বাঁকিপুরের মস্তান
হাওড়া-বর্ধমান কর্ড লাইনে মির্জাপুর বাঁকিপুর নামে একটি স্টেশন আছে। স্টেশনের একদিকের প্ল্যাটফর্ম মির্জাপুরে এবং অপরদিকেরটি বাঁকিপুরে। অনেকদিন আগের কথা, বাঁকিপুরের এক মেছ্নি মির্জাপুরের হাটে যেত মাছ বিক্রি করতে। তখন এসব জায়গা ছিল ঘন বনজঙ্গলে ভরা। মেছুনির নাম নিস্তারিণী। খুব দুর্দান্ত মহিলা এবং অসমসাহসী বলে ব্যাপক পরিচিতি ছিল তার। একা একা রাতভিত দূর-দূরান্তরে যাওয়াটা তার কাছে কোনও ব্যাপারই ছিল না। তা হাট থেকে ফিরতে নিস্তারিণীর একটু রাত হয়ে যেত। তখনকার দিনে গ্রামেঘরে সন্ধেরাতই তো অনেক রাত। সেই রাতে মাথায় মাছের শূন্য ঝুড়ি আর হাতে আঁশবঁটি নিয়ে গ্রামে ফিরত নিস্তারিণী।
মির্জাপুর বাঁকিপুর পাশাপাশি গ্রাম হলেও দূরত্ব ছিল অনেকখানি। আর ওখানে তখন হাট বসত বিকেলের দিকে। তা ফেরার সময় রাতের অন্ধকারে নিস্তারিণী প্রায়ই শুনতে পেত ছায়া ছায়া কালো কালো কারা যেন বলছে, “এই মাছ দেঁ না।”
ওরা যে কারা তা নিস্তারিণী বেশ ভালভাবেই জানত। কিন্তু ভয়ডর বলে তো কিছু ছিল না ওর, তাই বলত, “মাছ খাওয়ার শখ হয়েছে, মাছ খাবি? তা আমার নাম নিস্তারিণী। বাঁকিপুরের ডাকসাইটে মেয়ে আমি। দেখছিস হাতে কী? এই আঁশবটি দিয়ে নাক কান কেটে ছেড়ে দেব। দূর হ!”
“দেঁ না রে। রাঁগ করিস কেন! খুব খেতে ইচ্ছে করছে।”
“খেতে ইচ্ছে করছে তো পুকুরে যা। অনেক মাছ পাবি। আমার টুকরিতে কি মাছ আছে যে দেব?”
“পুঁকুরে তো জাঁল ফেলা হয়েছে। যদি জঁড়িয়ে যাই।”
“তবে চুলোর দোয়ারে যা। ভাগ!”
অবশেষে পালাত সব।
আর নিস্তারিণী গজগজ করতে করতে বাড়ি ফিরত। “মর মর হতচ্ছাড়ারা। জ্বালিয়ে খেলে। সারা রাস্তাটা মাছ দে, মাছ দে, যমের বাড়ি যা।”
নিস্তারিণীর মুখে সব কথা শুনে সকলে বলত, “আর কেন পিসি? তিন কুলে কেউ তো নেই তোমার। কী দরকার ওইরকম বিপদের ঝুঁকি নিয়ে আসতে যাওয়ার? একটু বেলাবেলি ফিরলে তো পারো। গ্রামেঘরে থাকি আমরা। ভূতের উপদ্রবে তো জ্বলেপুড়ে মরছি। জেনেশুনে ওদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রোজ ওইভাবে আসবার দরকারটা কী? একটু বেলাবেলি এসো এবার থেকে।”
নিস্তারিণী বলল, “তাই কি হয় রে বাবা! বেলাবেলি ফিরব বললেই কি ফেরা যায়? সব মাল বেচতে বুচতেই তো সন্ধে কাবার। তারপর দুটি মুড়ি মিষ্টি কিনে একটু জলটলও তো খেতে হবে। কাজেই রাত হয়।”
কথাটা সত্যি। যার যা কাজ তাকে তা করতেই হয়। আর ফেরবার সময় এ-পথে আসার সঙ্গীও কেউ থাকে না। কাজেই একা একাই ফিরতে হয়।
সেদিনও হাটবার ছিল। নিস্তারিণী রাতের অন্ধকারে একা একা ফিরছিল হাট থেকে। আজ একটা ছোট রুইমাছ বেঁচে গেছে তার। কাজেই মনটাও বিশেষ ভাল ছিল না। আসার পথে বনের ভেতর শুরু হল উপদ্রব “ওঁরে কে আছিস, দেখবি আয় পিসি আজ আমাদের জন্য মাছ এনেছে।”
নিস্তারিণী রেগে বলল, “আয়, নিবি আয়। এই আঁশবঁটি দিয়ে যদি না তোদের নাক-কান কেটে দিই তো কী বলেছি।”
কিন্তু বললে কী হবে? কে কার কথা শোনে?
চারদিক থেকে সবাই এসে ছেঁকে ধরল নিস্তারিণীকে। সবাই একজোট হয়ে বলল, “আঁজ আর তোঁকে ছাঁড়ছি না পিসি। রোঁজ ফাঁকি দিয়ে চলে যাস। আঁজ তোকে মাছ দিতেই হবে।”
নিস্তারিণী বলল, “দিতে তো কোনও আপত্তি নেই। তবে তোরা যে ভারী বদ। তোদের হাতে মাছ দিলেই তো তোরা আমাকে মেরে ফেলবি।”
“না না মাঁরব না। ভঁয় নেই।”
“ঠিক বলছিস?”
“হ্যাঁ, ঠিক বলছি। মাছ দে।”
“তা হলে একটু এগিয়ে গিয়ে ওই ওইখানটায় দাঁড়া।” বলামাত্র অশরীরী ছায়াগুলো এগিয়ে গিয়ে সেইখানে দাঁড়াল। নিস্তারিণীও এক-পা দু’ পা করে এগিয়ে চলল।
“কঁই দে?”
“আর একটু এগিয়ে যা।”
ছায়ারা আরও এগিয়ে গেল।
“এঁবার দে।”
“আঃ। এত তাড়া কেন? বলছি তো দেব। রেললাইনটা পেরিয়ে ওপারে যা, ঠিক দেব।” “ঠিক দিবি তো? তুই কিন্তু অনেকক্ষণ থেকেই দেঁব দেঁব করছিস কিন্তু দিচ্ছিস না।”
“এবার ঠিক দেব!”
ছায়াগুলো এবার লাইন পেরিয়ে বাঁকিপুরের জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল। নিস্তারিণীও লাইন পার হয়ে এপারে এল। এইভাবে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে শুঁড়িপথ বেয়ে খানিকটা যেতে পারলেই গ্রামে গিয়ে পৌঁছবে। অতএব আর একটু যদি ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় ওদের তা হলে চেঁচামেচি করে লোকজন ডেকে তাড়ানো যাবে এবারের মতো। কিন্তু না। নিস্তারিণী যা ভাবল তা হল না। আর যাওয়া গেল না। ততক্ষণে গাছের কাঁচা ডাল ভেঙে বাঁশগাছ নুইয়ে পথ বন্ধ হয়ে গেছে।
নিস্তারিণী বলল, “এ কী! এইভাবে পথ আটকালি কেন? বনের ভেতরে সাপখোপ কোথায় কী আছে, তোদের কি কাণ্ডজ্ঞান নেই? তার চেয়ে আমার বাড়িতে চল! ভাল করে মাছ রেঁধে খাওয়াব তোদের।”
অমনই উত্তর এল, “আমরা রান্না করা মাছ খাঁই না পিসি। ওঁই মাছ তুই এখানেই দেঁ। যদি না দিস তাঁ হলে জেনে রাখিস আজই তোর শেষ রাত।
নিস্তারিণী বুঝল আজ সত্যিই তার নিস্তার নেই। কেননা যেভাবে মরণফাঁদে আটকেছে ওরা তাতে এই ঘেরাটোপ থেকে কোনওমতেই প্রাণ নিয়ে পালাতে পারবে না সে। আজ ভূতের হাতেই মরতে হবে তাকে। নিস্তারিণী তখন হঠাৎ একটু চেঁচিয়ে বলতে লাগল, “চারদিকে এত ভূত কিন্তু আমাদের এই বাঁকিপুরের কি কেউ কোথাও মরে ভূত হয়ে নেই গো। আমি একজন অসহায় স্ত্রীলোক। মির্জাপুরের ছ্যাঁচ্চোড় ভূতগুলো এসে আমাকে একা পেয়ে বাঁকিপুরের মাটিতে দাঁড়িয়ে ভয় দেখাচ্ছে। আর তোমরা বাবারা এটাকে মেনে নেবে? তোমরা কি কেউ আমাকে সাহায্য করবে না? এটা তো তোমাদেরও মান ইজ্জতের ব্যাপার। তোমরা থাকতে আমি বেঘোরে মরব?”
সঙ্গে সঙ্গেই হইহই করে উঠল কারা, “কেঁ! কেঁ ডাকে আমাদের? কেঁ গাঁ।”
“আমি বাঁকিপুরের নিস্তারিণী। এই দেখ না বাবারা মির্জাপুরের ছ্যাঁচড়া ভূতগুলো এসে আমাকে কীরকম জ্বালাতন করছে।”
“ওঁ। আঁমাদের নিস্তারপিসি? তোঁমাকে ভয় দেখাচ্ছে মির্জাপুরের ভূতেরা। দাঁড়াও মজা দেখাচ্ছি।” বলেই বাঁকিপুরের ভূতেরা অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে মির্জাপুরের ভূতেদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর সে এক রীতিমতো খণ্ডযুদ্ধ। বাঁকিপুরের ভূতেরা বলল, “চাঁলাকি পেয়েছিস তোঁরা? বেঁপাড়ার ভূত এ পাঁড়ায় এসেছিল রঙবাজি করতে? আঁমরা কোনওদিন ভুলেও পিসিকে ভয় দেখাইনি। আঁর তোদের এত সাহস যে আমাদের পিসিকে তোরা ভয় দেখাস! ভূত ভূতের মতন থাকবি, মানুষের পেছনে লাগা ·কী রে? আর কোনওদিন যদি এই তল্লাটে তোদের দেখেছি তো মেরে হাড় গুঁড়িয়ে দেব। তোদের চেয়েও সংখ্যায় আমরা অনেক বেশি। আমরা যদি সবাই গিয়ে এবার দলে দলে তোদের মির্জাপুরে ঢুকি তো এই অঞ্চল ছেড়ে পালাতে পথ পাবি নে তোরা। বুঝলি?”
বলার সঙ্গে-সঙ্গেই তো মির্জাপুরের ভূতেরা দৌড় দৌড় দৌড়।
বাঁকিপুরের ভূতেরা বলল, “তা নিস্তার পিসি, এবার তুমি নিশ্চিন্ত মনে ঘরে যেতে পারো। যা শিক্ষা দিয়েছি ওদের ওরা আর কখনও তোমাকে জ্বালাতন করবে না।” এই বলে সবাই মিলে হাতাহাতি করে গাছের ডালপালা সরিয়ে নোয়ানো বাঁশ খাড়া করে পথ পরিষ্কার করে দিল পিসির। নিস্তারিণীও এবার নিশ্চিন্ত মনে ঘরে ফিরে এল।