক ছাড়তে হবে। কৃষক-সমিতির যে-সব বন্ধুরা এদের পাল্লায় পড়েছেন, সরে আসুন। এ আমাদের ইজ্জতের আর মানের কথা। গ্রামের লোকেরা ওকে ত্যাগ করুক, ধরিয়ে দিক। সুযোগ পেলেই ধরিয়ে দিতে হবে। চিরঞ্জীব বিশ্বাসঘাতক, ও আমাদের সব রকম ক্ষতিসাধন করতে পারে। আমাদের যারা শত্ৰু, এই সব অসামাজিক নোংরা লোকেরা তাদেরই বন্ধু। এরা আর এক দিক থেকে জমিদার জোতদার মহাজন সরকারেরই দোসর। এরাই সরল নিরীহ কৃষকদের আজ বিপথে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছে। আজকে আমাদের সামগ্রিকভাবে লড়তে হবে।
কৃষকদের চরিত্রবলের ওপর জোর দিয়েছেন শ্রীধর। একবারও চিন্তা করেননি, তিনি সত্যিই একজন বে-আইনি চোলাইকরের বিরুদ্ধে শুধু কথা বলেননি; তিনি চিরঞ্জীবের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে, বেশি নিষ্ঠুর হয়েছিলেন। সেটা রাগে ও যন্ত্রণায়। চিরঞ্জীবের ঔদ্ধত্য তাঁকে রুদ্র করে তুলেছে। একটা পুরনো হতাশা তাঁকে আবার নতুন করে, নির্মম করেছে। তিনি এ কথা বলতেও দ্বিধা করেননি, আঘাত করুন। গ্রামে ঢোকা বন্ধ করে দিন। যেখানে পাবেন, ধরে শায়েস্তা করুন।
বিমলাপুরের সেই মিটিং-এ যদিও কৃষি-ঋণ ও টেস্ট-রিলিফ ও আগামী বছরের ধানের দরের ওপরেই প্রধানত বলার ছিল শ্রীধরের, তবু এ বিষয়ে অনেকখানি বলেছিলেন। কেউ কেউ অবাক হয়েছিল। প্রকাশ্য সভায় ইতিপূর্বে এ-সব বিষয় এ ভাবে কেউ বলেননি। কৃষকেরা বিশেষ কথা বলতে পারেনি। একটা অস্বস্তিকর বিস্ময়ে অধিকাংশরাই চোখাচোখি করেছিল।
তবু, তারপরেই আঁকাবাঁকা লাল অক্ষরে বাজারে স্টেশনে পোস্টার পড়েছিল, চোরা চোলাইকর চিরঞ্জীবকে বয়কট কর। চোলাইকরদের শায়েস্তা কর। উহারা কৃষকের শত্রু।
বিমলাপুরের যে সব লোকেরা চিরঞ্জীবের দলে ছিল, তারা সত্যি সত্যি দল ছেড়ে গিয়েছে অনেকে। কথা বন্ধ করেছে অনেকে তার সঙ্গে। যদিও ওই ব্যাপারের পর, সাত দিনের মধ্যেই, তিনজন স্মাগলারকে জামিনে খালাস করে আনতে হয়েছিল শ্রীধরকে। আর তারা কেউই চিরঞ্জীবের দলের লোক ছিল না। তারা নিজেরাই চোলাই করে স্মাগল করতে গিয়েছিল।
কিন্তু চিরঞ্জীবের দল একটুও ভাঙেনি, এ কথা বলা যাবে না। তাতে, চাকে ঢিল খাওয়া ভীমরুলের ক্রোধ বেড়েছে বই কমেনি। দুর্গা নতুন নতুন মেয়েদের নিয়ে দল তৈরি করেছে। যার সবটুকু চিরঞ্জীবও জানে না।
বলাই বলল, শ্রীধরবাবু একজন জনপ্রিয় এম. এল. এ। তিনি আপনাকে ভালবাসতেন। আজ তিনিই আপনাকে ধরিয়ে দিতে চাইছেন। তাঁর দলের সমস্ত লোক আপনাদের ধরিয়ে দিতে সাহায্য করবে। এবার আর আপনি রেহাই পাবেন না চিরঞ্জীববাবু।
চিরঞ্জীব উঠোনে নেমে বলল, চ্যালেঞ্জ? দেখা যাক।
–দাঁড়ান।
এবার হুকুমের সুর ফুটল বলাইয়ের গলায়! সামনে এসে বলল, আমি আবার বলছি, এ পথ আপনি ছাড়ুন।
চিরঞ্জীব বলল, এত লোক থাকতে আপনি আমাকে নিয়ে পড়লেন কেন?
–কেন জানতে চান। বললে হয়তো আপনি একটা ঝানু স্মাগলের মতো আমার উইকনেস বলে মনে করবেন সেটা। কিন্তু গোটা জেলার মধ্যে আপনি হচ্ছেন সবচেয়ে রিমার্কে নটোরিয়াস্ আর সবচেয়ে বেশি পপুলার চোলাইকর আর চালানদার।
এর মধ্যে পপুলারিটির কী আছে?
–সেটা বাংলা দেশের দুর্ভাগ্য, তারা ক্রিমিন্যাল হিরোইজমেও আনন্দ পায়, উত্তেজনা বোধ করে। আর সিক্রেট রিপোর্ট জানতে চান আপনি? তাও বলছি, আপনাকে এ পর্যন্ত একবারও না ধরতে পারাটা আমার ডিজক্রেডিট বলে প্রমাণ হতে চলেছে।
চিরঞ্জীব ঠোঁট উলটে বলল, তা হতে পারে। সুরেশবাবুর মুখে শুনেছিলুম, আপনি তরাইয়ের বাঘ।
বলাই বলল, বোধহয় সেইটেই অসুবিধে। এই সহজ সমতলে আমি অনভ্যস্ত। এখানে যে গ্রামের ভদ্র-অভদ্র সকল ব্যক্তি এ সব সমর্থন করে, তা আগে জানতাম না। কিন্তু এবার গ্রামের লোকেরা আপনাকে ধরিয়ে দেবে।
–দেখা যাক তবে সেটা।
–হ্যাঁ, তাই দেখবেন।
বলাইয়ের চোখও তখন ধক ধক করে জ্বলছে। দুজোড়া চোখের আগুনে মেঘমেদুর সন্ধ্যায় যেন আগুন লেগে গেল। বলাই আবার বলল, ভেবেছিলাম আপনার মধ্যে এখনও কিছু মনুষ্যত্ব আছে। সেইখানেই আমার দাবি ছিল।
চিরঞ্জীবের ঠোঁটের কোণে ছুরির বাঁকটা আরও শাণিত হল। বলল, মনুষ্যত্ব সুখী লোকদেরই একচেটিয়া থাকুক।
কিন্তু চিরঞ্জীব মোটেই দুঃখী লোক নয়। একটি পাকা বদমাইস। একটা বাগদি মেয়েকে রক্ষিতা রেখে, মদ চোলাইয়ের ব্যবসা যে করে, তার বড় বড় কথা সাজে না।
–বাগদি মেয়েকে রক্ষিতা কথাটা শুনে চিরঞ্জীব চকিতে ঘুরে দাঁড়াল। তার ঠোঁট কেঁপে উঠল একবার কিছু বলবার জন্যে। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। পরমুহূর্তেই পিছন ফিরল সে।
–দাঁড়ান। কী বলতে চাইছিলেন?
পথরোধ করে দাঁড়াল বলাই। কী এক অদৃশ্য ইঙ্গিতে যেন কাসেমও চিরঞ্জীবের পিছনে এসে দাঁড়াল। তার চোখেও বিদ্বেষ এবং প্রতিশোধের আগুন। হুকুম পেলে যেন, পোষা হিংস্র কুকুরের মতো ছিঁড়ে ফেলবে চিরঞ্জীবকে।
চিরঞ্জীব তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল, বলতে চাইছিলুম, বড় কর্তাদের কাছে নিজের ডিজক্রেডিট বাঁচাবার জন্যে এইসব কথা বলতে আরম্ভ করেছেন। তবে ডেকে এনে এ সব কথা বলার দরকার ছিল না। এবার আমি একটা কথা বলব? বলে চিরঞ্জীব যেন রহস্য করে হাসল।
–শুনি?
সুরেশবাবুর সঙ্গে আমাদের একটা চুক্তি ছিল। আমাদের কোনও লোককে, স্মাগলের সময় পঁচিশ হাত দূরে দেখতে পেলে, তাকে ছেড়ে দেবেন। পেছন তাড়া করবেন না। আপনি কি এরকম চুক্তিতে রাজি আছেন আমাদের সঙ্গে?
কথা শেষ হবার আগেই বলাই চিৎকার করে গর্জে উঠল, কাসেম, একটা বেত নিয়ে এসো তো।
কাসেম ছুটে একটা লিকলিকে সাপের মতো পিঙ্গল বেত নিয়ে এল। বলাই বেতটা নিয়ে, চোখে চোখে তাকিয়ে, আঘাত করতে পারল না। কেবল চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, তোমার ওই মুখ আমি চাবকে থেঁতো করে দেব। নোংরা কোথাকার! গেট আউট, গেট আউট। দেখি তোমাকে আমি বামাল ধরতে পারি কি না।
বলে দুপা পিছিয়ে এসে বেতটা ছুড়ে ফেলে দিল বলাই। অফিসে ঢুকে গেল তাড়াতাড়ি। কাসেম ফিরে তাকাবার আগেই চোখের নিমিষে অদৃশ্য হল চিরঞ্জীব।
.
তিন রাস্তার মোড়ে এসে থমকে দাঁড়াল একবার চিরঞ্জীব। সে ভুলে গিয়েছে, কোথায় যাচ্ছিল। এখন কোথায় যাবে! তার দপদপে চোখের তারা অস্থির। যেন এই মাত্র সে বহুদূর থেকে দৌড়ে এসেছে, এমনি আরক্ত ঘর্মাক্ত তার মুখ। কেবল নির্জন খালধারের ছবিটাই এখন ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। যদিও আকাশে মেঘ আছে। বাতাসও ভেজা-ভেজা। বেলা চলে গিয়েছে। একেবারেই। অন্ধকার নামো-নামো। তবু পশ্চিমে ঘুরে জঙ্গলে পা বাড়াল সে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই শুনতে পেল, এদিকে এসো। ওদিকে কোথায়?
চিরঞ্জীব দেখল, আসশেওড়া আর কালকাসুন্দের ঘন ঝোপে দুর্গা। জঙ্গল মাড়িয়ে কাছে ছুটে এল সে। ত্রাসে ও উৎকণ্ঠায় যেন রুদ্ধশ্বাস দুর্গা। বলল, কী হয়েছেল? আবগারি দারোগা তোমাকে ডেকে নে গেছল ক্যান? তুমি তো ঝাড়া হাত পা ছিলে, তবে?
চুপ করে থাকতে ইচ্ছে করছিল চিরঞ্জীবের। তবু সে কোনওরকমে বলল, কিছু নয়, এমনি কথা বলার জন্যে।
কিন্তু সে দুর্গার দিকে তাকিয়ে দেখল না। ঝোপ-জঙ্গল মাড়িয়েই সে দ্রুত চলতে লাগল। খেয়াল করল না, খালধারের পথ ছেড়ে, দুর্গাদের বাড়ির দিকেই চলেছে।
দুর্গার কোনও কথা বলতে সাহস হল না। কিন্তু তার সারা মুখে একটি ব্যথা ও হতাশার ছাপ ফুটে উঠল। মুখ নামিয়েই বলল, আবগারি-আপিসেই যাব ভাবছিলুম। কিন্তু
কথা থামিয়ে চোখ তুলে একবার চিরঞ্জীবকে দেখল। চকিতের জন্য একটু সলজ্জ হাসির ছোঁয়া লাগল তার ঠোঁটে ও চোখে। পর মুহূর্তেই আঁচল দিয়ে সোনার হারটা ঢাকল। নতুন সোনার হার দুর্গার গলায়। তাই দুর্গা সরাসরি আবগারি-অফিসে যেতে পারেনি।
আজ দুর্গার কোথাও যাবার দিন ছিল না। আজ বাইরের দুয়ার সে বন্ধ করেছিল। ভিতর দুয়ার মুক্ত করে আজ সে চোখে কাজল পরে ছিল। মুখে মেখেছিল হিমানী। পায়ে দিয়েছিল আলতা। পরিয়ে দিয়েছিল যমুনা-মাসির মেয়ে যোগো। বড় বড় চুলের গোছা নিয়ে তো দুর্গা কোনওদিন কৃষ্ণ-কুঞ্চিত কেশিনী নয়। সবাই বলে, রাক্ষুসে-চুল। মা কালী গো। যোগো সেই চুলে নিখুঁত করে বেঁধে দিয়েছিল খোঁপা। ঠিক পান পাতার মতো। যোগো বলেছিল, হরতনের টেক্কা হয়ে গেল ভাই দুগগা। দাঁড়া পাতাসুদ্ধ গন্ধরাজ ফুল গুঁজে দিই! ইসকাবনের টেক্কা হয়ে যাবে।
আজ দুর্গা সাদা জমিনে নীল ফুল তোলা টকটকে লালপাড় ছাপা শাড়ি পরেছিল। মেজেন্টো রং-এর জামা দিয়েছিল গায়ে। কুঁচিয়ে শাড়ি পরার রেওয়াজ নেই কোনওকালে। কিন্তু হালকা রং-এর শায়া পরেছিল। পিতলের দুটি দুল ছিল অনেকদিনের। মাটি ঘষে, চকচকে করে পরেছিল কানে।
আজকে এ-দুর্গা বাইরের নয়, ভিতরের। এ-দুর্গাকে চিনবে কেন বাইরের লোকে। চিনলেও বড় লজ্জা। এমন বেশে এ সংসারের দুয়ার খুলে কি সদরে যাওয়া যায়? এ লুকনো, এ চুপিচুপি এ তার এবং আর একজনের মাঝখানে, এক দুর্লঙঘ্য সীমা পার হবার সাহসের বসনভূষণ প্রসাধন। এ তার দেহের মাটির রক্ত-রসের সিঞ্চনে, আকাশের বুকে নিঃশব্দে ফোঁটার আবেগ। এ বাইরে বেমানান।
কিন্তু বেড়ায়-গোঁজা আরশির সামনে দাঁড়াবার সময় পায়নি। খবর এসেছিল, আবগারি দারোগার সঙ্গে চিরঞ্জীব অফিসের মধ্যে ঢুকেছে। খবর রটে গিয়েছিল, এতদিনে ধরা পড়ল তবে চিরো বাঁড়ুজ্জে।
ভিতর দুয়ারের নিঃশব্দ চুপিচুপি অভিসারের বেশবাস খোলবার সময় পায়নি দুর্গা। যে-কে-সেই চিতানীটাই বেশবাস বাঁশঝাড় জঙ্গল মাড়িয়ে ছুটে এসেছিল ঊর্ধ্বশ্বাসে। কিন্তু থমকে দাঁড়িয়েছিল দূরের এই আসশেওড়া কালকাসুন্দের জঙ্গলে। এই বেশে সে যেতে পারেনি অফিসে। চিতাবাঘিনীটারও লজ্জা করে উঠেছিল। হায়, সে লজ্জা কিনা আবার দুর্গার লোকলজ্জা। কিন্তু অফিসের সামনে ভিড় নেই এ কেমন ধরপাকড়। তারপর সে জঙ্গল ঘেঁষে-ঘেঁষে, আরও কাছে গিয়েছিল। দেখতে পেয়েছিল জানালা দিয়ে অফিসের ভিতর। দারোগার সঙ্গে ছোট্ঠাকুর কথা বলছে। কেন? কী কথা দারোগার সঙ্গে? মিটমাট, ঘুস দেওয়া-নেওয়া চুক্তির কথা? এতদিনে নতুন দারোগার মন টলল? তবে না শোনা গিয়েছিল, যুধিষ্ঠির মানুষ। বাঘ নাকি এসেছে?
একটু নিশ্চিন্ত হয়েই দুর্গা সরে গিয়ে অপেক্ষা করেছিল। কিন্তু চিরঞ্জীবকে দেখে আর নিশ্চিন্ততা রইল না তার। চিরঞ্জীবের এমন চুপচাপ দপদপে চোখে অপলক-চাউনি দেখলেই সে বুঝতে পারে, খারাপ কিছু ঘটেছে।
দুর্গাদের বাড়ির সামনে এসে দেখা গেল, রীতিমত জটলা বসে গিয়েছে। যমুনা, মাতি মুচিনী, গুলি এরা তো ছিলই। গজেন-সতীশও এসেছে। আর ছিল শ্মশানের বেদো ডোম। মাতি মুচিনী আর বেদো ডোমের মধ্যে বিতর্ক চলছিল। বাকিরা শ্রোতা ঠিক বলা যাবে না। মাঝে মধ্যে দু একটা কথা শুনছিল ; কথা বলছিল নিজেদের মধ্যে।
মাতি বুড়ি বলছিল, যাগ চিরো ঠাউর তালে ধরা পড়ে গেল শেষতক?
বেদো ভেংচে উঠেছিল, তোমাকে বলে গেছে কানে কানে আবগারি দারোগা, না?
–আবগারি-দারোগা কেন, সবাই বলতে নেগেছে।
যদিও মাতি বুড়ি চিরঞ্জীবের দলের হয়েই কাজ করে, তবু তার একটা রাগ হয়ে গিয়েছে। দুর্গা যে তাকে মেরেছিল, এ কথাটা সে কোনওদিন ভোলেনি। মাতি মুচিনীর বয়স হয়েছে। যৌবনে সে খাঁটি স্বৈরিণী ছিল। তাই দুর্গার জীবনটা তার কাছে ভীষণ অহঙ্কার বলে মনে হয়। মনে মনে সে খুশি হয়, যদি চিরঞ্জীব সত্যি সত্যি ধরা পড়ে থাকে। এ গাঁয়ে সে অনেক রং অনেক ঢং করেছে তার বয়সকালে। তাই চিরঞ্জীব আর দুর্গা, এই জুটিকে তার বড় ঘৃণা। এরা যেন অন্যরকম। ঠিক তাদের কালের পুনরাবৃত্তি হয়নি। তাই এখানে নাক গলাতে পারেনি মাতি। তাই বড় ঘৃণা। সংসারে এমনি নিয়ম। সবাই নিজের মতো ভাবে এবং চলে আর জ্বলে অবুঝ হয়ে। কারণ, তার বিশ্বাস, প্রেম-পিরিতি তারাও করেছে, কিন্তু দুর্গার মতো অত ভাগ্য নাকি তাদের ছিল না। মনে মনে সে নখে-টিপে মারে দুর্গা আর চিরঞ্জীবকে।
বেদো তাই রেগে বলেছিল, তবে আর কী। চিরো ঠাউর ধরা পড়েছে, এবার কাপড়খানি খুলে ফেলে নেত্য করতে আরম্ভ করো।
মাতি বলছিল, ও বাবা ধর্মের কল। একেবারে যে কেউ পেত্যয় যেত না, চিরো ঠাউরও একদিন ধরা পড়বে।
ধরা পড়বে কেমন করে শুনি? সে কি মাল নে গেছে যে ধরা পড়বে?
–তবে কি আর এমনি এমনি আবগারি-থানায় হাওয়া খেতে গেছে?
বেদো মনে জোর পায়নি। কিন্তু রাগ হচ্ছিল। বলছিল, মাগি বড় বেইমান দেখছি যে? বলে যার শিল যার নোড়া তারই ভাঙ্গি দাঁতের গোড়া।
–কেনরে, কেন? কাজ করে দিই পয়সা নিই। মিনি মাগনা নাকি? একজন যাবে আর একজন আসবে। ওকুর দে আছে, সনাতনবাবুর দল আছে। কাজ নাই নাকি? বেইমান বলছিস যে বড়?
লাগ দানাদান লেগে যেত হয়তো। কিন্তু স্বয়ং চিরঞ্জীবকেই দুর্গার আগে আগে আসতে দেখে মাতি একেবারে কাঠ। এই জন্যে সে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেছে, দুর্গা আর চিরো ঠাকুর শুধু মানুষ নয়। ওরা আরও কিছু অশরীরী অদৃশ্য অপদেবতার সঙ্গে নিশ্চয় ওদের মন্ত্রতন্ত্র যোগাযোগ কিছু আছে। সে তাড়াতাড়ি হাঁটা ধরে বলল, না যাই, ঘর-দোর খোলা পড়ে আছে।
বেদো বলল, কেন যাবে কেন, এটটু বক্তিমে দে যাও।
মাতি বাঁকা-বাঁকা পায় বকের মতো লাফিয়ে চলল, মুখ ফিরিয়ে অস্ফুটে গালাগালি দিল, যমে নিক তোকে, মড়া ডোম।
বেদো সে কথা শুনতে পেল না। সে একটু গলা তুলে হেসে বলল, তবে যাবে কোথা? আসতে হবে এ বেদো ডোমের কাছে। তোমার শেষ দরজা আমি আগলে বসে আছি।
যেন দৈববাণী করে হেসে উঠল সে। মাতি বুড়ির বুকের মধ্যে তার স্তিমিত রক্তধারা চলকে উঠল। গুরগুর করে উঠল। তার আতঙ্কিত চোখের সামনে ভেসে উঠল খাউ-খাউ আগুন। সেই আগুনের মধ্যে যে দেহটিকে বেদো বাঁশ দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দিচ্ছে, সেটা আর কারুর নয়, মাতি মুচিনীর নিজের।
এই ঘোর-লাগা সন্ধ্যায় মাতির বুকের মধ্যে কেঁপে উঠল। সে ফিসফিস করে বলল, হেই গো ঈশ্বর। হেই গো ভগমান!…
মাতির বয়স নেই, যৌবন হারিয়েছে অনেককাল। তার বুড়িহাড়ে জীবনধারণ দায়। তার ধন নেই, রত্ন নেই। তার সন্তান নেই সন্ততি নেই। তবু মরণে বড় ভয়। শেষের দিনের কপাট সে বন্ধ করে রাখতে চায়। তাই অলৌকিকত্বে তার বিশ্বাস। বুড়ি ভাবে, চিরো ঠাকুর আসলে দেবতা। নইলে বেদো ডোম তার আজ্ঞাবাহী হত না।
চিরঞ্জীব বাড়িতে ঢুকে, উঠোনে লোকজন দেখে অবাক হল। তার প্রথম দৃষ্টি পড়ল গজেন-সতীশের দিকে। জিজ্ঞেস করল, তোমরা এ সময়ে এখানে কেন?
সতীশ বলল, এসেছিলুম এক সোমবাদ নে। এসে শুনলুম আর এক সোমবাদ।
গজেন বলল, তাই তো।
কিন্তু দুজনেই চিরঞ্জীবের চোখের দিকে যেন তাকাতে পারছে না। সকলেই তার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করেছিল।
চিরঞ্জীব বলল, কী, বিমলাপুরে জাওয়া ভেঙে দিয়েছে আমাদের, সে খবর দিতে এসেছ?
সতীশ অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ। জানলে কেমন করে?
–তোমাদের মুখ দেখেই বুঝেছি।
বলে দাওয়ার ওপরে বসল চিরঞ্জীব। দুর্গাকে বলল, বাতি জ্বালা।
জাওয়া হল চোলাইয়ের সম্পূর্ণ সরঞ্জাম। যে-পাত্রে মাল-মশলা দিয়ে সাজিয়ে-গুছিয়ে উনুনে বসানো হয়, তার সবটা মিলিয়ে একটা নাম জাওয়া বসানো।
গজেন বলল, কিন্তুক, এ তো বড় মুশকিলের বিষয় দাঁড়িয়ে গেল বলতে হবে। এই নিয়ে চার খেপ আমাদের জাওয়া ভাঙল, আর সকলেরটা ঠিক রয়ে গেল। বিমলাপুরে দেখছি আমাদের আর কাজ কারবার করতে দেবে না। সেই কবে গত মাসে উড়ানখোলার জঙ্গলে গে জাওয়া বসালুম। কিষক-সমিতির লোকেরা বললে, এখানে ও সব হবে না। বললুম, ঠিক আছে, বসিয়ে ফেলেছি, এবারটা ছেড়ে দাও। আর বসাব না। কিন্তুক ঠিক খবর চলে গেল। কাসেম দলবল নে একেবারে উড়ানখোলার জঙ্গলে। অত বড় পিপেয় করে জাওয়া বসিয়েছিলুম। সবশুদ্ধ ঢেলে উপুড় করে ফেলে, পিপে নে চলে গেল। এবারে বসিয়েছিলুম কানার ধারে চরার জঙ্গলে। ছোট দারোগা দলবল নে গে হাজির। উনুন ভেঙে, জাওয়া ভেঙে একসার। আড়াল থেকে দেখলুম সবই। কথা হচ্ছে জাওয়া তো আর আমরা একলা বসাচ্ছি না। সকলে পার পেয়ে যাচ্ছে, আর ধরা পড়ল পর পর আমাদেরই, এ কেমন কথা?
কথাগুলি যার উদ্দেশে, সেই চিরঞ্জীব স্থির অপলক চোখে বাইরের সদ্য-নামা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল। কোনও কথা বলল না। হাতের সিগারেট জ্বলে যেতে লাগল বৃথা।
সতীশ বলল, যদি বুঝতাম যে বিমলাপুরে যারা সমিতি করে, তারা সব হাত গুটিয়ে লিয়েছে, তবু না হয় হত। কিন্তুক এ কেমন ধারা? সমিতিতে তো আমরাও আছি। এখন চিরো বাঁড়ুজ্জের দলে থাকলেই যদি এরকম হয়, তা হলে তো মুশকিল। আর শালা সনাতন ঘোষ, ওকুর দেরা কাম সেরে যাবে? ছিধরবাবুর কথা যদিন মানতে হয়, তবে সকলের পেছুতে লাগ। একজনের কেন?
বেদো বলে উঠল, পালটা ব্যবস্থা করো তোমরা। তোমরাও ওদের বেলায় খবর দে দাও।
চিরঞ্জীব বলে উঠল, তা হলেই ষোলোকলা পূর্ণ হয়। আমরা নিজেদের মধ্যে লড়ে মরি, পুলিশ হাত তুলে নাচুক। ও সব হবে না। আজ রাত্রে আমি বিমলাপুর যাব, কথা বলব কয়েকজনের সঙ্গে। মিটমাট করে ভাল, নইলে অন্য ব্যবস্থা দেখতে হবে। তবে
কয়েক মুহূর্ত ঠোঁট টিপে চুপ করে থেকে বলল সে, আমাদের শত্রু এখন ঘরে বাইরে। দারোগা আজ আমাকে ডেকে শাসিয়েছে, যেমন করে হোক, সে আমাদের ধরবে। কৃষক-সমিতির লোকেরা আর কদিন পেছনে লাগবে। চোলাই তো আর বন্ধ করতে পারবে না। পারেনি। সবাইকে যদি ডেকে ডেকে চোলাই বন্ধ করতে শুরু করে
বলতে বলতে তিক্ত হেসে উঠল চিরঞ্জীব। বলল, সামনে ভোটের লড়াই। অত সহজ নয় সব। তবে শুধু আমাদের পিছনে বেশিদিন লেগে থাকলে আমরাও ছেড়ে কথা কইব না। আজই আমি বিমলাপুর যাব। কথা কইব, তারপর আমরাও পালটা লোকের নাম করে করে পোস্টার দেব, কারা কারা চোলাই করছে। আমাদের চারটে জাওয়া ভেঙেছে বলছিলে না?
সতীশ বলল, হ্যাঁ।
চিরঞ্জীব বলল, দুটো জাওয়ার খরচ ফিরে পাওয়া চাই। একটা দেবে সোলেমন। ও সমিতি করে, চোলাইও করে। আর একটা দেবে সনাতন ঘোষ। ও তো মন্ত্রীর দলের লোক, পুলিশ ওর বাপ। কিছু না দিক, পাঁচ মন কয়লা আর চার মন গুড় দিতে হবে তাদের।
দুর্গা বলল, তারা দেবে কেন?
চিরঞ্জীবের সর্বাঙ্গে প্রতিশোধের জ্বালা। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, দিতে হবে। তাদেরটা ধরা পড়েনি, আমাদেরটা কেন পড়েছে, জবাব তাদেরই দিতে হবে। আমি তো পুলিশের কাছে যাব না। ওদের জাওয়া আমি তুলে নিয়ে আসব, না হয় ভাঙব।
দুর্গা দরজা ধরে অনেকক্ষণ থেকেই দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার একবারও ফেরেনি চিরঞ্জীবের মুখের থেকে। সে বলল, মারামারি করবে তুমি?
দরকার হয়, করব। মুখ বুজে বুজে ওদের প্যাঁচকষুনির মার তো বারবার খেতে পারব না।
–তবে যে বললে, নিজেদের মধ্যে লড়বে না।
চিরঞ্জীব বিরক্ত হয়ে বলল, বাজে বকিস কেন? সে কথা পুলিশের বেলায় বলেছি। নিজেদের মধ্যে রফা করা আর পুলিশের কাছে ছোটা কি এক কথা হল? ক্ষমতা থাকে, নিজেরা এসে আমার জাওয়া ভাঙুক। ওরা পুলিশ চিনতে শিখেছে কবে থেকে, সেইটা একবার জানতে হবে। আগুন যদি লাগাতে হয়, ভাল হাতেই লাগাতে হবে।
গজেন-সতীশের দিকে ফিরে বলল যে, তোমরা চলে যাও। হানিফকে আর নন্দকে বলবে, বাড়ি থাকে যেন, দেখা করব।
এ অঞ্চলে হানিফ আর নন্দ খুন না করেও খুনি বলে কুখ্যাত। তাদের লাঠির ঘায়ের দাগ কয়েকজনের মাথায় আছে। জেলের ভাতও আছে তাদের পেটে। দুজনেই ভূমিহীন কৃষক। সংসার ধ্বংস হয়েছে তাদের অনেকদিন। এখন তারা বড়লোক জোতদারের পাইক-পাহারাদার হয়েছে। এ দুজনের নামে সবাই আতঙ্কিত। সহসা কেউ এদের ঘাঁটায় না! প্রতিষ্ঠিত-সম্পন্ন লোকেরাও না। বিমলাপুরের আন্দোলনের সময় থেকে এরা চিরঞ্জীবের অনুরক্ত। হানিফ গোঁফ-গজানো অবস্থায় ক্লাশ ফোর অবধি পড়েছিল চিরঞ্জীবের সঙ্গে। তারা আজ একটি জিনিস বুঝেছে। দিন-মজুরের চেয়ে তাদের খাতির বেশি। ঘৃণা তাদের করে লোকে। ভয় করে তার চেয়ে বেশি। তাদের দুজনকে অনেকে যেচে পুষতে চায়।
চিরঞ্জীবের মুখে, নাম দুটি শুনে, সকলেই যেন একটু সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। সেটা বুঝে চিরঞ্জীব গজেন সতীশের দিকে ফিরে বলল, কী ভয় হল নাকি?
সতীশ বলল টেনে টেনে, না ভয় নয়। তবে, ওদের জানো তো। যা হুকুম-টুকুম দেবে, এটটু সমঝে দিয়ো।
চিরঞ্জীব যেন যুদ্ধের ঘোড়ার মতো দূর থেকেই বিপদের গন্ধ পাচ্ছিল। বলাই সান্যালের মুখটা মনে পড়ছে আজ। শ্রীধরদার কথাগুলিও ভোলবার নয়। বয়স কম হলেও এই জীবনের অভিজ্ঞতায় তার সমগ্র অনুভূতি আশ্চর্য তীক্ষ্ণ। সে যেন পরিষ্কার দেখতে পেল, চারিদিক থেকে ক্রমেই একটা অদৃশ্য জাল ঘিরে ধরেছে। তবু আজকের অপমানের জ্বালাটাও তার রক্তের মধ্যে ফুটছে। যে অপমানের কথাটা সে কাউকে বলতে পারবে না।
অন্ধকারের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে সে হঠাৎ বলল, তবে, এবার থেকে আর আমাদের গাঁয়ের স্টেশনে নয়। চন্দননগরেও নয়। শিয়াখালার ছোট লাইন দিয়ে সোজা হাওড়ার ভেতর দিয়ে না হয় লেনদেন চলবে। পূর্বদিক আর কেউ মাড়াবে না। শিয়াখালা-জনাইয়ের ভেতর দিয়ে পথ করতে হবে। দরকার হলে, দ্বারহাট্টা দিয়ে একবারে হাওয়াখানা হয়ে জাঙ্গীপাড়া দিয়ে যেতে হবে।
গজেন সতীশ একযোগে বলে উঠল, সেটা মন্দ বলনি। এদিকটা বড় কড়াকড়ি। এক ভোলা আর কেষ্টার ফেউগিরিতেই অস্থির। যা হোক, যা ব্যবস্থা হয়, একদিন তালে সবাইকে ডেকে-ডুকে কথাবার্তা বলে নিতে হয়। আমরা চলি।
চিরঞ্জীব বলল, তোমরা যাও, আমি যাচ্ছি। গুলি, বাড়ি থেকে সাইকেলটা নিয়ে আয়। টর্চলাইটটা কোথায় আছে?
দরজার পাশ থেকেই জবাব দিল দুর্গা, এখানে।
–বার করে দে।
একে একে সবাই চলে গেল। যমুনাও চলে গিয়েছে কখন। দাঁড়িয়ে আছে শুধু বেদো ডোম। সে চিরঞ্জীবের পায়ের কাছে বসে বলল, তালে দারোগা তোমাকে শাসাবার জন্যে ডেকে নে ছেল? আর এতক্ষণে সারা থানা মহকুমা বোধ হয় রটনা হয়ে গেল, চিরোঠাউর ধরা পড়ে গেছে।
চিরঞ্জীব বলল, সে আর আশ্চর্য কী। এ্যাদ্দিন ধরা পড়িনি, এবার একদিন ধরা পড়ব।
বেদো হাঁটু দোলাতে দোলাতে, মাথা নেড়ে বলল, সে আমার বিশ্বেস লয় ঠাউর। ওটা আমি মানতে পারব না।
সে কথা বলছে। কিন্তু তার চোরা-নজর দুর্গার দিকে। আসলে সে এসেছে একটা খবর দিতে। চিরঞ্জীবের সামনে বলতে পারছে না। দুর্গা তাকে গোপনে চোলাই করতে দেয়। মালমশলা কয়লা, সবই কিনে দেয়। খালধারে, শ্মশানেই চোলাই করে বেদো আর তার ডোমনী। একদিকে চিতার আগুন জ্বলে। আর একদিকে, বেদোর মাটির ঘরে জাওয়া বসে। ওদিকটায় সহসা কারুর নজর পড়ে না। এক সময়ে চিরঞ্জীব নিজেই বেদোকে চোলাই করতে দিয়েছিল।
কিন্তু বেদোর সব ভাল হয়ে, একটাই কাল করেছে। চোলাই করে সে আর তার বউ লোভ সামলাতে পারে না। বেহিসেবি হয়ে খেয়ে ফেলে। একবার খেয়ে ফেললে, তারপরে আর হিসেব কৈফিয়তের ধার ধারে না সে। তখন চিরঞ্জীবকেও শুনিয়ে দেয়, দেখ ঠাউর, অমর্ত নে ভগমানেরাই নিকি লড়ে যায়। নিজে হাতে তোয়েরি করে এটটু না চেখে কেউ পারে? অত কিপটেমি করলে চলে না, সত্যি।
চিরঞ্জীব বকেছে ধমকেছে রাগ করেছে। দু একটা থাই থাপ্পড়ও যে না দিয়েছে, তা নয়। কিন্তু ভবী ভোলবার নয়। তাই বেদোকে আর চোলাই করতে দেয় না সে। কিন্তু দুর্গা দেয়। লুকিয়ে চুপিচুপি দেয়। বেদো খেয়ে কিছু ক্ষতি করে বটে। জায়গাটা নিরাপদ। তা ছাড়া বেদোকে না দিলে মনটা খারাপ লাগে দুর্গার। বেদো তাকে ভালবাসে, বাপের মতো। বাঁকার সে প্রিয় ছিল। কোথায় যেন দুজনের মধ্যে একটা মিলও রয়েছে। সে যখন এসে বলে, আগুন না হলে থাকতে পারিনে। শ্মশানে কী নে থাকব বল? চিতা না জ্বললে, শ্মশান শ্মশান লয়। তা মানুষের চিতা না জ্বলুক, এ্যাটটা চিতা তো জ্বলবে। দেবে গো মেয়ে কিছু মালমশলা? ট্যাকা পসা চাই না। জিনিসপত্তর দিলেই হবে। তখন দুর্গা মনে মনে হাসে। কিন্তু গম্ভীর হয়ে বলে, দিলেই তো খেয়ে ফেলবে। এবার আর খাব না। দুর্গা বলে, না, খাবে, খেয়ো, কিন্তু আমি গে ভাগ করে দেব। আমি যা দেব, তাই খাবে। হবে তো? ঘাড় নাড়তে কোনও বাধা নেই বেদোর। বলে, লিচ্চয়। গলা নামিয়ে বলে, আমার জন্যে তো ভয় নাই। ও মাগিটা একেবারে কথা শোনে না, মাইরি। ঘটি ডুবিয়ে খেয়ে নেয়। অর্থাৎ তার বউ। ভাগ্যি, কথাগুলি ডোমনীর সামনে বলে না। তা হলে বেদো এক জায়গায় বসে থাকতে পারত না।
সে আজ খবর দিতে এসেছে, চোলাই হয়ে গিয়েছে। পাত্র চাই। অর্থাৎ ব্লাডার কিংবা টিউব। সে আর তার বউ সেগুলি ভরতি করে পৌঁছে দেবে অঘোর কবিরাজের বাড়ি। আজকাল অঘোর কবিরাজের আইবুড়ো মেয়েরা প্রায়ই কলকাতায় কিংবা চন্দননগরে, আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যায়। সঙ্গে থাকে হয়তো একজন মুনিষ। বোঁচকা পুঁটলি দু একটা তাদের হাতে থাকে। সেগুলির ওপর সহসা কারুর নজর পড়ে না। পড়ে, চিরকালের পুরুষের চোখ। সে তো মেয়েদের দিকেই পড়ে।
বেদো অপেক্ষা করবে ভাবল। চিরঞ্জীব বিমলাপুর চলে গেলে, কথা বলবে। কিন্তু তার আগেই দুর্গা বলল, বেদো খুড়ো, তুমি এখন যাও।
একটা চকিত হতাশার চমকেই বেদো উঠে দাঁড়াল। বলল, চলে যেতে বলছ?
দুর্গা বলল, হ্যাঁ। দরকার থাকে তো কাল এসো।
বেদো বলল, আচ্ছা। কাল আসব তালে।
বেদো চলে গেল। তবু দুর্গা দাঁড়িয়ে রইল দরজার একটি পাল্লা ধরে। দুজনের মাঝখানে হ্যারিকেনটা জ্বলছে। সাজ খোলা হয়নি কিন্তু আঁচল লুটিয়ে পড়ছে দুর্গার। তার মেজেন্টো রঙের জামাটা এখন কালো দেখাচ্ছে। তাই বুঝি কণ্ঠার কাছে চিকচিক করছে সোনার হার। যে-সোনার হার আজ সকালে পাঠিয়ে দিয়েছিল চিরঞ্জীব। অনেক দিন আগে দিতে চেয়েছিল। দুর্গা পা দাপিয়ে বারণ করেছে। এবার আর বারণ মানেনি চিরঞ্জীব।
আসলে চিরঞ্জীবের মন মানেনি। কেন, তা সে জানে না। সে জানে না, তার মনের মধ্যে বাস করে এক সেই যুবক। যে-চেয়েছে, তার মনের মতো মেয়েকে সাজাবে সর্বালঙ্কারে। তার সবকিছু দিয়ে সবটুকু দিয়ে। সে জানে না, তাই মনে মনে যুক্তি দিয়েছে, দুর্গার অনেক পাওনা। তার পাওনা তাকে দিতে হবে।
সকালবেলা গুলি এসে হারটি দিয়ে বলেছিল, চিরোদা পাঠিয়ে দিলে। বলেছে, পরতে। সন্ধেবেলা আসবে।
গুলির সামনে দুর্গার লজ্জা করেছিল। কিন্তু হারটি পছন্দ হয়েছিল তার। তবু মুখ গোমড়া করে বলেছিল, ছোট্ঠাকুরের দেখছি টাকা কামড়াচ্ছে। সেই হার এনে কোট বজায় রাখলে।
বলে সে হারের বাক্সখানি তাচ্ছিল্য করে তুলে রেখেছিল। গুলি চলে যাবার পর তাড়াতাড়ি গিয়ে খুলেছিল আবার। আস্তে আস্তে হারখানি তুলে নিয়ে, গলার কাছে ঝুলিয়ে, বেড়ায় গোঁজা আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিল। পরমুহর্তেই তার নিশিন্দা পাতা চোখ দুটিতে ফুটে উঠেছিল অভিমান। যে একদিন তার হাত ধরবে বলে সব দরজা আগলে বসে রইল, সে আজ সোনার হার পাঠিয়ে দিল। কেন? দুর্গা রক্তমাংসের মন দিয়ে গড়া সাধারণ মেয়ে। তার কোথাও কোনও জটিলতা নেই। রক্ত মাংস মন, কোনওটাই এ সংসারে কোনওদিন সোনা দিয়ে ভরেনি! সে মাটির মতো পূর্ণতা চেয়েছে। পরিপূর্ণ সতেজ প্রাচুর্যভরা গাছের মতো বাঁচতে চেয়েছে। সে রোদে নিজেকে মেলতে চেয়েছে, বৃষ্টির কামনা করেছে। তার জন্যে, ঘরে বাইরে কোথাও সে কোনও লজ্জা রাখেনি। আকাশের তলায় প্রকৃতির মতো মুক্ত রেখেছে নিজেকে। আতুর হয়ে হাত বাড়িয়ে রেখেছে ঊর্ধ্বে।
আবার হারটির দিকে চোখ পড়তে হেসেছিল সে। এ কি শুধু সোনার হার? এ কি কোনও ইচ্ছে হয়ে আসেনি? মনের একটি ছিটে কি আসেনি এই হারের বিছে বন্ধনে? তাড়াতাড়ি গলায় পরেছিল হারখানি। যদি হার পরা হল তবে সাজ না হবে কেন? ইচ্ছে হয়ে যদি এসে থাকে, তবে চিরইচ্ছের বাঁধনে কেন বাঁধা হবে না। তাই সে আজ সরোবরে ভাল করে স্নান করতে গিয়েছিল। ডুব দিতেই সে হাসিটুকু শুনতে পেয়েছিল। আর সেই স্বর, মরণ তোর দুর্গা।
দুর্গা বলেছিল, কেন?
–মরণ হল না তোর তাই।
–কেমন করে?
ত্রিশঙ্কু হয়ে রইলি। না গেলি ঘাটে, না ফিরলি ঘরে। চিরো ঠাকুরের পাথরে সে চুম্বক কই যে তোকে টেনে নিয়ে যাবে?
তা হলে পথের মাঝখানেই চিরদিন দাঁড়িয়ে থাকব।
এত অহঙ্কার? কেন, এত অহঙ্কার কীসের?
মরণের বাড়া ভয় নেই বলে।
সরোবরের জলে ডুব দিয়ে দ্বিধাটুকু কাটিয়ে এসেছিল দুর্গা। মরণের বাড়া ভয় নেই। আজ মরণের দরজায় তাই নির্লজ্জ নির্ভীক অভিসারের দিন এসেছিল কিন্তু ফিরে গিয়েছে সে।
চিরঞ্জীব বলল, শুনেছিলুম, জটা এসেছে বাজারে। ওকে তাড়িয়ে দিতে গেছলুম।
কিন্তু চিরঞ্জীব চোখ তুলল না দুর্গার দিকে। দুর্গার দৃষ্টি সরল না। বলল, এখন আবার বিমলাপুরে যাবার কথা বললে কেন? খাবে কখন? কাল যেয়ো।
না। আজই যাব। একটু চা দিবি?
–দেব।
দুর্গা উঠোনের উনুনে পাতা জ্বালিয়ে চা করতে গেল। আগুন জ্বেলে জল বসিয়ে ডাকল, এদিকে এসো না একটু।
চিরঞ্জীব তার পাশে গিয়ে বসে বলল, কী বলছিস?
কী বলেছে দারোগা?
–অপমান করেছে ডেকে নিয়ে।
কী বলে?
–যা-তা বলে। তোর কথা বলেছে।
কী?
-কী আবার। ওই সব বাজে বাজে কথাগুলো। তোকে নাকি আমি রেখেছি। বলেই উঠতে যাচ্ছিল চিরঞ্জীব। জামা টেনে ধরল দুর্গা।
কী হল?
–এ্যাটটা কথা রাখবে?
কী?
আমার মামার বাড়ি আছে পাওনানে। আমি সেখেনে চলে যেতে চাই। তোমার মিছে দুর্নাম যাবে ছোট্ঠাকুর।
চিরঞ্জীব সে কথার কোনও জবাব না দিয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, একী, তুই চোখে কী দিয়েছিস?
দুর্গা বলল, কাজল।… বুঝলে, আমি চলে যাব পাওনানে।
চিরঞ্জীবের যেন সহসা নজরে পড়ল দুর্গার বেশবাস। ওর হিমানী মাখা মুখ। বলল, কী ব্যাপার বল তো? সেজেছিস কেন?
তাদের দুজনের মাঝখানে সেই দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীরটা যেন কেঁপে ওঠে। তবু যেন সে ছলনার মায়া মাত্র।
দুর্গা বলল, সাজতেও কি মানা আছে? তুমি আমার কথার কোনও জবাব দিলে না?
এবার গলার হারটা দেখতে পেল চিরঞ্জীব।
হাত বাড়িয়ে গলার হারটা ধরে বলল, পরেছিস? দেখি, কেমন হয়েছে?
দুর্গা তাড়াতাড়ি হারগাছটি খুলে ছুড়ে দিল চিরঞ্জীবের কোলে। নাও তোমার হার।
হারে হাত দিল না চিরঞ্জীব। দুর্গার হাত টেনে ধরল, শোন।
–ছাড়ো, জল ফুটে গেছে।
-ফুটুক।
চিরঞ্জীবের গলা শুনে ফিরে তাকাল দুর্গা। তার মুখও গম্ভীর হয়ে উঠেছে।
চিরঞ্জীব বলল, ওরা যে মিছে দুর্নাম দেয়। সেগুলো তুইও কি মানিস?
–না।
তবে?
–সে জন্যেই পালাতে চাই।
তবে মিছিমিছি মিশেছিলি কেন আমার দলে?
দুর্গা অবাক হয়ে বলল, এ কেমন কথা। থাকলে নাম খারাপ, যেতে চাইলে জবাবদিহি? কী চাও তবে তুমি আমার কাছে?
কী চাই? চিরঞ্জীবের গলার স্বর চাপা শোনাল। বলল, জানিনে। সত্যি জানিনে রে। তবে লোকে যখন ওরকম করে বলে, আমি সইতে পারিনে। আমি যে সত্যি ওদের মতো করে কোনওদিন ভাবিনি।
দুর্গার অপলক চোখ পাতার আগুনের দিকে। কিন্তু বুকের মধ্যে কাঁপছে। এমন করে সে কোনওদিন চিরঞ্জীবকে বলতে শোনেনি। এমন সুরে স্বরে ও ভাষায়। বলল, তুমি কেমন করে ভাব ছোট্ঠাকুর, একটু শুনি?
চিরঞ্জীব বলল, কী জানি। খালি মনে হয়, আমি জটা হতে পারব না। ও যেমন করে বীণাকে রেখেছে, তেমন করে রাখা আমি জানিনে।
বলতে বলতে তার গলার স্বর আরও চেপে এল। দুর্গাও যেন শ্বাসরুদ্ধ গলায় বলল, তা কেন হবে?
যেন কোন গম্ভীর অতল থেকে বলল চিরঞ্জীব, তাই আমার খালি ভয় হয়। কী বা আমার মান সম্মান। তবু এক ভয় দুর্গা তোকে না কোনওদিন খাটো করে ফেলি। দুর্গা, আমার খালি দিদির কথা মনে পড়ে।
গলার স্বর বন্ধ হয়ে এল তার। দুর্গার চোখে একটি স্তিমিত শিখা যেন ক্রমেই উজ্জ্বল হয়ে উঠতে লাগল। সে বলল, কেন গো?
চিরঞ্জীব বলল, পাছে ঘুরে ফিরে আর একরকম ভাবে তোকেও সেই হাল করি। দিদি, বীণা—
মুহূর্তে ভয়ংকর একটা সত্য বিদ্যুৎ কষায় যেন হানল দুর্গার বুকে। আলোটুকু পুরোপুরি জ্বলল তার চোখে। পরম সত্যের বুঝি সুখ দুঃখ বলে কোনও অনুভূতি থাকতে নেই। সে চিরঞ্জীবের কাঁধে হাত দিয়ে বলল, থাক। ও কথা থাক!
যাক। কিন্তু চলে যাবার কথাটা তুই আর বলিসনে দুর্গা।
দুর্গার মনে হল, সে যেন তার সারা জীবনের শেষ দৈববাণী শুনল। শেষ নির্দেশ পেল নিয়তির কাছে। সে যেন বড় ভয় পেয়েছে। তবু জীবনের সবকিছুর সেরা আশ্বাসের আনন্দে তার স্বর নেমে গেল হৃৎপিণ্ডের কাছে। সে ফিসফিস করে বলল, বলব না। আর কখনও বলব না। আমাকে মাপ করো।
তারপরে সে কথাটা দুর্গার মুখের ভাষায় জোগাল না সে তার বুকের কল্লোলে শুনল, তোমার এত ভয়, তাই আমার পাশে থেকেও তোমার এত সাহস। তাই বুঝি আমার সাহসেরও অন্ত নেই। তার ইচ্ছে হল, আবার গিয়ে সরোবরে ডুব দিয়ে বলে আসে, ওরে, তাই আমার এত অহঙ্কার। যাদের কপালে সিঁদুর, কোলে ছেলে, তারা আমার বাইরের দেখা দুঃখে দুঃখ পাবে। তবু আমার অহঙ্কার ঘুচবে না।
চিরঞ্জীবের কোলের উপর থেকে হারটি নিয়ে সে উঠে যেতে যেতে অস্ফুটে বলে গেল, চা চিনি নিয়ে আসি।
দুর্গা ফিরে আসবার আগেই তীব্র টর্চের আলো ধাঁধিয়ে দিল চিরঞ্জীবের চোখ। পরমুহূর্তেই সে দেখল, ইনস্পেক্টর বলাই সান্যালের সঙ্গে আবগারির প্রায় পুরো স্টাফ।
বলাই বলল, অখিলবাবু, আপনি এ বাড়ি সার্চ করুন। কাসেম, তুমি আর ধীরেনবাবু, এখানে একজনকে রেখে বাকি সবাইকে নিয়ে গোটা বাগদিপাড়াটা সার্চ করো।
কাসেম বলল, আচ্ছা স্যার।
চিরঞ্জীব একটি চকিত মুহূর্তের জন্য অবাক হয়েছিল। এবার তার সঙ্গে চোখাচোখি হল বলাইয়ের। পরস্পরের দৃষ্টি যেন তাদের তীরের মতো হানল।
দুর্গার গলার স্বর শোনা গেল, কী ব্যাপার!
অখিলবাবুর রুক্ষ গলা শোনা গেল, আগে পথ ছাড় ঘরের, তারপরে শোনবার অনেক সময় পাওয়া যাবে।
দুর্গা বলল, কেন?
অখিলবাবু দুর্গাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন, সর আগে।
চকিতে চিরঞ্জীবের গলায় একটি ক্রুদ্ধ হুঙ্কার শোনা গেল, গায়ে হাত দিচ্ছেন কেন? রাত করে পাড়ায় ঢুকে মেয়েদের গায়ে ধাক্কা দিতে এসেছেন? বলে চিরঞ্জীব দ্রুত পায়ে গিয়ে দাঁড়াল দুর্গার পাশে।
দুর্গাও ফুঁসে উঠল, তাই না বটে। দারোগা হলেই খপ করে গায়ে হাত।
অখিলবাবু দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন দরজার কাছে। বলাই মুখের ভাব কঠিন রেখে, মনে মনে কেমন একটি অপ্রতিভ বিনয়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে অখিলবাবুকে বলল, বি সোবার প্লিজ। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকবেন না, সার্চ করুন।
কিন্তু অখিলবাবুর চোখে আগুন ফুটে বেরুল। জ্বলন্ত চোখে তাকালেন চিরঞ্জীবের দিকে। চিরঞ্জীব আর দুর্গাও তাকিয়েছিল। অখিলবাবু দুর্গার দিকে তাকালেন না। কেন এই স্মাগলার শুণ্ডিনীর দিকে তাকাতে পারলেন না, নিজেও জানেন না। যদিও রাগে ও ক্ষোভে দুজনের ওপরেই ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছিল। ইচ্ছে করছিল ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করতে। খালি বললেন, বড় যে মান জ্ঞান দেখছি?
দুর্গা বলে উঠল, না থাকলেই বুঝিন ভাল হয়? চোলাই মদ ধরতে এসেছেন, পাবেন তো বামাল ধরে নে যাবেন। গায়ে ধাক্কা দেবেন কেন?
অখিলবাবুর মুখ রাগে ফুটে উঠল। বললেন, হুঁ? মনে রেখো, এক মাঘে শীত পালায় না। চলো, বাতি নিয়ে ঘর দেখাবে চলো।
দুর্গা বাতি নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, সে কি আর জানি না ছোটবাবু, এতখানি বয়স হল আমার। শীত ফি বছরেই আসে।
চিরঞ্জীব নেমে এল উঠোনে। ঘরের মধ্যে জিনিস ফেলা-ছড়ার শব্দ শোনা গেল। ইতিমধ্যে গোটা পাড়াতেই একটা হই হট্টগোল পড়ে গিয়েছে। তার মধ্যে মাতি মুচিনীর গলাই শোনা যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। যে গানি মুচিনী কড়ে রাড়ি কাসেমের রক্ষিতা, সে বুঝি সম্পর্কে মাতির ভাইঝি হয়। মাতি এখন সেই ব্যাখ্যাই শুরু করেছে, গানি এসে দেখে যাক, কার সঙ্গে সে রং পিরিত করেছে। যার সঙ্গেতে করি ঘর, সে-ই আমার পর। হাজার হলেও মাতি তো পিসশাশুড়ির তুল্য।
বলাই টর্চের আলো ফেলে বাড়ির আশপাশে দেখতে লাগল। অখিলবাবু বেরিয়ে এলেন শুন্য হাতে। বলাই ফিরে এসে বলল, কী হল?
অখিলবাবু বললেন, কিছু পাওয়া গেল না স্যার।
সে কথার কোনও জবাব না দিয়ে বলাই হঠাৎ দুর্গার দিকে ফিরে বলল, মদ চোলাই করো তুমি?
দুর্গা বলল, সবই তো দেখলেন দারোগাবাবু
বলাই ধমক দিয়ে উঠল, ও সব বাজে কথা রাখো।
–তোমার চলে কী করে?
দুর্গা বলল, লোক আছে দারোগাবাবু।
লোক আছে?
–হ্যাঁ, লোক আছে, টাকা দেয়।
-কেন?
–তা কী জানি।
বলাইয়ের চোখ দপদপ করে উঠল। বলল, আজ হেঁয়ালি করছ, আর মুখ তুলে যা খুশি তাই বলছ। কিন্তু যেদিন তোমাকে ধরব, সেদিন সকলের সামনে ধরে চাবকাব, বলে রাখলাম।
চিকুর-হানা চোখে তাকিয়ে বলল দুর্গা, কেন দারোগাবাবু, আইনের সাজা কি উঠে গেছে?
বলাই বলল, তোমাদের মতো নোংরা জীবদের জন্য আইনই সব নয়। দশজনের সামনে তোমাদের সামাজিক শাস্তিও দরকার।
দুর্গা খিলখিল করে হেসে উঠল। ইতিমধ্যেই সে দ্রুত হাতে কখন খোঁপা খুলে দিয়েছে। জোড়া সাপের মতো তার দুই বিনুনি কেঁপে কেঁপে উঠল। তার এই রঙ্গিণী মূর্তি দেখে টের পাওয়া যায় না, কিছুক্ষণ আগেও সারা মুখ ও মন থমথমিয়ে ছিল। বলল, সমাজের কথা বলছেন দারোগাবাবু। তা, বলতে পারেন। ভাত দেবার মুরোদ নেই, কিল মারার গোঁসাই আছে অনেক। তা যেদিন পারেন, মারবেন, কী আর করব।
বলাইয়ের আসলে দৃষ্টি চিরঞ্জীবের দিকে। যে কথা বলার ইচ্ছে তার ছিল না, চিরঞ্জীবের ওপর শোধ নেবার জন্যই যেন সেই কথা বলল, গ্রামে কেন রয়েছ, শহরে গিয়ে বসলেই তো পারতে।
দুর্গা বলল, সেই আপনাদের জ্বালা বড় বাবু, শহরে গে কেন বসলুম না। ওকুর দে মশাইও কত বলছিলেন। কত লোকে কত বলেছিল। গেলে আর এ সব ঝামেলা পোহাতে হত না।
অখিলবাবু বলে উঠলেন, একদিন তো তাই যেতে হবে।
দুর্গা ঠোঁট টিপে হেসে বলল, সেদিনে যত খুশি গায়ে হাত দেবেন ছোটবাবু, কিছুটি আর বলব না।
বলাইয়ের প্রতিশোধ স্পৃহা ও রাগের মধ্যে কোথায় যেন একটি অস্পষ্ট গ্লানিবোধ রয়েছে। দুর্গার কথাগুলি সে যতই শুনছে, ততই মলিনার কথা মনে পড়ছে তার। কেবলি মনে হতে লাগল এমন একটা অসামাজিক অন্যায়ের সঙ্গে লিপ্ত থেকেও, মেয়েটার চোখের চাউনিতে এত ধার কেন? কথায় এমন একটা সপ্রতিভ স্পষ্ট তীক্ষ্ণতা কোথায় পেল? কী আছে ওর? কীসের জোরে? শুধু পাপ কি এত শক্তি দেয় শিরদাঁড়ায়?
অন্যথায়, আর কীসেরই বা শক্তি? এ শুধু পাপেরই আস্ফালন নিশ্চয়। মলিনার শ্লেষ হাসি মুখখানি মনে পড়ল বলাইয়ের। সে হলে বলত, পাপের আস্ফালন নয় গো। ভাল করে তাকিয়ে দেখো, ওটা জ্বলুনি।
বলাই হলে বলত, তোমার বই-পড়া বিদ্যের কথা রাখো। বাস্তবের কথা বলো।
মলিনা হেসে কিন্তু রুষে বলত, বাস্তবের কথাই বলছি, রাগছ কেন বলাইবাবু। সবাই মিলে যাকে গর্তে ঢুকিয়ে মারছে, ওটা তার দাপানি ফোঁসানি। গর্তের ভিতরে থাকলে খোঁচা, বাইরে এলে বে-ইজ্জত। পাপের মধ্যে কখনও ভালবাসা থাকে না।
সেই বাইরেটা বোধ হয় সদর শহর। যে পরিষ্কার ইঙ্গিত কিছুক্ষণ আগেই বলাই করেছে। কিন্তু ওদের ভালবাসার কথা শুনলেই ধৈর্য হারায় বলাই। তখন বলাই না বলে পারত না, তবে কী বলতে চাও? ভালবেসে ওরা যা করছে, ঠিকই করছে? মলিনা বলত, কখনও নয়। তোমার মুখেই বড় বড় বিলাতি মদের দোকানের আর পাবলিক বার-এর গল্প শুনেছি। সেখানে বড় বড় ব্যাপার, বিরাট মহৎ অহঙ্কার করতে পারার মতো গৌরবজনক সব চুরি বাটপাড়ি সেখানে হয়, কিন্তু তাদের অনেক টাকা, সমাজের উচ্চস্তরের লোক তারা। আর এদের তোমরা ইচ্ছে করলেই বাংলা দেশের রাস্তার বাড়তি কুকুরের মতো গুলি করে মারতে পারো। কিন্তু ওপরের ওদের খাতির করতে হবে।
বলাই তখন আরও রেগে যেত। বলত, একজনের দোষ দেখিয়ে আর একজনের দোষ ঢাকা দিয়ো না।
মলিনা বলত, দেব না। কিন্তু একটা লোভে, আর একটা পেটের দায়ে। তোমার মুখেই শুনেছি, এ গ্রামের অর্ধেক লোক এ ব্যাপারে জড়িত। বলেছ, স্বয়ং এম. এল. এ-কে বেআইনি চোলাইয়ের আসামিকে জামিন দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে হয়। কেন বলো তো? কেন?
তখন বলাইয়ের ক্ষুব্ধ বিস্ময়ে মনে হত অন্যায়কে এরা প্রশ্রয় দিতে চায়। অন্যায়কে অন্যায় বলে মানতে চায় না। এ কী রকম। দুজনের কেউ কাউকে বুঝতে পারে না। যদিও অন্যায়টা আসলে কারুর কাম্য নয়। কিন্তু বলাইয়ের মনের মধ্যে কেবলি প্রতিধ্বনিত হতে থাকত, অন্যায়, অন্যায়, অন্যায়!
এবং এখনও সেই প্রতিধ্বনিই শুনতে পেল সে। না, কোনও সংশয় নয়, অন্যায়। সবটাই ঘোর অন্যায় ও পাপ। যত মনে হল, ততই তার জেদ বাড়ল। সে অখিলবাবুকে ডেকে বলল, আজ থেকে আপনি এ পাড়াটা নজরবন্দি করে রাখুন। প্রত্যেকটি লোকের ওপর বিশেষভাবে চোখ রাখার ব্যবস্থা করুন। আই মাস্ট সি দিস নোটেরিয়াস পার্টি। মেক অ্যাবসার্ড দেয়ার মুভমেন্টস।
অখিলবাবু পুরনো লোক। চিরঞ্জীবকে অনেকদিন থেকেই চেনেন। গ্রামের ছেলে হিসেবেই কথা বলেন তার সঙ্গে। হুঁশিয়ারির ভঙ্গিতে বললেন, আগুন তা হলে ভাল হাতেই লাগালে চিরঞ্জীব। এবার আর রেহাই পাবে না।
চিরঞ্জীব তখন থেকেই চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। বলল, আগুন লাগাই ভাল অখিলবাবু। জ্বলে পুড়ে যা থাকে থাকবে। তবে আবগারির আইন তো, গভর্নমেন্ট ওটা বুঝে শুনেই করেছে। হাজার টাকা ফাইন হচ্ছে সবচেয়ে বেশি, আর অনাদায়ে দশ মাস জেল। তারপর! ওতে কী আগুন জ্বলবে?
বলাই বলে উঠল, চোরের মায়েরই দেখছি বড় গলা। কত হাজার টাকা আছে আর কত মাস জেল খাটার ক্ষমতা আছে, সেটাই এবার দেখব। আসুন অখিলবাবু।
দুজনেই চলে যেতেই, দুর্গা আর চিরঞ্জীব দেখতে পেল, আরও দুটি ছায়া আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। দেখেই চিনতে পারল, ভোলা আর কেষ্ট। কাছে পিঠেই কোথাও দাঁড়িয়েছিল অন্ধকারে। চিরঞ্জীবের চোখ দুটি শ্বাপদ হিংস্রতায় জ্বলতে লাগল। কিন্তু আশ্চর্য! সে কিংবা দুর্গা, কেউ কোনও কথা বলল না এ সব বিষয়ে।
পাড়ার গোলমাল থেমে এল পুলিশ চলে যাবার পর। সবাই একবার ঘুরে গেল এ বাড়িতে। সংবাদ পেয়ে অন্য পাড়ার লোকজনও এসেছিল কেউ কেউ। পাড়া ঘিরে তল্লাশি বড় একটা দেখেনি কেউ। কিন্তু পুলিশ কিছুই পায়নি। সকলেরই বক্তব্যের ভঙ্গিটা এইরকম, ও সব বাবা চিরো বাঁড়ুজ্জের কীর্তি। পুলিশের সাধ্য কী ধরে। কেউ কেউ চিরঞ্জীবকে খোশামোদও করে গেল। কিন্তু চিরঞ্জীব কারুর সঙ্গেই কোনও কথা বলল না। সে জানে আজকের ও কাহিনী পত্র-পল্লবিত হয়ে ছড়াবে। সত্যি মিথ্যের মিলিয়ে সে এক অপূর্ব, অদ্ভুত কাহিনী। সেই বিচিত্র কাহিনীর নায়ক চিরঞ্জীব সম্পর্কে আশ্চর্য সব কথা রটনা হবে। পুলিশ যে বোকা বনেছে, তার এক রোমাঞ্চকর কল্পিত কাহিনী রটে যাবে সর্বত্র। কেন যে লোকে এমন করে, কে জানে। এতে যে চিরঞ্জীব একটুও আত্মপ্রসাদ অনুভব না করে, তা নয়। এটা একটা মৌতাতের মতো। কিন্তু তাতে শান্তি নেই। ওই মানুষগুলিকে সে প্রাণধরে বিশ্বাস করতে পারে না। এদের মধ্যে গ্রামের ইতর ভদ্র সবরকম মানুষ আছে। মাতি মুচিনীর মতো তাদেরও কোথাও একটা কুসংস্কার আছে চিরো বাঁড়ুজ্জের সম্পর্কে। চিরঞ্জীবের হাজার হাজার জমানো টাকার কল্পিত কাহিনী বলতে তারা ভালবাসে। যদিও, চিরঞ্জীবকে তারা ঠিক ভালবাসে না। ঘৃণা হয়তো করে, কারণ, একটু ভয় পায়। যেখানেই ভয়, সেখানেই ঘৃণা।
কিন্তু এ সব কথা ভাবছে না চিরঞ্জীব। তার বুকের মধ্যে কোথায় যেন কতগুলি শাণিত নখ আঁচড়াচ্ছে। জ্বলছে, ফুঁসছে বুকের মধ্যে। এ আগুন খুঁচিয়ে উসকোচ্ছে পুলিশ। তাকে ভয় দেখাতে পারেনি। বরং আরও ভয়ঙ্কর কিছু করবার, মরিয়া হয়ে ওঠা জেদ চাপিয়ে দিয়ে গিয়েছে। মরণের বাড়া ভয় নেই। সেই মরণেরই পণ থাক, তবু পুলিশের জেদের কাছে আত্মসমর্পণ কিছুতেই নয়। কেউ তাকে কিছু দেয়নি। কৃষক-সমিতি তাকে শোধন করতে চায়। পুলিশ তাকে শাসন করতে চায়। এ যদি ওদের অনধিকার চর্চা না হয়, তা হলে তারও নির্ভয়ে কাজ চালিয়ে যাবার অধিকার আছে।
–চা নাও।
চিরঞ্জীব পাশ ফিরে দেখল, দুর্গা চায়ের গেলাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু মাথা নত করে আছে। দুর্গার গলার স্বর নিস্তেজ, সুরে যেন একটি ব্যথিত অভিমানের স্পর্শ। অন্ধকারে, দুর্গার এ ছায়ামূর্তিকে ঘিরে যেন একটা গ্লানি চেপে রয়েছে।
আশ্চর্য! চিরঞ্জীবের মনে হল, তার ঘাড়েও কোনও কোনও শিরা যেন অবশ ও শিথল হয়ে রয়েছে। সেও মাথা তুলতে পারল না। হাত বাড়িয়ে সে চায়ের গেলাস নিল। কিন্তু কী যেন ঘটে গিয়েছে। কোনও কথা বলতে পারল না। দুর্গা বুঝি একবার মুখ তুলল। তারপরে সরে গেল।
আর সেই মুহূর্তে চিরঞ্জীবের মনে হল, বুকের অদৃশ্য শাণিত নখরের আঁচড়গুলি শুধু ক্ষিপ্ততা নয়। শুধু মরণের জেদ নয়, শুধু পুলিশের উসকে দেওয়া আগুন নয়। আরও কিছু, যা মরণের চেয়ে বড়। অনেক গভীর অব্যক্ত সেই আশ্চর্য জ্বালাটা তার অনুভূতির অন্ধকারে যেন একটি তীব্র চকিত বিদ্যুৎ ঝিলিক হানল। আজ বিকেল থেকে সব ঘটনার মূলে তার সবচেয়ে স্পন্দিত জায়গাটার ছাদ হারিয়েছে। সবকিছুর চেয়ে বেশি তীব্র অনুভূতিশীল কেন্দ্রটিতে তীক্ষ্ণ খোঁচা লেগেছে। এই আবিষ্কারের ব্যথায় ও গ্লানিতে, সে ব্যাকুল চোখ তুলে দুর্গাকে খুঁজল অন্ধকারে। কে জানত, দুর্গার অপমান তার এতখানি বাজবে। তার সামনে দুর্গার অপমান সত্ত্বেও তাকে যে মাথা নত করে থাকতে হয়, আর সেটা যে বড় কষ্টের ও যন্ত্রণার, এটা তার অনাবিষ্কৃত ছিল। কে জানত, মদ চোলাইয়ের জীবনে, একটি বাগদি মেয়ের সঙ্গে নিজের একটি আত্মসম্মানের অসম্ভব অবাস্তব তৃষ্ণা থেকে গিয়েছিল। আর সেই তৃষ্ণাটাকে পুলিশ আরও খুঁচিয়ে দগদগিয়ে দিয়ে গিয়েছে। তাই, যারা পরস্পরের দিকে চোখ তুলে তাকাতে কোনওদিন কোনও লজ্জা করেনি, আজ তারা সামনা-সামনি মাথা নিচু করে আছে।
চিরঞ্জীব ডাকল, দুর্গা।
কোনও জবাব পেল না। আবার ডাকল। দুর্গা জবাব দিল উঠোনেরই অন্ধকারে এক কোণ থেকে। চিরঞ্জীব এগিয়ে গিয়ে বলল, একী, ভেজা নারকোল পাতাগুলোর ওপর বসে আছিস?
বলে কিন্তু চিরঞ্জীবও বসল দুর্গার পাশে। বলল, তুই চা খাবিনে?
দুর্গা বলল, ইচ্ছে করছে না।
একটুখানি খা।
দুর্গা বলল, তুমি খেয়ে একটু দাও।
চিরঞ্জীব গেলাসটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, তুই আগে খা।
দুর্গা চমকে উঠে বলল, ছি! আমার এঁটো খাবে বুঝি?
–দোষ কী? আমার যে ইচ্ছে করে।
আজ দুর্গার বড় বুক কাঁপছে। বাঘিনীর বুক কাঁপছে। আজ ছোট্ঠাকুরকে তার অন্যরকম লাগছে। আজকের এই মুহূর্তের চিরঞ্জীবকে যেন তার চিরদিনের ঝড়ের শেষ ঝাপটা মনে হচ্ছে।
সে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ইস! আমি তা কখনও পারব না। তুমি খেয়ে নাও।
প্রতিবাদ না করে কয়েক চুমুক খেয়ে গেলাস বাড়িয়ে দিল চিরঞ্জীব। দুর্গা নিল গেলাসটা। কিন্তু তাদের মাঝখানে কীসের আড়ষ্টতা এসেছে সহসা, সে কথা কেউ বলল না। কেবল গেলাসে ঠোঁট ঠেকিয়ে, গোটা জেলা-মাতানো বাঘিনীটার মনে হল, তার চোখের জলে আর গেলাসের চায়ে বুঝি একাকার হয়ে যাবে।
চিরঞ্জীব নারিকেল পাতা টানতে টানতে বলল, রাঁধবিনে?
–তুমি তো বিমলাপুর যাবে বললে?
বিমলাপুর গেলে কি খেতে নেই?
তা হলে রাঁধব?
যেন তেমন মন নেই, প্রাণ নেই।
চিরঞ্জীব আবার বলল, আমি না খেলে বুঝি রাঁধবিনে?
-না, আজ এক ফোঁটা খিদে নেই।
পরমুহূর্তেই চিরঞ্জীবের গলার স্বর যেন চাপা রুদ্ধ শোনাল ; তুই একলা যেতে পারবি দুর্গা?
দুর্গা বলল, কোথায়?
চিরঞ্জীব বলল, কোথায় যেন তোর মামাবাড়ি বলছিলি, সেখানে।
দুর্গা অবাক স্খলিত গলায় বলল, পাওনানে?
–হ্যাঁ। কবে যেতে চাস? কাল হোক, পরশু হোক, যত তাড়াতাড়ি হয়, চলে যা সেখানে!
দুর্গা রুদ্ধ গলায় বলল, আর তুমি?
–আমি এখানেই থাকব। তুই চলে যা দুর্গা।
আমাকে সরিয়ে দিয়ে তুমি এখানে থাকবে? আমি থাকব পাওনানে?
যেন ফাঁসির হুকুম শুনছে। শুনে অন্ধকারে হুকুমকর্তার মুখের দিকে তাকাল সভয় তীক্ষ্ণ চোখে। পরমুহূর্তেই দু হাতে মুখ ঢেকে চাপা রুদ্ধ গলায় ফিসফিস করে বলল, কতক্ষণ আগে, চলে যাবার কথা বলতে তুমি আমাকে বারণ করেছিলে ছোট্ঠাকুর। এখন তুমিই বলছ?
–হ্যাঁ, বলছি। শোন—-
-না, শুনব না! শুনতে পারব না। না না না!
বলতে বলতে দুর্গার একটি হাত জোরে আঁকড়ে ধরল চিরঞ্জীবের পা। বলল, আমি মরতে চেয়েছিলাম বলে, তুমি আমাকে সত্যি সত্যি মারতে চাও?
চিরঞ্জীব ডাকল, দুর্গা।
সে জোর করে পা থেকে দুর্গার হাত ছাড়িয়ে নিজের হাতে তুলে নিয়ে এল। চিবুক ধরে মুখ তুলল দুর্গার। আবগারির দুঃস্বপ্ন, বাঘিনীটার দুচোখে জল। সহসা চিরঞ্জীবের এতদিনের মিথ্যে গ্লানির সব বাঁধ ভেঙ্গে গেল! সে দুহাতের ব্যাকুল বেষ্টনীতে দুর্গাকে টেনে নিয়ে এল বুকের মধ্যে। সব অপমান সব যন্ত্রণা নিয়ে তার তৃষ্ণার্ত ঠোঁট অমৃতের সেতু রচনা করল দুর্গার ঠোঁটে মুখে চোখে, চোখের জলের লবণাক্ত স্বাদে। কঠিন আলিঙ্গনে বারে বারে ডাকল দুর্গা। দুর্গা। পারুলবালা।
জীবনে এই বুঝি প্রথম এই নামে ডাকা। তুলে রাখা, ঢেকে রাখা, ভুলে যাওয়া নাম। যে নামের সঙ্গে হয়তো একটি আসল মনই বিস্মৃত গুপ্ত ছিল। সেই যে বুক কেঁপেছিল দুর্গার, তা থামল না। তাই সে আরও জোরে আঁকড়ে ধরল চিরঞ্জীবকে। তার সন্ধ্যার অভিসার শেষ পর্যন্ত বুঝি এই গভীর রাত্রের চোখের জলে প্রতিধ্বনিত হল। তার যৌবন, ধ্যান, জ্ঞান, সব যেন এক শীর্ষবিন্দুতে এসে, চিরঞ্জীবের প্রতিটি স্পর্শের প্রতিটি প্রতিদানে নিজেকে নিঃশেষ করতে চাইল।
আকাশে ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে ফাঁকে যেন চলমান নক্ষত্রেরা তাকিয়ে আছে নীচে, এই অন্ধকারে উঠোনের ওদের দিকে। দক্ষিণের বাতাস পুবে জলো হাওয়াকে উড়িয়ে নিয়ে চলেছে। টিপ টিপ জোনাকি দীপগুলি বাতাসে অস্থির। এই প্রসন্ন অন্ধকার রাত্রি এবং বিশ্ব আর সর্ব চরাচর যেন দুলছে, নুইছে, স্বপ্নে কথা বলছে ফিসফিস করে!
পাতার ওপর পা ছড়িয়ে, উপুড় হয়ে দুর্গা চিবুক রেখেছে চিরঞ্জীবের কোলে। বলল, মিছে বলব না ছোট্ঠাকুর, বড় গায়ে লাগছেল দারোগার কথাগুলোন। মনে করতুম, আমার আবার মান। কিন্তুন, মনের কথা কি সব জানি? তা শহরের মেয়ে পাড়ায় গে বসিনি, এখেনেও মাতি বুড়ি, বা গানির মতো আজ একে, কাল তাকে নে ঘর করতে পারিনি। একা আইবুড়ো বাগদি মেয়ে আমি কপালের লিখন খণ্ডাতে গেছি, তাই দারোগাবাবুদের অকথা কুকথাগুলোন শুনে যেন মুখে কালি লেপে গেল। মনে হয়েছিল, কপালের লিখন খণ্ডানো যায় না, কলঙ্ক আমার ঘুচবে না কোনওদিন। এ আবার কেমন চিন্তা ছোটঠাকুর? এ পথে আবার ওসব ভাবনা কেন? এ কি শুধু তোমার সঙ্গে মিশেছি বলে?
চিরঞ্জীব বলল, না। এই যে বললি, মনের কথা কি সব জানি? এ তোর সেই মনের কথা।
মাথা নেড়ে বলল দুর্গা, না, এ তোমারি জন্যে। নইলে মরব পণ করে কী মতি হয়েছিল আমার। চোলাই করব বলে তোমাকে কেন খবর দিয়েছিলুম? তোমারি জন্যে, নইলে, তুমিই তো কই ওরা চলে যাবার পর মুখ খুলতে পারোনিকো? কিন্তু আর আমি সে কথা ভাবি না।
-কেন?
–ও যে মিছে কথা। বড় মিছে কথা। লোকে কতকাল ধরে বলে, আড়ালে বলে। দারোগা বলেছে মুখের ওপর। তবু তুমি জানো, আমিও জানি, ওদের কথা সত্যি নয়। রাগে ওদের চিত্তির জ্বলছে। ধরে মারতে পারে না, তাই মারার বাড়া গাল দে শোধ নিতে চায়। গাল মনের ঝাল মিটিয়েছে। কিন্তু, তার শোধ নেব।
দুর্গার দু চোখ জ্বলে উঠল অন্ধকারে। আবার বলল, ওই ছোটদারোগা অখিলবাবু, এখেনে কতকাল ধরে আছে। কাসেমচাচার সময় থেকে। সে একটা শুধু ধাক্কা দিলে কি আর এমন চেঁচিয়ে উঠতুম? ঘেন্না হয় বলতে, অত বড় লোকটা শরীলের এমন জায়গায় হাত দে ধাক্কা দিলে, মনে হয়েছেল মুণ্ডুটা ঠুকে দিই।
চিরঞ্জীব হাত রাখল দুর্গার পিঠে। তার চোখও জ্বলছে। বলল, শুধু আইনের জোরটুকু থাকলে সবাই শাসন করতে চায়। আর ওরা আমাদের শোনায়, চোরের মায়ের বড় গলা। দেখি ওরা কত আগুন লাগায়।
সে উঠতে গেল। দুর্গা বলল, কোথায় যাচ্ছ?
–বিমলাপুর। দেখি, গুলিটা কেন সাইকেল নিয়ে আসছে না।
কথা শেষ হবার আগেই, অন্ধকার থেকে গুলির গলা শোনা গেল, দাঁড়িয়ে আছি সাইকেল নিয়ে।
ওরা দুজনেই চমকে উঠল। দুর্গার মনে হল, তার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল লজ্জায়। সে একবার চিরঞ্জীবের দিকে তাকিয়ে, তাড়াতাড়ি ঘরে চলে গেল।
চিরঞ্জীবও যেন কেমন বিব্রত হয়ে উঠল। বলল, কতক্ষণ এসেছিস?
–এই আসছি।
তা ডাকবি তো।
গুলি বলল, ডাকতে যাচ্ছিলুম।
সে সাইকেল নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল।
চিরঞ্জীব বলল, দাঁড়া, টর্চলাইটটা নিয়ে আসি ঘর থেকে।
সে ঘরে এসে দেখল, দুর্গা মাথা নত করে দাঁড়িয়ে, পায়ের নখে মেঝের মাটি খুঁটছে। এ এক অচেনা দুর্গা। ঠোঁটের কোণে লজ্জিত হাসি, চোখের পাতা তুলতে না-পারা এক বিচিত্র ব্রীড়া জড়ানো সর্বাঙ্গে। তার চেয়েও অদ্ভুত শোনালো, যখন সে মুখ না তুলে বলল, ছি!
চিরঞ্জীব কাছে এসে বলল, ছি করার কী আছে। কোনও অপরাধ তো করিনি।
যদিও চিরঞ্জীবেরও কোথাও যেন একটি লজ্জাবোধ থেকে গিয়েছে। কারণ উঠোনের মাঝখানে দুর্গাকে কোনওদিন অমন করে নিয়ে বসেনি।
দুর্গা বলল, অপরাধ না-ই বা হল। লজ্জা করে না বুঝিন?
প্রতিটি কথা প্রতিটি চাউনি, প্রতিটি ভঙ্গি আজ অন্যরকম লাগছে দুর্গার। কী এক মোহিনী শক্তি যেন আজ ওর আয়ত্তে। কথার জবাব দিতে গিয়ে, তাই সে আগে দুর্গাকে টেনে নিল কাছে। বারে বারে নুয়ে পড়ল দুর্গার মুখের ওপর।
দুর্গা রুদ্ধশ্বাস হয়ে বলল, গুলিটা দাঁড়িয়ে আছে যে? তা হলে ওকে চলে যেতে বলো। আর এত রাতে না-ই গেলে বিমলাপুরে।
চোখ তুলে দুর্গার দিকে তাকিয়ে একবার চিরঞ্জীবও তাই ভাবল। পরমুহূর্তেই বলল, না, যেতে হবে। টর্চলাইটটা দে।
দুর্গা টর্চ লাইট দিয়ে বলল, এখেনে আসবে তো ফিরে?
–হ্যাঁ। যত রাত হোক, রেঁধে রাখিস, খাব।
আচ্ছা।
কিন্তু এই দুর্গা ঠায় তাকিয়ে থাকত চিরঞ্জীবের মুখের দিকে। তাতে চিরঞ্জীবই লজ্জা পেত। আজ দুর্গা লুকিয়ে তাকাচ্ছে।
চিরঞ্জীব চলে গেল। কিন্তু পরস্পরকে ছেড়ে যাবার কথাটা আর ওরা বলল না। কারণ, সমাজের চোখে যত হেয় হোক, ওটুকুই বোধ হয় ওদের মূলধন।
চিরঞ্জীব চলে যাবার পর দুর্গা বলল, গুলি যাস না যেন! না বললেও গুলি যেত না! আজ তার দুর্গাদিকে দেখার বড় কৌতূহল। সে শুধু দেখেছে, দুর্গাদি চিরোদার কোলে মুখ রেখে শুয়ে আছে। আর চিরোদা দুর্গাদির গায়ে হাত রেখেছে। ও দেখাটা নতুন বটে। কিন্তু না-দেখা আরও কিছু অনুভব করেছে গুলি ওর মন আর বয়স দিয়ে। আজ তাই দুর্গাদিকে ওর দেখতে ইচ্ছে করছে।
দুর্গা বাইরে এসে বলল, এখানেই খাবি। কয়লার উনুনটা নিয়ে আয় তো এদিকে। পাতাগুলোন সব ভেজা। কাঠের ঝামেলাও পোয়াব না আজ। খানকয়েক ঘুঁটে দিয়ে, কয়লাই জ্বালাব। তাকিয়ে আছিস কী? যা।
আজ দুর্গার গুলিকেও লজ্জা। গুলির দিকেও যে ভাল করে তাকানো যায় না যেন। আর গুলির মনে হল, দুর্গাদিকে এত সুন্দর কোনওদিন দেখেনি সে। কয়লার উনুনটা নিয়ে এল গুলি দাওয়ার কাছে।
দুর্গা ঘুঁটে কুচিয়ে দিতে দিতে বলল, ভাত বসিয়ে আমি একটুখানি বেরুব। তুই থাকবি, বুঝলি? ভাতটা ফুটে গেলে নামাতে পারবিনে?
বলে তাকাতে গিয়েও চোখ নামাল দুর্গা। গুলি যেন কেমন হাবাগোবার মতো তাকিয়ে আছে।
গুলি বলল, কোথায় যাবে?
–বেদোর ওখেনে যাব একবারটি।
শ্মশানে?
তা কী হয়েছে? শুনিসনি, পাড়ায় অষ্টপোহর আবগারি পাহারা বসাবে। সব সময় চোখে চোখে রাখবে। বরং আজ রাতের মধ্যে আর আসবে না। তৈরি জিনিস পড়ে আছে বেদোর ঘরে। রাতভর ওর ঘরে জিনিস থাকলে কাল আর কিছু থাকবে না। দেবা-দেবী দুটিতে সব গিলে বসে থাকবে। রাত পোহাবার আগে যেন সব কবরেজের বাড়ি পৌঁছে দেয়, সে কথা বলে আসব।
গুলি আমতা আমতা করতে লাগল। সে একলা যাবে, এ কথা বলার সাহস তার নেই। সব জায়গায় যাওয়া যায়, কিন্তু শ্মশানে একলা? এ বোধহয় সে কোনওদিন পারবে না। বলল, একলা যাবে দুর্গাদি।
দুর্গা বলল, তা দোকলা পেলুম কবে রে? বেদোর ব্যাপার তো ছোটঠাকুর জানে না। আর শ্মশানে তো মানুষ একলাই যায়।
বলে ঠোঁট টিপে হাসল।
যদিও গুলির পরনে পায়জামা আর চুলে পানিফলের মতো ত্রিকোণ উচ্চতা, তবু তাকে বড় অসহায় মনে হল। বলল, তার চেয়ে এক কাজ করো না দুর্গাদি। উনুন ধরিয়ে, ঘরের মধ্যে ভাত বসিয়ে দাও। তারপরে চলো, আমিও যাই তোমার সঙ্গে।
দুর্গা ঠোঁট কামড়ে এক মুহূর্ত ভাবল। বলল, তা মন্দ বলিসনি। তা হলে আমি উনুন ধরাই। তুই একবার আশপাশটা পাক দে দেখে আয়। ভোলা-কেষ্টাকে তো বিশ্বেস নেই।
বলা মাত্র গুলি নিঃশব্দে মিশে গেল অন্ধকারে। দুর্গা উনুন ধরিয়ে চাল ধুতে ধুতে ওর ছেলেবেলার একটি গান গুনগুনিয়ে উঠল,
ও কুসুম লুকোবি কোথা।
ভোমরা আছে যথা তথা।
কিছুক্ষণ পর গুলি ফিরে এলে, ঘরে ভাত বসিয়ে শিকল তুলে, দুর্গা বেরিয়ে গেল। খালধারে এসে পাশে চলতে চলতে গুলি হঠাৎ বলল, জানো দুর্গাদি, চিরোদার মা কী করছে?
কী?
–চিরোদার জন্য সম্বন্ধ দেখছে, বে দেবে।
দুর্গা হঠাৎ কোনও কথা বলতে পারল না। যদিও হাসতে হাসতে একদিন চিরঞ্জীবও বলেছিল।
একটু পরে দুর্গা বলল, তা ছেলের বে দেবে না?
গুলি সে কথার কোনও জবাব না দিয়ে বলল, ওই যে সেই অশ্বিনী চাটুয্যে, চিরোদাকে তো কত গালাগাল দিত বামনাটা। সে নাকি রাজি হয়েছে তার মেয়েকে দেবে। বলেছে, ব্যাটাছেলে, চুরি করুক চোলাই করুক, কী এসে যায়। রোজগার থাকলেই হল। আর চিরঞ্জীবের মতো ছেলে সহায় থাকলে ভাবনা কী?
দুর্গা হঠাৎ বলল, তা এ সব আমাকে বলছিস কেন?
গুলি বলল, আমার রাগ হয় শুনলে।
–তোর রাগ হলে কী হবে? ছোটঠাকুর যদি বে করে চাটুয্যের মেয়েকে?
গুলি বলল, চিরোদা? একবার বলুক না তাকে। ওই মাকে সুদ্ধ চাটুয্যেকে বিদেয় করবে। চিরোদা যখন থাকে, তখন চাটুয্যে বাড়িতেই ঢোকে না।
দুর্গা চুপ করে রইল। কিন্তু তার চোখের সামনে চিরঞ্জীবের মুখখানি ভাসতে লাগল অন্ধকারে। বুকের মধ্যে কোথায় যেন ধিক্কার ধ্বনি শুনতে পেল দুর্গা। সে সহসা গুলির কাঁধে হাত রেখে, তাকে কাছে টেনে নিয়ে চলতে লাগল। বলল, বে যদি করেই, তাতে কী? তবু তো সেই ছোট্ঠাকুরই। এর বেশি বলতে লজ্জা করল।
গুলি ভেবেছিল দুর্গাদির মন খারাপ করে দিয়েছে সে। কিন্তু পরমুহূর্তেই অন্ধকারেও টের পেল দুর্গাদির মুখে একটি সুন্দর হাসি। দুর্গাদি যেন বাতাসে ভর করে চলেছে। দুর্গাদি তাকে কোনওদিন এমন আদর করে কাঁধে হাত দেয়নি। এমন করে একজন যুবতী মেয়ের নিঃসঙ্কোচ স্নেহ সে কখনও পায়নি! কোথায় যেন তার একটু অস্বস্তি লাগল। কিন্তু তার ভবঘুরে দুর্বিনীত-প্রায় কৈশোর উত্তীর্ণ মন আনন্দে ভরে উঠতে লাগল। তবু বুকের মধ্যে কেমন যেন টনটন করতে লাগল। গুলির মনে হল, ওর চোখে জল আসতে চাইছে।
একটু পরে গুলি বলল, আমি জানি, দুর্গাদি, চিরোদা তোমাকেই বে করবে।
দুর্গা হেসে উঠে বলল, তুই একটা মুখপোড়া। আমি জাতে বাগদি না?
গুলি বলল, হলেই বা। চিরোদা ও সব মানে না।
দুর্গা চুপ করে রইল। শুধু চিরঞ্জীবের মুখখানি দেখতে লাগল।
গুলি চুপ করে থাকতে পারছে না। হয়তো কোনও কারণ নেই। কিংবা কেন কথা বলছে, নিজেও ঠিক জানে না। আবার বলল, কিন্তু আমাদের খুব হুঁশিয়ার থাকতে হবে দুর্গাদি। পুলিশ আমাদের খুব পেছুতে লাগবে এবার।
–জানি।
সবাই আমাদের পেছুতে লেগেছে। ঠিক যেন সাঁড়াশির মতো ঘিরেছে আমাদের।
জবাব দেবার আগেই একটা চাপা শাসানি শুনতে পেল দুজনে। লক্ষ করে দেখল শ্মশানে এসে পড়েছে। কোনও চিতা জ্বলেনি। ঝুরিনামা বটের তলায়, বেদোর চালাঘরটাও অন্ধকার। শুধু একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠল। চারিদিক খোলা পেয়ে, বাতাস এখানে শোরগোল তুলে দিয়েছে।
দুর্গা চাপা গলায় ডাকল, বেদো-খুড়ো।
বেদোও কান খাড়া রেখেছিল। তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে বলল, কে মেয়ে নাকি?
–হ্যাঁ।
–আরে বাবা! এসো এসো!
দুর্গা কাছে এসে বলল, বাতি কোথায়?
–নেই! তেল ফুরিয়ে গেছে!
বলেই অন্ধকারে আঙুল দেখিয়ে বলল, এই, এই হারামজাদির জন্য।
দুর্গা বলল, কী হয়েছে, ধমকাচ্ছো কেন?
বেদো চাপা গর্জন করে বলল, ধমকাচ্ছি? ধরে বেঁধেছি মাগিকে। তোমাকে খবর দিতে গেছলুম, এসে দেখি উনি প্রাণ ভরে মাল খেয়ে চিত হয়ে পড়ে আছেন। ওই তক্কে তক্কে ছেল, আমি কখন বেরুব বুইলে? আর তেলের কথা মনে থাকে?
দুর্গার টেপা হাসিটা অন্ধকারে দেখা গেল না। বলল, তা ধরে বেঁধেছ কেন?
–বেঁধে গেলাচ্ছি। দেখি ও কত গিলতে পারে মদ। হা করবে না, তাই এই পেতলের হাতা লিয়েছি।
এতক্ষণে বেদোর ডোমনী ককিয়ে উঠল, অই গো মেয়ে, দেখো আমার কষ দে রক্ত বার করে দিয়েছে। ওই হাতার বাঁট দে আমার মুখ ফাঁক করে করে মদ ঢেলে দিচ্ছে। পায়ে ধরছি, তবু ছাড়ছে। না।
দুর্গা উদগত হাসি চেপে বলল, তা তুমিও যেমন। ও সব করতে যাওয়া কেন?
যদিও, দুজনেই সমান। পালটা শোধ এক সময়ে ডোমনীও নেবে। তবু আপাতত বেদোর রাগ থামাবার জন্য দুর্গার আর কিছু বলার ছিল না।
বউ কেঁদে উঠে বলল, এবারটি আমাকে ছেড়ে দিতে বলো। লইলে মরে যাব নিগ ঘাত।
বেদো হেঁকে উঠল, তো কি বাঁচবার জন্যে গেলাচ্ছি। এ মশানে এইছিস। আজ তোকে শোধ বিদেয় দেব।
দুর্গা বলল, তা আর এখন কোরো না। পুলিশের হাঙ্গামা খুব বেড়েছে। তুমি চলে আসার পর আবগারির বড়বাবু, ছোটবাবু, সব এয়েছিল আবার।
বেদো যেন একটু ঝিমিয়ে পড়ল। বলল, হ্যাঁ।
–হ্যাঁ শোনো, এই নাও বেলাডার। এই চারটিতে ভরতি করে, রাত পোহাবার আগেই দিয়ে আসবে কবরেজের বাড়িতে। আমার ওখেনে যেখন ত্যাখন যেয়ো না, বুঝলে? সব সময় পুলিশের নজর আছে।
বলেই দুর্গা বেরুবার উপক্রম করল।
বেদো ব্লাডারগুলি নিয়ে বলল, চলে যাচ্ছ?
–হ্যাঁ, ভাত বসিয়ে এসেছি।
গুলি এতক্ষণ কোনও কথা বলেনি। যাবার আগে খালি বলল, বুড়িকে যা খাইয়েছ খাইয়েছ, আর খাইওনি। নিজেও আর খেয়ো না। গন্ধে তো মাতিয়ে দিয়েছ শ্মশান।
বেদো তাড়াতাড়ি যুক্তি দিয়ে বলল, তা বললে হবে না বাবা গুলিরাম? মশানের গায়ে ও গন্ধ সবসময়ে লেগে আছে জানবে। কারণ কী, না—
দুর্গা বাধা দিয়ে বলল, খুড়ো, চুপ করো। খুড়িকে রান্না করতে দাও। তুমি বেরিয়ে পড়ো।
বলে, দুর্গা গুলি তাড়াতাড়ি খাল ধার ধরে এগিয়ে গেল।
গুলি বলল, সেটি হচ্ছে না। খুড়ো এখন কী করবে আমি জানি।
দুর্গা জানলেও, কৌতুকচ্ছলে হেসে বলল, কী করবে?
গুলি বলল, খুড়ি কাঁদবে। সামলাতে গিয়ে খুড়োও কাঁদবে খানিকক্ষণ, তারপর
কথা শেষ হবার আগেই দুর্গা হেসে উঠল খিলখিল করে। বলল, তা পরে দুজনেই আরও খানিকটে গিলবে।
গুলি তাড়াতাড়ি বলল, চুপ দুর্গাদি, কেউ শুনতে পাবে।
দুর্গা মুখে আঁচল চাপল। ডাকিনীর চেয়ে আজ দুর্গা রঙ্গিনী বেশি।
.
কিন্তু শুধু বাগদিপাড়া নজরবন্দি করে স্বস্তি বোধ করল না বলাই। কয়েক দিন পরেই সে একদিন অক্রূর দেকে ডেকে পাঠাল। এই ডেকে পাঠানোর মধ্যে নিজেকে ছোট মনে হল বলাইয়ের। অস্বস্তি হল। তবু তার তীব্র জেদ বাধা মানল না।
অক্রূর এল প্রায় ছুটতে ছুটতে। অক্রূর নয়, ওকুর। ওই নামেই তাকে মানায়। ফিনফিনে ধুতি হাঁটুর ওপরে। থপথপে মাংসল বুকটা হাট করে খোলা। শার্টের সোনার বোতাম শুধু পাটিতে লাগানো। এসে হাত জোড় করে, পোষা কুকুরের মতো হেসে বলল, ডেকেছেন স্যার?
এসেছে ভয়ে ভয়েই। কোথাও কোনও বিপদ-আপদ ঘটে বসে আছে কি না কে জানে। যদিও কোনও বিপদের সংবাদ সে পায়নি। আবার আশাও আছে মনে মনে, যদি এতদিনে বলাই সান্যালের সুমতি হয়ে থাকে। তা হলে হাত ভরে টাকা দেবে অক্রূর তাকে।
কিন্তু বলাই তাকে একবারও বসতে বলল না। ভাল করে ফিরেও তাকালে না। শুধু অখিলবাবু আর কাসেম অবাক হয়ে তাকিয়েছিল বলাইয়ের দিকে। কী জন্য অক্রূরকে ডাকা হয়েছে, এখনও কিছুই জানে না তারা।
বলাই বলল, হ্যাঁ, ডেকেছি। কথা আছে আপনার সঙ্গে।
ঘাড় কাত করে, বিগলিত হেসে বলল অজুর, বলুন স্যার। শোনামাত্রই এসেছি। কিন্তু স্যার, এর মধ্যে আমার কোনও মাল
–সেইজন্যে নয়।
বলাই বাধা দিল। তবে যে জন্যে ডেকেছে, সে কথা বলতে শুধু সঙ্কোচ নয়, লজ্জা হচ্ছে। তার নিজেকেই ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে! কার্যসিদ্ধির মধ্যেও কোথায় যেন একটা পরাজয়ের খোঁচা লাগছে। কিন্তু না বলে উপায় নেই।
সে ফাইলের থেকে চোখ না তুলেই বলল, দেখুন, আমি বললেও চোলাইয়ের ব্যবসা ছাড়তে পারবেন না। কারণ, যে গোরু একবার বিষ্ঠা খায়, সে আর তা ছাড়তে পারে না।
অক্রূর মাথা নিচু করে, হেসে বলল, কী যে বলেন স্যার!
বলাই অক্রূরের চোখের দিকে তাকাল। বলল, তা তো বটেই কথাটা সুবিধের লাগল না। কিন্তু একটা কথা রাখতে পারবেন।
বলুন স্যার।
–আমার কাছ থেকে তাতে কিন্তু আপনি একটুও উপকৃত হবেন না। আমি কোনওদিন আপনার কাছ থেকে ঘুষও খাব না। আপনার লোককে পেলেও ছাড়ব না। ভেবে দেখুন।
অক্রূর তেমনি কুঁজো হয়ে বলল, তা কি হয় স্যার! শত হলেও আইন বলে একটা জিনিস আছে দেশে! আপনি তো রক্ষে করছেন। আপনার মতো মানুষ কখনও ঘুষ খেতে পারেন? ও আমাকে কেউ তাঁবা তুলসী গঙ্গা
–থাক।
–অ্যাঁ?
বলছি থাক অতটা বলতে হবে না। কথাটা রাখতে পারবেন কি না, তাই বলুন।
–চেষ্টা করব স্যার।
বলাই বলল, মাসকয়েক এই চোলাইয়ের কাজ বন্ধ রাখতে পারবেন?
অক্রূর যেন বুঝতে পারেনি, এমনি বোকার মতো তাকিয়ে রইল।
বলাই আবার বলল, বুঝতে পারলেন না। আমি বলতে চাইছি, আপনারা সবাই সরে দাঁড়ান, চিরঞ্জীবকে একলা স্মাগল করতে দিন। আমার সুবিধে হবে।
অক্রূর তাড়াতাড়ি বলল, তা স্যার আপনার হুকুম নিশ্চয় পালন করব। তা ছাড়া, আপনার শাসনে ও-কারবারে তো একেবারে ঢিলে পড়েই গেছে।
রাগে ও অস্বস্তিতে, বিদ্রূপ করে বলল বলাই, তাই নাকি? কিন্তু এখন সুযোগ নিয়ে সেটা পরে আর জোরদার করতে পারবেন না। তা আমি দেবও না পারতে। একটা জিনিস বোঝেন তো, আপনাদের চেয়ে চিরঞ্জীবকে ধরাই মুশকিল বেশি।
অক্রূর বুঝল বলাইয়ের কথার অন্তর্নিহিত অর্থ। চিরঞ্জীবকে সামলাতে পারলে সবাইকে সামলানো যাবে। অক্রূরদের যে কোনওদিন ঢিট করা যায়। করা হয়েছেও অনেকখানি। তবে, অক্রূরের ফণা নেই, কিন্তু বিষ ছিল। সে-বিষ একটু না উগরে সে পারল না। বলল, যা বলছেন স্যার। অতবড় চোলাইকার আর এ তল্লাটে কখনও কেউ দেখেনি। তবে, সনাতন ঘোষকে স্যার কেউ কিছু করতে পারবে না। আপনাকেও তার ওপর থেকে মামলা তুলে নিতে হবে।
ছোবলটা ঠিক জায়গাতেই লাগল। বলাইয়ের বুকে কাটাঘায়ে নুনের ছিটার মতো জ্বলে উঠল। কথাটা সত্যি কিন্তু অপমানকর। সেই বিস্ময়কর চিঠিটার কথা কোনওদিন ভুলতে পারবে না বলাই। খুব সাধারণ চিঠি, তাতে কোনও বড় জায়গার ছাপ ছিল না। একটি নাম সই যথেষ্ট ছিল। চিঠির বক্তব্য ছিল, শাসনের আওতায় সবাইকে রাখার চেষ্টা কোরো না, কারুর কারুর সঙ্গে মিলে মিশে আলোচনা করে, পরস্পরের মধ্যে একটা মিতালির আবহাওয়া সৃষ্টি করে নিতে হবে। পাবলিক কোর্টের সামনে তাদের হাজির না করে, সব সময়ে নিজেদের মধ্যে মিটমাট করা উচিত। নিজেদের লোক সম্পর্কে তোমার অবহিত হওয়া উচিত। এটা নীতি। পত্রটি সনাতন ঘোষের হাত দিয়েই পাঠালাম, কিছু মনে কোরো না। তোমাদের কর্তার সঙ্গে তোমার বিষয়ে আমি আলাপ করব। পত্রটি পড়ে ফিরিয়ে দিয়ো, এই অনুরোধ।
পত্র পড়ে স্তব্ধ আড়ষ্ট হয়ে বসেছিল বলাই। সেই মুহূর্তে তাকে ভাবতে হয়েছিল, হয় চাকরি রাখা, অন্যথায় চিঠিটা হস্তগত করে, নিজের কাজ চালিয়ে যাওয়া। এবং নিশ্চয় বরখাস্তের জন্য অপেক্ষা করা। শুধু বরখাস্ত নয়, তার সঙ্গে আরও কিছু ঘটা অসম্ভব নয়।
একটি চকিত মুহূর্তের জন্য বোধহয় শক্ত হয়ে উঠেছিল বলাইয়ের মন। কিন্তু সেটা বিবেকের কথা। পরমুহূর্তেই সে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। নিজেকে তার মনে হয়েছিল, একটা মারখাওয়া খাঁচা বদ্ধ জীব। খাঁচাটা জীবন ধারণের। চিঠিটা সে ফিরিয়ে দিয়েছিল সনাতন ঘোষের হাতে। বিজয়ী সনাতন ঘোষ যাবার সময় খালি বলেছিল, আমার মামলাগুলো তুলে নেবার চেষ্টা করবেন বলাইবাবু। যখন দরকার পড়বে, আমাকে ডাকবেন যে-কোনও কারণে, যখন খুশি।
মামলা তুলতে হয়েছিল। কোনওদিন ডাকেনি বলাই সনাতনকে। সেইদিন থেকে মনে মনে স্থির করেছে, আগে চিরঞ্জীব, তারপর সাধারণ লোক লেলিয়ে দিতে হবে ওই সনাতনের ওপর। কারণ, তাকে ধরার অধিকার পুলিশের নেই। কিন্তু সনাতনকে সে রেহাই দেবে না। আইনের আশ্রয় নিয়ে সনাতনকে ধরা যাবে না। আজ যেমন সে ভাবছে, সবাইকে সরিয়ে ফাঁদের মধ্যে একলা চিরঞ্জীবকে এনে ফেলবে, ঠিক তেমনি করে সনাতনকে ধরার কথা ভেবেছিল। সবাইকে দূরে রেখে, একলা সনাতনকে বিচরণ করতে দেবে সে। তারপর সাধারণ মানুষের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবে। সাধারণ মানুষকে লেলিয়ে দিতে হবে ওর বিরুদ্ধে।
–আর জীবনে বোধ হয় এই একটি ব্যাপার, পত্রটির বিষয় মলিনাকে কখনও বলতে পারেনি বলাই। তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল শুধু আবগারি ইনস্পেক্টর সুরেশবাবুর মুখ। সুরেশবাবুর পরিণতিটা যেন এই শাসনতন্ত্রের একটি স্বাভাবিক ছন্দ।
অক্রূরের কথায়, রাগে ও ঘৃণায় জ্বলে উঠল বলাই। বলল, সে বিষয় আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনি তা হলে আমার প্রস্তাবে রাজি আছেন?
অক্রূর তেমনি বিগলিত বিস্ময়ে বলল, আপনি যেমন বলবেন স্যার। তবে যদি অনুমতি দেন, একটা কথা বলব?
কী?
–চিরো বাঁড়ুজ্জেকে আপনি জেলা খারিজ করে দিন না।
এক মুহূর্ত থমকে বলাই বলল, কী লাভ। আপনারা কণ্টকশূন্য হতে পারেন, কিন্তু চিরঞ্জীবের কীসের টান আছে এখানে? কিছু না। সে যেখানে যাবে, সেখানেই চোলাই করবে, স্মাগল করবে। তাকে আমি দেশছাড়া করতে চাইনে, অপরাধ বন্ধ করতে চাই। তা ছাড়া, ওকে তাড়িয়ে দিলে মেয়েটার কী হবে?
অক্রূরের যেন বিষম লাগল। সে অবাক হয়ে বলল, আজ্ঞে কী বললেন স্যার? বলেই বুঝতে পারল, বলাইয়ের কথাটা ঠিক পুলিশের মতো হয়নি। চিরঞ্জীবের অভাবে দুর্গার কী হবে, সে দুশ্চিন্তা বলাইয়ের করার কথা নয়। নিজের অজান্তেই কথাটা বেরিয়ে গিয়েছে তার।
কিন্তু অক্রূর কথাটাকে ঠিক, ধুলো থেকে চিনির টুকরো তুলে নেওয়া পিঁপড়ের মতো তুলে নিল। তাড়াতাড়ি আবার বলল, অ সেটা ঠিক বলেছেন স্যার। মেয়েটার মাথার ওপরে কারুর থাকা দরকার। আমার বাড়িতে নিয়ে যাব স্যার মেয়েটাকে। আগেও অনেকবার বলেছি স্যার
–কিন্তু যেতে চায়নি মেয়েটা, না?
বলাই অক্রুরের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল। অক্রূর একটু থতিয়ে গিয়ে হাসল। বলল, হ্যাঁ স্যার।
বলাই বললে, শুনুন, আপনাদের বাড়ি-ঘর-দোর নানান ব্যবসা আশেপাশে আছে। জেলা খারিজ যদি করতে হয়, আপনাদের মতো লোককেই আমি করব। তাতে ফল হবে।
অক্রূর করুণ গলায় বলল, আজ্ঞে?
-হ্যাঁ, চিরঞ্জীবকে জেলা খারিজ করে আমার কোনও লাভ হবে না। তবে আপনাদেরও করতে চাইনে আমি। তা হলে, আজ থেকে ওই কথা রইল। কাজ বন্ধ থাকবে, কেমন?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
এবার আসুন।
অখিলবাবু আর কাসেমের দিকে একবার তাকিয়ে, বলাইকে নমস্কার করে চলে গেল অক্রূর।
বলাই জিজ্ঞেস করল কাসেমকে, কী মনে হল কাসেম। অক্রূর কথা রাখবে?
কাসেম বলল, রাখতে পারে। চিরঞ্জীবকে যদি ঘায়েল করা যায়, সেই আশায়।
কিন্তু স্বস্তি পেল না বলাই। তার কপালে কতকগুলি সর্পিল রেখা ছড়িয়ে রইল জালের মতো। কিন্তু ওপরে মলিনার কাছে যেতে তার ইচ্ছে করল না। ঘুরেফিরে মলিনাও এই প্রসঙ্গেই আসবে। একটু বাঁকিয়ে, ঠোঁটের কোণে হেসে জিজ্ঞেস করবে, কী, নতুন কোনও ফাঁদ পাতলে নাকি? এ ক্ষেত্রে বলাইয়ের পরাজয়-ই মলিনার কাম্য। মলিনা ভুলে যায়, সে আবগারি অফিসের বাড়িতে বাস করে। সে একজন ইন্সপেক্টারের স্ত্রী। সে নিজের মন দিয়ে, নিজের জগৎ দিয়ে বিচার করে। মনে করে, বলাই এই সমাজ ও শাসনের কিছু বোঝে না। মলিনা সহজ বোঝে। বোঝে শুধু ভালবাসাবাসি। সংসারের একমাত্র নিরিখ। কষ্টিপাথর। সেইটুকু বুঝি বলাইয়েরও পরম ভাগ্য। কিন্তু প্রত্যহের তিক্ত কুটিল জটিলতা সে বোঝে না।
তবু এখন ওপরেই যেতে হবে। হাতঘড়িতে সময় দেখে বলল সে কাসেমকে, যে মামলা তিনটে আছে, তাদের মালগুলো বার করে রাখো। আমি কোর্টে যাব। অখিলবাবু বিমলাপুর পর্যন্ত একটা টহল দিয়ে আসবেন। বিনয় কোথায়?
কাসেম বলল, নিল্লায় গেছে একটা কেসের সংবাদ পেয়ে।
বলাই বেরিয়ে গেল। কাসেম দেয়ালে ঝোলানো, বড় চাবির গোছাটা তুলে নিয়ে বলল, কই, কিছু বললেন না ছোটবাবু?
অখিলবাবু বললেন, বলার দরকার নেই কাসেম। আমি জানি ও ছুঁড়িকে না ধরতে পারলে চিরঞ্জীবকে ধরা যাবে না কোনওদিন। দেখি, আমিই সে চেষ্টা করব।
কাসেমের সুরমা টানা চোখের চাউনিটা তীক্ষ্ণ হল। কুঁচকে উঠল চোখের কোল। বেশ কয়েক বছর একসঙ্গে থেকেও এমন সন্দেহ কোনওদিন হয়নি তার অখিলবাবুর সম্পর্কে। কিন্তু কয়েকদিন ধরে কাসেম অনুভব করছে, ছোটবাবুর মনে একটি ফুল ফুটেছে। সে ফুল দুর্গা। মনে মনে সে বলেছে, ই-আল্লা! তাজ্জব! খোদার মর্জির কোনও তল নেই নাকি? আত্মীয়স্বজনহীন বিপত্নীক প্রায় বুড়ো ছোটবাবুর নজর শেষে ওখানে গিয়ে ঠেকল! বড় বেকায়দার জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে।
সে চাবিটা নিয়ে মালখানার দিকে এগুল। মালখানাটা এই প্রকাণ্ড বাড়ির এক অন্ধকার মহল। লোকে বলে, সেকালের জমিদারের কোর্টঘর আর জেলখানা ছিল এই মহলে। অচেনা মানুষ হলে একলা আসতে ভয় পেত। রাতে অবশ্য পালা করে পাহারা দিতে হয়। কারণ, মালখানা থেকে মাল চুরি হয়ে গেলে, কোর্টে প্রমাণ করা যাবে না।
কাসেম থমকে দাঁড়াল। ঝনাৎ করে শব্দ হল তার চাবির গোছায়। বলল, ওখানে কে?
মালখানায় যাবার সুদীর্ঘ বারান্দার দুপাশেই ঘর। তারই এক অন্ধকার কোণ থেকে আবির্ভূত হল ভোলা আর কেষ্ট। মুখে পোষা জন্তুর হাসি, চোখে একটা অপ্রস্তুতের ভাব।
ভোলা ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, আমরা চাচা।
কাসেম দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, শালা! তোদের না ছোটবাবু চব্বিশ ঘণ্টা বাগদিপাড়ায় থাকতে বলেছে।
কেষ্ট বলল, সারাদিন তো থাকি চাচা। এখন সব রান্না খাওয়ার সময়, তাই একটু চলে এয়েছি।
কাসেম ভেংচে বলল, কেন এয়েছ?
ভোলা-কেষ্টকে যেন কেউ কাতুকুতু দিয়েছে, এমনি ভাবে তারা হাসতে লাগল।
কাসেম বলল, বাঃ! বাঃ!
ভোলা-কেষ্টর হাসি তাতে আরও বাড়ল। কাসেম চাবির গোছাটা সুদ্ধ হাত তুলে খেঁকিয়ে উঠল, চোপ! চোপ্! মস্করা করতে এয়েছ কাজ ফেলে? ঠিক খেয়াল আছে, এ সময়ে মালখানা খোলা হবে। আর দুটিতে এসে ঘাপটি মেরে আছ? ডাকছি ছোটবাবুকে।
ভোলা বলে উঠল, পায়ে পড়ি চাচা।
কেষ্ট বলল, হ্যাঁ চাচা পায়ে পড়ি। ছোটবাবুকে ডেকো না। তোমার সঙ্গে খালি একটু ঢুকব আর বেরুব।
–খালি ঢুকবে আর বেরুবে? কেন, ঠাকুর আছে মালখানার মধ্যে?
আবার দুজনে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠল।
কাসেম মালখানার দরজার দিকে যেতে যেতে বলল, ও সব কিছু হবে না বলে দিলাম। কোনও কিছুতে হাত দিবি তো হাত মুচড়ে ভেঙে দেব।
দরজা খুলল সে মালখানার। একটা তীব্র গন্ধ আর একটা ভিন্ন জগৎ। অনেক উঁচুতে মোটা মোটা লোহার রড-গাঁথা দুটি গবাক্ষ। সেই আলোয় প্রায় সবটাই দেখা যায়। আর কোনও জানালা নেই। দরজাও মাত্র একটিই।
প্রথমেই চোখে পড়ে রাশি রাশি ব্লাডার। টিউবও কম নয়। তা ছাড়া তরকারির ঝাঁকাতে ব্লাডার আর টিউব আছে। তরকারি অনেকদিন শুকিয়েছে। ব্লাডার-টিউবে পড়েছে ছাতা। ফুটো হয়ে গলে গলে পড়ছে মদ। স্যুটকেশ, ট্রাঙ্ক, ঝুড়ি, মাটি আর ধাতুর হাঁড়ি, কেরোসিনের টিন, ছোট বড় মাঝারি শত শত বোতল। সবই বে-আইনি ধরা-পড়া মদের পাত্র। নিঝুম, মদের নেশায় বুঁদ অসাড় মালখানা-ঘরটায় কোনও সাড়াশব্দ নেই। কেবল গবাক্ষ দিয়ে ঢোকা বাতাসের চাপা ফিসফাস। ইঁদুর কখনও আসে না। এ ঘরে সাপের কোনও প্রশ্নই নেই। যদিও সাপের পক্ষে একদিক থেকে আদর্শ আশ্রয় এই প্রায়ান্ধকার ঘরটা। কিন্তু গন্ধেই তাকে পালাতে হবে।
শুধু নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠল ভোলা আর কেষ্টর। চোখের চাউনি বদলে গেল। ভোলা বলল, দুগগার রস আছে মালখানায়।
কেষ্ট বলল, হ্যাঁ বাঁকা বাগদির মেয়ের রস।
দুজনে রক্তাভ চোখ তুলে শত শত ব্লাডার টিউব বোতল আর ঝাঁকাগুলির দিকে তাকায় অনুসন্ধিৎসু চোখে।
কাসেম হাঁক দেয়, অই ছুঁচো, ধর এটা। দরজার কাছে রাখ।
তিনটি বোতল-সুদ্ধ একটি চটের থলি এগিয়ে দিল সে।
ভোলা হুকুম পালন করল যন্ত্রের মতো। কিন্তু তার নজর অন্য দিকে। নাকের পাটা ফুলিয়ে নিশ্বাস টেনে টেনে দুজনেই ব্লাডারের গায়ে হাত বোলাতে থাকে। যেখানে ব্লাডারের গা বেয়ে মদ চুইয়ে পড়ছে, সেখানে আঙুল ঘষে ঘষে, শোঁকে। পরস্পর দুজনেই চোখাচোখি করে হাসে। চাপা হিসহিস শব্দে হাসে।
–এই শালারা, ধর এটা।
গুটিতিনেক মাটির হাঁড়ি, মুখে-মুখে পর পর সাজানো। তিনটের মধ্যেই তিনটি মদ ভরতি ব্লাডার। হাঁড়িগুলি দিয়ে, সে এগিয়ে গেল একটা টেবিলের দিকে। টেবিলের ওপরে ছিল একটি বড় মাটির টব। টবে ছিল গাঁজা গাছের ছোট ছোট চারা। ধরা পড়েছে দিন কুড়ি আগে। যদিও বলাইয়ের নির্দেশে জল দেওয়া হয় রোজ, তবু গাছগুলির মরো মরো অবস্থা। আজ কোর্টে দিন পড়েছে এ কেসের। টবটা তুলে নিয়ে এসে, কাসেম হাঁক দিল, আয়, বেরিয়ে আয়।
ভোলা আর কেষ্ট তখন আঙুল দিয়ে নেড়ে নেড়ে পোকা দেখছে। মদের পোকা, সাদা সাদা, প্রায় কেঁচোর মতো মোটা কিন্তু ছোট ছোট।
ভোলা বলল, মালের বাচ্চা।
কেষ্ট বলল, মালেরও খোকা-খুকু হয়।
আর ওদের দুজনেরই মনে হল, সমস্ত চোলাই মদের পাত্রগুলির ওপরে যেন মহারানির মতো বসে আছে দুর্গা। সেই যেমন বসেছিল ন্যাড়া কালীতলায়।
কাসেম আবার ধমক দিল। এই, আসবি? না তালা বন্ধ করে যাব?
ওরা দুজনে করুণ চোখে তাকাল কাসেমের দিকে।
কাসেম খেঁকিয়ে বলল, শালারা দোজাখের ভূত। নে, যা এগিয়ে গিয়ে ডান দিকের ঝাঁকা থেকে একটা ব্লাডার তুলে খেয়ে নে।
কিন্তু ওরা একটা বিশেষ ঝাঁকার কাছে দাঁড়িয়েছিল। বলল, এ ঝাঁকাটা তুলব চাচা?
–কেন, ওতে কী?
ভোলা বলল, এটা বোধহয় দুগগার হাতের রস।
কেষ্ট বলল, মানে, মনটা বলছে আর কী।
কাসেম বলল, ওঃ, দুগগার হাতের রস না হলে ভাল লাগে না বুঝি? খচ্চরের জানু। মরবি ওই করে। নে, খেয়ে নে, খা।
কাসেমের মুখের ওপরে রুক্ষতা থাকলে, ভিতরে একটা নরম দিক আছে ভোলা-কেষ্টর জন্য। হুকুম পাওয়া মাত্র ভোলা একটা ব্লাডারের মুখ খুলে চুমুক দিল। তার শেষ না-হতেই কেষ্ট টেনে নিয়ে চুমুক দিল। পরস্পর টানাটানি করে যেন অমৃত পান করতে লাগল।
ব্লাডার চুপসে আসবার আগেই কাসেম ধমকে বলল, রাখ এবার রেখে দে। খালি ব্লাডার কোর্টে প্রডিউস হবে নাকি? ব্লাডার রেখে দিয়ে দরজার কাছে এগিয়ে চলে দুজনেই। পেছন ফিরে তাকাল আর একবার। তারপর দরজার বাইরে গেল। কিন্তু তাদের চেহারা ও চাউনি বদলে গেছে কয়েক মিনিটের মধ্যেই। তারা টলে না, যেন নিশ্বাসও নেয় না। পাথরের মূর্তির মতো স্থির।
কাসেম দরজা বন্ধ করে ফিরে তাকাল ওদের দিকে। কোমরে হাত রেখে বলল, তারপর?
কেষ্ট বলল, মোটা নির্ভীক গলায়, তাপরে আর কিছু নয় চাচা। এই দুগগার জন্যে এখনও আছি।
–কোথায়?
ভোলা বলল, এ লাইনে।
কেষ্ট বলল, হ্যাঁ। দুগগাকে ধরবার জন্যে।
এখন ওদের গলা মোটা কিন্তু স্পষ্ট। ভোলা বলল, হ্যাঁ, ওকে একদিন ধরব, তা’পরে চলে যাব অন্য দেশে।
কাসেম যে একজন বাঘা আবগারি জমাদার, সেটা বোধহয় এ সময়েই ভোলে। যেন খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, একদিন ধরলেই হবে? ব্যস?
কেষ্ট বলল, হ্যাঁ, একদিন।
কাসেম বলল, কী ধরবি? মদ ধরবি, না ওকে ধরবি, কোনটা?
ভোলা বলল, ওই যা বলো, ওকেই ধরব আসলে।
কাসেম বলল, হুঁ। সকলেরই লজর দেখছি ওই ছুঁড়ির দিকে। তা তোরা এ্যদ্দিনেও পারলি নে। এবার
কেষ্ট বলে উঠল, ছোটবাবু চেষ্টা পাচ্ছেন চাচা।
ভোলা বলল, দেবী পায়ে কত গণ্ডা মুণ্ডু বলি যায়। আর একখানা বাড়ল।
কাসেমের যেন কেমন অস্বস্তি হয়। তীব্র চোলাই মদের গন্ধ, আর খালি গা, সদ্য মদ-খাওয়া এই দুটি মূর্তি। দুপাশে ঘর এই গলি বারান্দাটা যেন নরকের সুড়ঙ্গ। সে বলে উঠল, নে, নে, মালগুলোন হাতে নিয়ে চল।